রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গে

 

বক্তৃতা

আখতার হোসেন খান

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পূর্ববঙ্গের বক্তৃতা : ১৮৯২-১৯২৬

সংকলন ও ভূমিকা : ভূঁইয়া ইকবাল

প্রথমা প্রকাশন

888sport app, ২০১৬

২৫০ টাকা

রবীন্দ্রনাথ নামের মহাসমুদ্র-মন্থন এক অসম্ভব প্রকল্প; এবং তাই কেউ যদি দাবি করেন, তিনি বিশ্বকবির পুরোটা নিয়ে এক মহাগ্রন্থ লিখবেন, সম্ভাব্য উৎসুক পাঠকদের উচিত হবে জন্মান্তরের জন্য অপেক্ষা করা।  ‘রবীন্দ্র-জীবনীকার’ পরিচয়ের একটা শব্দগুচ্ছ বাংলা ভাষায় যুক্ত হয়েছে। সেসব জীবনীগ্রন্থ না পড়েই বলে দেওয়া সম্ভব, পুরো রবীন্দ্রনাথ তাতে নেই। অনেক ঢাউস-ঢাউস বই বেরিয়েছে বিশ্বকবিকে নিয়ে; পিএইচডির সন্দর্ভ লেখকেরা বাদে অন্য কেউ নাম-পাতার বাইরে যান কি না, এ-সম্পর্কে যুক্তিসংগত সন্দেহপোষণ সম্ভব। বরঞ্চ ওই মহাসাগরের খাড়ি-উপখাড়ি, কোনা-কাঞ্ছি, তটভূমি নিয়ে নিবিষ্টচিত্তে বর্তমান যুগের পাঠকদের জন্য মূল্যবান সব রত্ন বা উপল-খ-  নিয়ে মনোনিবেশ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অসামান্য চিত্তাকর্ষক যেসব বই বেরিয়েছে, তার একটা বড়ো অংশ মহাকবির অংশবিশেষকে নিয়ে এগিয়েও তাই মহৎ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য। বুদ্ধদেব বসুর কবি রবীন্দ্রনাথ এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখ প্রত্যেকেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে 888sport app download for androidীয় সব 888sport live-888sport app download apk লিখেছেন। সুধীন দত্তের কুলায় ও কালপুরুষ গ্রন্থের পাঁচটি এবং ইংরেজিতে লেখা আরও তিনটি 888sport live রবীন্দ্র-অনুরাগের প্রমাণ। কয়েক বছর আগে সুধীন দত্তের সরাসরি ছাত্র কলকাতার শিক্ষাবিদ ও গবেষক অমিয় দেব লিখেছেন কী ফুল ঝরিল নামে এক অসামান্য বই। মনে হবে ছোটো পরিসরে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এক নতুন ভাষায় লেখা তুলনাহীন এমন এক সৃষ্টি পুরো রবীন্দ্রনাথই যাতে আছেন। একই লেখকের সাম্প্রতিকতম বই (কলকাতার বইমেলা ২০১৬ উপলক্ষে ‘কারিগরে’র প্রকাশনা) বিপুল তরঙ্গ রে বাংলাভাষীদের রবীন্দ্র-আখ্যান-তৈরিতে এক প্রাঞ্জল ও অভিনব সংযোজন। 888sport appকেন্দ্রিক সব অগ্রগণ্য লেখকই ঘুরে-ফিরে রবীন্দ্রনাথে এসেছেন; এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা-888sport free bet এই বাংলাতেও গণনার অতীত।

ওই ধারাতেই রবীন্দ্রনাথের লেখা, বক্তৃতা বা চিঠিপত্রের সংকলন নিয়েও যে অমূল্য ও প্রাসঙ্গিক সব বই লেখা সম্ভব তার প্রমাণ রেখেছেন সম্প্রতি গবেষণার জন্য বাংলা একাডেমি 888sport live football 888sport app download bdজয়ী ভূঁইয়া ইকবাল। এই গবেষক এক বিরল পথের যাত্রী, তীক্ষ্ণ চোখের এক অসামান্য দ্রষ্টা। তাঁর বিষয়-নির্বাচন তাঁর অতুলনীয় বিচারবোধের স্বাক্ষর; এবং বিষ্ণু দে-কথিত প্রচলিত ‘রবীন্দ্র ব্যবসা’র বাইরের বলয়ের কারণে ও বিষয় নিয়ে তাঁর পদচারণা শুধু তৃপ্তিদায়কই নয়, স্বভাষাগোষ্ঠীর বৌদ্ধিক পরিম-ল গঠন ও বিস্তারে অসামান্য ভূমিকা রাখতে সমর্থ। তাঁর লিখিত ও সম্পাদিত গ-া চারেক বইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথবিষয়ক পঞ্চম বইটি (২০১৬-এর 888sport cricket BPL rateের বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথমা প্রকাশনের পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা ১৮৯২-১৯২৬) তাঁর নিরীক্ষাধর্মী মনন ও বিশেস্নষণে পারঙ্গম চিৎপ্রকর্ষের প্রমাণ।

