এই ঝালরকাটা জ্যোৎস্নায়, যখন না-দিন না-রাত, মন্দারবাড়ির উঠানে কে কথা কয়, কে ডাকে? এ কি ডাক, নাকি বিরহের সুর? যেন মানুষেরই কথা, মানুষেরই ডাক, মানুষেরই সুর। সে কি মানুষ? হয়তো মানুষ, কিংবা অর্ধমানুষ, কিংবা না-মানুষ। কিংবা সে মানবাধম কোনো প্রাণী। মানবাধম, না মানবোত্তম? এই বিচিত্র জগতে বিচিত্র সব প্রাণীর মধ্যে কে কার অধম, কে কার উত্তম, তা কে বলতে পারে! কিন্তু যেহেতু সে মানুষের আশ্রিত, সেহেতু তাকে মানবাধম ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে সে পেয়ে গেছে মানুষের স্বভাব। সে মানুষেরই মতো খায়, ঘুমায়, হাসে, কাঁদে, হাঁটে, হাগে, মোতে, ছোটে। মানুষের মতো তার একটা নামও আছে – লালাই।
নামটা দিয়েছিল নিশাত, তার জন্মের পনেরো কি কুড়ি দিনের মাথায়, এমনই এক ঝালরকাটা জ্যোৎস্নারাতে শেয়াল কি বাগডাশের ভয়ে যখন সে আশ্রয় নিয়েছিল মন্দারবাড়ির কলতলায় এবং ডাকছিল কুঁই কুঁই করে। নিশাত তাকে কোলে তুলে নিয়েছিল মাতৃস্নেহে। মাতৃস্নেহে, কেননা প্রত্যেক কিশোরীর ভেতরে একজন মা থাকে। সেই মায়ের ভেতরে অপার স্নেহ থাকে।
নিশাত তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর বাবা কই? মা কই? সে জবাব দিতে পারছিল না, কেবলই কুঁই কুঁই করে কাঁদছিল। কীভাবে জবাব দেবে? সে তো মানুষ নয়। ওই বয়সে মানবশিশুও তো কথা বলতে পারে না। সে কেবলই নিশাতের বুকের গভীরে, আরো গভীরে, ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছিল। সে বুঝি মায়ের মাই খুঁজছিল। হয়তো সে দুদিন কিংবা তিনদিনের ভুখা ছিল। কে খাওয়াবে তাকে, তার মা তো তাকে ফেলে চলে গেছে। ইচ্ছে করে যায়নি। পৃথিবীর কোনো মা সন্তানকে ফেলে ইচ্ছে করে কোথাও চলে যায় না। হয়তো সে ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল বলে খাবারের খোঁজে দূরে কোথাও গিয়েছিল। ঢুকে পড়েছিল কোনো বাড়ির হেঁসেলে। বাড়ির বউটি, বা মেয়েটি, বা ছেলেটি এসে লাঠির আঘাতে তার পা ভেঙে দিয়েছিল। কিংবা চুলার তপ্ত লাকড়ি তার চোখে ঠেসে ধরেছিল, কিংবা গরম তেল তার চোখে ছুড়ে মেরেছিল। পালিয়ে সে কোনো বাদাড়ে গিয়ে পড়ে ছিল। ভাঙা পা নিয়ে দাঁড়াতে পারছিল না, হাঁটতে পারছিল না। চলৎশক্তি রহিত দশায় পড়ে থাকতে থাকতে একটা সময় তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। কিংবা পোড়া চোখে সে কিছুই দেখছিল না। হাতড়াতে হাতড়াতে পুকুরে গিয়ে পড়েছিল। তারপর তলিয়ে গেছে অতল জলে। কিংবা খরস্রোতা মুহুরীর খুমে পড়ে গিয়ে ভেসে গেছে উত্তাল স্রোতে। কিংবা মরে গেছে অন্য কোনো অপঘাতে। এমনও হতে পারে, সে যখন খাবারের খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটছিল, পাকা রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ কোনো ট্যাক্সি, কোনো বাইক কিংবা কোনো টেম্পো তাকে চাপা দিয়ে চলে গেছে। সেই অপঘাত সে সামলেছিল প্রাণের বিনিময়ে।
