লালন সাঁই : প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ

লালন সাঁই :

প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ

আবুল আহসান চৌধুরী

সূচীপত্র

ফেব্রুয়ারি, ২০০৪

দাম : ১৫০ টাকা

প্রায় নিঃশব্দেই আমাদের দেশের লোকজ চিন্তার জগৎ বিকাশের সোপানশীর্ষে ওঠে অষ্টাদশ শতাব্দীতে। তখন একদিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চলছে এবং সেই শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনো সরাসরি বিরোধিতায় না গিয়ে বাঙালির মনোজগৎ আধুনিক করে তোলার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩), রাধাকান্ত দেব (১৭৮৩-১৮৬৭), ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১), বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩), বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) প্রমুখ চিন্তার জগতে ঝড় তোলা নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা। এর অন্যপিঠে সাধারণ জনতার মনস্তাপ যেন হঠাৎ করেই প্রকাশ পেয়েছিল সিপাহী মঙ্গল পাণ্ডের প্রতিবাদ থেকে সৃষ্ট সর্বস্তর ছুঁয়ে যাওয়া ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের ভেতর দিয়ে। এর উত্তাপ থেকে নিশ্চয়ই আমাদের এই চিন্তাবিদরাও দূরে ছিলেন না; কিন্তু সমাজ-মননকে তাঁরা উর্বর করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক কোনো বিদ্রোহের পথে পা না বাড়িয়েই সমগ্র ভারতবর্ষের সামাজিক চিন্তার গতিধারা পরিবর্তন করে। এ-সবই ছিল শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তা-প্রচেষ্টা। আমাদের অন্ত্যজ বাঙালিরা ছিল এসব চিন্তা ও ভাবনার দোলাচল থেকে অনেক দূরে। এই অন্ত্যজ বাঙালির লোকজ চিন্তাধারা গঠন ও বিকাশের একটি তাত্ত্বিক রূপরেখা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম অন্যতম 888sport live footballিক ও সমাজতাত্ত্বিক আবু জাফর শামসুদ্দিনের 888sport liveের মধ্যে। যে বাংলা ভাষাকে হাতের নাগালে নিয়ে ১৯৫২-র পর বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকশিত হলো, মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে গেল, সেই বাংলা ভাষাকে যে আসলে একদা এই অন্ত্যজ বাঙালিরাই রক্ষা করেছিল ‘বনেদি’ ভাষা সংস্কৃত, উর্দু, হিন্দি আর ফারসির দাপট থেকে, তা-ও তিনি আলোচনা করেছিলেন প্রসঙ্গক্রমে। বোধকরি, লোকজ চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার এই রূপকেই পরিণতভাবে সংরক্ষণ করেন সাধক-কবি লালন। দিন যত যাচ্ছে তাঁর চিন্তার দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির প্রভা আরো বিচ্ছুরিত হচ্ছে এবং তিনি ক্রমেই বন্দি হচ্ছেন এলিট শ্রেণির গবেষণা ও আলোচনার বৃত্তের মধ্যে।

লালনের সেই সময়কে আমরা এখন আর খুঁজে পাব না। তিনি একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে স্বকীয় চিন্তা নিয়ে উঠে এসেছিলেন এবং তাঁর চিন্তা প্রকাশ পেয়েছিল বিভিন্ন গানের ভেতর দিয়ে। এখন ভিন্ন একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে কোনো মানসসাধনা ছাড়া কেবল লালনের সংগীতচর্চার মধ্য দিয়ে তাঁর অনুসারীরা আদৌ টিকে থাকতে পারবেন কি-না, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। তাঁর কুষ্টিয়ার মাজার ও অনুসারীদের নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে যেসব ঘটনা ঘটে গেল স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন অবধি, তাতে এ-ব্যাপারে আশান্বিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের আশান্বিত হওয়ার দিকটি হলো, এই লোকজ অন্ত্যজ বাঙালির ভাবজগৎ আর চিন্তাধারার গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে লালনের বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে।

