আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ
নামে কী আসে-যায়, কর্মে তার হবে জয় – এমন একটা প্রবাদবাক্যও আছে। কথায় বলে – বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়! পুষ্প তোমার নাম কী? ঘ্রাণে জগৎময়! শহীদুল হক নামেই প্রথম গ্রন্থ পারাপার লিখেছেন। পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করেন। এ-প্রসঙ্গে লেখক নিজেই জানিয়েছেন, ‘দেখা গেল যে শহীদুল হক নামে লোকে আমাকে চিনতে পারছে না। আমার লেখা ছাপানোর পরও ভাবছে যে, আমি না – কারণ, তখন অন্য একজন শহীদুল হক ছিলেন। টাইমসের সম্পাদক। লেখালেখি করতেন অবশ্যই। আরেকজন আছেন শহীদুল হক খান। তাঁদের দুজনের নামের সঙ্গে আমাকে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলা হচ্ছিল। তখন আমি বুঝলাম যে, এঁরা আমার সমস্যার জন্য নিশ্চয় তাঁদের নিজেদের নাম বদলাবেন না। আমি অখ্যাত। আমাকেই বদলাতে হবে অর্থাৎ আমার দাদার নাম ছিল জহিরউদ্দীন। হকের স্থলে সেই জহির গুঁজে দেওয়া’… এভাবেই যে একটা নামের সৃষ্টি হলো, শহীদুল জহির তা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন। শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) কথা888sport live footballিক হিসেবে ছিলেন সৃজনী প্রতিভার অধিকারী। নিত্যনতুন ভাষাবিন্যাস এবং রীতি-ব্যবহারে গল্প বলার কৌশল তাঁকে দিয়েছিল অন্য আর সবার থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান। স্বাধীনতা-উত্তর 888sport appsের গল্প888sport live footballে আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রায় কমেছে। সেখানে অবশ্যই বেড়েছে বিষয়বস্ত্তর বৈচিত্র্য। অধিকাংশ গাল্পিক যুদ্ধোত্তর হতাশা-অবক্ষয় এবং নৈরাজ্যের শব্দরূপ নির্মাণে সচেষ্ট হলেন। সেইসঙ্গে উৎসাহিত হলেন যন্ত্রণাদগ্ধ তারুণ্যের নষ্ট জীবনের 888sport live chatমূর্তি সৃজনে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অর্থাৎ সত্তর বা আশির দশকে বাংলা888sport live footballে ছোটগল্প নির্মাণে যেসব 888sport live chatীর আবির্ভাব ঘটে, তাঁদের মধ্যে বুলবুল চৌধুরী-আতা সরকার-আহমদ বশীর-মঞ্জু সরকার-সৈয়দ ইকবাল-হরিপদ দত্ত-শহীদুল জহির-মামুন হুসাইন-সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়-নাজিব ওয়াদুদ প্রমুখ 888sport live chatী প্রকৃত অর্থেই রেখেছেন প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর।
শহীদুল সত্তরের দশকে লেখালেখি শুরু করলেও আশির দশকে নিজেকে পুরোপুরি 888sport live footballাকাশে মেলে ধরেন, আর সে-কারণে আশির দশকের গল্পকার সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল ও শক্তিমান শহীদুল জহিরের গল্পে মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি ও সংগ্রাম নবীন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। কারণ তাঁর সমসাময়িক 888sport live footballিকদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক আলোড়িত। প্রেম-ভালোবাসা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ এবং মানুষের অস্তিত্বের সংকট তাঁর গল্পের প্রধান বিষয় এবং নিরীক্ষাধর্মী 888sport live chatজিজ্ঞাসার ছাপ স্পষ্ট লক্ষণীয়। