রেজাউল করীম : সমন্বয়ী চিন্তার ঋত্বিক

 

বুলবুল আহমেদ

ভারতের সামাজিক ইতিহাস মূলত সমন্বয়ের ইতিহাস। নানা সময়ে নানা রকম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির মানুষজন এই দেশে এসেছে বিভিন্ন প্রয়োজনে। তাদের খুব সামান্য সংখ্যকই ফিরে গেছে। যারা ফিরে যায়নি, তারা একসময়ে ভারতবর্ষকেই নিজের দেশ বলে মনে করেছে। এই দেশেরই জল-হাওয়া-কুসুম-অমৃতত্বে লালিত হয়েছে তাদের জীবন। আবার একসময়ে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রেরণা থেকে সরে গেছে অনেক যোজন দূরে। বিরাট ভারত-সংস্কৃতির দেহে তারা মিলে গেছে, মিশে গেছে; এরই সঙ্গে লীন হয়ে গেছে তাদের প্রাত্যহিকতা, তাদের স্বপ্ন রচনার ক্ষেত্র ও প্রক্রিয়া। তবে, কোনো সমন্বয়ই একমুখী নয়, তা অভিপ্রেতও নয়। এদেশে এসেছে যারা তারা যেমন ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে বাঁচার রসদ পেয়েছে, তেমনি তাদের সঙ্গে করে আনা সংস্কৃতির অনেক উপাদানও গৃহীত হয়েছে। আর কালের নিয়মে তৈরি হয়েছে এক ভারতীয় সমন্বয়ধর্মী মন ও সংস্কৃতি। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও ভারতের মুসলমানদের ক্ষেত্রেও এ-কথা সত্য। আর সমন্বয়-ভাবনার ক্ষেত্রে যাঁরা বিভিন্ন সময়ে প্রেরণা দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রেজাউল করীম (১৯০২-৯৩) একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

গোটা উনিশ শতক বাংলার মুসলমান সমাজের জন্য একটা বন্ধ্যা সময়। ইংরেজরা এদেশের শাসনক্ষমতায় বসার পর বাঙালি হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করে এবং ব্যবহারিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলার মুসলমানরা উগ্র ব্রিটিশ-বিরোধিতা এবং ধর্মীয় কারণে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। এই সময়-পরিসরটা প্রায় একশ বছরের। অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত ও দিশেহারা হয়ে ধর্মকে তারা আঁকড়ে ধরে। জাগতিক সব ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়তে থাকল। ক্যালকাটা মাদ্রাসা নামের একটা প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে হিন্দু কলেজে তাদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। অশিক্ষার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া ও ইহজাগতিক সব ক্ষেত্রে হেরে যাওয়া তাদের অনিবার্য নিয়তি। সিপাহি বিদ্রোহের পরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। তবে পৃথিবীর অনেক সৃষ্টির আগে একটা বিশৃঙ্খলার পর্ব থাকে। বিভ্রামিত্মর পথ বেয়ে আসে নির্মাণের আকাঙক্ষা। উদ্যোগহীনতার আবর্ত থেকেও বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় একসময়ে। হিন্দু কলেজ ততদিনে পরিণত হয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং মুসলমান ছাত্ররাও সেখানে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ পেতে শুরু করেছে।

মুসলিম এলাকায় স্থাপিত স্কুলগুলোতে ইঙ্গ-ফার্সি বা ইঙ্গ-বাংলা বিভাগ খুলে কলা ও 888sport apk শিক্ষার সামান্য চেষ্টা চলছে। একটা বদলের আভাস টের পাওয়া যাচ্ছে, যার প্রথম যুগের ফসল মীর্জা দেলোয়ার হোসেন, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখ। ক্রমে মুসলমানদের মধ্যেও সচেতনতা জাগতে দেখা যায়। ১৮৮০ সালে সৈয়দ আমীর আলী প্রস্তাব রাখেন মাদ্রাসা শিক্ষা সংকুচিত করে মুসলমানদের জন্য আরো বেশি ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করার। সমাজে দৃষ্টিভঙ্গির বাঁক নেওয়ার ক্রামিত্মকালে উপস্থিত হচ্ছেন বিরল ব্যতিক্রমী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০)। সেই সরণি বেয়ে আসছেন মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্ (১৮৮৫), মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (১৮৮৮), মুজফফর আহমদ (১৮৮৯), এস. ওয়াজেদ আলী (১৮৯০), কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪), আবুল হোসেন (১৮৯৬), গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭),
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯) এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই কুদরাত-এ-খুদা (১৯০০) ও রেজাউল করীম (১৯০২)।

বীরভূম জেলার মাড়গ্রামে তাঁদের পরিবার আর্থিক দিক থেকে তেমন সচ্ছল ছিল না; কিন্তু বাড়িতে বিদ্যাচর্চার পরিবেশ নজরে আসে। পিতা আবদুল হামিদ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও আরবি ও ফারসি ভাষা খুব ভালো জানতেন। তিনি পারস্যের কবি হাফিজ ও শেখ সাদির 888sport app download apkর গভীর অনুরাগী ছিলেন। রেজাউল করীমের বড় দুভাই মঈনউদ্দীন হোসায়ন রিপন কলেজ থেকে ও আবদুল
গনি-ইল-আববাসী সিটি কলেজ থেকে স্নাতক হন। তিনিও উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় আসেন অল্প বয়সে। প্রথমে তালতলা হাইস্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। পরে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে ১৯২০ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস ক্লাসে ভর্তি হলেও পড়া বন্ধ হয় অচিরেই। এ-সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকায় (১১ আগস্ট, ১৯৮৫) প্রকাশিত আমার ছেলেবেলা নামের আত্মচারণায় তিনি লিখেছেন –

সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তে পড়তে মহাত্মা গান্ধীর কণ্ঠ থেকে অসহযোগের বাণী এল, সেই সময় যে গান গাওয়া হত, তা মনে আছে, ঐ বাণী কানে বাজে –

চল, চল, চল বুকে বেঁধে বল

মায়ের সেবার কাজে।

সেই বাণী আমার কানে বাজল। আমি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজকে বিদায় দিয়ে দেশমায়ের সেবায় যোগ দিলাম।

কলেজ থেকে বাইরে এসেই দেখলাম ছাত্ররা নিকটস্থ পার্কের দিকে যাচ্ছে। আমি সেখানে দেখি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন একটি ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করছেন। সে-যুগে দেশবন্ধুর বক্তৃতা যারা শুনেছে তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে, কি আবেগ, কি উচ্ছ্বাস, কি অন্তরের আহবান। আমরা অনেকেই সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। সেখানে আমিও কিছু বললাম। সভার শেষে বাসায় ফিরে এলাম। সব কথা শুনে আমার বড়ভাই আমাকে সমর্থন করলেন। আমাকে বললেন, গোলামখানায় যাবার দরকার নেই। সেইদিন বেরিয়ে এলাম দেশের কাজে।

মুর্শিদাবাদের সালারে জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিলেন রেজাউল করীম। সেখানে পড়াতেন সখারাম গণেশ দেউস্করের দেশের কথা এবং বিবেকানন্দের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। তিন-চার বছর চলেছিল সে বিদ্যালয়। জাতীয় বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে মাড়গ্রামে নিজেদের বাড়ির বৈঠকখানায় নৈশ বিদ্যালয় চালাতেন। এভাবেই দেশের কাজ করেছেন। পরে তাঁর মামা খ্যাতনামা আইনজীবী ও একনিষ্ঠ কংগ্রেসকর্মী আবদুস সামাদের অনুরোধে বহরমপুরে এসে কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩০ সালে ইংরেজি 888sport live footballে অনার্সসহ বিএ পাশ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে পড়া ছাড়তে হয়। সে-সময়ে খিদিরপুরে করপোরেশনের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন। পরে ১৯৩৪ সালে ইংরেজিতে এমএ এবং ১৯৩৬ সালে আইন পরীক্ষায় পাশ করেন।

