সব কিছু নড়ছে

আনোয়ারা সৈয়দ হক

মহিলা তার চেম্বারে ঢুকল ধীরপায়ে।

এই নিয়ে তেরোজন। মনে-মনে বলে উঠলেন রাজিয়া বানু।

ইন্টার্ন ডাক্তারের হাতে পাঠানো কার্ডে এর আগেই চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন একবার।

আর সেখানেই সংক্ষিপ্ত করে লেখা ছিল সব উপসর্গের বর্ণনা।

মহিলার দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন, বসুন।

মহিলা না বলে তরুণী বলাই ভালো। তরুণী বিনীত হয়ে রাজিয়ার টেবিলের সামনে চেয়ার সরিয়ে বসল। টেবিল শব্দটা খুব সাধারণ শোনালেও রাজিয়া বানুর এই টেবিল আসলেই দেখবার মতো একটা জিনিস। দামী মেহগিনি কাঠের টেবিল। একদিকে বাঁকানো এমনভাবে যেন সেখানে রাজিয়া বানু তার ল্যাপটপ রাখতে পারেন। সেইসঙ্গে তার হাতব্যাগ এবং ডাক্তারি ব্যাগ।

টেবিলের একদিকে একটা কাচের ফ্লাওয়ার ভাস-এ শাদা রজনিগন্ধা ফুল। কনসালটিং রুমের দেয়ালে ঝোলানো আছে কতকগুলো অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইনটিং। আর আছে একটা ভ্যানগগ। হলুদ শস্যক্ষিতে কাকের ওড়াউড়ি। পুরো ছবিটার ভেতরে এক ধরনের ঢেউখেলানো অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার ভেতরেও আছে এক মাদকতা। ভ্যানগগ নিজেও ছিলেন মানসিক দিক থেকে অস্থির ও অসুস্থ।

রাজিয়া বানু জানেন কিছু-কিছু মানুষ অসুখ ভালোবাসে। অসুস্থ থাকতে ভালোবাসে। অসুস্থতার ভেতরেই তারা বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায়। যেদিন তাদের শরীর থেকে অসুস্থ থাকার ইচ্ছার অবসান হবে, তখন হয়তো তারা এ-পৃথিবীকে গুডবাই বলে উঠবে!

ব্যাপারটা একটু জটিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এই সবই তো মানুষ নামের এক জটিল অস্তিত্বের ব্যাপার। রাজিয়া বানু তার চেম্বারে কাজ করতে-করতে মাঝে-মাঝে ভাবেন।

রাজিয়া বানু একজন ডাক্তার। তবে সাধারণ ডাক্তার নয়, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। সোজা বাংলায়  মনোব্যাধি-বিশেষজ্ঞ। বিদেশ থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই বিশেষজ্ঞ পদবীটি তার অর্জন করা।

পাশ করার পর তিনি দেশে এসে আজ বহুবছর প্র্যাকটিস করছেন। মানুষের নানা প্রকারের বিকৃতি দেখে তার অভিজ্ঞতার ঝোলা বেশ ভারী হয়েছে, কিন্তু এই অভিজ্ঞতা কাউকে বলা যাবে না, মৃত্যুর সময় সঙ্গে করে সব অভিজ্ঞতা নিয়ে যেতে হবে। এটাই এ-বিশেষজ্ঞ পদবীর মূল কথা।

তবে রাজিয়া বানুরও ভেন্টিলেশন দরকার হয়। এজন্যে তিনি মাঝে-মাঝে বিদেশ চলে যান। সেখানকার কলিগদের সঙ্গে, যাঁরা তাঁরই মতো মানসিক ব্যাধি চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। আবার অনেক সময় দেশি-বিদেশি জার্নালেও

তার সমীক্ষার খবর প্রকাশিত হয়, তবে সেটা নিতান্তই ডাক্তারদের নিজেদের গ–র ভেতরে। সেখানে লুকোছাপা কিছু নেই। শুধু রোগীদের নামধাম কিছু থাকে না। থাকলে সেটা হবে চরমভাবে অনৈতিক একটি ব্যাপার।

এসব কারণে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিও আবার পূর্ণ রাখার প্রয়োজন।  তবে তা এমনভাবে যেন তার ব্যক্তিগত জীবনে এসব ঘটনা ছায়া না ফেলে। নইলে কে না জানে, মানসিক-বিশেষজ্ঞরাও অনেক সময় জীবনের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে থাকেন!