ছানাটিকে নিশাত সোপর্দ করেছিল রাফাদের কাছে। বলেছিল, মামা, দেখো দেখো কী সুন্দর মিষ্টি ছানা! পারলে আমি একে 888sport appয় নিয়ে যেতাম। কিন্তু পারব না। নেওয়ার কোনো উপায় নেই। বাসায় তাকে রাখার মতো জায়গাও নেই। তুমি তাকে পুষবে। আমাকে যেভাবে আদর করো, ঠিক সেভাবে তাকেও করবে। তিন বেলা খেতে দেবে, সপ্তায় দুদিন সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাবে, ঘুমানোর জন্য ঘরের ঢেলায় একটা চট বিছিয়ে দেবে। আমি তার একটা নাম দিয়েছি – লালাই। তোমরা তাকে এ-নামেই ডাকবে। মনে রাখবে, সেই আদ্যিকালে প্রাণীদের মধ্যে কুকুরই প্রথম জুড়ে গিয়েছিল মানুষের সঙ্গে, হয়ে উঠেছিল মানুষেরই পরম সখা। বড় বিশ্বস্ত প্রাণী। কখনো বিশ্বাস ভাঙে না।
ভাগ্নির কথামতো তাই করেছিল রাফাদ। আইৎনার চকির নিচে পুরনো একটা চট বিছিয়ে দিয়েছিল। সেখানেই থাকত লালাই। রাফাদ তাকে তিন বেলা খেতে দিত। কখনো বাসি ভাত, কখনো বাসি রুটি। কখনো মাছের কাঁটা, কখনোবা মুরগির হাড়। কখনো ভুট্টা, কখনো গম।
লালাইকে দেখলেই হোসনাবানুর গা রি-রি করে উঠত। লালাইকে তার মোটেই সহ্য হতো না। কী করে হবে? কুকুর যে নাপাক! ঘরে ঢুকলে সাতদিন নাপাক থাকে ঘর। মায়ের কথা মানত না রাফাদ। বলত, এটা কাউতের কথা। কুকুর কেন নাপাক হবে? সে কি নাপাক কিছু খায়? হাঁস-মোরগে তো গু খায়। তারা কি নাপাক? তারা কি ঘরে ঢোকে না? ঢুকলে কি ঘর নাপাক হয়ে যায়? আমরা কি তাদের খাই না? খেয়ে আমরা কি নাপাক হয়ে যাই? পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ তো কুকুরের মাংস খায়। যারা খায়, তারা তো আমাদেরই মতো মানুষ। তারা কি নাপাক হয়ে যায়?
শুনে হোসনাবানুর বমি আসার জোগাড় হতো। এ কী বলে ছেলে! মানুষে কুত্তার গোস্ত খায়! ছে ছে ছে! এ কী করে সম্ভব! নিশ্চয়ই তারা বেজাত। জাতের মানুষ হলে কখনো এ-কাজ করতে পারত না।
এই মন্দারবাড়ি তখন এতটা ফাঁকা ছিল না। মানুষে ভরপুর ছিল। এ-ঘরে মানুষ, ও-ঘরে মানুষ। উঠানে মানুষ, ঘাটায় মানুষ, কলতলায় মানুষ। হোসনাবানুর ছেলেরা ছিল, ছেলেবউয়েরা ছিল, নাতিরা ছিল, নাতনিরা ছিল। তাদের কলরবে হরদম মুখর থাকত বাড়িটা। সেই মুখরতা বাড়িয়ে তুলত লালাই। এদিকে ছুটত, ওদিকে ছুটত; এর গা ঘেঁষত, ওর গা শুঁকত। অচেনা কাউকে দেখলে ডেকে ডেকে গোটা বাড়ি সন্ত্রস্ত করে তুলত। ততক্ষণ থামত না, যতক্ষণ না বাড়ির কেউ গিয়ে তাকে থামাত, মাথায় বা পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করত। কিংবা হোসনাবানু এই বলে ধমক দিত – থাম লালাই! এমন করে না!
