রজনীকান্ত সেন : জীবন ও গান

রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজ্যেশ্বর মিত্র দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের জন্য কোনো প্রচেষ্টা স্বভাবতই আমাদের মনোভাবের মধ্যে নেই, সংগীত সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রযত্ন যে আরো কম হবে, বলাই বাহুল্য। আজ রজনীকান্তকে 888sport app download for android করে দুঃখের সঙ্গে এই কথাটাই মনে পড়ছে।’ (বাংলার গীতিকার ও বাংলা গানের নানা দিক, রাজ্যেশ্বর মিত্র, জিজ্ঞাসা) জীবিতাবস্থায় রজনীকান্তের গানের ছটা যেভাবে মোহিত করেছিল তাঁর পরিপার্শ্বকে, মৃত্যুর পর তা স্তিমিত হয়েছিল অচিরেই। চিরন্তন যা কিছু তার স্থায়িত্ব ডুবে গিয়েও ভেসে থাকে – এই সত্যকে প্রমাণ করেছে তাঁর গান। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর গান গীত হচ্ছে, তাঁর গানের চর্চা তাঁকে এবং তাঁর সময়কে জানার আগ্রহ তৈরি করেছে সংগীতবোদ্ধা, 888sport live chatী ও শ্রোতাদের মধ্যে। তাঁর গান এখন প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে, অনুষ্ঠানে গাওয়া হচ্ছে যা রজনীকান্ত তাঁর জীবিতাবস্থায় দেখে যেতে পারেননি।

রজনীকান্ত তাঁর সমগ্র জীবন কাটিয়েছেন কলকাতার নাগরিক সংস্পর্শ থেকে দূরে। জন্মেছিলেন সিরাজগঞ্জের সেন বংশের সচ্ছল এক যৌথ পরিবারে। সে-সময় সিরাজগঞ্জ ছিল পাবনার অন্তর্গত একটি মহকুমা। তাঁর বাবা ছিলেন সাবজজ আর জ্যাঠা ওকালতি করতেন রাজশাহীতে। শৈশবে দশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবন কেটেছে নির্বিঘেœ। জ্যেষ্ঠদের আকস্মিক অকালমৃত্যু পরিবারে নিয়ে আসে বিপর্যয়। রাজশাহীর যে-কুঠিতে পারিবারিক বিপুল অর্থ রাখা ছিল তা হঠাৎ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় তাদের ওপরে নেমে আসে অভাবিত আর্থিক বিপর্যয়। পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করে আইন পড়ে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। এর মধ্যে মাত্র আঠারো বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয়। সংসার-সন্তান সব মিলিয়ে ঈশ্বর-বিশ্বাসী নীতিবাদী যুবক রজনীকান্ত আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সৎপথে থেকে জীবিকা অর্জন করতে। তাঁর সরলতা, সত্যবাদিতা, নীতিবাদ ওকালতি পেশার জন্য উপযুক্ত ছিল না। যে ছলচাতুরী, বাক্পটুতা ও কূটকৌশল এই পেশায় প্রয়োজন তিনি ছিলেন তা থেকে দূরে। এ-কারণে ওকালতি পেশায় তাঁর সাফল্য আসেনি। আর্থিক বিপন্নতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।

রজনীকান্তের গানের মধ্য দিয়ে যে-মানুষটির ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তিনি পরম ঈশ্বরনিষ্ঠ, ভগবৎপ্রেমে কাতর আত্মতুষ্ট একজন মানুষ, প্রচারবিমুখ না হলেও আকাক্সক্ষার তীব্রতায় আচ্ছন্ন হননি কখনো। কিন্তু জীবনে যে বহুমুখী অভিজ্ঞতা থাকলে সৃষ্টিশৈলীতে অভিনবত্ব, বৈচিত্র্য আসে, রজনীকান্তের জীবনে সেই অভিজ্ঞতার অভাব ছিল।

সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত রজনীকান্তের দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কিংবা অতুলপ্রসাদ সেনের মতো পারিবারিক ঐতিহ্য, সাংগীতিক পরিম-ল, পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং সংগীতের অভিজ্ঞতা কোনোটাই ছিল না। যেমন সাধারণ ছিল তাঁর জীবন, তাঁর গানের বাণীময় কাব্য, তেমনি সংগীতে সুরপ্রয়োগের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সাধারণ। তাঁর গানে রাগসংগীতের প্রয়োগ থাকলেও রাগমিশ্রণের বাহুল্য বা ছন্দের কারুকার্য নেই। নেই তানের চমক। তাঁর গান প্রার্থনার গান, নিবেদন ও সমর্পণের গান। আরো স্পষ্ট করে জানার জন্য রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর গান সম্বন্ধে যা বলেছেন সেটা একটু দেখে নিতে পারি। ‘রজনীকান্তের সুরের মূল বৈশিষ্ট্য রাগমিশ্রণের সূক্ষ্মতায় নয় – সুরের দিক থেকে তিনি খুব একটা কলাকৌশল সম্পাদনের দিকে যাননি, ভারতীয় সংগীতের বিভিন্ন ধারা নিয়ে যে তিনি পরীক্ষা করেছেন তাও নয় – তাঁর রচনায় তিনি এক অতি পবিত্র শান্তরসের সান্দ্র পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এই শান্তরসই তাঁর সংগীতের মূল আবেদন। সংগীতের দিক থেকে এই অকৃত্রিম সরল-শান্তরস পরিবেশন করা খুব সহজ কাজ নয়। বস্তুত, এই সহজ জিনিসটা আসলে বড়ই শক্ত।

সরল-সহজ জীবনযাপন করা শক্ত, 888sport live footballের এবং 888sport live chatের ক্ষেত্রেও সহজ এবং সরল রচনা সুকঠিন ব্যাপার। তেমনি সংগীতের ক্ষেত্রেও একটি সহজ-সরল এবং সুন্দর রচনা দুর্লভ। যে-কোনো বিদ্যায় বিশেষ দক্ষতা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে একটি সুন্দর, সরল এবং স্বাভাবিক সৃষ্টি হয় না। রজনীকান্ত তাঁর সুগভীর রসবোধ থেকে এই সুন্দর সংগীত সৃষ্টি করেছেন। দুঃখ, শোক, আকুলতা, 888sport apk download apk latest version, সমর্পণ – প্রতিটি বিচিত্র অনুভূতি দিয়ে গড়া তাঁর সুর হৃদয়ের গহন থেকে স্বতঃউৎসারিত হয়ে এসেছে এবং তাঁর স্বচ্ছ, সরল, সুন্দর গতি শ্রোতাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে স্নিগ্ধ রসাবেশে চিত্তকে শান্তিতে নিমগ্ন করে দিয়েছে। তাঁর সুরের এটিই মূল কথা।’ (বাংলার গীতিকার এবং বাংলা গানের নানাদিক, রাজ্যেশ্বর মিত্র, জিজ্ঞাসা)

রজনীকান্তের গানের সহজ-সরল স্বাভাবিক সৌন্দর্যের কথা বললেও রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর গানে গভীরতার অভাবের কথা বলেননি। মুক্তগলায় প্রাণের আনন্দে গান গাইতে ভালোবাসতেন। শ্রোতা আছে কি নেই সে-ব্যাপারেও তাঁর ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কণ্ঠ যখন রুদ্ধ, বাক্শক্তি স্তব্ধ, তখনো তাঁর গানের আবেগ থেমে থাকেনি। হাত দিয়ে গান রচনা করেছেন, হারমোনিয়াম বাজিয়ে পুত্র-পরিজনদের দিয়ে তাঁরই পুরনো কোনো সুরে বাঁধা গান তাঁর নির্দেশে গেয়ে শুনিয়েছেন তাঁরা। কলকাতার সমঝদার শ্রোতাদের কাছে তাঁর গান না পৌঁছালেও রাজশাহীর ধনী জমিদাররা ছিলেন তাঁর গানের গুণগ্রাহী শ্রোতা। 888sport live chatী হিসেবে রজনীকান্ত পেয়েছেন এঁদের আনুকূল্য। কিন্তু সংগীতের যে-শ্রোতা পেলে তাঁর গানের ভুবন হতে পারত আরো উন্নত, তেমন শ্রোতা তিনি পাননি। রজনীকান্তের মধ্যে একটি শিশুমন লুকিয়ে ছিল। সেই মনটি শৈশব পেরিয়ে আর সাবালক হতে পারেনি। যখনই যে তাঁকে ডেকেছে, তাৎক্ষণিক গান রচনা করে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। এটাই বোধহয় ছিল তাঁর বড় দুর্বলতা। শুভ পরিণয় থেকে শুরু করে ধনী ব্যক্তির জামাতা বিয়োগ – যে-কোনো উপলক্ষই হোক না কেন, রজনীকান্তের গান রচনায় কোনো দ্বিধা কিংবা সংকোচ ছিল না। গান রচনা করেছেন, সে-গান গেয়ে আত্মতৃপ্তির আনন্দে ভেসেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা, সুর দেওয়ার মধ্যে ক্ষমতার প্রকাশ থাকলেও গভীরতার উপলব্ধি থাকে না। চরম আস্তিক্যবাদের সঙ্গে তাঁর জীবনবোধে যুক্ত হয়েছিল চরম আত্মতৃপ্তি। এই আত্মতৃপ্তি তাঁর গানে বিষয়বৈচিত্র্য কিংবা গভীরতার স্বাদ আনতে পারেনি।

