লব্ধ ভিক্ষুকসমগ্র

মহীবুল আজিজ

শহরে হঠাৎই ভিক্ষুকহীনতা দেখা দিলে সাদি খুব বিপন্ন বোধ করতে লাগল, কারণ তার একশ একজন ভিক্ষুক দরকার। এখন একদিনে এত ভিক্ষুক সে কোথায় পায়! অথচ ভিক্ষুক না পেলে তার সমূহ সংকট। তার মায়ের মনোবাঞ্ছা থেকে যাবে অপূর্ণ এবং এর পরিণামে হয়তো তার এবং তাদের সকলের জীবনের ভবিতব্য হয়ে পড়বে কালগ্রস্থ। এমন অবলম্বনহীনতার বোধ সাদিকে কেবলই ঠেলে দিতে থাকে দুর্ভাবনার দিকে। সে তার চিত্রোন গাড়িটা নিয়ে বিখ্যাত চৌরাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হয় এবং চারপাশে ভিক্ষুকের সন্ধানে তার চোখকে একটি শক্তিশালী যন্ত্রের মতো স্থাপন করে যার সীমানায়

এসে দেখা দেবে প্রয়োজনীয় সম্ভাবনা। গাড়িটা একপাশে রেখে সে গাড়ির দরজা আটকে সেটার গা-ঘেঁষে এমনভাবে দাঁড়ায় যে, তা দেখে যে-কেউ তাকেই কালো রঙের চিত্রোন গাড়িটার মালিক ভাববে। শহরে এমন গাড়ি তেমন সুলভ নয়, সেটি সরাসরি ফ্রান্স থেকে আনা ফরাসি গাড়ি। কিন্তু গাড়ির আভিজাত্য তখন বিবেচ্য নয়, বরং সাদি অন্বেষণ করতে থাকে দেশের বিখ্যাত ভিক্ষুকদের।

অন্যদিনে এতক্ষণে সে এতটুকু সময়ের মধ্যেই নানারকম ভিক্ষুক-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠত। অন্ধ-পঙ্গু-আংশিক অন্ধ-আংশিক পঙ্গু বা একেবারে শক্ত-সমর্থ বলবান ইত্যাকার বিচিত্র ভিক্ষুক-দৃশ্যে ভরপুর হয়ে উঠত। সত্যি কথা বলতে কী, শহরে চলতে-ফিরতে গেলেই তার মনে হতো দেশে দিন-দিন ভিক্ষুকের 888sport free bet বেড়েই চলেছে। কিন্তু আজ প্রয়োজনমুহূর্তে সাদির মনে হলো, তার ভাবনাটা সেকেলে ও প্রাক্তন হয়ে যেতে চলেছে। তবে কি তার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক তৎপরতার ব্যস্ত অবকাশে দেশ ভেতরে ভেতরে ভিক্ষুকস্বল্পতার সমৃদ্ধি অর্জন করতে চলেছে! হ্যাঁ, একটা পরি888sport free betনের কথা তার মনে থাকে। কোথাও বলেছিল, দেশ আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে মধ্য আয়ের অবস্থানে পৌঁছে যাবে। তাহলে কি সে-অবস্থান আজই বাস্তবতার রূপ নিয়ে ফেলল, যখন তার ভিক্ষুক ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই। কিন্তু দেশের অধিকাংশ লোকও যদি মধ্য আয়ের অবস্থানে পৌঁছে যায়, তাও কি নিম্ন আয়ের লোকের এমন অভাব দেখা দিতে পারে! যতদূর চোখ যায়, দৃষ্টিকে পাঠিয়ে দেয় সাদি। হয়তো অবস্থাদৃষ্টে কাউকে-কাউকে তার ভিক্ষাবৃত্তির পেশাদারী মনে হয়; কিন্তু তার তো একটি-দুটিতে চলে না, তার চাই কম এবং অধিক পক্ষে একশ একজন ভিক্ষুক।

আজ বারো তারিখ, তার মানে পনেরো আসতে আর বাকি তিন দিন বা মাঝখানের দুই দিন। পনেরোতে তার বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তার মায়ের মনোবাঞ্ছা পনেরো তারিখে বাবুর্চি দিয়ে রান্না করে একশ একজন ভিক্ষুককে পরিতৃপ্তি-সহকারে খাওয়াতে হবে। সাদি যদিও জানে, মায়ের মনোবাঞ্ছার পেছনে আসলে মা নিজে দায়ী নয়, দায়ী তার পির মোর্শেদে বরহক পীরে কামেল সিরাজ শাহ। পিরের দ্বারা আদিষ্ট হলে শিষ্যার পক্ষে করণীয়কে  বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য গতি নেই। তাও আবার মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকী। নইলে সে বলতে পারত, এবার ভিন্ন আঙ্গিকে কিছু করো। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তার মনে হয়, দামি চিত্রোন গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থেকে এমন সন্ধানের কোনো অর্থ হয় না। তখন উদ্ভাবনী সাদিকে অনুপ্রাণিত করে এবং সে সেসব স্থানের কথা ভাবতে শুরু করে, যেখানে অকাতরে মিলবে আকাঙ্ক্ষিত ভিক্ষুক। যারা ভিক্ষা ছাড়া অন্য কাজ করে না। সে গাড়িতে আরোহণ করে এবং তখন তার মনে ভিড় করতে থাকে নানারকম ভিক্ষুক-888sport sign up bonus।

