আঠারো
রায়পুরা থেকে নৌকায় আগরতলা পৌঁছতে আমাদের দুদিন লেগেছিল। পথে বড় কোনো সমস্যা হয়নি। রাজাকাররাই টাকার বিনিময়ে আমাদের নিরাপদে দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছিল। যাত্রাপথে অজয় রায় প্রথমবারের মতো তাঁর জীবনের কিছু গল্প বলেছিলেন। নিজের সম্পর্কে সাধারণত তিনি বেশি কিছু বলতে পছন্দ করতেন না। পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার মুখে দেশ ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়ার উদ্বিগ্ন সময়টিতে আমাদের মনোযোগ সরানোর জন্যই হয়তো জলে ভাসতে ভাসতে নিজের কথা বলছিলেন। তাঁর জীবনটাই তো ছিল আসলে ভাসমান। এখান থেকে ওখানে স্থিত হওয়ার সংগ্রাম। কিশোরগঞ্জ থেকে বারানসি, আবার কিশোরগঞ্জ। সেখান থেকে মুন্সিগঞ্জ। পড়াশোনা, শিক্ষকতা, রাজনীতি, জেল। ময়মনসিংহ। আন্দোলন-সংগ্রাম। বিশেষ একটি সময়ে আমার সঙ্গে জীবনযোগ এবং যুদ্ধযাত্রা।
১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঈশ্বরগঞ্জে জন্ম। তাঁর বাবা ড. প্রমথনাথ রায় ছিলেন বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষার অধ্যাপক। মা কল্যাণী রায় ছিলেন গৃহবধূ। বাবার কর্মস্থল বারানসিতেই অজয় রায়ের শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে বাবা এবং পরের বছর মায়ের মৃত্যু হলে অজয় রায়ের বারানসি থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ততদিনে তিনি প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করে বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে অনার্স পড়া শুরু করেছিলেন। আবার রাজনীতিতেও হাতেখড়ি হয়ে গেছে। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বারানসি থাকতেই তিনি যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর ছোট ভাইবোনদের নিয়ে তিনি বাপের পৈতৃক ভিটা বনগ্রামে ফিরে আসেন। তাঁর এক পিসেমশাই ছিলেন মুন্সিগঞ্জের মুন্সেফ। পিসেমশাই অজয় রায়কে হরগঙ্গা কলেজে বিকম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিকম পাশ করেন।
এর কিছুদিন পর কমিউনিস্ট পার্টি করার কারণে গ্রেফতার হন। এক বছর পর মুক্তি পেয়ে তিনি মুন্সিগঞ্জ চাপাতলি স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে 888sport free betলঘু সম্প্রদায়ের ব্যাপক দেশত্যাগের কারণে ছাত্র888sport free bet কমে যাওয়ায় স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ-অবস্থায় অজয় রায় পার্শ্ববর্তী রামপাল হাই স্কুলে যোগ দেন। কিন্তু ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রেফতার হয়ে ১৯৫৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জেলে কাটান। এবার তাঁকে গ্রেফতার করে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নেওয়া হয়েছিল। ‘মালাউনের বাচ্চা, কমিউনিস্ট – এখনো দেশ ছাড়িসনি’ বলে গালাগাল করলে অজয় রায় খুবই অপমানিত বোধ করেছিলেন। কোমরে দড়ি বাঁধার বিষয়টিও তাঁর বড় মনোকষ্টের কারণ হয়েছিল। তিনি বলেন, জীবনে এত কষ্ট ও অপমান আর কিছুতে হয়নি। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল।
তাঁকে সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে রাখা হতো। নিয়মিত দড়ি পাকিয়ে তাঁর হাতে কড় পড়ে গিয়েছিল। জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার মতো তেমন কোনো আত্মীয়স্বজনও ছিল না। এক কাকিমা মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন। দুঃসহ নিঃসঙ্গ জীবন তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
জেলখানায় একবার টানা ৪০ দিন অনশন করেছিলেন। জেলার এবং ডাক্তার জোর করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’ নীতিতে অবিচল ছিলেন। অনিয়মিত খাদ্যগ্রহণ কিংবা অন্য কোনো কারণে জেলে তাঁর যক্ষ্মা ধরা পড়েছিল। জেলে একজন সহবন্দি ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। এই ডাক্তারের ওষুধেই অজয় রায় যক্ষ্মামুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের পর কারাবন্দি মুনীর চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত কবর নাটকটি লিখেছিলেন। জেলের ভেতরে এই নাটক অভিনীত হয়েছিল। 888sport promo code চরিত্রবর্জিত এই নাটকে অজয় রায়ও অভিনয় করেছিলেন।
রাজনৈতিক জীবনে অজয় রায় ১৮ বছর জেলে কাটিয়েছেন। আত্মগোপনে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। জেলে থেকেই তিনি এমএ পরীক্ষা দিয়ে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন।
