সংগীতহীন অন্ধকারে চলেছে যে পথিকেরা

888sport appয় আমরা সত্যেন বোস-কাজী মোতাহারদের গানের আড্ডার কালটি পাইনি। কিন্তু পেয়েছি তার 888sport sign up bonus। এই আড্ডার কথা জেনেছিলাম স্বয়ং আড্ডার আড়তদারের মুখেই। একষট্টি সন। কর্ণফুলির ইসমাইল সাহেব মেলা টাকা দিয়েছেন ছায়ানটকে, স্কুল আরম্ভ করবার জন্যে। ছয় হাজার টাকা! স্থির করলাম আমরা যন্ত্রপাতি যতীন থেকেই নেব। যতদূর মনে পড়ে সন্জীদা তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন সাহেবকে বলেছিলেন আমাদের সঙ্গে যেতে। ভাবতে ভালো লাগছে যে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আমার ভুলও হতে পারে। ভালো লাগছে বলেই হয়তো অমনটা ভাবছি। ভুলের সম্ভাবনা জেনেও বলছি, পাটুয়াটুলীতে যতীন অ্যান্ড কোংয়ের দোকানে যেতেই আমাদের যেন অভ্যর্থনা করে দোতলায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে এক বৃদ্ধ, কাজী সাহেবের চাইতেও, বসেছিলেন। একটি দুটি কথা কইলেন তাঁর প্রাক্তন দিনের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। কাজী সাহেব কানে ভালো শোনেন না। যতীনবাবু জোরে বলতে পারেন না। কথা জমল না তাঁদের, কিন্তু খুব আহ্লাদ হলো মিষ্টিতে আমাদের সয়লাব করে দিয়ে। অবাক তাকিয়ে থাকি বুড়োর দিকে। এই রূপকথার নায়ক যতীন মণ্ডল! বিশ ত্রিশের দশকে পূর্ববঙ্গ আর আসামের এমন কোনো সচ্ছল বাড়ি ছিল না, যেখানে তাঁর বানানো হারমোনিয়াম ঢোকেনি। এখনকার পশ্চিমবঙ্গে যতীনবাবু কতটা প্রবেশ পেয়েছিলেন জানি না। কিন্তু তাঁদের বাঘাসুর গ্রাম, 888sport app থেকে মাওয়া রোড ধরে কিছুদূর গেলেই, এবং তার সংলগ্ন অনেক অনেক গ্রামে, যেমন-ব্রাহ্মণকৃত্যা বা বামনকিত্যা ইত্যাদিতে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে ছিল হারমোনিয়াম ও 888sport app সংগীতযন্ত্র নির্মাণের কারিগর। হয়তো যতীনবাবু ঐ ট্রাডিশনের একজন এবং অবশ্যই তিনি তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্য দিয়ে, কত যে গ্রামের কর্মদাতা মহাপুরুষ ভাবলে অবাক লাগে। সেই নায়ককে চর্মচক্ষে দেখছি আর বাক্য-নবাব আমি চুপ হয়ে যাচ্ছি।

যতীনবাবুর জামাই অশ্বিনী মণ্ডল মশাই কার্যত সব কথাবার্তা বললেন, আমাদের অর্ডার নিলেন। তাঁর ছেলে শ্যামলকে তখন দেখেছি বলে মনে পড়ে না, যতীনবাবুর ছেলেকেও না। কথায় কথায় বেরিয়ে এল বিভাগপূর্ব 888sport appর এক আশ্চর্য ইনস্টিটিউশনের   কথা। যতীন কোম্পানিতে ফি শনিবারে গানের আড্ডা, সকাল-সকাল দোকান বন্ধ করে দিয়ে। আসতেন বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের, বোস-আইনস্টাইন সুপারকনডেনসেট তথা তথা সুপার-অ্যাটমের সত্যেন বসু, জগজ্জয়ী পদার্থ-গণিতবিদ বাজাতেন এস্রাজ। আসতেন সাইকেল চালিয়ে ঢ্যাঙা টিংটিঙে অধ্যাপক কাজী মোতাহার, গৌরবর্ণ ক্লিনশেভড উজ্জ্বল মুখশ্রী, শুভ্র ধুতিজামাতে খোলতাই। গুল মুহম্মদ খাঁ আগ্রাওয়ালা থাকতেন কাছেই। নিয়মিত আসতেন
কি-না জানি না। আগ্রাতে জন্ম তাঁর বড় ছেলে ইউসুফ খান কোরায়শি, দঙ্গল লড়বার বয়স তখন তাঁর, নিশ্চয় আসতেন। আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন হেকিম মুহম্মদ হোসেন, কাজী সাহেবসহ এক পুরো প্রজন্মের সংগীতগুরু। খাঁটি 888sport appইয়াদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বড় কোনো গুণীর কথা আমি শুনিনি। সন্জীদার দিদিরা পর্যন্ত তাঁকে পেয়েছেন, আমার দুর্ভাগ্য আমি পাইনি। এমন কি লতিফ দারোগা সাহেবের (নূরুল কাদের সিএসপির বাবা) কনিষ্ঠা কন্যা রেণুও তাঁর কাছে গান ও সেতারে তালিম নিয়েছিলেন দীর্ঘদিন।

আর আসতেন হেকিম সাহেবের দুই ছেলে, আমান আলী ও মুনীর হোসেন। আমান জবরদস্ত টপ্পাবাজ ছিলেন। মুনীর হোসেন যত না গান করতেন, কূটতর্ক তুলতেন তার বেশি, রীতিমতো বেয়াদবি মনে হতো হেকিম সাহেবের। কয়েকবার আড্ডা থেকে দেবদর্শন সৌম্যমূর্তি হেকিম সাহেব তাঁকে বারও করে দিয়েছিলেন। এই ছেলেটি তাঁর স্বভাবের মতো দেখতেও ছিলেন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তোবড়ানো গাল, চেহারা মূর্তিমান পাঁচ। তা ওই চেহারা আর স্বভাবের দুর্বাসাপ্রায় পরিখা ডিঙিয়ে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সংগীত-সোনাকে আবিষ্কার করবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।

টপ্পাবাজ রমজান খাঁ 888sport appয় ছিলেন অনেককাল। কিন্তু মুহম্মদ হোসেনের টপ্পা যেন রাণাঘাটের নগেন দত্ত মশাইয়ের কাছেই আহরিত ছিল মনে হয়। তাঁর প্রতিভাধর পুত্র আমান আলী (নিশ্চয় ভিন্ডি বাজারের আমানকে মনে রেখেই তার নামকরণ হয়েছিল) 888sport appর কুখ্যাত এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুলি খেয়ে মারা যান। রইলেন মুনীর হোসেন, স্বভাবদোষে নিজের কপাল নিজে খাবার জন্যে। আমার যদি কিছুমাত্রও সংগীতবোধজনিত সঞ্চয় দাঁড়িয়ে থাকে সাতটি দশক পেরিয়ে, তার মূলে তিনি। ভাতখণ্ডের বইয়ের অধিকাংশ তাঁর আয়ত্তে ছিল, ভাতখণ্ডের সূত্রে নয়, সেই বই তিনি দেখেননি জীবনে। কখনো রেডিও কিংবা গ্রামোফোন শুনতে দেখিনি তাঁকে। হঠাৎ একদিন চম্পক রাগে ‘এ মগজাই’ গানটি এক লাইন-দুই লাইন গেয়ে উঠলেন। ও-গান যে ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত রেকর্ডে ধৃত, সে বিষয়ে তিনি অচেতন ছিলেন।

আজ খুবই কুণ্ঠিতচিত্তে, এবং চোখের জলে, তাঁকে 888sport app download for android করি। তাঁকে অত্যন্ত হীনাবস্থায় পতিত দেখেছি। মনে হয় না সংসার নির্বাহের জন্য প্রয়োজন যৎকিঞ্চিৎও তিনি সংগ্রহ করে উঠতে পারতেন। আমিও ছিলাম এক সহায়-সম্বলহীন নির্বিত্ত বাড়ির পিতৃহারা জ্যেষ্ঠ সন্তান, মাথা উটকো বুদ্ধিতে ভরা। তাঁর কোনো উপকারেই লাগেনি আমার জীবন। বিচ্ছেদের পর মনটা যখন আমার মুনীর হোসেন তৃষ্ণায় আইঢাই করছে খবর পেলাম তিনি তাঁর আমলিগোলার বাড়িতে কণ্ঠ-কর্কট রোগে মারা গিয়েছেন। এমনই হয়েছে আমার বারে বারে। আমার সময় যখন হয় তখন আর গুণীকে পাই না। আমি সন্ন্যাসী উপগুপ্ত নই যে বাসবদত্তার প্রয়োজনকালে ঠিক উপস্থিত হয়ে যাবো।

মকিম কাটরা দিয়ে মৌলভীবাজারে ঢুকতেই ডানদিকে বোধ হয় কড়াই হাট্টা কিংবা রুইহাট্টার গলির পাশে এক দোতলা বাড়ি। নিচের তলায় সেখানে বয়স্কা হিন্দুস্তানি মেয়েরা মটরকলাই ছোলাবুট ভাজে সারা দিনমান। তার খাবো-খাবো গন্ধে এলাকাটা মেখে থাকে। সে বাড়ির দোতলা থেকে কিন্তু আসে সংগীতের ধ্বনি সকালে সন্ধ্যায়। একদিন আমি ঢুকেই পড়ি এক সন্ধ্যারাতে। এক নবযুবা বসন্ত গেয়ে উঠল কি পরজ। ধরল খাম্বাজে সেই বিখ্যাত ঠুমরি, ‘সাঁওরিয়ারে, কাহে মারে নজরিয়া’। যুবকের নাম মমতাজ। গানের টানে প্রায় সন্ধ্যায় সেখানে যাই। একদিন শুনি নিম্নকণ্ঠে কে কুঁইকুঁই করে দক্ষিণী ঢঙে ভাজছে দুর্গা। পরে ইদু মিঞাকে আমি জিজ্ঞাসা করি তাঁর এই বিরল এবং দুর্গম গায়কীর মূল কোথায়। তিনি অত্যন্ত সপ্রতিভভাবে জানালেন, মাদ্রাজে তাঁর পানবিড়ির দোকান ছিল। বউ বাচ্চা ছিল না, তাই গান আর পান নিয়ে কেটেছে কয়েক বছর। সেই প্রভাব। তাঁরা বললেন, ওস্তাদকে পেতে হলে সকালে আসবেন।