বেশ কয়েক বছর আগে বাবার সঙ্গে সে যাচ্ছিল জামে মসজিদের পাশ দিয়ে। মসজিদের গা-ঘেঁষে যাওয়া রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়ে দুটি সমান্তরাল রাস্তাকে আলিঙ্গন করে, সেখানে অপেক্ষাকৃত ঢালু রাস্তার মুখে ছাপড়ামতো একটা ঘরে একটা লোক বসে-বসে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে নিবিষ্টতার সঙ্গে। ছাপড়াটাকে ঘর বললে ঘরের অবমূল্যায়ন হয়। সেটা দশ ফুট বাই চার ফুটের একটা প্রকোষ্ঠ। দেখে বোঝা যায় না, ভেতরে ধর্মগ্রন্থ-পাঠ করা লোকটা আসলে কে বা কী তার পেশা। লোকটাকে দেখিয়ে বাবা বলেন, ওর নাম রিকশা-ফকির। শ্রম এবং একাগ্রতার সমন্বয়ে কী হতে পারে তার একটা জ্বলন্ত নজির সে। একসময়ে পেশাদার ভিক্ষুকই ছিল। একটি বিশেষ সীমাবদ্ধতার কারণে তার গতিবিধি ছিল খুব সীমিত। মসজিদের এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও তার সাধ্যে কুলাত না। তার দুটো পা-ই হাঁটুর নিচ থেকে আর নেই। সেই জায়গাটাতে বিশেষভাবে তৈরি দুটো গোলাকার রাবারের জুতো লাগিয়ে সে তার হাঁটার কাজ চালায় এবং খুব প্রয়োজন না হলে সে হাঁটে না। তার আরেকটা নাম ছিল হাঁটু-ফকির। ভিক্ষের অর্থ জমিয়ে সে ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খোলে এবং একদিন দেখা গেল হাঁটু-ফকির           দুটো রিকশার মালিক। রিকশাভাড়া বাবদও তার অনেকটা আয় হয়। একপর্যায়ে তার হাঁটু-ফকির  নামটা  পরবর্তীকালে  অর্জিত  রিকশা-ফকির নামের কাছে পর্যুদস্ত হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত তার রিকশা-ফকির নামটাই স্থায়ী রূপ নেয়। সবাই জানে, লোকটা ভিক্ষুক, তা সত্ত্বেও সে একদিক থেকে সম্পত্তির মালিকানাধারী। বাবার মুখে ঝরে পড়ত লোকটার জন্যে প্রশস্তি। তিনি বলতেন, দেশের সব ভিক্ষুক যদি তার মতো এমন শ্রমনিষ্ঠ ও লক্ষ্যমুখী হতো, তাহলে দেশে আর দারিদ্র্য থাকত না এবং দেশ ভরে উঠত ছোট ছোট মালিকশ্রেণিতে।

বাস্তবে সেটা ঘটে না। ঘটে না বলে সাদি একজন-দুজন নয়, একশ একজন ভিক্ষুকের সন্ধানে বের হতে পারে। রিকশা-ফকিরকে এখনো অবশ্য ফকিরই বলা চলে। হাত সে পাতে না বটে, কিন্তু দয়াপরবশ হয়ে কেউ তাকে সাহায্যের অর্থ দিয়ে গেলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে না। আরেকজন বিশেষ ধরনের ভিক্ষুকের কথা কোনোভাবেই ভুলতে পারে না সাদি। সে-ধরনটা তার বাবার এবং তার কারো জানা থাকত না, যদি সে সুদূর লংগদু না মাটিরাঙা থেকে তার আইনজীবী পিতার কাছে আসত মামলার কাজে। তার আদত বাড়ি হয়তো ভোলা বা হাতিয়া বা চর আলেকজান্ডার। এই শহরেই সে চষে বেড়ায় ভিক্ষাবৃত্তির কাজে, যদিও পার্বত্য অঞ্চলে সে ছোটখাটো একটি বাড়ি ও বাড়িসংলগ্ন ভিটের মালিক। সে একচোখ কানা-ভিক্ষুকের অভিনয় করলেও বস্ত্তত সে দুই চোখেই দেখতে পায়। কোনো এক সদাশয় সরকারের আমলে সে তার পিতৃনিবাসের নিঃস্বতার পটভূমি থেকে উন্মূল হয়ে লংগদু বা মাটিরাঙ্গায় গিয়ে সম্পন্ন গৃহস্থের পরিচয়ে বৃত হয়; কিন্তু সে তার পুরনো পেশা বিসর্জন দেয় না। বাবা অবশ্য বলতেন, রিকশা-ফকিরের তুলনায় এ-লোকটা অনেক ধড়িবাজ এবং প্রতারক। আবার এটাও তো সত্য, প্রতারণা করা এবং প্রতারিত হওয়া যে-দেশের লোকদের ঐতিহ্যের অন্তর্গত, তাদের কাছে বরং এমন ধড়িবাজি প্রশস্তিযোগ্য।