তাঁর জীবনের এসব কথা শোনার আগেই তাঁর মেধা ও ত্যাগ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়েই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আগরতলা যাওয়ার পথে তাঁর মুখে এসব তথ্য জেনে কেবল মনে হয়েছে, ভুল মানুষের সঙ্গে আমি আমার জীবন জড়াইনি।
আগরতলার কাছাকাছি যাওয়ার পর অজয় রায় বললেন, এখন আর বিষের কৌটা বহন করে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। গোমতীর জলে বিষের কৌটা বিসর্জন দিয়ে আগরতলার মাটিতে পা রাখলাম। আগরতলায় আমার এক মামা ছিলেন, পেশায় চিকিৎসক। একবার লটারিতে তিনি সাত লাখ টাকা পেয়েছিলেন বলে তাঁর বাড়িটি সাত লাখের বাড়ি বলে পরিচিত। ওই বাড়িতে গিয়েই আমরা প্রথম উঠেছিলাম। তবে আগরতলায় ততদিনে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের অনেকেই গিয়ে পৌঁছেছেন। ক্রাফটস হোস্টেল হয়েছে সবার ঠিকানা। আমরাও সেখানে গিয়েই উঠলাম। ক্রাফটস হোস্টেলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়, যাঁদের আগে দেখিনি কিন্তু নাম শুনেছি এবং 888sport apk download apk latest versionর আসনে ঠাঁই দিয়েছি। দেখা হয় মণি সিংহ, খোকা রায়, জ্ঞান চক্রবর্তী, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, বজলুর রহমান, নুরুর রহমান, ডা. সারওয়ার আলীসহ কতজনের সঙ্গে। মণি সিংহসহ সবাইকে আমি প্রণাম করে আশীর্বাদ চাই। মণি সিংহ বলেন, যুদ্ধের দামামার মধ্যে তোমরা নতুন জীবন শুরু করেছ। দুই যুদ্ধ একসঙ্গে।
মোজাফ্ফর আহমেদ ছিলেন মজার মানুষ। তাঁর কথা আমার এখনো কানে বাজে। তিনি অজয় রায়ের সঙ্গে আমাকে প্রথম দেখায় বলেছিলেন, দাঁড়কাকের মুখে সিঁদুরে আম। তাঁর এমন কথা বলার অর্থ : অজয় রায় দেখতে ততটা ফরসা ছিলেন না, যতটা আমি ছিলাম। মোজাফ্ফর সাহেবের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠেছিলেন।
888sport promo codeনেত্রীদের মধ্যে সেখানে মতিয়া চৌধুরী ছাড়াও ছিলেন মালেকা বেগম, মাখদুমা নার্গিস রত্না, ফরিদা খানম, ফওজিয়া মোসলেম। রত্না আপা, ফরিদা আপা, ফওজিয়া আপার কোলে তখন তাদের শিশুকন্যারাও ছিল। ক্রাফটস হোস্টেলে জ্ঞান চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে সবার জন্য রান্না হতো। সে এক মহাযজ্ঞ। মতিয়া আপা তরকারি কুটতে বসতেন। আমিও তাঁকে সহযোগিতা করতাম। কচুরলতি কিংবা কচি কাঁঠাল, কুমড়ো ছাড়া অন্য তরিতরকারি খুব একটা জুটত না। রেশনের মোটা চালের ভাত, পাতলা ডাল আর একটি ঘ্যাট দিয়ে হতো দিনের আর রাতের খাবার। ব্যাচে ব্যাচে খাবার পরিবেশন করা হতো। নোয়াখালীর শহীদুল্লাহভাই খাবার পরিবেশন তদারকি করতেন। আমরাও খাবার পরিবেশন করতাম। আনন্দে থাকার জন্য কখনো বা হঠাৎ করেই গেয়ে উঠতাম :
আয় তবে সহচরী
হাতে হাতে ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি
গাহিবি গান। …
সবাই হয়তো পেটপুরে খেতে পারতেন না, তারপরও তৃপ্তি ছিল। কারো কোনো অভিযোগ ছিল না। কারণ তখন সময়টা ছিল সবাই মিলেমিশে থাকার, একাট্টা থাকার।
দিনকয়েক পরে ঠিক হয়, অজয় রায় মেঘালয় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, প্রশিক্ষণে পাঠানো ইত্যাদি কাজ দেখভাল করবেন। মেঘালয় যাওয়ার আগে একবার কলকাতা গিয়ে ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হয় তাঁর। আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়া তখন খুব সহজ ছিল না। বিমানে যাওয়ার মতো অর্থও ছিল না। অজয় রায় কলকাতায় তাঁর মামা সাধন দত্তের কাছে কিছু টাকা চেয়ে পাঠান। সাধন মামার টাকায় আমাদের বিমানে কলকাতা যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। অজয় রায়ের মাসি ছিলেন গৌরী (দত্ত) আইয়ুব। 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধে গৌরী মাসিরা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন।
কলকাতা গিয়ে আমরা উঠি অজয় রায়ের ভাই বরুণ রায়ের বাসায়। বরুণ তখন কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। অজয় রায়ের অন্য দুই ভাই অধ্যাপক মানস রায় ও বাবুল রায় এবং দুই বোন অধ্যাপক উত্তরা রায় এবং ছন্দা রায়ও ওই একই বাসায় থাকত। দীর্ঘদিন পর দাদাকে কাছে পেয়ে ভাইবোনেরা বেজায় খুশি। বিশেষ করে তাদের দাদা যে গৃহী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতেই তারা আনন্দিত। আমার সঙ্গে দ্রুতই তাদের খুব ভাব হয়ে যায়। তারা সবাই বেশ লড়াই করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং বড়ভাইয়ের রাজনীতিতে জড়ানোর ফলে তারা আসলে অভিভাবকহীন অবস্থায় নিজেরাই নিজেদের অবলম্বন হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে।