গানপাগল মানুষটি জীবনের সঙ্গে গানকে যুক্ত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর স্বভাবের সরলতা তাঁকে কোনোদিন এই জাগতিক বিশ্বের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট করেনি, গান গেয়ে আত্মতৃপ্তির আনন্দে ভেসে যাওয়া রজনীকান্ত নিজের ভেতরে থাকা স্ববিরোধিতার সন্ধান পাননি।

রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদের সমসাময়িক গীতস্রষ্টা হয়েও নিজেকে রজনীকান্ত ভক্তি-ভাবের গ-ির মধ্যে বন্দি করে রাখলেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না। মফস্বলের ক্ষুদ্র গ-ির মধ্যে বন্দি থাকায় তাঁর মন হয়তো পাখা মেলতে পারেনি দূর আকাশের অসীম নীলে। কলকাতার নাগরিক সমাজের সান্নিধ্যে আসতে পারলেন না। রাজনীতির যে-উত্তাপ তখন ছড়িয়ে পড়ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে কলকাতায়, তার সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেননি তিনি। মফস্বলের শান্ত, স্থির জীবনে রজনীকান্ত এমন কোনো বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হননি, যা তাঁর জীবনকে নাড়া দিতে পারত, তাঁর গানে আনতে পারত অভিনবত্ব, বৈচিত্র্য। ঘটনাবিহীন জীবন, সমঝদার শ্রোতাবিহীন সংগীত, চরম আস্তিক্যবাদ তাঁর দৃষ্টি-মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তাই সবখানেই তিনি চিরবন্ধু করুণানির্ঝরের উপস্থিতি উপলব্ধি করেছেন। বলেছেন – ‘সুন্দর তব সুন্দর সব, যেদিকে ফিরাই আঁখি।’ একজন 888sport live chatস্রষ্টার জন্য এই অনুভব তাঁর সৃষ্টির পথে সীমাবদ্ধতা তৈরি করে। সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়। সত্যিকারের 888sport live chatীর মধ্যে নিরন্তর অস্থিরতা আর অপূর্ণতার বোধ কাজ করে। সৃষ্টিকর্মের ভেতর দিয়ে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ভেতরে কাজ না করলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রসারিত হয় না। রজনীকান্ত নিজেকে ভাঙলেন না, ভাঙতে ভাঙতেই নিজেকে গড়ে নিতে পারতেন নতুনভাবে, নতুন করে। 888sport live chatীর জীবনে তো ভাঙাগড়ার খেলাই চলে।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে রজনীকান্ত নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর জীবন ‘ক্ষুদ্র, বৈচিত্র্যহীন এবং নীরস’। এই আত্মোপলব্ধিই তো তাঁকে জীবনের বৈচিত্র্যের সন্ধান দিতে পারত। তা হলে আমরা তাঁর কাছ থেকে ভক্তিগীতির অতিরিক্ত আরো নানা ধরনের গানের স্বাদ পেতাম। তাঁর সমসাময়িক গীত-রচয়িতারা সংগীতে

পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলা সংগীতকে যখন আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, রজনীকান্ত সেই মিছিলে শামিল হয়েও পিছিয়ে রইলেন। রজনীকান্তের জীবন ও গান বিষয়ে বলতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন – ‘ভক্তের অন্তরে যদি বিশ্বাসের চিরনির্ভর গভীরতা থাকে, তবে জাগতিক কোনো ব্যথা বেদনা অপমান তাকে কী করে স্পর্শ করবে? অথচ যথার্থ বড় 888sport live chatীর মধ্যে আত্মবিরোধ আর অস্থিরতা থাকে। থাকে অপূর্ণতার বোধ আর সেই সঙ্গে দুঃখ পেরোনোর অনপনেয় উদ্যম। দেখার প্রগাঢ় দৃষ্টি থাকলে ফোটা ফুলের প্রমত্ত বসন্ত সম্ভারে বসেও মনে আসতে পারে শুকনো – পাতাঝরা – ফুলের খেলায় বিচিত্র কারুণ্যের বার্তা।’ (‘কান্তগীতি আর অতুলপ্রসাদের গান’, সুধীর চক্রবর্তী, শারদীয়া আনন্দবাজার ১৪২০) দেখার সেই প্রগাঢ় দৃষ্টি না থাকার জন্যই কি আমরা তাঁর কাছ থেকে প্রকৃতি, প্রেম পর্যায়ের গান পেলাম না! প্রেম পর্যায়ে তিনটি গান থাকলেও প্রকৃতি বিষয়ে একটিও গান তাঁর নেই। অথচ প্রকৃতির যে অপরূপ সৌন্দর্য, রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্য দিয়েই তো আমরা তা দেখতে শিখেছি। স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন অসাধারণ সব স্বদেশ পর্যায়ের গান, দ্বিজেন্দ্রলাল মঞ্চনাটকের জন্য রচনা করে গেছেন নাটকের গান, রজনীকান্ত তাঁর 888sport live chatীজীবনের ব্যাপ্তি কিংবা বিস্তারের জন্য নিষ্ঠার যে ঐকান্তিকতা এবং চর্চিত অনুশীলন প্রয়োজন তার কথা ভাবেননি। তাঁর সমসাময়িক গীতরচয়িতারা বিভিন্ন বিষয় – প্রেম, প্রকৃতি, মিলন, বিরহ বিষয়ে গান লিখেছেন, সে-গানকে টপ্ খেয়াল, লচ্চা ঠুংরির নিজস্ব ঢংয়ে পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বাংলা গানের নতুন আঙ্গিক, নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন, রজনীকান্ত তাঁর গানে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারেকাছেও যাননি। তাঁর সব গানই লোকসংগীত এবং বাউল গানের সুরে বাঁধা। রাগাশ্রয়ী গানও আছে তাঁর। তবে রাগের ব্যবহারে খুব যে অসাধারণত্ব আছে তাও নয়। তাঁর কিছু গানে ছন্দ ও সুরের সুন্দর সমন্বয় ঘটেছে যেমন – ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’, ‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে তুমি অভাগারে চেয়েছো’ – রাগাশ্রয়ী এসব গান গীতস্রষ্টা হিসেবে তাঁর ক্ষমতাকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি তাঁর রচিত এমন অনেক গান আছে যা ভাবের আবেগেই কেবল রচিত হয়েছে। ‘… রজনীকান্তর জীবন-পরিক্রমায় তেমন কোনো চমক বা সাহসের প্রবণতা আমরা দেখি না। সেজন্যই তাঁর বেশিরভাগ গান নির্মাণের আকুলতা আর ভাবের গরিমায় ভরপুর, কিন্তু সেই অনুপাতে সৃষ্টির তাপে ও শৈলীতে অভিনব নয়।’ (‘কান্তগীতি আর অতুলপ্রসাদের গান’, সুধীর চক্রবর্তী, শারদীয়া আনন্দবাজার ১৪২০)

সহজ, সরল, সাদাসিধে জীবনে শান্তি খুঁজে নিয়েছিলেন রজনীকান্ত। জীবনে যে দুঃখ, শোক, আর্থিক বিপন্নতার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে সেসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগীতের মধ্য দিয়েই তিনি প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছেন ঈশ্বরের কাছে। যন্ত্রণাকাতর জীবনের শেষমুহূর্তে লিখছেন –