জায়গাটায় আসতে পেরে মনে-মনে নিজেকে ধন্যবাদ দেয় সাদি। এমন লোকারণ্য মাজারে সর্বদাই লোকের আনাগোনা এবং সেখানে ভিক্ষুকরাও 888sport free betয় নিতান্ত কম নয়। মাঝে মাঝে সাদির মনে হতো, শহরের এই আমানত শাহ মাজারের আশপাশটাই শহরের প্রায় সব ভিক্ষুকের কেন্দ্রস্থল। যেখানেই তারা থাকুক না কেন, মাজারের দিকে একবার না একবার তাদের আসতেই হয়। অথবা এখান থেকেই তারা দলে দলে ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিকে এবং ফিরেও আসে এখানেই। অবশ্য তখনই সাদির মনে পড়ে তাদের এলাকার বিখ্যাত ভিক্ষুক-বস্তির কথা। সেখানকার সকলেই ভিক্ষুক এবং তাদের একটি সমবায় সমিতিও আছে – ভিক্ষুক-সমিতি। তারা নিজ নিজ ভিক্ষা-আয়ের অর্থে টেলিভিশন কিনে সেটা সবাই মিলে উপভোগ করে। একটা নিয়ম তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে। ধরা যাক দশটি ভিক্ষুক পরিবারের একটি টিভি। একেকটি ভিক্ষুক-পরিবার একেক সপ্তাহে সেই টেলিভিশনের মালিকানা ভোগ করবে। তখন ইচ্ছা করলে অন্য পরিবারগুলির সদস্যরা সেই ক্ষণস্থায়ী টিভি-নিয়ন্ত্রিত পরিবারে এসে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবে। আকাশ-টিভির বিবিধ অনুষ্ঠানের তারা নিয়মিত দর্শক। জি-বাংলা, 888sport cricket BPL rateে বাংলা, সনি টিভি, তারা টিভি প্রভৃতি চ্যানেলের তারা নিয়মিত উপভোগকারী। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকেই সেসব টিভির নিয়মিত সিরিয়ালে পরের কিস্তিতে কী ঘটবে তা দেখার জন্য হন্যে হয়ে থাকে। এ নিয়ে একবার প্রবল বাদানুবাদের ঘটনাও ঘটে। রাতে একটা বাড়িতে জেয়াফতের খাবারের সুবন্দোবস্ত ছিল। কথিত ভিক্ষুক পরিবারটির কর্তা খেয়ে এসে তার মেয়ে আর বউকে বলল, যা তোরা খায়্যা আয় গিয়া। কিন্তু তারা প্রবল বাদ সাধে। কী, মীরাক্কেল না শেষ করে তারা কোনোভাবেই উঠবে না। এমনিতেই তাদের জীবনে হাসির উপলক্ষ ক্বচিৎ ঘটে। এমন বিনে পয়সায় প্রাণ খুলে হাসার উপলক্ষ ছেড়ে কে খায় জেয়াফতের খাবার! পরিবারের কর্তাটি নাছোড় এবং তদধীনস্থ সদস্যরা ততোধিক প্রবল। শেষে সেই কর্তা হাতের কাছে একটি দা পেয়ে বেমক্কা কোপ বসিয়ে দেয় মা-মেয়ের শরীরে। আর যায় কোথায়। দৌড়ে আসে থানা-পুলিশ। একপর্যায়ে সাদির আইনজীবী বাবা জড়িয়ে পড়ে সে-মামলা নিয়ে।  এভাবেই ভিক্ষুকদের অনেক কাহিনি সাদির অবগতিতে আসে। তবে মাজারের ভিক্ষুকদের দেখে মনে হয় না, তারা টিভি বা আকাশ-সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে আসক্ত। তাদের যাবতীয় ব্যস্ততা ভিক্ষাকে ঘিরে। এত এত লোক আসে-যায় মাজারে। দেখলেই মনে হয় যে, তারা বাড়ানো হাতের দিকে টাকা-পয়সা ছুড়ে দেওয়ার জন্য অত্যধিক ব্যগ্র। তারা হয়তো নিজ নিজ মনের সুপ্ত বাসনা পূর্তির লক্ষ্যেই মাজারটায় আসে, এসে নিঃস্বকে খানিকটা অর্থ দান করে পুণ্যতা-লাভের পরিতৃপ্তি অর্জন করে।

