অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস প্রেক্ষাগৃহের পরদা খুলতেই দেখা যায় মঞ্চের মাঝে বসে আছেন শাঁওলী মিত্র। পেছনে দোহারের দল। শুরুর আগেও শুরু থাকে। সেটা ছিল কথকের প্রাক্কথন। তিনি বলেন, পাঠের আগে আমি কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই। এটা আশির দশকের কথা। আজকে আমার দুজনের কথা খুব মনে পড়ছে। একজন হলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য। যিনি বলেছিলেন, ‘সীতা’কে নিয়ে কিছু ভাবো। প্রচুর উপাদান পাবে। আর একজনও বলেছিলেন, ‘সীতা’ নিয়ে কিছু ভাবতে। তিনি শিবনারায়ণ রায়। আজ দুজনেই নেই।
সীতা সম্পর্কে আমাকে এঁরা অনুরোধ করেছিলেন ভাবতে, কিন্তু তখন আমার ভেবে দেখা হয়নি যে সীতার মধ্যে কী কী নাটকীয়তা রয়েছে। কেমন করে তা বার করে আনা যায় সেসব কথা। পরে সীতাকে নিয়ে একটি 888sport live লিখি। তারও অনেক পরে ২০১৫ সাল নাগাদ অর্পিতা আমাকে বলে যে, একটু নাট্য-আকারে সীতার কথা যদি পড়া যায়। তারপর গানও লেখা হয়েছিল। গান লিখে সুর করেছিলেন তড়িৎ ভট্টাচার্য। যিনি দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অন্যলোকে। তারপর আর কাজটা করা হয়ে উঠছিল না। আগস্ট মাসে আমাদের নাট্য তর্পণ থাকে। তার আগে অর্পিতা আবার সীতার কথা তুললো। আবার মেজে-ঘষে শুরু করলাম।
সীতার উপস্থাপনা প্রসঙ্গে শাঁওলী মিত্র বলেন, কাজ করতে করতে মনে হয়েছে সীতা যে-রকমভাবে আমাদের কাছে আছে, এখন আছে, তার একটা অন্য পাশও রয়েছে। দেখতে চেয়েছি যে সীতা নিজের জীবনে কী কী দেখতে দেখতে গিয়েছে। তার অন্যায়, তার নির্বুদ্ধিতা, আবার তার ভালোত্ব, তার ভালোবাসা ইত্যাদি। এভাবে ভেবে ভেবে একটা জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। দ্রৌপদী আর সীতা, দুই-ই তো মহাকাব্যিক চরিত্র। তাদের মধ্যে মিল বা অমিলগুলো … দুটো যে একদম আলাদা দুটো চরিত্র তা রামায়ণ আর মহাভারত পড়লেই বুঝতে পারা যায়। তেমন কোনো মিল নেই। গুলিয়ে যাওয়া সম্ভবই নয়। স্ক্রিপ্টটা তো আমিই লিখেছি। স্ক্রিপ্টটা যখন লিখেছি, তখন সীতার মতো করে ভাবতে ভাবতে এগোনোর চেষ্টা করেছি। সীতাকে নিয়ে একটা মৌলিক সৃষ্টি এই নাটক। ফলে দ্রৌপদীর সঙ্গে তুলনার প্রশ্নই উঠছে না।
কথাগুলো বলার পর তিনি নিজেকে ভেতরে ভেতরে তৈরি করে নিলেন কথকের ভূমিকায়।
মঞ্চে কথক শাঁওলী মিত্র রূপান্তরিত হলেন সীতায়। তাঁর উচ্চারণ এবং কণ্ঠ-অভিনয় মুগ্ধ করে রাখছিল। প্রথমেই মঞ্চের পেছনে বসা দোহারের দল যখন গান ধরেন তখনই প্রেক্ষাগৃহের অন্দরমহলে চমৎকার এক গ্রামীণ পাঁচালি-পাঠ অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরি হয়ে ওঠে। যেমনটা আমরা শুনেছি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে কিংবা 888sport app গ্রামেও। ছোটবেলায় দেখা রামযাত্রাতেও এমন সুর শুনেছি। এখনো প্রত্যন্ত গ্রামে রামযাত্রা হয়।
