888sport app download apk latest version : জাভেদ ইকবাল
[বানু মুশতাক (১৯৪৮-)। ভারতের কর্নাটক রাজ্যের কন্নড় ভাষার একজন প্রসিদ্ধ 888sport live footballিক। ছোটগল্প সংকলন হার্ট ল্যাম্প-এর জন্য লেখিকা ২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক বুকার 888sport app download bd লাভ করেন।]
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমার মতো কোটি কোটি
ক্ষুদ্রস্য-ক্ষুদ্র প্রাণ সৃজনের পর, আমাদের ভালো কাজের জন্য স্বর্গ আর মন্দ কাজের জন্য নরক বানিয়ে, যে সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাদের ফেরার অপেক্ষায় বসে আছো : হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি নিশ্চয়ই স্বর্গের মিষ্টি সুবাস উপভোগের জন্য এখন স্বর্গের বাগানে বসে আছো। কিংবা তোমার সামনে নূরে উদ্ভাসিত বদনে, করজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা তোমার দূতদের হুকুম জারি করে চলেছো। আমি হয়তো তোমারই আত্মার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারি; তবু তোমাকে একটা অনুরোধ করার অধিকার তো আমার আছে, তাই না? কেননা …
এটা সেই সময়ের কথা, যখন আমি শারীরিক-মানসিকভাবে বিশেষরকম দুর্বল-ভঙ্গুর ছিলাম, অসহায়-অরক্ষিত ছিলাম। অবশ্য, সত্যিকার অর্থে তখন আমার খুব বেশি কোনো সমস্যা ছিল না। আমার চারদিক তখন সর্বদা চার দেয়ালে মোড়া থাকতো; আর স্বাধীনতা – তোমার বিশুদ্ধ কল্পনাপ্রসূত এক বিস্ময়কর ফসল-মৃদুমন্দ বাতাস হয়ে আমার মুখ স্পর্শ করতো; তবে শুধু তখনই যখন আমি জানালা খুলে দিতাম। যে একবারই মাত্র আমি বাতাস মাতাল করা সুবাস ছড়ানো জুঁইশাখে আলতো হাত বুলিয়েছিলাম, টোকা দিয়েছিলাম, সময়টা তখন রাত ছিল।
পেঁজা তুলো-তুলো সাদা মেঘের কিনার অস্তগামী সূর্যের অপূর্ব কিরণে রক্তিমাভায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে, আর
পেছন-উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র কারিপাতা গাছের শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে দেখা আকাশে কালো-কালো মেঘের তর্জন-গর্জন – যে-মেঘদলকে ভীষণ রৌদ্রদাহে পুড়ে যাওয়া কালো কালো মত্ত হাতির মতো দেখাচ্ছিল – এসবই আমি বাড়ির ঠিক মাঝখানের ঘরের জানালা খুলে দেখেছি। শুধু আমার হৃদয়-গভীরেই আমি বৃষ্টির দুর্দান্ত হিংস্রতা দেখেছি; গ্রথিত-সন্নিবন্ধ মুক্তোদানার মতো। আমার পা কোনোদিন সামনের উঠোন স্পর্শ করেনি; বাড়ির চৌকাঠের ভেতরের মেঝেতেই আমি পা ফেলে ফেলে চলেছি। মাথায় তোলা আঁচলের ঘোমটা একবারের জন্যও কখনো পিছলে পড়ে যায়নি। আমার চোখের পাতা পর্যন্ত লজ্জা-কুণ্ঠা-ভীরুতায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ছিল। আমার হাসি কখনো ঠোঁটের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তো না। মৌমাছির চঞ্চলা চোখের মতো আমার দু-চোখ চারদিকে ঘুরঘুর করতো না। আম্মা সেজন্যই আমাকে কখনো কঠোর চোখের শাসনে রাখেননি : ‘এটা কোরো না, ওটা কোরো না; ওভাবে দাঁড়িও না, ওভাবে তাকিও না’ … আমাকে তাঁর এসব বলার প্রয়োজন পড়েনি। আর খুব বেশিকিছু নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অভ্যাস আমার নিজেরই ছিল না।
তারপরও তোমার কাছে আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন আছে! এসব কিছু – অর্থাৎ, এই যে চকমকে-জ¦লজ¦লে সবুজ রঙের সব ঝিঁঝিপোকা, চারদিকের রঙিন-বর্ণিলসব রং, দীপ্তিমান সব পাথর, সুবাসিত-সুরভিত কাদামাটি, মৃদুমন্দ বাতাস, এই মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ, উদ্ভিদ-বৃক্ষ-লতা, এসব বিস্তীর্ণ মাঠ আর ঘন অরণ্য, গর্জনমুখর সাগর-মহাসাগর, এই বৃষ্টি, বৃষ্টিতে ভেসে চলা কাগজের নৌকা – এসব কিছুকে আমি স্পর্শ করতে পারি না; ওদের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে পারি না। আমি ওসবের গন্ধ নিতে পারি না, দেখতে পারি না; ওদের দিকে মুখ তুলেও তাকাতে পারি না। এর সবকিছুই তুমি পুরুষের জন্য দিয়েছো, তাই না? শুধু এই সত্যটুকুই আমার জানা। সেজন্যই আমি তেমন কোনো ঝামেলা করিনি; কেননা, এটা তোমার হুকুম বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। … আমার হতভাগী আম্মা! আর কি-ই বা সে করতে পারতো?
