সাধারণত নাটক রচিত হয় সমকালের দর্শকের সামনে অভিনীত হওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে। অভিনয় নয়, কেবল পাঠকের জন্য নাটক খুব কমই রচিত হয়। সমকালকে উপেক্ষা করে, ঘটমান বর্তমানের বাস্তবতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে নাট্যরচনা একদিকে যেমন কঠিন, অন্যদিকে রচনাটির সাফল্যও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘888sport live football পাঠ করিবার সময় আমরা সকলেই মনে মনে অভিনয় করিয়া থাকি সে অভিনয়ে যে কাব্যের সৌন্দর্য্য খোলে না, সে কাব্য কোন কবিকে যশস্বী করে নাই। … নাটকের ভাবখানা এইরূপ হওয়া উচিত যে, – ‘আমার যদি অভিনয়ে হয় ত হউক, না হয়ত অভিনয়ের পোড়া কপাল – আমার কোন ক্ষতি নাই।’ কিন্তু অসামান্য 888sport live football গুণসম্পন্ন মহাকাব্য ছাড়া পৃথিবীতে মঞ্চসফল না হলে কোনো নাট্য রচনাই টিকে থাকেনি।
সমাজ, দেশ, বিশ্ব ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও কর্মযোগের প্রাসঙ্গিতা আমরা নিত্যই অনুভব করতে পারছি। তবে রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে কথা বলার শুরুতে আমার উল্লেখ করতে ইচ্ছা করছে আজ থেকে কুড়ি বছর আগে লেখা কবি ও নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য মূল্যায়ন, যেখানে তিনি লিখেছেন :
নাট্যকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ অনন্য হয়েও নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, উদাসীনতায় উপেক্ষিত। বিশ্বমানের নাটকের স্রষ্টা হয়েও, এক বৈপ্লবিক নাট্যরীতির উদ্ভাবক হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের মতো এমন উপেক্ষিত স্রষ্টার দৃষ্টান্ত সারা বিশ্বে বিরল। বাংলার নাট্যসমাজ চোখের সামনে হীরের খনি পেয়েও চোখ বুজে রইল – শুধু সেকালে নয়, একালেও। শম্ভু মিত্রের প্রযোজনায় বহুরূপীর রবীন্দ্রনাট্যানুষ্ঠান তাবৎ অনাদর ঠেলে প্রথম রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করে, আমাদের প্রত্যক্ষ করায় তাঁর নাটকের ঐশ্বর্য ও মহত্ত্বকে। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী প্রযোজনা এবং পরবর্তী অন্য দু-একটি প্রযোজনার সযত্ন প্রয়াস ছাড়া রবীন্দ্র-নাটক যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়েছে। আজ আমাদের সকলের মুখেই খেদ রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রতি সুবিচার করতে না পারার জন্য, কিন্তু খেদোক্তি ছেড়ে কেউই কিন্তু রবীন্দ্রনাটকের চর্চায় এগিয়ে আসছি না।
রবীন্দ্রনাথের নাট্যভাবনার খেই ধরতে গেলে আমাদেরকে বিশ্লেষণ করতে হবে তাঁর নাট্যরচনাকে এবং খুঁজে বের করতে হবে নাটক মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে তিনি কী বলেছিলেন। প্রথমেই দ্বিতীয় পথটি ধরে এগোনো যাক। একশ বছরেরও বেশি আগে ‘রঙ্গমঞ্চ’ নামে একটি 888sport live লিখেছিলেন তিনি। তাতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন :
বিলাতের নকলে আমরা যে থিয়েটার করিয়াছি, তাহা ভারাক্রান্ত একটা স্ফীত পদার্থ। তাহাকে নড়ানো শক্ত; তাহাকে আপামর সকলের দ্বারের কাছে আনিয়া দেওয়া দুঃসাধ্য; – তাহাতে লক্ষ্মীর পেঁচাই সরস্বতীর পদ্মকে প্রায় আচ্ছন্ন করিয়া আছে। তাহাতে কবি ও গুণীর প্রতিভার চেয়ে ধনীর মূলধন ঢের বেশী থাকা চাই। দর্শক যদি বিলাতি ছেলেমানুষিতে দীক্ষিত না হইয়া থাকে এবং অভিনেতার যদি নিজের প্রতি ও কাব্যের প্রতি যথার্থ বিশ্বাস থাকে, তবে অভিনয়ের চারিদিক হইতে তাহার বহুমূল্য বাজে জঞ্জালগুলো ঝাঁট দিয়া ফেলিয়া তাহাকে মুক্তিদান ও গৌরবদান করিলেই সহৃদয় হিন্দুসন্তানের মত কাজ হয়। বাগানকে যে অবিকল বাগান আঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে এবং স্ত্রী চরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে, এরূপ অত্যন্ত স্থুল বিলাতি বর্ব্বরতা পরিহার করিবার সময় আসিয়াছে।
তাঁর নাট্যদর্শনের অনেকটাই এই লেখাতে আছে। তিনি চেয়েছিলেন চিত্রপটের চেয়ে চিত্তপটকে যেন আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। এ-প্রসঙ্গে যাত্রার কথা 888sport apk download apk latest versionর সঙ্গে 888sport app download for android করেছিলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল জাতীয় নাট্য-আঙ্গিকের খোঁজ করতে বেরোলে যাত্রার দিকেই আমাদের নজর ফেরানো দরকার। শান্তিনিকেতন তৈরি হলে সেখানে মুক্ত পরিবেশে নাটক করার একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। ‘মুক্তধারা’র মঞ্চস্থপতি হিসেবে প্যাট্রিক গেডেসকে বাছাই করে তিনি বলেছিলেন খোলা আকাশের তলায় মঞ্চ রচনা করতে। তাঁর রচনা করা গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য বরাবরই গৌরপ্রাঙ্গণের খোলা পরিবেশে মঞ্চস্থ হয়েছে। এখনো হয়। এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটারের প্রবক্তা হিসেবে আমরা রিচার্ড শেখনারের নাম করি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঢের আগে এর ফলিত প্রয়োগ করে গেছেন। আমরা সেই চর্চা আর সেভাবে করিনি। নাটকের অঙ্কদৃশ্যের বিভাজনকে মোটের ওপর মেনে চললেও, প্রবেশ-প্রস্থানের নির্দেশ বা 888sport app মঞ্চনির্দেশ লিখে যাননি তিনি। রিয়েলিস্টিক থিয়েটারের শেকল খুলে রেখে ভরসা করেছেন দর্শক-উপভোক্তার কল্পনাকে। আজ বিলিতি ধাঁচের প্রসেনিয়াম থিয়েটারে নাটক করার এত অসুবিধে আমাদের সামনে আসছে যে, তার সুবিধাগুলো গৌণ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের থিয়েটার। এ-পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের নাট্যদর্শনকে পাথেয় করে আবার পথ চলতে পারি আমরা। রবীন্দ্রনাথের 888sport sign up bonusবিজড়িত এ-জনপদে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রয়োগ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের সময়ে আমরা যেসব আধুনিক মঞ্চপ্রয়োগের কথা জানি, সবই ছিল পশ্চিমের অনুকরণ। পেছনে ঝোলানো পটচিত্রের পরিবর্তে এলো ফ্রেমে আটকানো বাড়িঘর, দরজা-জানালা; মঞ্চ ভরে গেল রিয়েলিস্টিক আসবাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেই কতকাল আগে এসব বাহুল্য মনে করেছেন। আজকের মঞ্চনাটকে এ-ধরনের বাস্তবধর্মী মঞ্চসজ্জা দেখলে আমরা বিরক্ত হই। একটা ফ্রেম দেখলেই আমরা দরজা কল্পনা করতে পারি। আসলে দর্শকের কল্পনাশক্তির ওপর মঞ্চসজ্জা ছেড়ে দিলে বাহুল্য বর্জন করা সম্ভব। এতে প্রযোজনা যেমন সহজ হয়, দর্শকও ছিমছাম মঞ্চ দেখলে খুশি হন। নাটক দাঁড়িয়ে থাকে অভিনয়ের ওপর, কাহিনির গাঁথুনির ওপর। চোখ-ধাঁধানো কারিগরি দিক দিয়ে ক্ষণিকের জন্য দর্শকের মন-ভোলানো যায়, কিন্তু নাটক মরমে পৌঁছায় না। আলো, সংগীত, দৃশ্যসজ্জা – এসব অভিনয়কে সহযোগিতা করবে, কখনো ছাপিয়ে যেন না যায়।
রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার কথা বলতে গেলে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা খুব দরকারি মনে হয়। 888sport live chat-বিপ্লবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটকের একটা স্পষ্ট বিরোধ আছে। রক্তকরবীর মতো নাটকে যেভাবে শ্রম ও শ্রমিকের অবমাননা দেখানো হয়েছে, যেভাবে মানুষের ব্যক্তিপরিচয় মুছে দিয়ে তাকে 888sport free betয় রূপান্তরিত করা হয়েছে, তা আজকের করপোরেট ওয়ার্ল্ডেও সমান সত্যি। মুক্তধারা নাটকে নদী আটকে বড় বাঁধ দেওয়ার যে বিশ্বব্যাপী প্রবণতা একশ বছর আগে মাথাচাড়া দিয়েছিল, তার বিপদের জায়গা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন তিনি। নদী-রাজনীতি এ-মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশের এক সংঘাতের ক্ষেত্র। জাতীয়তাবাদ কেন সংকীর্ণ করছে আমাদের দৃষ্টিকে, কীভাবে বাঁধ তুলে দেশে-দেশে বৈষম্য বাড়ছে, তার কথা এখন বাসি হলেও ভয়ংকর সত্যি।
মুক্তধারা নাটকে উত্তরকূটের রাজা বিদ্রোহী শিবতরাইয়ের প্রজাদের বশে আনতে না পেরে এক বিরাটকায় যন্ত্রদানবসদৃশ বাঁধ তৈরি করিয়ে তাদের জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে শিবতরাইয়ের খাবার আর চাষের জল রুদ্ধ। আমরা জানি, মানবজীবনের স্বচ্ছন্দ ও অবিরাম গতিই মুক্তধারা। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদের আদর্শে যন্ত্রশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে আজ বিশ্বের কত জাতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল জাতিকে অত্যাচার করছে, বাধ্যগত করে রাখার চেষ্টা করছে, তার নানা নজির তো আমরা হামেশাই দেখতে পাই। মুক্তধারা নাটকেও আমরা তার প্রকাশ দেখতে পাই। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মনে কীভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করা হয়, তার একটি চমৎকার উদাহরণ রয়েছে রাজা রণজিৎ সকাশে যখন গুরু তাঁর ছাত্রদের নিয়ে উপস্থিত হন, সে-দৃশ্যে :
গুরু : যাতে উত্তরকূটের গৌরবে এরা শিশুকাল থেকে গৌরব বোধ করতে শেখে তার কোন উপলক্ষ্যই বাদ দিতে চাই নে।
রণজিৎ : বিভূতি কি করেছে এরা সবাই জানে ত?
ছেলেরা : (লাফাইয়া হাততালি দিয়া) জানি, শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছেন।
রণজিৎ : কেন দিয়েছেন?
ছেলেরা : (উৎসাহে) ওদের জব্দ করার জন্যে।
রণজিৎ : কেন জব্দ করা?
ছেলেরা : ওরা যে খারাপ লোক!
রণজিৎ : কেন খারাপ?
ছেলেরা : ওরা খুব খারাপ, ভয়ানক খারাপ, সবাই জানে।
রণজিৎ : কেন খারাপ তা জানো না?
গুরু : জানে বই কি, মহারাজ। কী রে, তোরা পড়িস নি – বইয়ে পড়িস নি ওদের ধর্ম খুব খারাপ।
ছেলেরা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওদের ধর্ম খুব খারাপ।
গুরু : আর ওরা আমাদের মতো – কি বল্ না – (নাক দেখাইয়া)
ছেলেরা : নাক উঁচু নয়।
গুরু : আচ্ছা আমাদের গণাচার্য কী প্রমাণ করে দিয়েছেন – নাক উঁচু থাকলে কী হয়।
ছেলেরা : খুব বড় জাত হয়।
গুরু : তারা কী করে? বল্ না – পৃথিবীতে – বল্ – তারাই সকলের ওপর জয়ী হয়, না?
ছেলেরা : হ্যাঁ, জয়ী হয়।
গুরু : উত্তরকূটের মানুষ কোনোদিন যুদ্ধে হেরেচে জানিস্?