মূলত এই লালন সাঁইকে নিয়েই প্রকাশ পেয়েছে অতি সম্প্রতি আবুল আহসান চৌধুরীর বই লালন সাঁই : প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ। লালনকে নিয়ে তিনি কাজ করছেন অনেক বছর ধরে। এমন অনেক দু®প্রাপ্য লেখাও তিনি উদ্ধার করেছেন যা লালনগবেষণায় অপরিহার্য। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘লালন সাঁই আমার সারস্বত-সাধনার প্রধান প্রসঙ্গ।’ সারস্বত-সাধনার কারণেই লালনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে আর সেগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও ছাপা হয়েছে। কোনো কোনো লেখা এখনো বইভুক্তই হয়নি। ২০০৪-এর বইমেলায় প্রকাশিত এ-বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বই ও পত্রিকা থেকে নির্বাচিত কিছু লেখা। লেখাগুলোর বিষয়বস্তু মূলত লালন ও বাউল সম্প্রদায়। আর এদের নিয়ে আলোচনাকে আরো উর্বর করার লক্ষ্যেই উঠে এসেছেন আরো কয়েকজন ব্যক্তিত্ব কাঙাল হরিনাথ, রবীন্দ্রনাথ, পাগলা কানাই, মীর মশাররফ হোসেন, হাসন রাজা আর ফকির মহিন শাহ। ফকির মহিন শাহের বিভিন্ন সংগীতে আমরা পুনরায় পাই বাউলদের সমকালীন সামাজিক-রাজনীতিক মনস্তাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা, কিন্তু তা অন্তর্গত হতে পারে না শেষাবধি।

তবে লালন সাঁই তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতকে এত বেশি অন্তর্গত করে নিতে পেরেছিলেন যে, এটি বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বাউলদের মধ্যে কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল চিন্তাচিন্তনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছানো যে-পর্যায়কে বলা যাবে বিকাশের সর্বোচ্চ পর্যায়। আবুল আহসান চৌধুরী লালনের সমাজমনস্কতা তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তাঁর ‘লালন সাঁই : সমাজমনস্ক এক সাধক কবি’ শীর্ষক আলোচনায়, পাশাপাশি ‘লালন-বিরোধী সামাজিক প্রতিক্রিয়া’য় তুলে এনেছেন তাঁর চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আমাদের প্রচল সামাজিকতার বিরোধ। এই সমাজমনস্কতার সঙ্গে তখনকার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতকে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, লালন কত দূরের পথিক ছিলেন। লালনের সময়েই সংঘটিত হয় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, যদিও এই বিদ্রোহে তিনি কীভাবে ও কতটুকু সূত্রবদ্ধ ছিলেন তা আমাদের জানার উপায় নেই। লালনের বাড়ি ছিল কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে এবং কুষ্টিয়ার সঙ্গে পাবনার যোগাযোগ ছিল খুবই নিবিড়, পদ্মার এপার-ওপার যাতায়াত ছিল প্রতিদিনের ব্যাপার। কিন্তু লালনের জীবদ্দশাতেই সংঘটিত পাবনা-সিরাজগঞ্জ কৃষক-বিদ্রোহ লালনকে কতটুকু আলোড়িত করেছিল তা আমাদের বোঝার উপায় নেই। যদিও এ-রকম জানা যায়, লালন-অনুসারীরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন নদী পেরিয়ে পাবনা জেলায়। তাছাড়া বাউল সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নেমে এলেও অনেকে ঠাঁই নেয় সেখানে। এইসব ঘটনায় তিনি যে আলোড়িত হবেন তা তো খুবই স্বাভাবিক। কাঙাল হরিনাথকে যখন জমিদার-সামন্ত শ্রেণি থেকে হুমকি দেওয়া হয়, তখন তিনি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান, জমিদারের লাঠিয়ালদের প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নেন লালন-অনুসারীরা। তাই মহাবিদ্রোহ আর সিরাজগঞ্জের কৃষক-বিদ্রোহও নিশ্চয়ই লালনের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু এসব ঘটনা আমরা তাঁর গানের বহিরাঙ্গে খুঁজে পাই না। রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেয়েও সামাজিক পরিবর্তনকে তিনি জরুরি করে দেখেন এবং তাঁর গান খুঁজে নেয় এমন সব বিষয়-আশয়, যা কেবল রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত হয় না, অনেক সময়ে বরং আরো জটিল হয় এবং সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, অন্তরের অন্তরতর উদ্বোধন ঘটিয়েই কেবল যার সমাধান হতে পারে।

