যশোধরা বাগচী
আমরা যখন বড়ো হয়ে উঠছি, তখন শুনতাম, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে সেই সময় দুই ‘অমিতা সেনে’র রমরমা – একজন নাচে ও একজন গানে।
নাচতেন কিরণবালা ও ক্ষিতিমোহন সেনের ছোট কন্যা – আমার অমিতাপিসি। আমার ছোটকাকা রামানন্দ সেনগুপ্তর ক্যামেরায় তাঁর কিছু অংশ তোলা ছিল বলে শুনেছি, নিজে কখনো দেখিনি। কিন্তু অনেক পরে প্রায় প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে অমিতাপিসির সজীব লেখাগুলির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি।
কলকাতা শহরে সংগীত-পাগল স্কুলপড়ুয়া আমি কিন্তু অন্য অমিতা সেনের সঙ্গে অনেক সহজে পরিচিত হয়েছিলাম, তাঁর ৭৮ আরপিএম রেকর্ডের মারফত। ‘ওগো বধূ সুন্দরী/ তুমি মধুমঞ্জরী/ পুলকিত চম্পার লহো অভিনন্দন’ – যে যেখানেই গাক না কেন, আমার কানে গানটি একান্ত অমিতা সেনেরই। বাড়িতে আরো শুনতাম, 888sport app বিক্রমপুরে আমাদের গ্রাম আউটসাহীর হেমবালা সেনের ভাইজি অমিতা সেন, সবাই বলে ‘খুকু’। একটু বড়ো হয়ে বুঝতে পারলাম যে, এই সুললিত অথচ ওজস্বিনী গলায় আর নতুন গান আমরা শুনতে পাবো না, কারণ অত্যন্ত অল্প বয়সে আমাদের প্রিয় রোম্যান্টিক কবি জন কিটসের মতোই অমিতা সেনও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
দুই
অনেক বছর পরে যখন ভারতের 888sport promo code-আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মানবী বিদ্যাচর্চার প্রবর্তন করার সুযোগ পেলাম, তখন প্রায়শ বিস্মৃত মহিলাদের সৃজনীশক্তিকে নতুন করে পরিচিতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের পুনর্মুদ্রণ সিরিজ শুরু করেছি। সেই সময়ে 888sport promo code-আন্দোলনের সহযোদ্ধা ইলিনা সেনের কাছে খবর পাই যে, প্রয়াত অমিতা সেনের লেখাগুলি পুনর্মুদ্রণের ব্যাপারে তাঁরা উৎসাহী। বলা বাহুল্য, আমার কৈশোরের idol-কে আবার লোকচক্ষুর সামনে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমার উৎসাহ ছিল প্রবল। তৎসত্ত্বেও আমার দিনগত পাপক্ষয় কিন্তু আমার পাপের বোঝা বাড়িয়ে তোলে, কারণ বেশ কয়েকবার আলোচনা করেও সেই লেখাগুলি আমাদের পক্ষে প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। তাই এত বছর পরে যখন ইলিনার সুযোগ্য সম্পাদনায় ‘চর্চাপদ’ থেকে এ-বইটি প্রকাশিত হলো, তখন সেন পরিবারের পরেই বোধহয় আমার আনন্দ হয়েছিল সবচাইতে বেশি! হবেই বা না কেন, 888sport app বিক্রমপুর অন্তর্গত আউটসাহী গ্রামের মেয়ে আমি, বইটির মধ্যে অমিতা সেনের যে দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে, আমাদের গ্রামের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সঙ্গে তা জড়িত বলে আমার বিশ্বাস। তাই, 888sport apps থেকে কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক যখন ঊর্মি রহমানের মাধ্যমে আমার কাছে একটি লেখা