এইখানে একটু ঘুরে আসি পুরনো 888sport appর কথা মনে করে। 888sport appয় বাবা মাকে, আমাকে, বাচ্চুকে (মিতা হকের বাবা, প্রবীণ সাংবাদিক রেজাউল হক) ও শহীদ জিয়াউল হককে নিয়ে 888sport appয় এসে সংসার পাতেন উনিশ শ’ আটত্রিশের দিকে। ভাড়াবাড়িতে কখনো ছিলাম সাত রওজায়, এখনকার আনন্দ বেকারির উল্টাদিকে। কখনো চুড়িহাট্টায় অবৈতনিক মিউনিসিপ্যাল প্রাইমারি স্কুলের বিপরীতে। ওটা আজগর লেইন, না আজিম বখশ সাবুনওয়ালার হায়দর বখ্শ্ লেইন, গুলিয়ে যাচ্ছে। কেবল মনে আছে বাসার পাশ দিয়ে এক গলির গলি তস্য গলি ছিল উর্দু রোডে বেরোবার। তাতে একটু ফায়লা জায়গায়, গফুর সাহেবের বাড়ির সামনে, ছিল সরকারি জলকল। বাড়িতে বাড়িতে তখন জলসংযোগ ছিল না। সচ্ছল বাড়িতে ভিস্তিরা চর্মনির্মিত মশকে করে জল দিয়ে আসত। বাকি সকলে রাস্তার কল থেকেই জল নিত। ফলে সকালেই জমে উঠত কলতলায় এক জটলা, বিচিত্র মানুষের। বেশির ভাগ ভাঙা-উর্দুভাষী 888sport appইয়া (আমাদের গ্রামের পুব্যা ভাষায় ঢাক্কুইল্লা), যারা যারা নিজেদেরকে কী মনে করত জানি না, আমাদেরকে বলত বাঙালি। তা সেই প্রভাতী জটলায় বাঙালিও থাকত কিছু, যেন সঙ্কোচভরেই। এই জটলা থেকেই প্রথম কাউকে গেয়ে উঠতে শুনি কল্লু কও্ওয়ালের সেই বিখ্যাত গান ‘প্রেম নগর কি রাহা কঠেন হৈ।’ তখন বুঝতাম না প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ঠিক পাশেই চলে আসছিল উর্দুভাষী গোঁড়া সমাজে একটা গান ও 888sport app download apkর ধারা যা ধর্মকে, প্রচলিত ঈশ্বরধারণাকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করত। ঐ গানটিতেই তো আছে, ‘কয়া (ক্যায়া) মন্দির মেঁ মূরত পূজা, মসজিদ মেঁ কয়া সিজদা করো, প্রেম নগরকি রাহা কঠেন হৈ’। নজরুল উর্দু-ফার্সি গজল থেকে এই সুন্দর মনোভঙ্গিটি পেয়েছিলেন এবং মানবপ্রেমকে হাজার মসজিদ হাজার কাবার চাইতে জ্যোতিষ্মান বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর গানে। উর্দু কবিরা এ পেলেন কোত্থেকে? সুন্নি, বিশেষত ওয়াহাবি ধারায় তো এ রীতিমতো পাপ। পেয়েছেন অবশ্য মধ্যযুগের সন্তকবিদের কাছ থেকে। এবং তাঁরা সকলে গানে গানেই তাঁদের ধর্মদ্রোহ ছড়িয়েছেন, নজরুলও তাই।

888sport appর রাস্তায় তখন অনেকই গান শোনা যেত। তখনও রেডিওর চল আরম্ভ হয়নি, রেকর্ড বাজে জমিদার বাড়ি, সংস্কৃতিমনস্ক হিন্দু মধ্যবিত্তের বাড়িতে। আমাদের বাসার পাশে গরিব 888sport appইয়া পাঙ্খাওয়ালা জাতীয় পাইকারি সাপ্লাইয়ের দর্জিরা বাস করত। তাই বুঝি উর্দু রোড চান্নিঘাট (চাঁদনি) এলাকায় প্রথম গার্মেন্টস 888sport live chat আরম্ভ হয় (রিয়াজ?)। এই বস্তিম তো ঘিঞ্জি এলাকায় কারো বাড়িতে বিয়ে লাগলে কমপক্ষে তিন রাত্রি মেয়েরা সন্ধ্যা সকাল সমস্বরে চেঁচাত (সঙ্গে ঢোলের বাড়ি, মেয়েরাই বাদক) ‘রাতভরি রইয়ো, সাবেরে চলা যাইয়ো জী’ কিংবা ‘পেয়ারে না না দাইয়া, সারোতা কঁহা ভুল গয়ো’। চুড়িহাট্টায় আমাদের একতলা বাড়ির পাশে সুদৃশ্য দোতলা, সেরামিকের চুমকি-করা উজ্জ্বল বাড়িতে থাকতেন আলাউদ্দিন হাল্ওয়াই। আমরা জানতাম তাঁরা বিহারের ভোজপুর থেকে এসেছেন। আলাউদ্দিন সাহেবকে দেখেছি। তাঁর চকবাজারস্থ আদি দোকান থেকে আমরা প্রায়ই পরোটা এবং আদত বাকরখানি (তন্দুর থেকে বার করা) এবং সাগরপালা, নকলদানা জাতীয় মিষ্টি কিনতাম। তাঁর আওলাদেরা ব্যবসাটার আধুনিকায়ন করেছেন। মিষ্টান্নের দিকে ঝুঁকেছেন সার্থক ও সফলভাবে সম্ভবত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কারিগরদের সহায়তায়। মেয়েদের যে রাত জাগানিয়া বিয়ের গান তা যেন কোথা দিয়ে মনে হয় সুদূর ভোজপুর থেকে 888sport appয় আমদানি।

একটু এগিয়ে বাসা নিই আমরা একচল্লিশ বিয়াল্লিশেই। বাড়ির বিপরীতে কেন্দ্রীয় কারাগারের উঁচু পাঁচিল। তখনো রিকশা নামেনি রাস্তায়। পথচারী আসে যায়। পাড়ারই একটি ব্যতিক্রমি উঠতি যুবক, মনসুর। কেমন যেন ঘোরে থাকে সারাক্ষণ। হঠাৎ কোনো সন্ধ্যায় খাম্বাজ কিংবা গারা ঠুমরির হাহা তান শুনে দোতলার ব্যালকনিতে ছুটে গিয়ে দেখি মনসুর। বিজলির মতো চমকে ওঠা সে সুর। যেন মাতাল হয়ে মাথাটা একটু কাৎ করে হাঁটছে মনসুর।

মকিম কাটরার সেই ‘মুহম্মদ হোসেন মিউজিক স্কুলে’ পিদিম-জ্বালা আবছা অন্ধকারে মমতাজ যেন সেই মনসুর। তাদের পরামর্শমতো এক সকালে হাজির হই সে স্কুলে। পদ্মাসনে বসে আছেন মুনীর হোসেন। তাঁকে চিনতাম। এক ছাত্র, ছাব্বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে, তারস্বরে গেয়েই যাচ্ছে নানা রাগে ততোধিক বন্দিশ। থেকে থেকে মারছে তান, যেন হদ্দু-হস্সুদের প্রেত ভর করেছে তাকে। কিন্তু বেহদ্ বেসুর। তার গানে অন্ধকার হয়ে যায় সেই সকালটি, স্থির বসে আছেন গুণী। কিছুই বলছেন না। হয়তো শুনছেনও না। গান শেষ করে শিষ্য বক-মার্কা এক প্যাকেট রাখল পাঁচ টাকার একটা নোটের ওপর। অনুনয় করে বলল, ওস্তাদ নতুন কোনো গান দিন, নতুন কোনো রাগে। ওস্তাদ প্রস্তরবৎ বসেই থাকেন। হতাশ শিষ্য চলে যাচ্ছে দেখে জিগ্যেস করি, আপনি কত গান জানেন? তিনি বলেন, ‘আসসিটা রাগ পাইছি, আউজগা পাইলে একাসিটা অইত।’ এই আমার গুরু পরম গুণী মুনীর হোসেন। নামটা নানা বানানে লিখি, ওঁর নিজের বানান কখনো জানতে পাইনি, লেখাপড়া কেমন ছিল তা যেমন জানিনি। তাঁর শিষ্য মমতাজকে, বহু পরে, গুরুভাই জ্ঞান করে ছায়ানটে নিয়োগ দিই। তখনও মমতাজের স্বরজ্ঞান, রাগদারি বজায় ছিল এবং মাঝে মাঝেই আমাকে চমকে দিত পাঞ্জাবি ভাষার কিছু খেয়াল-বন্দিশ তথা চিজ গুনগুন করে, যেন সে মাতৃভাষা বাংলায়ই কোনো গান গাইছে। তার পাঞ্জাবি উচ্চারণও কত সাবলীল ও সহিহ্ ছিল। সবই মুনীর হোসেনের দান। মমতাজ প্রায় বকলম ছিল। পাওয়ার বোর্ডে লাইনম্যানের কাজ করত। মোটরসাইকেলে করে সব জরুরি পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটতে হতো তাকে। বুকে সারা বছর কফ জমে থাকত। মমতাজ তো ছায়ানটে ক্লাস করতে আরম্ভ করল। মেয়েরা বলল, গান বোর্ডে লিখে দিন, স্বরলিপি লিখে দিন। মমতাজ দুটোর কোনোটাই পারে না। এবং তার পড়াবার ভাষা মোটেই শিক্ষকসুলভ মার্জিত-শালীন নয়, বিশুদ্ধ 888sport appইয়া কুট্টি। মেয়েরা আন্দোলন আরম্ভ করল, শিখব না এঁর কাছে। অধ্যক্ষ সন্জীদা আমাকে সব জানান। কিন্তু তাঁকে তো আমি জানাতে পারি না, কী অসম্ভব গুণী মানুষটা।

