এগারো
১৯৬৮ সালে বিএ পাশ করার পর আমি আনন্দ মোহন কলেজে এমএ ক্লাসে ভর্তি হই। আমার বিষয় ছিল বাংলা। আনন্দ মোহন কলেজ ময়মনসিংহের একটি নামকরা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক আনন্দ মোহন বসুর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ১৯০৮ সালে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য তার আগে ১৮৮৩ সালে তিনি প্রথমে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আনন্দ মোহন কলেজের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রদান কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯০৯ সালে। প্রতিষ্ঠাকালে কলেজটিতে শিক্ষক ছিলেন মাত্র নয়জন এবং শিক্ষার্থী ১৭৮ জন। ১৯৬৪ সালে কলেজটি সরকারিকরণ করা হয়। এখন এই কলেজে প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে বলে শুনেছি।
স্বাধীন 888sport appsের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, লেখক ড. সফিউদ্দিন এবং কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাধা বিনোদ পাল আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আনন্দ মোহন কলেজে যাঁরা অধ্যয়ন করে পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের কয়েকজনের নাম : নীহাররঞ্জন রায় (ইতিহাসবিদ), পি সি সরকার (জাদুকর), প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ (শিক্ষাবিদ ও 888sport live footballিক), নুরুল আমিন (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (ঔপন্যাসিক), আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (কবি), যতীন সরকার (888sport live footballিক ও গবেষক), নির্মলেন্দু গুণ (কবি), রাশেদ খান মেনন (রাজনীতিবিদ)।
আমি আনন্দ মোহন কলেজে যখন ভর্তি হই তখন ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা রফিকউদ্দিন ভূঁইয়ার স্ত্রীও এ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তেন। তিনি দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন। তাঁকে আমরা আড়ালে মধুবালা বলে ডাকতাম। তিনি আমাদের কাছে ভারতীয় চিত্রনায়িকা মধুবালার মতোই ছিলেন।
আমাদের বৈষ্ণবকাব্য পড়াতেন আজিজুর রহমান স্যার। তিনি খুব রসিক মানুষ ছিলেন। তাঁর ক্লাসে আমরা খুব মজা পেতাম। স্যারের খুব পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। আজিজুর রহমান স্যার সৈয়দ নজরুল ইসলামের আত্মীয় ছিলেন বলে পরে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছে শুনেছি। ছাত্র অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে আমি দু-একবার গিয়েছি। তিনি আমাদের কিছু চাঁদা দিতেন। ছোট একটি টিনের ঘরে তাঁর ল’ চেম্বার ছিল।
আমি এমএ পড়ার সময়ই গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসি। তখন আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের কাজে বেশি না জড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কাজে যুক্ত করা হয়েছিল। আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাঁদের চিঠিপত্র আদান-প্রদানের কাজে আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। আত্মগোপনকারী নেতারা কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতেন না। প্রকাশ্যে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদের কাছে চিঠির মাধ্যমে নির্দেশনা পাঠাতেন নেতারা। দু-তিন হাত বদল হয়ে ওইসব চিঠি প্রাপকের হাতে পৌঁছত। নেতাদের নিরাপত্তার জন্যই কঠোর গোপনীয়তা মেনে চলা হতো। গোপন কাজ করতে গিয়েই আমি জ্যোতিষ বোস, মন্মথ দে-সহ অনেক কমিউনিস্ট নেতার সান্নিধ্যে এসেছিলাম। অজয় রায়ের সঙ্গেও আমার পরিচয় গোপন কাজের সময়েই। তিনি অবশ্য আমার দাদুবাড়িতে মাঝে মাঝে আত্মগোপনেও থেকেছেন।
অজয় রায়ের সঙ্গে প্রথমদিনের দেখা হওয়ার কথা বেশ মনে আছে। তিনি যখন জেলে ছিলেন তখন আমরা মিছিলে সেøাগান দিয়েছি – ‘জেলের তালা ভাঙবো, অজয় রায়কে আনবো’; কিন্তু অজয় রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় ছিল না। তবে তিনি যে বিপ্লবের জন্য আত্মনিবেদিত, সেটা জানতাম।
একদিন সন্ধ্যায় আমার বড়ভাই বিকাশ পাল আমাকে বলে যে, বাসায় একজন অতিথি আসবেন। গেস্টরুমে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে তাঁর আসার বিষয়টি কাউকে জানানো যাবে না। গোপন রাখতে হবে। কারণ তিনি রাজনীতি করেন। জানাজানি হলে তাঁরও বিপদ, আমাদেরও বিপদ। আমি কৌতূহল চেপে রেখে কে আসেন, তা দেখার অপেক্ষা করি।
দাদা বেরিয়ে গিয়ে ঘণ্টাখানেক পর একজন সুদর্শন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। আমার কানে কানে দাদা বলেন, ইনি অজয় রায়, আমাদের নেতা। তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কয়েকদিন আমাদের এখানে থাকবেন। অজয় রায়ের নাম শুনে এবং চোখের সামনে তাঁকে দেখে আমি ভেতরে ভেতরে শিহরণ অনুভব করি। তাঁর সম্পর্কে কত কথা শুনেছি। যিনি অনেক মানুষের কাছে আদর্শ, তিনি আমার সামনে, আমাদের বাসায় অতিথি। ভাবতেও তখন বিস্ময় লাগছিল। যা হোক, অজয় রায় প্রথম দফায় আমাদের বাসায় তিন-চার রাত ছিলেন। আমার সঙ্গে যে তখন তাঁর খুব বেশি কথা হয়েছে তা নয়। তিনি ওই সময় তাঁর কিছু চিঠি আমাকে দিয়ে বাইরে বিভিন্নজনের কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি সারাদিন ঘরেই থাকতেন। বই পড়তেন, লেখালেখি করতেন। রাতের বেলা বের হতেন। তবে ছদ্মবেশে। লুঙ্গি পরে, মাথায় টুপি দিতেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। আলগা দাড়িও ব্যবহার করতেন বলে মনে পড়ে।
আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় জ্যোতিষ বোস একদিন আমাকে দেখা করতে বলেন। দিনের বেলায় বাইরে বেরুনো সহজ হলেও রাতে বাইরে যাওয়া ছিল আমার জন্য কঠিন। দাদু-দিদিমা রাতে বাইরে যাওয়া পছন্দ করতেন না। জ্যোতিষদার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য আমাকে পরিচিত একজনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের গল্প ফাঁদতে হয়েছিল। সঙ্গে নিয়েছিলাম ছোটভাই বিজনকে। মনে আছে, সে-রাতে আমাকে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল, কারণ সত্যি তো আর কারো জন্মদিন ছিল না।
জ্যোতিষদা একজন রেলশ্রমিকের অসুস্থ স্ত্রীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। তাছাড়া কোনোভাবে সম্ভব হলে তাকে একটি শাড়ি দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। আমি আমার মায়ের একটি শাড়ি চুরি করে নিয়ে ওই শ্রমিকের স্ত্রীকে দিয়েছিলাম এবং ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থাও করেছিলাম।
আত্মগোপনে থাকা নেতাদের নির্দেশে আমাদের গোপনে কাউকে কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হতো। আমার হাতে পয়সাকড়ি তেমন থাকতো না। দাদুর কাছ থেকেই ফন্দিফিকির করে দু-চার টাকা হাতিয়ে নিয়ে তা আবার দান করতাম। তখন মানুষের চাহিদাও কম ছিল। অল্পতেই একজনকে তুষ্ট করা যেতো।
কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েই আমার সঙ্গে পরিচয় হয় ময়মনসিংহের 888sport promo codeনেত্রী রাজিয়া খাতুনের সঙ্গে। তাঁকে আমরা খালাম্মা বলতাম। আমার আগে থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। আমার মতো নতুন কর্মীদের কাছে রাজিয়া খালাম্মা অভিভাবকের মতো ছিলেন। তিনি বিয়েশাদি করেননি। ময়মনসিংহ শহরে তাঁর বাবা তাঁকে একটি বাড়ি বানিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বাড়িটি ছিল আমাদের এক প্রিয় ঠিকানা। রাজিয়া খালাম্মা ময়মনসিংহে মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী ছিলেন। ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি 888sport promo code-আন্দোলন এবং প্রগতিশীল রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীরা তাঁর কাছে মায়ের স্নেহ পেয়েছে। বিপদে-আপদে সবার পাশে দাঁড়াতেন।
রাজিয়া খালাম্মার বাবা নাসিরউদ্দিন সরকার ছিলেন জামালপুরের মেলান্দহের বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা। মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া ইউনিয়নের কাপাসহাটিয়া গ্রামে নিজের বাড়িতে ১৯৩৪ সালে গান্ধী আশ্রম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাসির সরকার। তাঁর মেয়ে রাজিয়া খাতুন ছিলেন গান্ধী আশ্রম কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তরুণ সমাজকে স্বদেশ চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে গান্ধী আশ্রমে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হতো।
নাসির সরকার ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ, গান্ধীজীর একান্ত ভক্ত। তিনি পাকিস্তানবিরোধী মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন। ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় এক সন্ধ্যায় মুসলিম লীগের গুণ্ডারা তাঁকে আক্রমণ করেছিল। তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে গিয়েছিল। গুরুতর আহত নাসির সরকারকে প্রথমে ময়মনসিংহে এস কে হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। সেখানে বিখ্যাত চিকিৎসক ও পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে মুসলিম লীগ সরকারের আক্রোশের শিকার হয়েছিল গান্ধী আশ্রম কেন্দ্র। কেন্দ্রটি প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নাসির সরকার মাথা নত করেননি। তাঁর বাড়িটি একসময় প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ঝিনাই নদী পরিবেষ্টিত নাসির সরকারের বাড়িতে ষাটের দশকে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রসর কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ওই বাড়িতে হয়েছে। মণি সিংহ, খোকা রায়, রবি নিয়োগীসহ অনেক কমিউনিস্ট নেতার ওই বাসায় যাতায়াত ছিল। ন্যাপ নেতা আলতাব আলী, আজিজুল ইসলাম খানের সঙ্গেও নাসির সরকারের সখ্য ছিল। নিজে গান্ধীবাদী হয়েও তিনি পাকিস্তানি দুঃশাসনের কালে বাম রাজনীতির এক বড় ভরসাকেন্দ্র ছিলেন। অজয় রায়ও একাধিকবার ওই বাড়িতে গিয়েছেন, থেকেছেন। তাঁর বাড়িটি ছিল মুক্তিকামী মানুষের মিলনকেন্দ্র।
ওই বাড়িতে অনেক গাছ ছিল। আমগাছও ছিল। একটি গাছের আম অজয় রায়ের ভীষণ পছন্দ ছিল। রাজিয়া খালাম্মা অজয় রায়ের জন্য জেলখানাতেও ওই গাছের আম পৌঁছে দিতেন বলে শুনেছি।
নাসির সরকার মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৭ সালের ৭ নভেম্বর। তাঁর মৃত্যুর পর, ২০০৭ সালের ২ অক্টোবর গান্ধী আশ্রম পুনরায় চালু হয়। তাছাড়া নাসির সরকারের বাসভবনেই মুক্তিসংগ্রাম জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটা জামালপুর জেলার একটি অনন্য সংগ্রহশালা হিসেবে এর মধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে।
বারো
রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, ইলা মিত্র – এদের জীবনকথা যে আমাকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেটা স্বীকার করতেই হবে। এই বিপ্লবী 888sport promo codeরা যে ত্যাগ ও সাহসের ঐতিহ্য তৈরি করে গেছেন, সে-সম্পর্কে জেনে আমি ভাবতাম, শুধু নিজের জন্য যে জীবন, সে-জীবনের সার্থকতা কী? দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার আগ্রহ আমার মধ্যে তৈরি হতে ওইসব বীর ও সংগ্রামী 888sport promo codeর জীবনসংগ্রাম আমাকে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করেছে।