 

মঈনউদ্দীন ও নূর লাইব্রেরি

রেজাউল করীমকে বুঝতে তাঁর বড়ভাই মঈনউদ্দীন হোসায়ন ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত নূর লাইব্রেরি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। মঈনউদ্দীন বীরভূম থেকে কলকাতা এসেছিলেন উচ্চতর পড়াশোনার জন্য; কিন্তু এখানকার নানা সমকালীন কর্মকা–র মধ্যে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই জাতীয়তাবাদী এবং বিপস্নবে বিশ্বাসী। ‘অনুশীলন সমিতি’র সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল। তিনি যুগান্তর, সন্ধ্যা ইত্যাদি কাগজ রাখতেন। আমরা জানি, এসব পত্রিকা পরোক্ষে ছিল বাংলার বিপস্নববাদীদের মুখপত্র। কলকাতায় পড়তে এসে দাদার কাছে থাকার সময়ে রেজাউল করীম এ-কাগজের গুরুত্বপূর্ণ লেখার কাটিং ও 888sport app 888sport free bet loginের সন্ধান পান। তাঁর মননে দেশ ও জাতি সম্পর্কে এক পরিবর্তন আসে। মূলত একটা প্রকাশনা সংস্থা হলেও নূর লাইব্রেরির পরিচয় লেখা থাকত এভাবে : ‘Academy of Islamic Research and Oriental Learning.’ উদ্দেশ্য ছিল জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল মুসলিম লেখকদের বই লেখানো যাতে তাদের বৃহত্তর সমাজে জাতীয়তার আদর্শ সঞ্চারিত হয়। তা ছাড়া ইসলামের ইহজাগতিক ও সর্বজনীন ভাবধারার সঙ্গে অন্য সকলের পরিচয় ঘটে এবং দূর হয় পারস্পরিক অপরিচয়ের অন্ধকার। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। তখন মুসলমান-সম্পাদিত 888sport app পত্রিকা কেবল ইসলাম প্রচার ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে মুসলমানদের দাবি তুলে ধরছে। এই পরিবেশে মঈনউদ্দীনের প্রচেষ্টা শিক্ষিত ও উদার মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন যুগের সূচনা করে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল শহীদুলস্নাহ্, মুজফফর আহমদ, নজরুল, মোজাম্মেল হক প্রমুখের সঙ্গে। নূর লাইব্রেরি-প্রকাশিত অনেক বই জনপ্রিয় হয়। কাজী আবদুল ওদুদের মীর-পরিবারসহ কয়েকটি বই, কাজী নজরুল ইসলামের বিষের বাঁশী, যুগবাণী, নতুন চাঁদ ইত্যাদি বই বেরিয়েছে সেখান থেকে। তাঁর বিষের বাঁশী কাব্যের ভূমিকায় নজরুল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ‘দেশের কাজে-উৎসর্গ-প্রাণ আমার পরম শ্রদ্ধেয় বন্ধু মৌলবী মঈনউদ্দিন হোসেন সাহেব বিএ
(নূর লাইব্রেরী)-র প্রতি।’ তা ছাড়া ফারসি থেকে যখন নজরুল রুবাইত-ই-ওমর খৈয়ামের 888sport app download apk latest version করছেন তখন মঈনউদ্দীন নানাভাবে সাহায্য করেছেন, ভূমিকায় তার উলেস্নখ রয়েছে।

নজরুল-প্রমীলার বিয়েতে তিনি পৌরোহিত্য করেছিলেন। মুজফফর আহমদের নজরুল-888sport sign up bonusকথায় এসব ঘটনার উলেস্নখ রয়েছে। বঙ্গীয় মুসলমান 888sport live football সমিতি এবং নবযুগ পত্রিকায় তিনি তাঁদের বিশেষ সহযোগী ছিলেন। নূর লাইব্রেরির মাধ্যমে মঈনউদ্দীন নানা মনের চিন্তাভাবনাকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। ঠিক এই কাজ করা হয়েছিল 888sport appয় মুসলিম 888sport live football সমাজ গঠন করে শিখা গোষ্ঠীর বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে। এভাবে রেজাউল করীমের মানসিক গঠনের প্রস্ত্ততিপর্বে বড়ভাই মঈনউদ্দীন ও তাঁর বন্ধুরা বিরাট প্রভাব ফেলেছেন। পরে তাঁর লেখা Anecdotes of Hazrat Mohammad এবং আবদুল কাদিরের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক মুসলিম কবিদের 888sport app download apkর সংকলন কাব্য-মলঞ্চ ওই নূর লাইব্রেরি থেকেই প্রকাশিত হয়।

 

টমাস পেইনের প্রভাব

রেজাউল করীম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পড়া বন্ধ রেখে সালারে জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, তখন তাঁর হাতে আসে পেইনের The Rights of Man. পরে কৃষ্ণনাথ কলেজের লাইব্রেরিতে পান The Age of Reason. এই দুটি বই পড়ে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর এযাবৎ লালিত ভাবনায় নতুন মোড় বদল ঘটল। পেইনের চিন্তাভাবনা সময়ের প্রেক্ষেতে চরম বৈপস্নবিক। ধর্মের ব্যাপারে চার্চের নিয়ন্ত্রণ পছন্দ করতেন না তিনি। তাঁর মনই তাঁর চার্চ। যিশু খ্রিষ্ট ও খ্রিষ্টান ধর্মের অনেক ইলিউশন চুরমার হয়ে গেছে তাঁর লেখায়। বাইবেলের বহু কাল্পনিক কাহিনিকে ভাঁওতা বলে অগ্রাহ্য করেছেন। কঠোর একেশ্বরবাদী পেইনের দাবি ছিল মানুষের সামাজিক সুরক্ষা – সকলের জন্য শিক্ষা ও ন্যূনতম সুনিশ্চিত আয়। পেইনের লেখা ফরাসি বিপস্নবকে ত্বরান্বিত করেছিল। তাঁর কাছে সবচেয়ে আকাঙক্ষার ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার চরম প্রকাশ। সর্বদা প্রশ্নশীল পেইন নিজের বিবেককেই সর্বোচ্চ নির্ধারক মনে করতেন। তৎকালীন ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিষ্টান সমাজ তাঁর প্রবল বিরোধী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রব্যবস্থা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং তাঁকে জেলে যেতে হয়। মৃত্যুদ-ও হতে পারত। আব্রাহাম লিংকন, আলভা এডিসন প্রমুখ অনুপ্রেরণা পান তাঁর লেখায়। অনুপ্রাণিত হন রেজাউল করীমও। একজন ধার্মিক মুসলমান হয়েও পেইনের ভাবনা-চিন্তায় তাঁর সম্পৃক্ত হওয়া বিস্ময়ের। পরে তিনি পেইনের ওপর 888sport live লেখেন এবং তাঁর নানা লেখায় ছড়িয়ে রয়েছে পেইনের ভাবনা ও দর্শন।