পাকিস্তান হবার পরে পরে তো অনেক গুণীই 888sport appয় বসতি করেন, মহাগুণী মস্তান গামা পর্যন্ত। মুশতাক হুসেন চমৎকার গাইতেন, কিন্তু কপাল পোড়ালেন, তিনি যেন রামপুরের মুশতাক এই ভাবটা করে। তাঁর আত্মীয়ই হবে, সরদার হুসেনের এক ঝিঞ্ঝোটি শুনেছিলাম রেডিওতে, ভুলতে পারিনি। তিনি মারা যান মোহাজির তাঁবুতে। একাত্তরের গণহত্যার পর দৃশ্যপট একটু পরিষ্কার হলে দেখি একেবারেই বাঙালি বনে যাওয়া সখাওয়াৎ হুসেন তবলা-নেওয়াজও চলে গেছেন লাহোর। সেই সংগীত দুর্ভিক্ষের দিনে মমতাজের মতো গুণীকে ছায়ানটে রাখা গেল না। ময়মনসিংহে তার বদলির জীবনের এক ছবি পাই অধ্যাপক নুরুল আনোয়ারের কাছ থেকে। নুরু মমতাজের এক-রুমের বাড়িতে গিয়ে দেখেন মমতাজ রান্না চড়িয়েছেন। কই মাছ কুটছেন সুপরি-কাটা সর্তা দিয়ে। আহা, মমতাজ! সরল বিকারহীন মমতাজ! তোমার গুরুর মতই তুমি চলে গেলে, কেউ জানলও না কী যে নিয়ে গেলে, দেশটা যে কতটাই দরিদ্র হলো। এত ছেলেমেয়ে বরোদা রবীন্দ্রভারতী শান্তিনিকেতন পাশ দিয়ে আসছে, কেউ মমতাজের পাশে বসবার যোগ্য নয়।

লতাফৎ হুসেন 888sport app বেতারে গান করতেন উচ্চগ্রামে। রাস্তায় রাস্তায় দেখা হতো। ইউরোপীয় পোশাক, কখনো হাতে একটা হকিস্টিক। পায়ে খেলোয়াড়ি কেড্‌স্। ভাবতাম এই কি আগ্রার লতাফৎ, আফতাব-ই-মুসিকির দূর আত্মীয় হলেও আলতাফ হুসেনের ব্যাটা, বিলায়েত হুসেনের অধস্তন জ্ঞাতি? ভুল পরে ভেঙেছে। তবে আগ্রার প্রভাব 888sport app হয়ে সমগ্র পূর্ববঙ্গে ছড়িয়েছিল খুবই। তার সূত্র ছিলেন মহাগুণী তসদ্দুক হুসেন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের চাচাই হবেন সম্ভবত। ময়মনসিংহের কদরদান জমিদার-দরবারগুলিতে যাবার পথে 888sport appয় স্থিতি করতেন, শেখাতেন বলধার জমিদার উদ্যানবিশারদ নরেন্দ্র নারায়ণের বাড়ির মেয়েদের। এসবই শোনা কথা। আমি আমার কথায় ফিরে যাই।

888sport appর তথা পূর্ববঙ্গের খেয়াল ধ্রুপদ চর্চার ভালো বিবরণ পাওয়া যাবে কুমিল্লার সুসন্তান অজয় সিংহ-রায়ের বইয়েতে। তবে সেখানেও বুঝি সেই কালে খাঁ সাহেবের 888sport appবাসের বৃত্তান্ত নেই। রসিক চূড়ামণি অমিয়নাথ সান্ন্যাল তাঁর কালজয়ী 888sport sign up bonusকথা ‘888sport sign up bonusর অতলে’-তে বড়ে গুলাম আলীর এই সাধক পিতৃব্য সম্বন্ধে এই বলে শেষ করেছিলেন যে, তারপর তার আর কোনো খবর কেউ জানে না। আমি জানি, তারপর তিনি 888sport appয় এসেছিলেন। এবং বহু মানুষ তাঁকে সারা দিনমান লোহার পুলের (ফরাশগঞ্জ) নিচের নদীতে ভেসে থাকতে দেখেছেন পরমানন্দে। তার আর পর নেই।

আমার জীবনে নজরুল-গীতি গায়ক ও শিক্ষক মফিজুল ইসলামের প্রভাব কম নয়। নরসিংদীর সেকেন্দার মাস্টার সাহেব ও তাঁর স্ত্রী (তাঁকে দেখেছি) একঘর প্রতিভার জন্ম দিয়েছিলেন। মফিজুল ইসলাম, তাঁর বড় বোন আফিয়া খাতুন (এখন দিল্), তাঁর ছোটভাই নজরুল ইসলাম, প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব এবং রাষ্ট্রদূত এবং আমিনুল ইসলাম, আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ধর্ষ প্রফেসর, নৃতত্ত্বের। মফিজ ভাইয়ের সূত্রে পরিচিত হই সখাওয়াৎ হুসেনের সঙ্গে। ক্রমে তাঁর বড় ভাই সলামৎ হুসেনকে পাই। রামপুরের ইনায়েৎ হুসেনের নাতি, আমার সংগীতবোধের প্রথম উন্মেষকদের মধ্যে প্রধান। অন্যতর মনির হুসেনের কথাটাই বড় করে বলতে চাই। তাঁর বেলায়ও যেন মফিজুল ইসলামের কোনো সূত্র কাজ করে থাকবে।

একদিন, আব্বাসউদ্দীন সাহেবের পুরানা পল্টনের বাসায়ই হবে, তাঁর মেয়ে মীর্না অর্থাৎ ফেরদৌসী এবং আরেকটি শ্যামলাবরণ ছোট মেয়ে, জাহানারা গান করল। মীর্না ও তুলু (মুস্তাফা জামান আব্বাসী) একবার আমাদের আয়োজন করা নূরুল কাদের অর্থাৎ ঝিলুর বাসায় এক আসরে গান করেছিল এর আগেই। তখন ওরা আবদুল গফুর খাঁর কাছে গান শিখছিল। তুলু আর মীর্নার সংগীতশিক্ষায় পিতার আগ্রহ ছিল, কিন্তু আব্বাস সাহেব বড় ছেলে দুলুর বেলায় (কালক্রমে প্রধান বিচারপতি আমার বন্ধু মোস্তফা কামাল) অন্যমত বোধ করতেন। মীর্না পরে খসরু সাহেবের কাছে গান শেখে। মোহাম্মদ হোসেন, ডাকনাম খোরশেদ। সংগীত-তাত্ত্বিক আমিরুল ইসলামের আগ্রহে নাম ঈষৎ পরিবর্তন করে আমীর-খস্রু নামে লিখতেন। গানের নেশায় পাগল হয়ে কুমিল্লা দারোগা বাড়ির এই ভদ্রসন্তান অভদ্র জায়গায়ও গান কুড়াতে যেতে কুণ্ঠিত হননি। সংগীতে তালিম মেহেদি হুসেন খাঁর কাছে। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে তিনিই সর্বাগ্রসর ছিলেন খেয়াল গায়নে ও সংগীততত্ত্বে। কিন্তু আমি যখন তাঁকে পাই তখন তাঁর সুরটি গেছে, গান করতে বসে শুধু লয়কারী করতেন। অযথা। আমি তাঁর কাছে বসতে পেয়ে ধন্য। পিতৃবন্ধু ছিলেন তিনি। বাবার কাছে আসতেন তিনি ফার্সি ও উর্দু গজল নিয়ে আলোচনা করতে, বুঝতে। না পেলে আমার পড়ার ঘরে গিয়ে বসতেন। আমার হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান করতেন, সময় কাটাতে আপন মনে তবলাও। বুঝতাম না কিছুই গিলতাম। হাঁ করে বাজাতেন। ওঁর কাছেই আমি সর্বপ্রথম ধ্রুপদের তোমনোস আলাপ শুনি। গানশেষে আপন মনে একবার বলেছিলেন, এই মেঘ রাগটা যথেষ্ট গমক প্রয়োগ না করলে ফোটে না কিছুতে। একদিন আমাকে নিয়ে পড়লেন, শিখে নাও তবলার অ্যালফাবেট। দীর্ঘকাল তারপরে আমার তবলা-পক্ষপাত কাটেনি। কিন্তু কোনো দিন, এখনো বুঝিনি গানে কেন তার সঙ্গত হবে। সত্যিকারের ‘সঙ্গত’ হলে তো খ্যাটাং খ্যাটাং আলগা আওয়াজ হবার কথা নয়। মরাঠীরা এ বিষয়ে খুব সচেতন। তম্বুর সারঙ্গীর সঙ্গে মিলে থাকে তবলা, যেন ওটাও একটা সুরের যন্ত্র। শামসুদ্দীনের সঙ্গতবিহনে করিম খাঁ সাহেবের গান কেমন শোনাত, ভাবতেই পারি না। একদিকে কোলাপুরে আল্লাদিয়া খাঁ, অপরদিকে মেরাজে করিম খাঁ। বোম্বাইতে আগ্রার খাদিম হুসেন – এঁদের শিক্ষায় মরাঠীদের অপূর্ব একটা ‘আন্দাজ’ দাঁড়িয়েছে, ওজনের বোধও এসেছে সুন্দর। শুধুই অভাব থেকে গেল হিন্দুস্তানি খেয়ালের একটা সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের ব্যাপার – নজাকৎ।

আব্বাসউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে জাহানারা অর্থাৎ লিলির গান শুনে অবধি আমার মনে হতে থাকে, ও মেয়ের প্রতিভার সত্যকার বিকাশের জন্য আমি কী করতে পারি? আসরে সে মনে হয় ইমনের একটি খেয়াল গেয়েছিল – জগমেঁ শরম রাখো মেরি। সম্ভবত মফিজুল ইসলামের শেখানো। তার গানে কী যেন ছিল। আমার আতিশয্যে আমার পরম বন্ধু, হয়তো এদেশে আমার পরিচিত ভদ্রতম সত্তম আহসানুল হক লিলিকে বিয়ে করেন । তার আগেই লিলির জন্যে শিক্ষক ঠিক হয়ে যান মনির হোসেন সাহেব। তাঁর শিক্ষায় লিলির দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে। মনির হোসেনের জীবনে এই প্রথম সচ্ছলতার স্পর্শ লাগে। তাঁর কাছে ফাহমিদা খাতুন, তার বন্ধু আখতার জাহান সাফা এঁরা শিখতে আরম্ভ করেন। আমার পরামর্শে আব্বাসউদ্দীন সাহেব মীর্না অর্থাৎ ফেরদৌসীর গুরু হিসেবে মনির হোসেনকে নিয়োগ করেন। কী ভালো লাগত – তিনি একটা রেশমি ছাতা মাথায়, রেশমি লুঙ্গি-কুর্তায়, মুখে একগাল হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসছেন ফাহমিদাদের বাড়ি থেকে। বলছেন, হক সাহেব, ল্যাপা তানই শ্রেষ্ঠ তান, আয়াস করে, কণ্ঠ বিকৃত করে ঝাঁকুনি দিয়ে তান করলে সংগীত দুষ্ট হয়। তান শ্বাসক্রিয়ার মতো আসতে যেতে থাকবে, তাতে মুখ-গহ্বরের কোনোই জায়গা অংশ নেবে না। গমক তো দ্রুত মীড় ছাড়া কিছু নয়, ওতে কোনোমতেই কোনো ঝাঁকুনি যেন না আসে। মনির হোসেন অপূর্ব কিছু গান শিখিয়েছিলেন লিলিকে। বিশেষ করে মনে পড়ে মিঞা কি মল্লারের বড় ও ছোট খেয়ালগুলো।

