আমরা ভুলে গিয়েছিলাম এই শহর যে শুধু মানুষের নয়। চারশো বছরের প্রাচীন এই শহরকে তিলে তিলে করে তোলা হয় মেগাশহর। একশ চৌত্রিশ বর্গমাইলের এই মহানগরীকে ভরিয়ে তোলা হয়েছিল মানুষে মানুষে। যেদিকেই চোখ যেত কেবল মানুষ আর মানুষ। রাস্তায় বেরোলেই আমরা ভাসতে থাকতাম মানবস্রোতে। রাস্তাগুলো ঢেকে থাকত কফ-থুতু আর আবর্জনায়। বাতাসে ভাসত ধুলা আর ধুলা, সিসা আর সিসা, ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আর যানবাহনের 888sport free bet? ঠিক হিসাবটি সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ছিল না। রাস্তায় বেরোলেই হর্নের শব্দে আমরা কেঁপে উঠতাম। শব্দদূষণে আমাদের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে পড়েছিল, কোলস্টেরল বেড়ে গিয়েছিল, স্নায়ুতন্ত্রগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আর বহুতল ভবন? যেদিকেই তাকাই কেবল দালান আর দালান। এই শহরের মানুষেরা আকাশ ছোঁয়ার সাধনায় মেতে উঠেছিল। দালানে আকীর্ণ এই শহরে আমরা আকাশ দেখতে পেতাম না, চাঁদ দেখতে পেতাম না, পূর্ণিমা দেখতে পেতাম না। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম অমাবস্যার গভীর অন্ধকারের নৈঃশব্দ্য। ভুলে গিয়েছিলাম আকাশে যে ছায়াপথ থাকে, কালপুরুষ থাকে, সন্ধ্যাতারা, ধ্রুবতারা, স্বাতীতারা ও সপ্তর্ষিমণ্ডল থাকে। শেষ কবে জোনাকি দেখেছি কেউ মনে করতে পারতাম না।
এই শহরে কোনো বৃক্ষ ছিল না। সড়কদ্বীপগুলো সাজানো হয়েছিল কৃত্রিম বৃক্ষে। পার্কগুলোকে করে তোলা হয়েছিল জনসভার ময়দান। মানুষ ভুলে গিয়েছিল পাতাঝরার শব্দ। ভুলে গিয়েছিল ফুলের সৌন্দর্য। এই শহরে শেষ কবে ফুল ফুটেছিল কেউ জানত না। শহরে কোনো খেলার মাঠ ছিল না, স্নানের কোনো পুকুর ছিল না, 888sport slot gameের কোনো জায়গা ছিল না। তরুণ-তরুণীরা বাসে, ট্রেনে, রেস্তোরাঁয়, ফুটপাতে বসে অভিসার করত। নদীগুলোকে দখল করতে করতে … দখল করতে করতে খুন করা হয়েছিল। যে তিনটি ক্ষীণকায় নদী বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল টন টন বর্জ্যে সেগুলো হয়ে পড়েছিল একেকটা ভাগাড়। পানি হয়ে পড়েছিল আলকাতরার মতো। এই শহরে কখনো বৃষ্টি হতো না। কালীদাসের মেঘদূত পড়ে আমরা বৃষ্টির রূপ উপভোগ করতাম। ষড়ঋতুর দেশ, অথচ এই শহরে কখনো শীত নামত না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের দিগন্তবিস্তারী বরফদৃশ্য দেখে আমরা শীতের আমেজ উপভোগ করতাম। এই শহরকে ঘোষণা করা হয়েছিল পৃথিবীর তৃতীয় দূষিত শহর হিসেবে।
এই শহরে দুর্ঘটনা প্রায় লেগেই থাকত। একবার এক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়েছিল সাড়ে তিনশো মানুষ। একবার এক বহুতল ভবন ধসে চাপা পড়েছিল চারশো মানুষ। একবার এক ভয়াবহ বোমা হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল একশ চুরাশিজন মানুষ। একবার এক রাজনৈতিক গোলযোগে নিহত হয়েছিল দেড় হাজার মানুষ। একবার এক জনসভায় পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল একশ কুড়িজন মানুষ। একবার এক বছরে হৃদরোগে মারা গিয়েছিল আটাশ হাজার মানুষ। একবার এক বছরে ব্রেইন স্ট্রোকে মারা গিয়েছিল তেতাল্লিশ হাজার মানুষ। একবার এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল সতেরো হাজার মানুষ। আমরা ভীত হইনি, সতর্ক হইনি। ভেবেছিলাম একেই বলে নগরসভ্যতা।