পেইন-পাঠ রেজাউল করীমের দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তিবাদের সূচনা করে। নতুন যুগের মানবতাবাদী মন ও যুক্তির আলোকে তিনি ইসলাম ও হযরত মোহাম্মদের ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্বকে অনুধাবনের চেষ্টা করলেন। প্রতিভায়, মনীষায়, সংগ্রামে, সংকটে, সমন্বয়ে, মানবতায় স্পর্শযোগ্য মানুষ মোহাম্মদ তাঁর ভাবনাবৃত্তে প্রতিভাত হলেন। ধীরে-ধীরে একটি মানবমুখী ও গঠনবাদী সংশয় তাঁর মধ্যে জেগে উঠল। এরই অনুপ্রেরণায় তিনি রাজনীতি, শিক্ষাকে ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্ত করার ব্রত গ্রহণ করেন। নিজে গান্ধীর অনুসারী হলেও এবং ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর অবদানকে স্বীকার করলেও অকারণ রাজনীতির মধ্যে ধর্মকে টেনে আনার গান্ধীর যে-প্রবণতা তার বিরোধী ছিলেন তিনি। গান্ধীকে নিয়ে লিখেছেন প্রচুর। কিন্তু ধর্ম ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কবন্ধনে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গেই তাঁর মানসিক সাযুজ্য বেশি প্রকট। ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত চর্চার বিষয় বলেই মনে করতেন তিনি। অথচ রাজনীতি ধর্মকে ব্যবহার করে উপমহাদেশে মানুষের সংকট ডেকে এনেছে বারবার।

 

ফরাসী বিপস্নব : পশ্চিমের আলোকশিখা

রেজাউল করীমের প্রথম বই ফরাসী বিপস্নব, বর্মণ পাবলিশিং হাউস থেকে ১৯৩৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন বিশ্ববিশ্রম্নত অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার। আজ ভাবতে অবাক লাগে যে, এই বইয়ের অধিকাংশ লেখা প্রকাশ পায় মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। তিনিই পরে মুসলিম লীগপন্থী হবেন এবং বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে
বহ্নি-উৎসবে নেতৃত্ব দেবেন। হারিয়ে যাবে তাঁর অতীতের কা-জ্ঞান।

বিনয় সরকার তাঁর হৃদয়ের বিরাটত্বের পরিচয় দিয়ে ভূমিকায় লিখেছেন :

যুবক মুসলমানের কাছ থেকেও বাংলা 888sport live football এসব সম্পদে ঐশ্বর্যশালী হইতেছে – এই কথাটার কিম্মত খুব বেশি। ১৯০৫ সনের পরবর্ত্তী যুগে বাঙালি জাতি যে সকল কারণে নানা প্রকারে দৌলতবন্দ হইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে তাহার ভিতর বাঙালি মুসলমানের ব্যক্তিত্ববিকাশ ও কর্ম্মতৎপরতা অন্যতম। বাঙালী মুসলমানের শক্তি একালের নয়া বাংলায় কর্ম্মযোগের অপূর্ব বুনিয়াদ রূপে দাঁড়াইয়া যাইতেছে। তাহাতে হিন্দু বাঙলার কোমরও যারপরনাই দৃঢ়তা লাভ করিতেছে। বাঙলার নর888sport promo code এক নবীন গৌরবের যুগে পা ফেলিতে চলিল।…

আবার দেখিতেছি রফিউদ্দিন আহমদ কলিকাতায় ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন, আর সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ পত্রিকাদি প্রকাশ করিয়া যুবক বাঙলার শক্তি যোগের ক্ষেত্র বাড়াইয়া দিতেছেন। এদিকে কয়েক বছর ধরিয়া ‘বঙ্গীয় মুসলমান 888sport live football সমিতি’র তদবিরে 888sport apkকে 888sport apk, দর্শনকে দর্শন, ইতিহাসকে ইতিহাস, 888sport live footballকে 888sport live football, সকল ধারায়ই মুসলমানের চিন্তা ফুটিয়া উঠিতেছে। আর সেদিন প্রাচীন কবি কায়কোবাদের বক্তৃতায় যেসুর শুনলাম (২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৩১) তাহাতে হিন্দু-মুসলমানের সমবেত শক্তি-গঠিত নয়া বাঙলার পূবর্বাভাষই সূচিত হইতেছে। রেজাউল করীম সেই নয়া-বাঙলারই বিশ্ব-শক্তি-সেবী 888sport live football সাধক।

আর আমরা রেজাউল করীমের লেখায় পড়ছি :

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত মত ও আধ্যাত্মিক ব্যাপার। উহা রাজনীতি ক্ষেত্রে নামিয়া আসিয়া দেশের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলেই দেশের সুখ ও শামিত্মর ব্যাঘাত করিবে। প্রত্যেক দেশের অধিবাসী – সে যে ধর্ম্মাবলম্বীই হউক না কেন – তাহার সমষ্টি লইয়াই একটি জাতি। এই জাতির কল্যাণ কামনা দেশস্থ সকলেরই করা উচিত। আপন ইচ্ছামত প্রত্যেকে ধর্ম্মপালন করুক, প্রচার করুক – তাহাতে কাহারও কিছু আসে যায় না। সেসব ব্যাপারের রাজনীতির কোনও সম্বন্ধ নাই। রাজনীতি তাহা হইতে একেবারেই ভিন্ন বস্ত্ত। এই যুগান্তকারী উচ্চভাব ইউরোপ ফরাসী-বিপস্নব হইতে পূর্ণরূপে শিখিয়াছে। বিপস্নবের প্রভাবে ভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বী ও মতাবলম্বী লোক একই দেশে বাস করিয়া আপনাদের ধর্ম্মগত পার্থক্য ভুলিয়া একই জাতি বলিয়া আপনার পরিচয় দিতে আর কুণ্ঠিত হইল না, বা লজ্জা বোধ করিল না।

তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, ফরাসি বিপস্নবের মরম-কথা ধর্ম ও সম্প্রদায়ে শতধাবিভক্ত ভারতবর্ষের মানুষেরা হয়তো অনুধাবন করতে পারবে না। এখানে চিরটা কাল ভক্তির যূপকাষ্ঠে যুক্তিকে বলি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তির নিজস্ব সত্তা নানা নিষেধের নিগড়ে বাঁধা পড়েছে। রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্র নিষ্পেষিত করেছে মানবাত্মাকে। মুক্তির পথ দেখিয়েছে এই বিপস্নব এবং তিনি আমাদের কীর্তি-আখ্যান মেলে ধরেছেন :

কুসংস্কার সমগ্র দেশকে এরূপভাবে গ্রাস করিয়াছিল যে, সমাজের আমূল ধ্বংস করা ভিন্ন তাহাদের অন্য কোনো উপায় ছিল না। রাজা, চার্চ ও অভিজাতবর্গের হসেত্ম পূর্বের ন্যায় ক্ষমতা রাখিয়া দিলে দেশের মুক্তি, তথা সমগ্র ইউরোপের মুক্তি হইত না। তাই বিপস্নবীগণ সমুদয় অনাচার ও অত্যাচারের ওপর খড়গহস্ত হইয়া উহার মূল উৎস বন্ধ করিতে চাহিয়াছিল। সেই জন্য তাহারা একটু বাড়াবাড়ি করিয়া ফেলিয়াছিল। অতটা না করাই তাহাদের উচিত ছিল। ফরাসি-বিপস্নবের সময় মুক্তির নামে বহু অত্যাচার অবাধে চলিয়াছিল সত্য, কিন্তু ইহাই আবার ইউরোপকে নানাবিধ অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও স্বৈরাচারের কবল হইতে উদ্ধার করিয়াছে। সত্য কথা বলিতে গেলে বলিতে হয় যে, বর্তমান ইউরোপ ফরাসি-বিপস্নবের সৃষ্টি। স্বৈরাচারিণী রাজশক্তির প্রভাবে প্রভাবান্বিত ইউরোপের কোথাও Personal liberty বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলিয়া কোনো অধিকারের অসিত্মত্বই ছিল না – রাজার ইচ্ছাই ছিল প্রজার ইচ্ছা।