সম্ভবত সেই বিশের দশকে, গত শতাব্দীতে, বেনারসের মিশির ভাইদের কেউ এসেছিলেন (শিবসেবক?)। তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করতে যে সারঙ্গিয়া এসেছিলেন, সেই মানুষটার প্রেমে পড়ে যায় 888sport appর রইস কদরদান লোকেরা। মিশিরজী চলে গেলেও খাঁ সাহেবকে থেকে যেতে হয়। এ শোনা কথা। গুল মোহাম্মদ খাঁ সাহেবের ব্যাঘ্র গর্জনের দাপটী গান শুনে কখনো তাতে ‘তন্ত্রবাদী’ কিছুর গন্ধ পাইনি। তাঁর তানকর্তব আগ্রারই কাছাকাছি ছিল। সপাট এবং সরল। সারঙ্গিয়ারা গায়ক বনে গেলে কিছু ছাপ কোথাও থেকে উঁকিঝুঁকি মারবেই। গান তো গানই। সারঙ্গী গলার খুব কাছাকাছি হলেও, তার সার্থকতা তার আপনা-মাঝে, তার যন্ত্রসম্ভব ভার্চুয়োসিটিতে। সেই দক্ষতা গানের বেলায় খুব জরুরি নয়, অনেক সময়ই গানের সুষমা হরণ করতে পারে তা। তার সুষমা, সৌ-সম্য তার ভিতরেই। তবু অন্তত দুইজন বড় গুণী তাঁদের মূলে সারঙ্গী থাকা সত্ত্বেও তাঁদের গান সে যন্ত্রকে সম্পূর্ণ পরিহার করে কণ্ঠসাঙ্গীতিক একটা মঞ্জিলে পৌঁছেন। বড়ে গুলাম আলী ও আমীর খাঁ সাহেব। পিতার কাছে পাওয়া সারঙ্গীরই তন্ত্রবাদী যত ফেরফার ছেড়ছাড়কে দিয়ে গুলাম আলী তাঁর প্রায় অপৌরুষেয় কণ্ঠটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর গান সারঙ্গী বাজায় না। যেমন বাজায় না আমীর খাঁরও গান, পিতা সারঙ্গীয়া হলেও। গুল মোহাম্মদ খাঁ সাহেবের গানেও আমিও সারঙ্গীর কোনো প্রভাব পাইনি। জীবনে আফতাব-ই-মুসিকি ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের গান সামনে বসে শুনিনি, অনেকানেক ‘লাইভ’ ব্রডকাস্ট শুনলেও। মারা গেলেন বুঝি উনিশশ’ পঞ্চাশে, আমার সংগীত ক্ষুধার ভরা জোয়ারে। সেই সাধ মেটাতাম গুল মোহাম্মদ খাঁ সাহেবের গানে। আহা, এমন কণ্ঠ আর হয়নি, আর হবে কি? প্রতিটা গানের বিল্ড-আপ – ঠিক বিস্তর বা বাঢ়ত্‌ বোঝাচ্ছি না আমি, মনকে সৌগন্ধ-আকৃষ্ট মৌমাছির দশা করে ছাড়ত।

তাঁর বড় ব্যাপার ছিল পূর্ববঙ্গে খেয়াল গানের প্রসার। দীপালি নাগ, সুনীল বসু প্রমুখ দিকপাল তো আছেনই – মধ্যবিত্ত হিন্দু ঘরে তো তখন সংগীতের প্লাবন চলছে 888sport appয় – তাদের মধ্যে সফল অসফল শত শত মানুষ উচ্চাঙ্গসংগীতে হাতে খড়ি পেয়েছেন খাঁ সাহেবের কাছে। যেমন পেয়েছেন লায়লা আর্জুমন্দ বানু। সংগীত-লেখক-গায়ক-শিক্ষক সুকুমার রায় খুব বিস্তৃত করে খাঁ সাহেবের এইমতো গুণকীর্তির কথা লিখেছেন। যতদূর মনে পড়ে রাণু সোম তথা প্রতিভা বসুও তাঁর ছাত্রী ছিলেন।

একবার ফজলুল হক হল নামে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রাবাসের ছাত্র ইউনিয়নে আমাকে অনুরোধ করে তাদের জন্যে একটা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর করে দিতে। আমি মুনীর হোসেন সাহেবকে বলি, খাঁ সাহেবকেও। জানতাম না তাঁদের মধ্যে যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। দুইজনই সানন্দে রাজি হলেন। এরকম আসর তো দশ বছরে হয়নি 888sport appয়। কিন্তু উভয়ে শর্ত দিলেন গানের আগে তাঁদের কিছু বলতে দিতে হবে। আমার অমত হবার কোনো কারণ ছিল না। অনুষ্ঠানের দিন ডাইনিং হলের উপরতলাটি কৌতূহলী ছাত্রদের দিয়ে সন্ধ্যা লাগতেই ভরে গেল। 888sport live chatীরা এলেন। মুনীর হোসেন কোনোকালেই পারফর্মার নন, গান গাইবে তাঁর ছাত্রী জাহানারা লিলি। কথামতো মুনীর হোসেন তাঁর কথা বলতে উঠলেন। বললেন, গানের অন্তরা যারা জানে না, তাদের এ আসরে গান করবার কোনো অধিকার নেই। হক কথা, কিন্তু সভাস্থলে যেন একটা বোমা ফাটল। গুল মোহাম্মদ   খাঁ সাহেব গর্জে উঠলেন। সঙ্গে তাঁর দুই ব্যাটা, নূর মোহাম্মদ আর ইয়াসিন, তারাও লাফ দিয়ে উঠল। তাদের উষ্মা নিবৃত্তি করি অতি কষ্টে। বলি, খাঁ সাহেব, আপনার যখন সময় আসবে, তখন তো আপনি আপনার খুশিমতো বলতেই পারবেন।

লিলির গানের পর খাঁ সাহেবরা মঞ্চে বসলেন। নূর মোহাম্মদের কণ্ঠটি ছিল পিতার কণ্ঠের কাছাকাছি, কিন্তু গজলেই তার মন মজেছিল এবং তিনি পিতার মতোই বলিষ্ঠ, উন্নতদর্শন, ছ’ফুটের ওপরে। ইয়াসিন, ঠিক তেমন না হলেও উঠতি যুবক, সুন্দর স্বাস্থ্য। মঞ্চটা যেন দেখতেই কেমন রাজসিক হয়ে উঠল। খাঁ সাহেব তাঁর কথা বললেন। যে নিজে গাইতে পারে না, সে গানের বিষয়ে কথা বলতে আসে কেন? এই আসর থেকে তাকে বহিষ্কার করা হোক। কথা শেষমাত্র ভগ্নস্বাস্থ্য বেঁটেখাটো একটা মানুষ লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠতে গেলেন হাতা গুটিয়ে। তিন বাপে-ব্যাটায় তাঁকে ধরতে পারলে ফেঁড়ে ফেলত নিশ্চয়ই। আমাদের সম্মিলিত চেষ্টায় সে বিপদ এড়ানো সম্ভব হয়। মুনীর হোসেনের কথা থামে না। বাজায় লকড়ি, গাইতে আসে গান।

তাঁকে ঠান্ডা করা গেলে খাঁ সাহেব অতি উত্তম গাইলেন। তিনজনে এই রকম করে গাওয়া আমি আর শুনিনি। ফৈয়াজের রেকর্ডে আরেকজনকে দোহারকি দিতে শুনি। সে তাঁর শ্যালক, দরস পিয়া মহবুব খাঁর ব্যাটা আতা হোসেন। কিন্তু তিনজনে গাওয়া, কাওয়ালী যেমন গায় অনেকে মিলে, আমি প্রথম শুনলাম, প্রথম চাক্ষুষ করলাম। গানও এত ভালো হলো যে, হলভর্তি ছেলেছোকরা যারা জীবনে কোনো দিন খেয়াল শোনেনি, মত্ত হয়ে তা শুনল। এবং মনোহারী সেই গানের সত্যিই কোনো অন্তরা ছিল না। অন্তরাহীন খেয়াল আমরা প্রায়শ শুনতে পাই। অজ্ঞান গায়কেরা কোথা পাবে অন্তরা! অনেক সময়েই গানে যে কারণে অন্য গানের অন্তরা শুনতে পাওয়া যায়। মৃত্যুঞ্জয়ী সংগীতকারদের মধ্যে আমীর খাঁ সাহেবকে পর্যন্ত দেখেছি, রেকর্ডে পর্যন্ত, অন্তরাহীন গান গাইতে। অথচ তাঁর তারানায় কেমন তারা ফুটে ওঠে যখন তিনি ফার্সি কাব্য থেকে অতি সুচয়িত কোনো অংশ জুড়ে দেন। আমি আমার পিতার মতো ফার্সি ধুরন্ধর নই। বুঝতে পারি না। কিন্তু তারানায় যেমন কোনোই অর্থবহ শব্দ থাকে না, কেবল কয়েকটি মাত্র ধ্বনি থাকে সুরের ব্যঞ্জনা সংঘাতকে, ছন্দের নাচকে প্রকাশ করবার জন্য। ঐ ফার্সি শব্দগুলোকে তাদেরই প্রসারণ মনে হয় – এতই সুপ্রযুক্ত তাদের ধ্বনি ও মাত্রাগুলি। এই মানুষ কেন অন্তরা ছাড়া গান বাজারে যেতে দেন? খেয়ালে মাত্র তো দুইটা তুক, তার অর্ধেকটাই থাকবে না। সম্ভবত এটা তাঁর সততারও ব্যাপার। তিনি কিরানার গান গেয়েছেন সারাজীবন, গুরু বলে মেনেছেন আবদুল ওয়াহিদ খাঁ সাহেবকে। কিন্তু তাঁর কাছে তাঁর বসা হয়েছে খুবই কম। হয়তো বা হয়নি। তাঁর গান তাঁরই গান হয়ে উঠেছে অনেক অর্থে। যে গানের অন্তরা হয়তো পাননি, সেভাবেই গেয়েছেন সে গান।