চট্টগ্রামের পটিয়ার মেয়ে প্রীতিলতা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন। তিনি যখন বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, তখন আমাদের দেশে 888sport promo code শিক্ষা, 888sport promo code জাগরণের ধারা সেভাবে তৈরি হয়নি। বলা যায়, প্রীতিলতাই এক্ষেত্রে পাইওনিয়র। প্রীতিলতার জন্ম ৫ মে, ১৯১১ সালে। তিনি পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়াতে সায়ানাইড খেয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করেন ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। এতো অল্প বয়সে এতো সাহস তিনি কীভাবে অর্জন করেছিলেন, সেটা ভেবে অবাক হতে হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের জন্য ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করতে গিয়ে প্রীতিলতা পুলিশের বেষ্টনীতে পড়লে তাদের হাতে ধরা না দিয়ে সঙ্গে থাকা সায়ানাইড গলাধঃকরণ করেন। এটাই ছিল তখন বিপ্লবীদের শিক্ষা। পুলিশ নির্যাতন করে যাতে বিপ্লবীদের তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য জানতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেওয়াই ছিল রীতি। প্রীতিলতা বিপ্লবী দলের কাছে দেওয়া অঙ্গীকার পালনে এতটুকু দ্বিধা করেননি। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রথম বাঙালি 888sport promo code শহিদ। তাঁর সম্পর্কে জেনে ভেতরে ভেতরে সাহস এবং প্রত্যয় অনুভব করতাম। জানতাম, তাঁর মতো হতে পারবো না; কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মানুষের কল্যাণের জন্য সামান্য কাজও যদি করতে পারি, তা-ই বা কম কী!
চট্টগ্রামের আরেক বিপ্লবী 888sport promo code কল্পনা দত্তও ছিলেন আমার অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর শ্রীপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনিও মাস্টারদা সূর্য সেনের বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য গ্রেফতার হয়েছিলেন। কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। পরে কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে এসে মানবমুক্তির সংগ্রামে নতুন করে অংশ নেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলেছিলেন। ভারতের গণতান্ত্রিক এবং 888sport promo code-আন্দোলনে কল্পনা দত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একসময়ের সাধারণ সম্পাদক পূরণ চাঁদ যোশীর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। 888sport promo code ও মানবমুক্তি আন্দোলনের এই সাহসী নেত্রী চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান নামে একটি বইও লিখেছেন। ১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সংগ্রামী 888sport promo codeনেত্রী ইলা মিত্রের জীবনসংগ্রামও আমাকে প্রভাবিত করেছে। ইলা মিত্রের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যে-বর্বর নির্যাতন চালিয়েছিল, তা জেনে একদিকে যেমন ব্যথিত হয়েছি, অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সাহসও পেয়েছি। শোষিত-বঞ্চিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়ানোর অপরাধে ইলা মিত্রের ওপর পুলিশ অকথ্য অত্যাচার করেছে; কিন্তু তাতে তাঁর লড়াকু মনোভাবের এতোটুকু পরিবর্তন হয়নি। পরিস্থিতির চাপে দেশের মাটি ত্যাগ করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু আমৃত্যু তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সাথি।
ইলা মিত্রের জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর, যশোরের শৈলকূপা থানার বাগুটিয়া গ্রামে। কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে গিয়ে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এতো অল্প বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। তাঁর নিষ্ঠা, কর্মোদ্দীপনা এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল। বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তাঁর বিয়ে হয় রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলের জমিদারপুত্র রমেন মিত্রের সঙ্গে। রমেন মিত্রও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে প্রথমদিকে ইলা মিত্র নানা রকম সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িত করেছিলেন। গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি শিক্ষকতা করে এলাকাবাসীর কাছে হয়ে উঠেছিলেন ‘রানিমা’।
ধীরে ধীরে স্বামীর সঙ্গে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হয়ে তিনি কৃষকদের পাশে দাঁড়ান। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। কৃষক সমিতির মাধ্যমে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসেন ইলা মিত্র। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কৃষক আন্দোলন বন্ধ করতে তীব্র দমন নীতির আশ্রয় নেয়। আন্দোলনরত নিরস্ত্র কৃষকদের ওপর ১৯৫০ সালে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই হামলা মোকাবিলা করার মতো প্রতিরোধক্ষমতা কৃষকদের ছিল না। কৃষকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। সাঁওতাল 888sport promo codeর ছদ্মবেশে আত্মগোপন করতে গিয়েও ইলা মিত্র ৭ জানুয়ারি