কলকাতায় আমরা থাকতে থাকতেই পার্ক সার্কাস এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টির অফিস খোলা হয়। খোকা রায় ওই অফিসেই বসতেন। একটি ঘটনার কথা আমার মনে আছে। সাধন মামা অজয় রায়কে একটি নতুন শার্ট এবং সোয়েটার দিয়েছিলেন। খোকাদা ওগুলো নিয়ে গায়ে জড়িয়ে হাসতে হাসতে বললেন, দেশ স্বাধীন না হলে যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অস্ত্র নামবে না, তেমনি আমার গা থেকেও এই শার্ট-সোয়েটার নামবে না। অর্থাৎ সাধন মামার দেওয়া পোশাক খোকাদার দখলে চলে যায়।
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও পার্ক সার্কাসেই থাকতেন। তিনি পরিবারকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, দেশ স্বাধীন না হলে তিনি পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন না। তাজউদ্দীন আহমদ খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। দুটো প্যান্ট এবং দুটো শার্ট ছিল তাঁর সম্বল। নিজ হাতে কাপড় ধুয়ে পরতেন। এমন মানুষের হাতে নেতৃত্ব থাকায় মুক্তিযুদ্ধ বিপথে যায়নি।
এদিকে অজয় রায়কে কলকাতা ছেড়ে মেঘালয় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় পার্টির পক্ষ থেকে। অজয় রায় আমাকে কলকাতায় তাঁর এক মাসির বাসায় রেখে যেতে চাইলে মাসি রাজি হননি। না, আমাকে বোঝা মনে করে নয়, বরং ওই সময় আমার অজয় রায়ের সঙ্গে থাকা জরুরি মনে করেই কণা মাসি রাজি হননি। আমি কণা মাসির বাড়ি গিয়েছি, তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। তিনিও খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন। আমাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে, তাই সে-সময় দুজন দুই জায়গায় থাকা তাঁর কাছে সঠিক মনে হয়নি।
যা হোক, আমাকে নিয়ে মেঘালয়ের পথে আসামের গোয়াহাটি গেলেন অজয় রায়। আমরা প্রথমে সেখানে সিপিআই নেতা ফণী বড়ার বাসায় উঠি। ফণী বড়ার স্ত্রী ছিলেন অজয় রায়ের মাসি। গোয়াহাটিতে আমার অলোকা মাসিও থাকতেন। তাঁকেও আমি খুঁজে বের করি।
উনিশ
গোয়াহাটিতে আমি অলোকা মাসিদের খুঁজে পেলেও সিপিআই নেতা ফণী বড়ার বাসায়ই বেশি সময় থেকেছি। ফণী বড়া আসাম বিধানসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর স্ত্রী হেনা বড়াও কমিউনিস্ট পার্টির 888sport promo codeনেত্রী ছিলেন। আগেই বলেছি, হেনা বড়া ছিলেন অজয় রায়ের মাসি। তাঁদের একটি প্রাইভেটকার ছিল। হেনা মাসি ওই গাড়িতে করে
এখানে-ওখানে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। আসামের মেয়েরাও দেখতে খুব সুন্দরী। হেনা মাসির সঙ্গে আমাকে দেখে অনেকেই জিজ্ঞেস করতেন, মেঘলা, না শাড়ি? আমি প্রথমে বুঝতে পারতাম না। হেনা মাসি বলতেন, শাড়ি।
পরে জেনেছি মেঘলা মানে অসমিয়া, আর শাড়ি মানে বাঙালি। অসমিয়াদের একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম ‘মেঘলা’।
আমার বেশ মনে আছে, ভারতীয় সংগীতজগতের কিংবদন্তি কণ্ঠ888sport live chatী 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে সাহায্য করার জন্য গোয়াহাটিতে একটি সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করেছিলেন। ভূপেন হাজারিকা তখনই উপমহাদেশজুড়ে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ওই সংগীতসন্ধ্যার টিকিট বিক্রির জন্য হেনা মাসি আমাকেও বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছেন। একটি বড় মিলনায়তনভর্তি দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে ভূপেন হাজারিকা তাঁর দরাজ কণ্ঠে বেশ কয়েকটি গান গেয়ে সবাইকে মোহিত করেছিলেন। সামনাসামনি এই বিখ্যাত 888sport live chatীর গান শুনে আমিও ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। তাঁর গাওয়া দুটি গানের কথা এখনো আমার কানে বাজে। একটি :
গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা
আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা
মেঘনা যমুনা।
একই আকাশ একই বাতাস
এক হৃদয়ের একই শ্বাস
দোয়েল কোয়েল পাখির ডাকে
একই মূর্ছনা। …
গানের কথা এবং ভূপেন হাজারিকার অসাধারণ গায়কি এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করেছিল।
অন্য গানটি ছিল :
সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ
চেতনাতে নজরুল
যতই আসুক বিঘ্ন বিপদ
হাওয়া হোক প্রতিকূল
এক হাতে অগ্নিবীণা
কণ্ঠে গীতাঞ্জলি
হাজার সূর্য চোখের তারায়
আমরা যে পথ চলি। …
এসব গান মানুষকে দারুণভাবে উদ্বেলিত করেছিল। 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের 888sport live chatী-888sport live footballিক-বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিকামী বাঙালির পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি-সাহস জুগিয়েছেন। ভূপেন হাজারিকা ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