আমায় সকল রকমে কাঙাল করেছে,

গর্ব করিতে চূর।

যশ ও অর্থ মান ও স্বাস্থ্য সকলি করেছে দূর।

ঐগুলো সব মায়াময় রূপে

ফেলেছিল মোরে অহমিকা কূপে

তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছ দীন আতুর

আমায় সকল রকমে কাঙাল করিয়া

গর্ব করেছ চূর।

ঈশ্বর তাঁকে সব রকমে কাঙাল করলেও তাঁর প্রতি তিনি প্রতিবাদী হতে কিংবা একটিও কঠিন শব্দ কখনো উচ্চারণ করতে পারেননি। ঈশ্বর যে তাঁর কাছে কতটা দয়ালু, চিরনির্ভর সেটা বোঝানোর জন্য তিনি গানের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি বিশেষণের পর বিশেষণ ব্যবহার করে গেছেন। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা, ঈশ্বর যে পরম দয়ালু, তাঁর বিশ্বব্রহ্মা-ে কখনো যে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটতে পারে না এ-বিশ্বাসে তিনি অটল ছিলেন। অথচ জীবনে যত দুঃখ তিনি পেয়েছেন তাতে তাঁর ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা, তা না করে আরো নিবিড়ভাবে তিনি তাঁকে আঁকড়ে ধরেছেন।

মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে গলায় কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে নিদারুণ দুঃখ-শোক সহ্য করার পর তাঁর মৃত্যু হয়। রজনীকান্তের জীবন ছিল দুঃখ-শোক আর রোগ-ব্যাধিতে জর্জরিত। কঠিন অসুখে যখন শয্যাশায়ী, বাক্রুদ্ধ, তখনো গান তাঁকে ছেড়ে যায়নি। হৃদয়ে ছিল গভীর ঈশ্বর-বিশ্বাস, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়ে যাইব তোমার রসাল নন্দনে’ এ-গানের রচয়িতাকে চিনতে যেমন কষ্ট হয় না, তিনিই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কণ্ঠরুদ্ধ অবস্থায় গান লিখছেন, ঈশ্বরের কাছে আকুল প্রার্থনা তাঁর একবারের জন্য কণ্ঠশক্তি ফিরিয়ে দেওয়ার, যাতে আরো একবার তিনি তাঁর দয়ালকে গান শুনিয়ে যেতে পারেন। এ থেকে যে-মানুষটিকে আমরা পাই তিনিই বলতে পারেন –

তোমারি দেওয়া প্রাণে, তোমারি দেওয়া দুঃখ,

তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব।

তোমারি দুনয়নে, তোমারি শোকবারি,

তোমারি ব্যাকুলতা, তোমারি হা হা রব।

তোমারি দেওয়া নিধি, তোমারি কেড়ে নেওয়া।

ঈশ্বরের প্রতি চিরনির্ভরতা ব্যক্তিজীবনের শোক-দুঃখকে ভুলিয়ে রাখার শক্তি হয়তো তাঁকে দিয়েছিল। পুত্রশোককে ঈশ্বরের দান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কোনো অভিযোগ ছিল না। উপরোল্লিখিত গানটি তাঁর তৃতীয় পুত্রের অকালমৃত্যুর পর (ভূপেন্দ্রনাথ) তিনি রচনা করেছিলেন।

রজনীকান্ত এবং অতুলপ্রসাদ দুজনেই তাঁদের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনে শান্তি খুঁজেছেন সংগীতের মধ্যে। অতুলপ্রসাদের তেষট্টি বছরের জীবনের বেশিরভাগই কেটেছে বাংলা থেকে দূরে লখনৌয়ে, তাঁর দ্বন্দ্ববিক্ষুব্ধ ব্যক্তিজীবন গানের মধ্য দিয়ে জীবনের দুঃখভার উন্মুক্ত করে দিতে চেয়েছে, তাঁর গানে তাঁর ব্যক্তিজীবনের ছায়া গভীরভাবে পড়েছে। অতুলপ্রসাদের গানে কান্না আছে, আছে একাকিত্বের বেদনা। তাঁর গান হয়ে উঠেছে আমাদেরও গান। আমাদের ব্যথা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বের মুহূর্তে তাঁর গান আমাদের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। অতুলপ্রসাদের গানে তাঁর দুঃখভারাক্রান্ত জীবন আর ঈশ্বরপ্রেমের ছায়া একইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর গানে যে গভীর অনুশীলন এবং চর্চিত নিষ্ঠার পরিচয় আমরা পাই রজনীকান্তের গানে তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। তাৎক্ষণিক আবেগে তৈরি করেছেন এমন গান, যার সুর নিয়েছেন কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো অতুলপ্রসাদের গান থেকে। অন্যের গানের সুরে নিজের গান যে বাঁধা যায় না, বাঁধা উচিত নয় তাঁর শিশুসুলভ মনের সরলতা এ-কথা তাঁকে ভাবতে শেখায়নি। ভাবের আবেগে গান রচনা করেছেন, সে-গান গেয়ে আনন্দ পেয়েছেন এবং আত্মতৃপ্তিতে ভেসেছেন।