রাজিয়া বানুর একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। তার কাজ হচ্ছে রোগী প্রথমে ঘরে ঢুকে নাম লেখালেই তার হিস্ট্রি লিখে ফেলা।   সে-ছেলেটি একজন তরুণ ডাক্তার। এখনো শিক্ষানবিশি পর্যায়ে আছে। রাজিয়া বানু যতক্ষণ চেম্বারে থাকবেন ততক্ষণ সে তার সঙ্গে থাকে। তাকে কাজ করতে সহায়তা করে।

তরুণ ডাক্তারের কাছ থেকে হাতে লেখা কার্ডটি নিয়ে একবার মাত্র চোখ বুলিয়ে রাজিয়া বানু মনে-মনে বলে উঠলেন, এই নিয়ে আজ হলো তেরোজন। এই তেরোজন ক্লায়েন্ট আজ তার চেম্বারে একটিই অভিযোগ এনেছে আর তা হলো গত সপ্তাহে ভূমিকম্প হবার পর থেকে তারা আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সকলেই মনে করছে এখনো হঠাৎ-হঠাৎ ভূমিকম্প হচ্ছে! এই অনুভব এত তীব্র যে, বাস্তবতাকেও হার মানায়। বাস্তবে কোনো ভূমিকম্প না হলেও তাদের মনে হচ্ছে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। আর সঙ্গে-সঙ্গে নড়ে উঠছে ঘরবাড়ি। নড়ে উঠছে সিঁড়ি। নড়ে উঠছে ঘরের যাবতীয় আসবাব।

বলা বাহুল্য, এরা সকলে মাল্টিস্টোরি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। উঁচুতলা বা বহুতলা ভবনে বসবাস করার অভিজ্ঞতা এদেশের মানুষের বেশিদিন হয়নি। বরং বলা যায় সবেমাত্র  গ্রামীণ পটভূমি থেকে তারা রওনা দিয়েছে এক মেগাসিটির নাগরিক হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায়। ফলে এখন রাজধানীর যেখানে চোখ পড়ে, শুধু মাল্টিস্টোরি চোখে দেখা যায়। তেরোতলা বা চৌদ্দতলায় বাস করা এখন আর কোনো গল্প কথা নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক। এই রাজধানী তা না হলে সকলের বাসস্থান কীভাবে জোগাবে?

এই পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে ভূমিকম্প হয়ে মানুষের সবকিছু হিসাব গুবলেট করে দিয়েছে। আমাদের মতো এই গরিব দেশে যেখানে ভবিষ্যতের ভূমিকম্পের কথা ভেবে বাড়িঘর তৈরি করা হয় না, সেখানে ভূমিকম্প হলে সাধারণ মানুষের কী হবে?

মনে হয় এসব কথা এতদিন বিশেষ কেউ ভাবেনি।

তবে না ভাবলে কি হয়। প্রকৃতি তো এর জন্যে মানুষের বোকামিকে ছাড় দেবে না!

ফলে যা হবার তা হচ্ছে। এই শহরের বেশ কিছু মানুষ যাদের আমরা দুর্বল হৃদয় বা মানসিকতার ভাবি, তারা এখন এক কম্প আতঙ্কে ভুগছেন।

সাধারণ একটি দিনে ঘরে বসে মাথার চুল আঁচড়াচ্ছেন বা আয়নার সামনে বসে প্রসাধন করছেন, ওমনি যেন মনে হয় আয়নাটা একটু দুলে উঠল। বা এই বুঝি খাট নড়ছে, আলমারি নড়ছে, চেয়ার-টেবিল নড়ছে। মাথার ভেতরেও কেমন যেন নড়ানড়ি শুরু হয়েছে।

এ এক বিষম অবস্থা। ভাবলে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করে। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। পরিত্রাণ কীসে পাওয়া যাবে? ভাবতে গিয়ে তাদের খাওয়া বন্ধ, চোখে ঘুম নেই, কোনোকিছুতে মনোনিবেশ করতে পারে না। সর্বক্ষণই মনে হয় ভূমিকম্প হলে তারা কীভাবে মাল্টিস্টোরি থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবে। কারণ তখন তো আর লিফট ব্যবহার করা যাবে না। নামার জন্যে সিঁড়িতে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। সেটা হবে বিশ্রী এক অবস্থা। যেমন হয়েছিল গত সপ্তাহে।