আর নিশিরাতে, যখন তামাম বিলোনিয়া গ্রাম 888sport app থাকত চিরায়ত অন্ধকারে, যখন মানুষ গরুগোতালি হাঁস-মোরগ আর পাখপাখালিরা অচেতন পড়ে থাকত নিশুতির কোলে, লালাই তখন রাতপ্রহরীর মতো উজাগর থাকত একাকী। ঘরের দক্ষিণের ঢেলায় চুপচাপ বসে থাকত কান খাড়া করে। গোয়াল পাহারা দিত, কুঁড়েঘর পাহারা দিত, বাড়ির চৌসীমানা পাহারা দিত। গাছ থেকে টুপ করে পাকা আম, জাম কিংবা বেল পড়লে, এমনকি শুকনো পাতাটিও খসলে সে হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়াত।
আর ঝালরকাটা পূর্ণিমারাতে, যখন গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে আঙিনায় লুটিয়ে পড়ত জ্যোৎস্না, যখন তালুকপাড়ার কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে কুকুউ … কুকুউ করে ডাকত নিশাচর প্যাঁচা, তখন কী এক দুর্নিবার টানে লালাই ছুটে যেত মাজাটিলার মাঠে। সেই ধুধু মাঠে জ্যোৎস্না ঝালর কাটে না, চাঁদের গায়ে গা লাগিয়ে মাটিতে সাঁতার কাটে। লালাই ছুটে বেড়াত মাঠের এ-মাথা থেকে ও-মাথায়। কখনো মারুতির মতো লাফ মেরে চাঁদকে ধরতে চাইত। কখনো-বা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘস্বরে ডাকত – ওঁউ-উ-উ-উ … ওঁউ-উ-উ-উ। সেই ডাক বিদীর্ণ করে দিত নৈঃশব্দ্যের দেয়াল। ছড়িয়ে পড়ত দূরে, বহুদূরে। কাকে ডাকত লালাই? ডাকত, নাকি বিলাপ করত? হয়তো বিলাপই করত। মায়ের জন্য, বাবার জন্য কিংবা ভাইবোনের জন্য। কিংবা ডাকত কোনো সঙ্গিনীকে, যে এসে সিক্ত করে দেবে তার রিক্ত যৌবন। কিংবা সদর্পে বুঝি এই ঘোষণা দিত – আমি জেগে আছি, জেগে থাকব সারা রাত। কেউ মন্দারবাড়ির চৌসীমানায় ঢোকার চেষ্টা করো না। করলে লালাই তাকে ছাড়বে না।
বিলোনিয়া গ্রামে মদদি, গাঁজুড়ি আর জুয়াড়ির যেমন কমতি নেই, তেমনি কমতি নেই চোরছেঁচরেরও। তারা
গরু-ছাগল চুরি করে, হাঁস-মোরগ চুরি করে, ধান-চাল চুরি করে,
হাঁড়ি-কড়াই চুরি করে, এমনকি কলের মাথা কিংবা ঘরের কোণার বাল্বটিও খুলে নিয়ে যায়। কিন্তু মন্দারবাড়িতে কোনো চোর ঢুকতে পারে না। পারে না লালাইর ভয়ে। চোর দেখলেই ডেকে ডেকে চোরের অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দেয় লালাই। কখনো জাপটে ধরে নখের আঁচড়ে গা চিরে দেয়, কখনো লুঙ্গিটা কামড়ে ধরে টানতে থাকে, আর কখনো দেয় ধাওয়া। এক ধাওয়ায় পার করে দেয় মাজাটিলা বা গোরস্তান বা তালুকপাড়ার সীমানা।
কেবল চোরেরাই নয়, মাঝেমধ্যে ব্ল্যাকারেরাও নাস্তানাবুদ হতো লালাইর কাছে। নিশিরাতে যখন তারা ইন্ডিয়া থেকে ব্ল্যাকে আনা মালামাল নিয়ে ছুটত, ছুটতে ছুটতে কখনো যদি মন্দারবাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ত, লালাই তখন বিজিবির জওয়ানের মতো তাকে জাপটে ধরত, কিংবা ডেকে ডেকে সন্ত্রস্ত করে তুলত। মাঝেমধ্যে তার হয়রানির শিকার হতো পাড়া-পড়শিরাও, যখন তারা গভীর রাতে হাট-ঘাট কিংবা দোকানপাট থেকে বাড়ি ফিরত।