ভূপেন হাজারিকা উচ্চশিক্ষিত এবং রাজনীতিসচেতন 888sport live chatী ছিলেন। বিদেশ থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি নিয়েছেন; কিন্তু কণ্ঠে তুলেছেন গণমানুষের পক্ষে কালজয়ী সব গান। তিনি সংগীত পরিচালক এবং গীতিকার হিসেবেও প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। চামেলী মেম সাহেব live chat 888sportের সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি ভারতের জাতীয় live chat 888sport 888sport app download bd পেয়েছিলেন। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, ভারতরত্ন, আসামরত্ন, দাদা সাহেব ফাল্কে 888sport app download bdসহ আরো অনেক 888sport app download bd ও সম্মাননায় ভূষিত এই 888sport live chatী মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ। ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া ভূপেন হাজারিকার জীবনাবসান ঘটে ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর।
তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তাঁর প্রতি 888sport apk download apk latest version জানাতে 888sport apps থেকে একটি 888sport live chatীদল ২০১৬ সালে গোয়াহাটি গিয়েছিল। সেই দলের আমিও একজন সদস্য ছিলাম। ২০০৯ সালে তাঁর জীবদ্দশায় গোয়াহাটির দীঘলিপুখুরী জিএসবি রোডে একটি বড় এলাকা নিয়ে একটি স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। আসামের ভাস্কর্য888sport live chatী বীরেন সিংহ ফাইবার গ্লাস ও 888sport app উপকরণ দিয়ে ‘ড. ভূপেন হাজারিকা’ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন। ওই ভাস্কর্য প্রাঙ্গণেই 888sport app download for androidসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে 888sport appsকে সাহায্য করার জন্য আয়োজিত একাত্তরের সেই সংগীতসন্ধ্যার কথা উল্লেখ করে আমিও দু-চার কথা বলেছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতজুড়েই মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব জাগরণ এবং সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় ভারতবাসীর ওপর স্বাভাবিকভাবেই একটি বড় চাপ তৈরি হয়েছিল; কিন্তু সবাই বিষয়টিকে সহানুভূতির চোখেই দেখেছেন। কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়ার মানসিকতা ছিল লক্ষণীয়।
888sport appsের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসাম ছাড়াও দূরবর্তী রাজ্যগুলোতেও 888sport appsকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। 888sport appsের দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতের মানুষদের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সাধারণ মানুষ সহমর্মী না হলে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারও হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সর্বাত্মকভাবে দাঁড়াতে পারত না।
আমার দেবর বরুণ রায়ের কাছে শোনা দুটি ঘটনার কথা আমার 888sport sign up bonusতে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার একটি হলো : খ্যাতনামা অভিনেতা সুনীল দত্তের নেতৃত্বে বোম্বের নামিদামি live chat 888sport তারকারা 888sport apps তহবিলে অর্থ সংগ্রহের জন্য পথে নেমে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ – এই বোধ একাত্তরে প্রবল হয়ে উঠেছিল। যাঁর যেমন সামর্থ্য ছিল, তিনি সেভাবেই বিপন্ন বাঙালি জাতির ত্রাণে শরিক হয়েছেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো : বোম্বের একটি স্কুলের ছাত্ররা তাদের স্কুলের সামনে বসে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে জুতা পালিশ করে যে-অর্থ উপার্জন করত তা 888sport appsের সহায়তা তহবিলে দান করত। কেউ কেউ ছাত্রদের এই উদ্যোগের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে জুতা পালিশ না করিয়েও তাদের হাতে কিছু অর্থ তুলে দিত। ওই স্কুল-শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ কত ছিল, সেটা বড় কথা নয়, তাদের মানবিক উদ্যোগটাই ছিল অনেক প্রেরণাদায়ী। 888sport appsের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বিষয়টি ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
