অপূর্ব শর্মা
হাওরের কাদামাটি-জলে কত সংগীত সুরস্রষ্টার জন্ম হয়েছে তার সঠিক হিসাব হয়তো বের করা যাবে না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে এমনসব মানুষ ছিলেন যাঁরা স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত। তাঁদেরই একজন রামকানাই দাশ। সংগীতের সব শাখাতেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি তবলায় যেমন পারদর্শী ছিলেন, ঠিক তেমনি পারঙ্গম ছিলেন সেতারে; হারমোনিয়ামে যতটা সবালীল ছিলেন, ততটা ছিলেন ঢোলক-মৃদঙ্গে। তাঁর কণ্ঠে যেমন সাবলীল ছিল লোকসংগীত, তেমনি একই ধারায় প্রবহমান ছিল রবীন্দ্রসংগীতও। শাস্ত্রীয়সংগীতে তাঁর দখল ছিল অনন্য। যেমন গানে তেমন বাদ্যযন্ত্রে, সমান পারদর্শী ছিলেন রামকানাই দাশ। গত ৫ সেপ্টেম্বর না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এই সংগীতগুণী। তাঁর প্রয়াণে সুরের আকাশ থেকে হারিয়ে গেল আরো একটি ধ্রুবতারা।
রামকানাই দাস ১৯৩৫ সালের ১৫ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার পুটকা গ্রামে বাবার মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামে।২ তাঁর মায়ের নাম দিব্যময়ী দাশ, বাবা রসিকলাল দাশ। তাঁরা দুজনেই ছিলেন সংগীতের মানুষ। গান বাঁধতেন, গান গাইতেন উভয়েই। শুধু তাঁর বাবা-মা নন, তাঁদের পূর্বসূরিরাও ছিলেন একই ভুবনের বাসিন্দা। রামকানাই দাশের দাদু প্রকাশচন্দ্র তালুকদার ছিলেন গুণী888sport live chatী। তিনি উরি এবং ঘাটুগানে পারদর্শী ছিলেন। গানও লিখতেন। প্রকাশচন্দ্রের পিতা রামচন্দ্রও ছিলেন সুরের পথের পথিক। তিনি অসংখ্য ঘাটুগান রচনা করেছেন। উত্তরাধিকারসূত্রেই সংগীতের ধারা প্রবহমান ছিল রামকানাই দাশের রক্তে। সেই স্রোতধারা এবং নিজের প্রচেষ্টা রামকানাই দাশকে আসীন করে অনন্য উচ্চতায়।
রামকানাই দাশের পিতা রসিকলালের একটি গানের দল ছিল। বর্ষায় আশপাশের গ্রামের লোকজন গান শুনতে তাঁর দলকে আমন্ত্রণ জানাত। পার্শ্ববর্তী রামপুর গ্রামের তাঁদেরই নিকটাত্মীয় রাধাকান্ত সরকারের বাড়িতে এক গানের আসরে বাবার সঙ্গে রামকানাইও যোগ দিয়েছিলেন। সেই আসরে গান করেছিলেন ছোট্ট রামকানাই। টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গাওয়া রামকানাইয়ের সে-গানে আবিষ্ট হয়েছিলেন শ্রোতারা। রসিকলালও গর্বভরে শুনেছিলেন অনুষ্ঠানে গাওয়া নিজ পুত্রের প্রথম গান। সেই থেকে বাড়িতে কোনো অতিথি এলে গান শোনাতে হতো রামকানাইকে। রামপুরের সেই রাধাকান্ত সরকার যখন যাত্রাদল গঠন করলেন তখন একটি চরিত্রের জন্য প্রথমেই তাঁর মাথায় আসে রামকানাইয়ের নাম। তিনি চলে আসেন মাসতুতো ভাই রসিকলালের বাড়িতে। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠশেষে সেদিন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্ত্তত হচ্ছিলেন রামকানাই। রাধাকান্ত রসিকলালকে জানালেন, তিনি একটি যাত্রার দল গঠন করেছেন, যদুপতি পালায় কিশোর সুবাহু চরিত্রের জন্য রামকানাইকে তাঁর প্রয়োজন। ছেলের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে প্রথমে রসিকলাল এ-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু রাধাকান্তের অনুরোধ শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি তিনি। সংগীত ও আমার জীবন বইয়ে রামকানাই দাশ সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এভাবে –