চাইলেন, তখন সেন পরিবার ও চর্চাপদের যুগলবন্দিতে অমিতা নামের যে-বইটি প্রকাশিত হলো তাঁর জন্মের একশ বছর পরে, সে-বইটিকেই বেছে নিলাম আলোচনার জন্য। বইটির সঙ্গে প্রকাশক আমাদের উপহার দিয়েছেন একটি সিডি, যাতে ধরা আছে খুকু অমিতার গলায় গাওয়া দুষ্প্রাপ্য দশটি গান। পাঠককে সেই রসে বঞ্চিত রেখেই আমাকে এগোতে হবে। অমিতা সেনের বিষয়ে আমার দুই প্রিয় আত্মীয়ের কাছে যেটুকু জানতে পেরেছি তা এই বইয়ের বক্তব্যের পরিপূরক। প্রথমজন আমার ছোটকাকা রামানন্দ সেনগুপ্ত যিনি ১৯২৫-২৬ সাল থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে আশ্রমবালক ছিলেন। আউটসাহী গ্রামের সূত্রে হেমবালাদির কাছে মাঝে মাঝেই যেত কিশোর রামানন্দ। তখন ‘খুকুদি’র সঙ্গে দেখা হতো। কিশোরমনে তিনি দাগ কেটেছিলেন অত্যন্ত ভালো, সৎ ব্যক্তিত্ব হিসেবে। গুরুদেবের খুব কাছের মানুষ খুকুদির গান থাকতো প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে। এছাড়াও ‘খুকুদি’কে তিনি খোলা গলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান করতে শুনেছেন। কিন্তু আমার জ্যাঠতুতো বোন বুবাই, আউটসাহীর বড়বাড়ির বড় ছেলে বেঙ্গল স্কুলের বিখ্যাত চিত্র888sport live chatী মণীন্দ্রভূষণ গুপ্তের মেয়ে সন্তোষকুমার মজুমদারের দুই বোন, তার মা রেখা ও মাসি নুটুর (রমা) সূত্রে খুকু-অমিতার সঙ্গে যুক্ত। মাসিকে ও পায়নি; কিন্তু মায়ের কাছে খুকু-অমিতার বিষয়ে অনেক 888sport sign up bonusচারণ শুনেছে। আউটসাহীতেও যখন খুকু-অমিতা যেতেন, কেউ গান গাইতে বললেই তিনি খোলা গলায় প্রাণস্পর্শী গান করতেন। বুবাইয়ের মা-কাকা-পিসিদের কাছে এ-কথা সে অনেক শুনেছে। তবে বুবাইয়ের শোনা একটি গল্প আমাকে বিশেষ নাড়িয়েছিল – খুকু-অমিতা শান্তিনিকেতনের মাঠে-ঘাটে যে-গানটি গেয়ে বেড়াতে সবচেয়ে ভালোবাসতেন, সেটি হচ্ছে – ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। ওর মুখে এই গানটি এত শোনা যেত যে, অনেকে বলতেন, গানটি রবীন্দ্রনাথ ওর গলার জন্যই লিখেছিলেন! তাঁর অকালমৃত্যুর ৩১ বছর বাদে গানটি হয়ে উঠলো এক নতুন জাতির প্রতীক।
তিন
চর্চাপদের তত্ত্বাবধানে এবং প্রিয় বান্ধবী ইলিনা সেনের সম্পাদনায় এই বইটির প্রকাশিত চেহারা দেখে আমার মনে হলো, এ-ধরনের গবেষণাভিত্তিক সংযোজনগুলি ছাড়া শুধু অমিতা সেনের লেখা ও চিঠি দিয়ে এই সংকলনটি বের হওয়া উচিত হতো না। সেদিক থেকে শতবার্ষিকী 888sport free bet হিসেবে এই পূর্ণতর রূপটির প্রকাশ হওয়াই প্রয়োজন ছিল। এর জন্য প্রকাশক, সম্পাদক, অমিতা সেনের ছোট ভাই দেবপ্রসাদ সেনের স্ত্রী অনসূয়া সেন, 888sport app পারিবারিক সদস্য ও বন্ধুদের সহায়তায় যে-বইটি আমরা শেষ পর্যন্ত হাতে পেলাম, একমাত্র সেরকম একটি সূক্ষ্ম জটিলতার সহমর্মিতার ফসলই অমিতা সেনের জীবনের বেদনা এবং উদ্বেল উচ্ছ্বাস irving Stove যাকে বলেছেন The agony and