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ পারাপার (১৯৮৫), দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ডুমুরখেকো মানুষ ও 888sport app গল্প (১৯৯৯), তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ডলু নদীর হাওয়া ও 888sport app গল্প (২০০৪)। তাছাড়া জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, যে রাতে পূর্ণিমা ছিলো, মুখের দিকে দেখি নামেও 888sport alternative link আছে। তাঁর প্রতিটি রচনায় জীবনবোধ খুব ঘনিষ্ঠভাবে ফুটে উঠেছে। বাস্তব-পরাবাস্তবের মাঝখানে অনিশ্চিত একটা অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে তিনি পছন্দ করতেন। চরিত্রদের একই সঙ্গে অন্তরঙ্গ ও অনিশ্চিত করে তুলতে পারেন, বিমূর্ত একটা ভাষায়, কিন্তু ঘনিষ্ঠ একটা বয়ানে তিনি বাস্তবের পর্দাপরা মানুষ ও প্রকৃতির জীবনের ভেতরের খবরটি বর্ণনা করতে পারেন। তাঁর ভাষায় বিমূর্ততা একটা স্তরে ছিল গভীর দ্যোতনা ও নিহিতার্থের একটা অবয়ব রচনার প্রয়াস। শহীদুলের গল্পে কাহিনি বাঁধাধরা নেই। একেবারে অন্যরকম। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছুকে ভিন্নতা দিয়েছেন, যা অন্য কোনো লেখকের লেখায় পাওয়া যায় না। কাহিনিকে সবটুকু ঢেলে না সাজিয়ে কিছুটা বোধের মধ্যে আটকে রেখেছেন তিনি। পাঠকের চিন্তায় বা মননে ঢুকিয়ে দিয়েছেন কৌশলে। হয়তো এখানেই শহীদুল জহিরের স্বাতন্ত্র্য।
শহীদুল জহিরের গল্প অন্য কারো মতো নয়, তিনি নিজেই নিজের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী। নিজেকে এভাবে নির্মাণ করেছেন বলেই তাঁর গল্পের বিষয়চরিত্রে আঙ্গিক ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো আহমদ বশীর যেমন পুরনো 888sport appর জনজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নিয়ে গল্প রচনা করেছেন, শহীদুল জহিরের অধিকাংশ গল্পের পটভূমিতে তেমনি ভূতের গলি বারংবার ঘুরেফিরে এসেছে। পুরনো 888sport appর মানুষের চালচিত্র ও আচার-আচরণ তাঁর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। 888sport live footballিক বিমল কর বা আবু রুশ্দ যেমন তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে একটা লেখাও লেখেননি বলেই গ্রামীণ গল্পের দিকে হাত বাড়াননি, শহীদুল জহিরও তাঁর চেনা জগতের বাইরে খুব একটা পা বাড়াননি। 888sport live footballিক মাহমুদুল হক বা আবদুল মান্নান সৈয়দও চেনা পরিবেশের মানুষজন নিয়েই 888sport live football রচনা করেছেন। পাঠককে 888sport app শহরের জীবনবৈচিত্র্য দেখার এবং এর স্বাদ গ্রহণ করার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে মানুষের যে-সম্পর্ক তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে পুরনো 888sport appর আঞ্চলিক ভাষাকে দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছেন।
পারাপার গল্পগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এই গল্পগ্রন্থ সম্বন্ধে শহীদুল জহির জানিয়েছেন, পারাপারের অধিকাংশ গল্প অনেকটা ট্র্যাডিশনাল স্ট্রাকচারে লেখা। প্রতিটি গল্পের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যে একটি স্বর-বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। রীতি বা কাঠামোগত দিক বিচার করলে অনেকটা আবদুল মান্নান সৈয়দের গল্পগ্রন্থ চলো যাই পরোক্ষের সঙ্গে মিল হলেও কোথায় একটা অমিলও জহিরকে ভিন্নতা দিয়েছে। শোষণ-বঞ্চনা-সমাজভাবনার দিক যেভাবে ফুটে উঠেছে, তাতে ত্রিশের মার্কসীয় ভাবনার পুনরুত্থানের একটা ছবির মিল আছে। গল্পগুলো প্রতিবাদের চেতনার ফসল বলে মনে হয়।