মানসিকব্যাধি শাস্ত্রে এই উপসর্গের নাম হচ্ছে পিটিএসডি। সংক্ষিপ্ত এই নামটিকে বিস্তারিত করলে দাঁড়ায় পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার।

তেরো নম্বর রোগীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে রাজিয়া অবাক হলেন একটু। ফুটফুটে চেহারার একজন তরুণী। কার্ডে এক পলক তাকিয়ে নামটা দেখে নিলেন। সাদিয়া শারমিন। বয়স খুব বেশি হলে আটাশ-ঊনত্রিশ হবে। চেহারা খুব সুন্দর। কিন্তু পোশাকে একটু এলোমেলো। হয়তো মনের অবস্থা ভালো নয় বলে পোশাকের দিকে খেয়াল রাখতে পারছে না। ভাবলেন রাজিয়া। আবার দুঃখে তার দুচোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রম্ন ঝরছে। বুক তার ভেসে যাচ্ছে চোখের পানিতে।

এখন আর এত সহজে রাজিয়ার মনে আবেগ আসে না। বর্তমানে তিনি অভিজ্ঞতায় পোড়-খাওয়া একজন মনোবিশেষজ্ঞ। তিনি তাকে বাধা না দিয়ে অনায়াসে কাঁদতে দিলেন। রাজিয়ার নির্দেশিত চেয়ারে বসে সে নীরবে অশ্রম্নপাত করতে লাগল।

কিছুক্ষণ কেঁদে নিয়ে মেয়েটি চোখ মোছার জন্যে হাতব্যাগ খোলার আগেই রাজিয়া তার সামনে টিস্যুবক্সটি এগিয়ে দিলেন। মেয়েটি শস্নথ হাতে তার ভেতর থেকে কাগজের রুমাল বের করে চোখ মুছল। নাক ঝাড়ল। তারপর রাজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধী স্বরে বলে উঠল, সরি, ম্যাডাম।

উত্তরে রাজিয়া বললেন, নট অ্যাট অল।

আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম, মেয়েটি আবারো বলল।

তার কথা শুনে মনে-মনে চমকিত হলেন রাজিয়া। এরকম সচেতন মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। কেঁদে ফেলার জন্যে সে লজ্জিত। ভাবছে থেরাপিস্টের মূল্যবান সময় সে নষ্ট করছে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপারটা হচ্ছে পৃথিবীর সচেতন মানুষেরাই সংসারে
দুঃখ-কষ্টের শিকার হয় বেশি। এটা মনে হয় প্রকৃতিরই একটি নিয়ম। মনে-মনে ভাবলেন রাজিয়া। আবার এটাও ভাবলেন
প্রকৃতির ধর্ম হচ্ছে অজ্ঞতার ভেতরে মানুষকে রেখে দেওয়া। প্রকৃতি রহস্য ভালোবাসে। মানুষ সচেতন হলেই প্রকৃতির রহস্য ছিন্ন হয়ে যায়। প্রকৃতি চায় না তার রহস্য মানুষেরা ছিন্ন করুক! যার ফলে প্রকৃতির রহস্য একটার পর একটা মানুষ ছিন্ন করে চললেও প্রকৃতি
নতুন-নতুন রহস্যের সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়তই। ভাবটা, দেখি কত রহস্য তোরা ছিন্ন করতে পারিস!