প্রেক্ষাগৃহে যখনই লোকসুর কিংবা আবহাওয়া তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। মুহূর্তে তা ভেঙে শাঁওলী মিত্র চলে আসছেন কথকের ভূমিকায়। তাঁর কথা বা পাঠ শোনার জন্য শ্রোতা/ দর্শকেরা উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন – কী শোনাবেন তিনি! সীতা এক বর্ণময় চরিত্র। তাঁর জীবন ঘিরে কত ঘটনা। কত টানাপড়েন। সেই টানাপড়েনে সীতা ব্যথিত কিন্তু ক্লান্ত নন। মঞ্চেও একটানা পাঠে শাঁওলী মিত্র ক্লান্ত নন, কিন্তু সীতার জন্য তিনিও ব্যথিত। সীতার সেই ব্যথা, সীতার যন্ত্রণা, অপমানিত সীতা ধরা দেন শাঁওলী মিত্রের কণ্ঠে। হয়তো এটা তাঁর অভিনয়। কিন্তু চরিত্রের প্রতি অনুভূতি না-থাকলে শাঁওলী মিত্রের কণ্ঠ কখনো ওইভাবে শ্রোতা/ দর্শকের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠত না। প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত কেউ একজনও উসখুস করেন না। একজনও বসে থাকা অবস্থায় পাশ ফিরতেও লজ্জাবোধ করেন, নাকি আনমনা হয়ে কিছু ‘মিস’হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চুপচাপ মঞ্চে উপবিষ্ট কথক শাঁওলী মিত্রের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাঠ শোনেন।
রামায়ণের মহানায়িকা সীতা। জনকনন্দিনী। জনকের কন্যা তাই জানকী। সীতা শব্দের অর্থ হলো রেখা। অর্থাৎ লাঙলের রেখা। লাঙল দিয়ে ক্ষেত বা মাঠ চষার সময় যে-দাগ তৈরি হয়, সেই দাগই সীতা। চাষের জমিতে লাঙলের ফলায় তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন জনক। তাই শিশুকন্যার নাম হলো সীতা। এ-কাহিনি বা গল্প আমাদের বহুশ্রুত। তবু আমরা কান খাড়া রেখে শুনি কথক শাঁওলী মিত্রের কাছে। তাঁর বাচনভঙ্গি এতটাই জাদুমিশ্রিত যে, মনে হয় তিনি নতুনভাবে সীতার কথা বলছেন। সীতা সম্পর্কে তিনি সংজ্ঞা দিচ্ছেন। জনক ঘোষণা করেন, ‘হরধনুতে যিনি জ্যা আরোপ করতে পারবেন, তাঁর সঙ্গেই আমার কন্যা সীতার বিবাহ দেব।’ রাম জিতে নিলেন সীতার মালা।
সীতার অসাধারণ সৌন্দর্য। মুখটি পূর্ণিমার চাঁদের লাবণ্যে ভরা।
নাটকীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী শাঁওলী মিত্রের কণ্ঠের ভাবপ্রকাশ মঞ্চে একটা ছবি দাঁড় করিয়ে দেয় শ্রোতা-দর্শকের সামনে। রাবণের সীতা হরণের বহুদিন পর সীতাকে রামের সামনে আনা হয়েছে। কতদিন পর সীতা দেখছেন রামকে, রাম দেখছেন সীতাকে। রামের কথাবার্তা মোটেও ভালো লাগেনি সীতার। যে-কোনো 888sport promo codeরই কোনো পুরুষের এমন কথা ভালো লাগার কথা নয়। রামের