রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চল

আবদুশ শাকুর
নিশিকান্তকাণ্ড
আমার মতে গুরুদেব গুরু অন্যায়টি করেছেন তাঁর নয় বৎসরের জ্যেষ্ঠ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক এবং দায়বদ্ধ সমাজ-সংস্কারক ডক্টর নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৫২-১৯১০) প্রতি। সামাজিক অন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে সাহসী সংগ্রামী এই শিক্ষাব্রতী মানুষটিকে মূর্খতা ও প্রতারণার চিরস্থায়ী একটি লেবেল দিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। চিরস্থায়ী এজন্যে যে, এই লেখকের লেখামাত্রই চিরস্থায়ী। তার মধ্যেও অনৃতভাষটি লিখিত হয়েছে – বিশ্বময় তাঁর অন্যতম সমধিক পঠিত গ্রন্থ জীবন888sport sign up bonusতে।
অত্যন্ত অরুচিকর অসত্যটি কবি প্রথমে প্রবাসী পত্রিকায় ছাপান ১৯১১ সালে, তাঁর জীবন888sport sign up bonus ধারাবাহিক প্রকাশকালে। বর্ধিত দুঃখের বিষয়টি হলো, আগের বছরই ডক্টর চট্টোপাধ্যায় অকালমৃত্যু বরণ করেন। অপ্রত্যাহৃত অসত্যভাষ্যটি ১৯১২ সালে কবির জীবন888sport sign up bonusতে গ্রন্থিত, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এবং পরে তাঁর চিরস্থায়ী রচনাবলিতে সংকলিত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বদেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জনকারী অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটিকে চিরস্থায়ীভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে যান রবীন্দ্রনাথ। নেহাতই অরাবীন্দ্রিক এই দুঃখজনক বিষয়টি বিস্তারিত বিবৃত আছে এ-লেখকের ‘রবীন্দ্রনাথের চিরস্থায়ী গালমন্দ’ নামক দীর্ঘ 888sport liveে।
ইউরোপে প্রথম ভারতীয় পিএইচডি এবং প্রথম ভারতীয় অধ্যাপক হিসেবে বিশেষ 888sport apk download apk latest versionভাজন বাঙালিটিকে অপমান করে পরম শ্রদ্ধেয় বাঙালি কবিপ্রবরের প্রকারান্তরে নিজের ঢাক নিজে পেটানোর এই হাস্যকর প্রয়াস তাঁর অবিসংবাদিত স্বীকৃতি লাভের প্রতীক্ষায় ধৈর্য হারানোর বহিঃপ্রকাশ বলেই অনুমিত হয়।
অনুমানটির চূড়ান্ত প্রমাণ মেলে দুবছর পরে যখন নোবেল প্রাইজ পাওয়া উপলক্ষে তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে অমূল্য উপহার নিয়ে বঙ্গীয় সারস্বত সমাজের বুধমণ্ডলী ১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর কলকাতা থেকে স্পেশাল ট্রেন ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে আসেন তখন। সদ্য নোবেলজয়ী কবির অত্যন্ত রূঢ় প্রতিভাষণে মর্মাহত হয়ে অপমানিত অতিথিগণ অন্নগ্রহণ না করেই ক্ষুণœমনে কলকাতা ফিরে যান।
এর দুমাস আগে ২৯ সেপ্টেম্বর প্রবাস থেকে কলকাতায় ফিরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সবচেয়ে আপনজনদের মধ্যে ঝগড়াবিবাদের নানাবিধ বিবরণ শুনে ভীষণ বিরক্ত হন। অশান্তির সূচনা হয় বেলা-শরতের মতো মীরা-নগেন্দ্রও যখন কবির ইচ্ছানুসারে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসবাস শুরু করলেন। বিবাদ বেড়ে গেলে সন্তানসম্ভবা জ্যেষ্ঠকন্যা মাধুরীলতা জোড়াসাঁকোর পিতৃগৃহ ত্যাগ করে স্বামী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে চলে যান, এন্টালিতে। অতঃপর ১৯১৮ সালে ক্ষয়রোগে মৃত্যু পর্যন্ত রবীন্দ্র-পরিবারে আর ফিরে আসেননি বেলা, যোগাযোগও রাখেননি পিতার সঙ্গে – যদিও স্বামীকে নিয়ে জ্যেষ্ঠতাত জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রাঁচির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন (জীবন-888sport sign up bonus, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং 888sport app সামাজিক দায়িত্বও পালন করেছেন।
কন্যার এই অভিমানের প্রধান কারণ তাঁর স্বামীর প্রতি  মীরার  স্বামী  নগেন্দ্রনাথ  গঙ্গোপাধ্যায়ের  উদ্ধত  আচরণ  এবং এ-ব্যাপারে, একনাগাড়ে ষোল মাস প্রবাসে থাকা, পিতা ও ভ্রাতার নিরবচ্ছিন্ন ঔদাসীন্য। নগেন্দ্রর ঔদ্ধত্যের কারণ শ্বশুরের সর্বকর্তৃত্ব কনিষ্ঠ জামাতাটির ওপর সঁপে যাওয়া। পিতাপুত্রীর বিচ্ছেদের পর ১৯১৭ সালে বেলার ক্ষয়রোগ ধরা পড়লে, একই রোগে মেজো মেয়ে রেনুকাকে হারানোর হৃদয়বিদারক 888sport sign up bonus অভিমানী পিতাকে অভিমানিনী কন্যার রোগশয্যার পাশে নিয়ে যায়। কিন্তু বৃথা – কন্যার মান ভাঙেনি, বেলা বেঁচেও থাকেনি। (পৃ ৩৮৪-৩৮৬, রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৭)।
১৯১২ সালের, মানে আগের বছরের, নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথকে ব্যঙ্গ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা নাটিকা আনন্দবিদায়ের মঞ্চায়নের মাধ্যমে রবীন্দ্র-বিদ্বেষ প্রচারের শীর্ষ স্পর্শ করে। রবীন্দ্রবিরোধী দলটির এসব কীর্তিকাহিনি সবিস্তার জেনে অত্যন্ত তিক্তচিত্তে ১৯১৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন প্রত্যাবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নোবেল প্রাইজদানের সংবাদটি পান কবি এর দেড়মাস পরে, ১৪ নভেম্বরে।
সম্ভবত ডি.এল-দলেরই কাউকে কাউকে ১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর শান্তিনিকেতনের নোবেল-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মঞ্চের সামনে উপবিষ্ট দেখেই কবিগুরু তাঁর প্রাতঃ888sport app download for androidীয় আত্মসংযম হারান। সীতা দেবী তাঁর পুণ্য888sport sign up bonusর পাতায় লেখেন, কথা ছিল অভিনন্দনের উত্তরস্বরূপ কিছুকাল পূর্বে রচিত তাঁর ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’ গানটি গাইবেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু হঠাৎ মত পরিবর্তন করে কবি তাঁর চিরপরিচিত মেজাজের সঙ্গে একেবারেই বেমানান প্রতিভাষণটি দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসবটিকে নিজেই মাটি করেন।
অন্যকথায়, নোবেল 888sport app download bdে ভূষিত কবির বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমে বিষোদ্গারের সুযোগ করে দিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। নমুনাস্বরূপ, রবীন্দ্রভবনে মাইক্রো-ফিল্মে রক্ষিত একটি কর্তৃকা থেকে জনৈক হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করা যায় :
…কেন যে 888sport live footballজগতে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালকে লইয়া দুইটি দলের সৃষ্টি হইয়াছে, এখন তাহা বুঝিতে পারিতেছি। দ্বিজেন্দ্রলাল ছিলেন সরল স্বভাব; তিনি যাহা যখন মনে ভাবিতেন, সরলভাবে সর্বসমক্ষে তাহা প্রকাশ করিতেন; আর রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ে সর্পের মতো উৎকট গোপন হিংসা পোষণ করেন। এটা বোধ হয় তাঁহার ঋষিত্বের লক্ষণ। আমরা রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ পড়িয়া বিস্মিত ও মর্মাহত হইয়াছি। এরূপ অশোভনভাবে দেশের গণ্যমান্য মুখপাত্রগণকে অপমানিত করার অন্যায় স্পর্ধা যে, কোনো ভদ্র ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব এরূপ আমাদের বিশ্বাস ছিল না। (পৃ ৪৫১, রবিজীবনী, ষষ্ঠ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯৩)।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিধবাবিবাহ আন্দোলনহেতু (১৮৫৪-৫৫) সরকারের আইন প্রবর্তন (১৮৫৬) এবং রেওয়াজটি প্রচলনের জন্য সামাজিক আন্দোলনের ফলপরিণামে যখন কলকাতা ও 888sport appয় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের দুর্গামোহন দাশ, শিবনাথ শাস্ত্রী, নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়, নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, শীতলাকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও অন্যরা নিজেদের গৃহে নিপীড়িতা মেয়েদের আশ্রয় দিচ্ছেন, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছেন – তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রস্থল জোড়াসাঁকোর দেবেন্দ্র-রবীন্দ্রনাথদের ঠাকুরবাড়িতে কোনও অসহায় মেয়ে আশ্রয় পেয়েছেন বলে জানা যায় না।
অথচ বাড়িটির অবস্থান তখন বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের শীর্ষে। সে-বাড়ির কন্যা ও বধূরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা হচ্ছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। কেউ ঘোড়সওয়ারি করছেন। কেউ রাজনীতিতেও অংশ নিচ্ছেন। আর ‘মাতঙ্গিনী’-‘ভবতারিণী’দের রূপান্তর ঘটছে ‘কাদম্বরী’-‘মৃণালিনী’তে। অথচ বাল্যবিবাহ ও বিধবাবিবাহের পীড়াদায়ক প্রশ্নে নিপীড়িতা বিধুমুখী, স্বর্ণময়ী ও লক্ষ্মীমণিদের নিয়ে সারাবাংলা যখন উত্তাল, তখন মহর্ষি ও তাঁর পুত্র ‘গুরুদেব’দের শীতল মনোভাবে বড় বিস্ময় লাগে।
আসলে আভিজাত্যের দুর্গে ‘আদি’রা নিজেদের আবদ্ধ রাখলেন, ‘সাধারণে’র সঙ্গে মিশতে বা মিলতে পারলেন না। নিশিকান্ত ও তাঁর সমবয়স্ক অর্বাচীনদের কাণ্ডকারখানা মহর্ষির মতো প্রাচীনদের পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অর্বাচীন রবিদের অপছন্দ কী হেতু? পরবর্তীকালে বরদানাথ হালদারের জামাতা ও দুর্গামোহন দাশের ভ্রাতুষ্পুত্র চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মহর্ষির নোবেলজয়ী পুত্র রবীন্দ্রনাথের যে-তিক্ত মতভেদ, তার একমাত্র কারণ কেবল জাতীয়তাবাদ বনাম আন্তর্জাতিকতাবাদ বলে মনে হয় না। এর শিকড় প্রগতিবাদ বনাম প্রতিক্রিয়ার গভীরে প্রোথিত বলেই বোধ হয়।
রবীন্দ্রনাথের এই অকরুণ আচরণের অজানা কোনো পারিবারিক কারণ থাকতে পারে কি? আগেই বলা হয়েছে, চট্টোপাধ্যায় ও ঠাকুর পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। ঠাকুরবাড়ির কন্যা চট্টোপাধ্যায়দের বধূ এবং চট্টোপাধ্যায়দের কন্যা ঠাকুরবাড়ির বধূ হয়েছিলেন। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেই যে সম্পর্ক মধুর হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, বরং উলটোটা হতেই দেখা যায় বেশি।
খেয়াল রাখা প্রয়োজন, ১৯০৫ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তিরোধানের সঙ্গেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ভাঙন আরম্ভ হয়। জোড়াসাঁকোর সাঁকো আর জোড়া থাকল না, ভেঙে টুকরো টুকরো হলো। ভাইয়ে-ভাইয়ে, ভাইয়ে-বোনে, বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে  মামলা-মোকদ্দমা শুরু হয়ে গেল। ধীরে-ধীরে ছিন্নভিন্ন হল আধুনিক বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিবারটি।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও নিশিকান্ত ও রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন পথের পথিক। চরম এবং নরম, দুই শ্রেণীর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। নিশিকান্তর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। হায়দ্রাবাদ থেকে ভ্রাতৃষ্পুত্রী সুবালাকে তিনি লিখেছেন :
আমার মতে, এই বিভাগ-কার্য অতি উত্তম; বঙ্গের বিশেষত পূর্ববঙ্গের যথেষ্ট উপকার দর্শিবে। পুনরায় 888sport app, বিক্রমপুর, চাটগাঁ ইত্যাদি স্থানের সমৃদ্ধি ও মর্যাদা বাড়িবে।
‘পুনরায়’ অর্থ ঔপনিবেশিক শক্তি পশ্চিমবঙ্গে শিকড় গাড়ার আগের কালের মতো। ড. নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের বাংলাভাগের ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কালে। সে-অনুযায়ী ১৯৭১ সালে স্বাধীন 888sport apps ভূমিষ্ঠ ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পূূর্ববঙ্গের মর্যাদা বাড়ার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে। ড. চট্টোপাধ্যায়ের সৌভাগ্য যে তিনি মৃত্যুও বরণ করেন বিভক্ত বঙ্গদেশেই – অর্থাৎ বঙ্গ পুনরায় অখণ্ড হওয়ার পূর্বেই, ১৯১০ সালে।
বিধবাবিবাহবিরোধী মহর্ষি নিজের নাতবৌ ১৫ বছর বয়সেই বিধবা সুশীলার পিতামাতা কর্তৃক গৃহীত তাঁদের কন্যাটির সদ্যপ্রবর্তিত (১৮৫৬) আইনসম্মত বিধবাবিবাহের উদ্যোগ বাঞ্চাল করে দেন এবং তাতে মুখ্য ভূমিকাটি পালন করেন তাঁর সকল আপত্তিকর কর্মের সমর্থক ও সংঘটক পুত্র রবীন্দ্রনাথ – যখন অন্য পুত্রগণ আদর্শগত অসমর্থনহেতু অপারগতা প্রকাশ করেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট 888sport promo code তো ব্রহ্মচারিণী কিংবা কামগন্ধহীনা যন্ত্রমাত্র নন। তবু বিধবাবিবাহের প্রশ্নে চোখের বালি (১৯০২) থেকে চার অধ্যায় (১৯৩৪) পর্যন্ত 888sport alternative linkগুলোর লেখকের কাছে মানুষের চেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে জীবনবিমুখ তত্ত্ব।
রক্তমাংস দিয়ে গড়া মানবী বা বঞ্চিতা বিধবার বোবাকান্না হারিয়ে যায় দার্শনিকের অবাস্তব কল্পনাপ্রবণতার ভাবোল্লাসে। ‘ইউটোপিয়ান ইউফোরিয়া’ কি একেই বলে? মাঝে মাঝে এমনও মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যা ভাবেন তা লেখেন না; যা লেখেন তা বিশ্বাস করেন না; যা বিশ্বাস করেন তা বলেনও না। কবির কথায় ও কাজে অসংগতি বা লেখায় ও আচরণে বৈসাদৃশ্যের সুদীর্ঘ প্রসঙ্গ বর্তমান লেখকের 888sport app 888sport liveগ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।
তাঁর প্রভাবে পুনর্বিবাহবঞ্চিতা বলেন্দ্রনাথ-পতœী সাহানা ঠাকুরের শিক্ষায়ও বাদ সেধেছেন চাচাশ্বশুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পড়াশোনার জন্য বালবিধবাটিকে প্রফুল্লময়ী-নাম্নী চিরদুঃখময়ী শাশুড়ি শান্তিনিকেতনে পাঠাতে চাইলে, তাতেও তাঁর বিখ্যাত দেবরের আনুকূল্য জোটেনি। ‘উদার ও মহান শিক্ষাবিদরূপে পরিচিত’ রবীন্দ্রনাথের এই ব্যবহারকে করুণাময় মুখোপাধ্যায় বিস্ময়ের ব্যাপার বলে উল্লেখ করেন। (পৃ ১৮৭, রবীন্দ্র বলয়, প্রথম সংস্করণ, ২০০৬, বেস্ট বুক্স, কলকাতা)। ঠাকুরপোর সহানুভূতি না-পেয়ে প্রফুল্লময়ী ঠাকুর তাঁর নিঃসঙ্গ পুত্রবধূটিকে শিক্ষার জন্য সরলাবালা মিত্র এবং তাঁর সহযাত্রী কোচবিহারের দুই রাজকন্যা প্রতিভা ও সুধীরার সঙ্গে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন।
ওদিকে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যা বিদ্যালয় স্থাপনের আদি উদ্যোক্তা বলেন্দ্রনাথের নামটি অনুক্ত থাকে সত্যেন্দ্রনাথের উদ্বোধনী ভাষণে তো বটেই, রবীন্দ্রনাথের কথনে-লিখনেও – এমনকি বিশ্বভারতী স্থাপনকালেও। প্রসঙ্গটি বিস্তারিত জানতে চাইলে আগ্রহী পাঠক পড়ে নিতে পারেন শোভন সোম-লিখিত বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, ২০০০, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।
কিন্তু প্রতিমা দেবীর জন্মের পরের বছর, ১৮৯৪ সালে জন্ম নেওয়া কবিকন্যা মীরা দেবী শিক্ষার ব্যাপারে পিতার কোনো আনুকূল্যই পাননি, তার বদলে পেয়েছেন ষোড়শী হবার আগেই বাল্যবিবাহের শিকল। প্রসঙ্গত এও স্মর্তব্য যে, রথীর শিক্ষার দোহাই দিয়েই রবীন্দ্রনাথ সদ্যপ্রয়াতা স্ত্রীর নির্বাচিতা পুত্রবধূ হওয়া সত্ত্বেও ১৯০৪ সালে প্রতিমার প্রথম বিয়ের সময় তাঁর সঙ্গে নিজের পুত্রের বিবাহে সম্মত হননি। এও এক দৃষ্টান্ত বইকি, রবীন্দ্রনাথের লিঙ্গবৈষম্যের।
প্রচলিত ভাবমূর্তিটি হলো, রবীন্দ্রনাথ খ্যাতির কাঙাল ছিলেন না। কিন্তু আমরা দেখি – ছিলেন। অন্তত প্রত্যাশী তো সর্বদাই ছিলেন, যে প্রত্যাশা তাঁর উড়িয়া চাকর বনমালী পূরণ না করলেও কবির মুখ ভার হয়ে যেত। তাঁর খ্যাতির লোভেই ছদ্মনামী পদকর্তা ভানুসিংহ বেনামী থাকতে পারেননি। আসলে তা তিনি চানও নি। তার প্রমাণ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর গ্রন্থাকারে প্রকাশকাল ১৮৮৪ সালেই নবজীবন পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের জীবনী’ লেখেন। স্বাক্ষরহীন সেই ব্যঙ্গরচনাতে কবি রহস্যচ্ছলে ইঙ্গিত করেন যে, ভানুসিংহ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে হলেও হতে পারেন। নিচের উদ্ধৃতিটি লক্ষণীয় :
ভানুসিংহের জন্মকাল সম্বন্ধে চারি প্রকার মত দেখা যায়। 888sport apk download apk latest versionস্পদ পাঁচকড়িবাবু বলেন, ভানুসিংহের জন্মকাল খ্রীস্টাব্দের ৪৫১ বৎসর পূর্বে। পরমপণ্ডিতবর সনাতনবাবু বলেন, ১৬৮৯ বৎসর পরে। সর্বলোকপূজিত পণ্ডিতাগ্রগণ্য নিতাইচরণবাবু বলেন, ১১০৪ খ্রীস্টাব্দ হইতে ১৭৯৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে কোনও সময়ে ভানুসিংহের জন্ম হইয়াছিল। আর মহামহোপাধ্যায় সরস্বতীর বরপুত্র কালাচাঁদ দে মহাশয়ের মতে ভানুসিংহ হয় খ্রীস্ট-শতাব্দীর ৮১৯ বৎসর পূর্বে না হয় ১৬৩৯ বৎসর পরে জন্মেছিলেন, ইহার কোনো সন্দেহমাত্র নাই। আবার কোনো কোনো মূর্খ নির্বোধ গোপনে আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের নিকট প্রচার করিয়া বেড়ায় যে ভানুসিংহ ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করিয়া ধরাধাম উজ্জ্বল করেন। ইহা আর কোনো বুদ্ধিমান পাঠককে বলিতে হইবে না যে, একথা নিতান্তই অশ্রদ্ধেয়। (পৃ ৪৩, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রথম সংস্করণ, তৃতীয় মুদ্রণ, ১৯৯১, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা)।
বেনামি এ-লেখাটিও উঠতি কবি রবীন্দ্রনাথের খ্যাতি ও স্বীকৃতির জন্য ব্যাকুলতাই প্রমাণ করে, যে-প্রমাণটিকে পাকাপাকিভাবে বহাল রাখে ২৯ বৎসর পরের নোবেলপ্রাপ্তি উপলক্ষে প্রদত্ত সংবর্ধনাকালীন তাঁর স্থান-কাল ভোলা বেসামাল কথাবার্তা। অথচ কবিগুরুর প্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তিটি হলো খ্যাতির প্রতি লোভহীন এক মহিমময় মনীষীর!