১৯৫০-এ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। নাচোল থানায় নিয়ে তাঁর কাছ থেকে কথা আদায়ের জন্য নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হয়। তাঁকে বিবস্ত্র করে মারপিট করে অত্যাচারের সব সীমা লঙ্ঘন করে পুলিশ বাহিনী। রাজশাহী জেলে নিয়েও তাঁর ওপর অত্যাচার অব্যাহত থাকে। তাঁর জীবনসংশয় দেখা দেয়। পরে চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। দেশে ফেরার উপায় না থাকায় তিনি স্বামীসহ কলকাতাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। ইলা মিত্র রাজনীতি ত্যাগ করেননি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমৃত্যু জড়িত ছিলেন। একাধিকবার পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন আমাদের অকৃপণ সুহৃদ। নানা উপায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। পরবর্তী সময়ে ইলা মিত্রের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই আজীবন সংগ্রামী 888sport promo codeর জীবনাবসান ঘটে।
আগেই বলেছি, অগ্নিকন্যা হিসেবে পরিচিত ছাত্র ইউনিয়নের একসময়ের সভাপতি মতিয়া চৌধুরীও আমার কাছে প্রেরণাদায়ী ছিলেন।
এমএ পড়ার আগে থেকেই আমার বিয়ের ব্যাপারে পরিবারে আলোচনা শুরু হয়েছিল; কিন্তু আমি পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে না করার কথা বেশ জোর দিয়েই জানিয়ে দিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে অবশ্য বিয়ের জন্য খুব চাপ ছিল না। এদিকে রাজনীতির সঙ্গে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন কাজের সঙ্গে, আমি জড়িয়ে পড়ছিলাম। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। আমি একজন মানুষ মনে মনে হয়তো খুঁজছিলাম যিনি হবেন আমার পথপ্রদর্শক, দিকনির্দেশক। বলা যায়, ঠিক ওই সময়টাতেই আমাদের বাড়িতে অজয় রায়ের আসা-যাওয়া, আত্মগোপনে থাকা শুরু হয়। তিনি টানা আমাদের বাড়িতে থাকতেন না। মাঝে মাঝে আসতেন। দু-চারদিন থেকে অন্য আস্তানায় যেতেন। তাঁর সঙ্গে যে আমার খুব কথাবার্তা হতো, তা-ও নয়। তাঁর নির্দেশমতো চিঠি এর-ওর কাছে পৌঁছে দিতাম। তাঁর কথা ছিল আমার মতো অনেকের কাছে অবশ্যপালনীয়, বেদবাক্যতুল্য। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। সুদর্শন এবং পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত ভাবগম্ভীর ওই মানুষটির সামনে গিয়ে কথা বলতেও বুক কাঁপতো। তাঁর সম্পর্কে, তাঁর পরিবার-আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে যে বেশি কিছু জানতাম, তা-ও নয়। তাঁর মুখোমুখি হলে ভয়ে সংকুচিত থাকতাম বলে কোনো প্রশ্ন করতে পারতাম না। তিনি নিজে থেকে কিছু বললে তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।
আত্মগোপনে কী কষ্টকর জীবন কাটাতে হয়, তার দু-একটি ঘটনা তিনি বলেছিলেন। একবার তাঁকে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে রাত কাটাতে হয়েছিল। তাঁকে রাতে থাকতে দেওয়ার মতো আলাদা কোনো ঘর ওই কৃষকের ছিল না। তাই ছাগলের ঘরে ছাগলের সঙ্গেই রাত্রিবাস করতে হয়েছিল। গন্ধে ঘুম আসে না, জেগে জেগেই রাত কাবার করতে হয়েছে।
বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো কখনো কখনো। মুসলমান পরিচয়ে এক মুসলিম পরিবারে থাকতে হয়েছে কিছুদিন। গৃহবধূ সন্তান প্রসব করলে মুরুব্বি হিসেবে অজয় রায়কে আজান দিতে বলা হয়। তিনি কীভাবে আজান দেবেন? এটা তো তাঁর জানা ছিল না। এটা-ওটা বলে তিনি আজান দেওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।
এমনতর গল্প শুনে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে এমন কষ্টের জীবন কাটাতে পারেন?
তাঁর জবাব ছিল : মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে কষ্টকে আর কষ্ট মনে হয় না। তাছাড়া আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের জীবনই তো কষ্টে কাটে। মানুষের
কষ্ট-দুর্দশা মোচনের লক্ষ্যেই তো আমাদের রাজনীতি।
এসব শুনে অজয় রায়ের জন্য আমার মনে একটি দুর্বলতা তৈরি হয়। অন্যের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন তো সবাই দিতে পারেন না। যিনি পারেন, তিনি তো সাধারণ কেউ নন। অজয় রায়কে আমার একজন অসাধারণ মানুষ বলেই মনে হতো।
ঊনসত্তর সালের প্রথমদিকের ঘটনা। অজয় রায় আমাদের বাসা থেকে মুক্তাগাছা যাবেন। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মকবুল হোসেন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। একটি গাড়িও ঠিক করা হয়েছিল। সন্ধ্যার পর মেকআপ নিয়ে তিনি বের হলেন। বেরুবার আগে বললেন, মুক্তাগাছায় ১০-১৫ দিন থাকতে হবে। ফিরে এসে তোমাদের এখানেই উঠবো। কিন্তু তাঁর আর আসা হয়নি। পরদিন মকবুল এসে জানায় যে, মুক্তাগাছা যাওয়ার পথে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে। চালক নাকি পথে তেল নেওয়ার কথা বলে গাড়ি থামিয়েছিল। তখনই গাড়ি ঘেরাও করে অজয় রায়কে গ্রেফতার করা হয়। হয়তো পুলিশের কাছে আগাম খবর ছিল, চালকও তাদের সহায়তা করে থাকতে পারে।
অজয় রায়ের গ্রেফতারের খবর শুনে আমি বেশ মুষড়ে পড়ি। এটা ছিল আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। বুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। স্পষ্ট বুঝতে পারি, মনের বিষাদভাব লুকাতে পারছি না। কেমন যেন অসহায় লাগে। কেন এমন হচ্ছে? তিনি আমার আত্মীয় নন, তাঁর সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক নয়, যার জন্য তাঁর গ্রেফতার হওয়ার খবরে আমার মধ্যে শূন্যতা তৈরি হতে পারে!