একদিন। আমরা যখন ঐতিহ্যবাহী এই শহরের চারশো বছরপূর্তি উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকা নেমে এলো আমাদের এই তিলোত্তমা মহানগরীতে। এক অজ্ঞাতে রোগে একদিনে মারা গেল একশ কুড়িজন মানুষ। সরকার গুরুত্ব দিলো না। দ্বিতীয়দিন মারা গেল দুইশো আটাত্তরজন মানুষ। সরকার গুরুত্ব দিলো না। তৃতীয়দিন মারা গেল সাড়ে চারশো মানুষ। সরকার তবু গুরুত্ব দিলো না। চতুর্থদিন মারা গেল দেড় হাজার মানুষ। এবার সরকারের টনক নড়ল। এই অজ্ঞাত রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে চিকিৎসকদের ডাকা হলো। তারা ঘোষণা করল, এই শহরে হানা দিয়েছে সংক্রমণ ব্যাধি ন্যানো ভাইরাস।
ভয়াবহ এই ব্যাধি ঠেকাতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করল সরকার। মৃত্যুর মিছিল থামল না। ষষ্ঠদিন সমস্ত মার্কেট বন্ধ ঘোষণা করল। মৃত্যুর মিছিল থামল না। সপ্তমদিন পৃথিবীর সবকটি দেশ এই শহরের সঙ্গে স্থল, নৌ ও আকাশ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো। অষ্টম দিন সরকার বন্ধ ঘোষণা করল সমস্ত মিল-কারখানা ও বেসরকারি অফিস। মৃত্যুর মিছিল থামল না। নবম দিন ঘোষণা করল সাধারণ ছুটি। জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া সকল সরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। আতঙ্কিত নাগরিকরা ছাড়তে শুরু করল এই নগর। দুই কোটি মানুষ ছড়িয়ে পড়ল দেশের নানা প্রান্তে। এবার গোটা শহর লকডাউন ঘোষণা করল সরকার। টানা এক মাস কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। বেরুলেই দণ্ড। জেল-জরিমানার শাস্তি। কোনো যানবাহন চলবে না। মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডা খুলবে না।
আকস্মিক এই লকডাউনে শহরে আটকা পড়ল অল্পকিছু মানুষ। কতজন? ধারণা নেই। কুড়ি হাজার, পঞ্চাশ হাজার কিংবা এক লাখ। এক মাসের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে তারা হয়ে পড়ল গৃহবন্দি। যারা খাদ্য মজুদ করতে পারেনি, তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো সরকার। আটকেপড়াদের মধ্যে আমিও একজন। আমার কোনো গ্রামের বাড়ি নেই। বহু বছর আগে হারিয়ে গেছে নদীভাঙনে। বাবা-মাও নেই। আত্মীয়স্বজনরা দুশ্চিন্তায় ভুগছিল আমাকে নিয়ে। ফোন করে তাদের আশ্বস্ত করলাম, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমি ভালো আছি। এক মাসের খাদ্যসামগ্রী মজুদ রেখেছি।
আমি থাকি রায়বাজারের একটি ফ্ল্যাটে। একা। চাকরি করি একটি আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে। স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকতে আমার খারাপ লাগে না। বরং ভালোই লাগে। কালো ধোঁয়া, ধুলোবালি, কফ-থুতু ও শব্দসন্ত্রাস আমাকে ছুঁতে পারে না। দুই ঈদে যে-কদিন ছুটি পাই গৃহবন্দিই থাকি। গান শুনি, সিনেমা দেখি, বই পড়ি, ফেসবুকে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করি। লকডাউনের দিনগুলোতেও তাই করতে লাগলাম। সকাল ১০টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। নাশতা করে গান শুনতে শুনতে ঘোরদোর পরিষ্কার করি। দুপুরে ডাল-চাল-আলুর খিচুড়ি রেঁধে খেয়েদেয়ে বই নিয়ে বসি। সন্ধ্যায় বারান্দায় গিয়ে ইজিচেয়ারে বসে থাকি। দেখি শহরের রূপ। সতেরো বছর বয়সে এই শহরে এসেছি। গত তেইশ বছরে শহরের এমন রূপ কখনো দেখিনি। আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোর মানুষেরা লকডাউনের আগেই শহর ছেড়েছে। চারদিকে গভীর নৈঃশব্দ্য। যেন গোরস্তান। যেন এই শহরে জীবিত কোনো মানুষ নেই, কোনোকালে ছিল না। যেন আমি একাই জ্যান্ত মানুষ। ঘণ্টাখানেক বসে থেকে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিই। আবার সিনেমা দেখতে কিংবা বই পড়ে কাটাই। ঘুমাতে যাই একটা-দেড়টায়।
লকডাউনের প্রথম দিন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। যারা শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়েছিল, বিশেষত যাদের মধ্যে রোগটার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, তাদের অন্তত চোদ্দো দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা অমান্য করছিল সরকারি আদেশ। সারাদেশে গণসংক্রমণের আশঙ্কায় সেনাবাহিনীকে মাঠে নামতে বাধ্য হলো সরকার। সেনাসদস্যরা শহর ছেড়ে যাওয়া মানুষদের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য করছিলেন।
সেদিন মধ্যরাতে গ্রামের বাড়ি থেকে আমার এক কাজিন ফোন করে জানাল যে, মসজিদে মসজিদে ও বাড়িতে বাড়িতে নাকি আজান হাঁকা হচ্ছে। হিন্দুরা নাকি বাড়ি বাড়ি উলুধ্বনি দিচ্ছে। মনে পড়ে গেল শৈশব888sport sign up bonus। আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন প্রবল তুফান উঠত, ঘরের চাল যখন উড়ে যায় যায় দশা হতো, মানুষ যখন নিদারুণ বিপন্নতা বোধ করত, ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে তারা হাঁকতে শুরু করত আজান। স্রষ্টার মহত্ত্ব ঘোষণা করে তারা তার আশ্রয় চাইত। কিন্তু ঝড়ের হুংকারের শব্দ উজিয়ে সেই মহত্ত্বধ্বনি বুঝি খোদার কাছ পর্যন্ত পৌঁছত না। নইলে ঝড় থামত না কেন? কেন উড়ে যেত ঘরের চাল? কেন উড়ে যেত গাছবিরিক্ষ? কেন ছারখার হয়ে যেত ঘর-গেরস্তালি? তবে কি আজান নিরর্থক? বাবা বলতেন, নিরর্থক হবে কেন? খোদার আরেক নাম তো কাহ্হার। ধ্বংসকারী। তিনি যখন ধ্বংসকাণ্ডে মেতে ওঠেন, তখন তার রাহিম রূপটি লোপ পায়। তখন তিনি প্রশংসা শুনেও সদয় হন না। তাই বলে তো আজান বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করলে তিনি আরো গোসা হবেন। মেতে উঠবেন ভয়ংকর ধ্বংসলীলায়।
প্রলয়ংকরী ঝড়ের সময় আমার মা মশলা বাটার শিলটা ছুড়ে মারতেন উঠানে। এতে নাকি ঝড়ের গতি কমে যায়। এটা লোকবিশ্বাস। লোকবিশ্বাস লোকসংস্কৃতিরই একটা উপাদান। এই বিশ্বাসের উৎপত্তি কোথায়, কবে যাত্রা শুরু করেছিল, আমার ঠিক জানা নেই। হয়তো আদিমকালে, মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল, মানুষ যখন বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। হয়তো তারা ঝড়কে কোনো অপদেবতা মনে করত। শিল ছুড়ে মারলে সেই দেবতা আহত হবে। আহত শেয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালাবে।