গাড়িটা একটু দূরে রেখে হেঁটে মাজারের গেটে যেতেই একটা ভালোলাগার বোধে স্পৃষ্ট হয় সাদি। এখানে অনেক ভিক্ষুক, একশ এক কেন গুনলে দু-তিনশোও হতে পারে। তাহলে শহরে ভিক্ষুকহীনতার তার কল্পিত সংকট হয়তো সত্য নয়। হতে পারে, শহরের প্রায় সব ভিক্ষুক কোনো একটি বিশেষ সময়ের জন্য একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হয়েছিল। সাদি ভেবে দেখল, শহরে কোনো মিটিং-মিছিলের উপলক্ষ নেই। থাকলে হঠাৎ ভিক্ষুকে টান পড়তে পারে। কারণ তারা মিটিংয়ে-মিছিলে গেলে একত্রে অনেকগুলো  টাকা পেয়ে যায় এবং কিছুটা সময়ের জন্য তারা মনে-মনে এমনই রাজনৈতিক হয়ে পড়ে যে খালি হাত তুলে ওপরঅলার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে তারা – আল��হ, মিটিং দে, মিছিল দে, মিটিং-মিছিল দে! তাদের মনে হতে থাকে যে, ভিক্ষার চেয়ে মিটিংয়ে-মিছিলে আয় বরং বেশি। যাক এ-কদিন শহরে সেরকম কোনো উপলক্ষ নেই। মাজারের গেটে প্রথমে খানিকটা সংশয়ে পড়ে সাদি। যারা মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে এবং নানা ভঙ্গিতে দৃশ্যমান তাদের তো ভিক্ষুক বলে চেনাই যায়। কিন্তু তার মনে হয়, আশপাশে হেঁটে যাওয়া লোকদের মধ্যেও ভিক্ষুকের পক্ষে থাকা সম্ভব। একটা লোককে তার পোশাকে-আশাকে পরিপূর্ণ ভিক্ষুক বলেই মনে হয়েছিল প্রথমটায় কিন্তু সাদি দেখল সেই লোক পকেট থেকে একটা দুই টাকার নোট বের করে বসে থাকা জনৈক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের থালায় রেখে দিলো। তখন অবশ্য সাদির মনে পড়ে তার বাবার কথা। তিনি বলতেন, মাজারে ভিক্ষুকদেরও নাকি এজেন্ট থাকে। তাদের কাজ হঠাৎ-হঠাৎ পকেট থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে ভিক্ষুকদের দেওয়া। এতে মাজারে আসা লোকদের মধ্যে একটা আপাত দানের প্রেরণা জাগে এবং তারাও নিজ নিজ পকেট থেকে মুক্তহস্তে দানের মহিমায় প্রণোদিত হতে থাকে। কৃপণ-অকৃপণ দুই ধরনের লোকই তো মাজারে আসে; কিন্তু এজেন্ট কথাটা সাদির বরং পছন্দ হয়। এজেন্টকে পেলে সে এখন তাকে গিয়ে কথাটা পাড়তে পারে। বলতে পারে যে, সামনের পনেরো তারিখে আমার একশ একজন ভিক্ষুক চাই। এজেন্ট যদি থেকে থাকেও, তাকে সে চিনবে কী করে! এজেন্টও কি ভিক্ষুক, নাকি তার দিন চলে সমবেত ভিক্ষুকের কাছ থেকে পাওয়া কর-জাতীয় উপার্জনে!

সাদির সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে হঠাৎ একটা লোক তরঙ্গ জাগিয়ে দেয় তার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে। পোশাকে লোকটা সাধারণ কিন্তু তাকেও প্রথম দফায় ভিক্ষুক মনে হলেও দোষের কিছু না। দ্বিতীয় চিন্তায় শুধু তার মাথার জরি-বসানো এবং কারচুপির কাজ-করা টুপি থেকে সে-ধারণার পরিবর্তন সম্ভব হলেও হতে পারে। সাদির ইতস্তত ভাব দেখেই হয়তো লোকটা তাকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারে কিংবা তারা আছেই এখানে মাজারে আসা লোকদের মনস্তত্ত্ব বিশে�ষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। সাদি বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, সময় বাঁচাতে বা ভারমুক্ত হতেই তার মনোবাঞ্ছার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলে লোকটা সাদিকে নিয়ে অদূরের টি-স্টলে এসে বসে এবং সে চায়ের অর্ডার দেয়। শুধু চা-ই। প্রথমেই সে সাদিকে এমন একটা প্রশ্ন করে বসে,   যেটিকে একদিক থেকে বলা চলে পেশাদার মনোবৃত্তির চূড়ান্ত, অন্য দিক থেকে অভিজ্ঞতার আলোকে জাত। চা তখনো তৈরি হয় ভেতরে। শুনে লোকটা সাদিকে প্রশ্ন করে, অাঁখনি দেবেন না কাচ্চি? সাদির সে-প্রশ্ন হৃদয়ঙ্গম না হলে সে একটু পুনর্বিন্যস্তভাবে একই প্রশ্ন করে, বাৎসরিকে ভিক্ষুকগো কী খাওয়াইবেন, অাঁখনি না কাচ্চি। সত্যি কথা বলতে কী, সাদির নিজেরও সে-প্রশ্নের উত্তর অজানা। খাওয়ার বন্দোবস্ত হবে, এটুকুই তার জানা; কিন্তু মেন্যু সম্পর্কে তখনো কোনো মাতৃআজ্ঞা সাদির কাঁধে বর্তায় না। তবু সে লোকটাকে গুরুত্ব দিয়ে বলে, বাৎসরিকের খাওয়া, বোঝেন-ই তো ভালো না হয়ে কি পারে!