কথা থেকে এমন ভাবই বেরিয়ে আসে – সীতা তোমার মঙ্গল হোক। আমি অর্থাৎ রাম যে যুদ্ধ করেছেন তা সীতার জন্য নয়। নিজের চরিত্র রক্ষার জন্য যুদ্ধ। রাম বলেন, ‘সীতা তোমাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি। এমনকি তোমার দিকে তাকাতেও পারছি না। রাবণ তোমার গায়ে হাত দিয়েছে। তোমার দিকে খারাপ দৃষ্টি দিয়েছে। এখন তোমাকে ফিরিয়ে নিলে আমি কী বলব সবাইকে! তোমার প্রতি আমার আর কোনো অনুভূতি নেই, আকর্ষণ নেই। সীতা তুমি ইচ্ছে করলেই লক্ষ্মণ, ভরত, সুগ্রীব, শত্রুঘœ, এমনকি বিভীষণ – যাকে ইচ্ছে বেছে নিতে পারো। তুমি সুন্দরী। রাবণ নিশ্চয়ই তোমাকে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি।’
সকলের উপস্থিতিতে, সকলের সামনে রামের এহেন বাক্যপ্রয়োগে সীতা লজ্জায় নিজের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন। পরমুহূর্তে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে রামকে বলেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলছেন কেন? আপনি হনুমানকে যখন আমার খোঁজে লংকায় পাঠিয়েছিলেন, তখনই আমাকে বর্জন করার কথা কেন বলে দেননি! তাহলে শুধু শুধু এত কষ্ট করতে হতো না। আমাকে যখন রাবণ হরণ করে তখন আমি ছিলাম পরাধীন, হুঁশ ছিল না। রাবণ আমাকে স্পর্শ করেছিল। সে-দোষ তো আমার নয়। আমি তো তাঁকে স্পর্শ করিনি। যে-হৃদয় আমার স্বাধীন ছিল সে তো আপনারই ছিল। আপনি বলবান কিন্তু বীর নন।’
সীতাপাঠের এই অংশটি যখন পাঠ করছিলেন শাঁওলী মিত্র তখন তাঁর কণ্ঠে সীতার অভিমান, সীতার প্রতিবাদ প্রক্ষেপ করছিলেন
শ্রোতা/ দর্শকের প্রতি। দারুণ এক নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি হয় প্রেক্ষাগৃহজুড়ে।
প্রেক্ষাগৃহের এক স্থানে দাঁড়িয়ে সীতা যেন রামের উদ্দেশে বলেন, ‘জনক আমার পিতা, বসুধা আমার মাতা। এসব নিয়ে একটিবারও চিন্তাভাবনা করলেন না। আমার পবিত্র নিষ্পাপ চরিত্রকে সম্মান দিলেন না। আমার পতিভক্তি এক নিমেষে নস্যাৎ করে দিলেন।’
লক্ষ্মণকে বললেন, ‘আমার চিতা সাজাও। অগ্নিতে আত্মাহুতি দেব।’ রামও ইঙ্গিতে সম্মতি দিলেন লক্ষ্মণকে। চিতার লেলিহান শিখা গ্রাস করল। সীতাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন অগ্নি। সীতাকে দাহ-মৃত্যু থেকে উদ্ধার করলেন অগ্নি। জনক-নন্দিনীকে রামের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘তুমি নিষ্পাপ বিশুদ্ধ চরিত্র সীতাকে গ্রহণ করো। এর মন, প্রাণ সবই তোমার প্রতি সমর্পিতা।’ রাম সামান্য ভেবে খুবই ডিপ্লোম্যাটিক উত্তর দেন, ‘সীতা যে অপাপবিদ্ধা জানতাম। সকলের মনে প্রত্যয়ের জন্য ওর অগ্নিশুদ্ধির প্রয়োজন ছিল।’