এসব অবশ্য মনোবিশেষজ্ঞ রাজিয়া বানুর নিজস্ব ধারণা।

এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন।

একটু পরে দেয়ালঘড়ির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে রাজিয়া বললেন, বলুন মা, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

সাধারণত রোগীদের মা বা বাবা বলে সম্বোধন করেন না রাজিয়া। এটা নিয়ম নয়। তবু আজকাল তিনি অবস্থা বা সময় বুঝে এরকম সম্বোধন করেন। ভাবেন, আফটার অল, এটা তো আর পাশ্চাত্য নয়। তাদের সামাজিক ধারা আর আমাদের সামাজিক ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

কথা বলার আগে খুব বড় একটা শ্বাস নিল তরুণী। হয়তো ভাবতে লাগল কিছু বলবে কী না বা বলাটা শোভন হবে কী না। বা বললে কীভাবে বলবে।

একটু পরে তরুণী বলল, ম্যাডাম, আপনাকে কীভাবে বোঝাব জানি না, আজকাল আমার মাথার ভেতরটা কেমন যেন হাবিজাবি লাগে। মনে হয় আমার চারপাশ যেন হঠাৎ-হঠাৎ করে নড়ে যাচ্ছে। যদি কোনো আসবাবের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকি তো মনে হয় সেটা নড়ছে। টেবিলে ভাত খেতে বসলে মনে হয় টেবিলটা বুঝি একটু  নড়ে  গেল। ভাতের থালায় হাত দিলে মনে হয়, থালাটা বুঝি একপাশে সরে গেল। কিন্তু বাসার মানুষজন আমার কথা শুনে হাসে। ভাবে, আমি বুঝি মিথ্যে বলছি, কল্পনা করছি। কারণ আমি যেটা অনুভব করি, তারা সেটা করছে না। নাকি, আমাকে তারা মিথ্যে বলছে, সেটাও বুঝতে পারছি নে!

রাজিয়া বানু তার কথা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। নাকি আমাকে তারা মিথ্যে বলছে, এই কথাটা তার মনে খট করে বেজে উঠল। এতক্ষণ যারা তার চেম্বারে এসে ভূমিকম্পের ভয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করেছিলেন, তারা সকলেই বুঝতে পেরেছিলেন তাদের অনুভব ছিল মনগড়া। শুধুই একটি অনুভব। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি ছিল না। এবং এর সঙ্গে রোগীর মনের দুশ্চিন্তা জড়িত। কিন্তু এই মহিলা বলছে, সে যা অনুভব করে সেটা হয়তো আসলেই সত্যি, কিন্তু বাড়ির মানুষেরা বলছে তার ধারণা মিথ্যে।

তাহলে কি এটাকে প্যারানয়া বলা যাবে? এই প্যারানয়া বেশি ঘনীভূত হলে মনোবিদ্যায় যাকে প্যারানয়েড ডিলিউশন বলে ধরা হয়?

ভাবতে লাগলেন রাজিয়া বানু। বড় দ্রম্নততার সঙ্গে ভাবতে লাগলেন। কারণ একজন রোগীকে নিয়ে সারাক্ষণ তার সময় ব্যয় করলে হবে না। তার আরো রোগী অপেক্ষমাণ আছে।

আর তাই যদি হয়, তাহলে বলতে হবে এটা সাধারণ একটি পিটিএসডি নয়, এর পেছনে কিছু গভীর একটি মানসিক বৈকল্য কাজ করছে। কী সেই মানসিক বৈকল্য?

ভাবতে-ভাবতে রাজিয়া বানু তার রোগীর কথা মন দিয়ে শুনলেন। প্রেসক্রিপশন প্যাডে কিছু নোট নিলেন। তারপর বললেন, আপনি কোথায় থাকেন?

কলাবাগে, ম্যাডাম।

বিবাহিত কী না, এ-প্রশ্ন আর জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ তার কার্ডেই লেখা আছে তিনি বিবাহিত। এবং দুই পুত্রসন্তানের জননী।

রেসিডেন্সের কথাও লেখা ছিল; কিন্তু রাজিয়া ইচ্ছে করে সেটা এড়িয়ে গেলেন। তাকে রোগীর সঙ্গে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

রাজিয়া এবার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্বামী কী করেন?

তিনি একজন অধ্যাপক। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।

আর আপনি?