ছেলেরা : কোনোদিনই না।
এর সঙ্গে কি আমরা আমাদের চারপাশের অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পাই না? কেবল আমাদের এ-অঞ্চলে নয়, অন্য ভূখণ্ডেও এ-ধরনের অন্ধ ও সংকীর্ণ মতাদর্শের শিক্ষা মাবনতার প্রতি বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি, আমার নিজের ধর্মই শ্রেষ্ঠ। ভিন্ন ধর্মের প্রতি আমাদের কোনো 888sport apk download apk latest versionবোধ নেই। ফলে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বেড়েই চলেছে। এখানেই এ-সময়ে রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারার মতো নাটকের প্রাসঙ্গিকতা। কিছুদিন আগে আমরা সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের স্কুলের পাঠ্যতালিকা থেকে কিছু লেখা বাদ দেওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। ওই যে গুরু শেখাচ্ছেন, ‘ওদের ধর্ম খুব খারাপ’, আমরা কি তারই পুনরাবৃত্তি করছি না? একটা সাম্প্রদায়িক প্রজন্ম তৈরি করার মরণখেলায় মেতেছি আমরা।
১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ 888sport slot gameশেষে তৃতীয়বারের মতো আমেরিকায় গিয়েছিলেন। পরের বছর কলকাতায় ‘শিক্ষার মিলন’ শীর্ষক এক 888sport liveে তিনি লিখেছিলেন :
অনবচ্ছিন্ন সাত মাস আমেরিকার ঐশ্বর্যের দানবপুরীতে ছিলেম। সেখানে ভোগের চেহারা দেখেছি, আনন্দের না। দানব মন্দ অর্থে বলছি নে, ইংরেজিতে বলতে হলে হয়তো বলতেম, টাইটানিক ওয়েলথ্। অর্থাৎ যে ঐশ্বর্যের শক্তি প্রবল, আয়তন বিপুল। … আটলান্টিকের ওপারে ইঁটপাথরের জঙ্গলে বসে আমার মন প্রতিদিনই পীড়িত হয়ে বলেছে, তালের খচরমচরের অন্ত নেই, কিন্তু সুর কোথায়? আরো চাই, আরো চাই, আরো চাই, – এ বাণীতে তো সৃষ্টির সুর লাগে না।
১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবীর প্রথম খসড়া ‘যক্ষপুরী’ রচনা করেন এবং পরের বছর প্রবাসীতে রক্তকরবী প্রকাশিত হয়। পাশ্চাত্যের ধনবাদী যান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা রক্তকরবীর পটভূমিকা হিসেবে বিবেচিত। কবির আমেরিকা 888sport slot gameের ছায়াও নাটকটিতে পড়েছে বলে আমরা অনুমান করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ নাটকটির প্রস্তাবনায় বলেছেন, বাল্মীকির রামায়ণকে ভক্তপাঠকেরা যেভাবে সত্যমূলক বলে স্বীকার করেন, এ-নাটকটিও ‘সত্যমূলক’। সঙ্গে এ-কথাও যোগ করেছেন, ‘কবির জ্ঞান-বিশ্বাস-মতে এটি সত্য।’ আরো বলেছিলেন, ‘কর্ষণ-জীবী এবং আকর্ষণ-জীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ-সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লিকে কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তাছাড়া শোষণ-জীবী সভ্যতার ক্ষুধা-তৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো।’ আজকের পৃথিবীর দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণগুলোকে এত প্রাসঙ্গিক মনে হয়! দূরে যাওয়ার দরকার নেই। আমাদের দেশেই সিন্দুকভর্তি রাশি রাশি অর্থ আর বিস্ময়কর বিত্তের তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মানুষের লোভ-লালসা, ভোগ-বিলাস, দুর্নীতি ও নীতিহীন রাজনীতি কী ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
রক্তকরবীর শেষদিকে যখন রঞ্জনের প্রাণহীন দেহ দেখে নন্দিনী প্রশ্ন করে, ‘কেন এমন সর্বনাশ করলে?’ তারপরের সংলাপগুলোতে আমরা একটু কান পাতি :
রাজা : আমি যৌবনকে মেরেছি – এতদিন ধরে আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে কেবল যৌবনকে মেরেছি। মরা-যৌবনের অভিশাপ আমাকে লেগেছে।
নন্দিনী : ও কি আমার নাম বলেনি।