ন্যানো ভাইরাসের এই দুর্যোগে মধ্যরাতের আজানও হয়তো কোনো লোকবিশ্বাস। স্রষ্টার মহত্ত্ব ঘোষণা করে গ্রামের মানুষ হয়তো এই অচেনা মহামারি থেকে বাঁচতে চাইছে। একই বিশ্বাস থেকেই হিন্দুরা হয়তো উলুধ্বনি দিচ্ছে।
কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো রাত ১টার দিকে। তখন ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম। ফেসবুকে সমস্ত তথ্য ও গুজব স্রোতের মতো প্রবাহিত হয়। এক পোস্টের মাধ্যমে জানা গেল, চট্টগ্রামের সমুদ্রবর্তী গ্রাম চরদুর্গায় নাকি এমন এক শিশু জন্ম নিয়েছে, যে কি না জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় কথা বলেছে। বলেছে, মুসলমান হলে আজান দাও, হিন্দু হলে উলুধ্বনি দাও। ন্যানো ভাইরাস পালাবে। এই গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। গুজবে মানুষের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি লোপ পায়। গুজবটা যাচাই-বাছাই না করে মধ্যরাতে তারা আজান হেঁকেছে, উলুধ্বনি দিয়েছে।
ব্রাউজ করতে করতে পেয়ে গেলাম আরেকটি পোস্ট, যেখানে বলা হচ্ছে, চরদুর্গায় নয়, শিশুটি নাকি জন্ম নিয়েছে মেঘনাতীরের গ্রাম ইছাপুরে। জন্মেই সে বলেছে, মসজিদে মসজিদে ও ঘরে ঘরে আজান দিতে এবং দুধ-চিনি ছাড়া আদা দিয়ে লাল চা খেতে। এটাই ন্যানো ভাইরাসের ওষুধ। গুজবটা মানুষ বিশ্বাস করল। মধ্যরাতে আজান দিতে লাগল এবং দফায় দফায় খেতে লাগল আদা-চা।
আমি ব্রাউজ করতে থাকি। চোখে পড়ল আরেকটি পোস্ট। শ্রীমঙ্গলের কোনো এক গ্রামে গুজব রটে যে, দেবাদিদেব শিবের ত্রিশূল নাকি ঢুকে পড়েছে মাটির গভীরে। রাত ১২টায় এই ত্রিশূল ব্লাস্ট হবে। কেঁপে উঠবে পৃথিবী। শুরু হবে ভয়াবহ ভূমিকম্প। শুরু হবে প্রলয়কাণ্ড। ধ্বংস হয়ে যাবে গোটা পৃথিবী। গুজবটা ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। জেগে ওঠে ঘুমন্ত মানুষজন। বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। জয়ধ্বনি দিতে থাকে ভগবান বিষ্ণুর নামে। এই বিপদে তিনিই একমাত্র সহায়।
সহসা আমার কাল নিয়ে সংশয় তৈরি হলো। আমি কোন কালের মানুষ? 888sport cricket BPL rate শতকের? এগারো শতকের? না তারও আগের? এই শতকের প্রথম দশকে, দেশ যখন প্রযুক্তির ডানায় ভর করে এক নবযাত্রা শুরু করল, যাকে বলা হলো ডিজিটাল যাত্রা, আমি ভেবেছিলাম এদেশ থেকে অশিক্ষার অন্ধকার বুঝি এবার নির্মূল হবে। সবকটি জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে, মানুষ এবার নিশ্চয়ই বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে উঠবে। কিন্তু না, কদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল উলটো চিত্র। প্রযুক্তির প্রদীপকে ঢেকে দিলো হাজার বছরের অন্ধকার। ফেসবুক ব্যবহার করে ছড়ানো হতে লাগল গুজব। গুজব ছড়িয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো রামু বৌদ্ধবিহার, হামলা চালানো হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু- অধ্যুষিত গ্রাম নাসিরনগরে। গুজব ছড়িয়ে ভোলার মানুষদের মাতিয়ে তোলা হলো ধ্বংসকাণ্ডে। আরো গুজব ছড়ানো হলো পদ্মা সেতু নিয়ে। জলদেবতাকে তুষ্ট করতে মানুষের মুণ্ডু কেটে নাকি নির্মাণাধীন সেতুর পিলারের গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মরতে লাগল মানুষ। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আরো কত গুজব যে ছড়ানো হলো তার কোনো শুমার নেই। ন্যানো ভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের কালেও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