তাঁর এক বিশেষ গুণ তিনি অল্প কথার মানুষ; এবং তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কারণেই হোক বা না হোক, তিনি সরাসরি বিষয়ে ঢুকে প্রামাণ্যকে সামনে আনেন ও তার সমাধান করেন। দেড়শো পৃষ্ঠার বইটিতে সাত পৃষ্ঠার ভূমিকায় প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি ১৮৯২ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে দেওয়া বিশ্বকবির কুড়িটি বক্তৃতা এ-বইয়ে সংকলিত করেছেন। তাঁর কৃতিত্ব আরো বড়ো করে দেখা সম্ভব এজন্য যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশাতেই এই বক্তৃতাগুলো পুস্তকাকারে প্রকাশের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন এবং এজন্যে উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। সে-বই শেষ পর্যন্ত বিশ্বকবির জীবদ্দশায় আর বের হয়নি।

এ-প্রসঙ্গে বইটির সম্পাদক ভূঁইয়া ইকবালের নিজ কথাই শোনা যাক : ‘সাময়িকপত্রে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই 888sport live football মন্দিরকে পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা গ্রন্থাগারে প্রকাশের একক স্বত্ব দেন কবি। বইয়ের প্রম্নফ দেখা ও ছাপার কাজও শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজতক বইটি প্রকাশ পায়নি। নয় দশক পর 888sport appর প্রথমা প্রকাশন পূর্ববঙ্গে বক্তৃতার প্রকাশভার গ্রহণ করল।’

বিষয়টি মনে করিয়ে দেয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে নির্বাচিত বাংলা 888sport app download apk ইংরেজি 888sport app download apk latest versionে প্রকাশের উদ্যোগ, যাতে রবীন্দ্রনাথ জড়িত হয়েছিলেন এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ভূমিকাও লিখে ফেলেছিলেন (সুকান্ত চৌধুরী-সম্পাদিত ও অমিয় দেবের ভূমিকাসংবলিত সুধীন দত্তের অগ্রন্থিত ইংরেজি লেখার সংগ্রহ দি আর্টিস্ট অফ দি ইনটেলেক্ট দ্রষ্টব্য)। ভূঁইয়া ইকবাল বিশ্বকবির একটা মনোবাঞ্ছা পূরণ করে বাংলাভাষীদের কৃতজ্ঞতায় বাঁধলেন। বইটি আসলেই ‘রবীন্দ্র গবেষণার এক নতুন অধ্যায়’।

এ-গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রচর্চায়  প্রথমা প্রকাশন একটা ঐতিহাসিক কাজ সম্পন্ন করেছে বলা চলে। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা যেহেতু ১৯০৫, ১৯৪৭ ও ১৯৭১-এর বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এসে মোটামুটিভাবে সেই পূর্ববঙ্গেই সার্বভৌম রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী 888sport apps প্রতিষ্ঠা করেছে, তাই এই বক্তৃতামালার গুরুত্ব ও তাৎপর্য একাধিক কারণে মনে রাখার মতো। বক্তৃতার স্থান রাজশাহী, পাবনা, সিলেট, 888sport app, ময়মনসিংহ, কুমিলস্না ও নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শহর ওই নতুন দেশেরই অংশ।

কুড়িটি বক্তৃতার মধ্যে দুটি নোবেল 888sport app download bdপ্রাপ্তির আগের; বাকিগুলো ১৯১৪ থেকে ১৯২৬ পর্বে। বিশ্বকবি যখন
বক্তৃতাগুলো দেন, 888sport appকেন্দ্রিক প্রদেশ গঠন-বিলোপ বা  888sport app বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে তৈরি উত্তাপের ছিটেফোঁটা যে তখনো নেই তা নয়। মুসলিম হলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার মূল ভবন কার্জন হলে দেওয়া মোট তিনটি বক্তৃতা তাই অভিনিবেশী দৃষ্টিতে দেখা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

