শেক্সপিয়র ইন দ্য পার্ক

শেক্সপিয়রের করিওলেনাস আমি কখনো পড়িনি, পড়ার আগ্রহও জাগেনি। এটি তাঁর শেষ রচনা, প্রবল রকম রাজনৈতিক, প্রবল রকম অগণতান্ত্রিক। পড়া বা সে-নাটক দেখার কোনো সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার আগেই মনে মনে তা বাতিল করেছিলাম। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের উন্মুক্ত মঞ্চ, ডেলাকোর্ট থিয়েটারে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সে-নাটক দেখার পর এ-ব্যাপারে মতামত যে বদলাল তা নয়, তবে নাটকটির অসাধারণ মঞ্চায়ন দেখে 888sport live chatের শক্তি নতুন করে আবিষ্কার করেছিলাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৬২ সাল থেকে নিউইয়র্কের ডেলাকোর্ট থিয়েটারে প্রতিবছর গ্রীষ্মে ‘শেক্সপিয়র ইন দ্য পার্ক’ এই নামে একটি নাট্যোৎসব হয়ে আসছে। দেড়শো বছরের পুরনো এই পার্ক, প্রায় পাঁচশো একর বিসত্মৃত, ইট-পাথরের এই মহানগরের সে যেন এক অভাবিত ওয়েসিস। থিয়েটারটি গ্রিক অ্যাম্পিথিয়েটারের আদলে নির্মিত, একটা প্রশস্ত খোলা মঞ্চকে সামনে রেখে স্টেডিয়ামের মতো দর্শকদের সারিবদ্ধ আসন। প্রায় এক হাজার আটশো দর্শক এখানে বসতে পারেন। আধুনিক শব্দব্যবস্থার এমনই ম্যাজিক যে, স্টেডিয়ামের সর্বোচ্চ আসনে বসেও প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি কথা স্পষ্ট শোনা যায়।
নামেই বোঝা যাচ্ছে, পার্কে বসে শেক্সপিয়রের নাটক মঞ্চায়ন এ-উৎসবের লক্ষ্য। নাটক মঞ্চায়নের দায়িত্ব পাবলিক থিয়েটার নামের একটি নাট্য সংস্থার। তাদের প্রযোজনায় এ-বছর মঞ্চস্থ হয়েছে দুটি নাটক, মাচ এডু অ্যাবাউট নাথিং ও করিওলেনাস। প্রতিটি নাটক উন্মুক্ত, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যে-কেউ এক জোড়া টিকিট সংগ্রহ করে নিতে পারেন। ভালো আসনের লোভে অনেকে মাঝরাতের পর টিকিটের জন্য লাইন দেন। দেশ-বিদেশের দর্শক, কারো হাতে গিটার, কারো হাতে বিয়ারের বোতল। সন্ধ্যায়, রোদের তাপ কমে এলে, নাটক শুরু। গ্রীষ্মে এখানে সূর্য ডোবে বিলম্বে। ফলে দিনের আলোতেই নাটক শুরু। মঞ্চের পেছনে, দীর্ঘ পপলার ও পাইন গাছের মাথা ছুঁয়ে সূর্য তার সোনা রঙের শেষ আভায় ভিজিয়ে যখন বিদায় নেয়, ঘড়িতে তখন নয়টা ছুঁইছুঁই। নাটক তখন সদ্য তার দ্বিতীয় অঙ্কে পৌঁছেছে।
শেক্সপিয়রের অনেক নাটকের মতো করিওলেনাসও রোমান ইতিহাস থেকে ধার করা, পস্নুটার্কের লাইফ অব করিওলেনাসের ভিত্তিতে এই নাটকের আখ্যানভাগ। প্রতিদ্বন্দ্বী ভলস্কিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে সদ্য রোমে ফিরেছেন সেনাপতি কেয়াস মারসিয়াস, কোরিওলির যুদ্ধে বিজয়ের 888sport app download bd হিসেবে রোমের অভিজাত নরপতিবৃন্দ তাকে করিওলেনাস নামে অভিষিক্ত করেছেন। এই রাজ্যে তখন প্রবল খাদ্যাভাব, বাজারে খাদ্য নেই অথচ ধনীদের খাদ্যভা-ার উপচে পড়ছে। এই নিয়ে অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের তুমুল উত্তেজনা। মারসিয়াস নিজেও এই অভিজাত শ্রেণির একজন। সাধারণ নাগরিকদের প্রতি তার প্রবল তাচ্ছিল্য। অভিজাত নাগরিকদের ইচ্ছা, সে এই নগররাষ্ট্রের কনসাল হিসেবে দায়িত্ব নিক। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন নাগরিকদের মন জুগিয়ে চলা, প্রয়োজন বিনয়ী মানসিকতার, যা ওলেনাসের স্বভাববিরুদ্ধ। গণতন্ত্রে তার বিশ্বাস নেই, নগরপতিগণ ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনো অধিকার রয়েছে, এ-কথা সে মানে না। কনসাল হিসেবে অভিষিক্ত হয়েও গণরোষের কারণে নগর থেকে পালাতে বাধ্য হয় করিওলেনাস। ক্রোধান্ধ সে এবার হাত মেলায় রোমানদের জাতশত্র‍ু ভলস্কিয়ানদের সঙ্গে। যৌথবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে রোম তার পদানত হয়। এবার সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই শহর সে আগুনে জ্বালিয়ে দেবে। মা ও স্ত্রীর অনুরোধে সেই রক্ততা-ব থেকে বিরত হয় করিওলেনাস, কিন্তু রোষের মুখে পড়ে ভলস্কিয়ানদের। তাদের হাতেই নিহত হয় সে।
করিওলেনাস কি নায়ক, না দুর্জন? সে যুদ্ধনায়ক অথচ যাদের জন্য যুদ্ধজয় সেই সাধারণ রোমানদের সে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে অপারগ। সাধারণ রোমানদের সমর্থন তার কাম্য – ‘গিভ মি ইয়োর ভয়েস’ তার এই আবেদন সে-কথার প্রমাণ; কিন্তু সমর্থন কীভাবে ধরে রাখতে হয় ধতা করিওলেনাসের অজ্ঞাত। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কোনো জবাবদির ভিত্তি রয়েছে, সে-বিবেচনা তার চেতনায় প্রবেশ করে না।
এই নাটক 888sport cricket BPL rate শতকে রচনা সম্ভব নয়, আধুনিক দর্শকের কাছে তা বড়জোর কৌতূহলোদ্দীপক একটি কাহিনি।
শেক্সপিয়রের নাটক বলেই যে পাবলিক থিয়েটার এই নাটক মঞ্চায়নের জন্য নির্বাচন করেছে আমার তা মনে হয় না। এর পেছনে সম্ভবত একটি অলক্ষ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করেছে। সাধারণ নাগরিকদের নামে ক্ষমতা অর্জিত হলেও আজকের নগরপতিরা তাদের মতামতের কোনো গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করেন না। রাষ্ট্র পরিচালনার অধিকার তাদের শ্রেণিজাত, একমাত্র তারাই পারেন নিজেদের ইচ্ছামতো সে-অধিকার ভোগ করতে। শেক্সপিয়রের আমলে সেটাই ছিল নিয়ম, রাজা যা বলতেন – যা ভাবতেন, তার বিরুদ্ধাচরণ ছিল অনভিপ্রেত। আজকের দিনে তা নিন্দিত কিন্তু সম্মিলিত নাগরিক অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে সে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ও শাসন ব্যবস্থাকে আমরা একনায়কতন্ত্র বলি।
করিওলেনাস চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার মাত্রাধিক দম্ভ, তার নিজের ওপর আস্থা, নিজের লক্ষ্যের শ্রেষ্ঠতায় অবিচল বশ্যতা। কেউ কেউ একে সততা বলে অভিহিত করেছেন, এবং এই সততাকে তার পতনের – তার ট্র্যাজেডির – উৎস বলে চিহ্নিত করেছেন। এই নাটকে আমরা দুর্বিনীত করিওলেনাসের বিজয় নয়, তার পতন প্রত্যক্ষ করি। বিদ্রোহী জনতার সামনে তার দাবি ছিল, আমাকে বলতে দাও। সে-কথার অর্থ, নেতা হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করো। তার প্রতি প্রবল অবিশ্বাস সত্ত্বেও জনতা তাকেই নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে; কিন্তু জনতার প্রতি অবজ্ঞা ও বিদ্রূপের মনোভাব ত্যাগ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে জনতার রোষাগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হয় সে।