‘ভালোবাসা’ গল্পটিতে অন্যরকম এক ভালোবাসার রূপ দিয়েছেন জহির। তুচ্ছ একটা ফুল দিয়ে যে মানুষের মনকে জয় করা যায়, তার সত্যিকার চিত্রাঙ্কন করেছেন তিনি ‘ভালোবাসা’ নামক গল্পে। নিম্নবিত্ত মানুষের সাংসারিক জীবনের একটা ছবি ফুটে উঠেছে এখানে, যেখানে হাফিজদ্দি গৃহকর্তা এবং তার স্ত্রী আবেদা আর তাদের একমাত্র মেয়ে তহুরাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। এর মধ্যে ফুল আসে অলক্ষে গৃহকর্তার হাত ধরে এবং ভালোবাসার একটা টিয়া নেচে ওঠে আঙিনায়। আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছিল কী এক সুখে। হঠাৎ ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয়, কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়। মনস্তাত্ত্বিক এ-গল্পটিতে মানুষের ভালোবাসাকে আরো সজীব-প্রাণোচ্ছল করা হয়েছে। মনোজগতের কামনা-বাসনাকে এভাবে রূপ দেওয়া এবং তাকে জীবন-সান্নিধ্যে উপস্থাপন করা শহীদুলের 888sport live chatসৃষ্টির মোক্ষম স্বাক্ষর। ফুল দিয়ে জাদু করা যায়… এমন কথা শুনে আরো ভালো লাগে। মানবিকতা গল্পের ছত্রে ছত্রে লক্ষ করা যায়।
‘মাটি ও মানুষের রং’ গল্পটি পুরোদস্ত্তর মনস্তাত্ত্বিক, ধনী-গরিবের যে-তারতাম্য তার প্রকৃত একটা চিত্র শহীদুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দারিদ্রে্যর প্রতি যে-অবিচার করা হয়, অবিচার করা হয় শ্রেণিহীন মানুষের ওপর, তা রূপকের মধ্য দিয়ে শহীদুল বয়ান করেছেন। আমাদের এই সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে ধনী-গরিবের বৈষম্যে। এখানে মানুষের আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, মূল্য নেই মানবিকতার। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। অভাব বা দারিদ্র্য স্বপ্নকে কোনোভাবে আটকাতে পারে না। আম্বিয়াকে ঘরে তুলে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল একসময় আসিয়া খাতুনের। মালেকের বউ হবে – এমন স্বপ্নও দেখত সে। বাস্তবে কিন্তু সম্ভব হয়নি। কারণ আম্বিয়া শান্ত স্বভাবের হলেও কচি বড়া পেয়ারার মতো ঘনশ্যাম গায়ের রং। এমন মেয়ের দ্বারা মালেকের ফুটফুটে ছেলে বিয়োনো সম্ভব নয় জেনে আম্বিয়াকে তার পছন্দ হয়নি। আম্বিয়ার বিয়ে হয় একটু দূরে একটা গরিব ঘরে। মনের ভেতরের যে-ক্ষোভ, তা দিনে দিনে স্ফুলিঙ্গের মতো দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকে। ভেতরে একটা কাঁটা মনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে, যা হয়তো কাউকে দেখানো যায় না। কালো-সাদার মধ্যে যে-বৈষম্য, ধনী-গরিবের মধ্যে যে-বৈষম্য, তা চোখে অতখানি দেখা না গেলেও ভেতরে-ভেতরে বেড়েই চলে দিবানিশি এবং একটা সময় তা অগ্নিগিরির মতো ফেটে বিস্ফোরিত হয়। গল্পটি গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত। গ্রামীণ যে-বৈষম্য তা সাদা চোখে ধরা পড়ে। পাঠক গল্পটির শেষ দৃশ্যে দেখতে পায়, আম্বিয়া বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে। একদিন পাড়ায় ঘুরতে বের হয়। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যায় হারুর মাকে। আসিয়া খাতুনের বাড়ি বেড়াতে এলে মালেকের ছেলে ফজুকে দেখে। কালো এবং মাথায় খুঁজলি। অনেক কথার মধ্যে হারুর মা জানায়, আমাগো আম্বির কিন্তুক পোলা হইছে একখান। বাপে কালো, মায় কালো পোলাপাইন আইছে কী সোন্দর। রাজার পোলার লান। হারুর মায়ের কথা শুনে আসিয়া খাতুন নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। একটু আগে নিজের নাতির নিন্দা করেছেন। তাই সঞ্চিত ক্ষোভ রাসায়নিক কোনো এক বিক্রিয়ায় বিষে পরিণত হয়ে নিক্ষিপ্ত হলো হারুর মায়ের ওপর। ফের ফজুকে কোলে তুলে নিয়ে অত্যন্ত সহজ স্বরে বললেন, ছিনালগো পোলা সুন্দরই হয়…। মানুষ যে কতখানি ঈর্ষাপরায়ণ হয় এবং তার ভেতরের মানুষটা কতটা হিংস্র প্রকৃতির হতে পারে, তার একটা রূপ চিত্রায়ণ করেছেন জহির। কিন্তু আম্বিয়া তার চাচির অমন কথা সইতে পারেনি। বিদ্রোহী হয়ে বলে ওঠে – চাচি সাত গেরাম দূরে বিয়া দিছইন। একদিন আপনেরে আমার বাইত লয়া যামু… দেকবাইন চাচি রোইদে কেমুন ক্ষেত জ্বইলা-জ্বইলা কালা অয়…। তাতেও আম্বির শরীরের জেদ কমে না। জিহবা আগুনে লকলক করে ওঠে। আমার সোয়ামির কুমোরের লুঙ্গি খুইল্লা দিলে বুজার পারবেন আমনেরও এইরম পোলা অইতো পারে। আমার ছিনাল হওন লাগে নাই সুন্দর পোলার লাইগ্গা… অনেক বড় প্রতিবাদ এখানে প্রকাশ পেয়েছে। সুতীক্ষ্ণ ছুরির ফালায় আসিয়া খাতুনকে কেটে ফেলা হলো, দানব মানুষের প্রতি এমন অস্ত্র-ব্যবহারই প্রকৃত যুদ্ধ। সে-যুদ্ধের এক সফল সৈনিক আম্বিয়া। সংগ্রামমুখর একটা দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় ‘পারাপার’ গল্পে।
গরিবকে ঠকানোর যে একটা রেওয়াজ আজন্মকাল তৈরি করেছে ধনীক শ্রেণি, তার স্পষ্ট প্রতিরূপ চিত্রায়িত হয়েছে এতে। ওলি এখানে বেকার যুবক। চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতেই জীবন শেষ। আমরা দেখি, স্টিমারে অল্পবয়সী দুটো কুলি, আবুল আর বশিরকে। ওদের সঙ্গে ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় ওলির এবং তাদের সঙ্গে জীবনসংগ্রামের টুকটাক অনেক গালগল্প হয়। আগেই সে অন্যের বেডিং পাহারার যে-দায়িত্ব নেয়, মাঝে সে-বেডিং মাথায় করে কুলিদুটো স্টিমার থেকে ট্রেনে নিয়ে যাওয়ার মজুরি বাবদ যা দাবি করে, তাতে রাজি হয় একসময়; কিন্তু ওলি জানায়, বেডিং দুটো তার নয়। তার কাছে জিম্মা রেখে গেছে এক সাহেব। ঘটনাক্রমে স্টিমার যখন ঘাটে আসে, বশির-আবুল তাড়াহুড়ো করে নিতে আসে। ভদ্রলোকটি কিন্তু দুই টাকার বেশি দেবে না ওদের মজুরি। শেষ পর্যন্ত রাজি হয় দুজনে। এখানে মধ্যস্থতায় ওলির একটা বড় ভূমিকা ছিল। বিশাল-বিশাল দুটো বেডিং অল্পবয়সী ছেলেদের মাথায় ওঠে সামান্য টাকার বিনিময়ে। প্রকৃতপক্ষে আবুল ওই বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে হেঁটে গেলেও সামলে রাখতে পারেনি। তাই নদীর পানিতে পড়ে যায় তার বেডিংটা। তারপরই অনাসৃষ্টি বাধে। এখানে একটা প্রতিবাদ লেখক তুলে ধরেছেন। ধনীক শ্রেণির সঙ্গে পিছিয়ে-পড়া মানুষগুলো কোনোভাবেই সামনাসামনি পেরে না উঠলেও কোথাও না কোথাও প্রতিবাদে ফেটে পড়ে তার পঞ্চেন্দ্রিয় শক্তি। তার পরের দৃশ্যে পাঠক আরো বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। কুলি দুটো ছেলের হয়ে কথা বলেছিল