সঙ্গ, নিঃসঙ্গতা ও প্রেমের কথকতা

মোহাম্মদ আজম

শহরে চাঁদের রূপ

শাকিলা হোসেন

শুদ্ধস্বর
888sport app, ২০১১

১২৫ টাকা
শাকিলা হোসেন শহরে চাঁদের রূপে একটি সরল গল্প বলেছেন। বলতে গিয়ে তাড়াহুড়া করেননি; এগিয়েছেন ধীরেসুস্থে। ঘটনা ও চরিত্র একেবারে কম নয়; কিন্তু সম্পর্কের বৈচিত্র্যে আর ঘটনার দিকবদলে কাহিনিতে কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। একদিক থেকে দেখতে গেলে এর কারণ লেখকের পক্ষপাত। লেখক বহ্নিকেই কেন্দ্রে রেখেছেন; তাকে পরিচ্ছন্ন করার কাজে অন্যদের ব্যবহার করেছেন। তার মানে এই নয়, অন্যরা লেখকের মনোযোগ থেকে অন্যায্যভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। বলা যায়, বহ্নির উপস্থিতি বাকিদের খানিকটা ম্লান করেছে।
বহ্নি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। পেশায় শিক্ষক। সে মার্জিত, দায়িত্বশীল আর কোমলস্বভাবের। তার চেয়ে বড় কথা, সে স্বপ্ন দেখে। বাস্তবের যে-অংশ স্বার্থপর আর অমার্জিত, তার সঙ্গে বহ্নির স্বপ্নের একটা দূরত্ব আছে। বিরোধ আছে; কিন্তু নিজের মতো তার স্বপ্নও ব্যক্তিত্ববান। বাস্তবের দরকারের সঙ্গে সহসা তা আপস করে না। করে না বলেই তার সঙ্গ নিঃসঙ্গতায় রূপ নেয়, তার প্রেম প্রতীক্ষার প্রহরকে দীর্ঘতর করে তোলে।
বহ্নিরও সমাজ-সংসার আছে, দশের সঙ্গে ওঠাবসা আছে। সেখানে সে সাধ্যমতো যাচাই-বাছাই করে নেয়। সংসারের মানুষ তো আর একরকম হয় না। ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নিজের মতো মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। সেখানে গ্রহণ-বর্জনেরও সুযোগ আছে। কিন্তু প্রেমের মতো আরো গভীর, আরো গোপন, আরো স্পর্শকাতর সম্পর্কের বেলায় এই গ্রহণ-বর্জনের হিসাব কি চলে? বহ্নি যে কৌশিকের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক পাতিয়েছে, তা তো আর হিসাব করে হয়নি। হয়ও না। ওর ‘স্বপ্নে ওর নিজস্ব একটা ঘর আছে, ঘরের মধ্যে একজন প্রেমিক পুরুষের আছে বাস, যে সাহসী, সংগ্রামী আর আবেগি’। কৌশিকের মধ্যে বহ্নি হয়তো এসবই দেখতে পেয়েছিল। কেউ বলে দেয়নি। বলে দিয়ে হয়ও না। আর আসলেই কৌশিক তো গুণী ছেলে। হলে কী হবে। তার নিজের মতো একা হিসাবও আছে – উন্নতির হিসাব, সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন। সে-হিসাবের সঙ্গে সে প্রেমকে মিলিয়ে দেখে। দুজনের পথ এভাবে আলাদা হয়ে যায়। বহ্নি তার ব্যক্তিত্ব, সততা আর প্রেমের খুব নিজস্ব একটা বোধ নিয়ে একাকী হয়ে যায়।