ফরাসি-বিপস্নবের মাধ্যমে মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়েছে, অর্জন করেছে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের অনন্য অধিকার।

 

নয়া ভারতের ভিত্তি : সমস্যার মূলে আঘাত

ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার নানাদিক এ-বইয়ের বিভিন্ন 888sport liveে আলোচিত হয়েছে। তৎকালীন সংকীর্ণ রাজনীতির কয়েকটি প্রধান দিক নিয়ে আন্তরিক তাগিদে দৈনিক বসুমতী, আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, বঙ্গবাণী, নবশক্তি ইত্যাদি পত্রিকায় 888sport live লিখেছেন রেজাউল করীম সমস্যার মূলে আঘাত করার জন্য। দি মডার্ন বুক এজেন্সি থেকে ১৩৪২ বঙ্গাব্দে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। নয়া ভারতের ভিত্তি বইয়ের সারগর্ভ একটি ভূমিকা লিখেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এ-বইয়ের লেখক সম্পর্কে তিনি লেখেন :

তিনি  (রেজাউল করীম) একজন শক্তিশালী, চিন্তাশীল ও নির্ভীক লেখক এবং যথার্থ জাতীয়তাবাদী। ইহার লেখার ভিতর একটা নিজস্ব চিন্তার ছাপ আছে। ইহার গভীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিশেস্নষণ শক্তির বিকাশ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছি। ইনি বিলক্ষণ উপলব্ধি করিয়াছেন যে, হিন্দু ও মুসলমানের সম্বন্ধ প্রীতি ও সদ্ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত না হইলে ভারতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং যে তিমিরে সেই তিমিরে রহিবে। গ্রন্থকর্তা স্পষ্টই বুঝিয়েছেন ও দেখাইয়াছেন যে, আসল রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায় না করিয়া কেবল খোসা ও ভূমি লইয়া অনর্থক ঝগড়া ও বিবাদ করিতেছি।… তবে আশার কথা এই যে, নব্য বাঙ্গালায় মিষ্টার রেজাউল করীমের ন্যায় সুসন্তান জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। ইনি সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী। ইহা যে দেশ ও সমাজের মহা অনিষ্ট করিতেছে তাহা ইনি অকুতোভয়ে ও তূর্য্যনিনাদে এই পুস্তকে ঘোষণা করিয়াছেন। এদিক দিয়া তিনি রাজনীতিক লেখকদের মধ্যে অগ্রগণ্য – বোধহয় অদ্বিতীয়ও। ভারতের রাজনৈতিক আকাশ আজ নানা কারণে ঘোর তমসাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে, আমার বিশ্বাস, ইহার মত শক্তিশালী লেখকদের দ্বারা তাহা দূরীভূত হইবে।

আমরা জানি রেজাউল করীম বা প্রফুল্লচন্দ্র রায় যে আশা করেছিলেন তা পূরণ হয়নি। রাজনীতির নেতাদের শুভবোধ ফেরেনি, ভারতের রাজনৈতিক আকাশে ঘোর তমসা ভেদ করে অরুণোদয় হয়নি। ক্ষমতার লিপ্সার শিকার হয়ে দেশের মানচিত্র বদলে গেছে ভ্রাতৃঘাতী মূঢ়তায়। সাধারণ মানুষকে মূল্য চুকাতে হয়েছে জীবন, ধন ও মান দিয়ে। পোড়া বার্তাকু পেয়েছি খাস, সুদিন আসেনি জাতীয় জীবনে।

তখনকার দিনে রেজাউল করীমের কাছে অনেকের অভিযোগ ছিল, মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী যতটা নির্মম হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিষয়ে তিনি ততটা নীরব। বইয়ের  নিবেদন অংশে এর সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন তিনি :

হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতা অপেক্ষা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার উপর আক্রমণের বেগ একটু বেশি হইয়াছে। হয়ত হইয়াছে। যদি তাহা হইয়া থাকে, তবে তাহা এ জন্য নয় যে, আমি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে নিন্দা করি না, বরং খুবই নিন্দা করি। তাহা হয়ত এই জন্য যে, হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতা দেশের অন্য বিষয়ে ক্ষতি করিলেও, হিন্দুদের জাগরণের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করে নাই। কিন্তু মুসলিম-সাম্প্রদায়িকতা মুসলমানকে পশ্চাতে ফেলিয়া রাখিয়াছে – তাহাদের মধ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের পথে প্রধান বিঘ্ন উৎপাদন করিয়াছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার হয়নি। তাদের মধ্যে আবির্ভাব হয়নি কা-জ্ঞানসম্পন্ন নেতার। জীবনের আর পাঁচটা ক্ষেত্রে হেরে গিয়ে প্রায় মরে বেঁচে আছে তারা।

বইয়ের শেষ 888sport live ‘ধর্মের নামে নরহত্যা’। আমাদের এই সময়ের জন্য 888sport liveটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজও এই উপমহাদেশে ধর্মের নামে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা সবচেয়ে সহজ। ধর্মরক্ষা করতে নরহত্যা চলেছে আজও। অথচ ধর্ম নামের প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত অবমাননায় তিনি দ্বিধাহীনভাবে তাঁর ঘৃণা ব্যক্ত করেছিলেন :

যে ধর্মকে রক্ষার জন্য মানুষকে বধ করিবার প্রয়োজন হয়, তাহা কখনই বিধাতার অভিপ্রেত ধর্ম নহে। যাহারা ধর্মের নামে নরহত্যার কার্যে লিপ্ত হয়, তাহারা ধর্মের আদেশ-বিধিগুলি যত কঠোরভাবেই পালন করুক না কেন, তাহাদিগকে আমরা ধার্মিক বা ধর্মপ্রাণ বলিয়া বিশ্বাস করি না বরং তাহাদিগকে ধর্মদ্রোহী, মানবের শত্রম্ন বলিয়া মনে করি।

সমকালের ঘটনা থেকে উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ‘স্বামী 888sport apk download apk latest versionনন্দ হইতে আরম্ভ করিয়া
নাথুরাম-হত্যা পর্যন্ত যে-কয়েকটি লোমহর্ষক নরবলি ধর্মের নামে সংঘটিত হইয়া গেল, তাহাতে ধর্মের সাফল্য সম্বন্ধে মনোমধ্যে সন্দেহ জাগিয়া থাকে।’ এবং 888sport liveের শেষ অংশে এসে লেখক তাঁর যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দেন :

ধর্মের নামে যথেষ্ট রক্তপাত হইয়াছে; বহু নিরপরাধ ব্যক্তি নৃশংসভাবে নিহত হইয়াছে – ইহাতে ধর্ম যে অধিকতর স্থায়িত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, এরূপ মনে হয় না। ইহাতে ভগবানের আসন স্থির থাকে নাই, বরং বিচলিত হইয়াছে। এরূপ বর্বরতা আর সহ্য করা যায় না।

আজকের আমাদের যাপিত জীবনেও এই কথাগুলো ভয়ংকর রকম সত্য। কেমন অপার যন্ত্রণা থেকে তাঁর এই লেখা তা সহজে অনুমেয়। মনে রাখতে হবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের একচেটিয়া নয়। আর উলেস্নখ করা খুব দরকার যে, এ-বই পড়ে ১৮ মে ১৯৩৭ আলমোড়া থেকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে জানান : ‘আপনার রচিত নয়া ভারতের ভিত্তি বইখানি মূল্যবান। ভাষায় চিন্তায় হৃদয়ের ঔদার্য্যে এই গ্রন্থখানি যে বিশিষ্টতা লাভ করিয়াছে তাহাতে আমি মুগ্ধ হইয়াছি, ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।’

 