কাকু ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি বললেন, আমি নিজে পড়াব রামকানাইকে, তার পড়ার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তা দেখার দায়িত্ব আমার। এলাকায় প্রথম যাত্রাপালায় হাত দিয়েছি, প্রায় নববই ভাগ আয়োজনও সম্পন্ন হয়ে গেছে, রামকানাইকে না দিলে আমার বড় দুর্নাম হবে ঠাকুরদা…। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে কাকু রাজি করে ফেললেন। হয়তো ভেতরে ভেতরে সায় ছিল আমারও। তবে সন্দেহ নেই যে সেটা ছিল আমার জীবনের বিশাল এক বাঁকবদল। আমার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সেখানেই চিরতরে সাঙ্গ হয়ে যায়।২
রামপুরে যাত্রাদলের সঙ্গে সম্পৃক্ততাই তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। সেখানে সংগীতের অনেক কিছুই শিখেছেন রামকানাই। 888sport live chatীজীবনের পেশাদারিত্বের সূচনা সেখান থেকেই। রামপুরের শিক্ষাই তাঁকে আগামীর পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। রামপুরের যাত্রাদল ভেঙে গেলে রাধাকান্ত সরকার রামকানাইকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। 888sport live chatী-সম্মানী হিসেবে রসিকলালের হাতে তিনি তুলে দেন একশ টাকার নোট। রামকানাই যাত্রাদলে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন বেশ দক্ষতার সঙ্গেই। সে-কারণে পরের বছর পার্শ্ববর্তী আঙ্গারুয়া গ্রামে যাত্রাদল গঠিত হলে সেখানেও ডাক পড়ে তাঁর।
যে-বয়সে লেখাপড়া করার কথা, সে-বয়সে রামকানাই দাশ যাত্রা888sport live chatী হিসেবে এ-দল থেকে সে-দলের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন, এতে অর্থও উপার্জন হচ্ছিল – এ-পরিস্থিতিতে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন রসিকলাল। কারণ ক্ষেত-কৃষি থেকে যে-পরিমাণ আয় হয় তা দিয়ে সকল ছেলেমেয়ের লেখাপড়া করানো তাঁর পক্ষে ছিল প্রায় অসম্ভব। অনেক ভাবনাচিন্তার পর তিনি রামকানাইকে পড়ালেখার বদলে ক্ষেত-কৃষি ও গান-বাজনা করার পরামর্শ দেন। এটা যেন ছিল রামকানাই দাশেরও মনের কথা। বাবার কথায় তাই রাজি হয়ে গেলেন। গানবাজনার জন্য রসিকলাল ছেলেকে একজোড়া তবলা কিনে দেন। তবলায় আবিষ্ট হলেন রামকানাই। এতটাই আত্মমগ্ন হলেন, তখন তাঁর মাথার মধ্যে শুধু যাত্রার আখড়াই খেলা করত। যেখানেই যাত্রাগান হতো সেখানেই ছুটে যেতেন। উদ্দেশ্য যাত্রা থেকে গানবাজনা শেখা। কারণ সে-সময় ভাটি অঞ্চলে গানবাজনা শোনার অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল যাত্রাগান। কলের গান কিংবা রেডিও তখনো পৌঁছেনি ভাটি অঞ্চলে। যাত্রার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায় রামকানাই দাশের ভাষ্যে –