বলে সাহেব ওলিকে সমান অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করে। একপর্যায়ে ওলির গায়ে হাত তোলে। চড় খেয়ে ওলির চোখে পানি এসে যায়। গাল বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। ওলি একবার লোকটার মুখের দিকে তাকায়। থুতনিটা উঁচু করে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে লোকটা। ওলি ঠোঁটে লোনা পানির স্বাদ পেল। চকিতে, বোধ আর বোধহীনতাকে তুচ্ছ করে। একটা অনুজ্ঞা রক্তের ভেতর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহের মতো দ্রুত শরীরের সর্বত্র, আঙুলের ডগায়, চোখের তারায়; হাতের পেশি চিতার মতো তৈরি হয়ে গেল। ওলির ডান হাতের মুঠটা লোকটার চোয়ালে স্পর্শ করল। ছিটকে পড়ে গেল লোকটা। গল্পটিতে প্রতিবাদের ভাষাকে জহির জোরালো করেছেন শক্তি দিয়ে। হয়তো তা-ই সমীচীন ছিল। প্রতীকীর মাধ্যমে লেখক শ্রেণিশত্রু নিপাতের কথা বলতে চেয়েছেন এখানে। ভাগ দাও, নয়তো ছিনিয়ে নাও। যুদ্ধ করো, সংগ্রাম করো, নয়তো মুক্তি নেই। মৃত্যুকে ভয় নয়… জয় করো। নিজেকে গুটিয়ে রাখার দিন নেই – এমনই বৈচিত্র্যধর্মী গল্প ‘পারপার’।
‘তোরাব শেখ’ গল্পটি একটি চমৎকার আঙ্গিকের শক্তিশালী গল্প। জহিরের গল্পে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা প্রচুর। অনেক ক্ষেত্রে তিনি শব্দ নিয়ে এঁকেছেন চিত্র। কাহিনিকে আরো স্বাবলম্বী ও উদ্ভাসিত করতে এক ধরনের কাব্যময়তা তৈরি করেছেন। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিদিনের দিনলিপি নিখুঁতভাবে দেখেছেন অথবা অনুভব করেছেন বলেই অনেক চিত্র অন্ধকারাচ্ছন্নের মধ্যেও তুলে ধরেছেন বলিষ্ঠভাবে। ‘তোরাব শেখ’ গল্পটিতে তোরাবকে লেখক এমনভাবে দেখিয়েছেন, যে বয়স্ক মানুষ, সারাদিন ঝুপরিতে থাকে। তার বউ রহিমা আছে। ছেলে জমির, ছেলেবউ লতিফা, এমনকি একটা মেয়ে লালবানুও আছে সংসারে। আরো আছে প্রতিবেশী সহচর নিযাম। সবাই তারা কাজ করে। জীবনসংগ্রামের যুদ্ধে কেউই পিছিয়ে নেই; কিন্তু বয়স্ক মানুষ তোরাব ঝুপরিতে থাকে। তার দিন কাটে না। কোনো কিছুই ভালো লাগে না। রাতেও ঘুম হয় না। কাজে যেতে চায় জমির নিষেধ করলেও। একদিন লালবানুর বিয়ের জন্য জমির বাপকে বলে। তোরাব জানতে চায় – পাত্র কে? মজিদ মিয়ার কথা শুনে জানায়, ওর লগে আমি মাইয়ার বিয়া দিমু না। দেখা যায়, তোরাবের নির্দেশ লালবানু মানতে পারে না। তাই তিনদিন পরই লালবানু পালায়। তোরাব শেখ নিজের মধ্যে সংকুচিত হতে-হতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কারণ এই সংসারে তার কোনো মূল্য নেই। নিজের বউ, ছেলে-ছেলেবউ এমনকি নিজের মেয়েও তাকে দাম দেয় না। তাই সে চলে যায়। মনের কষ্টে সত্যি সত্যিই নিরুদ্দেশ হয়। একটা রহস্য শেষাবধি রয়েই যায়। সে-রহস্য ভেদ করতে পারে না কেউ। মানুষের জীবন একটা গতির মধ্যে অতিবাহিত হয়। সেই গতি ধরেই মানুষ নিজেকে চিনতে পারে।