প্রসঙ্গ : ইসলাম ও ভারত-আরব সম্পর্ক

ইসলাম রেজাউল করীমের বরাবরের চর্চার বিষয়। আর তার সূত্র ধরে এসেছেন ভারত-আরব সম্পর্কে। হযরত মোহাম্মদের জন্মেরও আগে থেকে ভারতের সঙ্গে আরবের এক নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। সে-সম্পর্ক ছিল মূলত বাণিজ্যিক, ভারতের উপকূল অঞ্চলে আরব বণিকদের আনাগোনা ছিলই। তা ছাড়া শাসক হিসেবে আসার অনেক আগে থেকেই এদেশে মুসলমানরা এসেছে সুফি ও দরবেশদের মাধ্যমে। পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদটি কেরালায় অবস্থিত। হযরত মোহাম্মদের প্রতি রেজাউল করীমের ছিল আবাল্য অনুরাগ। ইসলাম ধর্ম ও তার প্রবর্তক সম্পর্কে তিনি প্রথম যৌবনে বই লেখার চেষ্টা করেছিলেন। অগ্রজ মঈনউদ্দীন হোসায়নও Saying of Mohammad নামে হযরত মোহাম্মদের বাণীর একটা সংকলন করেন। রেজাউল করীম For India and IslamAnecdotes of Hazrat Mohammad নামে দুটি বই প্রকাশ করেন।

For India and Islam গ্রন্থে অবিভাজ্য ভারতীয় জাতীয়তারই কথা রয়েছে আলোচনার কেন্দ্রে। জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম
ধর্ম-সম্পর্কিত পঁচিশটি 888sport live রয়েছে এ-বইয়ে। এই বই লিখতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় উৎসাহ দিয়েছিলেন। অনেক বিতর্কমূলক ভাবনাচিন্তা, মতামত ও সিদ্ধান্ত রয়েছে এখানে। একদম গ্রন্থের শুরুতে উৎকলিত হয়েছে গোলটেবিল বৈঠকে মৌলানা মোহম্মদ আলির দেওয়া ভাষণের অংশ : Where India is concerned, where India’s freedom is concerned, where the welfare of India is concerned, I am an Indian first, an Indian second and Indian last and nothing but an Indian. তাঁর বক্তব্যের সারকথা এখানে বিবৃত হয়েছে। আর স্বতন্ত্র নির্বাচন, স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন ভারতের মুসলমান সমাজকে যারপরনাই বিকলাঙ্গ করে দেবে, এই সতর্কবাণী সুস্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করেছেন রেজাউল করীম : I believe that the special privileges and safeguards are not more than palliatives that give temporary relief to the patient. They cannot be of permanent benefit to the Muslims. Habituated to depend on a third party for more than 50 years, the Muslims of these days have lost all faith in themselves and have become apathetic towards the movement that has been started to emancipate India – our motherland, from all sorts of bondage. I cannot recollect without shudder the terrible disaster that the opium of safeguard and reservation has brought upon us. These safeguards are not grace, not a favour – they are an opium which with its soporific effect has been benumbing into death.

এই সতর্কবাণীতে কান দেয়নি সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষ এবং বিনিময়ে মূল্য দিয়েছে অনেক, আজো দিতে হচ্ছে।

দারা শিকোহ নিয়েও একটি 888sport live আছে এই সংকলনে। পরে তিনি বাংলায় একটা বই লিখেছেন দারা সম্পর্কে এবং তাঁর নানা লেখায় ছড়িয়ে আছে দারার ভাবনা-চূর্ণ। দারা নিজের সুফি-ভাবনা থেকে হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে একটা সমন্বয়ের পথ খোঁজার চেষ্টা করেন। তাঁর কথা 888sport app download for android করেছেন রেজাউল করীম :

In these days of communal tension and acrimony the more we think of Dara, the more we are inclined to believe that if Dara would have succeeded Shah Jahan to the throne of the Mughal Empire, there would have been greater possibility of union and fusion between the Hindus and Moslems.

রেজাউল করীম কবি ইকবালের প্রতিভা ও প্রজ্ঞার কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেছেন, কিন্তু ব্যথিত হয়েছেন তাঁর মুসলিম রাজনীতির বিপথগামী হওয়ার কারণে। তাঁর উদ্দেশে লিখিত খোলা চিঠিতে ব্যক্ত হয়েছে মনের কষ্ট :

Poetry can never flourish and bud forth in the hot-house of polities, it soaks up the perennial fountain of inspiration. We always apprehend that in Iqbal the politician we will lose Iqbal the poet, which will be a great loss to the country and community. Your inspiration is needed elsewhere than in the arena of politics. Politics is a hard game for a poet like you which you will be never able to play out successfully. It is our earnest desire to find you above all pettiness and squibblings, raised to a place which is the fit abode of poets of all ages from where all will find guidance and consolation, light and inspiration in weal or woe. Therefore with bended knees and folded hands we request you not to allow your esteemed name to be associated with reactionary parties – with all these misguided geniuses whose selfishness has passed all reasonable limit.

সুভাষচন্দ্র বসু তখন কংগ্রেসের সভাপতি। তিনি রেজাউল করীমের এই বই ওড়িষ্যার প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ দাসকে পাঠিয়ে লেখেন :

In view of the communal situation in the country a book of this sort may be very helpful. I know the author very well. He is a thorough nationalist and I believe that his book, if popularised among the public, will help to counteract communalism. I should be very glad if you could possibly make use of this book in your province.

আর স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই বইয়ের প্রয়োজন শেষ হয়েছে বলে মনে হয় না।

ভারতীয় সংস্কৃতি যে কেবল প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুবর্তন নয়, ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিও যে এর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ তিনি তার অনুসন্ধান করেছেন সারাজীবন। এদেশের ভাষা, 888sport live football, ধর্ম, সংগীত, 888sport live chatকলা, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস – সকল ক্ষেত্রে যে হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় ঘটেছে তা তিনি ক্লামিত্মহীনভাবে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। ইসলামের আগমনে ভারতের ভাষা ও 888sport live footballে বৈচিত্রময় রূপান্তর ঘটেছে। মানুষের মুখের ভাষার বিবর্তনে উর্দু ভাষার উদ্ভব হয়েছে। ‘ফারসী চর্চায় হিন্দু সুধী’ 888sport liveে তিনি দেখিয়েছেন মধ্যযুগের উভয় সম্প্রদায়ের প–তগণ কীভাবে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছেন পরস্পরকে।

মুসলিম প–ত যেমন সযত্নে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেছিলেন, সেইরূপ হিন্দু প–তগণও আরবী ও ফারসী ভাষা শিক্ষা করতে কুষ্ঠিত হননি। কিছুসংখ্যক হিন্দু প–ত মুসলিম কালচার সম্বন্ধে বিবিধ প্রকার গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। শুধু সংস্কৃত ভাষায় নয়, ফারসী ও আরবী ভাষাতেও তাঁরা বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।… ভারতে হিন্দুচিন্তা ও মুসলিমচিন্তার মধ্যে দীর্ঘকাল থেকে আদান-প্রদান হয়ে আসছিল। ফলে উভয় ধরনের চিন্তাধারা একই মহাসাগরে মিলিত হচ্ছিল। এইভাবে ভারতে  সংস্কৃতি-সমন্বয়ের পথ সুগম হয়ে আসছিল। কিন্তু ইংরেজ অধিকারের পর সে সমন্বয় বন্ধ হয়ে গেল।

তারপর সে-চেষ্টা খুব কম দেখা গেছে উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে।