এমন আলটপকা প্রশ্নের জন্য লোকটা অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু প্রশ্নটা না করলেও তার চলে না। কারণ সে মাজারের ভিক্ষুকমন্ডলীর নির্বাচিত প্রতিনিধি। কাজেই তাদের সুখ-দুঃখের  চিন্তা সে না করলে করবেটা কে! তারা যে মানুষকে বিশ্বেস করে না, তা নয়। অনেক সময় বিশ্বাস এমন ক্ষতিকর পরিণাম বয়ে আনে, যা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। ধরা যাক, একবার এক সওদাগরের মায়ের বাৎসরিকে ভিক্ষুকদের দাওয়াত দেওয়া হলো। ওরা ভেবেছিল, অাঁখনি বা কাচ্চি না দিয়েই যাবে না। কিন্তু শেষে কী দেখা গেল, সাদা ভাত আর গরুর মাংস। ভাত সরু চালেরই ছিল কিন্তু যে-সময়টুকুতে তারা ওই একথালা ভাত-মাংসের জন্য বসে থাকল, সে-সময়টুকুতে তাদের ক্ষতি হলো জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা। কীভাবে! তারা তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে গেল অন্য ভিক্ষুকদের কাছে এবং সেই ভিক্ষুকরা তাদের ছেড়ে যাওয়া জায়গায় বসে-বসে একেকজন আয় করল গড়ে ষাট টাকা করে, যার মধ্যে তারা কমিশন হিসেবে পেয়েছিল মাত্র দশটি টাকা। কাজেই ব্যাপারটার পূর্ব-নিষ্পত্তি সবদিক থেকেই মঙ্গলজনক। সাদির কাছে লোকটার কথা অযৌক্তিক বলে মনে হয় না। কারণ তাকে তখন নিজের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষুক-দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করতে হয়।

লোকটা সাদিকে তার পুরো পরিকল্পনা জানিয়ে দেয়। পনেরো তারিখে একশ একজন ভিক্ষুকই গিয়ে হাজির হবে। তাদের মাজার থেকে যাওয়া এবং মাজারে ফিরে আসার খরচ সাদির। খাবার হিসেবে থাকবে অাঁখনি অথবা কাচ্চি এবং আসার সময় তাদের প্রত্যেককে একশ টাকা করে সম্মানী দিতে হবে। যেহেতু বর্তমানে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে, সেহেতু একশ টাকাই তাদের পাওনা হিসেবে ধার্য। কেননা, বাৎসরিক খাওয়ার জন্য না গিয়ে তারা তাদের জায়গায় বসে থাকলে, বসে ‘কিছু দ্যান গো’, ‘কিছু দ্যান গো’ না বললেও তাদের উপার্জন হবে গড়ে একশ টাকার বেশি। সাদি বলতে পারত, এমনও  তো  হতে পারে, লোকে সেদিন তেমন ভিক্ষাই দিলো না! প্রস্তাবটা দ্রুত একবার মনের মধ্যে নেড়েচেড়ে দেখে এবং কাল্পনিক একটি ক্যালকুলেটরে ব্যয়ের হিসাব করে নিয়ে সাদি ভাবল, দেখি আরেকটু খোঁজ করে, ভিক্ষুকের এলাকাতেই যখন এসে পড়েছি। বিদায় নিয়ে সাদি এবার যায় অদূরে আরেকটি মাজারে, বদর শাহ মাজার। এটি শাহ আমানত শাহ মাজারের মতো বিশাল না হলেও এর আশপাশেও অনেক ভিক্ষুক চোখে পড়ে। মনে মনে এখানেও সে একজন এজেন্টের প্রত্যাশা করে; কিন্তু পূর্ববর্তী অধ্যায়ের মতো এমন কারো দেখা সহজে মেলে না যে, দেখেই দূর থেকে তাকে বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে বলবে, কী ব্যাপার স্যার?

গেটের একপাশে একটা বিশালাকৃতির তালাবদ্ধ ট্রাংক নিয়ে বসে আছে একটা টুপি-দাড়িঅলা লোক। মুখোমুখি হতেই সে সাদিকে লক্ষ করে বলতে থাকে – দ্যান, দ্যান, মনের ইচ্ছা পূরণ হবে, বালা-মুসিবত দূর হবে। এক টাকায় সত্তর টাকার সোয়াব হবে। সাদির মনে তখনকার মতো অপূর্ণ থাকা কোনো ইচ্ছের কথা মনে না পড়লেও সে পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে ট্রাংকের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে ফেলে দেয়। পাশেই একজন মোমবাতি-বিক্রেতা আসীন। মুহূর্তেই বায়ু বিদীর্ণ করে এক বোরখাবৃতার চিৎকার শোনা গেলে সাদি পেছনে তাকিয়ে দেখে, বোরখাবৃতার শিশুপুত্র হাত থেকে সদ্য কেনা বড় একটি মোমবাতি ভুলক্রমে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। এখন ভেঙে যাওয়া মোমবাতি পিরের দরগায় দেওয়া নিষেধ। কাজেই বোরখাবৃতার অর্থশোককে অন্যায্য বলা মুশকিল। সে আরেকটি মোমবাতি কেনে এবং ছেলেকে এই বলে ধমক দেয়, পকটৎ রাকি দে, কারেন্ট গেলে জালাইৎ পারিবি। সাদি মোমবাতিঅলাকে ইত্যবসরে তার পরিকল্পনার কথা জানায় এবং শুনে মোমবাতিঅলা খানিকটা চড়া স্বরে ‘এয়াকুব’ ‘এয়াকুব’ বলে ডাক দিলে মাঝবয়েসি এক লোক এসে দাঁড়ায় সন্নিকটে। চায়ের দোকান একটু দূরে, সিঁড়ি ভেঙে অনেকটা নিচে নেমে যেতে হয়। এয়াকুব বলে কথিত লোকটাও চায়ের প্রসঙ্গ তোলে না। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই তারা কথা বলে। সামনেই সারি বেঁধে বসে রয়েছে নানা বয়সের নানা কিসিমের ভিক্ষুক।