the ecstasy পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ড. বিনায়ক সেন যখন রাষ্ট্রব্যবস্থার শিকার হয়ে তাঁর ন্যূনতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, অনসূয়া সেন সেই সময় তাঁর চরিত্রের যে দৃঢ়তার নিদর্শন দেশের সামনে রেখেছিলেন তারই খানিকটা আভাস পাওয়া যায় এই বইটিতে, তিনি যেভাবে তাঁর না-দেখা বড় ননদের জীবনের সংগ্রামকে তুলে ধরতে তাঁর পুত্রবধূ ইলিনাকে সাহায্য করেছেন। শতবর্ষের আলোর বিকিরণের জন্য প্রয়োজন ছিল। এবং প্রয়োজন ছিল ইলিনা সেনের মতো লড়াকু এক সম্পাদকের যে শুধু 888sport promo code-আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনের বর্তমান ভারতবর্ষে এক উজ্জ্বল প্রতিভূই নন, এর বিশ্লেষণেও তিনি বিশেষ পারদর্শিনী। ভারতের 888sport promo code-আন্দোলনের বর্তমান তিনি একেবারে গোড়ার দিকের ঐতিহাসিক। এ-বছর মানবীবিদ্যার সর্বভারতীয় সম্মেলন সংগঠিত হয় তাঁরই সভানেতৃত্বে। ডা. বিনায়ক সেনের ওপর রাষ্ট্রের জুলুম এবং নিজের শরীরে কর্কট রোগের দাপাদাপি সামলে তিনি যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তা আমাদের সবারই সপ্রশংস 888sport apk download apk latest versionর দাবি রাখে। তবে পেশায় সমাজতত্ত্ববিদ ইলিনা যে এই বইটির সম্পাদনার কাজে এমন নৈপুণ্য দেখাবেন তা চট করে ভাবা শক্ত ছিল। অনেকের সাহায্য তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, কিন্তু তাঁর নিজের দক্ষতারও এটি অসামান্য নিদর্শন।
এবার বইটির দিকে নজর দেওয়া যাক। অমিতার নিজের লেখার সংগ্রহটি স্বাভাবিকভাবেই বেশ স্বল্প-পরিসর। তবে বইটির উদ্বোধনের দিন সম্পাদিকা নিজেই বলেন যে, তাঁদের কাজ এখনো অসমাপ্ত। অমিতার নিজের বয়ানেই কিছু উক্তি থেকে তাঁর মনে হয়েছে, অমিতার আরো অনেক লেখা অগ্রথিত থাকার সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। লেখাগুলি খুঁজে বের করা ছাড়াও এ-বিষয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করার সম্ভাবনার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এগুলির কথা মাথায় রেখেও এই বইটি যেভাবে নির্মিত হয়েছে, সে-বিষয়ে দু-চারটি কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করি। এই নির্মিতির প্রথম কথা হলো, অমিতা নাতিদীর্ঘ রচনাসমগ্র, গদ্য, 888sport app download apk ও চিঠি মিলিয়ে – এর জন্য একটি উপযুক্ত বাতাবরণ তৈরি করা – যাতে করে অমিতার শান্তিনিকেতন ও শান্তিনিকেতনোত্তর জীবনের রূপরেখা ও তার অন্তর্নিহিত সংগ্রাম, বেদনা ও তজ্জনিত চাপগুলি বেরিয়ে আসতে পারে। ইলিনার সঙ্গে যখন লেখাগুলি প্রকাশের ব্যাপারে কথা বলেছি, তখন এই প্রসঙ্গটি আমাদের মনে ঘুরেফিরে এসেছে। ইলিনার 888sport promo codeবাদী বিশ্লেষণ এ-বিষয়ে ছিল সতত সজাগ।