আমার ঘুম আসে না। ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলাম। লিখলাম, উন্নয়ন করতে হলে মানুষের মননের উন্নয়নও করতে হবে। অর্থনীতি ও মনন, পাশাপাশি দুটোরই উন্নয়ন দরকার। এই দেশে দেখা দিয়েছে মননের ঘাটতি। এই ঘাটতি বহুকালের পুরনো। মাঝেমধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন ন্যানো ভাইরাসের এই দুর্যোগে প্রকট হয়ে উঠেছে। এই ঘাটতি কি আদৌ দূর হবে? কে দূর করবে? কোথাও তো কেউ নেই। কোথাও তো কোনো আলো নেই। যাদের আলো জ্বালাবার কথা তারা ‘সকলকে আলো দেবে মনে করে অগ্রসর হয়ে/ তবু কোথাও কোনো আলো নেই বলে ঘুমাতেছে।’
পোস্টটিতে মুহুর্মুহু লাইক পড়তে লাগল, কমেন্ট পড়তে লাগল, শেয়ার হতে লাগল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি পোস্টটিতে লাইক পড়েছে সাড়ে তিন হাজার, কমেন্ট প্রায় সাতশো, শেয়ার দেড় হাজার। আমার নিভুনিভু আশার প্রদীপটা জ্বলে উঠল। না, এখনো গোটা দেশ অন্ধকারে তলিয়ে যায়নি। আলো এখনো আছে। এখনো আলোর যাত্রীরা সরব আছে।
কেটে গেল পনেরো দিন। সেদিন দুপুরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দক্ষিণা বাতাস আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। একটা কুকুর লকলকে জিব বের করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কুকুরটাকে আমি চিনি। রাতভর এই পাড়া পাহারা দেয়। কাউকে সন্দেহ হলেই ডাকতে শুরু করে ঘেউ-ঘেউ। কদিন ধরে তার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম না। কোথায় ছিল কে জানে। হয়তো খাবারের সন্ধানে দূরে কোথাও গিয়েছিল। কোথাও কোনো খাবার না পেয়ে ফিরে এসেছে। শরীরটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আমার খুব মায়া হলো। ইচ্ছে হলো কিছু খাবার নিয়ে নিচে নেমে তাকে দিয়ে আসি। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে বের হওয়া কি ঠিক হবে? রাস্তার ময়লা-আবর্জনা থেকে আমিও তো ন্যানো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারি। তাছাড়া এ-ভাইরাস নাকি পশুপাখি থেকেও ছড়ায়। আমি সাহস পেলাম না। একটা পলিথিনের ঠোঙায় কিছু ভাত আর কিছু মাংস ছুড়ে দিলাম। কুকুরটা হুমড়ি খেয়ে খেতে শুরু করল। খাচ্ছে আর লেজ নাড়াচ্ছে। খাওয়া শেষ করে আমার দিকে তাকাল। তাকিয়ে রইল। আমি তার করুণ চোখ দুটোর দিকে তাকাই। দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বেঁচে থাকার আনন্দে সে কাঁদছে।
কুকুরটা আমাকে মনে করিয়ে দিলো এই শহরের ছিন্নমূল মানুষদের কথা, যাদের ঠিকানা ফুটপাত, ওভারব্রিজ, স্টেশন, যাত্রীছাউনি। যারা মানুষের দয়ায় বেঁচে থাকে। এখন তো শহরে মানুষ নেই, তারা কীভাবে বেঁচে আছে? সরকার কি খাবারের ব্যবস্থা করছে? করারই তো কথা। হয়তো করেনি। হয়তো উপোস থাকতে থাকতে তারা মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গেছে। হয়তো তারা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