মুসলিম হলের বক্তৃতায় তিনি আহবান জানান : ‘আবার একদিন আমাদের ক্ষমার পথ, সহিষ্ণুতার পথ, প্রীতি, মৈত্রী, সখ্যতার পথ খুলতে হবে।’ এর আগে জগন্নাথ (ইন্টারমিডিয়েট) কলেজে বক্তৃতায় বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ার পেছনে নদী ও ভাষা যে বিশাল কার্যকর ভূমিকা রেখেছে তা মনে করিয়ে দেন। নদী তো এক অর্থে রবীন্দ্রনাথকেই গড়েছে বলা চলে। বাংলার সভ্যতা-সংস্কৃতির যতটুকুই তিনি দেখে যেতে পেরেছেন, তার পেছনে তো নদীর ভূমিকা অসামান্য; আর বাংলা ভাষা ছাড়া বাঙালিদের কীইবা আছে।

সবচেয়ে বড়ো কথা, এই ভাষণগুলোর সর্বত্রই ঐক্যের ডাক। মুসলিমপ্রধান পূর্ববঙ্গের মুসলিমদের তিনি কাছে টানতে চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে পলিস্নপ্রধান সমাজের উন্নতির জন্য তিনি যে কত চিমিত্মত ছিলেন, তা বোঝা যায় ছত্রে-ছত্রে। গ্রামে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অতিসজাগ।

ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে তিনি গিয়েছিলেন দুজন ইতালীয় অধ্যাপককে সঙ্গে নিয়ে, যাঁদের তখনকার প্রচলিত কথায় ভারতবিদ বলা চলে। তাঁদের দৃষ্টান্তকে দেখিয়ে তিনি ছাত্রদের ‘জ্ঞানের পথ গ্রহণ’ করতে উদাত্ত আহবান জানান। অন্যত্র পূর্ববঙ্গের লোককে ‘নিষ্ঠাবান, দৃঢ়সংকল্প, সরলচিত্ত’ আখ্যা দিয়ে আরো জানালেন, ‘এরা বুদ্ধির অহংকারে বিদ্রূপের দ্বারা বড়ো বড়ো কথাকে দূর করে দেয় না’ – সেই জন্যে পূর্ববঙ্গকে তাঁর কাছে ‘কাজের ক্ষেত্র’ মনে হয়েছে। আরেক জায়গায় জানান : ‘সমগ্রতার রূপকে বাল্যকাল থেকে পূজা করে এসেছি। খ-তাকে বড়ো মানিনি।’

এই ভাষণগুলোর শুধু প্রথমটিই – ‘শিক্ষার হেরফের’ – রবীন্দ্রনাথের যুবকাবস্থায়, ১৮৯২ সালে রাজশাহীতে, নোবেল 888sport app download bd পাওয়ার দু-দশকেরও বেশি সময় আগের; বাকিগুলো ১৯১৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে। প্রায় সবই দেশ-হিতৈষণা, রাষ্ট্র-সমাজ নিয়ে ভাবনা, পলিস্নর উন্নতি ইত্যাদি নিয়েই ব্যাপৃত ব্যাপকভাবে; এবং ঐক্যের ডাক সর্বত্র। শতবর্ষের আগের হলেও তাঁর চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা আজো আছে বিপুলভাবে; এবং সেজন্যই তো আজো তাঁর পলিস্নভাবনা, সমবায় চিন্তা, দেশগড়া সবকিছু নিয়ে সবাই ভাবে; আধুনিক সমাজ গড়ায় রবীন্দ্রনাথের ডাক পড়ে।

নোবেল 888sport app download bd পাওয়ার পরে তাঁর জীবনের একটা নতুন পর্ব শুরু হয়। তিনি সারা পৃথিবীর হয়ে ওঠেন। কিন্তু এর মধ্যেও যে জ্বালা ছিল, তা তিনি নিজের কথাতেই প্রকাশ করেন : ১৯১৪-র ফেব্রম্নয়ারিতে পাবনায় 888sport live football সম্মেলনে নোবেল 888sport app download bdকে নিজ গায়ে বাঁধা ‘একটা ঝুমঝুমি’র সঙ্গে তুলনা টানলেন।