আমি হাউসওয়াইফ। আমি 888sport app ভার্সিটি থেকে ভূগোলে অনার্স নিয়ে মাস্টার্স করেছি। কিন্তু আমার স্বামী বলেছেন, বাচ্চারা ছোট থাকাকালীন আমি যেন কোনো চাকরি না করি। তাই বর্তমানে কিছু করছি না।

এরকম কথা শিক্ষিত মেয়েদের মুখে প্রায় শোনেন রাজিয়া বানু। এর উল্টো কোনোদিন শোনেন নি বা দেখেন নি। এমনকি স্ত্রীটি ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হলেও স্ত্রীকে বাড়িতে বসে থাকতে হয় আর থার্ডক্লাস পাওয়া স্বামীটি চাকরি বা ব্যবসা করতে ছোটে।

আপনার স্বামী কি আপনার সঙ্গে এসেছেন আজ? জিজ্ঞেস করেন রাজিয়া।

তার প্রশ্নে তরুণী একটু চুপ করে থাকল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, হ্যাঁ, এসেছেন। প্রথমে আসতে চাননি, পরে আমি জোর করাতে এসেছেন। এখন অপেক্ষা-ঘরে বসে আছেন।

আপনার সমস্যাটা একটু বিস্তারিত বলবেন কি? এবার বেশ নিচু স্বরে প্রশ্নটি করেন রাজিয়া।

উত্তরে কথা বলার আগে বড় করে আরো একটা শ্বাস নিল তরুণী। বলল, সেই 888sport sign up bonus আমি মনে করতে চাইলেও পারিনে, ম্যাডাম। ভাবতে চেষ্টা করলেই আমার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। শুধু মনে হয় আমি কি বাস্তবে না কি স্বপ্নে। সত্যি কি সেদিন ভূমিকম্প হয়েছিল না কি সেদিন পৃথিবী ধ্বংস হয়েছিল! শুধু এটুকু মনে আছে যেদিন সকাল এগারোটার দিকে ভূমিকম্প শুরু হয়, সেদিন আমার স্বামীর বিকালবেলা ক্লাস ছিল। তিনি তাই বাড়িতেই ছিলেন।

তারপর?

সাদিয়া চুপ করে যেতে রাজিয়া প্রশ্ন করলেন।

প্রশ্নটা ইচ্ছে করেই করলেন। কারণ ওদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। মূল্যবান সময়।

সাদিয়া মাথা নিচু করে ভাবছিল। প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে ধীরে-ধীরে বলল, তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার স্বামী তার পড়ার ঘরে বসে ছিলেন। কম্পিউটারে কিছু করছিলেন। আর আমি বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে টুকটাক ঘর-সংসারের কাজ করছিলাম। তারপর, তারপর –

সাদিয়া এবার বুকে হাত চাপা দিয়ে চুপ করে বসে থাকল। বড়-বড় করে শ্বাস ফেলতে লাগল। রাজিয়ার মনে হলো হয়তো সে ফিট লাগবে। হয়তো ফিট লেগে হাত-পা মোড়ামুড়ি শুরু করবে। যদি সে এরকম ব্যবহার করে, তবে সেটা তাকে করতে দেওয়া হবে সমীচীন। এইসব নকল ফিটেও মানুষের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়, এটা রাজিয়া বানু জানেন।

কিন্তু না, সাদিয়া ফিট লাগল না। চুপ করে বসে টেবিলের কোনা খুঁটতে লাগল।

রাজিয়া বুঝতে পারলেন 888sport sign up bonus ফিরিয়ে আনতে সাদিয়ার/ কষ্ট হচ্ছে। বেদনার 888sport sign up bonus কেই বা আবার মনে করতে চায়? কবি জীবনানন্দের একটা লাইন আছে এইসব 888sport sign up bonusর বিষয়ে, রাজিয়া বানুর মেয়ে মাঝে-মাঝে 888sport app download apkটা বলে। কিন্তু রাজিয়া বানুর পক্ষে সেটা এখন মনে করা সম্ভব নয়। এসব ব্যাপারে তিনি আর দশজন ডাক্তারের মতোই নিরেট।

তবে তিনি জানতেন এই উপসর্গে রোগী প্রায় তার কষ্টের বর্ণনা দিতে পারে না। কারণ তার 888sport sign up bonusর ওপরে চাপ পড়ে। 888sport sign up bonus তখন বি888sport sign up bonusর আড়ালে চলে যাওয়ার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করে। যেন রোগীর কষ্টের পরিমাণ আর না বাড়ে।

কিন্তু রোগকে আদর দিয়ে পুষে রাখলে তো চলবে না। রোগ তার মস্তিষ্কের গহবর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনতে হবে। তাকে আছাড় মেরে ফেলতে হবে উন্মুক্ত চাতালে। সত্যের সমুখে তাকে যাচাই-বাছাই করতে হবে। দুর্বিনীত রোগ হলে তাকে মাড়িয়ে ফেলতে হবে বড় চতুরতার সঙ্গে। বড় মুন্সিয়ানার সঙ্গে।

তার জন্যে সময় দরকার। ধৈর্য তো অবশ্যই।

রাজিয়া এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বিয়ে হয়েছে কতদিন আগে, সাদিয়া?