রাজা : এমন করে বলেছিল, সে আমি সইতে পারিনি। হঠাৎ আমার নাড়ীতে নাড়ীতে যেন আগুন জ্বলে উঠল।
নন্দিনী : (রঞ্জনের প্রতি) বীর আমার, নীলকণ্ঠপাখির পালক এই পরিয়ে দিলুম তোমার চূড়ায়। তোমার জয়যাত্রা আজ হতে শুরু হয়েছে। সেই যাত্রার বাহন আমি। – আহা, এই-যে ওর হাতে সেই আমার রক্তকরবীর মঞ্জরি। তবে তো কিশোর ওকে দেখেছিল। সে কোথায় গেল। রাজা, কোথায় সেই বালক।
রাজা : কোন্ বালক।
নন্দিনী : যে-বালক এই ফুলের মঞ্জরি রঞ্জনকে এনে দিয়েছিল।
রাজা : সে-যে অদ্ভুত ছেলে। বালিকার মতো তার কচি মুখ, কিন্তু উদ্ধত তার বাক্য। সে স্পর্ধা করে আমাকে আক্রমণ করতে এসেছিল।
নন্দিনী : তার পরে? কী হল তার। বলো কী হলো। বলতেই হবে, চুপ করে থেকো না।
রাজা : বুদ্বুদের মতো সে লুপ্ত হয়ে গেছে।
নন্দিনী : রাজা, এইবার সময় হল।
রাজা : কিসের সময়।
নন্দিনী : আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা : আমার সঙ্গে লড়াই করবে তুমি! তোমাকে-যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি।
নন্দিনী : তারপর থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। আমার অস্ত্র নেই, আমার অস্ত্র মৃত্যু।
এ-সংলাপেরই যেন অনুরণন শুনতে পাই হিংসায় উন্মত্ত আজকের ভারতে দিল্লির জামিয়া মিলিয়ারের এক তরুণ তুর্কি আমির আজিজের সাহসী 888sport app download apkয় :
সব ইয়াদ রাখা যায়েগা –
তুম রাত লিখো, হাম চান্দ লিখেঙ্গে,
তুম কালা কামাল লিখো, হাম লাল গুলাব লিখেঙ্গে,
তো তুম জামিন পে জুল্ম লিখ্ দো,
আসমান পে ইনকিলাব লিখা যায়েগা
সব ইয়াদ রাখা যায়েগা,
সব কুছ ইয়াদ রাখা যায়েগা।
এখানেই রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রাসঙ্গিকতা।
সবধরনের মৌলবাদ ও অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিয়েছিলেন যুক্তি ও মানবতার পক্ষ। বিসর্জন আর অচলায়তনের কথা ভাবুন। অধুনা ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত উপমহাদেশের রাজনীতিতে কত রঘুপতি, কত জয়সিংহ, কত নক্ষত্ররায় আমাদের চারদিকে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছেন, আমরা দেখতে পাই না। তাঁর নাট্যচর্চা আরো তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দিতে পারলে এমন বিপদ থেকে আমরা খানিক হলেও হয়তো রেহাই পেতে পারতাম। পঞ্চকদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারতাম। ডাকঘরের অমলদের বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম।
অচলায়তনের অন্ধ বিশ্বাস আর সংস্কারের একটু নমুনা দেখা যাক :
পঞ্চক : তোর কোনো ভয় নেই ভাই, কোনো ভয় নেই। তুই আমার কাছে বল্, কী হয়েছে বল্।
সুভদ্র : আমি পাপ করেছি।
পঞ্চক : পাপ করেছিস? কী পাপ?
সুভদ্র : সে আমি বলতে পারব না। ভয়ানক পাপ। আমার কী হবে!
পঞ্চক : তোর সব পাপ আমি কেড়ে নেব, তুই বল্।
সুভদ্র : আমি আমাদের আয়তনের উত্তর দিকের –
পঞ্চক : উত্তর দিকের?
সুভদ্র : হ্যাঁ, উত্তর দিকের জানলা খুলে –
পঞ্চক : জানলা খুলে কী করলি?
সুভদ্র : বাইরেটা দেখে ফেলেছি।
পঞ্চক : দেখে ফেলেছিস? শুনে লোভ হচ্ছে যে!
সুভদ্র : হ্যাঁ পঞ্চকদাদা। কিন্তু বেশিক্ষণ না – একবার দেখেই তখনই বন্ধ করে ফেলেছি। কোন্ প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
পঞ্চক : ভুলে গেছি ভাই। প্রায়শ্চিত্ত বিশ-পঁচিশ হাজার রকম আছে। আমি যদি এই আয়তনে না আসতুম তা হলে তার বারো আনাই কেবল পুঁথিতে লেখা থাকত; আমি আসার পর প্রায় তার সব-কটাই ব্যবহারে লাগাতে পেরেছি, কিন্তু মনে রাখতে পারি নি।
বালকদলের প্রবেশ
প্রথম বালক : অ্যাঁ, সুভদ্র! তুমি বুঝি এখানে?