আবুল আহসান চৌধুরী লালনের এই সমাজমনস্কতাকে সংগত কারণেই অনেক বড় করে দেখেছেন। লালন যে ‘ধর্ম-সমন্বয়, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, জাতিভেদ ও ছুঁৎমার্গের প্রতি ঘৃণা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা’র মধ্য দিয়ে লোকজসমাজকে প্রস্তুত করেন সমতার বোধে তা তিনি লালনের বিভিন্ন গানের পঙ্ক্তি তুলে ধরেছেন। লালনের এই মনোভঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। তাই তাঁরা লালনের সময় থেকেই অবিরাম তাঁর বিরোধিতা করে আসছে। তিনি কোনো রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, বিদ্রোহের সংগঠক ছিলেন না, কিন্তু তাঁকে নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা মানুষেরা। কেননা এসব সাম্প্রদায়িক শক্তির জানা ছিল, লালনের ভাবাদর্শ সম্প্রসারিত হলে ধর্ম নিয়ে রাজনীতিচর্চার কোনো অবকাশই পাবে না তাঁরা। লালনকে যেতে হয় তাই এক বিরুদ্ধ সামাজিক স্রোতের মধ্য দিয়ে। সমকাল ছাপিয়ে এত গ্রহণযোগ্যতার পরও সেই বিরুদ্ধস্রোত ঠেলে যেতে হচ্ছে তাঁকে।

লালনবিরোধিতার ধারা সৃষ্টি হয় মূলত তাঁর জাতপাতধর্মবিরোধী বক্তব্যের কারণে। আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার-আন্দোলনের ফলে এঁদের প্রতি অত্যাচার-নিগ্রহ

বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাউলসম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হয়ে পড়ে। হাজী শরীয়তুল্লাহ্ (১৭৮০-১৮৪৯), তিতুমীর (১৭৮২- ১৮৩১), কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০-১৮৭৩), দুদ্দু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী (১৮৬৭-১৯২৩) প্রমুখ ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকের উদ্যোগ-প্রচেষ্টায় বাউলমতের প্রভাব-প্রসার খর্ব-ক্ষুণ্ন হয়।’ তবে এঁদের ভূমিকার সঙ্গে লালনের বিরোধিতার দিক নিয়ে লেখাটিতে তিনি বিস্তারিত কোনো আলোচনা করেননি। কেবলমাত্র ‘ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার-আন্দোলন’ই যদি লালনের বিরোধিতা করে তবে বলতেই হয়, লালনের ভক্তিবাদী, সাধনমার্গীয় জীবনচর্চা ও সমাজগঠনের প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ইসলামি পুনর্জাগরণ-বাদীদের। বিভিন্ন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদীদের লেখায় এর সাক্ষ্যও পাওয়া যায়, আমরা তা জানতে পাই আবুল আহসানের আলোচনা থেকে। অন্যদিকে ধর্মসমন্বয়ের প্রচেষ্টা থাকার পরও তাঁর ওপর যে ঠাকুরবাড়ির প্রচ্ছন্ন অনুরাগ ছিল এ-ব্যাপারেও ইঙ্গিত দেন লেখক : ‘তাঁর প্রতি ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের সানুরাগ কৌতূহল তাঁর পরিচয়ের ভূগোলকে আরো প্রসারিত করে।’