অজয় রায়ের কাজের ক্ষেত্র ছিল মূলত মেঘালয় এবং তুরায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা অংশ নিতে গিয়েছিলেন তাঁরা বেশির ভাগ মেঘালয় রাজ্যে ছিলেন। জ্যোতিষ বসু, মন্মথ দে, আজিজুল ইসলাম খানও মেঘালয়-তুরাকে কেন্দ্র করেই কাজ করতেন। সীমান্তবর্তী এলাকার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দেখাশোনা করা এবং বামপন্থী নেতাকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট কেন্দ্রে পাঠানো, দেশের ভেতরে থাকা কর্মী-সমর্থকদের খোঁজখবর নেওয়া, পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা – এগুলোই ছিল অজয় রায়সহ অন্য নেতাদের কাজ। অজয় রায় ময়মনসিংহেও যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জামান খান, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাহতাব সাহেবের সঙ্গে তাঁর তথ্য আদান-প্রদান চলত। মাহতাব সাহেবের একটি মোটরসাইকেল ছিল, যেটা তিনি খবর আদানপ্রদানের কাজে ব্যবহার করতেন। কাজগুলো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তবে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ঝুঁকি নিতে তখন অনেকেই দ্বিধা করেননি। সবার পক্ষে দেশত্যাগ সম্ভব ছিল না। দেশের ভেতরে থেকেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবদান রেখেছেন। শামসুজ্জামান খান এবং মাহতাব সাহেব ছিলেন তেমন দুই যোদ্ধা। মাহতাব সাহেবও চিন্তাচেতনায় প্রগতিমনস্ক ছিলেন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি – সিপিআই – নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অর্থ ও 888sport app রসদ সংগ্রহের জন্য অজয় রায়কে দু-একবার দিল্লিতেও যেতে হয়েছে।
888sport appsের মুক্তিসংগ্রামে সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত অনেক বড় ভূমিকা পালন করেন। ভূপেশ গুপ্তের জন্ম কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলায়। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা নেতা। দীর্ঘদিন তিনি ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ভূপেশ গুপ্তের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক সুবিধা হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যে শুরু থেকেই 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল, তার পেছনে 888sport apps এবং ভারতের কমিউনিস্ট কর্মীদের ভূমিকা ছিল। এসব যোগাযোগে ভূপেশ গুপ্ত সেতুবন্ধ ছিলেন। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের ২০ অক্টোবর ভূপেশ গুপ্তের জন্ম। ১৯৮১ সালের ৬ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অত্যন্ত মেধাবী এবং লেখালেখিতে পারদর্শী ভূপেশ গুপ্তের সঙ্গে অজয় রায়ের সুসম্পর্ক ছিল। তারা দুজনেই ছিলেন ‘দেশি’ অর্থাৎ কিশোরগঞ্জের মানুষ। ভূপেশ গুপ্ত এবং আরেক খ্যাতনামা কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন আসাম-মেঘালয়ের শরণার্থী শিবির দেখতে গিয়েছিলেন। অজয় রায় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বারাঙ্গাপাড়ায় একটি বাড়িতে আমি আর অজয় রায় মাসতিনেক কাটিয়েছি। গারো সম্প্রদায়ের একজনের বাড়ি ছিল সেটা। একটি টিনের ঘর। আসবাবপত্রের মধ্যে রান্নার একটি স্টোভ, কিছু হাঁড়িপাতিল এবং শোয়ার জন্য ছোট দুটি চৌকি। সেখানেই বলতে গেলে আমি বিবাহিত জীবনের প্রথম সংসার শুরু করি। রিলিফের চাল, আটা, তেল ছিল সম্বল। গারো দু-চারজন মেয়ে আমাকে কিছু সহযোগিতা করত। বলত, আমরা থাকতে তোর কোনো অসুবিধা হবে না। আমার একটি হাতঘড়ি ছিল। একদিন খুলে বিছানার ওপর রেখেছিলাম। কিন্তু পরে আর খুঁজে পাইনি। জানালা দিয়ে কেউ হয়তো নিয়ে গেছে। দুঃসময়ে ঘড়িটি খোয়া যাওয়ায় আমার মন খারাপ হয়েছিল। তাছাড়া সময় দেখতে না পেরেও অস্বস্তি হচ্ছিল। আমার কষ্ট বুঝতে পেরে গারো মেয়েরাও কিছুটা বিমর্ষ হলো। তারা আমার ঘড়ি উদ্ধারের চেষ্টায় নেমে সফল হলো। আমি ঘড়ি পেয়ে খুশি, ওরাও খুশি। গারোরা খুব সহজ-সরল ছিল। ওদের আন্তরিকতা ছিল অকৃত্রিম।
অজয় রায় কাজের জন্য অন্য কোথাও গেলে আমার ভাই বিজন আমার সঙ্গে
থাকত। বিজন অবশ্য একসময় ট্রেনিং নিতে চলে যায়।
একদিন সকালে মন্মথদা আমাদের আস্তানায় এসে হাজির। তাঁর মুখ কেমন শুকনো, ভার ভার। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো। আমি তাঁর জন্য তাড়াতাড়ি রুটি আর আলুভাজি করলাম। অজয় রায় সেদিন ছিলেন না। নাস্তা খাওয়ার পর মন্মথদার কাছে তাঁর দুশ্চিন্তার কারণ জানতে চাইলাম। তিনি আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন। আমার সঙ্গে অজয় রায়ের সম্পর্কের বিষয়টি জানিয়ে আমার দাদুর সম্মতি আদায়ের প্রাথমিক কাজটুকু মন্মথদাই করেছিলেন। তিনি দেশের টানে আত্মীয়পরিজন ছেড়ে জেল-আত্মগোপনের কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন। এমন আত্মত্যাগী মানুষের প্রতি এমনিতেই 888sport apk download apk latest versionয় মাথা নুয়ে আসে।