আমার এই ব্যর্থ সংগীদ্ধাবন জীবনের আরম্ভকালের অনেকটাই পরম বন্ধু ঝিলুকে নিয়ে। এক সময়ে বোম্বে থেকে বেড়াতে আসা এক সেতারী, বাঙালি, সুধাংশু বাবুর বাজনা শুনে ঠিক করি বাঁশি নয়, সেতারই শিখব আমরা। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ভাই নায়েব আলী খাঁর দ্বিতীয় পুত্র মীরকাসেমকে ধরি তালিমের জন্যে। বন্ধু মীরকাসেম হেসে রাজি হন। ঝিলু অর্থাৎ নুরুল কাদের খান আর আমি সোনার একটা মিজরাব গড়াই গুরুকে গান্ডা বাঁধার অনুষ্ঠানে নজরানা দেবার জন্যে। সঙ্গে তার ত্রিশটি রৌপ্যমুদ্রা। আমি সদ্য পিতৃহীন এবং সহায়-সম্বলহীনও বটে। অনেক কষ্টে এই আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু কার্যকালে খটখট লবডঙ্কা। সোনার মিজরাব সেতারে কোনো আওয়াজই তুলতে পারল না। সেদিন কিংবা তারই কাছে-ধারে আমাদের ভাড়াবাড়ির উপরতলার বড় ঘরে মাসিক নিয়মিত সংগীতাসরের ব্যবস্থা করি দুজনে।

তার প্রথম রাতের অনুষ্ঠানে গান করেন সলাম হুসেন। শ্রোতা ছিলেন মীরকাসেমের মতো তাবৎ সংগীতসূত্রে প্রাপ্ত রসিকজন। খাঁ সাহেবকে দেখি কোনো মুজরা করতে গেলেই হিন্দুস্তানি মহফিলের যথোপযুক্ত চোগা-চাপকান মুঠোয় বিভূষিত হয়ে দামি আতরের বিরল সুগন্ধ মেখে যেতেন। তেমনি করে এলেন। কিন্তু গান করবার সময় ওপরের কাপড় ছেড়ে শুভ্র কুর্তায় কার্তিকটি বনে তানপুরা ধরলেন। সুদর্শন, সুপুরুষ মানুষটি গান ধরবার আগেই যেন আসরটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। অনেকক্ষণ বাজতে থাকল তানপুরা, আমাদের প্রতীক্ষাতে তীক্ষèতা দিতে দিতে। কিন্তু একটা উটকো ভাবনা আমাকে দোমনা করছিল থেকে থেকে। খাঁ সাহেবের তানকারী বড়ই কর্কশ ছিল। যেন বড়ে গুলাম আলীর অন্য পিতৃব্য আশিক আলীরই মতো কিংবা তারো চেয়ে। ভাবতে পারছিলাম না যে রাত এগারোটায় নিঃশব্দ শহরের এই ‘কোঠীতে যে অপূর্ব’ মাহোলটি তৈরি হয়েছে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক ঐ কর্কশ নীরসতায়। গান ধরলেন তিনি। দরবারী। আলাপ তোমনোমসহকারে। মধ্যমে পৌঁছালেন তিনি আধঘণ্টা বাদে। দেখলাম তিনি রাগের গাম্ভীর্যে বিঘ্ন না ঘটাবার জন্যে মোহরা দিচ্ছেন প্রচলিত রেখাবে নয়, ষড়জতে। কিংবা পরিস্থিতিমতো উদারা কোমল ধাতে। কেটে গেল আরো আধঘণ্টা। আমারি মতো উপস্থিত সকলেরই সম্ভবত বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। আলো জ্বালা হলেও অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ। মীরকাসেম স্তব্ধতা ভঙ্গ করে শেষ পর্যন্ত বলে উঠলেন, এমনটা আর শুনব না হয়তো কোনোদিন।

একদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে দেখি কে সেতার বাজাচ্ছে। দেখি সলামৎ হুসেন। সামনে তাঁর চিত্রার্পিত শ্রোতা, আমার মা। অনেকক্ষণ এসেছেন, আমাকে না পেয়ে মার সেতারখানা বাজাচ্ছিলেন। কৈশোরে, তালিমের অভাবে, আমি তারের যন্ত্রানুষ্ঠান নকল করবার চেষ্টা করতাম, মুখে, কণ্ঠ দিয়ে, তানা নানা দিয়ে। আমার সেই সময়কার বীর ইনায়েৎ খাঁ, বেলায়েতের বাবা। আর লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য। তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানি না, শুনিও না তাঁকে তিন যুগ। অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝি সলামৎ অপূর্ব বাজাচ্ছিলেন। তিনি 888sport appয় কোনোই কদর না পেয়ে কটক বেতার কেন্দ্রে চলে গেলেন চাকরি নিয়ে।

888sport appয় রয়ে গেলেন সহোদর সখাওয়াৎ। বেজায় তোতলা ছিলেন তিনি। কথা ঠেকে গেলে প্রসঙ্গ বদলে দিলে খুশি হতেন। আলাউদ্দীন খাঁ সাহেব 888sport app এলেন পঞ্চাশের দশকে। কৃতজ্ঞতার কারণে গেলেন মুক্তাগাছা। সঙ্গে নিলেন সঙ্গতের সাখাওয়াৎকে।

মহফিলে খাঁ সাহেব সখাওয়াৎকে বন্দনা-বিনা বাদা ধরেন না। গুরুঘরের পুত্র যে, গুরুরই শামিল। কিন্তু আবার তুই সম্বোধনে আদর ঝরিয়ে বলেন, তোর সঙ্গত তো আমার দরকার নেই। ধরে নিয়ে এসেছি গান শোনাবার জন্যে। ইনায়েৎ হুসেনের নাতি যে-তুই। সখাওয়াৎ, সাহেবের মন ভরিয়ে দিয়ে গান শোনাতেন। সখাওয়াৎ হুসেনের গান অবশ্য আমার আগে শোনা ছিল। ওঁরা সম্ভবত সুন্নিই ছিলেন। কিন্তু উত্তর ভারতের অন্যসব মুসলমান গাইয়ে-বাজিয়েদের মতো মোহররম এলে চল্লিশদিন গান বাজনা ছুঁতেন না। শুধু মর্সিয়া আর সোজ গাইতেন যন্ত্রসঙ্গত-বিনে খালি গলায়। সেই অনুষ্ঠান শুনেছি তাঁর রেডিওতে বছরের পর বছর। আশ্চর্য হয়েছি কেন তিনি – তবলার না-ই করলেন, গানের টিউশনি করেন না। গভীর আত্মমর্যাদা বোধের কারণে একমাত্র রেডিওর চাকরিটি সম্বল করে চলতেন। আমার জন্ম যখন তখন তিনি নিউ থিয়েটারসে তবলাবাদকের কাজ করতেন। সেই সময়কার প্রচুর গানের সঙ্গে রেকর্ডে তাঁর সঙ্গত ছিল। এমন সদাশয় শরীফ উঁচুমনের মানুষ আমি কম দেখেছি। তাঁর একমাত্র তবলার ছাত্র মদনগোপাল দাস। আমি খাঁ সাহেবকে বলি আপনার কাছেই গানের গান্ডা বাঁধব। তিনিও খুশি হলেন। যথারীতি গুরুকে গামছা এবং প্রণামি দিলাম, তিনি আমাকে গুড়মাখা ছোলা খাওয়ালেন হাতে করে। দিলেন আহির ভৈঁরোর এক বড় খেয়াল। কিন্তু আমার গান হলো না। নিজ দোষে। গুরুভাই মদনকে আমি সেই থেকে সহোদরসম প্রীতির চোখে দেখি। ছায়ানটের প্রথম থেকে সঙ্গে রেখেছি।

888sport appতে রেডিও স্টেশন হলো উনিশশ’ চল্লিশে। সাতচল্লিশে সেই স্টেশন হলো পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং হাউস। কলকাতা থেকে নতুন স্বদেশে ফিরলেন প্রতিভার তিন বরপুত্র, আবদুল আহাদ, নজীর আহমদ ও ফতেহ লোহানী। আরো কত বড় মানুষ, ফররুখ আহমদ, কবি শাহাদাৎ হোসেন, গীতিকার সাইয়িদ সিদ্দিকি প্রমুখ। সংগীতে 888sport app যেন হয়ে গেল শূন্য। সুনীল বোসকে দিয়ে তো স্টেশনের আরম্ভ, একেবারে মনে হতো ফৈয়াজের আপন ঘরের ব্যাটা কেউ গাইছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের কালে তিনি বেঁচে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে দিল্লিতে কথা বলেছি। তিনি তো আগেই গেছেন, চিন্ময় লাহিড়ী ছিলেন, তিনিও। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, প্রিয়লাল চৌধুরীরা এবারে গেলেন। প্রিয়লালের পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে উদ্ধার করি একটি সেতার। তিনি কিন্তু বাজাতেন তারশানাই। চট্টগ্রাম কাট্টলির অমর সংগীত-প্রতিভা, আর্য সংগীতের প্রতিষ্ঠাতা সুরেন্দ্রলাল দাশ ছিলেন কলকাতা রেডিওর প্রতিষ্ঠাতা সংগীত পরিচালক। তাঁর বহু সুকৃতির মধ্যে একটি তিনি বহু বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবক। একটি তার এখনো চলছে সগৌরবে, চলবে বহুকাল। তারশানাই। আরেকটি মেঘনাদ অর্থাৎ ব্যাস সেতার, সীমাবদ্ধ রইল রেডিও স্টেশনগুলিতে। চাটগেঁয়ে প্রিয়লাল তারশানাই যন্ত্র এবং বাদন উভয়ই পেয়েছিলেন গুরু সুরেন্দ্রলালের কাছ থেকে। দেশভাগের পর 888sport app রেডিওর বারো আনা 888sport live chatীই বোধ হয় চলে যায়। তার জায়গায় কলকাতা থেকে আসেন আব্বাসউদ্দীন, বেদারউদ্দীন, সোহরাব হোসেন, আবদুল লতিফ, আবদুল আলিম প্রমুখ।