এসব কারণে লালাইর শত্রু তৈরি হয়েছিল বিস্তর। সেসব শত্রুর কাছে লালাই হয়ে উঠেছিল কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধী। সে-কারণেই একবার মাথায় খেয়েছিল ছেনির কোপ। অতি রক্তপাতে লালাই মরেই যেত, যদি না রাফাদ তাকে নিয়ে যেত পশু হাসপাতালে। ডাক্তার তো চিকিৎসা দেবেনই না। কারণ পশু বলতে তিনি বোঝেন কেবল গরু-ছাগল আর মোষ-ভেড়া। কুকুরও যে পশু এবং এই পশু হাসপাতালে যে কুকুরেরও চিকিৎসা নেওয়ার অধিকার আছে, সে-কথা 888sport app download for android করিয়ে দিলো রাফাদ। তার বাচনভঙ্গি দেখে ডাক্তার বুঝে গিয়েছিলেন এই কুকুরের সেবা তাকে দিতেই হবে। না দিলে ঝামেলা হবে। ঝামেলা করবে রাফাদ। ঝামেলা থেকে বাঁচতে লালাইর মাথায় তিনি সেলাই দিয়ে করে দিয়েছিলেন ব্যান্ডেজ।
আরেকবার, শ্রাবণের এক তুমুল বর্ষায়, পড়শিদের কেউ একজন লালাইকে খেতে দিয়েছিল বাসি খিচুড়ি। ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল লালাই। গোগ্রাসে খেয়েছিল। যদি জানত সে খাবারে বিষ মেশানো, তবে তা সে মুখেও তুলত না। কীভাবে জানবে? সে তো মানুষ নয়। মানুষেরা বিষ চেনে, বিষ দিয়ে ইঁদুর মারে, পোকা মারে, সাপ মারে, বিচ্ছু মারে, এমনকি কখনো কখনো মানুষও মারে। লালাই তো মানবাধম আলাভোলা প্রাণী। সবকিছুই তার কাছে সরল। জটিল হিসাব সে বোঝে না। তার পূর্বজনেরা মানুষকে বিশ্বাস করেছিল, সেও করে। কখনো বিশ্বাস ভাঙে না।
সেবারও মরে যেতে পারত লালাই। মরেনি রাফাদের চেষ্টায়। রাফাদ তাকে কাঁধে তুলে তুমুল বৃষ্টি ঠেলে আবারো ছুটে গিয়েছিল পশু হাসপাতালে। ডাক্তার চিকিৎসা দিয়ে আবারো সুস্থ করে তুলেছিল তাকে। সেবারের ধাক্কায় লালাইর শিক্ষা হয়েছে। বুঝতে পেরেছে, মন্দারবাড়ির খাবার ছাড়া অন্য কারো বাড়ির খাবার খাওয়া তো দূরের কথা, মুখও দেওয়া যাবে না।
সেই ঘটনার পর হোসনাবানুর মনও পাল্টে যায়। লালাইকে তার সহ্য হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু কখনো কাছে ঘেঁষতে দিতেন না। লালাই কখনো তার গা ঘেঁষতে চাইলে ছি-ছি করে তাড়িয়ে দিতেন। কখনো দরজায় দাঁড়িয়ে লেজ নাড়াতে দেখলে লাঠিটা হাতে নিয়ে ভয় দেখাতেন। কিন্তু বিষ খেয়ে লালাই বেঁচে ওঠার পর তার মন পাল্টে গেল। লালাইকে তার আর পর মনে হয় না। মনে হয় নিজেরই কেউ একজন। বাড়ির গরুটির মতো, ছাগলটির মতো, কবুতর বা হাঁস-মোরগগুলোর মতো লালাইও এ-বাড়িরই বসিন্দা। কোনো কোনো খাঁ-খাঁ নিদাঘে, লালাই যখন দূরে কোথাও চলে যেত, হঠাৎ হোসনাবানুর মনে পড়ে যেত লালাইর কথা। এদিক-ওদিক খুঁজতেন তাকে। কোথাও না দেখে তার মনে হতো, লালাই ছাড়া এ-বাড়ি বিরান, বড় ফাঁকা। লালাই আছে বলে এ-বাড়ি এত মুখর, এত সুন্দর।