সীতার আবার মনে হয়, রাম বলবান, কিন্তু বীর নন। তাই হয়তো অযোধ্যার ফিসফিসানি কানে আসতেই সীতাকে বিসর্জন দেওয়ার কথা মাথায় আসে রামের। রাজা রাম পরাজিত হন সীতা-পতি রামের কাছে। যখন প্রেম-ভালোবাসার কথা ওঠে, সীতা তখন রামকে বলেন, ‘আমি ভালোবাসি … আমি ভালোবাসি… ভালো না-বেসে থাকতে পারি না।’ এই সময় পাঠ-পরিবেশকে শাঁওলী মিত্র চূড়ান্ত এক নাটকীয় জায়গায় পৌঁছে দেন। শ্রোতারা ভাবছিলেন অন্য কোনো কথা শুনবেন কথকের মুখ দিয়ে, সীতার অন্য কোনো শব্দের প্রকাশ। কিন্তু কী অবলীলায় কথক শ্রোতাদের চূড়ান্ত উত্তেজনায় রেখে – ভালো না-বেসে থাকতে পারি না। এরপর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।
সীতা যখন বুঝতে পারলেন তাঁকে বিসর্জন দেওয়া হবে তখন তিনি দেবর লক্ষ্মণকে বললেন, ‘লক্ষ্মণ তুমি আমার গর্ভলক্ষণ
নিজ-চোখে দেখে যাও। নইলে সন্তানের পিতৃত্ব নিয়েও অনেক কথা উঠবে, আঙুল তুলবে।’
বাল্মীকির আশ্রমে সীতাকে দিয়ে আসবার ভার পড়ে লক্ষ্মণের ওপর। লক্ষ্মণ জানেন, সীতার এ যাওয়া নয়, নির্বাসন। সীতা এই নির্বাসনের বিন্দুবিসর্গ জানেন না। তিনি তো রামকে বলেছিলেন, তিনি সন্তানসম্ভবা। তাই তিনি কোনো মুনি-ঋষির আশ্রমে কাটিয়ে আসতে চান। তপোবন দেখতে চান। তাই লক্ষ্মণ সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে পৌঁছে দিতে যাবেন।
পরিহাসছলে লক্ষ্মণকে বলেন সীতা, ‘চোদ্দো বছর একসঙ্গে বনে কাটিয়ে তুমি কী আমাকে ভুলে গেছো! বোধহয় কখনো কখনো মন্দ বলেছি, তাই মনে হয় তুমি আমার ওপর খুশি নও।’
রাম অনেক ব্যথা দিয়েছেন সীতাকে, অনেক সন্দেহের তীর ছুড়েছেন সীতার দিকে, তবু তিনি রামের প্রতি আস্থা হারাননি। রামের প্রতি এতটুকু ভালোবাসা কমেনি। তাই তো তিনি কথকের মাধ্যমে বলতে পারেন, ‘বারবার আমি ভালোবেসেছি, ভালো না-বেসে পারিনি।’ রামের প্রতি শেষমেশ সীতার উপলব্ধি – ‘তুমি বলবান, বীর নও।’
কথক শাঁওলী মিত্র লব-কুশের কথাও বলেছেন। তাঁরা এসেছেন সীতার প্রসঙ্গ ধরেই। কথক যখন পাঠ করেন, তখন আলোর একটা ভূমিকা থাকে মঞ্চে। নাটকের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী আলোকে ব্যবহার করা এ এক মস্ত কাজ। যদিও সীতাপাঠে শাঁওলী মিত্রের কথকের ভূমিকায় আলোর প্রয়োজন খুব-একটা জরুরি হয়ে ওঠে না। তবু সবার অলক্ষে আলোর ব্যবহার মঞ্চকে নাটকীয় করে তুলেছে অর্পিতা ঘোষের আলোক-পরিকল্পনা। তাঁর সঙ্গে মুন্শিয়ানা দেখিয়েছেন আলো-ব্যবস্থাপক কল্যাণ ঘোষ। দুজনেরই প্রশংসাবাদ প্রাপ্য। সেইসঙ্গে ধন্যবাদ দিতে হয় দোহারদের। যাঁরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কথককে সাহায্য করলেন। সবমিলিয়ে পঞ্চম বৈদিকের সীতাপাঠ চমৎকার এক প্রযোজনা।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.