আমি ভাবি এই শহরের শ্রমিকদের কথা, যারা রিকশা চালায়, ভ্যান চালায়, স্টেশনের বোঝা টানে, ফুটপাতে চা বেচে। তারা দিনমজুর। দিনে এনে দিনে খায়। এখন তাদের রুজি নেই, কীভাবে বেঁচে আছে তারা? আমি টিভিটা চালু করলাম। খবর শুরু হয়েছে। খবরে বলা হচ্ছে, দেশে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আমদানি-রফতানি আরো এক মাস বন্ধ থাকলেও বাজারে তার প্রভাব পড়বে না। অসাধু ব্যবসায়ীদের দ্রব্যমূল্য না বাড়াতে হুঁশিয়ার করেছে সরকার। নিম্ন আয়ের মানুষদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্রশাসন তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় খাবার।
কেটে গেল পঁচিশ দিন। খবরে শুনতে পাই শহরে লকডাউনের সময়সীমা বাড়িয়েছে সরকার। আরো এক মাস। আমি খুশি হই। আরো এক মাস অফিসে যেতে হবে না। তেইশটা বছর ধরে জীবিকার তাগিদে লড়তে লড়তে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। কখনো ভাবিনি রিটায়ারের আগে এমন দীর্ঘ ছুটি পাবো। কখনো ভাবিনি শহরটা যে কোনোদিন এভাবে লকডাউন করা হবে। ভালোই হলো। যেসব সিনেমা দেখব দেখব করেও দেখা হচ্ছিল না, যেসব বই পড়ব পড়ব করেও পড়া হচ্ছিল না, এই অখণ্ড অবসরে সব দেখে ফেলব, সব পড়ে ফেলব। জেমস আইভরি, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, স্টিফেন স্পিলবার্গ ও জাঁ-লুক গদারের কিছু ছবি ডাউনলোড করে রেখেছি, সেগুলো দেখে ফেলব। মহাভারতটা আরেকবার পড়ব। সেই কবে কিনেছিলাম শাহনামা! সময়ের অভাবে পড়া হয়ে ওঠেনি। এবার না পড়ে রাখছি না। বাসায় পর্যাপ্ত খাবার আছে। কিনেছিলাম এক মাসের খাবার। এখন মনে হচ্ছে দুই মাস চলে যাবে। টান পড়লে সরকারের হেল্পলাইনে কল করব। বাসায় পৌঁছে দেবে খাবার। না দিলেও চিন্তা নেই। চিড়া-মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারব। আমার অভ্যেস আছে। বেকারত্বের কালে কত দিন উপোস থেকেছি, কত দিন চা-মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি।
এক মাস পর, একদিন ভোরে কাকের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। জানালার ফাঁকে তাকিয়ে দেখে শত শত কাক ভিড় করেছে পাশের ভবনের ছাদে। এত কাক একসঙ্গে কখনো দেখিনি। ভোরের লাল সূর্য দেখে আমার ভেতরে হাহাকার জাগল। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল এক গভীর শূন্যতা। ইচ্ছে হলো বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। এই বন্দিদশা আর ভালো লাগছে না, অসহ্য হয়ে উঠেছে। এভাবে কি মানুষ বাঁচতে পারে? অসম্ভব। মানুষ ছাড়া সবকিছুই অর্থহীন। ঠিকই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ : যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ। ড্রইংরুমের দেয়ালে ঝোলানো তাঁর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে তাঁকে প্রণাম জানালাম। জীবনের কী গভীর সত্যই না তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন!
দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখার জন্য আমি নিউজপোর্টালগুলো দেখি। বেশিরভাগ মিডিয়া অফিস সরিয়ে নেওয়া হয়েছে শহরের বাইরে। সংবাদপত্রগুলোর প্রিন্ট ভার্সন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। চালু রাখা হয়েছে অনলাইন ভার্সন। প্রতিমুহূর্তে দেশের পরিস্থিতির আপডেট দিচ্ছে পোর্টালগুলো। স্বস্তির কথা, সারাদেশে যে গণসংক্রমণের শঙ্কা ছিল তা হয়নি। হয়তো ন্যানো ভাইরাস গ্রামীণ পরিবেশে টিকতে পারে না। আমি ঠিক জানি না। প্রকৃতির অনেক কিছুই আমরা জানি না। সরকার আশার বাণী শোনাচ্ছে, শিগগির এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। গরম পড়তে শুরু করেছে, রোদ তেতে উঠছে। চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ন্যানো ভাইরাস টিকতে পারবে না।
মনটা ভরে উঠল অনাবিল আনন্দে। মহামারি চলে গেলে আবার সচল হবে এই শহর। আবার জমে উঠবে ভাঙা হাট। আহা কতদিন হাজির বিরিয়ানি খাই না। কতদিন স্টারের কাবাব খাই না। কতদিন বারে যাই না। সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে। আবার গড়াতে শুরু করবে থমকে যাওয়া জীবনের চাকা।
এক মাস কুড়ি দিন পর এক মধ্যরাতে বৃষ্টি ও বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে, বিজলি চমকাচ্ছে, বজ্রপাত হচ্ছে। নিজেকে ময়ূর মনে হলো। পেখম মেলে দিতে ইচ্ছে করল। আহা বৃষ্টি! কতদিন বৃষ্টি দেখি না! এই শহরে কবে বৃষ্টি হয়েছিল আমি ভুলে গেছি। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নাকে ঝাপটা দিলো ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ। শুনতে পেলাম গগন মাঝির ডাক – ও শাকের, কনে যাও? জেগে উঠল শৈশব888sport sign up bonus। এমন ঘনঘোর বৃষ্টিতে কত ভিজেছি! ভিজতে ভিজতে কত মাছ ধরেছি, কত শাপলা-শালুক তুলেছি, কত হা-ডু-ডু-ফুটবল খেলেছি। আহা শৈশব! ফেলে আসা শৈশব! 888sport sign up bonusরা আমার মাথায় একসঙ্গে হানা দিলো। 888sport sign up bonusর সংবেদনে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমার দু-চোখেও ঝরতে লাগল অঝোর বৃষ্টি।
দু-মাস ফুরাতে আর মাত্র তিনদিন বাকি। সরকারের তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে লকডাউন শেষ হওয়ার আগে কেউ যেন শহরে না ঢোকে, কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয়। কিন্তু আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। বেরিয়ে পড়ার জন্য মনটা খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করছিল। সেদিন ভোরে বাধা-বারণ উপেক্ষা করে আমি বেরিয়ে পড়লাম। পাড়ার গলি ধরে হাঁটতে থাকি মেইন রোডের দিকে। কোথাও কোনো জনমানুষ নেই। ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। তুমুল বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে গেছে সমস্ত আবর্জনা। রাস্তার ধারে, বাড়ির আঙিনায় গজিয়েছে ছোট ছোট গাছ। বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, বুনোচেরি, মেন্ডা, পটপটি, শটি আর ভাঁটফুল। ভবনগুলোর দেয়ালের ফাঁকফোকরে গজিয়েছে লতাগুল্ম। কার্নিশে কার্নিশে ঝুলছে চড়ুইয়ের বাসা। কোনো কোনো বাড়ির গেটে, বারান্দায়, ছাদের কোনায় চাক বেঁধেছে মধুপোকা।
আমি নদীর দিকে হাঁটতে থাকি। দেখি একটা খরগোশের পেছনে ছুটছে একটা বাঘডাশা। দেখি ঢোঁড়া ছুটছে একটা ব্যাঙের পেছনে। একদল ঘাসফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা কালোমুখ হনুমান আমাকে দেখে ভেংচি কাটল। একদল সাদা বক আমাকে দেখে উড়াল দিলো। একদল শালিক আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। একটা গুইসাপ আমাকে দেখে সটকে পড়ল। ভোরের নবীন সূর্য আমাকে সম্ভাষণ জানাল।
আমি হাঁটতে থাকি। দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যাই নদীর তীরে। বাতাস আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমি বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলাম। কিন্তু নদীটা আমার কাছে অচেনা ঠেকল। এই নদীর এমন রূপ আমি কখনো দেখিনি। টলটলে স্বচ্ছ জল। যেন মিনারেল ওয়াটার। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে। ঘাই মারছে। দুই তীরে কাঁকড়া ও কাছিমের দল চরে বেড়াচ্ছে। ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদীর ঢেউ ধুয়ে দিচ্ছে আমার পা।
সহসা শুনতে পাই একতারার বোল। বেড়িবাঁধে দেখতে পাই এক বাউল। একতারা বাজিয়ে সে গাওয়া ধরে, এবার তোর মরাগাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী …।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.