কার্জন হলে তিন দিনে দুটি ইংরেজি বক্তৃতা –  ‘দি মিনিং অফ আর্ট’ এবং ‘দি রুল অফ দি জায়ান্ট’ –  উপস্থিত বিদেশিদের মনে রেখেই দেওয়া। এর মধ্যে প্রথমটি এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত অন্যসব ভাষণ থেকে ভিন্নমাত্রার। বিশ্বকবি এখানে আর্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা আর স্বর্গবিশ্বাসের কথা এনেছেন বটে, কিন্তু যে-তত্ত্ববাণী এর বিভিন্ন বাক্যে এসে গেছে, তা নিয়ে ওই সময়ের আর্ট ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে যাঁরা বেশি ভাবতেন, তাঁদের কথা মনে করিয়ে দেয়।  কখনো-কখনো মনে হবে যেন, পরের যুগের রজার ফ্রাই, ক্লাইভ বেল, হাবার্ট রিড প্রমুখের লেখা পড়ছি। রবীন্দ্রনাথ যে-আর্টের দর্শনের এক গুরুভার চিন্তক, এই বক্তৃতা তার স্বতঃপ্রমাণ।

বেদব্যাখ্যাকারী সায়ণাচার্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ভাষণের প্রথম অনুচ্ছেদেই তিনি বললেন : ‘আর্ট মানুষের জীবন-সম্পদের বহিঃপ্রকাশ; উৎকর্ষের রূপকল্পেই তা স্বাধীনতার সন্ধান করে, ওই উৎকর্ষেই তার পরিণতি।’ জীবনকে তিনি দেখেন সারাক্ষণ সৃষ্টিশীল; কেননা এতে আছে সেই উদ্বৃত্ত যা সন্নিকটবর্তী স্থানকালের সীমা অতিক্রম করে  যায়; আত্মোপলব্ধির বিচিত্র রূপকল্পে রোমাঞ্চে-ভরা অবিশ্রাম অনুধাবনই তার কাজ। চিত্রকে তিনি বললেন ‘চিরস্থায়ী স্বপ্ন’, আর নৃত্যকে অভিহিত করলেন ‘গতির স্থির কেন্দ্রবিন্দুতে পরমানন্দময় ধ্যান’ বলে। চিত্র ও নৃত্যের এ তো এক নতুন সংজ্ঞা।

‘দি রুল অফ দি জায়ান্ট’ যুদ্ধবিদ্যা ও লাভার্জনের ব্যাপক প্রসারের বিপদ সম্পর্কে সচেতন-ঘণ্টা বাজায়। বক্তৃতাশেষে আসে এই অমোঘ কথাগুলো : ‘গণতন্ত্রের সৌধে অসংখ্য জীবনের উৎসর্গ হলেও শুধুই ধনপ্রতাপী আর স্বৈরীরাই তাঁদের ঘাড়ে পা দিয়ে মোটা হন; এবং দেবতা যেমন কিছুই টের পান না, তেমনি ধর্মভীরু পূজারীও মূর্খতার তৃপ্তিতে হাসেন।’ কথাগুলো আজকের দিনে কি আরো বেশি সত্য নয়?

পল্লির ‘প্রাণ-নিকেতনেই’ কর্মের অনুষ্ঠান গড়ে তুলতে তিনি আহবান জানান কুমিল্লণা অভয় আশ্রমের বক্তৃতায়। ব্রাহ্মমন্দিরের ভাষণে তিনি আধ্যাত্মিকতার চেয়ে বেশি দেশের কথা বলেন। অন্য বক্তৃতাগুলোও ঘুরে-ফিরে যত-না 888sport live footballবিষয়ক, তার চেয়ে বেশি একজন দেশহিতৈষীর আন্তরিক বোধ।

ওই একই ভাষণে তিনি ‘গন্তব্যে’র জায়গায় ‘গম্যস্থান’ ব্যবহার করেছেন। এই বিরল-ব্যবহূত শব্দটি মনে রাখার মতো; কবিদের কাজে লাগতে পারে। ময়মনসিংহ মহিলা সমিতির সংবর্ধনার উত্তরে অন্য কথার মধ্যে এ-কথাটি জানান : ‘মাতৃভাষায় যথার্থ যে বাণী তা মেয়েদের কাছে যেমন সত্যভাবে পৌঁছায়, এমন আর কোথাও নয়। আমি আমার কাব্য রচনার প্রথম আরম্ভ থেকে এই কথাটি অনুভব করেছি, মেয়েদের হূদয়ে, কণ্ঠে আমার গান আমার কাব্য স্থান লাভ করেছে।’ মেয়েদের কাছে মাতৃভাষার বাণী অধিকতর পৌঁছানোর এই যে তত্ত্ব, তা প্রণিধানের বিষয়ই বটে। মানুষের ভাষাকে তো ‘মাতৃভাষা’ই বলা হয়, ‘পিতৃভাষা’ নয়।