এই বইটির অসামান্য গুণ হচ্ছে যে, শতবার্ষিকী প্রকাশনা হিসেবে এর ব্যতিক্রমী চেহারা। শতবার্ষিকী প্রকাশনা সাধারণত যে একমাত্রিকতা-দোষে দুষ্ট হয়ে থাকে; এই বইটি তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এক অসাধারণ 888sport live chatীর মনন এবং সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যে কত জটিল প্রসঙ্গ, তার নিদর্শন অবশ্যই আমরা পাই ‘অমিতা’র জীবনে। কিন্তু এই রকম একটি পরিচ্ছন্ন গ্রন্থণের মধ্যে সেই জটিলতাকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছি, এটি খুব সহজ নয়। বইটি মন দিয়ে পড়লে বোঝা যায় যে, এই গুরুদায়িত্বটি প্রথমেই মাথায় তুলে নিয়েছেন সম্পাদিকা ইলিনা সেন স্বয়ং। যেরকম পরিমার্জিত অথচ আপসহীন ভাষায় তিনি অমিতার ক্ষণস্থায়ী জীবনের আলোচনায় এবং বিপদসংকুল বেদনার ছায়াঘন দিকগুলিকে যুগপৎ তুলে ধরেছেন তাতে আমাদের মনে প্রশ্নগুলির পরিপ্রেক্ষিত নির্ণয় করা অনেকটা সাধ্যের মধ্যে এসে পড়ে। এবারে সম্পাদিকার পিছুপিছু আমরাও এই পীড়াদায়ক কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হই।
যে-প্রশ্নটি উঠে আসে যে, অমিতা সেনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে ‘888sport live chatী’ এবং ‘বিদুষী’র যে-সংমিশ্রণ ঘটেছিল পরের প্রজন্ম তাঁকে এত সহজে বি888sport sign up bonusর অতলে ঠেলে দিতে পেরেছিল কেন? শুধুই কি তার স্বল্প আয়ু এর জন্য দায়ী হতে পারে? মনে হয় না। তাঁর জীবনে যেমন পারঙ্গমতা চোখে পড়ার মতো, সেইসঙ্গে যেসব অভূতপূর্ব বাধার সম্মুখীন তাঁকে হতে হয়েছিল এবং সেগুলি অতিক্রম করার জন্য তাঁকে যেভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছিল এবং যেভাবে তার মূল্য দিতে হয়েছিল – এই দুটি পাশাপাশি রাখলে আমাদের সামনে যে ব্যক্তিচেতনা মূর্ত হয়ে ওঠে তা যথার্থই ট্র্যাজেডির আয়তন লাভ করতে পারে। এই ব্যতিক্রমী 888sport live chatীসত্তাকে আমাদের কাছে এত দেরিতে পৌঁছে দেওয়া হলো কেন? একটি পর্যায়ে আমি নিজেও যে এই বিলম্বের জন্য দায়ী সে-দোষ স্বীকার করে নিয়ে বলছি যে, এর খানিকটা আমার ওপরেও বর্তায়। তাঁর দশটি গান, যা শুনে আমরা ছোটবেলায় বড় হয়েছি, তা 888sport free betয় এত কম হলো কেন? কেন আরো যত্ন করে তাঁর গান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আরো বেশি প্রচার করা হয়নি? কেন রবীন্দ্রনাথের কাছের মহিলাদের যেমন রানু অধিকারী বা মৈত্রেয়ী দেবীদের সাধারণ পাঠক যত সহজে জানার বোঝার সুযোগ পেয়েছেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরেই রবীন্দ্রনাথ যাঁকে তাঁর গানের ভান্ডারি করতে উদ্যত হয়েছিলেন, সেই অমিতা খুকুদি কী করে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেলেন সে-সম্পর্কেও সংগতভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন রেখেছেন সম্পাদিকা। এবং যে-সম্ভার তিনি, তাঁর সহায়কগণ ও প্রকাশক সযত্নে এই বইটিতে গচ্ছিত করেছেন, তা থেকে আমরা এই প্রশ্নগুলির খানিকটা মোকাবিলা করতে পারবো। প্রথমে এইগুলির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করবো বইটির বিভিন্ন অংশের মুখোমুখি হয়ে। সবশেষে আবার কিছু জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করাবো নিজেদের।