কেন বেসামাল হয়েছিলেন এমন একজন মহান 888sport live chatী? তিনি কি জানতেন না যে ইতোমধ্যেই তাঁর অনেক দানের মূল্যই চিরস্থায়ী হয়েছে? তাঁর মাপের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নিশ্চিতই জানতেন। তবে? যখন গ্রহণযোগ্য কোনো কারণই খুঁজে পাই না, তখন মাঝে মাঝে আমার ধীবিভ্রম ঘটে এবং মনের চোখে একটি অলীক দৃশ্য দেখতে পাই। দৃশ্যটির কাল ১৯১১ সাল।
অব্যবস্থিতচিত্ত রবীন্দ্রনাথ অস্থিরমনে নিরুদ্দিষ্ট পদচারণা করছেন আর ভাবছেন – কেন তিনি স্বদেশেও যথাযোগ্য প্রাপ্যটি এখনো পাচ্ছেন না, যখন কিনা তাঁর স্বীকৃতি বিদেশেও পাবার দাবিদার, দশককাল আগে থেকে তো বটেই। কারণ গত বছরই তাঁর সৃজনকর্ম গীতাঞ্জলি পর্বে পৌঁছে গেছে (১৯১০ সালে)।
অতঃপর অব্যবস্থিতচিত্ত কবি তাঁর সৃষ্টির খতিয়ান নিতে শুরু করেন। উন্মেষ পর্ব : বাল্মীকি প্রতিভা, প্রভাতসংগীত, প্রকৃতির প্রতিশোধ, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, কড়ি ও কোমল… ঐশ্বর্য পর্ব : মানসী, চিত্রাঙ্গদা, চিত্রা, চৈতালি, পঞ্চভূতের ডায়ারি, গল্পগুচ্ছ… বিংশশতক পর্ব : ক্ষণিকা, নৈবেদ্য, শিশু, চোখের বালি, আত্মশক্তি, বিচিত্র 888sport live, 888sport live football, আধুনিক 888sport live football, শিক্ষা, খেয়া,…
এমন সময় গুরুদেবের পায়চারির সাথী হলেন জনৈক ‘রবীন্দ্র-উপগ্রহ’ এবং বললেন :
শুনে এতই খুশি হলাম যে ছুটে চলে এলাম। দেশে অনেক বাঙালি আপনার কবিসার্বভৌমিকতা একবাক্যে এখনো মেনে নিচ্ছেন না। কারণ তাঁরা রবীন্দ্রকাব্যে অশ্লীলতা, অনৈতিকতা, গুরুচণ্ডালী ইত্যাদি খুঁজে পাচ্ছেন। অথচ বিদেশে অবস্থানকারী নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামের এক বাঙালি আপনার বয়ঃসন্ধিকালের লেখা ভানুসিংহের 888sport app download apkর ভূয়সী প্রশংসাবাণী সংবলিত একটি চটিবই লিখে ডাক্তার উপাধি পেয়েছেন।
অতিশয় তিক্ত সময়ে অতিশয় মিষ্ট এই সন্দেশটি শিষ্যের মুখে শোনামাত্রই গুরুদেব লেখার টেবিলে গিয়ে তাঁর বক্ষ্যমাণ জীবন888sport sign up bonusতে লিখে ফেললেন :
ভানুসিংহ যখন ভারতীতে বাহির হইতেছিল ডাক্তার নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়… আমাদের দেশের গীতিকাব্য সম্বন্ধে একখানি চটি-বই লিখিয়াছিলেন। তাহাতে ভানুসিংহকে তিনি প্রাচীন পদকর্তারূপে যে প্রচুর সম্মান দিয়াছিলেন…ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের এসব বক্তব্যে তাঁর হেলাফেলা করার মনোভাবই প্রকাশিত হয় নিশিকান্তর The Yatras : Or, The Popular Dramas of Bengal (Trubner & Co., London, 1882) শীর্ষক মুদ্রিত থিসিসটির প্রতি  – যে-থিসিসে অপ্রাসঙ্গিক ভানুসিংহ ঠাকুরের নামগন্ধও ছিল না।
এ আমার হ্যালিউসিনেশন বা অলীকদর্শনমাত্র। তবে বর্ণিত পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিতই এটা ছিল গুরুদেবের দীর্ঘপুঞ্জিত টেনশানের আকস্মিক নিঃসরণবিশেষ।

প্রফুল্লময়ী ট্র্যাজেডি
প্রফুল্লময়ী (চট্টোপাধ্যায়) ঠাকুর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তবন্ধু সাঁতরাগাছি নিবাসী হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা ও দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের পতœী। তাঁদের বিবাহ হয় ১৮৬৮ সালের ১৮ ফেব্র“য়ারি। হরদেব দেবেন্দ্রনাথের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রফুল্লময়ীর দিদি নীপময়ীরও বিবাহ হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের সঙ্গে। হরদেব দরিদ্র ছিলেন, প্রফুল্লময়ীর 888sport sign up bonusকথা থেকে জানা যায়, তাঁর পিতৃশ্রাদ্ধও দেবেন্দ্রনাথের ব্যয়ে সম্পন্ন হয়। তাঁর 888sport sign up bonusকথায় রবীন্দ্রনাথের বালককালে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের আবহাওয়ার একটি সুন্দর ছবি পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন :
বিবাহের পরদিন আমার দেওর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরকারকে সঙ্গে করিয়া গয়নার বাক্স সঙ্গে লইয়া আমাকে সেই সকল পরাইয়া আনিবার জন্য আমাদের বাড়িতে গিয়াছিলেন। আমাকে সেই সব গহনা কাপড় পরাইয়া, মা আমার দুর্গাপ্রতিমার স্তব করিয়া আমাকে পাল্কীতে তুলিয়া দিয়া পা মুছাইয়া দিলেন।… আমার স্বামী চার ঘোড়ার গাড়িতে বিবাহ করিতে গিয়াছিলেন।…
…বিবাহের আটদিন পরে যেদিন বাপের বাড়িতে যাই, সেইদিন শাশুড়ি নিজে গহনা পরাইয়া আমাকে সাজাইয়া দিলেন, তাঁর নিজের একটি চুনী-মুক্তোর নথ ছিল, সেইটি আমার নাকে পরাইয়া দিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সেটা এত ভারী ছিল যে পরিতে গিয়া আমার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহা দেখিয়া আমার বড় ননদ [সৌদামিনী দেবী] আর পরিতে দিলেন না। আমি যে যাত্রা রেহাই পাইলাম। চুনী এবং দুটি মুক্তোর দাম দু-হাজার টাকা।… আমার বড় জা সর্বসুন্দরী দেবী নিজের টাকাপয়সা খরচ করিয়া নানারকম পাড়ের সাড়ী কিনিয়া নানা রঙে ছুবাইয়া আমাকে প্রত্যেক দিন পরাইয়া সাজাইতেন। বড় জা আমাকে নিজের বোনের মত øেহ করিতেন। তখন আমার ননদ জায়েরা মিলিয়া সকলে একসঙ্গে খাইতে বসিতাম। নতুন বৌ আমি তার উপর পাড়াগেঁয়ে মেয়ে, কাজেই ঘোমটার বহরটা বেশী রকমই ছিল, ঘোমটা ছাড়া একমুহূর্ত থাকিতাম না। খাইতে বসিবার সময় একহাত ঘোমটার ভিতরেই কোনোরকমে খাইতাম।… আমাদের সেই সময় বেশ ভূষার বড় একটা কিছু আড়ম্বর ছিল না। আমরা কেবলমাত্র একটি সাড়ি পরিয়া থাকিতাম গায়ে জামা দিবার চলন ছিল না।…
যে-সময়ের কথা বর্ণিত হচ্ছে তখনো জ্ঞানদানন্দিনী বোম্বাই থেকে শাড়ি পরার আধুনিক কেতা শিখে এসে সেই নূতন ধরন ও অন্তর্বাস পরার রীতিটি বঙ্গে চালু করেননি।
বিবাহের অল্পকাল পরেই বীরেন্দ্রনাথ উন্মাদরোগে আক্রান্ত হন। সেই অবস্থায় তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবান কিন্তু চিররুগ্ণ একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের জন্ম হয় ৬ নভেম্বর ১৮৭০ তারিখে, এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯ আগস্ট ১৮৯৯। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ফলে দেবেন্দ্রনাথের শেষ উইলে অপুত্রক ও বিকৃতমস্তিষ্ক বীরেন্দ্রনাথ পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন – তাঁর পরিবারের জন্য মাথাপিছু মাত্র ১০০ টাকা মাসোহারা নির্দিষ্ট হয়। এই সময়ে প্রফুল্লময়ীকে বৈষয়িক চিন্তায় ব্যাপৃত দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে মৃণালিনী দেবীকে বলেন্দ্রনাথের শ্রাদ্ধের আগের দিন লেখা এক পত্রে যে-মন্তব্য করেছিলেন সেটা ছিল শুধু বিরূপই নয়, অত্যন্ত নির্মমও :
নবোঠানের এক ছেলে, সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে তবু তিনি টাকাকড়ি [কোম্পানির কাগজ?] কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত্রি যেরকম ব্যাপৃত হয়ে আছেন তাই দেখে সকলেই আশ্চর্য এবং বিরক্ত হয়ে গেছে – কিন্তু আমি মনুষ্যচরিত্রের বৈচিত্র্য আলোচনা করে সেটা শান্তভাবে গ্রহণ করবার চেষ্টা করচি – এক এক সময় ধিক্কার হয়।
রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছিলেন যে পনেরো বছর বয়সী নিঃসন্তান বিধবা পুত্রবধূর সামাজিক দায়িত্বও প্রফুল্লময়ীর উপরই বর্তাচ্ছে। সুতরাং তাঁর পক্ষে টাকাকড়ি নিয়ে চিন্তিত থাকাটা আদৌ বিচিত্র নয়। অথচ রবীন্দ্রনাথ ‘মনুষ্যচরিত্রের বৈচিত্র্য আলোচনা করে সেটা শান্তভাবে গ্রহণ করবার চেষ্টা’ করছেন!
বলেন্দ্রনাথের বিধবা সুশীতলা বা সাহানা দেবীর পিত্রালয় থেকে বিবাহের আয়োজন হচ্ছে, এই সংবাদ পেয়ে বিধবাবিবাহের বিরোধী দেবেন্দ্রনাথ পারিবারিক সম্মান (!) রক্ষায় উদ্বিগ্ন হয়ে পুত্র রবীন্দ্রনাথকে এলাহাবাদে পাঠিয়েছিলেন বিয়ের চেষ্টা বাঞ্চাল করে তাঁকে পিতৃগৃহ থেকে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে আসবার জন্য। পিতার এমন বেআইনি অপকর্মটিও সুসম্পন্ন করে এলেন গুরুদেব – ব্যক্তিগত আদর্শের বিপরীত হওয়াতে যেটি করতে তাঁর অন্য কোনো দাদা সম্মত হননি।
বীরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রফুল্লময়ী গেরুয়া ধারণ করতেন। প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক ও রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সীতা দেবী তাঁর 888sport sign up bonusকথা পুণ্য888sport sign up bonusতে লিখেছেন :
তাঁহার [রবীন্দ্রনাথের] তিনতলার শয়নকক্ষে উঠিয়া গিয়া দেখিলাম, মেঝেতে পাতা বিছানায় তিনি শুইয়া আছেন, পাশে গৈরিকধারিণী এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা বসিয়া তাঁহার শুশ্রƒষা করিতেছেন। শুনিলাম তিনি কবির চতুর্থ ভ্রাতা বীরেন্দ্রনাথের পতœী প্রফুল্লময়ী দেবী।…
প্রফুল্লময়ীর 888sport sign up bonusকথা (‘আমাদের কথা : প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৩২) থেকে সেকালের ঠাকুরবাড়ির অনেক তথ্য জানা যায়। ঠাকুরপরিবারের বধূ হয়েও কেমন করে তিনি শ্রেণিচ্যুত হয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছেন তারও বর্ণনা পাই এখানে :
…বলু মারা যাওয়াতে এবং স্বামী উন্মাদ হওয়ার জন্য আমরা আমাদের বিষয় হইতে বঞ্চিত হইলাম। যতদিন আমরা বাঁচিয়া থাকিব, ততদিন পর্যন্ত এই বাড়ির একটা অংশ ভোগ করিবার অধিকার এবং মাসহারা পাইবার ব্যবস্থা হইল। এই বন্দোবস্তের ভিতরেই আমরা জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে লাগিলাম, কিন্তু দিন দিন সকল জিনিষই অত্যন্ত দুর্মূল্য হওয়ার দরুণ সেই সামান্য অর্থে সংসার নির্বাহ হওয়া কঠিন হইলে আমাদের বাড়ির অংশ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র বাড়ি ভাড়া করিয়া থাকিতে বাধ্য হইলাম। প্রথমে শিবপুরে বাড়ি ভাড়া করিয়া আমার বোনঝি সুষমার সঙ্গে কিছুকাল বাস করি, সেখানে বাড়িটিতে নানা অসুবিধার জন্য পুনরায় ব্যাটারিতলায় [ব্যাঁটরায়?] বাড়িভাড়া করিয়াছিলাম। বাড়িটি বেশ বড় ছিল কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত মেরামত না হওয়ায় অতিশয় জীর্ণ অবস্থায় পড়িয়াছিল। বাড়িটি লইয়া বেশ কিছু অর্থব্যয় করিয়া উহার জীর্ণতার আবরণ আমাদের ঘুচাইতে হইয়াছিল। সেই বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর সাহানার শরীর হঠাৎ বড়ই অসুস্থ হয় এবং সেইজন্য মাথার নানারকম পীড়া হইতে আরম্ভ হইলে সে আবার জোড়াসাঁকো বাড়িতে চলিয়া আসে। আমি তখন সেখানে একলা, কেবলমাত্র একটি ঝি সহায়। আমার আর এক ভাইপো হরিপ্রসন্ন আমার কাছে থাকিত, সারাদিন তাকে তাহার কার্যের জন্য বাহিরে থাকিতে হইত। রাত্রি যখন দশটা সাড়ে দশটা তখন সে বাড়ি ফিরিত। বাড়িটা মুসলমান পাড়ার ভিতর ছিল। নানারকম বিপদের মধ্যে বাস করা।…
রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন গ্রন্থে সমীর সেনগুপ্ত লিখেছেন :
এই বর্ণনার অনেকটা অংশ আমাদের কাছে সহজবোধ্য নয়। বাড়ির যে অংশে তাঁর অধিকার ছিল, ব্যয়সংকোচ করবার জন্য সেই অংশ ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ভাড়া করে অন্যত্র থাকার অর্থ বোঝা যায় না। কিছুদিন পরে সাহানা জোড়াসাঁকোয় ফিরে এলেন, কিন্তু প্রফুল্লময়ী ফিরলেন না (ফিরেছিলেন অবশ্য অনেকদিন পরে), একটি দাসী সম্বল করে মুসলমান পাড়ায় একা দিন কাটাতে লাগলেন – কেন? মনে হয় বর্ণনার ভিতরে অভিজাত পরিবারের সাংসারিক জটিলতার অনেক কাহিনি অনুক্ত রয়ে গেছে।
মনে রাখতে হবে প্রফুল্লময়ীর নিজের দিদি নীপময়ীও এ-বাড়িতে বধূ হয়ে এসেছিলেন এবং স্বামীর মৃত্যুর পর জীবিত ছিলেন দীর্ঘ ২৬ বছর – দেবেন্দ্রনাথের শেষ উইলে তাঁর সম্পর্কে ভালোই ব্যবস্থা ছিল। তা ছাড়া তাঁর জামাতাগণও ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত – ছিলেন স্বয়ং আশুতোষ চৌধুরী, বিশালভাবে সফল ব্যারিস্টার ও পরে হাইকোর্টের জজ, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত বন্ধু। কিন্তু প্রফুল্লময়ী ও তাঁর বিধবা পুত্রবধূকে কেন এত কষ্ট ভোগ করতে হলো, ঠাকুরবাড়িতে জায়গা পর্যন্ত হলো না, তার কোনো সদুত্তর আমরা পাই না। রবীন্দ্রনাথের কাছেও না, যিনি উন্মাদ ভ্রাতার সম্পত্তি-বঞ্চিতা অভাগিনী পতœী, অকালপ্রয়াত পুত্রের মাতা এবং বালবিধবার দায়িত্বভারাক্রান্ত শাশুড়িকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে অমন নাজুক সময়ে বিদ্রƒপ এবং নিজগুণে ক্ষমা করার ধৃষ্টতাও দেখাতে পারেন।
সমীর সেনগুপ্ত আরো লেখেন :
মনে হয়, বৈষয়িক চিন্তায় বিব্রত রবীন্দ্রনাথ এখানে মানবিক সহানুভূতি হারিয়ে প্রফুল্লময়ী দেবীর উপর কিছুটা অবিচার করেছেন। উন্মাদ স্বামীকে নিয়ে কষ্ট-পাওয়া এই গৃহবধূর একটিমাত্র সান্ত্বনাস্থল  ছিল পুত্র  বলেন্দ্রনাথ।  চিররুগ্ন  এই সন্তানটিকে নিয়েও তাঁর উদ্বেগের অবধি ছিল না। আদি ব্রাহ্মসমাজ-আর্যসমাজের মিলনের এবং ঠাকুর-কোম্পানির ব্যবসায়িক সাফল্যের অর্থহীন প্রয়াসে যখন প্রফুল্লময়ীর সেই একমাত্র অবলম্বন অকালে ঝরে গেল, তখন প্রবল শোকের মধ্যেও উন্মাদ স্বামী, বিধবা অল্পবয়স্কা পুত্রবধূ ও নিজের স্বার্থরক্ষার জান্তব প্রয়োজনে বৈষয়িক হয়ে ওঠা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুর ফলে দেবেন্দ্রনাথের শেষ উইলে বীরেন্দ্রনাথ সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন ও তাঁর পরিবারের জন্য মাথাপিছু মাত্র ১০০ টাকা মাসোহারা নির্দিষ্ট হয় এবং মহর্ষির মৃত্যুর পর এই মাসোহারা পাওয়া গিয়েছে অবিবেচক ট্রাস্টীদের হাত থেকে, যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন। (রবিজীবনী, চতুর্থ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা, প্রকাশকাল : প্রথম সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০১, পৃ ২৪৯)।

চিরদুঃখী বলেন্দ্রনাথ
আদি ব্রাহ্মসমাজের নেপথ্যচারী উৎসাহী কর্মী ছিলেন সু888sport live footballিক বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাতাশ বছর বয়সের তরুণ বলেন্দ্রনাথ পিতামহের ধর্মবিশ্বাসের প্রাণনায় মুম্বাইকেন্দ্রিক প্রার্থনাসমাজ, লাহোরকেন্দ্রিক আর্যসমাজ ও কলকাতাকেন্দ্রিক ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে এক অখিল ভারত একেশ্বরবাদী সংগঠনের কল্পনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বলেন্দ্রনাথ তাঁর এই অভিপ্রায় পিতামহ দেবেন্দ্রনাথকে জানালে দেবেন্দ্রনাথ একেশ্বরবাদী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণের পরামর্শ দেন।
শান্তিনিকেতনে প্রস্তাবিত ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের বলেন্দ্রনাথের তৈরি নিয়মাবলি রবীন্দ্রজীবনীকার উদ্ধার করেছেন। চোদ্দোটি বিধান ছিল সেই নিয়মাবলিতে। কিন্তু বলেন্দ্রনাথ এই নিয়মাবলিতে নিজের কোনো ভূমিকা রাখেননি। আঠারোশো নিরানব্বইয়ের পউষ উৎসবে, শান্তিনিকেতন-সাধনাশ্রমের সাম্বৎসরিক উদ্বোধনের লক্ষ্যে ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের গৃহ নির্মাণ ত্বরান্বিত হয়েছিল। সেই গৃহের কিছু অংশ আদিকুটির বা প্রাক্কুটির নামে এখনও বর্তমান। কিন্তু এর চার মাস আগে উনিশে আগস্ট বলেন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণ ঘটে।
কিন্তু বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে গৃহনির্মাণ বন্ধ হলো না, ব্রহ্ম-বিদ্যালয় প্রকল্পও পরিত্যক্ত হল না; যথাসময়ে ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের দ্বার উদ্ঘাটন করলেন বলেন্দ্রনাথের জ্যাঠামশাই সত্যেন্দ্রনাথ। তিনি উদ্বোধন ভাষণে পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, কিন্তু 888sport world cup rateের কোথাও ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের রূপকার বলেন্দ্রনাথের নামটুকুও উচ্চারিত হল না। তাঁর ভূমিকা রয়ে গেল প্রচ্ছন্ন।
এ ছাড়াও সম্ভবত বলেন্দ্রনাথ তাঁর প্রণীত নিয়মাবলিটি পিতামহ দেবেন্দ্রনাথকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন এবং এটিই রবীন্দ্রনাথেরও ‘ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ে’র নিয়মাবলি হিসেবেই অনুসৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের এই বিদ্যালয় স্থাপিত হয় উনিশশো এক সালে। দেবেন্দ্রনাথ পরলোকগমন করেন উনিশশো পাঁচ সালে। এই চার বছরকাল রবীন্দ্রনাথের ‘ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ে’র জন্যে কোনো স্বতন্ত্র নিয়মাবলি রচিত হয়নি। দেবেন্দ্রনাথ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এই বিদ্যালয়ে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের স্বতন্ত্র আহার, অব্রাহ্মণকে প্রণাম না করা, কাষায় পরিধান, দণ্ডধারণ ও ‘প্রকৃত হিন্দু’ হয়ে ওঠার নিয়মগুলি পালিত হয়েছে (একজন ব্রাত্য ব্রাহ্মণের ব্র্রাহ্মণ্যবাদের বহর মাপুন!)।
ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের বৈষম্যমূলক অবস্থান ও আচরণ রবীন্দ্রনাথও যথারীতি বহাল রাখেন।