আমার বয়স তখন বারো কি তোরো হবে। তখন আশ্বিন মাসে প্রতি পূজামন্ডপে গ্রামাঞ্চলে যাত্রাগান হতোই। খবর পেলাম পাঁচমাইল দূরবর্তী আনন্দপুরে অশ্বিনী রায়ের বাড়িতে যাত্রা হবে। আমাদের গ্রামেও যাত্রা ছিলো, ছিলো পাশের গ্রামেও। কিন্তু আনন্দপুরে ভালো দলের গান হবে শুনে সেখানেই যাব স্থির করলাম।
সন্ধ্যার পর খাওয়া-দাওয়া সেরে রওনা হবার সময় দেখি – একমাত্র আমি, মহারাজদা ও নন্দকুমারদা ছাড়া সবাই চলে গেছে। তখন ভরা বর্ষা না হলেও অন্যগ্রাম যেতে হলে নৌকাই ছিলো একমাত্র বাহন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোনো নৌকা বা অন্য কোনো সঙ্গী পেলাম না। অথচ যাত্রা দেখতে যেতে হবেই আমাদের। সিদ্ধান্ত নিলাম সাঁতরেই চলে যাব পাঁচ-ছ মাইল দূরের আনন্দপুর গ্রামে। আশ্বিনের সে সময়টায় গ্রামাঞ্চলে বিষধর শাপের চলাচল বেড়ে যায়, তদুপরি রাত্রিকাল।… মাথায় লুঙ্গি ও শার্ট বেঁধে কেবল আন্ডারওয়্যার পরে কিছু কোমরপানি, কিছু গলাপানি, আবার খানিকটা সাঁতার। এভাবে কচুরিপানার দলা ও ঝোপঝাড় মারিয়ে শ্যামারচর, লৌলারচর, গোপালপুর প্রভৃতি গ্রাম পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম জয়পুর পর্যন্ত। তখন রাত প্রায় দশটা বাজে।৩
এভাবেই গানবাজনা শিখতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটে গেছেন রামকানাই। তাল ও সুরের প্রতি এতটাই মোহাচ্ছন্ন ছিলেন যে, স্থান-কাল সবকিছু ভুলে যেতেন। এমনকি শূন্যে আঙুল চালিয়ে তবলার বোল বাজাতেন। সংগীতের প্রতি তাঁর এই গভীর অনুরাগকে অনেকে পাগলামি ভাবতেও দ্বিধা করেনি। তাঁর অহর্নিশ গুনগুনানিকে মাথা খারাপের লক্ষণ বলে মায়ের কাছে ছেলেকে কবিরাজ দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন পাড়া-প্রতিবেশীর কেউ কেউ। কিন্তু লক্ষ্যের প্রতি অবিচল ছিলেন রামকানাই। বর্ষার ছ-মাস যাত্রার দলে আর বাকি ছ-মাস কৃষিকাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন তিনি। যদিও কৃষিকাজ আর সংগীত কোনোভাবেই সমার্থক ছিল না। যে-হাত কাদামাটিতে একাকার হয়ে যেত, লাঙল ধরে শক্ত-সামর্থ্য যে-হাত, সে-হাতে তবলার বোল কিংবা সা-রে-গা-মা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু দমে যাননি রামকানাই। দূরবর্তী হাওরের ডেরাতেও সঙ্গে থাকত তবলা। হাওর-সংলগ্ন গ্রামগুলোর রাতের গানের আসরে নিত্য-যাতায়াতও ছিল তাঁর। তখন কবিগায়ক হিসেবে এলাকায় বেশ সুনামও হয়েছে রামকানাইয়ের। গানবাজনা হলেই ডাক পড়ে। এই পরিস্থিতিতে নিজেই গঠন করেন একটি পালাগানের দল। ততদিনে তবলায়ও তিনি বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। দলের সংগীত-পরিচালক ছিলেন নিজেই। দল গঠন এবং পরিচালনা – এ যেন অন্য এক