কিন্তু প্রেম তো একরকমের নয়। এই কাহিনিতে অনেকগুলো প্রেমসম্পর্ক আছে। কৌশিক আর লোপার কথাই ধরা যাক। লোপাকে তো কৌশিক ভালোবাসে বলেই মনে হয়। একই সঙ্গে লোপার বাবার সহায়তায় উঁচুতে ওঠার স্বপ্নও সে দেখে। এ-ব্যাপারে আবার লোপা বা লোপার বাবা-মায়ের কোনো অস্বস্তি দেখা যায় না। বহ্নির সঙ্গে সম্পর্কের দায়ও কৌশিক মনেপ্রাণে স্বীকার করে। তা না হলে তার এত দ্বিধা কেন? লেখক কৌশিকের জন্য বিস্তর জায়গা বরাদ্দ করেছেন এ-বইয়ে। তাতে বোঝা যায়, কৌশিকের বিক্রি হয়ে যাওয়া বা প্রেমের ব্যাপারে আপস করা, বিশেষত জাগতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় লেখকের সায় না থাকলেও তার মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহলে লোপা-কৌশিক জুটিতে পাই প্রেমের আরেক ধরন। অন্য এক ধরন তো মজুদ আছে বহ্নির ঘরেই। তার বোন সহপাঠীর সঙ্গে পড়তে পড়তেই ঠিক করে নেয় সম্ভাব্য জীবনের নিশানা। সেখানে বিদেশ গিয়ে ভালো জীবন গড়ার হিসাব থেকে শুরু করে কোন কোন বৈশিষ্ট্যের পারস্পরিকতায় দুজন সুখী দাম্পত্যজীবন যাপন করতে পারবে তাও পরিকল্পনার মধ্যে থাকে।
বহ্নির সমস্যাটা তাহলে তার ব্যক্তিগত। না, হৃদয়ঘটিত সমস্যার ক্ষেত্রে নিজের বিশেষ ধারণা তার আলাদা হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ নয়। বরং আসলে তার দায়িত্বশীলতা, সহমর্মিতা আর নিজেকে নিজের মধ্যে সীমিত করে না ফেলাটাই তার কাল হয়েছে। এই অর্থে যে, চারপাশের সঙ্গে তার দূরত্বটা এভাবেই তৈরি হয়েছে। পারিবারিক সম্পর্কের ফর্দ নিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। তার ভাই এ-শহরেই নিজের সংসার নিয়ে থাকে। বাবাকে দেখার সামান্য ফুরসতও তার হয় না। পরে, বাবা মারা যাওয়ার পর, বহ্নি তার এ-ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকতে পারেনি স্রেফ ভাই-ভাবির আত্মকেন্দ্রিকতার জন্য। বহ্নির ছোট বোন নিজের পথ ঠিক করে নিয়ে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে সে-পথে এগোতে থাকে। অনায়াসেই বাদ দিয়ে দেয় বাবা বা বোনের জন্য ভাবার বাড়তি ঝামেলা। এ দুজনের – বহ্নির ভাই ও বোনের – এ-আচরণ বাস্তবসম্মত হয়েছে কিনা, বা এ দুই চরিত্র লেখকের আরোপিত নিরাসক্তির স্বীকার হয়েছে কিনা, সে-প্রশ্ন তোলা অসংগত হবে না; কিন্তু এতে পাঠকের এক নগদ লাভ হয়েছে। পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে আলাদা থাকায় আমরা পেয়ে গেছি বাপ-মেয়ের এক অন্তরঙ্গ সম্পর্কের চিত্র। বহ্নির অবসরে থাকা বাবা শুয়ে-বসে হয়তো মৃত্যুর অপেক্ষাই করে। কিন্তু নিজের ভালো-মন্দের সঙ্গে এমনকি ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনকেও জড়াতে না চেয়ে তিনি নিশ্চয়ই মানসিক ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছেন। একমাত্র বহ্নিই হয়েছে তার আশ্রয়, আর ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতায় পতিত বহ্নির জন্যও বাবাই হয়েছে মন ও মননের সঙ্গী। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাবা আর কন্যার এক মিষ্টি পারস্পরিকতা মিলেছে এ-সম্পর্কে।