‘বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্র উভয়েই প্রাচীন হিন্দু বর্ণাশ্রমধর্মের আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণ করে চলতেন। শিক্ষার্থীরা সকালসন্ধ্যা কাষায় বস্ত্র পরে উপাসনায় বসত, গায়ত্রীমন্ত্র ধ্যান করত, উপাসনা শেষে সমবেত হয়ে বেদমন্ত্র পাঠ করত। প্রাতঃকালে উপাসনার পর ছাত্ররা শিক্ষকদের পদধূলি নিয়ে প্রণাম করে গাছের তলায় নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পাঠ গ্রহণের জন্য বসত। রান্নাঘরে খাবার সময় ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ ছাত্র-শিক্ষক আলাদা পঙ্ক্তিতে বসতেন। ব্রাহ্মণ-পাচক ও ব্রাহ্মণ-কর্মী আহারার্থীদের পরিবেশন করত।’ (পৃ ২৩৬-২৩৭, চিঠিপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৯২)।
অব্রাহ্মণ কুঞ্জলাল ঘোষ শিক্ষকরূপে বিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ায় সমস্যার উদ্ভব হয়। ১৯০২ সনের ১৩ নভেম্বর অধ্যক্ষসমিতির (মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৭১-১৯৫০, জগদানন্দ রায়, ১৮৬৯-১৯৩৩, সুবোধচন্দ্র মজুমদার, ১৮৭৮-১৯৩০) কর্মসম্পাদক শ্রী কুঞ্জলাল ঘোষকে লিখিত একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) লেখেন :
যাঁহারা (ছাত্র বা অধ্যাপক) হিন্দুসমাজের সমস্ত আচার যথাযথ পালন করিতে চান তাঁহাদিগকে কোনো প্রকারে বাধা দেওয়া বা বিদ্রƒপ করা এ বিদ্যালয়ের নিয়মবিরুদ্ধ। রন্ধনশালায় বা আহারস্থানে হিন্দু আচারবিরুদ্ধ কোনো অনিয়মের দ্বারা কাহাকেও ক্লেশ দেওয়া হইবে না।… (পৃ ১৬৬-১৬৭, চিঠিপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৯২)।
ছাত্ররা যখন খাইতে বসিবে তখন পালা করিয়া একজন ছাত্র পরিবেষণ করিলে ভাল হয়। ব্রাহ্মণ পরিবেষক না হইলে অপত্তিজনক হইতে পারে। অতএব সে সম্বন্ধে বিহিত ব্যবস্থাই কর্ত্তব্য হইবে।… (পৃ ৮৫, মহামহিম রবীন্দ্রনাথ, বাংলা একাডেমী, 888sport app, ১৯৯৭)।
এর ২২ দিন পর ৫ ডিসেম্বর ১৯০২ এ-বিষয়ে কবি বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষসমিতির সভাপতি মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে লেখেন :
প্রণাম সম্বন্ধে আপনার মনে যে দ্বিধা উপস্থিত হইয়াছে তাহা উড়াইয়া দিবার নহে। যাহা হিন্দুসমাজবিরোধী তাহাকে এ বিদ্যালয়ে স্থান দেওয়া চলিবে না। সংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছে ছাত্ররা তদনুসারে ব্রাহ্মণ অধ্যাপকদিগকে পাদস্পর্শপূর্ব্বক প্রণাম ও 888sport app অধ্যাপকদিগকে নমস্কার করিবে এই নিয়ম প্রচলিত করাই বিধেয়।
সর্ব্বাপেক্ষা ভাল হয় যদি কুঞ্জবাবুকে নিয়মিত অধ্যাপনার কার্য্য হইতে নিষ্কৃতি দেওয়া যায়। তিনি যদি আহারাদির তত্ত্বাবধানেই বিশেষরূপে নিযুক্ত থাকেন তবে ছাত্রদের সহিত তাঁহার গুরুশিষ্যসম্বন্ধ থাকে না। ব্রাহ্মণেতর ছাত্রেরা কি অব্রাহ্মণ গুরুর পাদস্পর্শ করিতে পারে না? (পৃ ১১-১২, চিঠিপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৯২)।
দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তখনও প্রাচীন ঋষিদের তপোবনের ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। পিতার আদর্শে তাঁর বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ‘প্রকৃত হিন্দু’রূপে গড়ে তোলার ব্যাপারে তিনি অটল। আরও প্রমাণ হচ্ছে যে, ‘গুরুদেব’ তাঁর ছাত্রদের ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণে ভেদাভেদ তথা শ্রেণিভেদ ভোলানোর উদ্যোগ নেবারও সাহস রাখেন না। মনু-নির্ধারিত হিন্দুদের বর্ণধর্মপ্রথার বিরুদ্ধে যুগোচিত উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে গুরুদেব এতই ভীরু যে তার চেয়ে অব্রাহ্মণ বর্ণের কুঞ্জলাল ঘোষকে শিক্ষকতার চাকরি থেকে খারিজ করাও কাম্যতর তাঁর কাছে। অল্পকাল পরে এই নিবেদিতচিত্ত অব্রাহ্মণ কর্মীটিকে তাঁর আদর্শ বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে দেওয়াও সমর্থন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অথচ তাঁর অর্ধশতাব্দী পূর্বে ‘বিদ্যাসাগর’ সংস্কারসাধনপূর্বক সংস্কৃত কলেজে ‘অব্রাহ্মণে’র প্রবেশাধিকার প্রবর্তন করেন। তার আগে ১৮৪৭ সালে সহ-সম্পাদক হিসেবে তাঁর সংস্কারের প্রস্তাব সম্পাদক রসময় দত্ত অগ্রাহ্য করলে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করেন। ১৮৫০ সালে 888sport live football-অধ্যাপকের পদগ্রহণ করেন এই শর্তে যে, তাঁর প্রস্তাবমতো কলেজ-সংস্কার করতে হবে। ১৮৫১ সালে সম্পাদক রসময় দত্ত অবসর গ্রহণ করলে, নবসৃষ্ট অধ্যক্ষ-পদে নিযুক্ত হয়ে কলেজটির সর্ববিভাগের সংস্কারসাধনে ব্রতী হন সংস্কারশার্দূল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
কোনো কারণেই আপোস না করা ছিল আজীবন কঠোর সংগ্রামী এই মহাপুরুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এই জন্যই তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বর্ণনা করেছেন এভাবে : : ‘The genius and wisdom of an ancient sage, the energy of an Englishman and the heart of a Bengali mother|’ (পৃ ৬৫, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সংশোধিত চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৮, কলকাতা)।
প্রতিতুলনায় রবীন্দ্রনাথ আজীবন চলেছেন কেবল আপোস করে, বহুক্ষেত্রেই এবং বহুজনের সঙ্গে – পিতার সঙ্গে, স্বজনের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে, ব্রাহ্মের সঙ্গে, হিন্দুর সঙ্গে, এমনকি ইংরেজের সঙ্গেও। প্রধানত এ কারণেই সৃষ্ট হয়েছে রবীন্দ্রজীবনের অনুজ্জ্বল অঞ্চলটি।
তবে রবীন্দ্রনাথের এই শতভাগ রক্ষণশীল মনোভাবে পরিবর্তন সূচিত হতে দেখা যায় এর বছর-দশেক পর থেকেই। ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ৯ ও ১৬ কার্তিক, তৎকালীন সর্বাধ্যক্ষ নেপালচন্দ্র রায়কে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রাংশ দুটি তাঁর মনোভাব পরিবর্তনের পরিচয় দেয় :
…একজন মুসলমান অভিভাবক ছাত্র দিতে চান। আমিও লইতে ইচ্ছা করি। ছেলেটির বয়স অল্পই, আমি লিখিয়াছিলাম তাহার জন্য চাকর ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থা দরকার, তাহার যে উত্তর পাইয়াছি তাহা পাঠাই। এ ছেলেটিকে যদি আপনারা লওয়া স্থির করেন তবে অভিভাবককে জানাইতে বিলম্ব করিবেন না – যদি সুবিধা বোধ না করেন তাহাও লিখিবেন।
মুসলমান ছাত্রটির সঙ্গে একটি চাকর দিতে তাঁহার পিতা রাজি। অতএব এমন কি অসুবিধা, ছাত্রদের মধ্যে এবং অধ্যাপকদের মধ্যেও যাঁহাদের আপত্তি নাই তাঁহারা তাহার সঙ্গে একত্র খাইবেন। শুধু তাই নয় – সেই সকল ছাত্রের সঙ্গেই ঐ বালকটিকে এক ঘরে রাখিলে সে নিজেকে নিতান্ত যূথভ্রষ্ট বলিয়া অনুভব করিবে না। একটি ছেলে লইয়া পরীক্ষা শুরু করা ভাল। অনেকগুলি ছাত্র লইয়া তখন যদি পরিবর্ত্তন আবশ্যক হয়, সহজ হইবে না। আপাতত শালবাগানের দুই ঘরে নগেন আইচের তত্ত্বাবধানে আরো গুটিকয়েক ছাত্রের সঙ্গে একত্রে রাখিলে কেন অসুবিধা হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। আপনারা মুসলমান রুটিওয়ালা পর্য্যন্ত চালাইয়া দিতে চান, ছাত্র কি অপরাধ করিল?
একসঙ্গে হিন্দু মুসলমান কি এক শ্রেণীতে পড়িতে কিংবা একই ক্ষেত্রে খেলা করিতে পারে না? চাকর রান্নাঘর হইতে কয়েকজনের খাওয়া আনাইয়া শালবাগানে খাওয়াইয়া যাইবে। যে কয়জন তাহার সঙ্গে একত্রে খাইতে সম্মত তাহারা নিজের বাসন নিজে মাজিবে। ছেলেদের পক্ষে এইরূপ স্বেচ্ছাকৃত সাধনা উপকারজনক। প্রাচীন তপোবনে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু-মুসলমানে একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা।
আবার একবার বিবেচনা করিবেন ও চেষ্টা করিবেন যে আপনাদের আশ্রমদ্বারে আসিয়াছে তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন না – যিনি সর্ব্বজনের একমাত্র ভগবান তাঁহার নাম করিয়া প্রসন্নমনে নিশ্চিন্তচিত্তে এই বালককে গ্রহণ করুন; আপাতত যদি বা কিছু অসুবিধা ঘটে সমস্ত কাটিয়া গিয়া মঙ্গল হইবে। (পৃ ২৩৭-২৩৮, গ্রন্থপরিচয়, চিঠিপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৯২)।
[স্মর্তব্য যে, রবীন্দ্রনাথের ভিক্ষা চাওয়ার মতো এই করুণ গান গাওয়া – মুসলমান ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলীর (১৯০৪-৭৪) শান্তিনিকেতনে অধ্যয়নের (১৯২১-২৬) মাত্র ১০ বছর পূর্বেকার ঘটনা।]
স্বর্ণকুমারীও ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ করেননি। তিনি লিখেছেন, দেবেন্দ্রনাথ ‘ব্রহ্ম-বিদ্যালয়’ স্থাপনের ভার রবীন্দ্রনাথের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘বিশ্বভারতী বিদ্যালয়’ স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ পিতৃ-আজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেননি; কেননা বিশ্বভারতীর সংকল্প দেবেন্দ্রনাথের সংকল্প ছিল না। সাধনভজনের জন্যে উৎসর্গীকৃত সম্পত্তিতে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদ্যাচর্চার কোনও কথা অছিনামায় নেই। বিশ্বভারতীর অনুধ্যান সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথের। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ অছিনামার ‘ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ে’র সংকল্প থেকে সরে এসে প্রকৃতপক্ষে বিধান লঙ্ঘনই করেছিলেন।
বিশ্বভারতী পঞ্জিকৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্ম-বিদ্যালয় অস্তিত্বহীন হয়, বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে পূর্ববিভাগ ও পরে পাঠভবন হয়। যে শান্তিনিকেতন-সাধনাশ্রমে ‘চিরকাল, একব্রহ্মের উপাসনার জন্য ব্যবহৃত হইবে’ বলা হয়েছিল, সেই অভীষ্ট পূর্ণ হয়নি। উনিশশো এক সালের বাইশে ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের উদ্বোধন ও দীক্ষা-সংগীত ছিল ‘মোরা সত্যের পরে মন… সেই অভয় ব্রহ্ম-নাম, আজি মোরা সবে লইলাম।’ পরে ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ হয়ে ওঠে আশ্রম-সংগীত।
অজিতকুমার চক্রবর্তী তাঁর ‘ব্রহ্ম-বিদ্যালয়’ রচনাটি তেরোশো আঠারোর আট পউষ তথা উনিশশো এগারোর চব্বিশে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বার্ষিক সভায় পাঠ করেন। এই রচনায় তিনি লিখেছেন, তেরোশো আটের সাত পউষে এই বিদ্যালয় অর্থাৎ ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার চল্লিশ বছর আগে আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হলেও বিদ্যালয় ছিল না। ‘কিন্তু তাহার জন্মের পূর্বের সেই গর্ভের ইতিহাসকে একেবারে অগ্রাহ্য করা তো চলে না’ বলেও তিনি বলেন্দ্রনাথের প্রাথমিক উদ্যোগটির কথা বলেননি।
তিনি বলেছেন ‘রবীন্দ্রনাথ যখন এই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম-স্থাপনের সংকল্প করিলেন তখন মহর্ষি তাঁহাকে এই কার্যে খুবই উৎসাহ দিলেন।’ অজিতকুমার ব্রহ্মচর্য তপোবন-সাধনা ইত্যাদি আদর্শে অভিষিক্ত বিদ্যালয়ের কথা বললেও ‘ব্রহ্ম-বিদ্যালয়’ অচিরে লুপ্ত হল বিশ্বভারতীর আবেষ্টনে। এভাবে যে বিদ্যালয়কে আমরা সূচনায় দেখি তা দু-দশক অতিক্রান্ত হবার আগেই বিশ্বভারতীতে লীন হলো।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশশো উনিশ সালে। এই বছর থেকে পঠনপাঠন শুরু হলেও উনিশশো 888sport cricket BPL rate সালের তেইশে ডিসেম্বর বিশ্বভারতী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধিত হয়। উনিশশো বাইশ সালের ষোলো মে আঠারোশো ষাটের 888sport cricket BPL rate সংখ্যক আইন মোতাবেক বিশ্বভারতী পঞ্জিকৃত সমিতি বা রেজিস্টার্ড সোসাইটি হল। উনিশশো তেইশের ছাব্বিশে জুলাই রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে দুটি দলিল সম্পাদন করেন।
একটি দলিলে তিনি তাঁর গ্রন্থস্বত্ব বিশ্বভারতীকে দান করে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের সূত্রপাত করেন। দ্বিতীয় দলিলে বিশ্বভারতীর জন্যে একটি অছিসভা গঠিত হয়। তিন অছি হন রবীন্দ্রনাথ, চিকিৎসক নীলরতন সরকার, আইনজীবী হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বিশ্বভারতীর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ভার এই অছিপর্ষদের উপরে দেওয়া হয়। এর ফলে, দেবেন্দ্রনাথ-কৃত শান্তিনিকেতন-সাধনাশ্রমের অছিনামা কার্যত খারিজ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রজীবনীকার এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি লিখেছেন, এই নিয়ে মনান্তর, মতান্তর হয়েছিল এবং বিধুশেখর ভট্টাচার্যের আশ্রম ত্যাগের নানা কারণের মধ্যে এটিও একটি কারণ। পরে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে সমস্ত সম্পত্তি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর বর্তায়।
উনিশশো দুই সাল থেকে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয় প্রকল্পে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। তিনিও জানিয়েছেন :
স্বাধ্যায়ের (বেদপাঠের) নিমিত্ত ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা মহর্ষির ইচ্ছা ছিল। গ্রন্থাগারের দক্ষিণ আলিসার মধ্যস্থলে চুন-বালির পঙ্কে ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ অঙ্কিত ছিল, ইহাই তাহার প্রমাণ। কিন্তু তৎপরিবর্তে কবি আশ্রমে ব্রহ্মচর্চাশ্রমের সূচনা করিলেন।
ইতিহাসে সম্ভাব্যতার প্রশ্ন নেই, ঘটিত ঘটনা নিয়েই ইতিহাস। কিন্তু, বলেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম-বিদ্যালয় পরিকল্পনায় সিদ্ধকাম হলে এই বিদ্যালয়ের গতিপ্রকৃতি ও চরিত্র ভিন্নতর হত। রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন, তেমন কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা বলেন্দ্রনাথ তাঁর ব্রহ্ম-বিদ্যালয়-প্রকল্পে নিজের জন্যে রাখেননি। বলেন্দ্রনাথ ধর্মশিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই সাধারণ এন্ট্রান্স শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন। তাতে ছিল সাবেকের অনুবর্তন।
রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের সংকল্পের মধ্যেই তাঁর বিদ্যালয়কে সাবেক বিদ্যালয়-ভাবনা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য কেবল অছিনামার শর্ত পূরণ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সেই সংকল্পকে বৃহত্তর অনুধ্যানে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাকে আমরা পরিবর্তন না বলে শিক্ষার যুগোচিত উদ্বর্তন বলতে পারি। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়-ভাবনা ধর্মশিক্ষার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যার তীর্থ নির্মাণ করতে চেয়েছিল।
বলেন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের তৎপরতা ছিল রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়ের নান্দীমুখ। শান্তিনিকেতনে শিক্ষার দীপশিখাটি প্রথম জ্বালাতে চেয়েছিলেন বলেন্দ্রনাথ। শিখাটি থেকে রবিরশ্মির বিস্ফোরণকালে আদি প্রজ্বালক বরাবরই থেকে গেলেন অনুচ্চারিত ও অলিখিত – সত্যেন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেরই বচনে, ভাষণে এবং লেখনে। (শোভন সোম, বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, পৃ ৭৭-৮৩, আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ, মে ২০০০, কলকাতা)।

চিরদুঃখিনী সুশী
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র বলেন্দ্রনাথের পতœী সাহানা দেবীর (১৮৮৫-১৯২৮) পিতা মেজর ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাস করতেন এলাহাবাদে। সাহানার ডাকনাম ছিল সুশীতলা বা সুশী – এইসব ডাকনামে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায় নানান জনের 888sport sign up bonusকথায়। তাঁদের বিবাহ হয় ৪ ফেব্র“য়ারি ১৮৯৬। বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর কোম্পানির কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য শিলাইদহে থাকতেন, সাহানাও তাঁর সঙ্গে থাকতেন। যক্ষ্মারোগের উপর অতিরিক্ত পরিশ্রমে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় মাত্র ২৯ বছর বয়সে (১৯ আগস্ট ১৮৯৯), তখন সাহানার বয়স ১৫ বৎসর।
১৯০০ সালের নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ বালবিধবা সাহানার পুনর্বিবাহের আয়োজন ভণ্ডুল করে তাকে এলাহাবাদের পিতৃগৃহ থেকে নিয়ে এসে কলকাতা হয়ে শিলাইদহে রেখে আসেন। এরপরও সাহানা মাঝে মাঝে এলাহাবাদে মায়ের কাছে গেছেন। এলাহাবাদে তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে দেখা যায় (২৫ জন ১৯০৭), ‘আমাদের বিদ্যালয়ে সায়েন্স পড়াইবার সুবিধা বটে কিন্তু বিদ্যালয়ের লেবরেটরিতে তোমাকে শিক্ষা দিতে গেলে সকলের সামনে তোমাকে বাহির হইতে হইবে – সে কি সম্ভব হইবে?’