রামকানাইকে দেখল এলাকার মানুষ। কিন্তু শাস্ত্রসম্মতভাবে তখনো তালিম নেওয়া হয়নি তাঁর। ১৯৫২ সালে৪ আকস্মিকভাবেই সেই সুযোগ আসে। বাজারে গঠিত যাত্রাদলে তবলা সংগতের জন্য দলের ম্যানেজার চিতুবাবু তাঁকে মনোনীত করেন। এ-দলের সংগীত-পরিচালক ছিলেন আজমিরীগঞ্জের কালীমোহন চক্রবর্তী। চিতুবাবু রামকানাইকে কালীমোহনের কাছে নিয়ে যান। তাঁকে বাজনা শোনালেন রামকানাই। কালীমোহন বললেন, ‘ওতে চলবে না, আরো শিখতে হবে।’ শুরু হলো রামকানাইয়ের আনুষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষাগ্রহণ-পর্ব। কালীমোহন মনপ্রাণ ঢেলে তবলা এবং গান শেখাতে লাগলেন রামকানাইকে। দিনে পনেরো-ষোলো ঘণ্টা চর্চা করতে হতো। ভারতীয় সংগীতের খাস বন্দিশ গুরু কালীমোহনের কাছ থেকেই আয়ত্ত করেন তিনি। সেই শিক্ষাই পরিণত করে রামকানাই দাশকে। একটু-একটু করে সুনামও ছড়াতে থাকে চারদিকে। জীবিকার জন্য গান শেখানো শুরু করেন তখন। তবে, যখন যেখানে যে-পরিস্থিতিতে সুযোগ পেয়েছেন সংগীত শিক্ষার, তা কাজে লাগাতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি। এলংজুরীর শচীন্দ্র মাস্টারের কলের গান এবং ভাটিপাড়ার ফয়জুননুর চৌধুরীর রেডিও শুনে অনেক গান শিখেছেন রামকানাই। কিন্তু এতেও মন ভরছিল না তাঁর। আরো শিক্ষা প্রয়োজন। সে-উদ্দেশ্যেই ১৯৫৬ সালে বাবা-মায়ের সম্মতি নিয়ে পাড়ি জমান আগরতলায়। সেখানে তপন নন্দীর কাছে তবলা শিক্ষা শুরুও করেন। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার কারণে গ্রামে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। জন্মদাত্রীর জন্য ওষুধ আনতে ছুটে যান আজমিরীগঞ্জে। মায়ের জন্য ওষুধ আনতে যাওয়াই আশীর্বাদে পরিণত হয় তাঁর জীবনে। রামকানাই দাশের বক্তব্যে তা যেন সুস্পষ্ট –
মার অসুখ আমার জীবনের মোর ঘুরিয়ে দেয় অপ্রত্যাশিত আলোকোজ্জল ভুবনের দিকে। মার অসুখের খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আগরতলা থেকে বাড়ি ফিরে আসি। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আজমিরীগঞ্জে চলে যাই ঔষধের জন্যে, আজমিরী তখন সিলেটের অতি বিখ্যাত নৌবন্দর। সুরম্য সুবিশাল অট্টালিকা শোভিত এমন নৌবন্দর তখন থানা পর্যায়ে তো দূরের কথা, সিলেটের কোনো মহকুমা পর্যায়েও দেখা যেত না…। তখন দিরাইয়ের চাইতে আমাদের যোগাযোগ আজমিরীর সাথেই বেশি ছিল। আমাদের শ্যামারচর বাজারসহ গোটা থানার ছোটবড় সকল বাজার-হাটের পাইকারি ক্রয়কেন্দ্র ছিল আজমিরীগঞ্জে…।
সন্ধ্যার পর বাজারে ঘোরাফেরা করছি, হঠাৎ শুনি কোথা থেকে গানবাজনার শব্দ আসছে। লক্ষ করলাম, একটি ফার্মেসির পেছনের বাসা থেকে সে-শব্দ আসছে। ফার্মেসির নাম ‘মেসার্স রাজচন্দ্র ফার্মেসী’। ফার্মেসির প্রধান চেয়ারে একজন সৌম্যদর্শন ডাক্তার বসে আছেন। মেয়ে কণ্ঠের গান, দোকানের সামনের হেলান বেঞ্চে বসে স্বভাবদোষবশত টেবিলে তাল ঠুকছিলাম। ডাক্তার বললেন, তাল বাজাইও না, এটা গদি। কী চাও তুমি?