এই বক্তৃতাগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা যে-রবীন্দ্রনাথকে পাই, তা সুপরিণত, সুসমৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ; কুড়ি বছর আগে তিনি যা ছিলেন, তা থেকে অনেক বেশি ‘আলোর দিকে’ উৎসারিত। অন্য সব অমর ও মহতের মতোই তিনি দিনে-দিনে জগৎকে আরো বেশি করে জেনেছেন; কোনো এক অপরিসর কূপের জাড্যে স্থির হয়ে তিনি থাকেননি।

কিন্তু এর পরেও তাঁর একত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯২ সালে রাজশাহীতে দেওয়া ভাষণ ‘শিক্ষার হেরফের’ নামের দুর্লভ  সম্পদ মনে আসবেই। পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা বইয়ের সংকলনকারী ভূঁইয়া ইকবাল  আলাপচারিতায় বলতে পছন্দ করেন, বিগত সোয়াশো বছরে শিক্ষা নিয়ে বাংলা ভাষায় এ-ধরনের লেখা আর হয়নি। ওই বয়সেই রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন ‘নীরস শিক্ষায়’ জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ কতগুলো কথার বোঝা টেনে কেটে যায়; এবং আমরা ‘সরস্বতীর সাম্রাজ্যে কেবলমাত্র মজুরি করিয়া মরি, পৃষ্ঠের মেরুদ- বাঁকিয়া যায় এবং মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ হয় না।’ ভাষণের শেষ অংশে তিনি বলেন : ‘এখন আমরা বিধাতার নিকট এই বর চাহি, আমাদের ক্ষুধার সহিত অন্ন, শীতের সহিত বস্ত্র, ভাবের সহিত ভাষা, শিক্ষার সহিত জীবন কেবল একত্র করিয়া দাও।’ বক্তৃতার প্রথম দিকে আছে এই বৈপ্লবিক কথা : ‘পৃথিবীর পুস্তকসাধারণকে পাঠ্যপুস্তক এবং অপাঠ্যপুস্তক, প্রধানত এই দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। টেক্সট বুক কমিটি হইতে যে-সকল গ্রন্থ নির্বাচিত হয় তাহাকে শেষোক্ত শ্রেণীতে গণ্য করিলে অন্যায় বিচার হয় না।’ ভারাক্রান্ত শিক্ষায় জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ কাটানোর এই যজ্ঞে আজকের শিশুরা তো আরো বেশি বিপর্যস্ত; তাদের মুক্ত করার উদ্যোগ কোথায়?

পাবনায় রাজনৈতিক  কর্মসূচিতে দেওয়া ভাষণে তিনি গ্রাম নিয়ে ম-লী গঠন এবং সালিশের মাধ্যমে গ্রামের বিবাদ ও মামলা মেটানোর কথা আনলেন। এই সালিশের মাধ্যমে বিচার কি আজো আমাদের অধরা লক্ষ্য নয়? ওই ভাষণে বলা এই কথাগুলো কি আজো কানে বাজবে না : ‘দুর্বলতার সংশ্রবে আইন আপনি দুর্বল হইয়া পড়ে, পুলিস আপনি বিভীষিকা হইয়া উঠে। এবং যাঁহাকে রক্ষাকর্তা বলিয়া দোহাই পাড়ি স্বয়ং তিনিই পুলিশের ধর্মবাপ হইয়া দাঁড়ান।’

ভূঁইয়া ইকবালের রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র, রবীন্দ্রনাথ : তাঁর চিঠি, তাঁকে চিঠি এবং 888sport appsে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা ইত্যাদি বইয়ের মূল্য স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী 888sport appsে অসীম। পূর্ববঙ্গে বক্তৃতা ১৮৯২-১৯২৬ ওই তালিকায় যুক্ত আরেক জ্বলজ্বলে হীরকখ-। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা, রবীন্দ্রনাথ যে আজো আমাদের জন্য কত প্রয়োজনীয়, তা নির্বাচিত রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী ও তাঁদের ‘ধর্মবাপ’দের সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান বা গ্রাম-ম-লী গঠন ও সালিশের মাধ্যমে গ্রামের বিচার সম্পন্ন করার আহবানের মধ্য দিয়ে নতুনভাবে আরেক রকমে উদ্ভাসিত।