‘ঠাকুরবাড়ির বউ ও মেয়েরা উনিশ শতকেই পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, অভিনয় করেছিলেন, সরলা দেবী চাকরিও করেছিলেন। উনিশশো সাতে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই চিঠি পাঠককে বিস্মিত করে।’ (পৃ ৯২, বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, প্রথম সংস্করণ মে ২০০০, কলকাতা)।
বোঝা যায়, সাহানা নিজের জীবন কাটাবার পন্থার সন্ধান করছেন। বলেন্দ্রনাথের মাতা প্রফুল্লময়ীর 888sport sign up bonusকথা থেকে জানা যায়, সাহানাকে তিনি ‘ইংরাজী স্কুলে’ ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ‘কিছুদিন সে বিলাতে ট্রেনিং পড়িবার জন্য গিয়াছিল, কিন্তু কিছুদিন থাকিবার পর শরীর অসুস্থ হওয়ায় ফিরিয়া আসিতে বাধ্য হইল।’ সাহানা তাহলে ঠাকুরবাড়ির দ্বিতীয় বধূ যিনি বিলেতে গিয়েছিলেন, এবং বলতে গেলে একা একাই।
জ্ঞানদানন্দিনী গিয়েছিলেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে, তারপর এক প্রজন্মেরও অধিককাল অতীত হয়ে গেছে, তবু সংবাদটি আমাদের বিস্মিত করে। যে-পর্দাপ্রথার অনুগামী হবার জন্য তাঁর শান্তিনিকেতনে 888sport apk পড়া হয়নি, সেই পর্দাপ্রথাকে ঠেলে সরিয়ে তিনি ‘ট্রেনিং পড়িবার জন্য’ বিলেতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন! তবে সাহানার এর পরেকার জীবনকাহিনি অস্পষ্ট। সে-জীবনে তিনি কি কোথাও সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলেন, নাকি শেষ পর্যন্ত জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই তাঁর বর্ণহীন জীবন ধুঁকে ধুঁকে অতিবাহিত হয়েছিল, তা স্পষ্ট করে জানা যায়নি।

চলে গেলেন মোহিতচন্দ্র সেন
মোহিতচন্দ্র সেন (১৮৭০-১৯০৬)। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ও দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীর অনার্সসহ বি.এ. (১৮৮৮) ও প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান পাওয়া এম.এ. (১৮৮৯) বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার পর নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত এ বক্তা শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম পর্বে কবির শিক্ষাদর্শকে রূপদান করার জন্য বিদ্যালয়ে যোগদান করেন সতীশচন্দ্র রায়ের পরবর্তী অধ্যক্ষরূপে। তিনি শান্তিনিকেতনের অর্থকৃচ্ছ্রতার দিনে পরীক্ষকের পারিশ্রমিকরূপে প্রাপ্ত এক হাজার টাকা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দেন।
মোহিতচন্দ্র বিষয় বা ভাবের অনুষঙ্গের বিচারে কুড়িটি কাব্যখণ্ডে বিন্যস্ত করে রবীন্দ্র কাব্যগ্রন্থাবলী প্রকাশ করেন (১৩১০/১৯০৩)। এটা তাঁর মহত্তম কীর্তি এবং কবিরও গুরু-খ্যাতির প্রথম ভিত্তি। বিশ্ব888sport live footballে অনন্য শিশু-শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটির সৃষ্টি, পুষ্টি ও প্রকাশনার কৃতিত্বও মোহিতচন্দ্রেরই প্রাপ্য। কিন্তু প্রশাসনিক কারণে একদিন তাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে চলে যেতে হয়। কারণটা প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ নিজেই কিংবা তাঁর স্বভাবসুলভ ধরনটাই।
মোহিতচন্দ্র যখন বিদ্যালয় পরিচালনার ব্যাপারটা গুছিয়ে নিয়ে বসলেন, তখনই কবি আবিষ্কার করলেন যে এঁকে বেতন অনেক বেশি দিতে হয়, এঁর আদর্শ কবির শিক্ষাদর্শ থেকে সরে যাচ্ছে, অতিব্যবহারিকতা ও অতিবাস্তবতা উদগ্র হয়ে উঠছে – অতএব বিদ্যালয় পরিচালনার কাজটি তাঁকে নিজের হাতে নিয়ে নিতে হবে, ইত্যাদি। কিছুদিন পরেই তিনি অন্য কোনো মহত্তর অথবা নতুন কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে বিদ্যালয়ও তাঁর মাথা থেকে পড়ে যেত।
ফলে অচিরেই বিদ্যালয় আপনার পথে আপনি গড়িয়ে চলত, শিক্ষকগণ গতানুগতিকের অভ্যস্ত পথে চলে সকল কাজই সহজ করে নিতেন, আদর্শ আর আদর্শবাদ জানালা দিয়ে পালাত। তখন তাঁর ব্রহ্মবিদ্যালয়কে সামান্য ‘ইস্কুল’ মনে হত। সাধারণ ইস্কুলের ধরন-ধারণ পঠন-পাঠন তাঁর আশ্রমে প্রবর্তিত হবে – এটা রবীন্দ্রনাথ সহ্য করতে পারতেন না। অতএব পুরাতনকে দাও বিদায়। এই প্রক্রিয়ায় অমূল্য অবদান রাখা একাধিক শিক্ষককে বিদায় নিতে হয়েছে। এসব কথা স্পষ্ট ভাষায় লিখে গেছেন রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার :
মোহিতচন্দ্র সেন চলিয়া গেলেন; রবীন্দ্রনাথ ভাবিলেন কতগুলি বয়স্ক ছাত্র বিদায় ও অযোগ্য অধ্যাপক পরিবর্তন করিলেই বিদ্যালয়ের আমূল সংস্কার হইবে। কতবার ভাবিয়াছেন, অভিভাবকদের দিকে না তাকাইয়া বিদ্যালয়ের অন্তর্নিহিত আদর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। কিন্তু কোনোদিন তাঁহার বিদ্যালয়কে এন্ট্রান্স বা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার নিগড় হইতে মুক্ত করিতে পারেন নাই। এমন-কি, বিশ্বভারতী স্থাপিত হইলেও তাহাকে একটি স্বাধীন বিদ্যালয়রূপে গড়িবার সাহস ও সংকল্প তাঁহার মধ্যে দেখা যায় নাই। ফলে ইহার একটি অংশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি প্রাইভেট স্কুল ও কলেজের খ্যাতি অর্জন করিয়াছিল। (পৃ ১২৯, রবীন্দ্রজীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, প্রথম প্রকাশ ১৯৩৬, পুনর্মুদ্রণ ১৯৯৯)।
সে যাক। শান্তিনিকেতন ত্যাগের কিছুকাল পরেই মোহিতচন্দ্র সেনের অকালমৃত্যু ঘটে। তাঁর বিধবা পতœী সুলেখিকা ও কবি সুশীলা দেবীকে ফিরিয়ে এনে কবি মেয়েদের বোর্ডিং পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং অদক্ষতার কারণ দর্শিয়ে বিদায়ও দেন। ১৯২৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর দুই মাসব্যাপী মোহিত-সুশীলার ছোট মেয়ে উমা ওরফে বুলিকে (১৯০৪-৩১) জীবন্ত মিডিয়াম বানিয়ে প্ল্যান্শেটে-বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবী, মৃণালিনী দেবী ও শমীন্দ্রনাথ প্রভৃতির আত্মার সঙ্গে বাক্যবিনিময় করেন। সেই ভৌতিক বাতচিতের অন্যতম লিপিকারের ভূমিকা পালনকারী কবি অমিয় চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘মহাপৌরুষেয় ছেলেমানুষী’র, ধকলেই দু বছরের মধ্যে প্রতিশ্র“তিশীলা কবি উমা সেনের মৃত্যু ঘটেছে বলে প্লান্শেটে-অবিশ্বাসী মহলে সে সময় প্রবল গুঞ্জন উঠেছিল।

দিনেন্দ্র-বেদনা
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮২-১৯৩৫) দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথ ও সুশীলার একমাত্র পুত্র। সম্পর্কে তিনি রবীন্দ্রনাথের পৌত্র হলেও তাঁদের বয়সের ব্যবধান মাত্র 888sport cricket BPL rate বছরের। মনে হয় গানের জন্যই দিনেন্দ্রনাথের জন্ম। শিশুকাল থেকেই তাঁর মধ্যে সংগীতক্ষমতার প্রকাশ দেখা যায়। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন, তিনি তিন বছর বয়স থেকে ‘নিবারো নিবারো প্রাণের ক্রন্দন, কাটো হে কাটো হে এ মায়াবন্ধন’ ইত্যাদি গান গেয়ে তাঁদের কৌতুক উৎপাদন করতেন। একবার ‘শয়ন ভিজিল নয়নজলে ওগো সজনী’ গেয়ে পিতামহ দ্বিজেন্দ্রনাথের ভর্ৎসনা লাভ করেছিলেন, সে-কথাও ইন্দিরা দেবী সকৌতুকে বর্ণনা করেছেন।
যখন দিনেন্দ্রনাথ চার বছরের শিশু তখন রবীন্দ্রনাথের ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি’ সুরতাল সহযোগে গাইতে পারতেন। আর একটু বড়ো হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়বার সময় পিয়ানো বাজানোতে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে শ্রেষ্ঠ 888sport app download bd লাভ করেছিলেন। বাড়িতে গান শিখতে আরম্ভ করেন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও ব্রাহ্মসমাজের বেতনভুক্ত গায়ক রাধিকামোহন গোস্বামী এবং শ্যামসুন্দর মিশ্রের কাছে। রাগসংগীত ছাড়াও, বাংলা লোকসংগীতের বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালি ইত্যাদি ধারার প্রতি তাঁর সমান আকর্ষণ ছিল। মোটকথা সংগীতে দিনেন্দ্রনাথের প্রতিভা, শিক্ষা, দীক্ষা – সবই ছিল সমীহ জাগানো।
প্রথমা পতœীর মৃত্যুর অনতিপরে কমলা দেবীর সঙ্গে বিবাহের (১৯০২) পরপরই দিনেন্দ্রনাথ সস্ত্রীক শান্তিনিকেতন যান সেই বছরেই। পুনরায় পরের বছর গিয়ে গ্রীষ্মাবকাশের খানিকটা সময় সেখানে কাটান। এই সময় থেকেই তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের সংগীতশিক্ষার ভার নিতে আরম্ভ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এর পর তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য প্রথমবার বিলেত রওনা হন ১৯০৪ সালে এবং দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর (১৯০৫) পর পড়া অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসেন।
তাঁর বিলেত থেকে ফেরবার অব্যবহিত পরেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন আরম্ভ হয়। সেই আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা অবনীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন ঘরোয়ায়। বছরদুয়েক পরে, ১৯০৭ সালের আগস্ট মাসে আবার গেলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। কিন্তু এবারও ব্যারিস্টারিতে তাঁর মন গেল না, কিছুদিন পাশ্চাত্য সংগীতের তালিম নিয়ে দিনেন্দ্রনাথ দেশে ফিরে এলেন এই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে।
দ্বিতীয়বার বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি  স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে বসবাস করতে আরম্ভ করলেন। ক্ষিতিমোহন সেন শান্তিনিকেতনে যোগ দেন ১৯০৮ সালের জুন মাসে, তিনি তাঁর দিনলিপিতে এই সময়ের কথায় লিখেছেন – ‘কবির গানের ভাণ্ডারী ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ।… তাঁহাকে পাইয়া যেন কবির সুরের প্রবাহ মুক্তধারায় বহিয়া চলিয়াছিল।’ ব্রহ্মচর্যাশ্রমের তিনি ছিলেন সংগীতের শিক্ষক। কীভাবে তিনি গান শেখাতেন তার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন শান্তিনিকেতনের আদি যুগের ছাত্রী, নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের মাতা বিখ্যাত গায়িকা অমিতা সেন (খুকু) :
…গান শেখাবার সময়ে দিনেন্দ্রনাথ সাধারণত কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতেন না, গান গেয়ে যেতেন। আমরা দু-একবার শুনে তাঁর সঙ্গে গাইতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত গানের সুরের প্রত্যেকটি সূক্ষ্মতম কাজ আমাদের আয়ত্ত না হত, ততক্ষণ কিছুতেই তিনি নিরস্ত হতেন না। সকল ছেলেমেয়ের শেখবার ক্ষমতা সমান ছিল না, কিন্তু কখনো তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে দেখিনি। কিছুতেই যেন তাঁর বিরক্তি হত না, কেবল একটি বিষয় ছাড়া – সে আর কিছু নয়, ভুল সুর কানে গেলে তিনি সইতে পারতেন না। যতক্ষণ সেটাকে শুধরে ঠিক সুরে গাওয়াতে না পারতেন ততক্ষণ যেন শিশুর মতোই চঞ্চল হয়ে পড়তেন। গানে তাঁর ক্লান্তি কখনো দেখিনি।…
…যে সময়ে যে কাজটি করবার কথা ঠিক সেই সময়ে সেই কাজ তিনি নিজে করতেন, অন্যকে দিয়ে করাতেন। দুপুরবেলা কলাভবনের একটার সময় দিনদার রিহার্সেল নেবার কথা; আমরা সব কে কোথায় আছি একটু দিবানিদ্রার চেষ্টায় – ঠিক সেই সময়ে রৌদ্রের ঝাঁজ মাথায় করে দিনদা এসে উপস্থিত; আর এসেই হাঁকডাক শুরু করে দিতেন। ভয়ে ভয়ে আমরা তাড়াতাড়ি খাতাপত্র হাতে এসে জুটলে গান শুরু হত। প্রত্যেকের খাতায় গানগুলি ঠিকমতো তুলে নেওয়া চাই, ফাঁকি দিয়ে কাজ ফেলে রেখে, এর কাঁধের উপর দিয়ে, ওর পিঠের উপর দিয়ে দেখে কোনোমতে কাজ সারলে চলবে না। পঁচিশ তিরিশ জনকে একসঙ্গে গান শেখাতে বসেও দিনদার কান পড়ে আছে সুরের নিখুঁত টানের উপরে – কোন কোনায় কে এতটুকু বেসুর করে ফেলল, তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলতেন, আর আগেই বলেছি ঠিক সুরটি আয়ত্ত না করা পর্যন্ত কিছুতেই তার নিস্তার ছিল না।…
দিনেন্দ্রনাথের গান শেখানো সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন :
…গুরুদেব আর দিনদার শেখাবার ধরন ছিল একই রকম। গানের ছত্র ধরে তাঁরা কোনোদিনই গান শেখাতেন না, বার বার সম্পূর্ণ গানটি গেয়ে যেতেন, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে যেতাম। এই ভাবে গাইতে গাইতে শুধু কণ্ঠস্থ নয় গানগুলি হৃদয়েও প্রবেশ করত।… দিনদার গলা গ্রামোফোন রেকর্ডে যা শোনা যায় তা কিছুই নয়। কেবল দিনদার একটি গলার আওয়াজই সমস্ত গানের দলের সঙ্গে বড়ো অর্গ্যানের মতো বেজে চলত। সে যারা শোনেনি তাদের বোঝানো যাবে না। গান শেখাবার আসরে গুরুদেব আসতেন খাতা হাতে দিনদাকে গান শেখাতে, গান শেখা হয়ে যেত – তাঁরা দুজনেই গেয়ে চলতেন আনন্দে – সৃষ্টির আনন্দে। কতদিন এমনি হয়েছে – আমি বিস্ময়ে একবার গুরুদেবের মুখের দিকে একবার দিনদার মুখের দিকে তাকিয়ে সে দৃশ্য দেখতাম। গান শুনতাম।…
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন দিনেন্দ্রনাথের গান শেখানো বিষয়ে, তাঁর মৃত্যুর পর :
…আমার সুরগুলিকে রক্ষা করা এবং তা যোগ্য এমনকী অযোগ্য পাত্রকেও সমর্পণ করা তার যেন একাগ্র সাধনার বিষয় ছিল। তাতে তার কোনোদিন ক্লান্তি বা ধৈর্যচ্যুতি হতে দেখিনি।… তাঁর চেষ্টা না থাকলে আমার অধিকাংশ গানই বিলুপ্ত হত।…
কবি আরো বলেছিলেন :
কবির সম্পদ হত নিরর্থক, তুমি যদি তারে
না লইতে আপনার করি, না দিতে সবারে।
বিশেষ করে যোগ্য পাত্র পেলে তাঁর উৎসাহ কোনো বাধাই মানত না। এই বিষয়ে সাহানা দেবীর 888sport sign up bonusকথা উল্লেখের যোগ্য :
…একবার খুব মজার একটা ব্যাপার হয়েছিল, দিনুদা কলকাতায় এসেই টেলিফোনে ডেকে বললেন, ‘ঝুনু, চলে এস, অনেক নতুন গান আছে।’ আমি ত ছফফট করছি যাবার জন্যে, এদিকে মুস্কিল গাড়িও কিছুতেই জোগাড় করে ওঠা গেল না। ভবানীপুর থেকে জোড়াসাঁকো তো কম দূরের পথ নয় – আমি আছি মামার বাড়ি রসা রোডে, আর ওঁরা জোড়াসাঁকোয়। গাড়ি নেই। তর সইছে না। তখন আমার মামার [চিত্তরঞ্জন দাশ] আপিসঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই টেলিফোন যোগে চোদ্দটা গান শিখে নেওয়া গেল। দিনুদা জোড়াসাঁকো থেকে টেলিফোনে গাইছেন আর আমি ভবানীপুর রসা রোডে টেলিফোন ধরে গান শিখছি – সে ভারি মজা! কবি তো শুনে অবাক! এই কথা যে কত লোককে উনি পরে বলেছিলেন – ‘এমন গানপাগলা আমি আর কোনো মেয়েকে দেখলুম না।’…
গান শেখানো ছাড়াও দিনেন্দ্রনাথের আর একটি অসাধারণ গুণ ছিল, স্বরলিপি করবার অসামান্য ক্ষমতা। যাঁরাই তাঁকে স্বরলিপি করতে দেখেছেন তাঁদের অনেকেরই 888sport sign up bonusকথায় তার মুগ্ধ উল্লেখ দেখা যায়। অমিতা সেন (খুকু) লিখেছেন :
দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপি তাঁকে অমর করে রাখবে। স্বরলিপি লিখতে তাঁকে দেখেছি চিঠি লেখার মতন; কোনো যন্ত্রের সাহায্য নিতেন না, গুনগুন করেও গাইতেন না, সুর তাঁর মাথার মধ্যে খেলা করে বেড়াত, তিনি শুধু কাগজেকলমে তার প্রতিলিপি লিখে যেতেন অতি সহজে, অবলীলাক্রমে – সেও যেন এক খেলা।…
সাধারণত যাঁরা স্বরলিপি প্রস্তুত করেন তাঁরা সকলেই গুনগুন করে সুরটি আওড়ান, আঙুলে কড় গুনে তাল ঠিক রাখেন। কিন্তু দিনেন্দ্রনাথ যখন স্বরলিপি প্রস্তুত করতেন অথবা ছাত্রদের করা স্বরলিপি পরীক্ষা করতেন, কখনো এসব করতেন না – লোকে যেমন স্বচ্ছন্দ গতিতে চিঠি লিখে যায়, তিনিও তেমনি স্বচ্ছন্দ গতিতে স্বরলিপি রচনা করে যেতে পারতেন। সম্ভবত বাল্যকালে সেন্ট জেভিয়ার্স ইশকুলে এবং বিলেতে বাসকালে ইয়োরোপীয় পদ্ধতিতে সংগীত শিক্ষা করেছিলেন বলে এই ভারতীয়-দুর্লভ গুণটি তাঁর আয়ত্তে এসেছিল।
তিনি এসে যখন থেকে শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বাস করতে আরম্ভ করলেন, তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের আরম্ভ হলো। এর আগে তাঁর গানের প্রধান ছাত্রী ছিলেন তাঁর কয়েকটি দীপ্যময়ী ভ্রাতুষ্পুত্রী ও ভাগিনেয়ী – প্রতিভা দেবী, ইন্দিরা দেবী, সরলা দেবী, অভিজ্ঞা দেবী। রবীন্দ্রনাথের গানের সেই আদিযুগে গানগুলি সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার কাজটিও এঁরাই করেছেন। তাঁর প্রথম যুগের গানগুলি যে আমাদের কাল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে তার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রধানত এই চারজনের প্রাপ্য।
বাঙালি মেয়েদের সেই অন্তঃপুরের অন্ধকারে বাস করার যুগে, ঠাকুরবাড়ির এই সুন্দরী তরুণীদের দেখতে, এঁদের গলায় গান শুনতে মাঘোৎসবের দিন সকালে ও বিকেলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় মানুষের ঢল নামত। এঁদের গলায় প্রচারিত হয়ে হয়েই রবীন্দ্রনাথের গান ঠাকুরবাড়ির প্রাচীরের বাইরে, ব্রাহ্মসমাজের চৌহদ্দিও ছাড়িয়ে, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে আরম্ভ করে।