যাক, বলছিলাম বহ্নির সমস্যাটি আসলে তার স্বভাবের সমস্যা। এই হিসাব-নিকাশে ভরা নাগরিক বাস্তবতায় নিজেকে আলাদা রাখার সমস্যা। এ 888sport appর বর্তমান বাস্তবতার কথা মনে রেখে এ-তরুণীকে আমরা কোন স্থানে রেখে বিচার করব? না, মোটেই পিছিয়েপড়াদের মধ্যে পড়বে না সে। বহ্নি শুধু শিক্ষিত রুচিশীলই নয়, স্ব-উপার্জনে স্বাধীন আর প্রত্যয়ী এক 888sport promo code। নিজের অস্তিত্বের জন্য হবু স্বামীর ওপর নির্ভরশীল নয় সে। একাকী এ-নগরে একজন 888sport promo code বসবাস করলে যে-সমস্যার মুখোমুখি হয়, তা পরীক্ষা করার কোনো সুযোগ লেখক অবশ্য নেননি। বিশ্ববিদ্যালয় ডরমিটরির নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার সুযোগ পেয়ে যায় সে। কিন্তু না পেলেও সে ভেঙে পড়ত বলে মনে হয় না। আমরা বলতে পারি, মনে-মননে বহ্নি আধুনিক 888sport promo code। কিন্তু এই করপোরেট সংস্কৃতি-শাসিত 888sport appয় যে-তরুণীরা বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের বদলে নিয়েছে, বা ওই ধাঁচেই গড়ে উঠেছে, বহ্নি তাদের দলেও নয়। সে রবীন্দ্রসংগীত-গাওয়া সংস্কৃতিকর্মী। তাই মনের গভীরে বাস্তবের চেয়েও বাস্তব আকারে লালন করতে পারে স্বপ্ন আর প্রেম। স্বার্থ আর বেচাকেনার এ-হাটে নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে এখনো সে দিতে পারে চরম মূল্য। ভালোবাসার এই ধ্রুপদী রূপের প্রতি লেখকের চরম পক্ষপাত। বহ্নিকে তিনি তৈরি করেছেন সে-ভালোবাসার যোগ্য পাত্র রূপে।
এ-ধরনের পক্ষপাত সাধারণত অন্যদের ব্যাপারে ঔদাসীন্য তৈরি করে। এ কাহিনিতেও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু লেখকের সহনশীলতারও বিস্তর নমুনা দেখি। কৌশিক-লোপার কথা আগেই বলেছি। এখানে বিশেষভাবে দীপ্তর কথা বলা যাক। পুরো কাহিনিতে দীপ্ত বেশ ইতিবাচক চরিত্র হিসেবেই উঠে এসেছে। তার দায়িত্বশীলতা ও ব্যক্তিত্ব, নিজের চেষ্টায় বড় হওয়ার চেষ্টা ও সাফল্য বহ্নির আদর্শের সঙ্গে বেশ মিলে যায়। তাহলে লন্ডনে তার সঙ্গে এক ভারতীয় তরুণীর সখ্য ও প্রেমকে – যে-প্রেম লম্বা শারীরিক সম্পর্কেও গড়িয়েছে – আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? স্পষ্টতই এ-সম্পর্কের প্রতি বহ্নি বা লেখক কোনো ধরনের বিতৃষ্ণা দেখাননি। একবার এক সম্পর্কে জড়িয়েছে বলে সম্ভাব্য প্রেমিক হিসেবে দীপ্তর মহিমাও ক্ষুণ্ণ হয়নি। ঠিক এ-জায়গাটিতে এসে দেখা যাচ্ছে, লেখক এ-জমানার বাস্তবতা আমলে আনছেন এবং ধ্রুপদী প্রেমের ধারণার সঙ্গে তার সমন্বয় করে নতুন ধারণায় উপনীত হচ্ছেন। প্রেম হয়ে উঠছে এমন এক অনুভূতি, যা কোনো বহিঃশর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।