সংগীত এবং 888sport live chatকলায় হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয় প্রক্রিয়ার কথা সকলেরই জানা। রেজাউল করীম অনেক তথ্য পরিবেশন করে দেখিয়েছেন হাজার বিভ্রামিত্ম সৃষ্টি করেও এই দুটি ক্ষেত্র থেকে হিন্দু-মুসলমানকে পৃথক করা সম্ভব হবে না আর। ‘ভারতীয় মুসলমানের উপর হিন্দু প্রভাব’ 888sport liveে তিনি লিখেছেন :

ভারতের প্রাচীন চিত্রকেই মোগল 888sport live chatীগণ আদর্শরূপে গ্রহণ করেন এবং তার উন্নতি সাধন করেন। মধ্য এশিয়া ও পারস্য হইতে বহু 888sport live chatী ভারতে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা এদেশের উন্নত ধরনের 888sport live chatকার্য দেখিয়া অবাক হইয়া গেলেন। সুতরাং অনায়াসে এদেশের 888sport live chatের মডেল গ্রহণ করিতে লাগিলেন। এবং হিন্দু 888sport live chatীদের সহযোগিতায় নূতন পদ্ধতিতে চিত্রাঙ্কন আরম্ভ করিলেন। হিন্দু 888sport live chatীগণও নবাগত 888sport live chatকে অগ্রাহ্য করিলেন না। একটা বিশেষ চিত্রের প্রতি লক্ষ করিলে ইহার 888sport live chatী হিন্দু না মুসলমান তাহা নির্ণয় করা কঠিন হইয়া পড়ে। সংগীতচর্চার মধ্যেও সহজে সমন্বয় হইয়াছে। মুসলিম সংগীতজ্ঞগণ এদেশের নিকট নূতন জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন। আবার তাঁহারাও নূতন নূতন সংগীতযন্ত্র ও পদ্ধতি প্রবর্তন করিয়া এ-দেশের সংগীতের মধ্যে নূতন প্রাণ সঞ্চার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। আজ হিন্দুসংগীত ও মুসলিমসংগীত বলিয়া সংগীত ক্ষেত্রে কোনও রূপ সাম্প্রদায়িকতা নাই।

সময়ের স্রোতে সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। জীবনে নানা ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে। তখন আর বিশেষ কোনো একটিকে আলাদা করা সম্ভব হয় না। একই 888sport liveে রেজাউল করীম লিখেছেন আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর সমন্বয়ী প্রভাবের কথা।

প্রদেশে প্রদেশে পোশাক-পরিচ্ছদের বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে স্বতন্ত্র পোশাক খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে।… বিভিন্ন প্রদেশের হিন্দু-মুসলমান সেই প্রদেশের প্রচলিত পোশাকই ব্যবহার করে। পোশাক দেখিয়া
বুঝিবার উপায় নাই কে কোন সম্প্রদায়ভুক্ত। বাংলার আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খায় না বলিয়া সাধারণত বাংলার
হিন্দু-মুসলমান কেহই টুপি ব্যবহার করে না। আর পশ্চিমাঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান- নির্বিশেষে টুপি ব্যবহার করে। ভারতের মুসলমানগণ কয়েক শত বৎসরের মধ্যে আরব ও ইরানের পোশাক পরিচ্ছদ ত্যাগ করিয়া এদেশের পোশাকই গ্রহণ করিয়াছে। আরবী পাগড়ি, আমামা, জুববা, রিদা আর বড় একটা চলে না।

বলা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে আরব-ইরানের প্রভাবও ভারতীয় পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর পড়েছে। খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তনেও হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে এবং আজো করে চলেছে। এদেশের মুসলমান জন888sport free betর বেশিরভাগই ধর্মান্তরিত ভারতীয় হওয়ার কারণে নতুন করে হিন্দু প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার খুব প্রয়োজন পড়েনি। ধর্ম বদলে গেলেও তাদের সংস্কৃতি রাতারাতি বদলে যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্ম নয়, পরস্পরকে কাছাকাছি এনেছে, মিলিয়েছে সংস্কৃতিই। ভারতে এই সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ধারা আজো প্রবহমান।

জাগৃতি থেকে জাতীয়তার পথে

জাগৃতি প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে। এই বই সম্পর্কে প্রকাশক লেখেন – ‘ভারতবর্ষ অর্থে হিন্দু ও মুসলমান। এই দুই সম্প্রদায়ের সংঘর্ষ ও মিলনের চরম পরিণতির ওপর ভারতবর্ষের ভাগ্য নির্ভর করিতেছে। অতএব এই দুই সম্প্রদায়ের মৌলিক তত্ত্ব ও সংস্কৃতি সর্বাংশে বিদিত হওয়া প্রত্যেক ভারতবাসীর একান্ত কর্তব্য।’ এই যে পরস্পরকে জানার কাজটা ব্যাহত হয়েছে বারবার আর না-জানা থেকে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস ও সন্দেহ এবং যার পরিণতি সংঘর্ষে গিয়ে দাঁড়ায়। এই বইয়ের 888sport liveগুলোতে তত্ত্ব আলোচনার চেয়ে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে বেশি। আর এক্ষেত্রে ধর্ম ও রাজনীতির থেকে সংস্কৃতি ও 888sport live footballের ওপরেই লেখকের ভরসা বেশি।

মানুষের নৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রিক কল্যাণ সাধনের কৃতিত্ব ধর্ম-সংস্থাপকের একার নহে। ইহাতে 888sport live footballের দানও অতুলনীয়। জগতে ন্যায়, নীতি, সত্য ও সামাজিক নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠার জন্য 888sport live football যাহা করিয়াছে, তাহা ধর্ম-সংস্থাপকের দান অপেক্ষা কোনও অংশে কম নহে। হোমার, ব্যাস, বাল্মীকি, ফেরদৌসী তাঁহাদের অমর তুলিকায় যেসব পুণ্য চরিত্রের আলেখ্য আঁকিয়াছেন, তাহা জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে ও মানব চরিত্রোন্নতিতে কোনও মহাপুরুষের দান হইতে কম মূল্যবান নহে।

দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে দেশে যখন তোলপাড়, তখন তিনি হযরত মোহাম্মদের জীবন থেকে নানা ঘটনার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন এই তত্ত্ব কত অসার। আমরা আকবরের ধর্মীয় উদারতার কথা যতটা জানি, বাবর সম্পর্কে জানি না। রেজাউল করীম Twentteth Century পত্রিকায় প্রকাশিত এমপি মেটার লেখা থেকে বাবরের উইলের কথা জানতে পারেন। তিনি সেটা উলেস্নখ করেছেন, মৃত্যুর আগে হুমায়ুনকে উদ্দেশ করে ইচ্ছাপত্রে বাবর লিখেছেন :

ভারত সাম্রাজ্য নানা ধর্ম-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। তুমি ভগবানকে ধন্যবাদ দাও – যিনি তোমাকে এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর করিয়াছেন। সুতরাং তোমার উচিত – সকল প্রকার ধর্মীয় অন্ধতা ও গোঁড়ামি পরিত্যাগ করিয়া প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী বিচার করা,  – বিশেষত গোবধ করা হইতে প্রতিনিবৃত্ত থাকিবে।… তোমার সাম্রাজ্যের অধীনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যতগুলি ধর্মমন্দির ও ভজনালয় আছে, সেগুলির কোনও ক্ষতি করবে না।… জানিয়া রাখিবে – অত্যাচার দ্বারা নহে, দয়ার দ্বারাই ইসলামের উন্নতি হইবে।

বাবরের এই ইচ্ছাপত্রের অনুলিপিসহ 888sport app download apk latest version হবীবুলস্নাহ বাহার ও শামসুননাহার-সম্পাদিত বুলবুল মাসিকপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের দেশের শাসকেরা এর থেকে শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। জাতীয়তার পথে তাদের সম্যক জাগৃতি ঘটেনি আজো।