এরইমধ্যে অভিজ্ঞতার আলোকে সাদি বুঝতে পেরেছে, দেশে বর্তমানে একটি পেশাদার ভিক্ষুক-শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারা সময়, স্থান এবং পাত্রের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। তারা তাদের পেশার ওপর গভীরভাবে আস্থাশীল এবং পেশাটাকে কী করে আরো উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় সে-বিষয়ে তারা ভাবিত। নিজেদের সংঘবদ্ধতাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতেও তাদের নিরন্তর সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়। ভিক্ষুকদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠনই তার প্রমাণ। তাছাড়া নানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভিক্ষুক সমবায় সমিতির কথা তো সকলেরই জানা। এয়াকুবের কথায়ও সেই পেশাদারী মনোভাবের সম্যক পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠল। সাদির মনে সেজন্য বরং প্রশংসার ভাবই জেগে ওঠে। কেননা, নিজের কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা না থাকলে ভিক্ষুক কেন, কারো পক্ষেই উন্নতি করা সম্ভব নয় এমন প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা কঠিন দুনিয়ায়। তবে শাহ আমানত শাহর দরগাহ এলাকার চাইতে বদর শাহ দরগাহ এলাকার চাহিদাকে তার অনেকটা সহনীয় মনে হয়। সাদি অবশ্য এখানে চাইলে একটা শ্রেণিকরণের চিন্তাকে মনে ঠাঁই দিতে পারতো, কিন্তু তার হাতে সময় বড় কম। সে জানে, এখন গিয়ে পুরো ব্যাপারটা মাকে সবিস্তারে বলে কোনো লাভ নেই। মাকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অনুরোধ করারও কোনো অর্থ হয় না। যা-ই সে বলুক – মা বলবে, অ পুত, অাঁই এত হিসাব-কিতাব ন বুঝি। অাঁই যিয়ান বুঝি হিয়ান অইল্দে পন্দরো তারিখ অাঁর বাসাত্ একশো উগ্গা ফইররে খানা দ’ন পরিবো! কাজেই বদর শাহ দরগাহর এয়াকুবের প্রস্তাবটিকেই বাস্তবে রূপ দেওয়ার সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখে সাদি। এয়াকুবের জিজ্ঞাসার পরিধি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ হলেও একেবারে অধর্তব্য নয়। প্রথমেই সে জানতে চায়, খাবার কি বড়-বড় ডেকচিতে রান্না করে অকুস্থলেই খাওয়ানো হবে, না প্যাকেটে করে বিতরণ করা হবে। তাছাড়া একশ একজন ভিক্ষুকের প্রত্যেককে একশ নয় পঞ্চাশ টাকা করে দিলেই চলবে। এয়াকুব ভনিতা যোগ করে – দ্যাখেন আপনারা হলেন ড’র মানুষ, ফকির খাইয়ে পুণ্য অর্জন করে বেহেশতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবেন আর এই গরিবেরা জানেই না যে, তারা কোথায় যাবে, বেহেশতে না দোজখে। কাজেই এই সুযোগে তাদের অন্তত বেঁচে থাকার জন্যও যদি খানিকটা আর্থিক সাহায্য না করেন, তারা যাবে কোথায়! একটা ব্যাপারে অবশ্য আগের ও পরের দুই জায়গার চাহিদাই সমান – ভিক্ষুকদের আসা-যাওয়ার পরিবহন খরচ সাদিকেই বহন করতে হবে। সাদি দেখল এয়াকুবের প্রস্তাবটা বরং মেনে নেওয়া যায়। তিনশো টাকা অগ্রিম দিয়ে সে তার চিত্রোন গাড়িতে এসে বেশ নির্ভার হয়ে বসে। মাতৃআজ্ঞা পালনের তৃপ্তি তার মনে প্রশান্তি আনে। আর মাঝখানের দুদিন পেরোলেই তার বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন চিরদিনের জন্যে।

আসে পনেরো তারিখ। ‘শান্তির নীড়’ সন্নিহিত পুরো এলাকায় অচিরেই ভক্ষ্য হবে – এমন সুস্বাদ খাবারের ঘ্রাণ বাতাসে বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়তে থাকলেও এলাকাবাসীর মনে  উৎসব-উৎসব আমেজের পরিবর্তে এক ধরনের করুণামিশ্রিত আবেগ দেখা দেয়। তারা জানে, সে-ঘ্রাণের পেছনে রয়েছে মৃত্যুর ইতিহাস। কাজেই তারা মনে মনে সাদির আইনজীবী পিতার জন্য মমতা বোধ করে। তারা নিজেরাও ভাবতে থাকে যে, তারাও একদিন তারই মতো অন্য লোকের বাসিন্দা হয়ে যাবে এবং তখন তাদের সন্তানরাও হয়তো এমনই খাবারের আয়োজন করবে। খাদ্যের আয়োজন সবসময়ই যে উপভোগের নয়, ত্যাগেরও সেটা ভেবে তারা মুহূর্তের জন্যে মৃত্যুচিন্তায় প্রণোদিত হয়ে পড়ে। ‘শান্তির নীড়ে’ তখন চলছে মৃত্যুচিহ্নিত ব্যস্ততা। বাজার থেকে কেনা গরুর মাংস চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ডেকচিতে। যত্ন করে ধোয়া সরু চালের জল ঝরানো হয়ে গেছে। নতুন কেনা ঝুড়িপূর্ণ চাল যে-কোনো মুহূর্তে এসে মিলিত হবে মাংসের সঙ্গে। প্রয়োজনীয় তেল-মসলা, গরমমসলা আর কাটা পেঁয়াজের সম্ভার দেখে অনভিজ্ঞ লোকদের মনে হতে পারে, সেটি আসলে মৃত্যুর নয় অন্য কোনো উপলক্ষের হেতু। একটু পরেই সবটা আয়োজন পরিসমাপ্ত হলে যে-কারো পক্ষেই ঘ্রাণ বুঝে অনুমান করা সম্ভব হবে, কোনটি প্রাক আর কোনটি উত্তর-রন্ধনকালীন ঘ্রাণ। সাদির মা সকাল থেকেই জায়নামাজে পরিব্যাপ্ত। বাড়ির প্রশস্ত আঙিনাজুড়ে টানানো হয়েছে ক্যানভাসের মেরাপ, যাতে আচমকা বৃষ্টি হলেও সমবেত ভিক্ষুকদল বিপদে না পড়ে।