অজয় রায়ের অনুপস্থিতিতে তিনি আমার কাছে সমস্যার কথা বলতে একটু ইতস্তত করছিলেন। তবে আমার ক্রমাগত অনুরোধে তিনি বললেন, হাতে কোনো পয়সাকড়ি নেই। অথচ অনেকগুলো ছেলে এসেছে যুদ্ধে যোগ দিতে। ওদের জন্য এখনো কোনো রিলিফের ব্যবস্থা করা যায়নি। দুদিন ধরে ছেলেগুলো প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। বলতে বলতে মন্মথদার চোখ ছলছল করে উঠল। আমিও কষ্ট পেলাম। আমার হাতে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। কী করা যায় ভাবতেই হঠাৎ মনে হলো, আমার কাছে একটি সোনার হার আছে। ছোটবেলায় একবার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করায় আমার দাদু আমাকে হারটি উপহার দিয়েছিলেন। হারটি আমার খুব প্রিয় ছিল বলে সঙ্গেই রাখতাম। সবসময় গলায় না পরলেও কাছছাড়া করতাম না। বাড়ি থেকে আসার সময় দাদু যে-গহনা দিয়েছিলেন তা রাজ্জাক সাহেবের মায়ের কাছে গচ্ছিত রেখে এলেও বিপদে-আপদে কাজে লাগবে ভেবে বহু আগে দাদুর দেওয়া হারটি সঙ্গে এনেছিলাম।
কোনো দ্বিতীয় চিন্তা না করেই হারটি আমি মন্মথদার হাতে দিয়ে ওটা বেচে অনাহারে থাকা ছেলেদের খাবার কিনতে বললাম। মন্মথদা হারটি নিতে দ্বিধা করছিলেন। আমার অনুরোধে তিনি শেষ পর্যন্ত ঢেঁকি গিললেন। এ-ঘটনা আমি সে-সময় অজয় রায়ের কাছেও প্রকাশ করিনি।
বারাঙ্গাপাড়া থাকতেই আমি অনুভব করি যে, আমি মা হতে চলেছি। নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হচ্ছিল। খেতে পারছিলাম না। ওখানে ডাক্তার দেখানোরও তেমন সুযোগ ছিল না। তাই আমাকে আবার গোয়াহাটিতে মাসিশাশুড়ির কাছে পাঠানো হলো। সে-সময় হেনা মাসি মাতৃস্নেহে আমার যত্নআত্তি করেছেন। প্রতিদিন বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে আমাকে নিয়ে যেতেন হাঁটাহাঁটি করার জন্য। আবার সেই ব্রহ্মপুত্র, যার কূলে আমার জন্ম, তার কাছে ফিরতে পেরে কি যে স্বস্তি লাগত। ব্রহ্মপুত্র গোয়াহাটির কোলঘেঁষেই প্রবাহিত।
হেনা মাসি তাঁদের গাড়িতে করে আমাকে কামাক্ষা মন্দিরেও নিয়ে গেছেন একাধিক দিন। আমার মন যাতে ভালো থাকে তার জন্য যা যা করা দরকার তা করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। দুই পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জননী হেনা মাসি তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়েই আমার প্রথম মাতৃত্বকালের সুবিধা-অসুবিধা বিচার করতেন। হেনা মাসি হয়ে উঠেছিলেন আমার বড় ভরসা।
কুড়ি
আমি বারাঙ্গাপাড়া থাকতেই বুঝতে পারছিলাম যে, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে। সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় প্রতি রাতে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ শুনতাম। মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে হানাদারমুক্ত করে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছিল। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর কোনো কোনো দল প্রশিক্ষণশেষে 888sport appsের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে বলেও শুনছিলাম। প্রায় এক কোটি শরণার্থী নিয়ে বিপাকে ছিল ভারত। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের খাবার ব্যবস্থা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। শরণার্থীরা যাতে নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারে, তার পরিবেশ তৈরি করার জন্য ভারত নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে 888sport appsের পক্ষে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের পর অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। 888sport appsকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ভারত বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নিলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভারতের সঙ্গে থাকবে, সেটা নিশ্চিত হয়েছিল। এটাও শোনা যাচ্ছিল যে, মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে ভারতীয় সেনাবাহিনী। নভেম্বর মাসের শেষ দিক থেকেই ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অপারেশনে অংশ নিতে থাকায় পাকিস্তানি দখলদার সেনারা নাজেহাল অবস্থায় পড়ে।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান আকস্মিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। পশ্চিম সীমান্ত আক্রান্ত হলে ভারত তার নিরাপত্তার তাগিদেই 888sport appsে মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করবে বলে পাকিস্তান হয়তো মনে করেছিল। কিন্তু ভারতের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে পাকিস্তান কার্যত নিজের বিপদই ডেকে আনে। পাকিস্তানের আক্রমণ মোকাবিলায় ভারতও তার সমস্ত সামরিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান দিশেহারা হয়ে পড়ে। 