কতোরকম মানুষ আছে জগতে। কত রকম তার ফন্দি-ফিকির। সব রহস্য তো উন্মোচিত হয় না। কেউ বুঝতে পারে, কেউ বা পারে না। তারপরও মানুষ অনেকরকম রং মেখে জগতে চলে বেঁচে থাকার জন্য। এই বেঁচে থাকাটা মানুষের অন্যতম চাহিদা। কিন্তু কেন মানুষ বাঁচে, তার কোনো সঠিক উত্তর কেউই দিতে পারে না। ‘ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে’ গল্পটি পুরনো 888sport appর প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত। একটা লোক কোথা থেকে আবির্ভাব হলো একদিন। লোকটার নাম আলফাজুদ্দিন আহম্মদ নবাব। তার রফিক নামে একটা ছেলেও আছে। একদিন তার জরিনা নামে একটা বউও ছিল, কিন্তু মরে গেছে। লোকটা আনন্দপাল লেনের বাসিন্দা হতে চায়। জীবনযুদ্ধের এক পরাজিত সৈনিক সে। গল্পটিতে ঘেয়ো মানুষের কান্না ফুটে উঠলেও কড়া রোদের গন্ধ তাকে বিচলিত করে তোলে। সবাই তাকে বদনাম দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার যে-চক্রান্ত করে, তার রূপ দেখা যায় শেষ পর্যন্ত। গল্পে অনেক চিন্তারহস্য এবং ভাষার জাদু পাঠককে অন্য জগতে নিয়ে যায়। শহীদুল জহির পুরনো 888sport appর ভাষাকে হুবহু ব্যবহার করেননি কোথাও। কিছুটা নিজের মতো সাজিয়ে তোলেন ফুলের বাগান। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাব্যবহারেও সিদ্ধতা তাঁর ছিল বরাবরই। রাজনীতি-সচেতন জহিরের গল্পভাষা-গল্পবিষয় এবং গল্পভাবনা প্রায় ঘুরেফিরে একই রকম থেকে গেছে দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গ বা 888sport appsের যে-888sport live footballধারা, যে-ভাষাবিন্যাস দীর্ঘকাল ধরে এই দুই অঞ্চলের 888sport live footballাকাশে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন শহীদুল জহিরের 888sport live footballে ভাষা-ব্যবহার। ভাষার যে-রহস্য, সে-রহস্যের মধ্যে একটা বাঁক নির্মাণ করেছেন তিনি। ভাষা-ব্যবহারে যদিও খানিকটা মিল দেখতে পাওয়া যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সঙ্গে। বিষয়বৈচিত্র্যে এবং পটভূমির সঙ্গে সাদৃশ্য দেখা যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের কমলকুমার মজুমদার ভিন্ন আঙ্গিকের একটা ভাষা-কৌশল ব্যবহার করেছেন।
জহিরের নিজস্ব ভাষাবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কারো মিল নেই তার সমসাময়িক 888sport live footballিকদের মধ্যে। তাঁর গল্প বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশ্রণে নির্মিত। আবদুল মান্নান সৈয়দ-সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পথ অনুকরণ করা। ভাষাগত কিছু মিল কমলকুমার মজুমদার-সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সমগোত্রীয়। মার্কেজের জাদুবাস্তবতাও তাঁকে বারংবার টেনেছে বলে অনুধাবন করা যায়। ছোটগল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন 888sport live chatনৈপুণ্যের এক অনতিক্রান্ত এবং প্রতিষ্ঠিতাচিহ্নিত, 888sport live chatবোধ ও জীবনচেতনার প্রশ্নে পূর্বাপর সতর্ক-সপ্রতিভ এবং বিশ্ববিস্তারী শহীদুল জহিরের গল্পসমূহ বাংলা888sport live footballের ধারা সংযোজন করছে স্বকীয় মাত্রায় গল্পের বিষয় নির্বাচনে তিনি ছিলেন জনজীবন সম্পৃক্ত, বিশেষ করে পুরনো 888sport appর জীবন তাঁকে এনে দিয়েছে অন্য এক জাদু। সে-জাদুর স্পর্শে গল্প পেয়েছে নতুন যৌবন, নতুন জিজ্ঞাসা, বক্তব্য ও প্রকরণে সর্বজনীনতা। চেতনা এবং আঙ্গিকে জহির কখনো ছাড় দেননি। জীবনবোধের অনুবিশ্ব মানুষের অভীপ্সা-নৈঃসঙ্গ্য-শঙ্কা-অনুশোচনা-নিজের অস্তিত্ব-স্বনিষ্ঠ প্রভৃতি তাঁর গল্পের উপজীব্য। সেইসঙ্গে মনস্তত্ত্বধর্মী ও মনোময় তাঁর গল্পের জটিল হাতছানি।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.