সাত বছর হবে, ম্যাডাম। বলল সাদিয়া।

বাবা-মায়ের পছন্দমতো বিয়ে? রাজিয়া মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

জি না। আমরা পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম। আমার বাবা এইখানে বিয়ে দিতে চান নি। মা অবশ্য কিছু বলেন নি। তার মতে মেয়ে যত তাড়াতড়ি বিয়ে দেওয়া যায়, ততই ভালো। কিন্তু বাবা –

যাক, বিয়ে তাহলে তো হয়েই গেছে। আপনার ছেলেরা ভালো?

জি, ভালো। লেখাপড়া করে। তবে বড়টার চেয়ে ছোটটার বুদ্ধি বেশি।

প্রায় বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের সম্পর্কে এই ধরনেরই সমীক্ষা করে থাকেন। বড়  সন্তানটি বোকা, সোজা-সরল, ছোটটি চালাক, বুদ্ধিমান।

চুপ করে শুনলেন রাজিয়া বানু।

তারপর মহিলার স্বামী প্রসঙ্গে গেলেন। আপনারা কি ক্লাসমেট ছিলেন?

প্রশ্নটা শুনে তরুণী বলল, জি, আপনি ঠিক ধরেছেন। আমরা ক্লাসমেট ছিলাম। কিন্তু তার পরিবার আমার পরিবারের চেয়ে অর্থনৈতিক অবস্থায় একটু নিচু।  কিন্তু আন্দালিব বরাবর লেখাপড়ায় ভালো ছিল। যে জন্যে পাশ করার সঙ্গে-সঙ্গে সে একটা ভার্সিটিতে লেকচারার হবার চান্স পেয়ে যায়। আমিও একটা কলেজে সুযোগ পেয়েছিলাম, কিন্তু সে-সময় হঠাৎ করে আমি গর্ভবতী হয়ে পড়ি।  যার কারণে আমি সুযোগটা কাজে লাগাতে পারিনি।

যাক, তাহলে এবার বলুন ভূমিকম্পের সময়টাতে আপনি কী করছিলেন?

সাদিয়া মেয়েটি এবার বড় একটি শ্বাস নিয়ে বলল, আমি ঘরের সিটিং রুমে রাখা ফ্রিজটার গা পরিষ্কার করছিলাম। তার আগে বলি আমরা থাকি চৌদ্দতলার একটি মাল্টিস্টোরির দশতলার বি-বস্নকের ফ্ল্যাটে। মোট বাহান্নটি ফ্ল্যাট আমাদের বিল্ডিংয়ে।

সমস্ত ফ্ল্যাটেই কোনো না কোনো পরিবার বাস করে। তারা সকলেই আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বলা যায়। প্রায় সকলেই চাকুরিজীবী। কেউ-কেউ অবশ্য ব্যবসাও করে। মেয়েদের ভেতরেও কেউ-কেউ পোশাকের দোকান বা পার্লার দিয়েছে।

আমাদের সাততলার বস্নকের দুপাশে মধ্যবয়স্ক দুজন দম্পতি বাস করে। তাদের একজনের দুটি মেয়ে আছে। তারা কলেজে পড়ে।  আরেক জন দম্পতি, তারা সন্তানহীন। বস্নকের সকলের সঙ্গে আলাপ না হলেও এই পরিবার দুটির সঙ্গে আমাদের আলাপ ছিল। কখনো-কখনো আমরা স্বামী-স্ত্রী বাইরে বেড়াতে গেলে সেই সন্তানহীন দম্পতিটির কাছে বা সাততলার কলেজে পড়া মেয়ে দুটির কাছে আমাদের ছেলে দুটিকে রেখে যেতাম। বড় মেয়েটির নাম নাজমা আর ছোটটির নাম রেহানা। রেহানার চেয়ে নাজমা মেয়েটি দেখতে সুন্দর। শুধু সুন্দর নয়। তার চোখের ভাষা বেশ বাঙ্ময়। একবার কথা বললে আবার কথা বলতে ইচ্ছে করে। আমি মেয়েটিকে খুব সেণহ করতাম। আমার বাচ্চা দুটো এই পাতানো আন্টিদের সঙ্গে খুশি মনে খেলাখুলা করত। তাদের সঙ্গে বসে কার্টুন দেখত টিভিতে।