 

দারা শিকোহ-আলবেরুনী-কামাল পাশা চর্চা

১৯৪৫ সালে মডার্ন বুক এজেন্সি-প্রকাশিত বই সাধক দারা শিকোহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশনের দ্রম্নত পঠনরূপে নির্বাচিত হয়। এর ভূমিকা লিখেছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি লেখেন :

বইখানি কেবল সাধক দারা শিকোহের কথা লইয়া নহে, ইহাতে তাঁহার জীবনের পটভূমিকাস্বরূপ ভারতে হিন্দু চিন্তার ও ইসলামীয় চিন্তার সমন্বয়ের কথা খুঁটিনাটির সহিত আলোচিত হইয়াছে। আমরা নিজেদের ভুলিয়া যাই বলিয়াই নিজেদের স্থান হইতে ভ্রষ্ট হই। ভারতের মুসলমানের পিতৃপুরুষ প্রতিবেশী হিন্দুর সহিত মিলিত হইয়া এক সময়ে অপূর্ব সাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করিয়াছেন, তাহার কথা ভারতের মুসলমান এখন ভুলিতে বসিয়াছে; স্বল্পসংখ্যক কিন্তু বিশেষ প্রবল বিরোধ-ধর্মী কতগুলি নেতার প্রভাবে পড়িয়া, সার্বজনীন মানবিকতার ক্ষেত্রে মিলন অপেক্ষা, সঙ্কীর্ণ ধর্মধ্বজিতার দ্বারা প্রণোদিত বিদ্বেষ ও জুগুপ্সার দিকেই সে আকৃষ্ট হইতেছে। এই মনোভাব তাহাকে কেবল আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার দিকেই লইয়া যাইবে। হিন্দুরাও এই সমন্বয়ের চেষ্টার সব কথার বা সব দিকের খবর রাখেন না। এইরূপ অবস্থায়, রেজাউল করীম সাহেবের রচিত এই সুন্দর সুপাঠ্য এবং নিতান্ত যুগোপযোগী পুস্তকখানিকে বাঙ্গালা 888sport live footballের ক্ষেত্রে আমি সানন্দ স্বাগত জ্ঞাপন করিতেছি।… আজ এই হিন্দু-মুসলমান অনৈক্যের [দিনে], হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য যে এক সময়ে সম্ভব হইয়াছিল তাহার ইতিবৃত্ত, আমাদের দেশের প্রত্যেক হিন্দু ও মুসলমান নব-যুবকের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।

দারা রেজাউল করীমের অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র। সারাজীবন তিনি নিজে দারার দর্শন মেনেছেন এবং সকলকে তাঁর কথা বলতে চেয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন :

তাঁহার গভীর বিদ্যাবত্তা ও স্বাধীন অনুশীলন-প্রবৃত্তির পরিচয় নানাভাবে পাওয়া যায়। তিনি যেসব গ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা সকল যুগের সুধীবর্গের আদরণীয়। বলাই বাহুল্য, ধর্ম-বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার। যে যুগে মুসলমানগণ সাধারণত হিন্দুধর্ম বা অপরাপর ধর্মকে উদারভাবে আলোচনা করিতে চাহিত না, সেই-যুগে দারা শিকোহ এমন সরল সহজ ও উদারভাবে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করিয়া গিয়াছেন যে, দেখিলে মনে হয় যেন বিংশ শতাব্দীর কোনো যুক্তিবাদী লেখক বিভিন্ন ধর্মসমন্বয়ের চেষ্টায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন।

এ-কথা বলা নিশ্চয় অসমীচীন হবে না যে, আমাদের সময়ের দারা শিকোহ রেজাউল করীম নিজেই।

সব লেখাই রেজাউল করীম লিখেছেন একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে, সমাজকে পথ দেখাতে। বিশেষত নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে তাঁর আবেদন বেশি। তিনি চাইতেন অন্ধ সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে তাদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটুক। তাঁর লেখায় আমরা পড়ি :

পাশ্চাত্যের কবল হইতে এশিয়াকে রক্ষা করিবার জন্য যাঁহারা সংগ্রাম করিয়াছেন, কামাল তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম মহাপুরুষ। তিনি একটি মৃতকল্প জাতিকে নূতন জীবন দান করিয়াছেন। ভারতের মত অর্দ্ধমৃত দেশের জন্য কামালের ন্যায় ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ চাই।

কামালের প্রভাবে সমগ্র তুর্কি জাতি ঘোষণা করল : We are not Muslims first, we are Turks first। প্যান-ইসলামিজমের আবহ যখন চারদিকে সেই সময়ে দেশের অধিবাসীর মনোবৃত্তি এমন পরিবর্তন সাধন করেন কামাল, পৃথিবীর ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত বিরল। 888sport promo codeর অবরোধ-প্রথা তুলে দেওয়ার জন্য যে-ভাষায় তিনি কামালের প্রশংসা করেছেন তা দেখে বোঝা যায়, তিনি চেয়েছিলেন এদেশের মুসলিমরাও তুরস্কের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেরা পথ চলুক :

মুসলিমপ্রধান দেশসমূহের সবচেয়ে অগৌরবের বিষয় 888sport promo codeজাতির প্রতি তাহাদের কঠোর নির্মম ব্যবহার। ইসলাম 888sport promo codeজাতিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও মুসলমান আজ তাহাকে কঠোর অবরোধের মধ্যে আবদ্ধ রাখিয়া সর্ববিধ অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়াছে।

সংস্কৃতি-সমন্বয়ের অগ্রদূত ছিলেন আলবেরুনী। সংস্কৃতি ধর্ম থেকে আলাদা। যে-কোনো জাতির সার্থক উন্নতির চরমতম পরিণতি হচ্ছে তার সংস্কৃতি। আলবেরুনী সম্পর্কে রেজাউল করীম লিখেছেন :

আলবেরুনী গ্রীক দর্শনে গভীর জ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন। গ্রীকদের উদার প্রণালী ও দার্শনিক যুক্তি তিনি বেশ ভালভাবে আয়ত্ব করিয়াছিলেন।… তিনি মুসলমানের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন ও হাদীসের প্রচলিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে প্রস্ত্তত হন নাই, নিজের বিবেকসম্মত ব্যাখ্যাই তিনি স্বীকার করিতেন। ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র পাঠ করিয়া তিনি দেখিলেন যে, উহার সহিত ইসলামিক দর্শন বিশেষতঃ সুফি মতবাদের বিশেষ পার্থক্য নাই, অন্ততঃ মূলগত আদর্শ বিষয়ে। একজন নিরপেক্ষ দর্শকের মত তিনি সুস্পষ্টভাবে দেখিলেন যে, হিন্দু মানসিকতার অধঃপতনের মূল কারণ উহাদের দর্শন বা শাস্ত্রের মধ্যে নাই। সাধারণের মধ্যে বিদ্যাচর্চা কমিয়া আসাতে পৌরোহিত্য-প্রভাব বৃদ্ধি পাইল, এবং তাহা হইতে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ও স্ফুরণ আর রহিল না। তিনি এই উক্তি কেবল হিন্দুদের বেলায় করেন নাই। তাঁহার মতে মুসলিম মানসিকতার অধঃপতনের মূল কারণ তুর্কি প্রাধান্যবৃদ্ধি।

মুসলমান সমাজে ধর্মের অন্ধ তামসিকতা থেকে বেরিয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চার প্রধানতম অন্তরায় আজ তাদের মোলস্নাতন্ত্র। তারা পরলোকের সুখ ও স্বপ্নে বিভোর। এবং তার জন্য তারা ঠুনকো কারণে মানুষকে হত্যা করতে পিছপা হচ্ছে না। অথচ, মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। তাঁর সবচেয়ে পরিচিত এই 888sport liveের একদম শেষে রেজাউল করীম বলছেন :