কিন্তু ক্রমে এঁরা কালের নিয়মেই দূরে সরে গেছেন। প্রতিভাসুন্দরী পতিগৃহে চলে গেছেন (১৮৮৬), অভিজ্ঞার মৃত্যু হয়েছে (১৮৯৫?), ক্রমে ইন্দিরা আর সরলারও বিবাহ হয়ে গেল (যথাক্রমে ১৮৯৯ এবং ১৯০৫)। শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হলো (১৯০১), রবীন্দ্রনাথ সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করতে আরম্ভ করলেন; আগে তাঁর গান প্রধানত বাড়ির ছেলেমেয়েরাই শিখতেন, এখন শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাও শিখতে আরম্ভ করেছেন। ক্রমে গান শেখার ব্যাপারে বাড়ির ছেলেমেয়েদের তুলনায় ছাত্রছাত্রীরাই অগ্রাধিকার পেতে শুরু করলেন।
সরলা দেবী তাঁর জীবনের ঝরাপাতায় লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে রবিমামার আশ্রম জমে উঠবার পর থেকে তিনি বাড়ির ছেলেমেয়ের ত্যাজ্য করে তাঁর আশ্রমের ছেলেমেয়েদের প্রাধান্য দিতে লাগলেন। ১১ই মাঘের উৎসবের জন্যে গান ও বাজনার প্র্যাকটিসে বাড়ির ছেলেমেয়েদের আর যোগ রইল না। বোলপুর আশ্রমের ছেলেমেয়েরাই একেবারে সেখান থেকে তৈরি হয়ে এসে গাইতে বসে যায়।…’
এই সময়ে দিনেন্দ্রনাথ খুব স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারীর আসনটিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন। সকলেই জানেন রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করে সুর ভুলে যেতেন – এবং তিনি নিজে স্বরলিপি করতে জানতেন না বা করতে চাইতেন না। তাই গানে সুর দিয়েই তাঁর প্রথম কাজ ছিল দিনেন্দ্রনাথকে সেটি শিখিয়ে দেওয়া। দিনেন্দ্রনাথও তাঁর গান শেখবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকতেন – এই নিয়ে নানাজনের 888sport sign up bonusকথায় অজস্র চিত্তাকর্ষক কাহিনীর বর্ণনা আছে।  শিখে নিয়ে দিনেন্দ্রনাথ গানটির স্বরলিপি করতেন, এবং তারপর অন্যদের শেখাতেন।
দিনেন্দ্রনাথ যতদিন শান্তিনিকেতনে ছিলেন (১৯০৬-৩৪) সেই ২৮ বছরে রবীন্দ্রনাথের রচিত গানের 888sport free bet কমবেশি এক সহস্রের বেশির ভাগ গানেরই প্রথম ছাত্র, ও স্বরলিপিকার, হলেন দিনেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের কাছে দিনেন্দ্রনাথের গান শেখা প্রত্যক্ষ করেছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের শিক্ষক তেজেশচন্দ্র সেন, তিনি লিখেছেন :
…গুরুদের নিত্যনতুন সুরসৃষ্টি করলেও, নিজের গানের সুর ভুলে যাবার ক্ষমতাও তাঁর অসাধারণ। সেই জন্য গানে সুর দিয়েই তিনি দিনুবাবুকে ডেকে পাঠাতেন; – কখনো কখনো তিনি নিজেই গানের খাতা হাতে করে, গানের সুর গুনগুন করতে করতে দিনুবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন। তারপরেই শেখানোর ও শেখবার পালা আরম্ভ হত। সে সময় আমরাও সময় সময় উপস্থিত থাকতাম। দিনুবাবুর বাড়িতে সে সময়গুলির কথা কোনো দিন ভুলতে পারব না। সে সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই থাকতেন আনন্দে ভরপুর। উভয়েরই পা গানের তালে তালে উঠছে পড়ছে, হাতে তুড়ি বাজছে, গানের সুর আবৃত্তির পর আবৃত্তি হচ্ছে, উভয়েরই মুখ উজ্জ্বল, চোখে আনন্দের দীপ্তি। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি, এক একবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি।
এমনও ঘটেছে, øান করতে ঢুকে রবীন্দ্রনাথের মনে এসেছে সুর – ভৃত্যকে পাঠিয়ে তৎক্ষণাৎ ডাকিয়ে আনিয়েছেন দিনেন্দ্রনাথকে। তিনি এসে øানঘরের বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ øানঘর থেকে গাইছেন, দরজার এপারে দাঁড়িয়ে দিনেন্দ্রনাথ গলায় তুলে নিচ্ছেন সেই গান।
১৩২৪ বঙ্গাব্দে তাঁর করা প্রথম স্বরলিপিগ্রন্থ প্রকাশিত হলো – গীতলেখা ১ম ভাগ। এই সময় থেকে আরম্ভ করে তাঁর মৃত্যুর পরে পর্যন্তও তাঁর কৃত রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বাইশশো গানের মধ্যে সাতশো গানের অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গানের স্বরলিপি দিনেন্দ্রনাথের করা।
তবে দিনেন্দ্রনাথের করা স্বরলিপিসমূহের বিশুদ্ধতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে সংশয়ও ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে (২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩২১ তারিখে) লেখা একটি চিঠিতে দেখতে পাচ্ছি :
…আমার মুস্কিল এই যে সুর দিয়ে আমি ভুলে যাই। দিনু কাছে থাকলে তাকে শিখিয়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তমনে ভুলতে পারি। নিজে যদি স্বরলিপি করতে পারতুম কথাই ছিল না। দিনু মাঝে মাঝে করে কিন্তু আমার বিশ্বাস সেগুলো বিশুদ্ধ হয় না। সুরেন বাঁড়–জ্যের সঙ্গে আমার দেখাই হয় না – কাজেই আমার খাতা এবং দিনুর পেটেই সমস্ত জমা হচ্চে।…
ইন্দিরা দেবীও এ নিয়ে অভিযোগ করেছেন, ‘বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে’ গানটির দিনেন্দ্রনাথ-কৃত স্বরলিপির বিশুদ্ধতা নিয়ে তাঁর অভিযোগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর একাধিক পত্রব্যবহার হয়েছে। দিনেন্দ্রনাথ নাকি ইচ্ছাপূর্বক কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথের আরোপিত সুরের পরিবর্তে নিজের সুর ব্যবহার করেছেন, তবে          এ-অভিযোগ সত্য কিনা, কতদূর সত্য, যদি করেই থাকেন তাহলে কী উদ্দেশ্যে করেছিলেন, এসব প্রশ্ন পরীক্ষা করবার আজকের দিনে আর কোনো উপায় নেই।
১৯১৬ সালে প্রকাশিত ফাল্গুনী গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেন দিনেন্দ্রনাথকে। উৎসর্গপত্রে লেখেন :
যাহারা ফাল্গুনীর ফল্গুনদীটিকে বৃদ্ধ কবির
চিত্তমরুর
তলদেশ হইতে টানিয়া আনিয়াছে তাহাদের
এবং সেই সঙ্গে
সেই বালকদলের সকল নাটের কাণ্ডারী
আমার সকল গানের ভাণ্ডারী
শ্রীমান দিনেন্দ্রনাথের হস্তে
এই নাট্যকাব্যটিকে কবি-বাউলের একতারার মতো সমর্পণ করিলাম।
১৫ ফাল্গুন ১৩২২
বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হল ৮ পৌষ ১৩২৫ (২২ ডিসেম্বর ১৯১৯)। পরের শ্রাবণ মাসে তার প্রথম কর্মসূচি প্রকাশিত হলো। সেখানে দেখতে পাচ্ছি, 888sport app বিষয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান শেখাবেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় অথবা বিশ্বভারতী কোনোখানেই, পরিচালনা যাঁরা করবেন তাঁদের কোনো তালিকাতেই, দিনেন্দ্রনাথের নাম নেই।
বাস্তবিকপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সর্বাংশে মধুময় ও গীতমুখর ছিল না। নানা কারণে দিনেন্দ্রনাথের মন মাঝে মাঝেই বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠত – তখন তিনি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে যেতেন, কিছু দিন পর আবার ফিরেও আসতেন। তাঁর নানা আচরণে অসংগতিরও প্রকাশ হত। প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের নানা পত্রের অপ্রকাশিত অংশে তার উল্লেখ আছে (দ্র. রবিজীবনী ৬/২৯২)। তাঁর এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের সম্পাদকগণ যতœ নিয়েছেন যাতে এই সংবাদটি সাধারণ পাঠকের লক্ষগোচর না হয় – না হলে তাঁরা ছাপবার সময়ে সেই অংশগুলি বর্জন করতেন না।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনীতে লিখেছেন, ২৩ নভেম্বর ‘নোবেল প্রাইজ’ প্রাপ্তি উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের যে-সংবর্ধনাসভা হয় সেখানে বেদমন্ত্র পাঠ করেন ক্ষিতিমোহন সেন ও দিনেন্দ্রনাথ। কিন্তু এই আপাত-স্বাভাবিকতার তলে তলে অসন্তোষের একটি চাপা স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল –  শান্তিনিকেতনের পরিচালকদের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথের আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৯ সালের এপ্রিল মাসে দ্বিজেন্দ্রনাথ পারিবারিক জমিদারিতে তাঁর অংশ বাৎসরিক ৪৫,০০০ টাকার বিনিময়ে সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথকে ইজারা দিয়ে দেন।
দ্বিপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়েছিল ১৯২২ সালে, দ্বিজেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৯২৬ সালে। এর পর ইজারার প্রাপ্য নিয়ে দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের পরিবারের নানা গোলমাল আরম্ভ হয়। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে মনান্তর হয়েছিল নাকি টাকাপয়সা নিয়েই। ‘শোনা যায়’ যোগ করে সুভাষ চৌধুরী লিখেছেন :
…শোনা যায় প্রায় প্রতি বছর গরমের ছুটিতে দিনেন্দ্রনাথ দার্জিলিং বেড়াতে যেতেন। জয়ন্তী উৎসবের [১৯৩১ সালে, সপ্ততিতম রবীন্দ্রজয়ন্তী] প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর বিশ্রাম লাভের জন্য দার্জিলিং যাওয়ার খরচপত্রের কারণে বোধ করি ট্রাস্টির কাছ থেকে তাঁর বাৎসরিক প্রাপ্য ৫০০ টাকা রথীন্দ্রনাথ দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় দিনেন্দ্রনাথ যেমন ক্ষুব্ধ তেমন মর্মাহত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বভাববশত তিনি নীরবই ছিলেন।…
এর পরেও তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন প্রায় তিন বছর, ১৯৩২ সালে ‘বর্ষামঙ্গল’ করলেন, পরের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর পরিচালনায় কালের যাত্রা অভিনীত হলো, ১৭ ডিসেম্বর তাঁর পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন পালিত হলো সন্ধ্যায় আম্রকুঞ্জে, রবীন্দ্রনাথের পৌরোহিত্যে। যদিও,  এই উপলক্ষে তাঁর উদ্দেশে রচিত রবীন্দ্রনাথের দু-লাইনের আশীর্বাণীটি কেমন যেন বর্ণহীন, যাকে ইংরেজিতে বলে ষধপশষঁংঃৎব :
প্রথম পঞ্চাশ বর্ষ রচি দিক প্রথম সোপান
দ্বিতীয় পঞ্চাশ তাহে গৌরবে করুক অভ্যুত্থান।
দিনেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে উষ্ণ সম্পর্কের কথা আমরা শুনতে অভ্যস্ত সে-পটভূমিতে দ্বিপদীটি কেমন বেখাপ্পা লাগে – যেন কোনো অর্ধপরিচিত মানুষের অনুরোধে চিন্তা না করে তৎক্ষণাৎ লিখে দেওয়া, যেমন তিনি আরো অজস্র লিখেছিলেন। যে-মানুষ তাঁর ‘সকল গানের ভাণ্ডারী’, তাঁর সাতশোরও বেশি গানের স্বরলিপিকার, মধ্যরাত্রে যিনি সুরসৃষ্টিতে মগ্ন পদচারণারত কবির পিছনে পিছনে খাতা-পেনসিল হাতে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতেন স্বরলিপি লিখে রাখার জন্য, তাঁর পঞ্চাশতম জন্মদিনে বিশ্বকবির এই দায়সারা বাণী মেনে নিতে কষ্টই হয় আমাদের।
দিনেন্দ্রনাথ  সম্পর্কে  রবীন্দ্রজীবনীকার  প্রভাতকুমার  মুখোপাধ্যায়ের অস্বস্তিও  চোখে  পড়বার মতো।  দিনেন্দ্রনাথ যে-শান্তিনিকেতন ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে গেলেন, রবীন্দ্রনাথের গানের দৃষ্টিকোণ থেকে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটির কোনো বিশ্লেষণ নেই বিপুলাকার রবীন্দ্রজীবনীতে। পাঠক অনুভব করতে পারেন, নেপথ্যে একটা অস্বাচ্ছন্দ্য কার্যকর – বা কোথায় যেন অপ্রীতিকর কিছু একটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা লুকিয়ে রয়েছে। তাঁর মৃত্যুসংবাদটি পরিবেশন করবার পর প্রভাতকুমার যে-পাদটীকাটি যোগ করেছেন সেটিও গোপন তথ্যের চাপে অস্বস্তিকর ঠেকে। পাদটীকায় তিনি লিখেছেন :
…এত দীর্ঘকালের সম্পর্ক দিনেন্দ্রনাথ কেন ছিন্ন করিয়া গেলেন তাহা নানা জটিল বৈষয়িক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত; তাহার আলোচনা নি®প্রয়োজন।…
পাঠকের জন্য কিন্তু ‘নি®প্রয়োজন’ ছিল না। এমনি নি®প্রয়োজন ছিল না বলে এই রবীন্দ্রজীবনীকারই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিষেধ সত্ত্বেও কবির পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে অপ্রিয় সত্য জানিয়ে জীবনীকারের সঠিক ধর্ম পালন করে প্রশংসার্হ হয়েছিলেন। আমরা জানতে চাই, সেই ‘জটিল বৈষয়িক ঘটনা’কে রবীন্দ্রনাথ কতখানি গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিলেন যে, তাঁর গানের প্রধান ভাণ্ডারীর নির্বাসনে যাওয়াও তিনি নিঃশব্দে মেনে নিয়েছিলেন।
দিনেন্দ্রনাথের অবর্তমানে শান্তিনিকেতনে স্বরলিপির চর্চাকারী সে-সময় আর কেউ ছিলেন না, দক্ষতায় যিনি তাঁর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন। এ-কথা রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ভালো করে তো আর কেউ জানতেন না। স্বরলিপির ব্যাপারে দিনেন্দ্রনাথ যে কতখানি অপরিহার্য ছিলেন তা তাঁর ছাত্র ও পরবর্তীকালে সংগীতভবনের অধ্যক্ষ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের 888sport sign up bonusকথায়ও বর্ণিত আছে।
গীতবিতানের কোথাও দিনেন্দ্রনাথের নাম নেই কেন? রবীন্দ্রনাথ পোর্ট সৈয়দের পথে জাহাজ থেকে তাঁকে চিঠি লিখছেন (১৬ মার্চ ১৯৩০) : ‘…নতুন গানের বই ছাপতে দিয়ে এসেছি – একত্রে সব গান পুঞ্জিত হবে। তুই দেখে দিস যাতে প্রমাদ না ঘটে। খুব হাল আমলের গানগুলো অনবধানে বাদ না পড়ে যেন।…’ গীতবিতান  প্রস্তুত করবার ভার সরকারিভাবে যাঁর উপর ন্যস্ত ছিল সেই সুধীরচন্দ্র কর দিনেন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘আপনার তৈরি গানের তালিকা দেখিয়াই একরকম এই মূল সূচি তৈরি করিয়াছি।…’ পরে আরেকটি চিঠিতে লিখছেন, ‘গুরুদেব শুধু নাম সম্পর্কে একটু মত দিয়াছেন নাম আপনি ঠিক করিয়া জানাইবেন। সূচির ওপরে যদিও আমি কাজ চালাইবার জন্য একটি নাম লিখিয়াছি তবু সেটাতে কিছু মনে করিবেন না। আপনি একটা নাম ঠিক করিয়া লিখিবেন।…’ আরো লিখেছেন, ‘আপনার নির্দেশমত সম্পাদকীয় নিবেদন হিসাবে কিছু লেখা ইহাতে যাইবে।…’
উল্লিখিত পত্রাংশগুলি সবই সুভাষ চৌধুরীর ‘দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর : শতবর্ষের 888sport apk download apk latest versionঞ্জলি’ (দেশ, 888sport live football888sport free bet, ১৩৯০) থেকে উদ্ধৃত। তিনি উৎস উল্লেখ করেননি, রবীন্দ্রনাথের চিঠিটিও প্রকাশিত কিনা বলেননি। তবে সুধীরচন্দ্র করের চিঠিগুলি রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত আছে বলে অনুমান করা যায়।
এই সব পত্রাংশ থেকে বোঝা যায়, গীতবিতানের সংকলকদের মধ্যে দিনেন্দ্রনাথের অত্যন্ত সম্মানের একটি আসন ছিল, সম্ভবত প্রধানতম আসনটিই। কাজগুলি হয়তো করে তুলেছিলেন সুধীরচন্দ্র কর, কিন্তু গ্রন্থের পাঠ বিষয়ে প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন দিনেন্দ্রনাথই। কিন্তু গ্রন্থ যখন প্রস্তুত হলো এবং কবির জীবৎকালেই দুই খণ্ডে প্রকাশিত হল – দেখা গেল তার মধ্যে কোথাও দিনেন্দ্রনাথের নামটুকুর পর্যন্ত স্থান হলো না।
গীতবিতানের প্রথম দুই খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৩৩৮ এবং তৃতীয় খণ্ড ১৩৩৯ সনে। সেই ‘কালানুক্রমিক’ সংস্করণটি রবীন্দ্রনাথের মনঃপূত হয়নি, বিশেষত ‘ব্যবহারযোগ্যতা’র দিক দিয়ে। আরেকটা ‘ভিতরের তাগিদে’ও সেটি নিঃশেষ হওয়ার আগেই অস্থির হয়ে কবি প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডের ভাবানুক্রমিক বা বিষয়ানুক্রমিক পরের সংস্করণটি প্রস্তুত করেন –  যদিও খণ্ড দুটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৩৪৮ সনের মাঘ মাসে। কবি কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত এ-সংস্করণটির অনুসরণেই গীতবিতানের তৃতীয় অর্থাৎ শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হয় ১৩৫৭ সনে। এই তিন খণ্ড মিলেই আমাদের আজকের প্রচল সংস্করণ অখণ্ড গীতবিতান।
এতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর গীতের কথিত ‘ভাণ্ডারী’র নামটিকে গীতবিতানের ভুবনে প্রবেশাধিকার দেননি কবি সজ্ঞানেই। কিন্তু কারণটা কী? জবাবটা সবাই চেপে রেখেছেন। তাই আমরা ভেবে পেয়েছি যে, কারণটা দিনেন্দ্রনাথের প্রতি ইন্দিরা ও রথীন্দ্রনাথের বিরক্তি এবং এঁদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনুরক্তি। এ-ধরনের স্বজনপ্রীতির অপবাদ বিভিন্ন ব্যাপারে গুরুদেবকে মুখোমুখি বারবার দিয়েছেন তাঁর অনেক ঘনিষ্ঠ পরিকর।
কিন্তু কোনো পরিবর্তন যে তাঁরা আনতে পারেননি, তার একটি জাজ্বল্যমান উদাহরণ শান্তিনিকেতনে কবির পালিতা দৌহিত্রী নন্দিনীর (১৯২১-৯৫) বিলাসবহুল বিবাহ অনুষ্ঠান (৩০ ডিসেম্বর, ১৯৩৯)। বাড়াবাড়ি আড়ম্বরটা ছিল নন্দিনীর পালক পিতামাতা রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর উদ্যোগে ও আয়োজনে। কবির বিরূপ প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ ছিল এ মন্তব্যে : এসব সে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে করতে পারত, আমার শান্তিনিকেতনে কেন? বললেন বটে, তবে বিয়েটিতে পৌরোহিত্য করলেন এবং এ-বিয়ে উপলক্ষে তিনখানা গানও রচনা করলেন – ‘নবজীবনের যাত্রাপথে দাও এই বর’, ‘প্রেমের মিলনদিনে সত্যসাক্ষী যিনি’ এবং ‘সুমঙ্গলী বধূ’।
দিনেন্দ্রনাথের নাম অনুপস্থিত কেবল গীতবিতানেই নয়। স্বরলিপিকার দিনেন্দ্রনাথের নাম মুদ্রিত হয়নি তিন বছর পূর্বে প্রকাশিত গীতমালিকা ১ম ভাগ (১৩৩৩) এবং গীতমালিকা ২য় ভাগের (পৌষ ১৩৩৬) কোথাও – সুভাষ চৌধুরী লিখেছেন, তাও ইচ্ছাকৃতভাবেই। পারিবারিক মনোমালিন্য? কিন্তু তা কবির সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার গীতের গৃহে হানা দেবে কেন?