তাই, আম্মার মুখে মুখে আমি কোনো কথা বলিনি; আম্মা যা যা বলেছে, শুনে-মেনে চলেছি। সেসব কথাই তোমাকে একটু বলি প্রভু :
‘তুমি তার অনুগত-বাধ্যগত থাকবে’, আম্মা বলতো, ‘সে তোমার প্রভু, তোমার মালিক; সে যা-ই হুকুম করবে, বলবে, তুমি শুধু সেসবই করবে; তুমি একনিষ্ঠ মনে, অনুগত প্রাণে তারই সেবা করবে।’ আম্মার এসমস্ত কথা আমার অন্তরে গভীরভাবে খোদিত-প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। আর আপ্পার (আব্বার) কথা? – ‘ওরকম হয়ে ওঠো।’
যখন আম্মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হলো, আমার মনে হচ্ছিল – কেউ যেন এক হ্যাঁচকা টানে আমার হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে বের করে এনে, হাতের তালুতে রেখে শক্ত মুঠোয় বারবার চেপে চেপে ধরছে। আম্মাও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল; তবু মুখে কিছু প্রকাশ করল না। উন্মত্ত হিংস্র এক অস্থির করাত তার ভেতরটা কেটে কেটে যাচ্ছিল। তবু তার চোখ দুটোয় এক অদ্ভুত আভা জড়িয়ে ছিল; শুধু চোখের দু-কোণ ভিজে উঠেছিল।
প্রভু, তুমি সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝবে। ওরা বলে যে – তুমি আমাদের জন্য তোমার অন্তরে শত-শত, হাজারো মায়ের ভালোবাসা-মমতা ধারণ করো, অনুভব করো। তাহলে একজন মায়ের অন্তরের দগ্ধ-যন্ত্রণা নিশ্চয়ই তোমার অন্তর্গত হাজারো হৃদয়কে ষ্পর্শ করেছে। তবে আমি কিন্তু তোমাকে কোথাও দেখতে পাইনি। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আম্মা আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল; তার ঠান্ডা ঠান্ডা দুটো হাত আমার গনগনে দুই গাল হাতড়ে চলেছিল। কিন্তু তারপরই লোকটা আমাকে আম্মার বুক থেকে টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি তখন সোনালি-রুপালি সুতোর কাপড়ে মোড়া মহামূল্যের একটুকরো মনি-রত্ন।
জানি, আম্মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। এগিয়ে যত দূরই গেলাম না কেন, আম্মার কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম। এখানেও একটা ছোট্ট প্রশ্ন আছে প্রভু : কি এমন ক্ষতি হতো, যদি লোকটাই আমাদের বাড়িতে চলে আসতো! এখানে, আমাদের সঙ্গেই শিকড়-বাকড় মেলত? যখন তুমি তোমার অখণ্ড অবসরে, ধীরে-সুস্থে প্রাণিজগৎ তৈরি করেছিলে, সোনার প্রলেপে মোড়ানো নাজুক সুতোর মতো সূক্ষ্ম-সূক্ষ্মসব অঙ্গ ফুলের মধ্যে প্রবিষ্ট করে দিয়েছিলে; বিস্ময়কর এসব পুকুর-খালবিল, নদীনালা-স্রোতস্বিনী – তখন কি প্রভু, তোমার এতটুকুন সময় পর্যন্ত হলো না যে, আমার অন্তরে একটুখানি উঁকি মেরে আমার স্বপ্ন, আমার ভয় আর ইচ্ছা-আকাক্সক্ষাগুলো, আমার ভগ্ন
আশা-নিরাশাগুলোকে একটুখানি দেখে নেওয়ার?
আমার একান্ত নিজের বলতে আর কিছু রইল না। আরেকজনের উঠোনে-মাটিতে আমাকে শিকড় গাড়তে হলো; শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে হলো। লোকটা আমার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাচ্ছিল, অনুরক্ত হয়ে উঠছিল; আর আমার ব্যক্তিত্ব-পরিচয় সব গলে গলে হারিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি আমার নামটা পর্যন্ত হারিয়ে গেল। প্রভু, আমার নতুন নামটা কি তোমার জানা আছে? ‘তার বউ!’ আমার শরীর, আমার মন তখন আর আমার ছিল না। আমার দেহের প্রতি তার দারুণ আকাঙ্ক্ষার মধ্যেও, নিজ শরীরের প্রত্যাখ্যান, দেহের নিজস্ব অস্বীকার-অসম্মতির ক্ষমতা বুঝতে পেরে আমি ভীষণ অবাক হয়ে পড়েছিলাম! এসব কিছু আমার আগে জানা ছিল না। বুভুক্ষু লোকটা আমাকে গিলে গিলে খেত, গ্রাস করে ফেলত। শুধুমাত্র ওই মুহূর্তগুলো ছাড়া; তোমার অর্পণ করে দেওয়া ক্ষমতার রাজদণ্ড তার হাতের মুঠোয় ঝকমকে দীপ্তি ছড়াত।
কোথা কোথা থেকে যে তার ধূর্ততা-চাতুরী লাফিয়ে
দাপিয়ে বেরিয়ে আসতো, আর কিভাবে বেরোত, আমি তা জানতাম না। চোখের পলকে সে আমার অন্তরকে ভেঙে খানখান করে দিতে পারত; পরমুহূর্তে প্রতিটা টুকরোকে একেক কোণে ছুড়ে ফেলে দিতে পারত। আমার শরীরটা ছিল তার খেলার মাঠ; আমার হৃদয় তার হাতের খেলনামাত্র। এভাবে, এই যে প্রভু, এভাবে – আমার অন্তর মেরামতের চেষ্টায়, এভাবেই আমি মলম লাগাতাম। কিন্তু যখন-তখন খেয়ালখুশিমতো লোকটা আমর হৃদয়কে ভেঙে শত-টুকরো করে ফেলতো। প্রভু, আমাকে একটা খেলনা, খেলনা পুতুল হয়ে উঠতে হলো কেন? আমি তো তাকে ঘৃণা করতাম না; এমনটাও কখনো চাইতাম না যে, সে আমার হাতের খেলনা হয়ে উঠুক। আমি যদি তার আরেক মেরুদণ্ড হয়ে উঠতে পারতাম; আর সে যদি আমার অশ্রুজল মুছে দেওয়ার দুটো হাত হয়ে উঠত …
আমাকে ওভাবে ব্যবহার করার এক সপ্তাহ পার না হতেই, একদিন সে ক্ষেপে উঠে উন্মত্ত-পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল, ‘আমি কে? সমাজে আমার অবস্থান কি, জানিস তুই? কত কত বাপ আমাকে লাখ লাখ রুপি হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বসে আছে; আর এদিকে আমি তোর মতো একটা ফকিন্নিকে ঘরে তুলে বসে আছি!’