তখনো সূর্য মাথার ঠিক ওপরে আসে কি আসে না। দোতলার বারান্দায় বসে সাদি তার বাবার জীবনের নানা বৃত্তান্ত ছুঁয়ে-ছেনে দেখছিল বিভিন্ন সময়ে তোলা তাঁর অসংখ্য ফটোগ্রাফ সামনে রেখে। ছবিগুলো কালানুক্রমিকভাবে সাজানো হয়েছে অনেকগুলি অ্যালবামে। দারুণ স্মার্ট ছিলেন ভদ্রলোক। মনে-মনে ভাবে সাদি। চট্টগ্রাম থেকে 888sport app হাইকোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে কোনো মামলায় লড়তে গেলে অবশ্যই মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সারের স্যুট-টাই পরতেন। পায়ে থাকত স্যাক্সন কি হাস পাপির ইতালি বা পর্তুগালের চামড়ার জুতো। বাবার ছবি-সংবলিত জীবনীতে সে এমনই বুঁদ হয়ে থাকে যে, গেটে এসে একটা ট্রাক হর্ন দিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে থেমে গেলেও তার খবর পেতে অনেকটাই সময় লেগে যায়। সংবিৎ ফিরলে সে বুঝতে পারে, ট্রাকটির গন্তব্য শান্তির নীড়ই। ততক্ষণে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে বদর শাহ দরগাহর ভিক্ষুক-প্রতিনিধি এয়াকুব। এদিকে ওপর থেকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সমবেত ভিক্ষুকরাও লাফ দিয়ে একে-একে নেমে পড়ছে অত্যন্ত শৃঙ্খলাসহকারে। কেউ কারো গায়ের ওপর পড়ছে না, যদিও তারা সবাই ওপর থেকেই পড়ছিল খানিকটা নিচের দিকে। কারো হাতে লাঠি থাকে জরুরি মুহূর্তের আবশ্যিকতায়, কারো বা কাঁধে থলে, কেউ-কেউ সঙ্গে নিয়ে এসেছে থালাবাসন। হয়তো তারা খেয়েও যাবে, নিয়েও যাবে। অথবা তারা খাবে না, নিয়েই যাবে শুধু। কিংবা অন্যত্রও তাদের এমন আয়োজনের দায় থাকা সম্ভব। হতে পারে না, একই দিনে তো অনেক মানুষ একসঙ্গে প্রাণত্যাগ করতে পারে এবং সকলেই চায় মৃত্যুর সঠিক দিনটিতেই বাৎসরিকের আয়োজন করতে।

সাদি যখন নিচে নেমে আসে, ততক্ষণে ট্রাক পরিপূর্ণভাবে শূন্য হয়ে যায় এবং সাদি একটা আনুমানিক হিসাবে বুঝতে পারে যে, ভিক্ষুুকের 888sport free bet একশ একজন না হলেও তার কাছাকাছি। কিন্তু সাদি বুঝতে পারে না, কেন এয়াকুব ভিক্ষুক-পরিবহনের জন্য এমন সাতটনি ট্রাকের ব্যবস্থা করে। সে বলেছিল বটে, আনা-নেওয়ার খরচ তারই। তাই বলে দেশের আন্তঃজেলা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ট্রাকই সে নিয়ে আসবে! সম্ভাষণের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই এয়াকুব সাদিকে জানায়, এক ট্রাকে সবাইকে আনা যায়নি, আরো আসছে। আসে তারা অচিরেই। অল্পক্ষণের মধ্যে একে-একে রিবশা-ভ্যানগাড়ি-টেম্পো প্রভৃতি বাহনে চড়ে ভিক্ষুকরা এসে পড়ে। দেখে সাদির মনে হয়, পদব্রজেও আসে ভিক্ষুকরা। তখন ঠিক বোঝা যায় না, তারা এয়াকুবের মারফত আসা ভিক্ষুক নাকি রবাহূত। মনে হওয়ার কারণ, কোনো যানবাহনকে অকুস্থলে থামতে দেখা না গেলেও অবিরল ভিক্ষুকপ্রবাহ থাকে অব্যাহত। একশ একজন ভিক্ষুককে একসঙ্গে দেখলে এমন মিছিল-মিছিল ভাব মনে হতেই পারে; কিন্তু আদতে কি তারা একশ একজনই! পরিস্থিতির কথা মনে রেখে একশ কুড়িজনের খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন একসঙ্গে একশ একজনকে দেখে তবু সাদির মনে হয় গুনে দেখলে হয়তো তা দেড়শো ছাড়িয়ে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে সাদি আগে কখনো পড়েনি। বাবার মৃত্যুর বাৎসরিকের প্রয়োজন না পড়লে সে-অভিজ্ঞতাও তার কবে হতো কে জানে। তখন এয়াকুবের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলবার ফুরসতে সাদির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। একটা গোনা দিলেই তো বোঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে জমায়েত হওয়া ভিক্ষুকরা 888sport free betয় একশ এক কিনা। কাজেই সে চোখের দৃষ্টি তাক করে সমবেত ভিক্ষুকমন্ডলীর দিকে।