২৩ নভেম্বর ১৯৩৩, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের দল নিয়ে বোম্বাই পৌঁছলেন তাসের দেশ ও শাপমোচন অভিনয়ের জন্য। রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন, ‘দিনেন্দ্রনাথ আছেন গানের দল সামলাইবার জন্য।’ শান্তিনিকেতনের দলের সঙ্গে দিনেন্দ্রনাথের গান বা অভিনয়ের যোগ এখানেই শেষ। পরের বছর অক্টোবরে, নাটোরের মহারাজার বাড়িতে ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ, সভায় উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই তাঁদের শেষ সাক্ষাৎ।
সুভাষ চৌধুরী  লিখেছেন, ‘একটি প্রত্যাশা তাঁর শেষ পর্যন্ত ছিল – হয়তো রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ফিরে ডাকবেন – কিন্তু তাঁর সেই সাধটি অপূর্ণই থেকে গেল।  দিনেন্দ্রনাথ  সব চেয়ে  নিদারুণ  আঘাত পেলেন যখন রথীন্দ্রনাথ অর্থের বিনিময়ে তাঁকে শান্তিনিকেতনে ফিরে যাবার প্রস্তাব পাঠালেন। শান্তিদেব ঘোষ যখন দেখা করতে এসেছেন, তখন দিনেন্দ্র-পতœী কমলা দেবী তাঁকে বলেছেন, ‘রবিদাকে বলো যদি ওঁকে একবার ডাকেন।’ শান্তিদেব সে-কথা রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেও দিয়েছিলেন – তাতেও কোনো সাড়া মেলেনি।’
দিনেন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পর প্যারিস থেকে প্রকাশিত হল আর্নল্ড বাকের করা রবীন্দ্রনাথের ২৬টি গানের পাশ্চাত্য স্বরলিপি – ভূমিকায় বাকে 888sport app download for android করলেন দিনেন্দ্রনাথকে, ‘who by his untiring patience and assistance has made the publication possible.’তাঁর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুসংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছালে মন্দিরে উপাসনা করে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন তার মধ্যে ছিল :
…এই আশ্রমকে আনন্দনিকেতন করবার জন্য তরুলতার শ্যাম শোভা যেমন, তেমনি প্রয়োজন ছিল সংগীতের উৎসবের। সেই আনন্দ উপচার সংগ্রহের প্রচেষ্টার প্রধান সহায় ছিলেন দিনেন্দ্র।… আমি যে সময়ে এখানে এসেছিলাম, তখন আমি ছিলাম ক্লান্ত; আমার বয়স তখন অধিক হয়েছে – প্রথমে যা পেরেছি, শেষে তা-ও পারিনি। আমার কবিপ্রকৃতিতে আমি যে গান করেছি, সেই গানের বাহন ছিলেন দিনেন্দ্র।… দিনেন্দ্রের দান এই যে আনন্দের রূপ, এ তো যাবার নয় – যতদিন ছাত্রদের সংগীতে এখানকার শালবন প্রতিধ্বনিত হবে, বর্ষে বর্ষে নানা উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন চলবে, ততদিন তাঁর 888sport sign up bonus বিলুপ্ত হতে পারবে না, ততদিন তিনি আশ্রমকে অধিগত করে থাকবেন।…
এসব স্ববিরোধিতার অর্থ কী? অর্থ এই যে, বহু ক্ষেত্রেই স্ববিরোধিতা ছিল রবীন্দ্রনাথের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা। পুনরাবৃত্তি হলেও রবীন্দ্র-স্ববিরোধিতার একটি চূড়ান্ত উদাহরণ প্রসঙ্গক্রমে এখানেও দিতেই হয়। বিধবাবিবাহ আইন (১৮৫৬) কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ গ্রহণ করেনি। কিন্তু 888sport appর উদারমনা ব্রাহ্ম যুবকেরা বিদ্যাসাগরের আদর্শ রূপায়িত করতে অগ্রসর হলেন। তাঁদের সামাজিক আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল – ১. নাবালিকা বিধবার পুনর্বিবাহের ব্যবস্থা করা এবং ২. যে কোনও উপায়ে কিশোরী কুলীন কন্যার বহুপতœীক বৃদ্ধের সঙ্গে বিবাহ প্রতিরোধ করা। কৌলীন্য বজায় রাখতে কোনো বৃদ্ধ বা অতিবৃদ্ধর সঙ্গে কিশোরীর বিবাহ মানেই তাকে অকালবৈধব্যের দিকে ঠেলে দেওয়া।
888sport appর নিশিকান্ত-নবকান্ত-শীতলাকান্ত তিন চাটুজ্যে ভ্রাতা ও তাঁদের সমমনোভাবাপন্ন বন্ধুরা এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ব্রাহ্ম যুবকেরা যে-অসহায় বালিকাদের হৃদয়হীন অভিভাবকদের কাছ থেকে ‘অপহরণ’ করতেন, তাঁদের কলকাতায় (দেশবন্ধুর জ্যেষ্ঠতাত) দুর্গামোহন দাশ (১৮৪১-৯৭), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯) অথবা নব্যভারত সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর (১৮৫৪-১৯২০) গৃহে পৌঁছিয়ে দিতেন।
স্বভাবতই এই সামাজিক আন্দোলন কলকাতার রক্ষণশীলদের বিষনজরে পড়ে গেল। ভারতবর্ষীয় বৈধব্যের জয়গান করে প্রবীণ প্রাবন্ধিক অক্ষয়চন্দ্র সরকার একটি জনসভায় বললেন :
একটি পরিবারের সহিত একটি হিন্দুকুমারীর বিবাহ হয়; কেবল একটি পুরুষের সহিত নহে।… হিন্দুরমণী একবার যে কুলে গৃহীতা, নীতা ও পরিণীতা হইয়াছে সে কোন প্রকারেই আর সে কুল ত্যাগ করিতে পারে না। কুল-ত্যাগিনী কুলটা ব্যভিচারিণী আমাদের হিন্দুদের অভিধানে একই পর্যায়ভুক্ত।
অতীব বিস্ময়ের বিষয় যে, নবীন প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথও প্রকারান্তরে এই প্রগতিবিরোধী পক্ষেরই ওকালতি করলেন – যেমন তাঁর সমাজ-নামক গ্রন্থের ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’-শীর্ষক রচনায়। রচনাটির অংশবিশেষ নিম্নে উদ্ধৃত হলো :
বাহ্য সাদৃশ্যে আমাদের বিধবা য়ুরোপীয় চিরকুমারীর সমান হলেও প্রধান একটা বিষয়ে প্রভেদ আছে। আমাদের বিধবা 888sport promo codeপ্রকৃতি কখনো শুষ্ক শূন্য পতিত থেকে অনুর্বরতা লাভের অবসর পায় না। তাঁর কোল কখনো শূন্য থাকে না, বাহু দুটি কখনো অকর্মণ্য থাকে না, হৃদয় কখনো উদাসীন থাকে না। তিনি কখনো জননী কখনো দুহিতা কখনো সখী। এইজন্যে চিরজীবনই তিনি কোমল সরল স্নেহশীল সেবাতৎপর হয়ে থাকেন। বাড়ির শিশুরা তাঁরই চোখের সামনে জন্মগ্রহণ করে এবং তাঁরই কোলে কোলে বেড়ে ওঠে। বাড়ির 888sport app মেয়েদের সঙ্গে তাঁর বহুকালের সুখদুঃখময় প্রীতির সখিত্ববন্ধন, বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে স্নেহভক্তিপরিহাসের বিচিত্র সম্বন্ধ; গৃহকার্যের ভার যা স্বভাবতই মেয়েরা ভালোবাসে তাও তাঁর অভাব নেই। এবং ওরই মধ্যে রামায়ণ মহাভারত দুটো-একটা পুরাণ পড়বার কিংবা শোনবার সময় থাকে, এবং সন্ধ্যাবেলায় ছোটো ছোটো ছেলেদের কোলের কাছে টেনে নিয়ে উপকথা বলাও একটা স্নেহের কাজ বটে। বরং একজন বিবাহিত রমণীর বিড়ালশাবক এবং ময়না পোষবার প্রবৃত্তি এবং অবসর থাকে, কিন্তু বিধবাদের হাতে হৃদয়ের সেই অতিরিক্ত কোণটুকুও উদ্বৃত্ত থাকতে প্রায় দেখা যায় না।
এই-সকল কারণে, তোমাদের যে-সকল মেয়ে প্রমোদের আবর্তে অহর্নিশি ঘূর্ণ্যমান কিংবা পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রবৃত্ত, কিংবা দুটো-একটা কুকুরশাবক এবং চারটে-পাঁচটা সভা কোলে করে একাকিনী কৌমায কিংবা বৈধব্য যাপনে নিরত, তাঁদের চেয়ে যে আমাদের অন্তঃপুরচারিণীরা অসুখী, এ কথা আমার মনে লয় না। (রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বাদশ খণ্ড, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৮০, বিশ্বভারতী, পৃ ২৪১)।
হিন্দু বিধবাদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল এই লজ্জাকর বয়ানটি তাঁরই ‘চারিত্রপূজা’ 888sport liveের ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ শীর্ষক রচনার সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে কবির স্ববিরোধিতার মাত্রাটি সঠিক বোঝা যাবে। রচনাটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত হল :
বিদ্যাসাগর বালবিধবাবিবাহের ঔচিত্য সম্বন্ধে যে প্রস্তাব করিয়াছেন তাহাও অত্যন্ত সহজ; তাহার মধ্যে কোনো নূতনত্বের অসামান্য নৈপুণ্য নাই। তিনি প্রত্যক্ষ ব্যাপারকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া এক অমূলক কল্পনালোক সৃজন করিতে আপন শক্তির অপব্যয় করেন নাই। তিনি তাঁহার বিধবাবিবাহগ্রন্থে আমাদিগকে সম্বোধন করিয়া যে আক্ষেপোক্তি প্রকাশ করিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিলেই আমার কথাটি পরিষ্কার হইবে। –
হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ!… তোমরা প্রাণতুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রণানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছ; তাহারা দুর্নিবার-রিপু-বশীভূত হইয়া ব্যভিচারদোষে দূষিত হইলে, তাহার পোষকতা করিতে সম্মত আছ; ধর্মলোপভয়ে জলাঞ্জলি দিয়া কেবল লোকলজ্জাভয়ে, তাহাদের ভ্রƒণহত্যার সহায়তা করিয়া, স্বয়ং সপরিবারে পাপপঙ্কে কলঙ্কিত হইতে সম্মত আছ; কিন্তু, কি আশ্চর্য! শাস্ত্রের বিধি অবলম্বনপূর্বক তাহাদের পুনরায় বিবাহ দিয়া, তাহাদিগকে দুঃসহ বৈধব্য যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ করিতে এবং আপনাদিগকেও সকল বিপদ হইতে মুক্ত করিতে সম্মত নহ। তোমরা মনে কর, পতিবিয়োগ হইলেই, স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায়; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না; দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায়। কিন্তু, তোমাদের এই সিদ্ধান্ত যে নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক, পদে পদে তাহার উদাহরণ প্রাপ্ত হইতেছ। ভাবিয়া দেখ, এই অনবধানদোষে, সংসারতরুর কি বিষময় ফল ভোগ করিতেছ।
রমণীর দেবীত্ব ও বালিকার ব্রহ্মচর্যামাহাত্ম্যের সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর আকাশগামী ভাবুকতার ভূরিপরিমাণ সজল বাষ্প সৃষ্টি করিতে বসেন নাই; তিনি তাঁহার পরিষ্কার সবল বুদ্ধি ও সরল সহৃদয়তা লইয়া সমাজের যথার্থ অবস্থা ও প্রকৃত বেদনায় সকরুণ হস্তক্ষেপ করিয়াছেন। কেবলমাত্র মধুর বাক্যরসে চিঁড়াকে সরস করিতে সে’ই চায় যাহার দধি নাই। কিন্তু বিদ্যাসাগরের দধির অভাব না থাকাতে বাক্পটুতার প্রয়োজন হয় নাই। (রবীন্দ্র রচনাবলী. চতুর্থ খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৭৪, পৃ ৪৯৮-৯৯)।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘দধি’র অভাববশতই বিধবাদের সম্বন্ধে তাঁর উপরোদ্ধৃত ‘বাক্পটুতা’র প্রয়োজন হয়েছে। এই একই হেতু থেকে উদ্ভূত বাক্পটুতা গুরুদেবের ভাষণ-বাণীর উল্লেখযোগ্য একটা অংশ জুড়ে আছে।

চলে গেলেন অজিতকুমার চক্রবর্তীও
আদি নিবাস বরিশালের উজিরপুর থেকে আগত ট্রিপল অনার্স নিয়ে বি.এ. পড়ার সময় স্বল্পায়ু কবি সতীশচন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯০৪) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ে যোগদান করে গুরুদেব কর্তৃক ‘আদর্শ শিক্ষক’ আখ্যায়িত হন (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলা ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় শুরু করলেও অল্পকালের মধ্যে সতীশচন্দ্রই অভিধাটির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা)।
ফরিদপুরের মঠবাড়ি থেকে আগত অজিতকুমার চক্রবর্তী (১৮৮৬-১৯১৮) বন্ধু সতীশচন্দ্রের আদর্শে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে ত্যাগব্রতী শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। সুকণ্ঠ গায়ক ও সুদক্ষ 888sport live footballিক অজিতকুমার ছিলেন আদিযুগে রবীন্দ্র888sport live football ও রবীন্দ্রসংগীতের প্রামাণ্য ব্যাখ্যাতা। প্রথম রবীন্দ্রজীবনীকার (রবীন্দ্রনাথ) এবং রবীন্দ্র888sport live footballেরও প্রথম ব্যাখ্যাতা (রবীন্দ্রকাব্য পরিক্রমা) তিনিই। আধুনিক 888sport live footballের সুপাঠক ও সমঝদার অজিতকুমার চক্রবর্তী আগের কালের অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫০-৯৮) ও প্রিয়নাথ সেনদের (১৮৫৪-১৯১৬) প্রতিভূস্বরূপ তাঁর কালে কবির মনকে নিরন্তর জাগ্রত ও ওয়াকিবহাল রাখতেন।
অজিতকুমার রবীন্দ্রনাথের কিছু 888sport app download apk আনন্দ কেন্টিশ কুমারস্বামীর সহযোগিতায় ইংরেজিতে 888sport app download apk latest version করে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ১৯১০ সালে ম্যাঞ্চেস্টার বৃত্তি পেয়ে অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়ে সেখানেও তিনি বেশ কিছু রবীন্দ্র888sport app download apkর 888sport app download apk latest version প্রকাশ করেন। বলতে গেলে তাঁরই উদ্বুদ্ধ প্রয়াসে ও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগে ইংরেজির মাধ্যমে অবাঙালি সমাজ রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম আস্বাদন লাভ করেন। লক্ষণীয় যে, কবি-কৃত গীতাঞ্জলি 888sport app download apk latest version প্রকাশের আগেই অজিতকুমারের 888sport app download apk latest versionের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রকাব্য পরিচিতি পেয়েছিল।
প্রথমবার শান্তিনিকেতন-888sport slot gameের বিবরণে পিয়ারসন 17 Dec 1912 রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন : ‘[15 Dec] After dinner… ঠাকুরদাদা [ক্ষিতিমোহন]  read and explained to me some of the poems of কবীর. The poems seemed to vibrate with the rhythm of some mighty bell and it was wonderfully inspiring to have so enthusiastic an admirer of কবীর to explain the verses to me.’ উড়িষ্যার সমুদ্রতীরবর্তী চাঁদিপুরে পিয়ারসনের সঙ্গে গ্রীষ্মাবকাশ কাটানোর সময়েই অজিতকুমার ক্ষিতিমোহনের কবীর গ্রন্থের চারটি খণ্ড থেকে বেছে ১১৪টি দোঁহা ইংরেজিতে 888sport app download apk latest version করেন। পিয়ারসন 13 May গধু [৩০ বৈশাখ] রবীন্দ্রনাথকে লেখেন : ‘এখন আমরা বাড়িতে বসিয়া আছি অজিত কবীরের 888sport app download apk 888sport app download apk latest version করিতেছেন আমি চিঠি লিখিতেছি।’
পিয়ারসনই 888sport app download apk latest versionগুলি একটি রুল-টানা ৫৬ পৃষ্ঠার এক্সারসাইজ বুকে কপি করেন ও পরে এটি রবী
ন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দেন। ৭ মে ১৯১৪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লন্ডন থেকে ক্ষিতিমোহনকে লেখেন : ‘এখানে Evelyn Underhill প্রভৃতি কোনো একজন রসজ্ঞ লোকের সহযোগে এই জিনিষগুলি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করবার আয়োজন করতে হবে।’
তিনি এই 888sport app download apk latest version নিয়ে ইভলিন আন্ডারহিলের সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলেছিলেন, কারণ ইভলিন উল্লিখিত পত্রে তাঁকে জানান : ‘I am looking forward immensely to editing the Kavir poems & am very grateful to you for giving me the privilege of doing them.’(রবিজীবনী, ষষ্ঠ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা, প্রকাশকাল : প্রথম সংস্করণ ১৯৯৩, পৃ ৪১৪)।
শ্রীমতী ইভলিন আন্ডারহিলের Introduction-এ 888sport app download apk latest versionের ক্ষেত্রে অজিতকুমারের ভূমিকা কেবল কৃতজ্ঞতা-স্বীকারেই সমাপ্ত। অথচ তিনি কবীরের 888sport app download apk latest versionগ্রন্থের ভূমিকায় অজিতকুমারেরই লেখা ‘ইন্ডিয়ান মিস্টিসিজম’ সম্পর্কিত 888sport live থেকে বহু তথ্য নিয়েছিলেন। এ নিয়ে গুঞ্জন শোনা গেছে। পাণ্ডুলিপিটি পরীক্ষা করলেই অজিতকুমারের কৃতিত্বের পরিমাপ করা যায়। প্রচুর গুঞ্জন শোনা গেছে এ নিয়েও। আর্থিক দিক থেকে অজিতকুমারকে বঞ্চনা করার অভিযোগও রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে উঠেছে কোথাও-কোথাও। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে 888sport app download apk latest versionক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ও অজিতকুমারের নাম যুগ্মভাবে ব্যবহার করলেই যথার্থ ও শোভন হত। (রবিজীবনী, ষষ্ঠ খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা, প্রকাশকাল : প্রথম সংস্করণ ১৯৯৩, পৃ ৪১৫)।
‘প্রসঙ্গত বলা উচিত রবীন্দ্রনাথের 888sport live football অজিতকুমার তাঁহার স্বল্পকাল অক্সফোর্ড বাসকালে ইংরেজ বন্ধুমহলে প্রচার করিয়াছিলেন। এই তথ্য আজ প্রায় বিস্মৃত যে One Hundred Poems of Kabir-এর মূল কাজ অজিত কুমারের। অজিতকুমার তাঁহার বন্ধু ক্ষিতিমোহন সেনের ‘কবীর’ হইতে বহু দোহা 888sport app download apk latest version করিয়াছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাহা হইতে বাছিয়া ও কিঞ্চিৎ শোধন করিয়া পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। এ সম্বন্ধে পরে আলোচনা করা হইয়াছে।’ (রবীন্দ্রজীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩১৪)।