রজনীকান্ত এবং অতুলপ্রসাদ দুজনেই ছিলেন দুরকমে ভাগ্যহত। রজনীকান্তের স্বল্পায়ু জীবন ছিল শোক-দুঃখ আর

রোগ-ব্যাধি জর্জরিত, আর্থিক অনটনে বিপর্যস্ত, তাঁর গান ‘দুঃখ, শোক, আকুলতা 888sport apk download apk latest version, সমর্পণের গান’, সে-গানের সুর শ্রোতার মনে শান্ত-স্নিগ্ধতার ছোঁয়া এনে দিলেও জীবিতকালে তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মান, সমাদর পাননি। পাননি সমঝদার শ্রোতার সহযোগিতা, যারা পারতেন তাঁর গান প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রচার করে তাঁকে মরমি 888sport live chatী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। অতুলপ্রসাদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তাঁর ব্যক্তিজীবন বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে আঘাতে আঘাতে, সেই আঘাতের ছায়া পড়েছে তাঁর গানে। তাঁর গানের করুণ আবেদন শ্রোতার হৃদয় স্পর্শ করলেও জীবিতাবস্থায় তিনিও পারেননি প্রচারের আলোয় আসতে। এই দুজন গীতস্রষ্টা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন – ‘দুই রকমে ভাগ্যহত এই দুই বাঙালি স্রষ্টা তাঁদের জীবিতকালে যথাযথ সমাদর ও গায়নবৃত্ত পাননি, তাই শ্রোতাও জোটেনি তেমন ব্যাপক 888sport free betয়। দু’চারজন আত্মীয়-পরিজন আর ঘনিষ্ঠ গুণগ্রাহীরাই তাঁদের গান পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু প্রচার করেননি দিকে দিকে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। গণমাধ্যম ও নবপ্রযুক্তির সহায়তা তো পানইনি।’ (‘কান্তগীতি আর অতুলপ্রসাদের গান’, সুধীর চক্রবর্তী, শারদীয়া আনন্দবাজার ১৪২০) একই সময়ে রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর গান, গানের সংরক্ষণ স্বরলিপি প্রণয়ন, প্রচার এবং সুরের বিকৃতি রোধে সতর্ক এবং সাবধানি হয়েছেন, তাঁর সমসাময়িক গীতরচয়িতারা তাঁদের গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন করে কিছুই ভাবেননি। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের গানের চর্চা, জীবনসাধনা এবং সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা বাড়লেও এখনো তাঁরা অনেকটাই অপরিচয়ের অন্ধকারে আছেন। প্রত্যাশিত প্রচারের আলোয় আসতে না পারার পেছনে কাজ করেছে তাঁদের গানের যথার্থ স্বরলিপির অভাব, জীবিতাবস্থায় তাঁরা সেটা করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ফলে অনেক গানের সুর হারিয়ে গেছে। গ্রামোফোন কোম্পানিগুলোতে তাঁদের পুরনো গানের যে রেকর্ড ছিল সেগুলোর খোঁজও কেউ করেননি। করা হলে তাঁদের গানের যথার্থ সুরের সঙ্গে সবার পরিচয় হতো। এমনকি তাঁরা কোনো শিষ্য তৈরি করে যাননি, যারা পরম্পরাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন আগামীর দিকে।