উত্তর দিলাম আমি গান শুনছি। আমি একজন সংগীত শিক্ষক, কিঞ্চিত গানবাজনা জানি। নামধাম জানালাম তাঁকে। মেঘ না চাইতেই জলের ন্যায় আমি তার সস্নেহ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম নিমিষে। ডাক্তার বাবু নিজে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।৫
আজমিরীগঞ্জের সেই গানের আসরই তাঁর জীবন চলার পথ বদলে দেয়। তাঁর গানবাজনা শুনে স্থানীয় বিশিষ্টজনেরা তাঁকে আজমিরীগঞ্জে গান শেখানোর জন্য থেকে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁরা তাঁকে দশটি টিউশনিরও ব্যবস্থা করে দেন। আজমিরীগঞ্জে অবস্থানকালে শাস্ত্রীয়সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হন তিনি। ড. কৃষ্ণধন রায়ের বাসার রেডিও সেই অনুরাগ তৈরি করে। আজমিরীগঞ্জে পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেন। তবে জানার আগ্রহ তাঁকে এক স্থানে বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয়নি, একপর্যায়ে আজমিরীগঞ্জ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাড়ি জমান। সেখানে কিছুদিন তামিল নেন সুরেন্দ্র সূত্রধরের কাছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানকালে বিখ্যাত ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরার সঙ্গে যুক্ত হন, তবলায় সংগত দিতে। সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখারও সুযোগ হয়ে যায় তাঁর। পরিচয় হয় সংগীতের অনেক রথী-মহারথীর সঙ্গে। যাত্রাদলে তিন বছর কাটিয়ে চলে আসেন বাড়িতে। জানতে পারেন, সিলেট বেতারে লোক নেবে। অডিশন দিতে আসেন সিলেটে। তবলা, ক্লাসিক্যাল ও নজরুল সংগীতে পাশ করেন, চাকরি হয় রেডিওতে। ১৯৬৭ সালের ১৭ আগস্ট স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে সিলেট বেতারে যোগ দেন তিনি। কিন্তু নানা কারণে সেই চাকরি বেশিদিন করতে পারেননি। নয় মাসের মাথায় সিলেট বেতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তিনি।৬
বেতারে চাকরির সুবাদে সিলেটের সংগীত ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রায় সবার সঙ্গেই রামকানাই দাশের সখ্য গড়ে ওঠে, যা পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর জীবনচলার পথে সহায়ক হয়েছে। বেতারের চাকরি ছাড়লেও আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সিলেটে গান শেখানো শুরু করেন। অভূতপূর্ব সাড়া পান। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় সামলানো মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয় পর্যায়ে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা সুনাম অর্জন করতে থাকে। কিন্তু সেই অভিযাত্রায় ছন্দপতন ঘটে ১৯৭১ সালে। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওপারে পাড়ি জমাতে হয় তাঁকে। দুঃসহ সে-সময়ে অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে যুদ্ধজয়ের গান। শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে জনতার মনোবল সঞ্চারে গেয়েছেন সাহস-জাগানিয়া গান। আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি আশাহত মানুষকে।
দেশ স্বাধীন হলে ফিরে আসেন সিলেটে। শুরু হয় নতুন করে পথচলা। সংগীতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৮ সালে ‘সঙ্গীত পরিষদ’ গঠন করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন সংগীত শিক্ষাদান। নিজেও গাইতে থাকেন। বিশেষ করে তাঁর শাস্ত্রীয়সংগীতের পরিবেশনা চমৎকৃত করে সংগীতপ্রিয় মানুষদের। দেশের সব শাস্ত্রীয়সংগীত সম্মেলনে যোগ দিয়ে নিজের জাত চেনান রামকানাই। সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। শুধু খেয়াল সংগীতেই নয়, রবীন্দ্রসংগীত ও লোকসংগীতেও তাঁর চমৎকার পরিবেশনা মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে শ্রোতাদের। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ওয়াহিদুল হকের মন্তব্যে –
সংগীতের সূক্ষ্মবোধ তার মতো কারো মধ্যে দেখিনি। খেয়াল শৈলীর এই পরমগুরু বোধকরি একমাত্র উচ্চাঙ্গসংগীতের উস্তাদ যিনি প্রকৃত রবীন্দ্রসংগীতমনস্ক। তিনি শেখানও তা এবং শেখাতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসান। আমাদের দেশীয় গ্রাম্য গানের বিষয়েও তার রুচি, অভিজ্ঞতা এবং অধিকার অতুলীয়।৭