আমার মনের অস্থিরতা আমি কারো কাছে প্রকাশ করতে পারি না। কলেজে যাই, কিন্তু কোনো কিছুতে মন বসাতে পারি না। কী হলো আমার? এরই নাম কি তবে ভালোবাসা? আমি কি অজয় রায়ের প্রেমে পড়লাম?
তেরো
ছাত্র ইউনিয়ন আমাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে। মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা ছাত্র ইউনিয়ন না করলে হয়তো সেভাবে পেতাম না। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এরই ধারাবাহিকতায় দেশকর্মী অজয় রায়ের প্রতি কখন যে আমার মনে ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেছে, তা বুঝতে পারিনি। তিনি যখন আমাদের বাড়িতে থাকতেন, তাঁর গোপন চিঠিপত্র যখন বহন করতাম, তখন কি ভেবেছিলাম যে, একদিন তাঁর সঙ্গেই সাতপাঁকে বাঁধা পড়বো? তিনি হবেন আমার জীবনসঙ্গী? না। তেমন ভাবনা দেখা-সাক্ষাতের গোড়ার দিকে একেবারেই ছিল না। বরং, তাঁকে মনে হতো অনেক বড়মাপের এবং কিছুটা যেন দূরের মানুষ। তাঁর প্রতি ছিল গভীর 888sport apk download apk latest version। দেশের জন্য কাজ করছেন, কষ্ট সহ্য করছেন – এ জন্য তাঁকে সমীহ করতাম। এই সংগ্রামী মানুষের জীবনে আমার জীবন যোগ হবে, তা কল্পনা করিনি। মানুষের জীবনধারা বড় বিচিত্র। কখন যে কোন দিকে মোড় নেয় আগে থেকে তা অনুমান করা যায় না।
অজয় রায় নতুন করে জেলে যাওয়ার পর আমার ভেতরে সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। তাঁর প্রতি তৈরি হলো গভীর অনুরাগ। তাঁকে দেখার জন্য মন কেমন করা শুরু হলো।
কলেজে ক্লাস করতে গিয়ে আনমনা হয়ে বসে থাকতাম। কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগতো না। আমি যেন তখন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছি। আমার অবস্থা কিছুটা ‘ক্ষ্যাপা খুঁজিয়া মরে
পরশপাথর’-এর মতো। আমার এই পরিবর্তন সহপাঠীদের নজর এড়ায়নি। তারা নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা করতো। আগেই বলেছি, আমরা রফিক ভূঁইয়ার স্ত্রীকে মধুবালা বলতাম। তিনি আমাকে বলতেন সুচিত্রা সেন। ছেলেবন্ধুদের কেউ কেউও আমাকে আড়ালে-আবডালে সুচিত্রা বলেই ডাকতো। কেউ আবার বলতো ‘মিস ময়মনসিংহ’। একদিন ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে মধুবালা (তাঁর প্রকৃত নামটা এখন মনে করতে পারছি না) এসে পাশে বসে পিঠে হাত রেখে বললেন, আমাদের সুচিত্রা কি উত্তমকুমারকে খুঁজে পেয়েছে?
তাঁর কথায় আমি শিহরিত হলাম। সত্যি তো, আমি কি আমার জীবনের স্বপ্নের নায়ক বা পুরুষকে পেয়েছি? মনের মধ্যে তোলপাড় চললেও কাউকে কিছু বলতে পারি না। কারণ বলার মতো কিছু তখনো হয়নি। আবার এ-ও ভাবছি, আমি যে অজয় রায়ের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছি, সেটা জানলে তাঁর-ই বা কি প্রতিক্রিয়া হবে? তিনি কি আমার এই ভাবনাকে তারুণ্যের চপলতা বলে উপেক্ষা করবেন? আমাকে এসব ভাবনা থেকে দূরে সরতে বলবেন? যাঁর নিজের জীবন কাটছে জেল-আত্মগোপনে তাঁর অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে আরেকজনকে যুক্ত করতে চাইবেন কি?