এ-কথার আমি কি উত্তর করতাম? আম্মার শিক্ষা আর উপদেশমতো আমি চুপ থাকলাম। তারপরই লোকটা হুকুম জারি করল, ‘তুই তোর বাপের বাড়ি থেকে শিগগির পঞ্চাশ হাজার রুপি এনে আমাকে দিবি! যদি না দিস, তাহলে ওই বাড়িতে আর কোনোদিন পা রাখতে পারবি না!’
আমি আম্মার কাছে ফিরে গেলাম; নোংরা-ময়লা কাপড়ে জড়ানো একটুকরো অলংকারের মতো।
আম্মার মুখ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। পলকের মধ্যে তার চোখে হাজারো-লক্ষ সূর্য, চন্দ্র ঝিকমিকিয়ে উঠল। পরমুহূর্তেই সেসব আলো নিভে গেল, যখন আম্মা দেখল যে, আমার স্বামী আমার সঙ্গে আসেনি। ধীর পায়ে আম্মা আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। পঞ্চাশ হাজার টাকা যৌতুকের দাবি আমার মনের, চেহারার সুখ-শান্তিকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছে। সেই রাতে আম্মার পাশে ঘুমিয়ে আমি শান্তি পেলাম; কিন্তু জলদিই লোকটা মনের মধ্যে এসে হানা দিলো। আম্মার স্নেহ-মমতামাখা অন্তরের দুর্গে আচমকা একটা ছিদ্র হয়ে গেল; আর সেই ছিদ্র বেয়ে সে ঢুকে পড়ল! তিনদিন পার হওয়ার পর আমি নিজেই তার অপেক্ষায় অধীর-উন্মন হয়ে পড়লাম। আমাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আগে সে যখন জানতে চাইল – আমি টাকাটা এনেছি কি-না, তখন আমার ফ্যাকাশে মুখ দেখে লোকটা বলে উঠল, ‘তাহলে এই শেষবারের মতো তোর বাপের বাড়ি বেড়ানো হয়ে গেল। এখন থেকে তুই আর কোনোদিন এখানে আসতে পারবি না; আর তোর বাপ-মাও কোনোদিন আমার বাড়িতে যেতে পারবে না!’
ফেরার সময় আম্মা আমাকে পেট পুরে খাইয়েছিল। অন্তরের সবটুকুন স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আমাকে দোয়া করেছিল। আমার চুল আঁচড়ে জট ছাড়িয়ে দিলো, আর এমন আদরভরে বিনুনি করে দিলো, যেন তার স্নেহের সকল চুম্বনকে আমার চুলের ভাঁজে ভাঁজে বুনে দিচ্ছে। বিনুনিতে সাজিয়ে দেওয়া জুঁইয়ের মালাটাও ছিল আম্মার মতো; সুরভিত-খুশবুদার। কানাকাম্বারম ফুল জুঁই ফুলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। সেকেন্ড পরপর মুখ ফিরিয়ে আম্মার দিকে তাকিয়ে কুণ্ঠিত পা ফেলে আমি লোকটার পিছু নিলাম।
লোকটা তার জবান থেকে পিছু হটার মানুষ নয়। তার ঔদ্ধত্য অহং-মদের একটা সীমা কি থাকা উচিত নয়? তার এই বাড়িতে আসার পর এবার আমি টানা তিনদিন চুলের বিনুনি খুলিনি। ভয় হচ্ছিল, আম্মার স্নেহময় চুম্বনগুলো সব হারিয়ে-মিলিয়ে যাবে। আমার অন্তর বাঁধা আম্মার অন্তরে; আর লোকটার মন বাঁধা তার শেষ কথায়; তার শেষ কথা আদায় করে নেওয়ায়।
এ-ঘটনার পর আম্মার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। অবশ্য এসবের প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি সবকিছুই জানো; তোমার নিয়োজিত দূতেরা প্রতিদিন এমন কোটি কোটি ঘটনা তোমার কানে তোলে। কিন্তু সেসব তো কলমে-কাগজে লেখা 888sport world cup rateমাত্র। আমার এই কথাগুলো কিন্তু হৃদয় দিয়ে লেখা – একজন 888sport promo codeর হৃদয়; হৃৎপিণ্ডের ধারালো নিব আর হৃৎপিণ্ড-উৎসারিত লাল কালিতে লেখা একগুচ্ছ চিঠি। এরকম কোনো অনুরোধ সম্ভবত এর আগে তোমার কাছে পৌঁছায়নি। কেননা, তোমার দূতদের মধ্যে কারোর যে আমার মতো একটা 888sport promo code-হৃদয় নেই!