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান রামকানাই দাশ। সংগীত পরিষদ নিউইয়র্ক শাখায় শিক্ষার্থীদের উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম দিতে গেলেও একটানা বেশিদিন সেখানে থাকতে পারতেন না। বছরের ছ-মাস প্রবাসে আর ছ-মাস থাকতেন দেশে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে সোজা গ্রামের বাড়িতে চলে যেতেন, বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠতেন আড্ডায়। স্রোতস্বিনী নদীতীরে বসে খেলতেন তাস। বাতাসের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে খোলা গলায় গাইতেন গান। ‘বিদেশ কখনো স্বদেশ হয় না’ – এই উপলব্ধি ছিল তাঁর মর্মমূলে।
কবিগান, বাউলা, বাউল ও মালজোড়া, ঘাটু, উরি প্রভৃতি গান তাঁর কণ্ঠে ছিল একেবারেই সাবলীল। ‘বন্ধুর বাঁশি বাজে’ (২০০৪), ‘সুরধ্বনির কিনারায়’ (২০০৫), ‘রাগাঞ্জলি’ (২০০৬), ‘অসময়ে ধরলাম পাড়ি’ (২০০৬) এবং ‘পাগলা মাঝি’ (২০১০) অ্যালবামগুলোতে তাঁর কণ্ঠজাদুর নিদর্শন এখনো বর্তমান।
অসংখ্য গুণী মানুষের সংস্পর্শ রামকানাই দাশের চলার পথকে করেছে ঋদ্ধ। তিনি সময়ের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছেন নিরন্তর। সে-চেষ্টাই তাঁকে সংগীতের পন্ডিততুল্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার শিখরে পৌঁছে দেয়। সংগীতকে যেমন তিনি দিয়েছেন, ঠিক তেমনি সংগীতও তাঁকে খালি হাতে ফেরায়নি। সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯১ সালে ‘অগ্রদূত 888sport live chatীগোষ্ঠী সম্মাননা’, ১৯৯৭ সালে ‘ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন 888sport sign up bonusপদক’, ১৯৯৯ সালে ভারতের শিলচরের ‘সংগীতচক্র সম্মাননা’, ২০০০ সালে ‘রবীন্দ্র পদক’, ‘উর্বশী পদক’, ‘শাপলা 888sport live chatী গোষ্ঠী গুণীজন পদক’, ২০০২ সালে ‘স্বপ্নিল প্রডাকশন সম্মাননা’, ২০০৩ সালে ‘শুদ্ধ সংগীত প্রসার গোষ্ঠী সম্মাননা’, ২০০৫ সালে ‘হাছন রাজা ফোক ফেস্টিভাল সম্মাননা’, ২০০৭ সালে ‘সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড’, ২০০৮ সালে ‘ব্রাহ্মসমাজ সম্মাননা’, ২০০৯ সালে ‘শিকড় সম্মাননা’, ২০১০ সালে ‘নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট সম্মাননা’, ২০১২ সালে ‘বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ’, ২০১৩ সালে ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পদক ৮’ ও ২০১৪ সালে ‘888sport cricket BPL rateে পদক’সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি।
লেখক হিসেবেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন রামকানাই দাশ। ২০০৫ সালে অমর 888sport cricket BPL rateে বইমেলায় তাঁর সংগীতবিষয়ক বই সরল সঙ্গীত শিক্ষা প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে আত্মজীবনী সঙ্গীত ও আমার জীবন। তাঁর আত্মজীবনীটি পাঠক ও সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসিত।
উত্তরাধিকারসূত্রে সংগীতের যে-ধারা প্রবাহিত ছিল তাঁর রক্তে, তা পরবর্তী প্রজনেমর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন রামকানাই দাশ। তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবাই এই ভুবনের বাসিন্দা। শুধু কি পরিবারের সদস্যরাই, অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছ থেকে তালিম নিয়ে হয়েছেন সুরের পথের পথিক। প্রবহমান সংগীতের মাঝেই বেঁচে থাকবেন তিনি – এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র
১. দৈনিক যুগভেরী, সিলেট, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪।
২. সংগীত ও আমার জীবন, রামকানাই দাশ, 888sport app ২০১১, পৃ ২৫।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ ১২২।
৪. ‘যন্ত্রের সাহায্যে চলেছি’, দৈনিক কালের কণ্ঠে ২৭ মে ২০১০-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকার।
৫. সংগীত ও আমার জীবন, প্রাগুক্ত, পৃ ৪৯-৫০।
৬. দৈনিক কালের কণ্ঠ, প্রাগুক্ত।
৭. সংগীত ও আমার জীবন, প্রাগুক্ত, ফ্ল্যাপ-১।
৮. রামকানাই দাশের নন্দনভুবন, অন্তরঙ্গ আলাপ, সুমনকুমার দাশ, সিলেট, ২০১৪।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.