আমার মনে তখন অনেক প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর জানা নেই একটিরও। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন অজয় রায়ের একটি চিঠি আমার হাতে আসে। একজন সিপাহীর মাধ্যমে তিনি চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন। সেটা কোনো প্রেমপত্র ছিল না। ছিল তাঁর দেশভাবনার কথা এবং দেশে যে খুব শিগগির বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তার পূর্বাভাস। শাসকগোষ্ঠী যে মানুষের মুক্তিচেতনাকে আর বেশিদিন দাবিয়ে রাখতে পারবে না, সে-ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি শেষে লিখেছিলেন, কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বসে তিনি অনেক কিছু ভাবেন, এমনকি আমাকে নিয়েও ভাবেন।
অজয় রায়ের মতো বিশাল মানুষের ভাবনায় আমি আছি – এটা জেনে আমার মনে বিদ্যুচ্চমক খেলে গেল। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য মনের মধ্যে তৈরি হলো ব্যাকুলতা। কিন্তু কারাগারে তাঁর সঙ্গে আমি কীভাবে দেখা করবো? কারাবন্দিদের সঙ্গে কীভাবে দেখা করতে হয় তা তো আমি জানি না।
তখনই মনে পড়লো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আশরাফের কথা। আশরাফের বাবা ছিলেন ময়মনসিংহের জেলার। এটাও জানতাম যে, তিনি খুব ভালো মানুষ। নিজে জেলের বড় কর্মকর্তা হয়েও ছেলেকে রাজনীতিতে জড়িত হতে বাধা দেননি, তা-ও আবার বাম রাজনীতি। যেখানে পদে পদে বিপদের ঝুঁকি।
একদিন আশরাফকে বললাম, আমি তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাই। জেলের পাশে সরকারি কোয়ার্টারে তিনি সপরিবারে থাকতেন। আশরাফ আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে গেল। আমি অসংকোচে তাঁকে বললাম, খালু, আমি জেলখানায় গিয়ে অজয় রায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
আমার এই অদ্ভুত আবদার শুনে তিনি একটু থতমত খেয়ে গেলেন। চুপচাপ আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনি কী বুঝলেন তা আমি জানি না। একটু ভেবে বললেন, আমি আশরাফের মাধ্যমে পরে তোমাকে জানাবো।
তাঁর মনোভাব আমার কাছে ইতিবাচক বলেই মনে হলো। অপেক্ষার সময় নাকি দীর্ঘ হয়। আমার বেলায় তা হলো না। একদিন পরই আশরাফ বিকেল তিনটার দিকে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে গেল। খালু তাঁর সঙ্গে আমাকে জেলের ভেতর নিয়ে গেলেন।
অজয় রায় জেলের দোতলায় একটি রুমে থাকতেন। আমি নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জেলার সাহেবও কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। আমি তখনো
জানি না দেখা হলে অজয় রায়কে কী বলবো। তিনিই বা আমাকে কী বলবেন। শংকা ছিল, আমার এই ছেলেমানুষির জন্য আমাকে না আবার বকাঝকা করেন! ভয়ে যখন বুক কাঁপছে, তখন লক্ষ করলাম দোতলার সিঁড়ি দিয়ে মূর্তির মতো ধীরপায়ে নেমে আসছেন অজয় রায়। তাঁর হাতে প্লেটভর্তি গোলাপ ফুল। তিনি প্লেটভরা গোলাপ আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি গোলাপের প্লেট হাতে কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। অজয় রায়ও ছিলেন চুপচাপ। দুজনে পলকহীন তাকিয়েছিলাম পরস্পরের দিকে। কোনো কথা নেই। কিন্তু মনে হলো, অনেক কথা হলো আমাদের। যেন, অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলে!
মুহূর্তকালেই আমরা যেন বাঁধা পড়লাম প্রণয়জালে। জেলের মধ্যে এভাবে প্রেমবিনিময়ের ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে কি না, আমি জানি না। তবে আমার কাছে সেই বিকেলে অজয় রায়ের হাত থেকে গোলাপ নেওয়ার 888sport sign up bonus অমøান হয়ে আছে। এই অসাধারণ প্রেমের কথা জেলার সাহেব যেমন কাউকে বলেননি, আমিও কাউকে বলতে পারিনি। যখন বিদায় নেবো, তখন আমার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল কয়েক ফোঁটা জল। অজয় রায় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে শপথের মতো উচ্চারণ করেছিলেন, অচিরেই জেলের বাইরে আমাদের দেখা হবে। ভেঙে পড়ার কিছু নেই।
জেল থেকে স্বপ্নের পুরুষের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এলাম। আমার বুকের মধ্যে তখন বইছে আনন্দের ঝড়।
চৌদ্দ
জেল থেকে গোলাপ নিয়ে এসে আমি অজয় রায়ে বিমোহিত হয়ে গেলাম। বেশ বুঝে গেলাম, আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি; কিন্তু এই ভালেবাসার কথা প্রকাশ করার মতো ছিল না। আমার বাড়িতে কে কীভাবে বিষয়টিকে গ্রহণ করবে, তা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। পাত্র হিসেবে অজয় রায় কোনো বিবেচনাতেই খারাপ নন। তিনি শিক্ষিত, পণ্ডিত মানুষ। লেখালেখি করেন। তবে যে-কোনো মেয়ের অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার আগে তার সংসারজীবন সুখের হবে কি না, সেটা নিয়েই বেশি ভাবেন। পাত্র ভালো চাকরি করে কি না, অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে কি না, মেয়ের খাওয়া-পরার বন্দোবস্ত নিশ্চিত হবে কি না – এসবই হয় পাত্রকে উপযুক্ত বিবেচনার মাপকাঠি।
অজয় রায়ের পরিবার খুব ভালো। তাঁর বাবার চারটি ভাষায় দখল ছিল। বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। অজয় রায় নিজেও ছিলেন কৃতী ছাত্র। জেলখানা থেকেই পরীক্ষা দিয়ে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেছেন। এসব তাঁর গুণ হিসেবে ধরা হলেও দোষ ছিল তাঁর রাজনীতি। স্কুলজীবনেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে এসে নিরাপদ চাকরি-বাকরি বা আয়-উপার্জনের পথে না হেঁটে তিনি বেছে নিয়েছেন বাম রাজনীতির অনিরাপদ ঝুঁকির জীবন। জেল-হুলিয়া-আত্মগোপনে থাকা যার নিত্যসঙ্গী তাঁর হাতে মেয়ে তুলে দিতে চাইবে কোন অভিভাবক?
আমি বুঝতে পারি, অজয় রায়ের সঙ্গে জুটি বাঁধতে গেলে আমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। তিনি কারামুক্ত না হলে আমার বাড়িতে আমাদের মন দেওয়া-নেওয়ার কথা জানানো যাবে না। ভেতরে অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোনো পথ ছিল না। এই অপেক্ষা কত দীর্ঘ হবে, তা-ও জানতাম না। শুধু ভাবতাম, অজয় রায় আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। তিনি যদি তাঁর জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন, তাহলে বয়সে ছোট হয়ে আমি কেন অপেক্ষা করতে পারবো না?