চার
অমিতা সেনকে জানা-বোঝার দুর্ভেদ্য প্রাচীরটিকে নামিয়ে তাঁর দিকে এগোনোর ব্যাপারে সহায়তা করেছে বইটির গ্রন্থনপদ্ধতি। কয়েকটি ভাগে বইটির বক্তব্যগুলিকে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে অমিতার সম্পর্কে লেখা এবং দ্বিতীয়টি অমিতার লেখা। যদিও পড়তে গিয়ে বোঝা গেছে, এভাবে ঠিক আলাদা করা যায় না, কিন্তু নিজেদের সুবিধার জন্য এই দুটি ভাগ করার জন্য আমরা সম্পাদিকার কাছে কৃতজ্ঞ।
‘অমিতা সম্পর্কে’ অংশটি পড়লেই বোঝা যায় যে, এই বইটি কী অসাধ্য সাধন সম্পন্ন করেছে। রবীন্দ্রসংগীতের রচনা, সুর সংরক্ষণ ও পরিবেশনার ইতিহাস খন্ড খন্ডভাবে রচিত হয়ে যাচ্ছে। প্রথম লেখাটি, অর্থাৎ নিত্যপ্রিয় ঘোষের স্বভাবসিদ্ধ গবেষণার গোয়েন্দামনস্কতা আমাদের সমৃদ্ধ করেছে ‘কালনাগিনীর ঝোঁক’ লেখাটির মাধ্যমে। রবীন্দ্রসংগীতের কালো মেঘের অন্তরের তেজ এবং একাধিকতার অসহনীয় প্রত্যাখ্যান-জর্জরিত জীবনের মাথা উঁচু করে বাঁচবার সংগ্রামে তাঁর হাতিয়ার ছিল কালনাগিনীর ফোঁস – ‘কৃষ্ণিকলির’ parody করে নিশিকান্ত রায় চৌধুরী যেমন বলেছিলেন –
কালনাগিনী আমি তারে বলি
কালো তারে বলে পাড়ার লোক
শুনেছিলাম বইগুদামের ঘরে
কালো মেয়ের কালো মুখের ফোঁস।
(অমিতা, পৃ ২৪)
অমিতা সেনের বোনজি অধ্যাপক সুনন্দা দাসগুপ্ত, পার্থ বসু বা সিদ্ধার্থ ঘোষের তথ্যকেন্দ্রিক গবেষণা ব্যবহার করে নিত্যপ্রিয় ঘোষ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন এই সুরসম্রাজ্ঞীর মেধার শক্তি যা তাঁকে একই সঙ্গে গুরুদেবের গান গলায় নিজেকে তুলে নিয়ে তাকে সংরক্ষণ করা এবং লাইব্রেরি থেকে (‘বইগুদাম’ লক্ষণীয়) বই নিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিকে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাশ করায়। লেখাপড়ার আসক্তি ও গানের অবশ্যম্ভাবী টানের দোটানার মধ্যে চিরকাল যুদ্ধ করতে হয়েছে অমিতাকে – যেখানে গানের রশি বরাবর টেনেছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং, স্বাভাবিকভাবেই লেখাপড়ার রশি টানতে হয়েছে নিজেকে। সেই বিশাল দায়বদ্ধতা, যা তাঁকে পরীক্ষার পর পরীক্ষায় রৌপ্য ও স্বর্ণপদক দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু মনে হয় তাঁকে বিশ্বের সভার মুক্তদ্বারে আনীত করতে পারেনি। মধ্যবিত্ত সংসারে আর্থিক দায়িত্ব অনেকখানি নিজের ওপরে নিয়ে তাঁর অসাধারণ আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে তিনি বেঁচেছেন। সে-বাঁচা তাঁর ব্যক্তিজীবনে যে-মূল্য আদায় করেছে তার একটি দিক সম্পর্কে কিছু কৌতূহল আমরা লক্ষ করতে পারি। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রমা চক্রবর্তী আশ্রমবাসিনী উমা দত্ত সে-সম্পর্কে আমাদের নজর আকর্ষণ করেছেন (পৃ ১ ও পৃ ৯৭) এবং 888sport live football বোধে রাঙিয়ে লিখেছেন পার্থ বসু তাঁর বুল্বুলি 888sport alternative linkে এবং অনীতা অগ্নিহোত্রীর গল্পে। এমএ পড়ার সময়ে তাঁর সহপাঠী, একমাত্র ইলিনা সেন যাঁর নাম উল্লেখ করেছেন, সেই শম্ভুনাথ কীভাবে অমিতার উজাড় করা ভালোবাসার পরিবর্তে তাঁকে দিয়েছেন তাঁর সম্পদের শোষণ, অবহেলা ও পরিত্যাগ। নিজের অভাবী জীবনের এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসাভার অনেকখানি অমিতা নিজেই বহন করতেন, নিজের রোজগারের এবং রৌপ্য ও স্বর্ণপদক বিক্রয়লব্ধ টাকা দিয়ে। ছোটবেলায় নেফ্রাইটিস তার জানান দেয় এই পরিশ্রমের আতিশয্যে।
ছোট ভাই দেবপ্রসাদ কারমাইকেল হাসপাতালে ছাত্রাবস্থায় তাঁকে ভর্তি করে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন, পরে পাটনায় বুলা মহলানবীশের ভগ্নিপতি ডা. শরদিন্দু ঘোষাল তাঁর চিকিৎসা করেও ব্যর্থ হন। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে তাঁর জন্মস্থান 888sport appয় ফিরে যেতে চান।
সেখানে কিছুদিন কবিরাজি চিকিৎসার পরে ২৬ বছর বয়সে মারা যান। শম্ভুনাথ জাতকুল মিলিয়ে বিয়ে করেন, এই প্রত্যাখ্যান জেনেই অমিতার এতবড় 888sport live chatীজীবন শেষ হয়। এই ব্যর্থপ্রণয় নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘প্রগতিসংহার’ নামে যে-গল্পটি লেখেন তার মধ্যে অমিতার জীবনের সংগ্রাম ও টানাপড়েনের আসল চেহারাটি কি ফুটে ওঠে?
অমিতার জীবন যেমন রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদে ভরা, তেমনি তাঁর কাছ থেকে অমিতা পেয়েছেন কিছু দুঃসহ প্রত্যাখ্যান। তারই কি একটি নিদর্শন যে অমিতা-শম্ভুনাথের জীবনের ওপরে তাঁর লেখা ‘প্রগতিসংহার’ নামক গল্পে খুকু-অমিতার সংগীত888sport live chatকে একেবারে ছেঁটে বাদ দেওয়া হয়েছে? অমিতা, যে পরম সাহসী ছিলেন, মাত্র ১৬ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে প্রায় সদুপদেশ দিয়ে একটি অসামান্য চিঠি লিখেছিলেন (এই বইয়ে গোটা চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে!) তার সম্পর্কে তাঁর এত জমা বিরক্তি ছিল যে, ১৯৩৫ সালে প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবীশের তত্ত্বাবধানে অমিতার যে-কটি অমূল্য রেকর্ডিং করা হয়েছিল তার প্রকাশ তিনি নিষিদ্ধ করেন, এমনকি অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও এগুলি বাজানোর ওপরে তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন! এছাড়া সাতরার চিঠিতে অমিতা সম্পর্কে তিনি যেভাবে বিষোদ্গার করেন, আক্ষরিক অর্থে ‘খুকু’ অমিতার পক্ষে কি তা সহ্য করা সম্ভব ছিল?