অজিতকুমার চক্রবর্তী ১৮ বছর বয়সে বি.এ. পাস করেই পার্থিব জীবনের উচ্চ আকাক্সক্ষা বিসর্জন দিয়ে কবির শিক্ষাদর্শ রূপায়ণকল্পে তাঁর বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ১০ বছর পরে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই তাঁকে সেই বিদ্যালয় ত্যাগ করে চাকরির সন্ধানে কেন কলকাতার জনতার কাতারে দাঁড়াতে হল – তার কারণের সঙ্গে রবীন্দ্রজীবনের বেশ কিছুটা যোগ আছে। সেই যোগটি রবীন্দ্রজীবনীকার ব্যাখ্যা শুরু করেছেন এই বলে :
রবীন্দ্রনাথ কবি, ধনী ও জমিদার – সুতরাং এই তিনটির গুণ ও দোষ যে তাঁহাতে বর্তাইবে তাহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই।… সাধারণ মানুষ যে-বিষয় ও বস্তুটিকে যে-ভাবে দেখেন, কবির মনশ্চক্ষে তাহার রূপ সে-ভাবে প্রতিফলিত হয় না। কবির কাছে উহা, হয় তুচ্ছ হয়, না হয় উচ্ছ্বসিত আবেগে ভাষা পায়।…
কবি সর্বদাই ভাবিতেন,… এই লোক যখন পারিল না, আর ঐ লোক যখন উহার দোষত্র“টি সম্বন্ধে এতই সজাগ তখন ওই ব্যক্তি আদর্শকে মূর্তি দিয়া প্রাণপ্রতিষ্ঠা করুক-না কেন। বিদ্যালয়ের ইতিহাসে বরাবরই দেখা গিয়াছে যে, ক্ষমতালাভের জন্য ও কবির প্রিয়পাত্র হইবার জন্য কর্মীদের মধ্যে যে রেশারেশি চলিত তাহারই ঘাত-প্রতিঘাতে পুরাতনের পতন ও নূতনের অভ্যুদয় হইয়াছে বারে বারে।… তখন পুরাতন দূরে চলিয়া যায়, মন বলে ‘হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে’।
দশ বছর পূর্বে মোহিতচন্দ্র সেন এইভাবেই আসেন, এইভাবেই যান।
অজিতকুমার কবিচরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটুকু খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি কবির রসগ্রাহী সমঝদার ও সমালোচক ছিলেন। সমসময়ে অ্যান্ড্রুজ ও র্সনও কবিমানসে একটি বড়ো স্থান লাভ করেছিলেন। কবির এ-সময়ের পত্রধারা অধিকাংশই লেখা অ্যান্ড্রুজকে। অ্যান্ড্রুজ কবিকে সর্বতোভাবে আপনার করে পাওয়ার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়েছিলেন। সে সময় অজিত ও অ্যান্ড্রুজের মধ্যে বহু পত্রবিনিময় হয়েছিল। অজিত বন্ধুভাবে অ্যান্ড্রুজকে কবিচরিত্রের এই নৈর্ব্যক্তিক প্রেমের দিকটির কথা অতি স্পষ্ট করে একখানি পত্রের মধ্যে বিবৃত করেন বলে প্রভাতকুমারও শুনেছেন। অজিতের এই পত্র অ্যান্ড্রুজের ভালো লাগেনি। কবিকে তিনি সে পত্রখানি দেখান এবং তা পাঠ করে কবি আদৌ আপ্যায়িত হননি। এ-ঘটনাটি রবীন্দ্রজীবনীকার শুনেছিলেন নেপালচন্দ্র রায়ের কাছে।
প্রভাতকুমার লিখেছেন :
আমাদের মনে হয় কিছুকাল হইতে অজিতকুমার কবি-সম্বন্ধে বেশ একটু critical হইতেছিলেন। গত এক বৎসর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জীবনচরিত রচনাব্যপদেশে অজিতকে কলিকাতায় বেশির ভাগ সময় থাকিতে হয়। কলিকাতার 888sport live footballিক সমাজের সহিত অজিতের ঘনিষ্ঠতা হয় এই সময়ে। এই 888sport live footballিকদের মধ্যে সকলেই রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন না, অনেকে বিরোধী না-হইয়াও ক্রিটিক, আবার কেহ কেহ নিছক নিন্দাকারী। মোট কথা, এই ক্রিটিক সমাজের সহিত মেলামেশি ও বাক্বিতণ্ডার ফলে অজিত রবীন্দ্রনাথকে ক্রমেই critically বিচার করিতে আরম্ভ করেন। যে একদেশ-দৃষ্টি লইয়া তিনি এতাবৎকাল আশ্রমে বাস করিয়াছিলেন ও কবির রচনাকে দেখিয়া আসিয়াছিলেন তাহা বৃহত্তর বহির্জগতের সংস্পর্শে আসিয়া বহুল-পরিমাণে পরিমার্জিত হইয়াছিল। কবির নূতন রচনাসমূহ সম্বন্ধে অজিতের পূর্বের সংস্কার অনেকখানি দূর হইয়া যায়। মোট কথা অজিতের মন নানা কারণের যোগে রবীন্দ্রনাথ হইতে সরিয়া আসিতেছিল;…
এই ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে বলিবার হেতু আছে। আশ্রমের ইতিহাসে এইভাবে বহু প্রিয়জন কবিকে ত্যাগ করিয়াছেন এবং কবিও বহু কর্মীকে ত্যাগ করিয়াছেন। ইহার মূলে ছিল আদর্শের দ্বন্দ্ব, নিছক অর্থনৈতিক কারণ নহে। (পৃ ৫২৪, রবীন্দ্রজীবনী, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী, প্রথম প্রকাশ, ১৯৩৬, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৯)।
888sport live football-অধ্যাপনার অসামান্য শক্তিসম্পন্ন 888sport live footballিক-অধ্যাপক অজিতকুমার চক্রবর্তীর শান্তিনিকেতনের উপরে-বর্ণিত অভিজ্ঞতা প্রতিনিধিত্বমূলক এ অর্থে যে এতে প্রমাণিত হয় – রবীন্দ্রনাথও মানুষই ছিলেন। তাঁর কান ভারী করা যেত। তিনি সমালোচনা একেবারেই সইতে পারতেন না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতিরা ডাহা ভুল বলতেন না যে রবীন্দ্রনাথ স্তাবক-পরিবেষ্টিত থাকতে চাইতেন। মাত্রা ঘাটতির জন্যও স্তাবক বিতাড়িত হতেন। এমনকি সে-স্তাবক মোহিত এবং অজিতের মানের ও মাপের হলেও – যাঁরা প্রথমদিককার রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরবার কাজটি করেছেন দুটি নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ হয়ে।
এ রবীন্দ্রনাথকে কতখানি পাওয়া গেছে সদ্যসমাপ্ত একশত পঞ্চাশতম জন্মবর্ষ উপলক্ষে রচিত শত শত লক্ষ পত্রের গোলাভরা ফসলের মধ্যে? খতিয়ান নিলে দেখা যাবে যে পাঠক পাচ্ছেন কেবল ‘গুরুদেব’কে, রবীন্দ্রনাথকে নয়। তিনি যেমন রবীন্দ্রজীবনী হাতে পেয়ে প্রভাতকুমারকে বলেছিলেন – এটা রবীন্দ্রনাথের জীবনী নয়, দ্বারকানাথের পৌত্রের জীবনী। সেই প্রাতঃ888sport app download for androidীয় জীবনীকার কবির নিষেধ সত্ত্বেও দ্বারকানাথের পৌত্রের জীবনীই লিখেছেন পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে পরিবেশন করার খাতিরে। সেই পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ রচিত হওয়া সত্ত্বেও আজও তিনি ইতিহাসে অদ্বিতীয়ই আছেন। পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ সার্ধশতবর্ষে রচিত হলেও তিনি তাই থাকবেন চিরকাল। থাকবেন আরও মানবিক ভাবমূর্তি নিয়েই – শেক্সপিয়ার-গ্যেটেদের মতো।
সে যাক। শান্তিনিকেতন থেকে বিদায় হওয়া অজিতকুমারের জীবন কাটতে থাকে কলকাতার জটিল পরিবেশে কঠিন জীবনসংগ্রামের মাঝে। ক্রমবর্ধমান সংসারের ব্যয় সংকুলানের জন্য অনন্যোপায় হয়ে অবশেষে তাঁকে বাগড়িবাড়ি এস্টেটে সামান্য গৃহশিক্ষকের চাকরি নিয়ে আসাম চলে যেতে হয়। অর্থসংকট ও অশান্তির মধ্যে অসামান্য প্রতিভাবান 888sport live football-সংগীতকার অজিতকুমার চক্রবর্তীর অকালমৃত্যু ঘটে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে, 888sport appsের আবহাওয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সাধারণ একটি রোগে। এর পর তাঁর চার শিশুসন্তানসহ স্ত্রী লাবণ্যলেখাকে গুরুদেব শান্তিনিকেতনে ডেকে নিয়ে স্থান দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, কিছুদিন পরে সে-আশ্রয়ও তাঁদের ছেড়ে যেতে হয়।

বিশ্বপরিচয় বৃত্তান্ত
888sport apkাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে বিশ্বপরিচয় উৎসর্গ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এম.এস্ সি. তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে 888sport apk-অধ্যাপক। বইখানি লেখবার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলাম। ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল। তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তা ছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলোত না। তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি সাহায্যও পেয়েছি।
বিশ্বপরিচয় বইখানি প্রকাশের নেপথ্য কাহিনি শুনিয়েছেন আনন্দরূপম্ গ্রন্থের লেখক প্রমথনাথ সেনগুপ্ত :
গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যের সময় ডেকে পাঠালেন। উত্তরায়ণে গিয়ে দেখি ক্ষিতিমোহন বাবু ও শাস্ত্রীমশায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, আমাকে ডেকে সস্নেহে পাশে বসালেন, কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, ‘দেখো ‘বিশ্বপরিচয়’ লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না।” একটু থেমে বললেন, ‘অবশ্য তুমি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, আর তা ছাড়া 888sport apkের অনভ্যস্ত পথে চলতে শেষ পর্যন্ত এই অব্যবসায়ীর সাহসে কুলাত না। তুমি ক্ষুণœ হোয়ো না।’
প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথকে সহাস্যে বলেছিলেন :
বইখানা লেখার ভার আমার উপর দিয়েছিলেন, কাজ সম্পূর্ণ করে আপনার হাতে তুলে দিয়েছি, পরবর্তী ব্যবস্থার ভার আপনার, আপনি যে-ব্যবস্থা করবেন তাতেই আমি তুষ্ট, ক্ষুণœ হব কেন?
প্রমথনাথ ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতীতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কবির নির্দেশে তিনি বিশ্বপরিচয়ের একটি করে অধ্যায় লিখে কবিকে দেখতে দিতেন। প্রমথনাথ তত্ত্ব ও তথ্য দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনার যে খড়ের কাঠামো বানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ অননুকরণীয় ভাষার মাটি আর আশ্চর্য শৈলীর রং দিয়ে তাকে সুখপাঠ্য গ্রন্থপ্রতিমার রূপ দান করেন। নীরস 888sport apkে সরস 888sport live footballের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় তাজমহল নির্মাণের জন্যে খ্যাতি লাভ করলেন মোগল সম্রাট শাজাহান। কিন্তু ঈশা মহম্মদের মতো যে অসংখ্য দক্ষ স্থপতি ও রেজার সুদীর্ঘ কালব্যাপী নিরলস শ্রম ও প্রতিভা নিংড়ে এই সুরম্য 888sport sign up bonusসৌধ গড়া হল তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেল না। প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বপরিচয় বইখানির অন্তরঙ্গে প্রমথনাথ; বহিরঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। প্রমথনাথের লেখা বিবরণ বিশ্লেষণকে রবীন্দ্রনাথ নিজের কথায় সহজবোধ্য করে পরিস্ফুট করেছেন মাত্র। কবি তা স্বীকারও করেছেন, ‘…এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে…’ এ-ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে,  আঙ্গিক, ভাব, বিষয়বস্তু প্রভৃতি অপরিবর্তিত রেখে কেউ যদি রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনা তাঁর নিজের ভাষায় প্রকাশ করেন তবে তাঁকে কি মৌলিক সৃষ্টির কৃতিত্ব দেওয়া যাবে? 888sport app download apk latest versionককে কি স্রষ্টার সম্মান দেওয়া হয়?
বইটির পাণ্ডুলিপি পড়ে বিশ্বভারতীর শিক্ষাভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ ধীরেন্দ্রমোহন সেন যুগ্মলেখক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথনাথের নাম রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। নবীন শিক্ষাব্রতীর অধ্যবসায় ও প্রয়াসকে উৎসাহ ও স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বপরিচয় বইয়ের নামপত্রে (title-page) ) প্রমথনাথের নাম থাকাটাই সংগত ও শোভন হতো। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ তো তখন বিশ্বকবি হিসেবে বিশ্বব্যাপী মহামানবরূপে বন্দিত। বইখানির সম্পাদক ও উপদেষ্টা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম মুদ্রিত হলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না বরং প্রকৃত লেখকের প্রতি সুবিচার করা হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, বইখানির নামপত্রে রইলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আর উৎসর্গপত্রে রইলেন প্রমথনাথ কৃতজ্ঞতাভাজন হিসেবে। রবীন্দ্রজীবনের এসব অঞ্চল কিঞ্চিৎ অন্ধকার বইকি।

‘বিচিত্রা’ ভবনের বিচিত্র ভূমি
ঈশ্বরসন্ধানী হিমালয়-প্রবাসী মহর্ষি কেমন কৌশলী সংসারী ছিলেন, তার একটি প্রামাণ্য নজির বিচিত্রা ভবনের ধারয়িত্রী ভূমিটুকু। নিঃসন্তান অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু হলো ২০ অক্টোবর ১৮৫৮। পৈতৃক সম্পত্তিতে তিন ভাইয়ের সমান অংশ ছিল। অপুত্রক অবস্থায় নগেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর অংশ আইনানুগভাবে অপর দুই ভ্রাতার পরিবারে সমানভাগে ভাগ হয়ে যাবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত – তাঁর বিধবা পতœী ত্রিপুরাসুন্দরী শুধু আজীবন ভরণপোষণ পাবেন। (কী বিচিত্র সামাজিক ন্যায়বিচার!)। কিন্তু ত্রিপুরাসুন্দরী তাঁর মেজ ভাসুর গিরীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র গুণেন্দ্রনাথকে (১৮৪৭-৮১) দত্তক গ্রহণ করতে চাইলেন।
এই প্রস্তাবে দুটি সংকটের উদ্ভব হলো। প্রথমত, দত্তকগৃহীত গুণেন্দ্রনাথ আইনবলে নগেন্দ্রনাথের অংশ তো লাভ করতেনই, দ্বিতীয়ত তাঁর নিজের পিতা গিরীন্দ্রনাথের সম্পত্তিরও অর্ধাংশ লাভ করতেন, যেহেতু তাঁরা দুই ভাই। পারিবারিক সম্পত্তির অর্ধেক অংশই তাঁর দখলে চলে যেত, দেবেন্দ্রনাথের অধিকারে থাকত শুধু পূর্বনির্ধারিত ১/৩ অংশ, আর বাকি ১/৬ পেতেন গণেন্দ্রনাথ। এতে দেবেন্দ্রনাথ মূলত গরিব হতেন না। তবু তুলনামূলক গরিব হওয়ার পরিস্থিতিটিও হিমালয়চারী বিষয়ী-সন্ন্যাসীটির কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
এ অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথ ২৯ জানুয়ারি ১৮৫৯ তারিখে সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলা দায়ের করে দাবি করলেন, বিধবা ত্রিপুরাসুন্দরীর দত্তক নেবার অধিকার নেই। (পৈতৃক ঋণ পরিশোধ নিরোধকল্পে দ্বিজেন্দ্রনাথ বনাম দেবেন্দ্রনাথ-নামক সুচতুর মামলাটি 888sport app download for android করুন)। ১৫ মে ১৮৬০ তারিখে মামলার রায় বের হয় দেবেন্দ্রনাথের পক্ষে। ফলে অস্বীকৃত হয় ত্রিপুরাসুন্দরীর দত্তক গ্রহণের অধিকার তথা সম্পত্তিতে অধিকার। এর দরুন সম্পত্তিতে নগেন্দ্রনাথের অংশের দুই ভাগ লাভ করেন ত্রিপুরাসুন্দরী ও গুণেন্দ্রনাথ। অপর এক-তৃতীয়াংশ সম্বন্ধে রায়দান স্থগিত থাকে। ত্রিপুরাসুন্দরী এই ডিক্রি বাতিল করতে চেয়ে মোকদ্দমা করেন।
দীর্ঘকাল মামলা চলার পর রায় বেরোয় ১৮৭৬ সালে। তাতে নগেন্দ্রনাথের যে এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তির উপর রায়দান স্থগিত ছিল, তাতে ত্রিপুরাসুন্দরীর জীবনস্বত্ব স্বীকার করা হয়। দেবেন্দ্রনাথ এই রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে পুনরায় আপিল করেন। শেষ পর্যন্ত আপোসে স্থির হয়, ত্রিপুরাসুন্দরী তাঁর জীবনস্বত্ব দেবেন্দ্রনাথের অনুকূলে ছেড়ে দেবেন। পরিবর্তে দেবেন্দ্রনাথ তাঁকে এককালীন দশ হাজার টাকা এবং বার্ষিক ১০০০ টাকা হারে বৃত্তি দেবেন।
দ্বারকানাথ তাঁর উইলে ভদ্রাসন বাড়ির পশ্চিমদিকের সমস্ত জমি নগেন্দ্রনাথকে দিয়ে গিয়েছিলেন, এই ডিক্রি অনুযায়ী সেই জমির বেশিরভাগ অংশই দেবেন্দ্রনাথের অধিকারে আসে – যা তিনি পরবর্তীকালে কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথকে দান করেন। তিনিও বৈধতার বলে নৈতিকতার প্রশ্ন ভুলে মামলাবাজিতে কাকিমাকে কাহিল করে পাওয়া পিতার সেই বিতর্কিত জমিতে তাঁর ‘বিচিত্রা ভবন’ তৈরি করেন এবং সে-বাড়ি থেকেই মৃণালিনী দেবীর শবদেহ শ্মশানযাত্রা করে। এও থাক। আসল কথাটি হলো – এইভাবে দেবেন্দ্রনাথ, নিঃসন্তান বিধবা ভ্রাতৃবধূর বিরুদ্ধে মামলা করে দ্বারকানাথের সম্পত্তির (যে সম্পত্তি তিনি ট্রাস্টমুক্ত করে দিয়েও পিতৃঋণ শোধ করতে চেয়েছিলেন!) ১/৩ অংশের বদলে ৫/৯ অংশের মালিক হলেন।
দত্তকগ্রহণের সুবাদে সম্পত্তিতে ত্রিপুরাসুন্দরীর অধিকার আদালত কর্তৃক অস্বীকৃত হওয়ায় নগেন্দ্রনাথের ১/৩ অংশের ১/৩ অংশ, অর্থাৎ ১/৯ অংশ, প্রথমত তাঁর অধিকারে এল। তারপর, যে ১/৩ অংশের উপর রায়দান স্থগিত ছিল, ১৮৭৬ সালের মোকদ্দমার পরিণতি হিসেবে, তাঁর সঙ্গে আপোস-মীমাংসার ভিত্তিতে, তার ১/৩ অর্থাৎ মোট সম্পত্তির আরো ১/৯ অংশের তিনি মালিক হলেন।
হিরণ¥য় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ঠাকুরবাড়ির কথা গ্রন্থে (১ম সং ৩য় মু, পৃ ৮৬) দেখিয়েছেন, দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সমস্ত জমিদারি সম্পত্তির (দশ বছরের গড়ের ভিত্তিতে) মোট বার্ষিক খাজনা আসত ৩৬৮,৫০৯ টাকা। রাজস্ব ও আদায় খরচ বাদে তা থেকে নিট আয় ছিল ২৩৪,৩১০ টাকা। কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিধবা স্ত্রীর বিরুদ্ধে এই মামলাগুলি না করলে, দেবেন্দ্রনাথের এক-তৃতীয়াংশে বার্ষিক আয় থাকত মোটামুটি ৭৮,০০০ টাকা। কিন্তু তাঁর মামলাবাজির ফলে দেবেন্দ্রনাথ সম্পত্তির ৫/৯ অংশের মালিক হলেন, যার আয় গিয়ে দাঁড়াল গড়ে বার্ষিক ১৩০,০০০ টাকায়।