দ্বিতীয় বালক : জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র কী ভয়ানক পাপ করেছে?
পঞ্চক : চুপ চুপ। ভয় নেই সুভদ্র। কাঁদছিস কেন ভাই। প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় তো করবি।
প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারি মজা। এখানে রোজই একঘেয়ে রকমের দিন কাটে, প্রায়শ্চিত্ত না থাকলে তো মানুষ টিকতেই পারত না।
প্রথম বালক : (চুপি চুপি) জান পঞ্চকদাদা, সুভদ্র উত্তর দিকের জানলা –
পঞ্চক : আচ্ছা আচ্ছা, সুভদ্রের মতো তোদের অমন সাহস আছে?
দ্বিতীয় বালক : আমাদের আয়তনের উত্তর দিকেটা যে একজটা দেবীর।
তৃতীয় বালক : সেদিক থেকে আমাদের আয়তনে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে তা হলে যে সে –
পঞ্চক : তা হলে কী?
তৃতীয় বালক : সে যে ভয়ানক।
পঞ্চক : কী ভয়ানক, শুনিই না।
তৃতীয় বালক : জানি নে, কিন্তু সে ভয়ানক।
সুভদ্র : পঞ্চকদাদা, আমি আর কখনো খুলব না পঞ্চকদাদা। আমার কী হবে?
পঞ্চক : শোন্ বলি সুভদ্র, কিসে কী হয় আমি ভাই কিছুই জানি নে। কিন্তু যাই হোক-না, আমি তাতে একটুও ভয় করি নে।
এর সঙ্গে কী আমাদের দেশের কিছু বিদ্যায়তনের দম-বন্ধ-করা পরিবেশ আর শিক্ষার ধরনের মিল খুঁজে পাই না? এ-ধরনের অচলায়তন বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে সবাই কঠিন নিয়মে বাঁধা। শাস্ত্রবাক্যের বিকৃত ব্যাখ্যা অচলায়তনের বাসিন্দাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, রবীন্দ্রনাথ বারবার ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে উদাহরণ খুঁজেছেন। মালিনী, শ্যামাতে যে বৌদ্ধ পরিসর আছে তা বাঙালির খুব কাছের। নেপালি বৌদ্ধ 888sport live football থেকে গৃহীত এক গল্প থেকে সূত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চণ্ডালিকা নাটকের আখ্যান রচনা করেছেন। চণ্ডাল বলে আমরা যাদের আখ্যায়িত করি তারা আমাদের সমাজে অস্পৃশ্য। কেউ তাদের ছোঁয়া জল পর্যন্ত পান করে না। কিন্তু এক অভূতপূর্ব ঘটনা, চণ্ডালকন্যা প্রকৃতির জীবনে নিয়ে এলো ব্যাপক আলোড়ন। মায়ের প্রশ্নের জবাবে প্রকৃতি বর্ণনা করছে সে-ঘটনা।
প্রকৃতি। সেদিন রাজবাড়িতে বাজল বেলা দুপুরের ঘণ্টা, ঝাঁঝাঁ করছে রোদ্দুর। মা-মরা বাছুরটাকে নাওয়াচ্ছিলুম কুয়োর জলে। কখন সামনে দাঁড়ালেন বৌদ্ধভিক্ষু, পীত বসন তাঁর। বললেন, জল দাও। প্রাণটা উঠল চমকে, শিউরে উঠে প্রণাম করলেম দূর থেকে। ভোরবেলাকার আলো দিয়ে তৈরি তাঁর রূপ। বললেম, আমি চণ্ডালের মেয়ে, কুয়োর জল অশুদ্ধ। তিনি বললেন, যে-মানুষ আমি তুমিও সেই মানুষ; সব জলই তীর্থজল যা তাপিতকে স্নিগ্ধ করে, তৃপ্ত করে তৃষিতকে। প্রথম শুনলুম এমন কথা, প্রথম দিলুম এক গণ্ডুষ জল, যাঁর পায়ের ধুলোর এক কণা নিতে কেঁপে উঠত বুক।
মা। ওরে অবোধ মেয়ে, হঠাৎ এত বড়ো হোলো তোর বুকের পাটা! এ পাগলামির প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। জানিস নে কোন্ কুলে তোর জন্ম?