লেখাই বাহুল্য, আবুল আহসান চৌধুরী কোথাও কোথাও পাঠকের আগ্রহ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যেমন, এখানে লালন-সম্পর্কে সামাজিক প্রতিক্রিয়ার আলোচনায় ঠাকুরবাড়ির ব্যাপারটি আরো সম্প্রসারণ করার প্রয়োজন ছিল। লালনের যে-ছবিটি আমরা অহরহ ব্যবহার করি, যে-ছবিটি তাঁর চেহারা-সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার একমাত্র উৎস সেটি রবীন্দ্রনাথেরই ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা; লালনের গান প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হওয়ার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালি জনগোষ্ঠীর চোখে পড়ে, সে-কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, তাঁর গানের খাতাগুলোও অবিকৃতভাবে পাওয়া গেছে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে – এসব তথ্য তিনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করলেও ঠিক প্রয়োজনীয় এ-লেখাটিতে ব্যবহার করেননি। এ-লেখাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, কাঙাল হরিনাথকে রক্ষা করার জন্যে যে জমিদারবাহিনীর বিরুদ্ধে লালন ও লালন-অনুসারীদের প্রতিরোধপ্রস্তুতি-কথা – কিন্তু লেখেননি যে, তখন শিলাইদহে জমিদারি ছিল ঠাকুরপরিবারের। অথচ ঠাকুরপরিবারের সঙ্গে লালন আর কাঙাল হরিনাথের দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা থেকেই উঠে আসতে পারে তখনকার সমাজ ও বুদ্ধিবৃত্তিচর্চার তথা সামাজিক প্রতিক্রিয়ার নতুন নিরিখ। তিনি এ-লেখাটিতে জানিয়েছেন, “এই সংস্কার-আন্দোলনের প্রভাবে মীর মশাররফ হোসেনও বাউলদের সম্পর্কে অক্লেশে বলেছেন, ‘এরা আসল শয়তান, কাফের, বেঈমান/ তা কি তোমরা জান না (সঙ্গীতলহরী)।” অথচ তাঁর ‘মীর মশাররফ হোসেন : অন্তর্গত বাউল’ লেখায় এ-ব্যাপারে কোনো কিছুই লেখেননি। এটি ঠিক যে, লালন-অনুসারীদের ওপর ইসলাম ধর্মীয় সংস্কার-আন্দোলনের ফলে নিগ্রহনির্যাতন নেমে আসে, যে-সম্পর্কে কোনো ধারাবাহিক তথ্য পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু যেসব তথ্য আবুল আহসান চৌধুরী নিজেই পেয়েছেন, সেগুলোও সমন্বয় করার ক্ষেত্রে তিনি অধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন, সঙ্গীতলহরী থেকে উদ্ধৃত মীর মশাররফের উক্তিকে তিনি মুনীর চৌধুরী থেকে ব্যবহৃত উদ্ধৃতির আগে জুড়ে দিলে আমরা বরং পেতাম মশাররফের চিন্তাজগতের এক অনালোচিত বিবর্তনের ধারা। মুনীর চৌধুরীর যে-উদ্ধৃতি তিনি ব্যবহার করেছেন সেটি হলো : ‘স্পষ্টতই মনে হচ্ছিল যে কাঙাল হরিনাথের জীবন-চেতনা বরাবর এক তালে চলেনি, লালন ফকির এসে তার মূলে মোচড় দিয়ে গেছেন। মীর সাহেব উভয়স্তরেই কাঙালের সুহৃদ ছিলেন।’ সঙ্গীতলহরীর আর মুনীর চৌধুরীর এই উদ্ধৃতি মিলে নির্মিত হয় অখণ্ড মীর মশাররফ হোসেন এবং আমরাও পাই এমন এক সামাজিক স্রোত যা বিরোধিতার মধ্য দিয়েও শেষমেষ অর্জন করে লালনের সিদ্ধি। একইভাবে তিনি উল্লেখ করেননি সেই জেলা প্রশাসকের নাম, যিনি ১৯৬৫ সালে লালনের নামানুসারে কুষ্টিয়া জেলার নাম পরিবর্তনের জন্যে প্রশাসনিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে লালনবিরোধীদের রোষানলে পড়েন।