যথারীতি, আমারই আত্মার বন্দিনী আমি; যার দরজা-জানালাগুলো সবসময় বন্ধ, পুরোপুরি বন্ধ। আমার আম্মা, আমার আপ্পা বা ছোট ভাইকে আর কখনো দেখতে পাইনি আমি। শুধু এতটুকু ক্ষীণ আশা ছিল যে, আম্মা চুপচাপ বসে থাকবে না। আমি জানি, আম্মা অনেকবার আমার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেছে। কিন্তু লোকটা আমার চারপাশে এমন দুর্গম-কঠিন দুর্গ দাঁড় করিয়ে রেখেছে যে, আম্মার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। অর্থের প্রতি লোকটার বিশ্রী লোভ আমাদের সম্পর্ককে, আমাদের অনুরাগ-ভালোবাসাকে, আমাদের স্নেহ-মমতাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছে। নিজের এই অবস্থানের বিষয়ে লোকটা ছিল অন্ধ আর পাথর-কঠিন।
অনেক প্রতিবেশী আমাকে উপদেশ-পরামর্শ দিলো : লোকটা যেটা ঠিক মনে করে, ভালো মনে করে, সেভাবেই মানিয়ে থাকতে। প্রভু – এমনকি তোমার ধর্মদেশনাও সেই একই প্রভু, যে – সে আমার ঈশ্বর; যে – আমার কর্তব্য তাকে মান্য করা, অনুগত হয়ে থাকা; যে – এই দুনিয়ায় সে তার ইচ্ছামতো যখন-তখন, যেখানে খুশি যে-কারোর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবে। কিন্তু আমি? প্রভু, তুমিই তো বলেছিলে যে, জন্মদাত্রী জননীও প্রভুর সমান! তুমিই তো জগৎময় জানিয়ে দিয়েছিলে যে, মায়ের পায়ের তলে আমাদের স্বর্গ! এরপরও আমি আমার মায়ের সঙ্গে একটিবারের জন্যও দেখা করতে পারি না। আমার এই ক্ষুদ্র, সীমাবদ্ধ চিন্তাকে, আমাকে আঘাত-আহত করে চলা এসব ভাবনাকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো সময় তোমার আছে কি না; আমার পুরো জীবনকে তুমি তিন ঘণ্টার একটা নাটক বলে মনে করো কি না; কিংবা আমাকে তোমার কোনো অভিনেত্রী বলে মনে হয় কি না – আমি জানি না। তবে, আর যা-ই করো, একটা জিনিস কিন্তু মনে রেখো: আমার সুখ, আমার দুঃখ-কষ্ট-বিষণ্নতা কিন্তু ধার করা কোনো অনুভূতি নয়। এসবকে নাটকীয়ভাবে পরিবেশন করারও কিছু নেই। এসব শুধু অভিজ্ঞতায় যাপন করতে হয়। আর তুমি শুধু বিচ্ছিন্ন, দূরবর্তী ও উদাসীন একজন নির্দেশকমাত্র। যখন তোমারই সৃষ্ট কোনো চরিত্র আমার মনকে হিংস্র আক্রমণ করে, বলাৎকার করে, তোমার তখন কি কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য নেই? অন্তত একটাবারের জন্য হলেও আমাকে একটু সান্ত্বনা দাও, প্রবোধ দাও! এসবে আমার দোষটা কোথায়, ভুলটা কোথায় – বলো তো?
লোকটা আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করেনি যে, আমি কিছু খেয়েছি কি না, গলা দিয়ে কিছু নামিয়েছি কি না। কিন্তু সে ‘চাষ’ করে যায়, ‘বীজ’ বপন করে চলে। আমার আত্মা ছিন্নভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও, ক্লান্ত-অবসন্ন হওয়া সত্ত্বেও, শরীরটা তখন পরিপক্ব ও বতী হয়েছিল; গর্ভ তৈরি হয়েছিল। আর তার ক্ষুধাও ছিল তেমন – ভয়ানক!
আমি মা হতে চলেছিলাম। তবু এক কোণে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আমি সবসময় মায়ের বাড়ির পথ চেয়ে থাকতাম। দিগন্তপানে যতটুকু চোখ যেত, তার কোথাও আমি একটা কোনো আকার, একটা কোনো আকৃতি দেখতে পেতাম না। শুধু কয়েকটা সবুজ 888sport sign up bonus-বৃক্ষ দেখতে পেতাম; যারা তাদের সব পাতা ঝরিয়ে ফেলে দিন দিন অনাবৃত-নগ্ন হয়ে উঠছে।
পরে জেনেছিলাম যে, আমার আম্মা শেষ পর্যন্ত আপ্পাকে তার নিজস্ব সবকিছু বিক্রি করে দিতে রাজি করাতে পেরেছিল। আর বিশ হাজার রুপির একটা তোড়া নিয়ে আমাদের এই বাড়ি আসতে রাজি করাতে পেরেছিল।
সেদিন কাকেরা অনেক কা … কা … করলো, আমার ডান চোখ ফড়ফড় করে কাঁপতে থাকলো, গনগনে চুলা গুনগুনিয়ে উঠলো। মনে হলো আম্মা আসবে!