আমি নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে থাকি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি – হয় অজয় রায়, নয় কেউ নয়। বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিলে কীভাবে তা পিছিয়ে দিয়ে কালক্ষেপণ করবো, তা নিয়েও ভাবতে থাকি। তবে অজয় রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, তাঁর সঙ্গে দেখা করার উপায়ও খুঁজতে থাকি। তাঁর মধ্যেও হয়তো আমার সঙ্গে যোগাযোগের আকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছিল। একদিন জেলের একজন সিপাই আমার হাতে একটি চিঠি দেন। অজয় রায়ের চিঠি। ওই চিঠি পেয়ে আমি কী যে খুশি হয়েছিলাম, আমার ভেতর আবেগের বন্যা বইতে শুরু করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
ওই সিপাইয়ের হাত দিয়েই পরদিন আমি একটি চিঠি পাঠালাম। সিপাই হয়ে উঠলেন আমাদের ডাকহরকরা। একটি নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে কলেজের কাছাকাছি একটি জায়গায় আমি উপস্থিত হতাম। সিপাই ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে আসতেন। আমার হাতে অজয় রায়ের চিঠি দিতেন। আমার কাছ থেকে তাঁকে লেখা চিঠি নিয়ে চলে যেতেন। অজয় রায়কে তিনি খুব পছন্দ করতেন। সিপাইয়ের স্ত্রীও স্বামীর কাছে শুনে শুনে অজয় রায়ের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অজয় রায়কে একটি সোয়েটার বুনে দিয়েছিলেন। মানুষ তখন কত মানবিক ছিল! একজন জেলে থাকা মানুষের জন্য এক পুলিশদম্পতির ভালোবাসা আমাকেও ছুঁয়ে যেতো। তখন সবার কাছেই রাজবন্দিদের আলাদা মর্যাদা ছিল। দেশের মানুষের ভালোর জন্য কাজ করতে গিয়ে শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কারাগারে থাকা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য কারারক্ষী থেকে শুরু করে দাগী আসামিরা পর্যন্ত দরদ অনুভব করতেন। রাজবন্দিদের একটু উপকার করতে পারলে সবাই যেন বর্তে যেতেন। মানুষের এই সহমর্মিতাই রাজবন্দিদের বছরের পর বছর কারাগারের চার দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ থাকতে সাহস জোগাতো।
সিপাইয়ের মাধ্যমে চিঠিবিনিময় ছাড়াও নানা ফন্দিফিকির করে অজয় রায়ের সঙ্গে আমি দেখা করার চেষ্টা করতাম। কোনো কথা হতো না, দূর থেকে একটু চোখের দেখা। অনেক কথা যেন আমরা বলতাম কোনো কথা না বলে। কীভাবে আমাদের এই দেখা হতো? জেলখানার পেছনে আগাখানিদের কলোনি ছিল। সেখানে একটি সেলাই স্কুল ছিল। ওই স্কুলের কাছাকাছি দাঁড়ালে জেলের দোতলার জানালা দেখা যেতো। অজয় রায় ওই জানালার শিক ধরে দাঁড়ালেই আমাদের চোখাচোখি হতো। ইশারায় আমরা কথা বলতাম।
ওই সময়টায় দেশে চলছিল আন্দোলন। আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়েছেন। আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেছেন। তবে ঊনসত্তরের প্রবল গণআন্দোলনের রেশ চলছে। কিছু একটা এদিক-ওদিক হলেই ছাত্ররা মিছিল বের করতো। আমরা রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানিয়ে কখনো কখনো মিছিল নিয়ে জেলগেটে গিয়েও উপস্থিত হতাম। ‘জেলের তালা ভাঙবো, অজয় রায়কে আনবো’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই – দিতে হবে’ – সেøাগানে চারদিক প্রকম্পিত হতো। অজয় রায় জেলের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে আমাদের সঙ্গে সংহতি জানাতেন। কখনো বা বক্তৃতাও করতেন। আমি এবং শিখা সাহা মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গান গাইতাম –
কারার ঐ লৌহকপাট
ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদি …
অথবা
আজি দখিন-দুয়ার খোলা –
এসো হে, এসো হে,
এসো হে আমার বসন্ত এসো।
দিব হৃদয়দোলায় দোলা,
এসো হে, এসো হে,
এসো হে আমার বসন্ত এসো। …
অজয় রায় হাত নাড়তেন, আমি যেন তাঁর স্পর্শ অনুভব করতাম। আমি যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আমার হৃদয়ের উপঢৌকন এক বন্দির কাছে পৌঁছে দিতাম, তা আমার সঙ্গী-
সাথিরাও বুঝতে পারতো না।
তবে এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে চিঠিবিনিময়, মাঝেমধ্যে দূর থেকে চোখের দেখা হলেও আমার মধ্যে একটি চোরা অস্বস্তি সবসময় বহমান ছিল। কতদিন পর অপেক্ষার অবসান ঘটবে তা বুঝতে না পারায় মনের মধ্যে অস্থিরতা ছিলই। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সম্পর্কের বিষয়টিও ছিল সবার অগোচরে। এভাবে সময় যেতে থাকে। রাজনীতিতে ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। নির্বাচনের দাবি মানতে বাধ্য হয় ইয়াহিয়া; কিন্তু কমিউনিস্ট বন্দিদের কারামুক্তি ঘটে না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী হিন্দু এবং কমিউনিস্টদের বড় শত্রু মনে করতো। এদের মনে করা হতো ভারতের দালাল বা অনুচর। পাকিস্তানে খারাপ কিছু ঘটলেই তার দায় ভারতের ওপর চাপানো ছিল শাসকদের একটি কৌশল।