মহাজন নির্দেশমত সেইসব পথ ধরিয়া আমরা অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয় আলোচনা করি এবং পূর্ব হইতে বিদ্বেষ ও ঘৃণার ভাব পরিত্যাগ করি, তবে আশা করা যায়, মহামনীষী আলবেরুনীর সাধনা সার্থক হইবে – মহাপ্রাণ দারা শিকোহের আত্মবলিদান সফল হইবে এবং ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংস্কৃতিগত মিলন ও সদ্ভাব সম্ভব হইবে।

কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই তাঁর কথায় অন্য মত পোষণ করবে বলে মনে হয় না।

 

বঙ্কিমচন্দ্র

রেজাউল করীমের বঙ্কিম-ভাবনা বুঝতে হলে তৎকালীন মুসলিম মানস সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। তাঁর বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। ১৯৩৮ সালে বঙ্কিমের জন্মশতবর্ষে 888sport live লিখলেন ‘বঙ্কিমচন্দ্রের নিকট মুসলমানের ঋণ’। সে বছরই দেশআনন্দবাজার পত্রিকায় আরো কয়েকটি 888sport live লেখেন। বইটি বের হলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে মুসলমানদের আপত্তি মূলত আনন্দমঠ 888sport alternative link নিয়েই। বিশ শতকের তিনের দশকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চরমে উঠলে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কারণে বঙ্কিমের লেখা থেকে বের করা হয় মুসলমান-বিদ্বেষের ভূত। কলকাতার রাস্তায় মুসলিম নেতা মৌলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে প্রকাশ্যে শত-শত কপি আনন্দমঠ পোড়ানো হয়। এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন রেজাউল করীম। ‘আনন্দমঠের বহ্নি উৎসব’ নামে 888sport live লিখলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। তিনি লেখেন :

সেদিন বাংলার রাজধানীর বুকে লীগপন্থী মুসলমানদের মহতী সভায় বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত পুস্তক আনন্দমঠের মহাসমারোহে বহ্নি উৎসব হইয়া গেল, সভ্য জগৎ স্তম্ভিতচিত্তে দেখিল, ভারতের একটি বৃহৎ নগরে, বহু শিক্ষিত এবং 888sport live football-সেবকের সম্মুখে এবং সম্মতিক্রমে এমন একটি অনাচার হইয়া গেল, যাহা বর্বরতায় মধ্যযুগের ধর্মান্ধ জ্ঞানবৈরীদের সমস্ত অত্যাচারকে মস্নান করিয়া দিল।

এই বইয়ের কারণে তাঁকে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাতে আক্রান্ত হতে হয়। 888sport live football আকাদেমি প্রকাশিত Bankim Chandra Chatterjee : Essays in Perspective গ্রন্থে রেজাউল করীমের ‘অহিন্দুর দৃষ্টিতে বঙ্কিম-প্রতিভা’ ‘In the eyes of a non-Hindu’ নামে সংকলিত হয়। 888sport app download apk latest version করেন উইলিয়াম রাদিচে এবং বই সম্পাদনা করেন অধ্যাপক ভবতোষ চট্টোপাধ্যায়।

শেষ কথা কে বলবে!

গান্ধী ও আজাদের মতো রেজাউল করীমও এক ট্র্যাজিক চরিত্র। তিনি সারাজীবন সম্প্রীতি ও সমন্বয়ের কথা বলে গেলেন। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দেখলেন দেশে তথা উপমহাদেশেই ধর্ম নিয়ে মানুষের মূঢ়তা বেড়েছে, সকলকে সে ধারণ করতে পারেনি। নিজের শহরের উপান্তে কাটরা মসজিদকে কেন্দ্র করে নরহত্যা দেখলেন, দেখলেন পরিকল্পিত মদদে বাবরি ধ্বংস। পারস্পরিক বৈরিতা বেড়েছে বই কমেনি! অবিশ্বাসের অন্ধকার গাঢ় হয়েছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে, জীবনের শেষ লেখায় (আজকাল, ১৮-১১-১৯৯৩) বড়ো অসহায় হয়ে প্রশ্ন রাখলেন, ‘এই ভারতের কি স্বপ্ন দেখেছিলাম?’ তাতে লিখলেন ক্ষোভে ও হতাশায় :

মনে করা হত, মুসলিম লিগ সাম্প্রদায়িক দল, আর কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী দল। অবশ্যই ঠিক ভাবা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করতাম, কিছু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসি হিন্দু-মহাসভার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রক্ষা করে চলত। এই অভ্যাস আজও বাম-দক্ষিণ নির্বিশেষে, অনেকের মধ্যে অলক্ষ্যে বহমান এবং এটা খুব খারাপ লক্ষণ, দেশকে বাঁচাতে হলে এ থেকে মুক্ত হতে হবে।

তাহলে রেজাউল করীমের সমন্বয়ী ভাবনা, সম্প্রীতির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে? কেউ কেউ বলেন, স্বপ্নের জন্মের মধ্যেই স্বপ্নের মহত্ত্ব। মুক্তবুদ্ধি, প্রীতি, সহাবস্থান, মর্যাদাদান এসবেই মিলিত রূপ সমন্বয়। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজি সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তাহলে রেজাউল করীম সম্পর্কেও তা প্রযোজ্য :

Perhaps he will fail as the Buddha failed and as Christ failed to wean men from inequities, but he will always be remembered as one who made his life a lesson for all ages to come.

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের উচ্চারণ ও অবস্থান আরো দৃঢ় করা একান্ত প্রয়োজন। সংকীর্ণ ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে রচনা করতে হবে সংস্কৃতির নিবিড় বন্ধন। শেষ লেখার শেষতম অংশে রেজাউল একটা আশার রেখা দিয়েছেন আমাদের জন্য :

সেই যে একটি ভারতের ছবি মনে মনে বাল্যকাল থেকেই আঁকবার চেষ্টা করেছি, যুবককালে যার জন্য প্রাণ সঁপে দিয়েছিলাম, আজ প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, সে ছবি কি মস্নান হয়ে যাচ্ছে? তবু রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সেই বিশ্বাসের শিখা বড় সাবধানে অন্তরে জ্বালিয়ে রেখেছি, – এই শেষ বয়সেও! সেই শিখাটুকু একেবারে নিভে যায়, দেশে এমন ঝড় যেন না ওঠে।

 

সহায়ক তথ্যসূত্র

১. রেজাউল করীম, জহর সেন, বঙ্গীয় 888sport live football পরিষৎ।

২. 888sport live সংগ্রহ, রেজাউল করীম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।

৩. আকাদেমি পত্রিকা-৬, বৈশাখ ১৪০১, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি।

৪. রেজাউল করীম, জাহিরুল হাসান, 888sport live football আকাদেমি।

৫. বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলমান সমাজ, রেজাউল করীম, র‌্যাডিক্যাল, কলকাতা।

৬. বঙ্গদর্শন-১, সম্পাদনা : সত্যজিৎ চৌধুরী, বঙ্কিম ভবন, নৈহাটি।

৭. রেজাউল করীম একাডেমি পত্রিকা, সম্পাদনা : আবুল হাসনাত, বহরমপুর।

৮. রেজাউল করীম : মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে নির্ভীক সৈনিক (888sport live), আবুল হাসনাত, বহরমপুর।

৯. সংস্কৃতি সমন্বয় : কিছু ভাবনা, রেজাউল করীম, বুক ট্রাস্ট, কলকাতা।