আম্মা যাত্রা শুরু করেছিল ঠিকই, কিন্তু এসে পৌঁছাতে পারল না। মনে হয় কোথাও একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। সবকিছুই তো আমি ওভাবেই জেনেছিলাম … অন্যের মুখে। লোকটা আমাকে আমার আম্মার মরা মুখটাও দেখতে যেতে দিলো না। তার বদলে সে কঠোরভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেল যাতে, কিভাবে কী হয়েছে, সেসব কথা যেন আমার কানে কোনোভাবেই না পৌঁছায়।
এখানে, আমাদের এই ছোট শহরের বড় হাসপাতালে – মনে হয় ওরা আম্মার শরীরটা কাটাকুটি করেছিল। ওরা সম্ভবত আম্মার অন্তর, আম্মার হৃৎপিণ্ডটা কেটে দেখেনি। অবশ্য, কাটলে ওরা সেখানে জমাটবাঁধা রক্ত দেখতে পেত না। তার বদলে দেখতে পেত একটা জমাটবাঁধা আত্মাকে। সেই সঙ্গে অনতিক্রম্য কিছু লক্ষ্মণরেখা; আর অনল-তাপে দগ্ধ, পর্বতসম কয়েক ডজন অগ্নিপরীক্ষার প্রমাণ। তবে একটা ব্যাপার সত্যি: বেঁচে থাকা অবস্থায় আম্মার দেহ ছিন্নভিন্ন-শতছিন্ন্ন হলেও, তার মৃত্যুর পর কেউ তার অন্তর, তার হৃৎপিণ্ডকে স্পর্শ করেনি। কিংবা তার আত্মাকে। একজন শাশ্বত কুমারীর মতো, তার চোখ দুটো খোলা হয়ে ছিল। আমি ভেবে আকুল হই – আম্মা তখন কাকে দেখার আশা করছিল! একজনের আসার আকাঙ্ক্ষায়-অপেক্ষায়, অপেক্ষায়-আকাক্সক্ষায় তার হতভাগী দু-চোখ খোলাই থেকে গেল!
এখান থেকে একটু, ওখান থেকে একটু … জানালা দিয়ে আসা কিছু কথা … ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়া কিছু খবর আমি শুনেছিলাম বটে; তবে ঘটনার সবকিছু দেখা লোকটা তার ভীষণ কঠিন জেদ নিয়েই থাকল। মনে হয়, আপ্পা আম্মার মরদেহের পাশে বসে আম্মার কোমরে গোঁজা বিশ হাজার রুপির তোড়াটা বের করে নিয়ে লোকটার হাতে তুলে দিয়েছিল। তারপর মনে হয় অনুনয়-বিনয় করে বলেছিল – ‘এবার অন্তত আমার মেয়েটাকে একবার এখানে নিয়ে এসো!’ লোকটা আমাকে এসবের কিছুই বলেনি। আর আমাকে আম্মার ওখানেও নিয়ে যায়নি।
আমার একটা মেয়ে হলো; মুখটা একেবারে আম্মার মতো। আম্মার মতোই দুটো চোখ; পুকুরের মতো গভীর। আমি ওকে কোলে তুলি, উঁচিয়ে ধরি, আদর করি, জড়িয়ে ধরি; ওর সঙ্গে খেলি। এখন আর আমার চোখ বেয়ে অশ্রুধারা পুকুর বা নদী তৈরি করে না। বরং চোখের দু-কোণে চকচকে কুয়াশার মতো ঝুলে থাকে। তোমার এই অনন্য, বিস্ময়কর উপহারের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, তোমার শুকরিয়া, প্রভু! সবকিছু ভুলে থাকার জন্য, ভুলে যাওয়ার জন্য তুমি আমাকে শক্তি দিয়েছ, দৃঢ়তা দিয়েছ। জীবনমরুর ওপর পুরনো 888sport sign up bonusর ঠান্ডা-শীতল পরশ প্রশান্তিময় হয়ে উঠেছিল। মেয়েকে দুধ ছাড়ানোর আগেই, আমি আবার গর্ভবতী হয়ে পড়লাম। মেয়ে কোলে নিয়ে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে থাকতে, ঘুরতে-ফিরতে আরেক জোড়া পায়ের নরম লাথি অনুভব করতে শুরু করলাম; ক্ষুদ্র একটা হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন আমার ভেতরে শিকড় গেঁড়ে নিল।
কোলে একটা বাচ্চা, পেটে আরেকটা নিয়ে আমি যথেষ্ট বিক্ষুব্ধ-বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম। লোকটা গোঁফে তাও দিতে দিতে বলেছিল : ‘তা, আমি যখন ওদের প্রতিপালন করছি, তখন গর্ভে ধরতে তোর এত সমস্যা কিসের?’ আমিই আসলে হতভাগী, দুর্ভাগা। লোকটা যা বলেছে, ঠিকই তো বলেছে! তা, প্রভু – তুমি যদি তাকে একবার একটু বলে দিতে – সন্তান জন্মদানের কষ্ট-জটিলতা কেমন, তাহলে হয়তো লোকটা ওসব কথা মুখে আনত না। গলা খাঁকারি দিয়ে ঠিক করে নেওয়ার মতো সহজ, পেশাব করে তলপেটের চাপ কমিয়ে নেওয়ার মতো সহজতায় তুমি এমন সাধারণ একটা অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছ, যারা উদ্ধত আর সুখী। আর সেই সৃষ্টির পর থেকেই তুমি
উদাসীন-নির্বিকার। রক্তে-মাংসে কি তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে হবে? তার হাড়গোড় চূর্ণ করা সেই ‘লবণ’ কি আমাদের গর্ভে ঢুকিয়ে দিতেই হবে? সে কি শুধু রক্ত-মাংসের মধ্যেই বিরাজ করবে না? বরং প্রবল এক যন্ত্রণা হয়ে পাঁজরের হাড়গোড় ভেঙে দিতে থাকবে? তার যদি এসবের কোনো একটা কিছুর এতটুকুন অভিজ্ঞতা থাকত! না; এসব তো তোমার কাছে আমার জিজ্ঞেস করার, জানতে চাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, তুমি তো সৃষ্টিকর্তা; আর সে তোমার অতি প্রিয় সৃষ্টি! আর তাতেই কি আমি তোমার অপ্রিয় সৃজন হয়ে গেলাম?