রজনীকান্তের সংগীত রচনা সম্পর্কে যে-বিষয়টি সবাই স্বীকার করেছেন তা হলো, তিনি সংগীত সৃষ্টির ক্ষেত্রে যে নিষ্ঠা এবং দক্ষতার প্রয়োজন সেটার কথা ভাবেননি। তাঁর গান দুঃখ, শোক, আকুলতা, 888sport apk download apk latest version, সমর্পণের গান হলেও রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর গানে যে দক্ষতা এবং অন্তর্দৃষ্টির কথা বলেছেন তার সঙ্গে সবাই একমত হতে পারবেন কি না জানি না। তাঁর গানে অন্তর্জগতের গভীর উপলব্ধির প্রকাশ আমরা পাই না। এ-কথাই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে রজনীকান্ত যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে তাঁর গান শোনান, তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন ‘অন্তর্জগৎ’ সম্বন্ধে সচেতন হতে। সহজ-সরল মানুষটির স্বভাবেই হয়তো অন্তর্মুখীনতা ছিল না। তাঁর গানের বাণীর বিপুল ভার সুরের মধ্য দিয়ে যে মুক্তি খুঁজে পায়নি সে-ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন না। 888sport app download apk এবং গান, কবি এবং গীতিকারের সৃষ্টিশৈলীর মধ্যে যে-পার্থক্য সে-ব্যাপারে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল না। ‘বাণী’, ‘কল্যাণী’, ‘অভয়া’য় সন্নিবিষ্ট তাঁর 888sport app download apkগুলো নীতিকথাবহুল, সেগুলো গান হয়ে উঠতে পারে কি না ভেবে দেখার বিষয়। তারপরও তাঁর গান ‘দেশের মানুষের ভালো লেগেছিল বাণীর সারল্য, ভক্তিবিশ্বাসের ঐকান্তিকতা আর সহজ-সাধারণ সুরকাঠামোর জন্য – কোনো গভীর অন্তর্নিবিষ্ট সাংগীতিকতার বোধদীপ্তি তাতে অনুপস্থিত ছিল।’ রজনীকান্তের গান সেদিনের মতো আজো যে একইভাবে মানুষকে আবিষ্ট করে তার কারণ তাঁর গানের শান্ত-স্নিগ্ধ করুণ আবেদন, অসহিষ্ণু আর অস্থিরতার এই সময়ে যে-প্রশান্তি আমরা পেতে চাই, তাঁর গানে আমরা তা পেয়ে যাই। লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে বারবার তাঁর গান শুনতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে। শুনতে শুনতে থমকে ভাবতে হয়েছে যিনি ‘আমি স্বপনে তাহারে’ কিংবা ‘মধুর সে মুখখানি’র মতো গান রচনা করতে পারলেন তিনি কেন বাঁধা পড়ে থাকলেন ভক্তিগীতির নিরবচ্ছিন্ন ভাবের মধ্যে?

রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত এবং অতুলপ্রসাদ – এই চার গীতরচয়িতা সংগীত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলা গানে আধুনিকতার স্বাতন্ত্র্যের সূচনা করে গেছেন। এর মধ্যে রজনীকান্ত ছিলেন সব থেকে স্বল্পায়ু। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবন তাঁর (১৮৬৫-১৯১০)। স্বল্পায়ু এই জীবন সৃজনশীলতা বিচারের এক বড় মাপকাঠি। রবীন্দ্রনাথের আশি বছরের জীবন আর দুই হাজারের মতো গান, দ্বিজেন্দ্রলালের বিভিন্ন আঙ্গিকে রচিত পাঁচশো গান, পঞ্চাশ বছরের জীবন আর অতুলপ্রসাদের তেষট্টি বছরের জীবনে ২০৮ খানি গানের সম্ভার, এর পাশে রজনীকান্তের সহজ-সরল ভক্তিগীতির শান্ত-স্নিগ্ধতা যেন অনেকটাই মøান। কী প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর গান গাইবার আর গান শোনানোর! মৃত্যুর অনিবার্যতার কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে তাঁকে। অসুস্থতার যন্ত্রণা যত বেড়েছে, অসহ্য সেই যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর কাব্য রচনা থেমে থাকেনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও কাব্য রচনা করে গেছেন। এ-সময়ে রচিত তাঁর কাব্যগুলো হলো – ‘অভয়া’, ‘অমৃত’ ও ‘আনন্দময়ী’। জীবন এবং গান সমান্তরাল চলে। রজনীকান্তের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সৃজনশীল মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা ছায়া ফেলে তাঁর সৃষ্টিকর্মে। রবীন্দ্রনাথের গানে ধরা আছে তাঁর জীবনের ভালোলাগা, ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষার আভাস। তাঁর গানের মনোযোগী পাঠ কিংবা মনোময় পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তাঁকে অনেকটাই বোঝা যায়। মধ্যবিত্ত মানসিকতায় লালিত রজনীকান্ত শান্ত-সুখী দাম্পত্য জীবন, পুত্র-পরিজন নিয়ে জীবনযাপন, ঈশ্বরের প্রতি অগাধ আস্থা, নিত্যবন্দনা আর গান রচনার তাৎক্ষণিক তৎপরতায় মগ্ন থেকে এ-কথা ভাবতে পারেননি যে, সৃষ্টিকর্মের ভেতর দিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়াই একজন সৃষ্টিশীল 888sport live chatীর ধর্ম। শুধু ঈশ্বরপ্রেমের আকুলতার মধ্যে মগ্ন না থেকে বৃত্ত ভেঙে যদি তিনি বেরিয়ে আসতে পারতেন হয়তো তাঁর গানের ভুবন হতে পারত আরো বিস্তৃত, আরো বৈচিত্র্যময়।