প্রকৃতি। কেবল একটি গণ্ডুষ জল নিলেন আমার হাত থেকে, অগাধ অসীম হোলো সেই জল। সাত সমুদ্র এক হয়ে গেল সেই জলে, ডুবে গেল আমার কুল, ধুয়ে গেল আমার জন্ম।
অস্পৃশ্যতা আমাদের সমাজে এখনো বিরাজমান। আজকের ভারতেও কোনো কোনো এলাকায় এ-বিভেদ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। আমাদের দেশেও ‘হরিজন’ সম্প্রদায়ের 888sport promo code-পুরুষ উচ্চশিক্ষিত হলেও কর্মক্ষেত্রে অনেকের কাছেই ‘অস্পৃশ্য’ বিবেচিত এবং নানাভাবে সামাজিক নিগ্রহের শিকার হয়। চণ্ডালিকা কী আমাদের চোখ খুলে দিতে পারে না? পৃথিবীতে সব জাতি-ধর্মের মানুষের সমঅধিকারের কথা আমরা বড়গলায় বলি, কিন্তু নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে বিব্রত বোধ করি। চণ্ডালিকায় প্রকৃতি বলে : ‘যে-ধর্ম অপমান করে সে-ধর্ম মিথ্যে। অন্ধ ক’রে, মুখ বন্ধ ক’রে সবাই মিলে সেই ধর্ম আমাকে মানিয়েছে। কিন্তু সেদিন থেকে এই ধর্ম মানা আমার বারণ।’ এর মধ্যেই তো আমরা খুঁজে পেতে পারি আমাদের প্রতিবাদের শক্তি।
আমরা এখন বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক 888sport promo code দিবস পালন করি, 888sport promo codeর সমঅধিকারের দাবিতে সোচ্চার হই। কিন্তু 888sport promo codeর মর্যাদা ও স্বাধিকারের কথা রবীন্দ্রনাথের মতো এত স্পষ্ট করে আজো বলা হয় না। চিত্রাঙ্গদা বা তপতীর মধ্যে সেই সূত্র আমরা খুঁজে পেতে পারি।
মেহনতি মানুষের জন্য তাঁর দরদ ফুটে উঠেছে অনেক রচনায়। তাঁকে কমিউনিস্টরা এককালে অনেক গালমন্দ করেছেন। বুর্জোয়া বলে হেয় করেছেন। তাঁর মতো রথের রশি বা কালের যাত্রা লিখতে পারেননি। এখন যে-কোনো দেশে যে-কোনো সভ্যতায় সবধরনের শিরোমণিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর নাটক প্রতিবাদ হয়ে ঝলসে উঠতে পারে। তাই রক্তকরবী, মুক্তধারা বা রথের রশি এতরকমভাবে এতরকম জায়গায় মঞ্চস্থ হচ্ছে। হবেও।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকীর সময়ে আমরা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট থেকে তাঁর নিজের অনূদিত পনেরোটি
নাটকের ইংরেজি সংকলনের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম। তখন অনুভব করেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে কালজয়ী নাট্যকার হিসেবে বিশ্বসভায় তাঁর প্রাপ্য আসনটি দিতে হলে তাঁর নাটকের আজকের সময় উপযোগী মানসম্পন্ন ইংরেজি 888sport app download apk latest version খুবই প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে আনন্দ লালের করা রক্তকরবী, তপতী ও অরূপ রতন – এই তিনটি নাটকের আধুনিক ইংরেজি 888sport app download apk latest versionের কথা উল্লেখ করতে পারি।
এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে, যখন আমরা তাঁর নাটকগুলো টেক্সট পরিবর্তন না করে প্রযোজনায় শম্ভু মিত্রের মতো সৃষ্টিশীল হতে পারব, বৈচিত্র্য আনতে পারব। কালজয়ী নাটককে সমসাময়িক করার সেটাই তো প্রধান উপায়। তাছাড়া আমাদের দেশে বর্তমানে নাট্যরচনার বন্ধ্যত্ব কিছুটা ঘোচানো যেতে পারে রবীন্দ্রনাথের গল্প-888sport alternative linkের মানসম্পন্ন নাট্যরূপ দিয়ে। আবারো মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলব, খেদোক্তি না করে আমাদের রবীন্দ্রনাটকের চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে, তবেই এ-সময়ের একজন অনন্যসাধারণ নাট্যকার হিসেবে আমরা রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করতে পারব।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.