যখন লোকটার আকাঙ্ক্ষামতো একটা পুত্রসন্তানের জন্ম হলো, তার আনন্দ-আহ্লাদের আর কোনো সীমা রইলো না। আমি সুখ না পেলেও, আহ্লাদিত না হয়ে পড়লেও, একটা ব্যাপার আমাকে সন্তুষ্টি দিলো – আমরা অন্তত আমার মতো আরেকটা অসহায় হতভাগী জীবন-বন্দিনীকে এই জগতে নিয়ে আসিনি। করুণভাবে জীবন ধারণের পরিবর্তে, স্থিরতা-নিশ্চয়তাহীন বাঁচার পরিবর্তে একটা পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছে – যে সগর্বে-সদর্পে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে; পুরুষ হওয়ার পরিপূর্ণ ঔদ্ধত্য আর অহংকার নিয়ে।
আমি আমার কন্যার প্রতি আরো ভালোবাসা-মমতা ঢেলে দিলাম। দুটো বাচ্চাই বড় হতে লাগল, বেড়ে উঠতে লাগল। আর লোকটার মর্যাদা-প্রতিষ্ঠা, তার হামবড়াভাব আর ঔদ্ধত্য ডিম পেড়েই চলল, জন্ম নিয়েই চলল। আমি সবচেয়ে দায়িত্ববান-নিষ্ঠাবান কাজের লোকে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম। ওই একটাই মাত্র পথ ছিল আমার জন্য। পৃথিবীকে নিজে কিছু না দিয়ে, পৃথিবী থেকে কিছু না পেয়ে, সামাজিক সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে অচেতন থেকে, সেসবের স্বাদ না পেয়ে, নামহীন, মনুষ্যেতর আমি শুধু তার স্ত্রী হয়েই থাকলাম; যার মানে হলো ‘বিনা পয়সার কাজের লোক।’ তার আশ্রয়-সুরক্ষা ছাড়া আমার কি হতে পারে – রাতে শুয়ে শুয়ে একথা ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিত, কেঁপে কেঁপে উঠতাম। তাকে ছাড়া যে আমি কিস্ সু না – এই রূঢ় বাস্তবতা সদা-সর্বদা আমার চোখের সামনে, মনের উঠোনে হাজির থাকত। আমি তো শুধু একটা ছায়ামাত্র। প্রথম প্রথম আমি এটা মেনে নিতে পারতাম না। আমার ভেতরে দারুণ উথাল-পাথাল হতো, দ্বন্দ্ব-বিরোধ হতো। আমার ভবিষ্যৎ জীবনে তার অস্তিত্বহীনতার সামান্যতম চিন্তায় আমি ভীষণ ঘাবড়ে যেতাম, ভয় পেতাম। সেই অবস্থা কল্পনা করতেও
ভয়ে-আতঙ্কে আমার জান ছুটে যেত। আমি একজন ক্রীতদাসী হয়ে ছিলাম। তারপরও যে লোকটা আমার শ্রমের পরিবর্তে খাওয়া-পরা দিচ্ছে, আমাকে আশ্রয়ে রেখেছে, সেজন্য তাকে আমার ‘মহাত্মা’ বলেই মনে হতো।
হয়তো এভাবেই সবকিছু চলতে থাকত, আর বাচ্চা-কাচ্চাদের বড় করে, বিয়ে দিয়ে আমিও হয়তো মরেই যেতাম, ঠিক আমার আম্মার মতো। কিন্তু একদিন সে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করাল। আমার পাকস্থলীতে একটা টিউমার বড় হয়ে চলেছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানিয়ে দিলো – ‘অপারেশন করতে হবে।’ আমার প্রতি ভয়ানক রাগে ন্যালা-খ্যাপার মতো তার চোখ-মুখ বেঁকিয়ে গেল; তবে ডাক্তাদের সামনে সে কিছু বলল না। এরপর অপারেশন হয়ে গেলে, সে আমার বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়ে একটা হুকুম করল, ‘তোর গলার হারটা আমাকে দে!’