এ-কথা তো ঠিক, রজনীকান্তের গান আধুনিক বাংলা গানের ভিতটাকে মজবুত করেছে। বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে নিজস্বতায়, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। ১৮৬১ থেকে ১৮৭১, এই দশ বছরের মধ্যে বাংলায় যে-চারজন প্রতিভাবান গীতস্রষ্টা জন্মেছিলেন তাঁরা তাঁদের মিলিত সাধনা এবং সংগীত সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গড়ে দিয়ে গেছেন বাংলা গানে আধুনিকতার বিচিত্র স্বাতন্ত্র্য। এঁদের প্রত্যেকের গান রচনার স্বকীয়তা, নিজস্বতা, গান রূপায়ণের ধরন ছিল আলাদা, কেউ কারো মতো নন, প্রত্যেকেই আলাদা। একই সময়কালে বিস্তৃত ছিল তাঁদের কর্মজীবন, গান ছিল তাঁদের প্রত্যেকের প্রিয়, বলা যায় তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন গানের মানুষ। বাংলা গানের চলমান যে-ধারা তাকে ধারণ করেই তাঁরা তাঁদের নিজের নিজের সৃষ্টির প্রকাশপথ তৈরি করে নিয়েছিলেন। তাঁদের গানের মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয়েছে তাঁদের জীবন উপলব্ধির দর্শন। রজনীকান্ত তাঁর সমসাময়িক গীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল ও অতুলপ্রসাদের মতো আমাদের সংগীতজগতে মরমি স্রষ্টা হিসেবে অভিষিক্ত হয়ে আছেন। বাংলা সংগীতে তাঁর সম্মানিত স্থানটি নির্ধারিত হয়েই আছে।

শেষ করব রজনীকান্ত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে। মৃত্যুর আগে রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে হাসপাতালে এসেছিলেন। বাক্শক্তি হারানো রজনীকান্ত হাত দিয়ে লিখলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর গভীর 888sport apk download apk latest versionর কথা। মৃত্যুপথযাত্রী রজনীকান্তকে দেখে বোলপুরে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – ‘সেদিন আপনার রোগশয্যার পার্শ্বে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর তাহাকে আপনার সমস্ত অস্থিমাংস স্নায়ুপেশী দিয়া চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াও কোনমতে বন্দী করিতে পারিতেছে না, ইহাই আমি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম। … কণ্ঠবিদীর্ণ হইয়াছে, কিন্তু সঙ্গীতকে নিবৃত্ত করিতে পারে নাই; পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে মøান করিতে পারে নাই। … সছিদ্র বাঁশীর ভিতর হইতে পরিপূর্ণ সঙ্গীতের আবির্ভাব যেরূপ, আপনার রোগক্ষত বেদনাপূর্ণ শরীরের অন্তরাল হইতে অপরাজিত আনন্দের প্রকাশও সেইরূপ আশ্চর্য। … ঈশ্বর যাহাকে রিক্ত করেন তাঁহাকে কেমন গভীরভাবে পূর্ণ করিয়া থাকেন, আজ আপনার জীবন-সঙ্গীতে তাহাই ধ্বনিত হইতেছে ও আপনার ভাষা-সঙ্গীত তাহারই প্রতিধ্বনি বহন করিতেছে।’

 

তথ্যসূত্র

১. বাংলার গীতিকার ও বাংলা গানের নানাদিক, রাজ্যেশ্বর মিত্র, জিজ্ঞাসা।

২. ‘কান্তগীতি আর অতুলপ্রসাদের গান’, সুধীর চক্রবর্তী, শারদীয়া আনন্দবাজার ১৪২০।