এই অব্যবস্থিতকালে 888sport app রেডিওর যন্ত্রসহযোগের ব্যাপারটিতে দুই উৎস খুবই নির্ভরযোগ্য কাজ করে রেডিওকে সুস্বাস্থ্যে রাখে। যন্ত্রীদের মধ্যে সেই প্রথম থেকেই এই দুই ভাগ। শিবপুর দল, টঙ্গীবাড়ি দল। একদিকের ধাড়ী আলাউদ্দীন শিষ্য ও ভ্রাতুষ্পুত্র খাদেম হোসেন খাঁ (ধাড়ী কিন্তু মহাগুণী কলাবন্ত সংগীতকার)। আরেকদিকে যাদব আলী বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও সাদেক আলীই অধিক মাননীয় ছিলেন। এই দুই ভাইয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র ধীরালি মিঞার সঙ্গে কী করে ঝিলুর ও আমার খুব ভাব হয়। আমার প্রথম সংগীত তালিম ধীরালির কাছে। বাঁশিতে। ধীরালির সূত্রে যাদব আলী সাদেক আলীকে আমি নিজের কাকু বলেই জানতাম। ধীরালির ছোটভাই মনসুর বেহালা বাজাত, তার চাচার মেয়ে যমুনা ধরেছিল সেতার। এক সময় তাদের বিয়ে হয়ে যায় বুঝি। এবং মনসুর মারা যায় অকালে। এখনকার সুখ্যাত সুরকার আলাউদ্দীন আলী এঁদের কার কী জানি না পর্যন্ত। অথচ ছয়টি বছর আমাদেরকে আলাদা করা যেত না ওঁদের পরিবার থেকে। চোখ বুজলে স্পষ্ট দেখতে পাই ধীরালি আমাদের পাল্লায় পড়ে পলাশীর মাঠে বসে বাজাচ্ছেন বাঁশি, কিংবা আমাদের উর্দু রোডের বাড়ির ছাদে। ওঁদের সোহবত আমার জীবনে আশীর্বাদের মতো এসেছে।

পেয়েছি অন্যদলেরও প্রসন্ন দৃষ্টি, বন্ধুতা। খাদেম হোসেন ভাইকে মানতাম, জানতাম, ছায়ানটের শ্রেওাতার আসরের প্রথম অনুষ্ঠান করাই তাঁকে দিয়ে, বাষট্টি তেষট্টিতে। তখন তাঁর রিয়াজ গেছে। কিন্তু প্রস্তাবমাত্র খুব খুশি হয়ে রিয়াজে  বসলেন। একমাস বিরামহীন অভ্যাসের পর আসরে বাজালেন। সে সংগীত ভুলবার নয়। তাঁর সহোদর মীরকাসেম তো আমার গুরুই ছিলেন। আয়েত আলী খাঁ সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবিদ হোসেন অনেক পরে 888sport appয় আসেন। এখানে তাঁর অনুজ বাহাদুর হোসেন অনেক আগে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠ সরোদ-বাদক হিসেবে। বাহাদুর ভীষণ প্রতিভাবান ছিলেন। তাঁকে অবশ্যই দ্বিতীয় আলী আকবর বললে ভুল হয় না। তেজেন্দ্র নারায়ণের বাজনা শুনুন, কিছুটা তাঁর পাবেন। মন তাঁর 888sport appয় টিকছে না, জ্যেঠা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে না বসলে চলছে না। যাবেন সুদূর মাইহার। রাহা খরচ নেই। ওই আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ চুরি করলাম। মায়ের কিছু সোনাদানা। বাহাদুরের যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য হলো। বাহাদুরের অনুজ সুলেখক মোবারক হোসেন খাঁ আমার সুহৃদ।

পাকিস্তান আমলে একটা সময় খুব ঝোঁক চাপে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গুণী 888sport live chatী এনে এই সংগীতবিহীন অন্ধকারের দেশে কিছু আলোর ব্যবস্থা করি। পাকিস্তান আর্টস্ কাউন্সিলের তখনকার নেতা গোপালগঞ্জ মোকসেদপুরের খয়ের ভাই অনেক সব নামকরা 888sport live chatীদের নিয়ে আসতেন। তাঁর সুকৃতি-সূত্রেই যেমন শুনি বড়ে গুলাম আলীকে, তেমনি ছোটে গুলাম আলীকে, রওশন আরা বেগমকে, গজলের ইকবাল বানু ও ফরিদা খানমকে। সুরাইয়া মুলতানীকর 888sport appকে চমকে দিয়েছিল তার তানবাজি দিয়ে। কিন্তু গাইতেন বুঝি মূলত গজলটজলই।

আমার চেষ্টায় প্রথম বারের মতো 888sport appয় আসেন লাহোরের উমিদ আলী। আমানত আলী ফতেহ আলী ভ্রাতৃদ্বয়, নজাকৎ আলী সলামৎ আলী ভ্রাতৃদ্বয় প্রথম অন্য কারো আগ্রহে 888sport appয় এলেও আমার সূত্রে 888sport appয় তাঁরা আসেন কয়েকবার। সলামৎ কলকাতাকে মাতিয়েছিলেন খুব, বড় ভাই নজাকৎ দোহারকির কাজ করতেন। প্রথম দুইবার আমরাও খুব মাতি ওঁদের গানে। কিন্তু তার পরেই মন আর নিতে চায় না ওই সব লগন লাগি বলে বড় খেয়ালের সম, সব রাগেই। গানশেষে নিনিসা নিনিসা বলে দ্রুত লয়ে সংগীতবিহীন ছন্দোহীন অর্থতাৎপর্যহীন কারদানি মনকে কষ্টই দিত। 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাবের অনুষ্ঠানে ওদের বলেছিলাম, পাঞ্জাবি যখন টপ্পা শোনায় না কেন? ইনকার করেনি, শুনিয়েছিল। কিন্তু কোনো মতেই তা টপ্পা পর্যায়ে পড়ে না, লোরীর না, হম্দমের এমন কি আমাদের বাঙালি ঘরের মহাপুরুষ নিধুবাবুরও নয়।

আমানত ফতেহ আলীয়া ফত্তুর পরম্পরার গায়ক। আমানত খুব দরাজ এবং সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু গানটি গাইতেন মূলত ছোটভাই ফতেহ আলী। তানকারীতে অজস্র ফান্দা ও বুনটের কাজে আসর মাতাতেন, কণ্ঠটি তেমন মধুর এবং বুলন্দ না হলেও। এদের জোড়ার ব্যাপারেই, যে রাতে ছায়ানটে গান হবে, তার পূর্ববর্তী বারো ঘণ্টা ধরে পটাতে হতো প্রতিটা বন্দিশ বিশ-পঁচিশ মিনিট করে অনেকগুলি বন্দিশ গাওয়ার জন্যে। কারণ ওরা গায়ক যতটা গুণী ততটা নয়। তাদের অনুষ্ঠানে বুজর্গদের বাঁধা জিনিস পাওয়াটাই মস্ত লাভ, ওদের কারদানি কখনো কলার এলাকা খুব মাড়ায়নি।

এই আমার স্বভাব, এখনো আমাকে ছাড়েনি বড় মানুষদের সঙ্গ করা, দূরে প্রচ্ছন্ন থেকে। পারলে নিজ ঘরে ডেকে এনে। এখনো চলছে তা। তবে যৌবনের জোর এখন নেই। শান্তি শর্মা, শুভ্রা গুহকে এনেই, 888sport appয় সুপরিচিত করেই বুঝলাম আমার এই ভূমিকা, 888sport appকে শুনিয়ে শুনিয়ে গানে নিয়ে আসবার ভূমিকা, যেন ফুরাল। বুদ্ধদেব সরোদিয়াকে আর আনাতে পার- লাম না। শত ইচ্ছায়ও।

888sport app তথা এপার বাংলার শুদ্ধসংগীত চর্চার দেশভাগ-পরবর্তী প্রয়াসের এক বিশিষ্ট অবদান ছায়ানট সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের। বলা ভালো যে, সারা জীবন ধ্রুপদ খেয়ালের এবং আখড়ায় আখড়ায় গ্রামীণ সাধনসংগীতের পিছনে ঘুরে বেড়ালেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, রবীন্দ্রনাথের গান প্রকৃষ্ট শুদ্ধ সংগীত, তিনি সেই হিসেবে এই অপূর্ব গীতিভাণ্ডারের সৃষ্টি না করে থাকলেও। বাঙালি সংগীতপ্রয়াসী মানুষের সার্থকতার একটা অবধারিত বিষয় হলো সে রবীন্দ্রসংগীতে সংগীতটি খুঁজে পায় কি-না। ছায়ানটের চেষ্টায় বাংলা গানের ও সংস্কৃতির, এমন কি রাজনীতিরও অরাজক অবস্থা অনেকটা দূর হয়। পথচিহ্নহীন উষর মরুতে ঘুরতে থাকা বাঙালি মুসলমান নিজের সত্য ঘরের সন্ধান পেয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানে রবীন্দ্রগীতি গায় না। পূর্ববঙ্গে, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে এখনকার 888sport appsে হিন্দু-মুসলিমে ঠাকুর মশায়ের গানেরই চর্চা বেশি। সকলি ছায়ানট-প্রসাদাৎ।

ছায়ানট তেষট্টি সনেই গানের স্কুল খুলবে খুলবে করছে। সন্জীদা তো আছেনই। কিন্তু সংগীত শাস্ত্রী কাউকে তো দরকার। একবার ফিরোজা বেগমকেও প্রস্তাব করা হলো। কিন্তু তিনি তো তেমন শাস্ত্রী গোছের কিছু নন। আমার তোতা ভাই, ফজলুল হক, খুব বড় প্রকৌশলী। ছাত্র বয়সে শিবপুর কলেজে গায়ক বলে তাঁর নাম ছিল। মেয়েরা তাঁর খুব গায় বাজায়। টেলিভিশনে ফ্যামিলি অর্কেস্ট্রা বাজায়। নাজমা সালমাদের মধ্যে একদিন দেখি মতি মিয়া। সেতারী চুনী মিয়ার, গীটারের আলী সুরুজ মিয়ার বাবা। নাজিমুদ্দীন রোডের রেডিও রেস্টুরেন্টে কত দেখেছি তাঁকে। সদা-অসন্তুষ্ট, অন্য যন্ত্রীদের দ্বারা এড়িয়ে যাওয়া, বুড়ো মানুষ। এখানে দেখি সবার আহ্লাদের দাদু, ছোটদের গানবাজনা শেষে সকলে তাঁকে ঘিরে বসে। দেখি অন্য এক মতি মিয়াকে। গায়ক গাইছেন জ্ঞানেন্দ্র-প্রসাদের গান। কয়েকটি গেয়ে পুরনো দেশীয় গান ধরেন। গ্রামীণ সাধকদের। একটি তার ব্রহ্মতালে। বোধ করি দ্বিজদাসের। বড় সাধ জাগে তাঁকে কাছে পাই। এক সময়ে শ্যামবাজারে থাকতেন, সেখানেই এক সকালে গিয়ে দেখি একমনে বেহালা বাজাচ্ছেন। এ তো ঠিক আলাউদ্দীন বাজ, সেই টিপ, সেই তৈয়ারি, সেই মেলডি। তাঁর গুণের দাসানুদাস বনে যাই।