এই হারটা নিয়ে প্রভু – তোমায় কয়েকটা কথা জানিয়ে রাখি : আমার বিয়ের সময় আম্মা এই দুই-গোছার হারটা বানিয়েছিল। এটা বানাতে, আম্মাকে নিজের বিয়েতে তার মায়ের দেওয়া সব স্বর্ণালংকার গলিয়ে ফেলতে হয়েছিল। আম্মার 888sport app download for androidে-888sport sign up bonusতে আমি হারটা সবসময় পরে থাকতাম। তাই বিনা কথায় লোকটার হাতে ওটা তুলে দিতে পারলাম না। তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনি এখন এটা কি জন্য চাইছেন?’
আমার মনে হয়, আমার জীবনে এই প্রথমবারের মতো লোকটাকে কোনো একটা প্রশ্ন করলাম। শুনে, একবিন্দু করুণা-দরদ ছাড়াই স্বাভাবিক গলায় লোকটা বলল, ‘আমি আবার বিয়ে করছি। নতুন বউকে আমি ওটা দিতে চাই।’
অন্ধকার আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে তলিয়ে নিল। স্যালাইনের বোতল খুলে-ছুড়ে ফেলে, আমি কি এখন দৌড়ে পালাব? কিন্তু ভেগে আমি যাবটা কোথায়? লোকটার মুখে কি সপাটে একটা চড় বসিয়ে দেব? ছিঃ … এ তো কখনো সম্ভব নয়! আমার বাচ্চাদের কি হবে? বাড়ির চার দেয়ালের আশ্রয়ও যে আমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে, সেই সম্ভাবনা এখন নিরেট সত্য হয়ে চোখের সামনে ঝুলতে লাগল। হায়, আমি তো চুরমার হয়ে গেলাম!
আমি বাম হাতে হারটাকে গলার সঙ্গে এমনভাবে চেপে-আঁকড়ে ধরলাম, যেন ওটাই আমার জীবন, আমার প্রাণ। আর বললাম, ‘এটা আমি আপনাকে দেব না!’
লোকটা হতভম্ব হয়ে গেল। সম্ভবত এ-কারণে যে, আমার কাছ থেকে এরকম কথা সে ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি। পরমুহূর্তে ঘৃণার আগুন-চোখে আমার দিকে তাকাল। হার না পাওয়ার চাইতে আমার প্রত্যাখ্যান তাকে বেশি অপমানিত করেছে। প্রতিশোধের আগুনে লোকটা জ¦লতে-পুড়তে থাকে। ‘ওহ হো! তুই কি ভেবেছিস যে, তোর ওই হার না দিলে আমার বিয়েটা হবে না?’ লোকটা চিৎকারে ফেটে পড়ে। আর আমি ভীরু-দুর্বল গলায় তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কেন এখন আবার বিয়ে করতে চাইছেন?’
‘তোকে কি তার কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? আচ্ছা, শোন তাহলে! তোর মতো একটা ফকিন্নির সঙ্গে থেকে আমি আমার বাকি জীবনটা বরবাদ করতে চাই না। অসুস্থ মানুষের সঙ্গে আর কাজ কি, কিসের সংসার? ভালো ঘরের একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি আমি!’
প্রভু, অসহ কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করার অসম্ভব ক্ষমতা তুমি আমাকে দিয়েছ। কিন্তু এসব কষ্ট দেওয়ার জন্য পুরুষকে তোমার এত নিষ্ঠুর করে গড়া উচিত হয়নি। আর, সহ্যের শেষ সীমাই বা কোথায়? সহ্য-ধৈর্য্য-স্থিরতা ছিল আমার জীবনের মূলমন্ত্র; তারপরও আমি অসহায়ের মতো ধসে-ভেঙে পড়লাম। লোকটাকে কিছু বলার আগেই সে আমাকে বলল, ‘আরো কিছু শুনতে চাস তুই? তোর কাছ থেকে কি সুখটা, কোন তৃপ্তিটা আমি পেয়েছি? যতবার তোকে ছুঁয়েছি, তুই মড়ার মতো শুয়ে থেকেছিস। আর, সেজন্যই তো আবার বিয়ে করছি!’
সোজাসাপ্টাভাবে কিছু ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতা তখন আমি হারিয়ে ফেলেছি; নীরবতাই আমার সমস্ত কথা হয়ে উঠল। অশ্রুজল আমার দু-চোখের সামনে কুয়াশার মতো পর্দা নামিয়ে দিলো। আবর্জনার মতো আমাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো; ভীষণ রাগ-ক্রোধ আমাকে গ্রাস করে নিল। বিছানা ছেড়ে আমি উঠে পড়তে চাইছিলাম; কিন্তু পারলাম না। এরপর একটু একটু করে চিন্তা করতে শুরু করলাম। আমার পক্ষে কি লোকটাকে থামানো সম্ভব? তার বাধ্যগত চাকরানি হিসেবে আজ পর্যন্ত আমি তাকে যে তিন-চারটা সাধারণ প্রশ্ন করেছি, তার উত্তরে হাজার হাজার কথা শুনেছি।
‘দেখো, তুমি সুস্থ নও, তোমার শরীর ভালো নেই; ও আরেকটা বিয়ে করতে চায়, করতে দাও।’ একটা কণ্ঠস্বর একথা কথা বলে, তো আরেকটা স্বর বলে ওঠে, ‘আরে … সবই তো খুব ঠিক আছে! ও একটা ব্যাটামানুষ; একটা কেন, চার-চারটা বিয়ে করতে পারে। জিজ্ঞেস করার আর কি আছে?!’