তবে আবুল আহসান চৌধুরীর কৃতিত্ব যে, তিনি এই সামাজিক বিরুদ্ধতার দিকে বেশ গুরুত্ব নিয়েই নজর দিয়েছেন এবং আলোচনা করেছেন, যা আগে আমাদের চোখে পড়েনি। লেখাগুলোর নিচে রচনার তারিখ থাকলে তাঁর এই নিরীক্ষণের মৌলিকত্ব সম্পর্কে পাঠক আরো নিঃসন্দেহ হতো। তাঁর আরো এক কৃতিত্ব, লালনের জীবনী-রচনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তিনি সংগ্রহ ও ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় ১২৯৭ সনের বৈশাখে বা ১৮৯০ সালের এপ্রিলে অর্থাৎ লালনের মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘মহাত্মা লালন ফকীর’ লেখাটিতে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ-লেখাটি থেকে স্পষ্টভাবেই আমরা বুঝতে পারি, অন্ত্যজ বাঙালির চিন্তাবিদ হলেও লালন সবসময়েই আলোড়ন তুলেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় নিয়ত মানুষদের। ১৫ কার্তিক ১২৯৭/ ৩১ অক্টোবর ১৮৯০-এ প্রকাশিত এ-লেখা পড়ে মনে হয়, জীবদ্দশাতেই লালন পরিণত হয়েছিলেন এক কিংবদন্তিতে, যাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে মৃত্যুর পরও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি (‘ইহার জীবনী লিখিবার কোনো উপকরণ পাওয়া কঠিন।’- লিখেছেন হিতকরীর লেখক)। তবে তাঁর জীবনচর্চার ধারা ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। এবং তাই অনেক বিতর্কিত এ-মানুষ-সম্পর্কে সমসময়ের হিতকরীতে লেখা হয়েছে : ‘নিজে লেখাপড়া জানিতেন না; কিন্তু তাঁহার রচিত অসংখ্য গান শুনিলে তাঁহাকে পরম পণ্ডিত বলিয়া বোধ হয়। তিনি কোনো শাস্ত্রই পড়েন নাই; কিন্তু ধর্মালাপে তাঁহাকে বিলক্ষণ শাস্ত্রবিদ বলিয়া বোধ হইত। বাস্তবিক ধর্মসাধনে তাঁহার অন্তর্দৃষ্টি খুলিয়া যাওয়ার সারসত্ত্ব তাঁহার জানিবার অবশিষ্ট ছিল না। লালন নিজে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না; অথচ সকল ধর্মের লোকই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।’

লালনের সঙ্গে অনেক সামাজিক বিরোধের পরও ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা কেন লালনকে নিয়ে সবিশেষ কৌতূহলী ছিলেন আর ইসলামি পুনর্জাগরণবাদীরাই বা কেন তাঁর ওপর বিশেষভাবে ক্ষিপ্ত ছিল সে-সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় আবুল আহসান চৌধুরী-সংগৃহীত হিতকরীর এ-লেখাটি থেকে : ‘‘মুসলমানদিগের সহিত তাঁহার আচার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাঁহাকে মুসলমান মনে করিত; বৈষ্ণবধর্মের মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। জাতিভেদ মানিতেন না, নিরাকার পরমেশ্বরে বিশ্বাস দেখিয়া ব্রাহ্মদিগের মনে ইঁহাকে ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী বলিয়া ভ্রম হওয়া আশ্চর্য্য নহে, কিন্তু ইঁহাকে ব্রাহ্ম বলিবার উপায় নাই : ইনি গুরুবাদ পোষণ করিতেন। অধিক কি ইঁহার শিষ্যগণ ইঁহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারও উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিত না। সর্ব্বদা ‘সাঞ’ এই কথা তাহাদের মুখে শুনিতে পাওয়া যায়। ইনি নামাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায়? তবে জাতিভেদহীন অভিনব বৈষ্ণব বলা যাইতে পারে; বৈষ্ণবধর্মের দিকে ইঁহার অধিক টান। শ্রীকৃষ্ণের অবতার বিশ্বাস করিতেন। কিন্তু সময় সময় যে উচ্চ-সাধনের কথা ইঁহার মুখে শুনা যাইত, তাহাতে তাঁহার মত ও সাধন সম্বন্ধে অনেক সন্দেহ উপস্থিত হইত।’’

সমসময়ের ধারণায় এই হলো লালনের ধর্মবিশ্বাস। একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গীয় 888sport live footballপরিষদ-আয়োজিত ‘ছাত্রসভা’র এক অধিবেশনে ১৩১৬ সনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘লালন ফকির কুষ্টিয়ার নিকটে হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ – এরূপ শোনা যায় যে তাঁহার বাপ মা তীর্থযাত্রাকালে পথিমধ্যে তাঁহার বসন্তরোগ হওয়াতে তাঁহাকে রাস্তায় ফেলিয়া চলিয়া যান। সেই সময় একজন মুসলমান ফকির দ্বারা তিনি পালিত ও দীক্ষিত হন। এই লালন ফকিরের মতে মুসলমান-হিন্দু-জৈন মত-সকল একত্র করিয়া এমন একটি জিনিস তৈয়ার হইয়াছে যাহাতে চিন্তা করিবার অনেক বিষয় হইয়াছে। এ-বিষয়ে সকলেরই মন দেওয়া উচিত।’’ রবীন্দ্রনাথের ভাষণের এই অংশ পাওয়া গেছে সে-সময়ের বঙ্গদর্শন (নবপর্যায়)-এর পৌষ ১৩১৫ 888sport free betয়। বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের দেখাসাক্ষাৎ না-ও হতে পারে, কিন্তু লালনের দর্শনগত আবেদন যে তাঁর হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছিল এ-বক্তব্য তারই বহিঃপ্রকাশ।