হোসনাবানু দিনের বেলায় যখন বারচুলায় রান্না করতেন, কিংবা পৌষ-মাঘের শীতরাতে চুলার আগুন পোহাতেন, অদূরে চুপচাপ বসে থাকত লালাই। যেন সে হোসনাবানুর বডিগার্ড, যেন বসে থাকাটাই তার ডিউটি। ততক্ষণ বসে থাকতে হবে, যতক্ষণ হোসনাবানু হেঁসেলে থাকেন। এক মুহূর্তের জন্যও কোথাও যাওয়া যাবে না। হোসনাবানু কখনো একটা বিস্কিট, কখনো একটা পিঠা, কখনোবা একটা রুটি ছুড়ে দিতেন। টুপ করে খেয়ে নিত লালাই। খেয়ে সামনের দুই ঠ্যাং তুলে নেচে উঠত। তারপর করুণচোখে হোসনাবানুর দিকে তাকিয়ে থাকত। কখনো কখনো কয়েক পা এগিয়ে হোসনাবানুর কাছে ঘেঁষতে চাইত। হোসনাবানু যদি মাথায় কিংবা পিঠে হাত বুলিয়ে একটু আদর করেন! কিন্তু দু-পা এগিয়ে লালাই চার-পা পিছিয়ে যেত। কারণ ততদিনে সে বুঝে গিয়েছিল, বাড়ির এই বয়স্ক মানুষটি তাকে নাপাক ভাবে।
তারপর ক্রমে এ-বাড়ি জনশূন্য হতে লাগল। মেয়েদের তো আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরাও জীবন-জীবিকার টানে শহরে-বন্দরে চলে গেল। তাদের বউ-বাচ্চাদেরও নিয়ে গেল। ফাঁকা বাড়িতে থাকলেন কেবল হোসনাবানু। তার তো কোথাও যাওয়ার নেই। ছেলোরা তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। বলেছিল, এই ফাঁকা বাড়িতে তুমি কীভাবে থাকবে একা? চলো, আমাদের সঙ্গে চলো। কিন্তু তিনি যাননি। এই ঘর, এই বাড়ি, এই সংসার ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন? কেন যাবেন?
আর থাকল লালাই। হোসনাবানুর বিশ^স্ত সঙ্গী হয়ে, পরম সখা হয়ে। চার ঠ্যাং গুটিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকে ঘরের পৈঠায়। কখনো ঝিমায়, কখনো ঘুমায়, কখনো-বা অপলক তাকিয়ে থাকে দূরে, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের দিকে, কিংবা ঝালরকাটা জ্যোৎস্নার দিকে। আগের মতো সেই ঝালরকাটা জ্যোৎস্না এখনো নামে। এখনো মাজাটিলার মাঠে জ্যোৎস্না সাঁতার কাটে। কিন্তু লালাইকে এখন আর পূর্ণিমা টানে না। দুর্নিবার টানে সে ছুটে যায় না মাজাটিলার মাঠে। কেননা সে জানে এ-বাড়ি যে বিরান। একদিন যারা ছিল, এখন তারা নেই। একদিন যে-মুখরতা ছিল, এখন তা নেই। সবাই চলে গেছে দূরে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে। জ্যোৎস্নার টানে লালাই মাঠে গেলে হোসনাবানুকে কে দেখবে? কে পাহারা দেবে?
রোজ রাতে ঘুমানোর আগে হোসনাবানু দরজা খুলে লালাইকে একবার দেখে নেন। দরজা খুলতেই লালাই চট করে পৈঠা থেকে নেমে দাঁড়ায় উঠানে। যদি হোসনাবানুর গায়ে তার গা লেগে যায়! লেগে গেলে হোসনাবানু যে নাপাক হয়ে যাবেন!