একে যদি গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের একটি তুলনামূলক প্যারাবল বলে বিবেচনা করি, তাহলে এই নাটকের একটি অর্থ স্পষ্ট হয়। ইংরেজ রাজাকে খুশি করতেই শেক্সপিয়র এই নাটক লিখেছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জনতার শাসন কোনোক্রমেই গ্রহণীয় হতে পারে না, কারণ জনতা আবেগপ্রবণ, ক্ষুদ্র বুদ্ধিসম্পন্ন ও ঐশ্বরিক অনুশাসনের বিরোধী। গভীরভাবে অগণতান্ত্রিক এই নাটক সম্ভবত তার মেজাজ ও বার্তার জন্য আধুনিক দর্শকের কল্পনায় স্থান করে নিতে পারেনি।
অন্য সমস্যা, এই নাটকে করিওলেনাস নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনো সুযোগই পায় না। শেক্সপিয়রের প্রতিটি প্রধান নাটকের সেরা ঐশ্বর্য, তার জোর, নায়কের চরিত্র – তার দ্বৈততা, অনিশ্চয়তা, সন্দেহ। তাঁর নায়কের সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয় অপূর্ব কাব্যম–ত স্বগতোক্তিতে। মনে করুন হ্যামলেট, কিং লিয়ার অথবা জুলিয়াস সিজার। সে-তুলনায় এই নাটকে আদৌ কোনো 888sport app download for androidীয় স্বগতোক্তি নেই।
নাটকের বেশকিছু সাব-পস্নলট রয়েছে – যেমন, করিওলেনাসের সঙ্গে তার মা ভলুমনিয়া ও ভলস্কিয়ানদের নেতা আউফিডাসের বিপরীতমুখী সম্পর্ক – যার কোনোটাই পর্যাপ্ত অনুসরিত হয়নি। নাটকের শেষ দৃশ্যে কার্যত প্রতিবাদ ছাড়াই মৃত্যু হয় উদ্ধত এই রোমান যোদ্ধার। বীর সে, সম্ভবত সে সৎ, অথচ মৃত্যুর আগে ভলস্কিয়ানদের প্রতি তার ক্রুদ্ধ চিৎকার – ‘আমি একাই তোমাদের পরাস্ত করেছিলাম’ – কারো মনে সহানুভূতির জন্ম দেয় না।
করিওলেনাসের কাহিনিগত অসংলগ্নতা সত্ত্বেও যে-দক্ষতায় ড্যানিয়েল সালিভ্যান নাটকটি মঞ্চস্থ করেন, তা আমাদের বিস্মিত করে। একটি অপরিবর্তিত মঞ্চসজ্জা – যা একই সঙ্গে নগর রক্ষার জন্য নির্মিত প্রতিরোধ ব্যূহ, নগর পরিষদ ও সাধারণ নাগরিকদের সভাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় – এরূপ উন্মুক্ত মঞ্চের জন্য অত্যন্ত উপযোগী মনে হয়েছে। নিরাভরণ অথচ অর্থপূর্ণ। দর্শকদের অতিনিকটবর্তী দূরত্বে একাধিক যুদ্ধদৃশ্যের মঞ্চায়ন ও দর্শকদের সারি থেকে নাট্যচরিত্রসমূহের প্রবেশ ও প্রস্থান নাটকীয় ঘনত্ব নির্মাণে সহায়ক হয়েছে। সর্বোপরি নাম চরিত্রে জনাথন কেইক ও ভলুমনিয়া চরিত্রে কেইট বার্টনের অসাধারণ অভিনয় আমাদের মন ভরিয়ে দেয়।
অ্যাম্পিথিয়েটারে বসে এই নাটক দেখার আসল মজা অবশ্য অন্যত্র। শেষ বিকেলের আভা নিয়ে যে-নাটকের
শুরু, তা শেষ হয় প্রায় মধ্যরাতের আঁধারে। ম্যানহাটনের বুকের মাঝখানে, ইট-পাথর অতিক্রম করে এক নান্দনিক অরণ্যের ভেতর চারশো বছরের পুরনো এক নাটক, তার এই মঞ্চায়ন আমাদের সময় ও স্থানের সব চেতনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। 888sport live chatের শক্তি সম্বন্ধে নতুন সম্ভ্রম জাগায়।