লালন ছাড়াও কাঙাল হরিনাথ, গগণ হরকরা, পাগলা কানাই, হাসন রাজা, ফকির মহিন শাহ, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ও বাউল সম্প্রদায় নিয়ে এ-বইতে আলোচনা করেছেন আবুল আহসান চৌধুরী। এ-ছাড়াও রয়েছে 888sport appsের বাউলদের নিয়ে একটি আলোচনা আর লালন-গবেষক ক্যারল সলোমনের সাক্ষাৎকার। এ-সব আলোচনাই লালন সাঁইয়ের দর্শন ও ভাবগত আবেদনের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের যোগান দিতে পারে এবং একটি অখণ্ড ধারাবাহিক পূর্ণাঙ্গ ধারণার উৎস হতে পারে। কেননা একটি কথা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, লালনের সময়টিও ছিল ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা যেমন রাজনৈতিক অর্থে তেমনি সামাজিক সংস্কারগত অর্থেও। তিনি এমন এক দর্শনগত সামাজিক-আন্দোলনের জন্ম দেন, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণিকে অন্ত্যজ বাঙালির ভাবজগতের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষ্যে আবুল আহসান চৌধুরী আমাদের জানান যে, ‘লালন বাঙালির নবজাগরণে বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে রামমোহনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।’ বাঙালির আরো এক মনীষা আহমদ শরীফের ভাষ্যটিও উল্লেখ করার মতো। তিনি বলেছেন, ‘ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমী, জামী ও হাফেজের সগোত্র এবং কবীর, দাদু ও রজবের উত্তরসাধক। লালন কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা ও প্রেমিক। তাঁর গান লোক888sport live football মাত্র নয়, বাঙালির প্রাণের কথা, মনীষার ফসল ও সংস্কৃতির স্বাক্ষর।’

লালনের ভবিষ্যৎ কী? এ-প্রসঙ্গে চোখ আটকে যাচ্ছে বাউলদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে লেখা আবদুল ওদুদের কয়েকটি বাক্যের ওপরে। লালনবিরোধী আলেম সমাজের সমালোচনা করতে গিয়েও তিনি জানাতে ভোলেননি, ‘…একযুগ যে সাধনাকে মূর্ত করে তুলল, অন্য যুগের ক্ষুধা তাতে নাও মিটতে পারে।’ এ-বইয়ে লালনচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়েও একটি আলোচনা হতে পারত এবং বইটি তাহলে পূর্ণাঙ্গ হতো। কেননা এর মধ্যে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে অনেক ঘটনা ঘটেছে, গড়াই নদী দিয়ে অনেক পানিই গড়িয়ে গেছে এবং লালন একাডেমীর কার্যক্রম ও ভবন-নির্মাণ নিয়েও দেখা দিয়েছে অনেক বিতর্ক, যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন আমাদের দেশের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরাও। আমরা কি প্রকৃতার্থেই অন্য কোনো যুগের প্রান্তে আসতে পেরেছি যাতে লালনের মূর্তসাধনা এখনই মনে হবে অপ্রয়োজনীয়? তাছাড়া তিনি তাঁর বইয়ের কোনো ভবিষ্যৎ-সংস্করণে সব কটি লেখাকে সমন্বিত করতে পারে Ñ এমন একটি ভূমিকা লিখলে বইটি আরো ঋদ্ধ হবে।

বিভিন্ন অসম্পূর্ণতা অবশ্য বইটিকে ম্রিয়মাণ করতে পারেনি। এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি লিখে আবুল আহসান চৌধুরী যেমন লালন, 888sport app বাউল ও বাউল সম্প্রদায়-সম্পর্কে তাঁর ধারণা তুলে ধরেছেন, তেমনি আমাদেরও সে-ধারণা পাওয়ার বিরল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন।

০৪ আষাঢ় ১৪১১; ১৮ জুন ২০০৪।