888sport appsের ভেতরে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা নাস্তানাবুদ হতে থাকে। পশ্চিম সীমান্তেও ভারতকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। আমেরিকা এবং চীনের কাছ থেকে পাকিস্তান যেরকম সাহায্য পাবে বলে আশা করেছিল, বাস্তবে তারা তা পায়নি।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, পাকিস্তান লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে যাচ্ছে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ হামলায় 888sport appsে পাকিস্তানিদের একের পর এক ঘাঁটির পতন হতে থাকে। একের পর এক জেলা মুক্ত হয়ে স্বাধীন 888sport appsের বিজয় পতাকা উড়তে থাকে। আমরা গোয়াহাটি বসেই খবর পাই, 888sport app চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। রেডিওতে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশর একটি বার্তা প্রচার হতে থাকে। সবাই এটা বুঝতে পারে যে, 888sport apps পুরো শত্রুমুক্ত হওয়া, বিজয়ী হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিন বিকেলে 888sport appর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজী এবং ভারতীয় জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণ দলিলে সই করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন 888sport apps রাষ্ট্রের অভ্যুদয় নিশ্চিত হয়ে যায়। বিজয়ের এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে 888sport apps এবং ভারতের সর্বত্র আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে সর্বস্তরের মানুষ। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোয়াহাটিতেও বের হয়েছিল আনন্দ মিছিল। বাঙালি এবং অসমিয়া – সবাই ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে এবং ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান গেয়ে আনন্দ উদযাপনে শামিল হয়েছিল। আমি সন্তানসম্ভবা হওয়ায় শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ ছিলাম। তাই বাইরে গিয়ে আনন্দ-উল্লাসে শামিল হতে পারিনি; কিন্তু পিসিশাশুড়ি ঠিকই বাইরে গিয়ে মিছিলে অংশ নিয়েছেন। ভারতীয় নাগরিক হলেও 888sport appsের স্বাধীনতার জন্য তাঁরা সাধ্যমতো সব চেষ্টাই করেছেন।
দেশ বিজয় অর্জন করার পর শুরু হয়ে যায় দেশে ফেরার তোড়জোড়। শরণার্থীরা নিজের ভিটেমাটিতে ফিরে আসার জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠেন। অজয় রায় তাঁর কাজকর্ম গুছিয়ে মেঘালয় থেকে গোয়াহাটি এসে আমাকে নিয়ে দেশে ফেরার আগে আবার কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার কথা বললে আমি রাজি হই। কলকাতায় তাঁর ভাইবোন ছাড়াও মামা-মাসিরা ছিলেন, সেটা আগেই উল্লেখ করেছি।
অজয় রায়ের আত্মীয়রা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ। আমার শ্বশুর বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এবং অজয় রায়ের শিক্ষাজীবন সেখানেই শুরু – তাও আগে বলেছি। অজয় রায়ের জন্ম ময়মনসিংহে হলেও তাঁর আত্মীয়রা ছিলেন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাগ্রহণের জন্য কলকাতা গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়েছিলেন। তাঁদের বারানসি যাওয়া-আসা ছিল। নানা উপলক্ষে তাঁরা বারানসি যাওয়ায় অজয় রায়ের সঙ্গে সবারই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি ছাত্র হিসেবে খুব মেধাবী হওয়ায়
মামা-মাসিরা তাঁকে পছন্দ করতেন; কিন্তু বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর অজয় রায় ময়মনসিংহ ফিরে আসায় এবং রাজনীতিতে অতিমাত্রায় জড়িয়ে যাওয়ায় কলকাতার আত্মীয়দের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। অজয় রায়ের আত্মীয়দের অনেকেই একসময় স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
মনের দিক থেকে তাঁরা গোঁড়ামিমুক্ত এবং উদার ছিলেন।