দৃষ্টি সে তাক করে বটে। করে এক-দুই-তিন-চার গুনে তার ঠোঁটকে যথাসম্ভব সোচ্চার না করে। দশ পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই সে আসছিল। হঠাৎ মাঝপথে বাধা পড়ে এয়াকুবের, বুঝলেন, ভোরবেলা উইঠ্যা আবার সবটিরে কনফাম করলাম। আচ্ছা আচ্ছা বলে আবার সাদি শুরু করে। তখন সে দেখতে পায় দশের আওতায় এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দুজন ভিক্ষুক কী সক্রিয়তায় কে জানে হাঁটতে-হাঁটতে আরেকদিকে চলে যায়, যেখানে সাদির এগারো  থেকে শুরু করার কথা। ঠিক আছে এমন কী সমস্যা – ভেবে এগারো থেকে দুই বিয়োগ দিয়ে সাদি একটু পেছনে গিয়ে শুরু করে নয় থেকে। এয়াকুব তখন একটু সময়ের জন্য নীরব হয়ে পড়ে। সে কি কোনো বিশেষ কারণে এই নীরবতা পালন করে। সে কি সাদির মনোভাবকে তার নিজের ভাষায় 888sport app download apk latest version করবার চেষ্টা করে। হতে পারে, আবার না-ও তো হতে পারে। ঠিক তখন বলা নেই, কওয়া নেই গুনে ফেলা ও গুনতে শুরু করা এ দুই দলের মধ্যে কোনো একটা কারণে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। কথা কাটাকাটি হয়তো হাতাহাতিতেই পরিণত হতো কিন্তু শৃঙ্খলা তাদের মধ্যেও দুর্লভ নয় একেবারে। তাদের মধ্যে একটু মাঝবয়েসি একজন এগিয়ে গিয়ে কলহকারীদের কড়া ধমক লাগায় এবং তাতে তারা সম্পূর্ণ চুপ হয়ে যায়। তারপর বেশ একটা তৃপ্তিকর শান্তি-শান্তি ভাব বিরাজিত হতে শুরু করে। কিন্তু সাদির সমস্যার তাতে সুরাহা হয় না। সে খেই হারায়, সেটা তো জানা কথাই। উদূভত কলহপরায়ণতার ফলে আকস্মিক যে এলোমেলো অবিন্যস্ততার উদ্ভব ঘটে, তাকে আরো ঘনীভূত করে তোলে ভিক্ষুকদের চলমানতা। একশ একজনের মধ্যে অন্তত গোটাতিরিশেক লোককে পাওয়া যাবে, যারা অকারণে তাদের চলাচল বজায় রাখে। আবার তাদের মধ্যে কেউ-কেউ থেমে পড়ে তো কেউ-কেউ চলিষ্ণু হয়ে ওঠে। সাদি ভাবে এবং ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেয়, এটা হয়তো একটা সাময়িক ব্যাপার মাত্র। নিশ্চয়ই অচিরে সমাপ্তি ঘটবে এ-চলাচলের। এটা হয়তো তার একটা ধৈর্যেরই পরীক্ষা-পর্ব। বাবার বাৎসরিক উপলক্ষে মাতৃআজ্ঞা পালনের জন্যে একশ একজন ভিক্ষুককে খাওয়ানোর এমন একটা আয়োজনে নিশ্চয়ই তাকে ধীরস্থির থাকতে হবে। ভাগ্যিস, মায়ের পির একশ একজন 888sport free bet বেঁধে দিয়েছিলেন। যদি তা হতো তার পরিবর্তে দুশো এক বা তারও অধিক, তাহলে সে সাদিকে তা সামাল দিতে হতো না। মাথা ঠান্ডা রেখে, এয়াকুবের কণ্ঠক্ষেপকে একটুও গায়ে না মেখে, কোলাহলকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে সে ফের গুনতে শুরু করে – এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…।

তখন বয়সে লঘু হওয়ার কারণে কোনো কিশোর ভিক্ষুক অত্যধিক চপলতার সঙ্গে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে একদিক থেকে আরেকদিকে ছুট লাগালেও অসীম ধৈর্যসহকারে সাদির চোখও তার পিছু-পিছু ছোটে এবং সেই কিশোর যখন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে স্থির হয়, সাদি মুহূর্তেই তাকে বন্দি করে তার পিঠে একটি কল্পিত ‘ছয়’ এঁকে দেয়। দিয়ে সে সাত নম্বর ভিক্ষুকের দিকে মনোযোগী হয়।