এই যে প্রেমের সংজ্ঞায়নে গৃহীত উদার দৃষ্টিভঙ্গি, এ-কাহিনির অন্য কয়েকটি বিবেচনায়ও সেই ঔদার্যের পরিচয় আছে। একটা বোধহয় এই যে, মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে লেখক সাম্প্রদায়িক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠতে চেয়েছেন। কৌশিকের দুই প্রেমিকাই মুসলমান। কিন্তু তা নিয়ে কোনো পক্ষেরই বিশেষ উদ্বেগ দেখা যায়নি। অবশ্য এক্ষেত্রে লেখক বোধহয় বেশ খানিকটা সারল্যের আশ্রয় নিয়েছেন। বহ্নি বা লোপার না হোক, কৌশিকের ভিন্নধর্মাবলম্বী হওয়া নিয়ে বহ্নির বাবা এবং লোপার বাবা-মায়ের প্রশ্ন তোলার কথা। অন্তত সামাজিক বাস্তবতার সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখার কথা। লেখক অবশ্য ব্যাপারটাকে আমলেই আনেননি। না এনে তিনি হয়তো মানবিক সম্পর্কের মাহাত্ম্যই ঘোষণা করতে চেয়েছেন। ধর্মের মতো নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বাধাও হার মেনেছে দীপ্তের প্রবাসকালীন প্রেমের উপাখ্যানে। বোঝা যায়, স্বার্থপরতা আর ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের বিরোধিতা করলেও লেখক কোনো সনাতন মূল্যবোধের প্রচারণায় নামেননি।
লেখকের লক্ষ্য ছিল জীবনের সৌন্দর্য অন্বেষণ। সে-অন্বেষণের মূল অবলম্বন 888sport promo code হওয়ায় আমাদের – পাঠকদের – আরেকটি লাভ হয়েছে। আমরা 888sport promo codeর চোখে ব্যাপারগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছি। 888sport promo codeর সংকটগুলো এখানে খুব প্রবল হয়ে ধরা পড়েছে এমন নয়। কিন্তু সামাজিক সুস্থিতির মধ্যে প্রথাগত জীবনযাপন করে না, এমন এক 888sport promo codeর আত্মকথনে স্বভাবতই 888sport promo codeর জীবনবোধ ও জীবনদৃষ্টি প্রধান হয়ে উঠেছে। অন্য অনেক ব্যাপারের মতো এখানেও এ-লেখক ‘লিবারেল’। তাই 888sport promo codeর প্রতি পক্ষপাত কাহিনিটিকে পুরুষ-শয়তানের কোনো মহড়ায় পর্যবসিত করেনি, 888sport promo codeরও অযথা মহিমায়ন করেনি।
ভালো-মন্দ মিলানো এক পৃথিবীতে নিজের জন্য স্বস্তিকর বাঁকগুলো চিনে চিনে এগিয়েছে বহ্নি। তাড়াহুড়া করেনি। সময় গড়িয়েছে দ্রুত। বহ্নি নিজেকে আড়াল করে রেখেছে সেসব ছোঁয়াচ থেকে, যা তার পছন্দের নয়, যা তার রুচি আর চাহিদার সঙ্গে খাপ খায় না। তাই হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করেছে প্রকৃতির অপূর্ব শোভা। এই ইট-কাঠ-পাথরের শহরেও কৃতির হাজার মনোলোভা উপচার আছে। কিন্তু তা দেখার চোখ থাকতে হয়, মন থাকতে হয়। তৈরি হতে হয়। তাহলে অপেক্ষার প্রহর ফুরায় এক সময়। পাশে এসে দাঁড়ায় একই সঙ্গে মানুষ আর প্রকৃতি। শহরে চাঁদের রূপ সেই প্রস্ত্ততি আর প্রাপ্তির গল্প। 