পাকিস্তান (888sport apps) অবজার্ভারের নতুন বাড়ি উঠছে। মতিঝিলে। একতলা উঠেছে, তখনি আমরা সদরঘাট জনসন রোড থেকে চলে যাই ওখানে। শীতের সকালে ডেস্কে অলস বসে আছি। দূরে মাঠে বাঁশের ঘরের ক্যান্টিনে বাজছে কার উদাস ভৈরবী। মনটা হু হু করে উঠল। এই সংগীতকে দেশের মানুষ পাবে না? হতেই পারে না। সাদা কাগজে লিখে ফেলি নিয়োগপত্র। জনাব মতিয়র রহমান খান, মোট সাড়ে তিন শত টাকা মাস মাহিনা ধার্য করে আপনাকে ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা গেল। সপ্তাহে আপনার কর্মদিন পাঁচ এবং দৈনিক ঊর্ধ্বপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা। লেখা শেষ হলে রেডিওতে ফোন করে মতি মিয়াকে ধরি। বলি, চাচা চলে আসুন, এক্ষুনি। তিনি এলে পরে তাঁর হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বলি, আমার ওপর বিশ্বাস আছে তো? মাস দুয়েক পরে আরম্ভ হলো ছায়ানটের পথ চলা বিদ্যালয় হিসেবে, মতি মিয়ারও নতুন জীবন আরম্ভ মতিয়র রহমান খান হিসেবে। ভারতের শ্রেষ্ঠ বেহালা বাদিকা শ্রীমতী শিশিরকণা ধর চৌধুরী মতি মিয়ার শিলং-গৌহাটি কালের ছাত্রী। শিশিরকণা তাঁর দেশবিদেশের প্রতিটি অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে মতি মিয়ার কাছে তাঁর কৃতজ্ঞতা 888sport app download for android করেন। মতি মিয়া ছায়ানটে শেখ হাসিনা, বিবি (রাসেল) প্রমুখকে বেহালায় হাতে-খড়ি দেন এবং কণ্ঠসংগীত ক্লাসে নিয়মিত খেয়াল গান শেখান।

আমার সাঙ্গীতিক বোধবুদ্ধির অনেকটাই মতি মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া। আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবকে গুরুভাই বলতেন। তাঁরই মতো অজস্র বাদ্য বাজাতে পারতেন। তারযন্ত্র, শুষির, আনদ্ধ কোনো কিছু বাদ ছিল না। সবই যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে বাজাতেন। আলম (আলাউদ্দীন) মাইহার থেকে নিজ বাড়িতে বৃদ্ধ বয়সে বার দুই-তিন এসেছিলেন। প্রতিবারই গুরুভাইকে তিনি আদর করে কাছে টেনে বসিয়েছেন, একসঙ্গে বাজিয়েছেন। গুরুভাই কী ভাবে? দুজনেই তো সাধু আফতাবুদ্দিন খাঁর শিষ্য, সেইভাবে। আফতাবুদ্দিন প্রধানত বাঁশি বাজাতেন। তাঁর উদ্ভাবিত নাসাতরঙ্গও বাজাতেন। মতি মিয়া সম্ভবত তাঁর গায়নশক্তি লাভ করেন আফতাবুদ্দিনের শ্বশুর, ত্রিপুরা রাজদরবারের গুল মোহাম্মদ খাঁর কাছে। মতি মিয়ার গান এতই ভালো ছিল যে, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে এখনকার দিনের গানের মধ্যেও তাঁকে ঢুকিয়ে দিতাম। নজরুল গাইতেন অসাধারণ, না-শোনা যত গান। সলামৎ হুসেন এবং মতি মিয়া এই দুই জনের কাছেই শুনি, জানি সংগীত যে একটি পরম সংযমের 888sport live chat। এইখানে রবীন্দ্রনাথ এসে যান অপ্রতিরোধ্যভাবে। জোর না সুর, বলতেন মতি মিয়া। এবং তাঁর সমস্ত গানে অপরিমেয় শক্তি ছিল, সংযমের মধ্যেই। কত যে শত শত পুরনো গান শুনেছি তাঁর কাছে। একবার ছায়ানট থেকে ছুটি নিয়ে গেলেন লাহোরে ফিল্মসংগীত-সফল সুরুজের কাছে। কোথায় কি মাংসজাতীয় খাবার অসংযতভাবে খেলেন, আর তাঁর ফেরা হলো না দেশে। ছায়ানট পথে বসল প্রায়। এক সময় ছায়ানটে অধ্যক্ষ হন সন্‌জীদা খাতুন। মতি মিয়ার জায়গা নেয় এমন তো কেউ ছিল না, এখনো নেই।

পঞ্চাশের দশকের মাঝের দিকে এক কিশোরের সেতার বাজনা শুনে মুগ্ধ হই। জায়গাটা রেলওয়ের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট। বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো কার্জন হল সভাগৃহে। অপেক্ষাকৃত ছোট অনুষ্ঠানের জন্যে ক্যাপটেন (ঠাটারি) বাজারের এই ঘরটি ছিল কেবল। কত যে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে এখানে। খোঁজ নিয়ে জানি ছেলেটি খাদেম ভাইদের ভাগ্নে, খুরশীদ। খুঁজে তাকে পাই না। সে গেছে উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা, আলী আকবর মিউজিক কলেজে। আগুন হয়ে এল ফিরে। পছন্দ হলো। মামাকুল মীরকাসেম, আবিদ হোসেনকে বাদ দিয়ে তাকেই ছায়ানটে ডাকি। তাঁরা সম্ভবত ক্ষুণ্ন হন, কিছু দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এতদিন পরে, উভয়ে গত হলে, আবিদ-অনুজ মোবারকের মেয়ে ছায়ানটে যুক্ত হয়েছে শুনে আমার বুক থেকে একটা অপরাধবোধের ভার নেমে যায়।

মোবারক এখন খুব বড়মানুষ, আমার কাছে সেই ছোটটিই আছে। তাঁদের বাবা আলাউদ্দিন – অনুজ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের স্নেহ পেয়েছি আমি। নাজিমুদ্দিন রোডের সেই আজিজিয়া নামে রেডিও রেস্টুরেন্টে বসে কত 888sport sign up bonusর কথা বলতেন। আমি রবীন্দ্রসংগীত ঘেঁষা জেনে রবীন্দ্রনাথেরই গল্প করতেন কত। সেই গল্পের কিছু কিছু আমার লেখায়, আমার সূত্রে ছাপা হয়েছে ফিরে ফিরে। তার একটি। রবীন্দ্রনাথ আয়েত আলীকে বলছেন, বাবা, আমার গান কেউ কি শোনে? যুগটা পড়েছে ফৌজদারি আর আমার গান হচ্ছে আদালতি। আয়েত আলী শান্তি নিকেতনের সংগীত শিক্ষক ছিলেন এক সময়। সেখান থেকে চলে আসবার সময় কাজটা ফুলঝুরিকে দিয়ে আসেন। আয়েত আলী খাঁর বাজনা আমাদের হাতের কাছের রাজার ভাণ্ডার ছিল। মুখ দিয়ে খুব নকল করবার চেষ্টা করতাম।

একবার কারা – আলাউদ্দিন-তনয়া অন্নপূর্ণার বাজনা টেপ করে, চুরি করে মঞ্চের নিচে মাইক ঝুলিয়ে। আলী আকবরের কলকাতার কলেজের উদ্বোধন। ভাইয়ের অনুরোধে বোন ঐ শুধু একবারই মাত্র প্রকাশ্যে বাজিয়েছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে। সেই টেপ গোপনে হাতে হাতে ঘোরে। অন্নপূর্ণা জানেন তাঁর এককালের স্বামী রবিশঙ্করের কারসাজি ওটা। খারাপ রেকর্ডিং ছড়িয়ে লোককে বোঝাবে কী এমন বাজায় সে। আমিও, রেকর্ডিংয়ের পঁয়তাল্লিশ বছর পরে চুরি করেই যেন সে বাজনা শুনি। খুব চেনা চেনা মনে হলো। এই সুরবাহারের বাজনা শুনেছি প্রথমে ইনায়েত খাঁ সাহেবের রেকর্ডে। শুনেছি ইমরতেরও হাতে, সাক্ষাতে এবং রেকর্ডে। কিন্তু এ যে একেবারেই অন্যরকম, তবু চেনা চেনা।

তখন মনে পড়ে কত তো শুনেছি আয়েত আলী খাঁ সাহেবের সুরবাহার। এ তো সেই বাজনা। তবু যেন আলাদা। অন্নপূর্ণার তৈয়ারি আমাকে চমৎকৃত করে। উৎপাদিত সকল ধ্বনির ব্যঞ্জনা, কেবল সুর-ছন্দ নয়, আমাকে করে অভিভূত। রবিশঙ্করের রাগ-অনুরাগ বইয়ে দেখেছিলাম এই সাক্ষাৎ সরস্বতীর ছবি। আমার সকল কৃতজ্ঞতা হরিপ্রসাদ চৌরসিয়াকে, যিনি এই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতের জনমনচিত্তে।