ত্রিপুরাসুন্দরী স্পষ্টতই বঞ্চিত হয়েছিলেন। যে জমিদারির গড় বার্ষিক আয় ২,৩৪,৩১০ টাকা, তার ১/৯ অংশের বার্ষিক আয় ২৬,০০০ টাকারও বেশি। সেই সম্পত্তি চলে গেল ভাসুরের অধিকারে, তার পরিবর্তে ভ্রাতৃবধূ আপোসে পেলেন মাত্র এককালীন ১০,০০০ টাকা, ও বার্ষিক ১০০০ টাকা। তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে থাকতেন না, বর্তমান জোড়া গির্জার কাছে তাঁর নিজস্ব সুবিশাল গৃহে ভ্রাতাদের নিয়ে বাস করতেন। এই আপোস-মীমাংসার ফলে যে বাড়িটি তিনি পেয়েছিলেন, সেখানে এখন আয়কর দপ্তরের ‘ব্যাম্বুভিলা’।
মাঝেমধ্যে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসতেন, কিন্তু এ-বাড়িতে জলগ্রহণ করতেন না। কারণ তাঁর ভয় ছিল খাবারের সঙ্গে তাঁকে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হবে। কোনোমতে তাঁর মৃত্যু ঘটানো গেলে তাঁর বার্ষিক এক হাজার টাকার ঘানিও মহর্ষিকে আর টানতে হবে না, এই সন্দেহ দৃঢ়মূল হয়েছিল ত্রিপুরাসুন্দরীর মনে।
তিনি ‘মহর্ষি’ অভিধায় খ্যাত দেবেন্দ্রনাথকে বিশ্বাস করতেন না। করবেনই বা কিসের ভিত্তিতে। তাঁর প্রতি দেবেন্দ্রনাথের আচরণের বৈষয়িক গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও, নৈতিক সমর্থনযোগ্যতা থাকতে পারে না। আচরণটি তাঁর মহর্ষিসুলভ তো নয়ই, ঋষিসুলভও ছিল না। অথচ ১৮৬৭ সালে সমস্ত ব্রাহ্ম এক হয়ে তাঁকে ‘মহর্ষি’ উপাধি দেন।
এই মামলা আরম্ভের অব্যবহিত পূর্বে পৌঁছে (১৫ নভেম্বর ১৮৫৮) দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনী সমাপ্ত করেছেন। অন্যথায় এ মামলার কথা উল্লেখ করতে হতো, সে জন্যেই কী? হতে পারে।  প্রকৃতপক্ষে দেবেন্দ্রনাথের চিরস্থায়ী গগনচুম্বী খ্যাতির ভিত্তি ছিল বহুলাংশেই ফাঁপা, অন্তত সলিড ছিল না বিলকুল। গুণেন্দ্রনাথের মাতা, গিরীন্দ্রনাথের বিধবা পতœী যোগমায়া দেবী, এই ঘটনায় স্বভাবতই প্রীত হননি।
তদুপরি দেবেন্দ্রনাথ এই সময়ে স্থির করলেন, গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনশিলা তিনি বাড়ি থেকে স্থানান্তরিত করবেন,              বাড়িতে আর পূজা হবে না। এই কথা শুনে যোগমায়া দেবী লক্ষ্মীজনার্দনশিলা তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নেন, এবং ঠাকুরপরিবার ৫নং ও ৬নং বাড়িতে বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিভেদ বহুকাল পর্যন্ত বজায় ছিল। বাড়ির পুরুষদের মধ্যে যাওয়া-আসা থাকলেও মেয়েমহলে যাতায়াত বন্ধ ছিল অন্তত পঁচিশ বছর – অর্থাৎ পুরো একটি প্রজন্ম।
দেবেন্দ্রনাথের আত্মজীবনীতে বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) কোনো উল্লেখ নেই, কিন্তু এক সময়ে তাঁর সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের সৌহার্দ্য ছিল। তিনি দেবেন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বৎসরের ছোটো  এবং দেবেন্দ্রনাথের ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র অন্যতম সদস্য              ছিলেন।
১৮৪১ সালে তত্ত্ববোধিনী সভার তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনের বক্তৃতায় দেবেন্দ্রনাথ ‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ এই বাক্যটি ব্যবহার করেন; কয়েক বছর পরে (১৮৫১) বিদ্যাসাগর তাঁর বোধোদয় পুস্তকে এই বাক্যটি গ্রহণ করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতেও তিনি নিয়মিত লিখতেন, বিধবাবিবাহের প্রচারও তিনি করেছেন এই পত্রিকার মাধ্যমে। বস্তুত সেই প্রচারের আতিশয্য নিয়েই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য উপস্থিত হয়।
ভাগ্যবিড়ম্বিতা 888sport promo codeর পুনর্বিবাহের এমন বিরোধী পুরুষকে মহাপুরুষ ভাবা যায় না, অথচ তিনি আজও ‘মহর্ষি’ অভিহিত। তাতে আমাদের মাথাব্যথা নেই।  তবে  আমরা  প্রচণ্ড  শিরঃপীড়া  বোধ করি যখন দেখি মেয়েদের বাল্যবিবাহপন্থী এবং বিধবাবিবাহ-পরিপন্থী এই পিতৃদেব এসব অবৈধ ও অনৈতিক মূল্যবোধ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো অমূল্য পুত্রটিকেও রাহুর মতো গ্রাস করে রাখেন আমরণ। অবশ্য পুত্র পিতার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেন নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিধবা প্রতিমার বিয়ে দিয়ে।

রবীন্দ্রমন দুষ্প্রবেশ্য
রবীন্দ্রমন দুষ্প্রবেশ্য। উৎসর্গপত্রকে বলা যায়, লেখকের আত্মপরিচয়ের পৃষ্ঠা। সামাজিক জীব হিসেবে লেখকের                    যে-ব্যক্তিসত্তা 888sport apk download apk latest version-ভক্তি, প্রীতি-প্রণয়, প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ইত্যাদি হৃদয়ানুভূতিজনিত মানবিক সম্পর্কে বিধৃত, উৎসর্গপত্রে ঘটে তারই ছায়াপাত, পড়ে তারই প্রতিভাস। এর দরুন উৎসর্গপত্র হয়ে ওঠে দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ। পত্রটি লেখকের জীবনী ও মনোলোক সম্পর্কে কৌতূহল জাগ্রত করে এবং অবহিতও করে অন্তরমহলের কিছু গোপন খবর সম্বন্ধে ।
উৎসর্গপত্রে লেখক কাকে 888sport app download for android করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অভিরুচির বিষয়। তবে সে ইচ্ছা বা অভিরুচিকে অবচেতন ও অচেতন মন অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে,  এ-কথাটা মনঃসমীক্ষণ-বিদ্যার।  উৎসর্গপত্রে  নামোল্লেখের  ব্যাপারটাকে শিশিরপাতের সঙ্গে তুলনা করা যায়। ঘাসের পাতায় যে শিশিরপাত ঘটে তার সংঘটন নির্ভর করে বায়ুমণ্ডলে ভাসমান বাষ্পের তাৎক্ষণিক নৈকট্য ও নিবিড়ত্বের ওপর। তেমনি উৎসর্গপত্রে কবি যখন যাঁর নাম উল্লেখ করেছেন, বা যাঁকে 888sport app download for android করেছেন, বুঝতে হবে যে সে-মুহূর্তে কবির মনোমণ্ডলে ভাসমান বহু নামের মধ্যে সেই নামটি বা ব্যক্তিই ছিল তাঁর চেতনায় সবচেয়ে নিকট ও নিবিড়। এই নৈকট্য ও নিবিড়ত্বের কার্যকারণ বিশ্লেষণে পাওয়া যাবে কবিজীবন ও তাঁর মনোলোকের কিছু গূঢ় পরিচয়।
কালানুক্রমিক পরম্পরায় উৎসর্গপত্রগুলিকে চার পর্বে ভাগ করা যায়। পর্ব চারটি কবির জীবনচর্যাকে যে চারটি পর্বে চিহ্নিত করা হয় তারই সমান্তরাল। কবিজীবনের প্রথম পর্ব হলো তাঁর 888sport live footballচর্চার শুরু থেকে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ ‘য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারি, প্রথম খণ্ড’ প্রকাশকাল পর্যন্ত। এর পরের এক দশক (১৮৯১-১৯০১) হলো দ্বিতীয় পর্ব – যে সময় কবি শিলাইদহে তথা পূর্ববঙ্গে তথা 888sport appsে বাস করেন। তৃতীয় পর্বের কাল হলো ১৯০১ থেকে ১৯১২ পর্যন্ত। এই দশকে কবি শিলাইদহের পাট চুকিয়ে শান্তিনিকেতনে বাস করতে থাকেন এবং ব্রহ্মচর্য আশ্রম  প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায়  আত্মনিয়োগ করেন।  এই পর্বের  আদিতে  শান্তিনিকেতন আগমন এবং অন্তে পশ্চিম জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যে বিলেত গমন। চতুর্থ বা শেষ পর্ব ১৯১৩ থেকে ১৯৪১ সালে কবির মৃত্যুকাল পর্যন্ত। এই পর্বে কবি বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কীর্তিমান এবং বিশ্বকবিরূপে খ্যাতিমান – এককথায় বিশ্বব্যক্তিত্ব।
দেখা যাবে যে, প্রথম পর্বের সমস্ত উৎসর্গপত্রে কবির আত্মীয়স্বজনই স্থান পেয়েছেন (এর মধ্যে কাদম্বরী দেবী একাই স্মরিত হয়েছেন ১১টি গ্রন্থে)। কবির জীবনী না-জানা থাকলেও, এই উৎসর্গপত্রগুলির মাধ্যমে বোঝা যাবে যে এই সময় কবির বিচরণক্ষেত্র আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যেই সীমিত ছিল। স্বভাবে তিনি লাজুক ও আত্মমুখী, এটাও বোঝা যায়। এবং  সে-কারণে তিনি ঠাকুরবাড়ির গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরে বহুজনের সংস্পর্শে আসার তাগিদ অনুভব করেননি। বাড়ির আবহাওয়া ছিল কাব্যচর্চার অনুকূল। এও বোঝা যায়, পরিবার-পরিজন কবিকে 888sport live footballচর্চায় উৎসাহদানে ও পোষকতা জোগানে তুলনাহীন পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন।
জীবনের দ্বিতীয় পর্বে কবি জোড়াসাঁকোর গণ্ডি অতিক্রম করে বাইরের জগতের সংস্পর্শে আসেন। এই সময় কর্মজীবনে প্রাধান্য পেয়েছে জমিদার রবীন্দ্রনাথ। উৎসর্গপত্রের আলোকেও কবিজীবনের এই পরিচয়টি অবলোকন করা যায়। এই পর্বে পরিবার-পরিজনের মধ্যে কেবলমাত্র পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (নৈবেদ্য ১৯০১) এবং ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (নদী ১৮৯৬) 888sport app download for android করা হয়েছে। বাকি দশ জন সকলেই অনাত্মীয়, বাইরের সুহৃদ। 888sport app উৎসর্গিতের মধ্যে অনেকেই কবির বিদেশ বা মফম্বল বাসকালে তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন।
তৃতীয় পর্বে কবি বোলপুরের তরুবিরল, রুক্ষ, মরুপ্রায় প্রান্তে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যধর্মের আদর্শে ব্রহ্মচর্য আশ্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে যেভাবে জীবনযাপন করেন তাতে তিনি ছিলেন একজন আশ্রমগুরু। শিলাইদহ-পর্বের জীবন থেকে এই জীবনের পার্থক্য সহজেই অনুমেয়। এর প্রভাব তাঁর এই কালের 888sport live footballকর্মেও দেখা যায়। এখনকার 888sport live footballকর্মের মাধ্যম শতকরা নব্বই ভাগ গদ্য। এই সময়েই মোট ষোলো খণ্ডে কবির গদ্যরচনা গদ্য গ্রন্থাবলী নামে ছাপা হয়। এ-পর্বের ৪৩টি গ্রন্থের মধ্যে কাব্যগ্রন্থের 888sport free bet মাত্র তিনটি – খেয়া, শিশু ও গীতাঞ্জলি।
এই পর্বে প্রকাশিত গ্রন্থগুলিতে উৎসর্গপত্র অতি বিরল। ৪৩টি গ্রন্থের মধ্যে মাত্র তিনটিতে উৎসর্গপত্র আছে। অথচ এই সময় বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে – চোখের বালি, নৌকাডুবি, শারদোৎসব, গীতাঞ্জলি, রাজা, ডাকঘর। কিন্তু এদের কোনোটিই উৎসর্গপত্র বহন করে প্রকাশিত হয়নি। এই পরিস্থিতি কি কবিমনের সেই সময়কার নিঃসঙ্গতাজনিত? না, অন্য কোনো রসায়নও সক্রিয় ছিল কবির দুর্জ্ঞেয় অন্তরে – ভেবে দেখা যেতে পারে।
কবিজীবনের চতুর্থ পর্ব সুদীর্ঘ – ১৯১৩ থেকে কবির মৃত্যুকাল ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। এই পর্বের ১০৪টি গ্রন্থের মধ্যে ৩২টিতে উৎসর্গপত্র আছে। এই পর্বের প্রথম থেকেই তিনি ‘কবিগুরু’ কিংবা ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধিত হয়ে আসছেন। এখন তাঁকে ঘিরে যাঁরা, তাঁরা প্রায় সকলেই তাঁর বয়োকনিষ্ঠ। 888sport live footballে নোবেল 888sport app download bd লাভ, বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা, আমন্ত্রণক্রমে সারা বিশ্ব888sport slot game – সব মিলিয়ে কবি এখন শুধু বাংলার কবি নন, ভারতের কবিও নন, তিনি বিশ্বকবি, বিশ্বমনীষী, বিশ্বের একজন অতি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। কবির পরিচয়-পরিধির এই বিশ্বব্যাপ্তির সাক্ষ্য বহন করছে সেই সময়কার উৎসর্গপত্রে উল্লিখিত তিনটি নাম – রেভারেন্ড সি এফ অ্যান্ড্রুজ (উৎসর্গ ১৯১৪), উইলি পিয়ারসন (বলাকা ১৯১৬) এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (পূরবী ১৯২৫)।
উৎসর্গপত্রে নামোল্লেখ সাধারণত সবিশেষণ হয়ে থাকে। রবীন্দ্রগ্রন্থের ক্ষেত্রেও তাই দেখা যায়। উপরন্তু, অনেক সময় উৎসর্গের পাত্রপাত্রীকে সম্বোধন করে কিছু লিখেওছেন কবি। এই লেখা কোথাও পদ্য, কোথাও গদ্য; কোথাও সংক্ষিপ্ত কোথাও সুদীর্ঘ। এইসব পাঠ অনুধাবনযোগ্য। এতে করে আভাস পাওয়া যায় উৎসর্গের পাত্রপাত্রী উৎসর্গকালে কবির কাছে কীভাবে প্রতিভাত ছিলেন।
সংকলনসহ ৬৯টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ২৪টিতে, ৪৫টি নাটক-নাটিকার মধ্যে ১০টিতে, ২৭টি গল্প-888sport alternative link গ্রন্থের মধ্যে ৮টিতে এবং ৬০টি 888sport liveগ্রন্থের মধ্যে ১৫টিতে উৎসর্গপত্র আছে। স্বভাবতই কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্র 888sport free betয় সবচেয়ে বেশি। এই প্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ বিস্ময় জাগে যখন দেখি কথা888sport live chatী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কথা888sport live football-গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে স্থান পাননি এবং উদ্দীপক কবি কাজী নজরুল ইসলাম জায়গা পাননি কোনো কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। দুজনই স্মরিত হয়েছেন যথাক্রমে কালের যাত্রা ও বসন্ত-নামক দুটি গৌণ নাটিকায়।
যদিও  ইতিপূর্বে  বলা  হয়েছে যে  উৎসর্গপত্রের  ব্যাপারটা  লেখকের  ব্যক্তিগত  অভিরুচি-নির্ভর, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরিচয়-পরিধির মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যাঁদেরকে উৎসর্গপত্রে না দেখে আমরা বিস্মিতই হই। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের উৎসর্গপত্রগুলিই আমাদের এই বিস্ময় বিশেষভাবে জাগ্রত করে। কবি তাঁর উত্তরজীবনে বলেছেন, ‘মাকে আমরা জানিনি, তাঁকে পাইনি কখনো। তিনি থাকতেন তাঁর ঘরে তক্তাপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকরেরা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনত – যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কৈ আর।’ (ঘরোয়া)। কবির এই উক্তি তাঁর উৎসর্গপত্রে জননী সারদা দেবীর অনুপস্থিতি হয়তো কিছুটা ব্যাখ্যা করে।
কিন্তু তাঁর পরম স্নেহের পুত্রকন্যা – মীরা, বেলা, রানী, শমীন্দ্রনাথ কেন উৎসর্গপত্রে নেই সে-রহস্যের ব্যাখ্যা কী? সর্বোপরি, পরিবারের সবচেয়ে প্রতিভাবতী রমণী এবং বাংলা 888sport live footballের প্রথম 888sport alternative linkকার স্বর্ণকুমারী দেবীর অনুপস্থিতি শুধু বিস্ময়ব্যঞ্জকই নয়, পীড়াদায়কও। রবীন্দ্রনাথের এ ন-দিদির দুটি কন্যারতœ হিরন্ময়ী দেবী এবং সরলা দেবীর সঙ্গে 888sport live football-সংগীতে কবির কার্যসম্পর্ক ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। আরো বড় কথা, কবির এ-বোনটি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ গাথা (১২৮৭) ‘ছোটভাই রবি’কে উপহার দিয়ে উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন :

ছোট ভাইটি আমার,
যতনে গাঁথা হার কাহারে পরাব আর?
স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পরাই,
যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়ে ফেলো না খুলে,
দুরন্ত ভাইটি তুই – তাইতে ডরাই।
আশ্চর্যের বিষয় যে শত শত গ্রন্থের রচয়িতা হয়েও ‘স্নেহের রবিটি’ তাঁর এহেন স্নেহময়ী দিদিকে কোনো গ্রন্থোৎসর্গ করে এই উপহারের প্রতিদান দেননি। আরো একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হল, কবিকে উৎসর্গিত স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘গাথা’গুলির বিভিন্ন চরিত্রের নাম নলিনী, অজিত, বিনোদ, পৃথ্বিরাজ, অলকা, চপলা, দামিনী, বিপিন – এর প্রত্যেকটি নাম রবীন্দ্রনাথের কৈশোরক রচনায় বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। নলিনী ও দামিনী তো তাঁর পরিণত রচনাতেও ফিরে এসেছে (রবিজীবনী, খণ্ড ২, পৃ ৭২)।
জীবনের প্রথম পর্বে কবি তৎকালীন বাংলা888sport live footballের রথী-মহারথীদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, বিশেষ করে বিহারীলাল চক্রবর্তী, যাঁর অনুপ্রেরণা ও অনুকরণে একসময় তাঁর কাব্যচর্চা চলেছিল – এঁদের কাউকে উৎসর্গপত্রে 888sport app download for android করেননি কবি। বর্ণিত দ্বিতীয় পর্বে কবির সমসাময়িক ও বয়োকনিষ্ঠ অনেক 888sport live footballিক কবির সান্নিধ্যে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁরা প্রায় সকলেই উৎসর্গপত্রে অনুপস্থিত। পশ্চিমবঙ্গ সংস্করণের রবীন্দ্র রচনাবলীর ত্রয়োদশ খণ্ডের একস্থানে একটি ফোটোর নিচে লেখা আছে – ‘888sport live footballিকসহ রবীন্দ্রনাথ’ – ১৯১২ সালে গৃহীত। এতে আছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু এঁরা কেউই রবীন্দ্রনাথের উৎসর্গপত্রে স্থান পাননি।
রবীন্দ্রনাথের পরে যাঁর মতো বহুমুখী প্রতিভা বাংলা 888sport live footballে বিরল বলে সকলেই স্বীকার করেন, তিনি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪)।  কবিগুরুর  সঙ্গে  শ্রীবসুর  পত্র-সম্পর্ক,  888sport live football-সম্পর্ক,  এমনকি ব্যক্তিগত-সম্পর্কও  সুবিদিত  (অতিথি  হিসেবে শান্তিনিকেতনে সপরিবারে বেড়ানো এবং গুরুদেবের উষ্ণ আতিথেয়তা সম্পর্কিত বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত রচনাটি স্মর্তব্য)। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের উৎসর্গপত্রাবলিতে বুদ্ধদেব বসুর অনুপস্থিতি কি পীড়াদায়ক? না কি দৃষ্টিকটুও?
রবীন্দ্রমন সত্যই দু®প্রবেশ্য।