তবে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ক্রমাগত জেল-জুলুম সহ্য করেও তিনি আপস না করায় মানুষের আস্থা অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, তার পরের বছর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগ হয়ে উঠতে থাকে জনসমর্থনপুষ্ট একটি রাজনৈতিক দল। শেখ মুজিবের সাহস এবং বিচক্ষণতা আওয়ামী লীগকে গণমানুষের দলে পরিণত করে। ১৯৬৯ সালের সূচনাতেই ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসনবিরোধী ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান। শেখ মুজিবসহ অনেক রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শাসকরা। ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত হন শেখ মুজিব। এটা ছিল ছাত্র-জনতার ভালোবাসার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ।
কমিউনিস্টরা ত্যাগ-তিতিক্ষায় সেরা হলেও তাদের প্রতি মানুষের সমর্থন স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। তাই পূর্ববাংলার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ’৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ মুজিবের জয়জয়কার ছিল জনগণের ভালোবাসার চরমতম বহিঃপ্রকাশ।
রাজনীতিতে যখন একের পর এক চমক লাগানো ঘটনা ঘটছে তখন আমার ব্যক্তিজীবনেও তোলপাড় শুরু হয়। আমার বিয়ের জন্য অভিভাবকদের তৎপরতা বেড়ে যায়। নানা জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে থাকে। ’৭০ সালের শেষদিকে কলকাতা থেকে আমার পিসির এক আত্মীয় আসেন ময়মনসিংহে আমার দাদুর বাসায়। আমাকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়। কলকাতায় তাঁর বাড়ি আছে। আছে বড় ব্যবসা। শিক্ষিত, দেখতে-শুনতেও ভালো। পাত্র হিসেবে অমন ছেলেকে আমার অভিভাবকদেরও পছন্দ হয়। কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত অমন ছেলের হাতে আমাকে সঁপে দিতে আমার মায়েরও বিপুল আগ্রহ দেখে আমি প্রমাদ গুনি। কীভাবে ওই ছেলেকে আমি বিদায় করবো তার উপায় খুঁজতে থাকি। তেমন জুতসই যুক্তি পাই না। শেষ পর্যন্ত মাকে বললাম, বিয়ে করতে পারি; কিন্তু আমি দেশ ছাড়বো না। কলকাতায় আমি যাবো না।
আমার কথায় কে কী বুঝলো জানি না। তবে ওই হবু বর নিশ্চয়ই উৎসাহ হারিয়ে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
আমি বিষয়টি চিঠি লিখে অজয় রায়কে জেলে জানাই। আমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। এই অবস্থায় আমার করণীয় কী – তাঁর কাছে জানতে চাই। সেই সিপাইয়ের মাধ্যমে মন্মথ দে-র কাছে তিনি একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তিনি কী লিখেছিলেন তা আমি জানি না। আমি চিঠিটি মন্মথ দে-র হাতে দিলে তিনি তা পড়েন এবং দেখলাম তিনি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুটা যেন চিন্তিত।
সেদিন মন্মথ দে চলে গেলেন এবং দুদিন পরই আবার এক বিকেলে আমার দাদুর বাসায় এলেন। দাদুকে নিয়ে তিনি বৈঠকখানায় বসে একান্তে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর দুজনই বেরিয়ে এলেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ব্যাপার কী, তা আমি বুঝতে পারলাম না। তবে অজয় রায়ের চিঠি নিয়েই যে আমার দাদুর সঙ্গে মন্মথ দে-র কথা হয়েছে, সেটা অনুমান করলাম।
মন্মথদা যখনই আমাদের বাড়িতে আসতেন, তখনই সঙ্গে আনতেন চকলেট। সেদিনও আমার হাতে চকলেট গুঁজে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। এর দুদিন পর দাদু আমাকে তাঁর শোবার ঘরে ডেকে তাঁর পাশে বসালেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, মন্মথ বাবু বললেন, তুমি নাকি অজয় রায়কে ভালোবাসো?
আমার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। কী হতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দাদু এটা মানবেন, নাকি মানবেন না, সেটা নিয়ে আমার সংশয় হলো। চুপচাপ বসে থাকলাম।
দাদু আবার বললেন, কিছু বলো। এটা কি ঠিক?
আমি চুপচাপ থাকলাম। কিন্তু আমার দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।
দাদু বললেন, ভালো করে ভেবে দেখো। অজয় রায় মানুষ হিসেবে অবশ্যই খুব ভালো। কিন্তু তার জীবনটা তো অনিশ্চয়তায় ভরা। কবে জেল থেকে মুক্তি পাবে, তারও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। ভালো করে সবকিছু ভাবো। তোমাকে আমরা একটি অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিতে পারি না।
আমি দাদুর মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারি না। নতমুখে আড়ষ্ট কণ্ঠে মৃদুস্বরে শুধু বললাম, আমার আর ভাবার কিছু নেই। অজয় রায়ই আমার জীবনে স্বপ্নের পুরুষ। তিনি যতদিন জেল থেকে ছাড়া না পাবেন, আমি ততদিনই তাঁর জন্য অপেক্ষা করবো।
দাদু যা বোঝার বুঝে নিলেন। তিনি ছিলেন একজন খুবই দরদি মানুষ। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অপরিসীম। আমি কষ্ট পাই, এমন কিছু তিনি ভাবতেও পারেন না। আমি তা জানতাম।
আমার মনোযন্ত্রণা বুঝেই হয়তো অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, আচ্ছা, দেখি কী করা যায়! মন খারাপ করো না। আর কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে ধীরপায়ে দাদুর ঘর থেকে বের হলাম। (চলবে)
ছবি : জয়ন্তী রায়


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.