ভারতের খেয়ালিয়াদের মধ্যে দুই সুনীল বসু। একজনের কথা বলেছি, 888sport app রেডিওর প্রথম পরিচালক। আরেকজনকে জানলাম বড়ই অন্তরঙ্গভাবে। শুভ্রা গুহ, তখনো অপরিচিতা, আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন 888sport appয় তাঁর অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবার জন্যে। সে ব্যাপারে শুভ্রার সঙ্গে আলাপ করতে কলকাতার টালিগঞ্জস্থিত সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে বসি গিয়ে মান্যবর জেষ্ঠাগ্রজতুল্য জেন্টুদার (অজয় সিংহ রায়) ঘরে। তিনি তখন ভারতের এই অগ্রণী সংগীত প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারিক। অনন্তর শুভ্রা এসে উপস্থিত। মুহূর্তেই কাকু বনে গেলাম। দশ বছরের ঘনিষ্ঠতা  হয়ে গেল দশ মিনিটে। বেরোতে যাচ্ছি, শুভ্রা বলল, পাঁচ মিনিট – আমার গুরুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই আসুন। পিছন পিছন যাই। একটা মস্ত কাঠের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ। অপেক্ষা করছিলেন আরেক সুনীল বসু। ভাতখণ্ডেজীর ছাত্র, ফৈয়াজ খাঁর ছাত্র। খাঁটি আগ্রা। শুভ্রা তাঁর শিষ্যা, তাই সেও আগ্রা। আগ্রায় তো শুধুই তাজ নেই, আছে আগ্রা ঘরানাও। আছেন ফৈয়াজ খাঁ, খুদা বখ্শ আর নখন খাঁর মতো আশ্চর্য আওলাদ, অপরূপ আলো ঠিকরানো।

সুনীলদা আশ্চর্য মানুষ। বিয়ে কখনো করেছেন মনে হলো না। 888sport app বিক্রমপুরের ছেলে। কবে শেষ 888sport app দেখেছেন? বললেন, উনিশশ’ চৌত্রিশে। তারপর থেকে এই গানের ভেলায়, সারাটা জীবন-বেলা। এখন আছেন এসআরএ-তে, রেসিডেন্ট উস্তাদ। নিসার হুসেন খাঁ মারা যাবার পর থেকে। আমি বেরিয়ে পড়লে সেই কাঠের দরজায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকেন। বলি, দোহাই সুনীলদা, ভেতরে যান, নাহলে যে আমি যেতে পারছি না। তিবি বলেন, এমন আত্মীয় যে আবার কবে পাব জানি না তো। চোখে জলের আভাস। আমার তো হাউমাউ করে ভেঙে পড়বার অবস্থা।

সুনীলদার তখন উত্তরাশীতি চলছে, আমি প্রস্থানমান ষষ্টিতে। ফিরে গিয়েছিলাম সেই আমার পরশমণি দাদাটির কাছে। চারদিন ছিলাম এসআরএ-তে। ‘প্রতিবেলা’ নিজের হাতে করে খাওয়াতেন। আমার সঙ্গে ছিল প্রায় বিশ জনের দল। প্রত্যেককে কী আদর। সবার দাদু তিনি। একদিন হঠাৎই শুনলাম তাঁকে। গান বাৎলাচ্ছেন কোনো ছাত্রীকে। শুনে স্থাণু হয়ে যাই। এ যে আমার অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু পরক্ষণেই অনধিকার জ্ঞান করে সে স্থান ত্যাগ করি। জানি না কপালে আছে কি-না তাঁকে আবার পাওয়া।

ছায়ানট তার কার্যক্রম একষট্টিতে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর পরে পরে আরম্ভ করলেও সংগীত বিদ্যায়তনটি আরম্ভ হয় তেষট্টিতে। তার অনেক আগে মাহমুদ নূরুল হুদা প্রতিষ্ঠা করেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমী। ১৯৫৪-য় সম্ভবত। বুলবুল চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠান তাই সঙ্গতভাবেই নৃত্যনির্ভর। মঞ্চে নৃত্যের শক্তি বেশি। একাডেমী তবু গানকেও কদর করলেন। এনেছেন বাইরে থেকে রবীন্দ্রসংগীতের জন্য ভক্তিময় দাশগুপ্তকে, খেয়ালের জন্য বিমল দাসকে। এলেন সর্বশেষে পাবনা থেকে বারিন মজুমদার। জমিদার নন্দন । জমিদারিটি গেছে, জমিদারি মেজাজটি রয়েছে। তাই সর্বদাই থাকে তুঙ্গে। তার ওপর পড়েছে পালিশ লখনভী শরাফতের। তিনি ভাতখণ্ডেজীর লক্ষ্নৌ ম্যারিস কলেজের প্রথম দিককার ছাত্র, সুনীল বসুর এক বর্ষ পরেকার সম্ভবত, চিন্ময় লাহিড়ীর সতীর্থ। সিলসিলা আগ্রা ঘরানার। গাইবার ধরন ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের দলে বলে কওয়াল ধারার। কণ্ঠটি শানিত পরিশীলিত, শরাফত, লতাফতেরও ঈর্ষাযোগ্য। চট্টগ্রামে আর্য সংগীত পরিষদে গাইছেন। দূর থেকে শুনে ভ্রম হলো  ফৈয়াজ স্বয়ং কবর থেকে উঠে এসে এই হরিকেলে গান জুড়েছেন সমুদ্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

কিন্তু তিনি গান তেমন করলেন না। অত্যন্ত উচ্চ ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষা। উচ্চ সংগীতকে তিনি তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে বসাবেনই। এটা হাসিল করবার দুই পথ ছিল। গান গেয়ে, শুনিয়ে শুনিয়ে গণজাগরণের পথে। অন্যটি, সরকারের নীতিনির্ধারক স্তরে প্রভাব বিস্তার করে। তিনি দ্বিতীয় পথটি নিয়েছিলেন। প্রথম পথটি তাঁর জানা ছিল না। তার ওপর তাঁর গায়ক হিসেবে ছিল না কোনো ব্যক্তিগত উচ্চাশা। 888sport appবাসী হবার পর সারাটা জীবন কাটে তাঁর পাকিস্তান সরকার নামে এক গণবিরোধী সংস্কৃতিখাদক রাক্ষসকে ভুলিয়ে ভালিয়ে, উচ্চ সংগীতের প্রতি নেকনজর কাড়বার চেষ্টায়। মুজতবা ময়নাভাই বাজাতেন বাঁশি, অপূর্ব। যক্ষ্মায় ধরাতে ধরলেন বেহালা। মনস্তত্ত্বের ভালো ছাত্র যোগ দিলেন বুলবুল একাডেমীতে, বেহালার শিক্ষক। ময়না ভাইয়ের ভাই ভালো ক্রিকেটার, আলীগড়ি ব্যারিস্টার, এটিএম মুস্তাফাকে সামরিক একনায়ক আয়ুব তাঁর মন্ত্রিসভায় তুলে নিয়েছিলেন। বারিনদা ময়না ভাইয়ের সূত্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে দিয়ে করিয়ে দিলেন মিউজিক কলেজ। বারিনদার অন্তত একটা স্বপ্ন সফল হলো। ভাবলেন, এটি হলো তাঁর উঠতি যৌবনের ম্যারিস কলেজ। ভাতখণ্ডেজী একা সেই কলেজ করেননি। প্রকৃত সংগঠক ছিলেন ঠাকুর নবাব আলী – মা’রিফুন্নগমাত-খ্যাত। বারিনদা সংগঠক নন। অথচ গান ছেড়ে তিনি সংগঠনে নামলেন। না হলো গান, না সংগঠন। তালিম হোসেন কবি যেমনই হোন, প্রচণ্ড পাকিস্তানবাদী ছিলেন। তিনিও আয়ুবকে ব্যবহার করেন তাঁর স্বপ্ন নজরুল একাডেমীকে রূপ দিতে। তাঁর হয়ে আয়ুবী নেকদৃষ্টিটি কাড়েন মন্ত্রী এবং অননুতপ্ত রাজাকার খান এ সবুর। নজরুল সরকারি জোয়ালে ঢোকেনি, তালিম ভাইয়ের সুবুদ্ধিতে। বারিনদার বুদ্ধিহীনতায় সরকারি মিউজিক কলেজ প্রথম সুযোগেই তাঁর প্রতিষ্ঠাতাকে মাটিতে দিল ফেলে। আক্ষেপ হয়ে রইল বারিনদার আমৃত্যু সঙ্গী। বাঙালির মধ্যে এক শক্তিশালী খাঁ সাহেব পেয়েছিলাম আমরা। পারলাম না তাঁর সোনার খনির ভাগ পেতে। শিক্ষিত 888sport appsীয় বাঙালি রইল খেয়াল গান থেকে শত হস্ত দূরে। আমিও রইলাম বারিনদার ঈষৎ বিরক্ত এবং চিরপিপাসিত ভক্ত।

মনের মানুষ পেয়েছি মতি মিয়া ছাড়া আরেক জনকে। শ্রীমিথুন দে। তবলার গুণী পেয়েছেন। বারাণসীর মৌলভী রামকে। মুক্তাগাছায়। তবলার ছাত্র উপেনবাবুর। গানের ছাত্র লক্ষেèৗফেরত শৈলেন বাবুর। ময়মনসিংহ কালক্রমে মফস্বলে পর্যবসিত তখন, সংগীতের পীঠস্থান থেকে। মিথুনদার গুণ বুঝবে সে জায়গায় তেমন কেউ নেই। ছিলেন বিজয়বাবু, খেয়ালিয়া, সলামতের শ্যামচৌরাসীর শেষ সলতে ভীষ্মদেবের বাবা। পরিচয় হলো মিথুনদার সঙ্গে অনেক দেরিতে। তাঁকে তড়িঘড়ি 888sport app নিয়ে এলাম, ছায়ানটে কাজে লাগালাম। সুমনরা যা পারল নিতে থাকল, তাঁর কাছ থেকে। কিন্তু তাঁর সময় হয়ে গেল শেষ। উচ্চ সংগীতের ক্ষেত্রে আমার শেষ বান্ধব গেলেন চলে। মিথুনদাকে বলতাম তবলার চারটা বাজ আলাদা করে করতালিযোগে বোল বাতলিয়ে বাজিয়ে শোনান তো। ঐ আমার পরিচয় তবলার ঐশ্বর্যের সঙ্গে।

দেশভাগে সংগীতের যে দীর্ঘ রাত্রির সূচনা হয় তার অন্ধকার কাটতে এখনো এখানে অনেক দেরি। এই তামসের কালে যে প্রদীপগুলোকে আলো ছড়াতে দেখেছি তাদের কারো কারো কথা লিখলাম অযোগ্য অক্ষরে। ৎ

* এই লেখাটি কালি ও কলমের প্রথম বর্ষ প্রথম 888sport free betয় (ফেব্রুয়ারি ২০০৪/ ফাল্গুন ১৪১০) প্রকাশিত হয়েছিল।