কলকাতা গিয়ে আমরা আমার দেবর বরুণ রায় ছাড়াও সাধন মামা, রেবা মামি, গৌরী মাসির বাড়িতে গিয়েছি। গৌরী মাসি তখনই বেশ বিখ্যাত মানুষ। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন। সমাজকর্মী হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন। 888sport apps থেকে কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া 888sport live chatী-888sport live footballিকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গৌরী মাসি মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে মিলে ‘খেলাঘর’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সমাজে অবহেলিত-দরিদ্র-অনাথ শিশুদের বড় সহায় ছিল এই খেলাঘর। যুদ্ধের সময় এতিম 888sport appsি অনেক শিশুর দায়িত্বও এই সংগঠন নিয়েছিল। গৌরী মাসি সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করার ক্ষেত্রেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন আরেক লেখক-দার্শনিক-চিন্তাবিদ আবু সয়ীদ আইয়ুবকে। সেজন্য তাঁর নাম হয়েছিল গৌরী আইয়ুব।
আবু সয়ীদ আইয়ুব ছিলেন অবাঙালি ও মুসলমান। কলকাতায় জন্ম হলেও আইয়ুব ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত বাংলা জানতেন না। একটি উর্দু পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়ে বাংলা শিখতে আগ্রহী হন। পরে বাংলাভাষায় তিনি 888sport live footballচর্চা করে খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুবের বিখ্যাত গ্রন্থ হলো পান্থজনের সখা এবং আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ।
গৌরী মাসির বাবা ধীরেন্দ্রমোহন দত্তও ছিলেন একাধারে শিক্ষক, দার্শনিক এবং লেখক। তিনি ছিলেন অজয় রায়ের দাদু। তিনি পাটনা কলেজে দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপনা করতেন। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে অজয় রায়ের মামাবাড়িটি একসময় স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘বিদ্যাসাগর’ বাড়ি বলে পরিচিতি পেয়েছিল, ওই বাড়ির প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন বলে।
একবার গৌরী মাসি 888sport appsে এলে তাঁকে নিয়ে আমি ঈশ্বরগঞ্জ গিয়েছিলাম পূর্বপুরুষের ভিটা দেখানোর জন্য। তখনো উপস্থিত বয়স্ক দু-একজন মানুষ বিদ্যাসাগর বাড়ির 888sport sign up bonusচারণ করেছিলেন।
আমার দুই মেয়েকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করাতে গেলে গৌরী মাসি যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। শান্তিনিকেতনে তাঁর যোগাযোগ ও জানাশোনা থাকায় আমার এক মেয়ের ক্লাস সিক্সে এবং আরেক মেয়ের ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে কোনো সমস্যা হয়নি।
একাত্তরের ডিসেম্বরে কলকাতায় যখন আত্মীয়দের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই তখন সব জায়গাতেই আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। সবারই ‘যেতে নাহি দেবো’ তবু ‘যেতে দিতে হয়’ অবস্থা। বিশেষ করে আমি সন্তানসম্ভবা হওয়ায় আমাকে নিয়ে সবারই ছিল দুশ্চিন্তা। একপর্যায়ে অজয় রায় আমাকে কলকাতায় রেখে আসার কথা বললে গৌরী মাসি বলেছিলেন, ‘চুনি, তুই কি জয়ন্তীকে পরীক্ষা করছিস? দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশে ফেরার আগ্রহ ওরও আছে। তবে সাবধানে থাকতে হবে। প্রথম মা হওয়া আনন্দেরও যেমন, তেমন ঝুঁকিও থাকে বইকি! ও নিশ্চয়ই তোকে ছাড়া একা কলকাতা থাকতে চাইবে না।’
আমি মাথা নেড়ে মাসির কথায় সম্মতি জানালাম।
রেবা দত্ত মামির একটি কথা আমার এখনো মনে আছে। আমরা তাঁকে প্রণাম করে বিদায় নিতে গেলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, এক ছন্নছাড়াকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছ। কখনো একে অপরকে ভুল বুঝবে না। সব সময় মনে রাখবে, পরস্পরের প্রতি পরস্পরের 888sport apk download apk latest versionবোধই প্রকৃত ভালোবাসা। দুজনই এটা মেনে চলবে – এই আশীর্বাদই করি।
আমাদের দীর্ঘ যৌথজীবনে অনেক কঠিন সময় পার করেছি, অভাব-অনটনও কম ছিল না; কিন্তু একে অপরের নির্ভর হয়েই চলেছি।
আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হচ্ছিল; কিন্তু সদ্য স্বাধীন দেশে ফেরার আকুলতাও মনের মধ্যে ছিল। যারা যে-পথে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল, সে-পথেই আবার ফিরে আসার নির্দেশনা পার্টির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। আমরা কলকাতার আত্মীয়দের কাছ থেকে নতুন কাপড়-চোপড় উপহার পেয়ে আবার আগরতলা ফিরলাম। ক্রাফটস হোস্টেল ততদিনে খালি হয়ে গেছে। সেখানে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই দেশে ফিরে গেছেন। আগরতলায় ওখানকার পরিচিতদের সঙ্গে অজয় রায় এবং আমি দেখা করলাম। তাঁরা সবাই 888sport apps স্বাধীন হওয়ায় খুব খুশি। আবার দেখা হওয়ার আশা ব্যক্ত করে আমাদের সানন্দে বিদায় জানালেন। অনিশ্চিত প্রবাসজীবনের ইতি ঘটিয়ে আমরাও নৌকায় করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলাম।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.