মাঝরাতে হোসনাবানু লোটা হাতে টয়লেটে গেলে লালাই দেহরক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে। হোসনাবানু ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে পরে সে পৈঠায় গিয়ে আগের মতো চার ঠ্যাং গুটিয়ে বসে। কখনো মধ্যরাতে, কোনো স্বপ্ন দেখে যখন হোসনাবানুর ঘুম ভেঙে যায়, তখন তিনি ডাক দেন, লালাই! লালাই জবাব দেয়, ঘে-উ-উ। শেষরাতে, হোসনাবানু যখন তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য অজু করতে কলতলায় যান, লালাই তখন দাঁড়িয়ে থাকে তার পেছনে। সাবধানে, অতি সবাধানে সে হোসনাবানুর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। যদি তার গায়ে গা ঘেঁষে যায়! সে তো জানে, হোসনাবানু তাকে নাপাক ভাবে।
হঠাৎ একদিন সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল মন্দারবাড়ি। মেয়ের বাড়ি বেড়াতে চলে গেলেন হোসনাবানু। পাশের বাড়ির মেয়েটিকে কিছু টাকা দিয়ে তিনি লালাইকে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। লালাই তাকে খোঁজে। গোটা বাড়িতে খোঁজে, আর খোঁজে পড়শিদের বাড়িতে। মাজাটিলার মাঠ আর লিচুবাগানে গিয়েও খোঁজে। কোথাও না পেয়ে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে লালাই আর্তস্বরে বিলাপ করে – ওঁউ-উ-উ-উ …
ওঁউ-উ-উ-উ।
কদিন পর লালাই বুঝে গেল তার একমাত্র সঙ্গীও চলে গেছে এই বাড়ি ছেড়ে। নিশ্চয়ই তিনি একদিন ফিরবেন। কে জানে, হয়তো আর কখনো ফিরবেন না। এই ফাঁকা বাড়ি দেখেশুনে রাখতে হবে তাকে। কাউকে এ-বাড়ির চৌসীমানায় ঢুকতে দেওয়া যাবে না।
কত দিন চলে গেল, কত রাত চলে গেল, গভীর অন্ধকারের অমাবস্যা চলে গেল, ঝালরকাটা জ্যোৎস্নাও চলে গেল, তবু ফিরলেন না হোসনাবানু। অপেক্ষায় থাকে লালাই। তার বিশ্বাস, একদিন নিশ্চয়ই ফিরবেন হোসনাবানু। আবার তাকে ডাকবেন, লালাই! আবার তাকে তিন বেলা খেতে দেবেন।
প্রায় আড়াই মাস পর, হঠাৎ একদিন ফিরলেন হোসনাবানু। ঘরের পৈঠায় ব্যাগটা রেখে তিনি দরজা খুলছিলেন। আর অমনি কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো লালাই। তাকে দেখে চমকে উঠলেন হোসনাবানু। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে লালাই। সিনার হাড় বেরিয়ে গেছে। খসে গেছে পিঠের বিস্তর রোম। লালাই মুখটা ঊর্ধ্বপানে তুলে দীর্ঘস্বরে ডাক দেয় –
ওঁউ-উ-উ-উ … ওঁউ-উ-উ-উ … ওঁউ-উ-উ-উ …
ওঁউ-উ-উ-উ।
হোসনাবানু বুঝতে পারে, এ-ডাক নয়, এ লালাইর কান্না। এই কান্নার অর্থ, আমাকে ফেলে এতদিন কোথায় ছিলে, মা?
হোসনাবানুর খুব কান্না পায়। বুকে ওঠে স্নেহের তুফান। ভিজে যায় চোখ। মা যেমন সন্তানকে বুকে নেওয়ার জন্য বাড়িয়ে দেয় দুই হাত, তেমনি বাড়িয়ে দিলেন তিনি। মারুতির মতো লাফ মেরে লালাই উঠে পড়ে তার কোলে। হোসনাবানু
পাক-নাপাকের কথা ভুলে জড়িয়ে ধরেন লালাইকে। লালাই একদিন যেভাবে নিশাতের বুকের গভীরে, আরো গভীরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেছিল, বহুদিন পর, ঠিক সেভাবে, হোসনাবানুর বুকের গভীরে, আরো গভীরে, ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.