অন্যরা মিথ্যা সান্ত্বনা-সমবেদনার আড়ালে, পুরুষ্ট গোঁফের নিচে হাসতে হাসতে উপদেশ দেয় : ‘দেখো, তোমাকে আমরা স্নেহ করি। ও যদি চায়, তাহলে বিয়েটা করতেই দাও। আর নিয়মিত প্রতিমাসে কিছু খোরপোষ যেন দেয়, তার জন্য দাবি জানিয়ে একটা মামলা ঠুকে রাখো। তা, বিচার শেষ করে রায় দিতে দিতে চার-পাঁচ বছর তো লেগেই যাবে। সেই সময় পর্যন্ত দিনমজুরি বা অন্য কিছু একটা করতে থাকো।’
এসব কথার মানে হলো – লোকটা যা যা করছে, সমাজ সবকিছু মেনে নিয়েছে। প্রভু – ওরা একথাও বলে যে, তুমিই নাকি এসব কাজে সাহায্য করো! তোমার নাম নিয়েই লোকটা এসব করে। কেননা, আমি তো তোমার অসম্পূর্ণ সৃষ্টি, তাই না প্রভু? তুমি কি আমার এই নালিশ, এই অভিযোগ কিছু শুনতে পাচ্ছ? আমার আর্তনাদ-কান্না কি তোমার ও-পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে? এখন আমি কি করি … কি আর করতে পারি আমি …
পরের তিনদিন সে আর হাসপাতালমুখো হলো না। হাসপাতালে রোগীরা যে ফ্রি খাবার পায়, তাই খেয়েই আমি আর আমার দুই সন্তান টিকে থাকলাম। এরপর ডাক্তার আমাকে ছেড়ে দিলে নিশ্চিন্ত অতটুকুন খাবারের পথও বন্ধ হয়ে গেল। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক কষ্টে বাসায় পৌঁছালাম। দেখি, দরজায় ইয়া মোটা একটা তালা ঝুলছে। বাসার ঠিক সামনে সবুজ নারিকেল পাতার একটা ছোট শামিয়ানা খাটানো। অথচ বাড়িতে কেউ নেই। প্রতিবেশীরা একটু উঁকি দিয়েই যে যার মতো সরে-সটকে পড়ল। বাচ্চারা আমার শরীরে গা লাগিয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকল। দিন ওভাবেই পার হয়ে গেল, রাত এলো। আমি তবু বাড়ির সামনে একঠাঁয় বসে থাকলাম।
হৃদয়ের দরজা, বাড়ির দরজা সব বন্ধ। অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়। আমার অমন অসহায়ত্ব দেখে অবুঝ বাচ্চারাও তাদের ক্ষুধার কথা মুখে আনে না। পা-দুটো লেগে-ধরে যাওয়ায়, একটু মেলে-ছড়িয়ে বসি। বাচ্চারা গায়ে লাগালাগি করে শুয়ে পড়ে; আধোঘুমে তলিয়ে যাওয়ায় সময়জ্ঞানও লোপ পায়।
আচমকা, হৃদয় জ¦ালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মতো এক আর্তচিৎকারে চোখ খুললাম; দেখলাম আমার ছোট্ট ছেলেটা – যে আমার পাশেই ঘুমিয়েছিল – একটা ডোবার মধ্যে পড়ে গিয়েছে। আমি এক লাফে সেই ডোবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম, আর ছেলেটার নোংরা জল-কাদামাখা শরীরটাকে আঁকড়ে-জাপটে ধরলাম। সেই অবস্থাতেই একটা টেম্পোকে সবুজপাতার শামিয়ানার নিচে এসে থেমে পড়তে শুনলাম। সেইসঙ্গে মানুষের হই-হল্লা, উত্তেজনা আর উৎসবমুখর হুড়াহুড়ি। লোকটা টেম্পো থেকে নেমে এলো। এরপর টেম্পোর পেছন দরজা দিয়ে তার ভীষণ শক্তপোক্ত দুটো হাতে লাল শাড়িতে মোড়া একটা মেয়েকে পাঁজকোলা করে তুলে নিল। যেন সোনার সুতোয় বোনা, লাল কাপড়ে মোড়ানো মহামূল্যবান এক অলংকার!
বাড়ির সামনের দরজা খুলে গেল। সবাই লোকটার সঙ্গে ছিল। কাঁপতে কাঁপতে ছেলে আমাকে ভীষণ জোরে জাপটে ধরল। ফেটে পড়া চোখে আমি ওদের দেখতে থাকলাম।
আমার লাল কালি-ভরা হৃদয়ের নিব ভেঙে গিয়েছে। আমার মুখ আর কিছু বলতে পারে না। কোনো চিঠিও আর লেখার নেই। ধৈর্য্যরে এখন আর কি মানে হতে পারে, আমি জানি না।
প্রভু – এই পৃথিবীটা যদি তোমার আবার কখনো গড়তেই হয়, আবারো যদি সৃষ্টি করতে হয় পুরুষ ও 888sport promo codeকে – তখন কিন্তু তুমি কোনো অপরিপক্ব-অনভিজ্ঞ কুমোর হয়ে যেও না। দুনিয়াতে 888sport promo code হয়ে একবার এসো, প্রভু! শুধু একবার 888sport promo code হও!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.