বইটি থেকে যে-তিনটি প্রসঙ্গ আমার চোখে পড়েছে সেগুলি উল্লেখ করে আমি এই রূঢ়তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করবো।
প্রথমত. আমার মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের এতবড় একটি ভান্ডার ‘খুকু’ যে পড়াশুনো এবং পরীক্ষার সাফল্যের দিকে মন দিতো, সেটা তাঁর মনে অস্বস্তির উদ্রেক করতো।
নিত্যপ্রিয় ঘোষ জানাচ্ছেন, খুকু ম্যাট্রিক পাশ করলে ডার্টিংটন হল থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘খুকু, তুই ভালো করে পাস করেছিস এতে খুব খুশি হলুম। এইবার বোধহয় গানবাজনায় মন দিতে পারবি।’ (পৃ ২৩)
অথবা, পার্থ বসুর বুলবুলিতে, ‘পড়াশুনো করবি, পরীক্ষা দিবি। ফলও আমি জানি ভালো হবেই… কিন্তু গানটাকে কখনও যেন এড়িয়ে যাস নে।’ (পৃ ১৬৫)
এই দ্বন্দ্ব কিন্তু খুকু-অমিতার জীবনকে গ্রাস করলো। চাকরি করতে করতে এমএ পড়লো। স্কুলে চাকরি, পরে অধ্যাপনার কাজ। কারণ নিজেকে ছাড়াও আর এক মানুষ যাকে তিনি ভালোবাসতেন তার ক্ষয়রোগের চিকিৎসার খরচ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মতবিরোধের দ্বিতীয় প্রসঙ্গ হয়ে রইল। কারণ তিনি খুকুকে আর্থিক সংগ্রাম থেকে মুক্ত করার জন্য সংগীত ভবনের অধ্যক্ষার কাজ নিতে বললেন, তাতে সচেতন তিনি শান্তিনিকেতনে তাঁর প্রিয় পরিবেশে থাকতে পারতেন। কিন্তু প্রণয়ীকে তৎক্ষণাৎ চাকরি না দেওয়ার অভিমানে খুকু এই চাকরি ছেড়ে দিলেন।
কিন্তু এসব দিয়েও কি রবীন্দ্রনাথের নিষেধাজ্ঞার রূঢ়তা বোঝা যায়? বোধহয় না। এর মধ্যে উঁকি মারে রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের সম্পর্কের তিক্ততা ও খুকু-অমিতা দিনেন্দ্রনাথের নৈকট্য। শেষের দিকে দিনেন্দ্রনাথের স্বরলিপি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আপত্তির কথা শোনা যায় এবং স্পষ্টবাদী খুকু দিনেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাওয়ায় রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর বিরক্তি চেপে রাখেননি। সব মিলিয়ে যে-তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল, ‘খুকু’র রেকর্ডের ওপরে রবীন্দ্রনাথের নিষেধাজ্ঞা কি তারই ফল? অনেকের মনে যেটা আছে যে, ‘খুকু’ রবীন্দ্রনাথের এত স্নেহধন্য হয়েও যাঁর উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে’ তাকে আঘাত দিয়েছিল! উভয়ের ক্ষমতার তারতম্যের কথা ভেবে বোঝা যায় যে, ‘খুকু’র জীবনে রবীন্দ্রনাথ কত বড়ো আঘাত হেনেছিলেন, সে-কথাটা মনে রেখেছে খুব অল্প মানুষ! আনন্দের কথা, অনীতা অগ্নিহোত্রী, পার্থ বসু যে মনে রেখেছিলেন, এই বইটি তা প্রকাশ করে খুকু-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
বলার কথা এইটুকু যে, ছোট মেয়ে বলে ‘খুকু’কে রবীন্দ্রনাথ অনুকম্পা দেখাননি, তাঁর গানের একজন যথার্থ 888sport live chatীকে সম্মান জানিয়েছেন, তাঁর কঠোর প্রত্যাখ্যানের মধ্যেও।
অমিতার শেষ অসুখে রবীন্দ্রনাথকে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে হাসপাতালে খুকুর প্রিয় জার্মান-পামারের বিস্কুট পাঠাতেন, যাতে সে সুস্থ হয়ে তাঁর কাছে তাঁর নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু শ্যাম-সমান মরণ খুকু-অমিতাকে নিয়ে যায়। তার এক বছরের মাথায় রবীন্দ্রনাথও পা বাড়ান মৃত্যুর শান্তি-পারাবারে।
অমিতা সেনের নিজের বলিষ্ঠ মর্মস্পর্শী লেখাগুলির মূল্যায়ন করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তার বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রবেশ করিয়ে দিলো চর্চাপদের অমিতা।
সবার শেষে, আমার একটি অনুযোগ রইলো : ‘নাম পরিচয়ে’র মধ্যে ‘বাবলিদি’ বাদ পড়লেন কেন? বইতে তাঁর কথা দু’বার আছে… পৃষ্ঠা ৮৩-তে। ইনি ছিলেন রেবা সরকার। অধ্যাপক সুশোভন সরকারের স্ত্রী বুলা মহলানবিশের বোন। এঁর এবং ওঁর পরিবারের সংগীতানুরাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও আছে। এঁর পরিচয় অবশ্য থাকা উচিত ছিল। আশা করি পরের সংস্করণে এই ত্রুটি শোধরানো যাবে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.