যখন ভূমিকম্প শুরু হয়, মনে হয় বেলা এগারোটার দিকে, আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। আমার বাসার কাজের বুয়া
ছিল রান্নাঘরে। সে হঠাৎ করে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে বলল, আপা, রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল নড়চড়া করে। মনে হয় ভূমিকম্প হইতেছে।

তার কথা শুনে আমি যেন স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। জীবনে আমি কোনোদিন ভূমিকম্প হতে দেখিনি। শুধু বইতে পড়েছি বা বুড়ো মানুষদের মুখে শুনেছি। প্রথমে আমি তার কথা হেসে উড়িয়ে দিলাম। কিন্তু আমার চোখের সামনে ডাইনিং রুমের ঝোলানো বাতির তার দুলতে লাগল ভীষণভাবে। দেখে আমার প্রাণ উড়ে গেল। এখন এই চৌদ্দতলার সিঁড়ি ভেঙে কীভাবে আমরা নিচে নামব। সবচেয়ে আগে মনে হলো মিশুর বাবা তার ঘরে বসে লেখাপড়া করছে। সে হয়তো বুঝতেও পারছে না যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। আমি চিৎকার করে মিশুর বাবা বলে ডেকে উঠলাম। আর সে তার পড়ার ঘর থেকে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, আমি কাজ করছি, ডাকছো কেন?

মিশুর বাবা, ভূমিকম্প হচ্ছে।

কী বললে? আন্দালিব ঘরের ভেতর থেকেই নড়চড়া না করে বলে উঠল।

মিশুর বাবা, ভূমিকম্প। পিস্নজ, তুমি বাইরে বেরোও।

কি, কী বললে?

এবার লাফিয়ে উঠল আন্দালিব। ততক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে বিপদের গুরুত্ব। মনে আছে এই ফ্ল্যাটটা কেনার সময় আমরা বিল্ডারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দশতলায় ফ্ল্যাট কিনলে, সে ফ্ল্যাটে বসবাস করা নিরাপদ কী না, ভূমিকম্প হলে বেরোনো যাবে কী না, তখন বিল্ডারদের একজন হেসে বলেছিল, আমাদের ফ্ল্যাটে ভূমিকম্প হলেও আপনারা বুঝতে পারবেন না, এমনভাবে এই বিল্ডিং তোলা হয়েছে! কিন্তু তার কথা যে ঠিক নয়, আমি তা হাড়ে-হাড়ে বুঝলাম। কারণ কিছুদিন আগেই একটা সমীক্ষায় বেরিয়েছিল যে রাজধানীর অধিকাংশ মাল্টিস্টোরি বিল্ডিংই আর্থকোয়েক প্রম্নফ নয়।

এবার লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আমার স্বামী আন্দালিব। দৌড়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে লাফাতে-লাফাতে নিচে নামতে-নামতে বলল, পালাও, পালাও, শিগগির নিচে নামো, শিগগির, শিগগির –

বলতে-বলতে সে অতি দ্রম্নততার সঙ্গে আমাদের সকলকে ডিঙিয়ে নিচে নামতে লাগল।

তার পেছনে-পেছনে আমার বাসার কাজের বুয়া। সকলের পেছনে আমি। কিন্তু আমরা নিচে নামবো কী করে? ততক্ষণে ওপরের ফ্ল্যাটগুলো থেকে দুদ্দাড় করে অন্য বাসিন্দারা নামতে শুরু করেছে। তাদের অধিকাংশ রিটায়ার্ড মানুষ, এবং তাদের কাজের মানুষজন, এবং ছেলেমেয়েরা। বাসাবাড়ির অধিকাংশ পুরুষ তখন কাজে চলে গেছে। মাল্টিস্টোরির যেসব বাসিন্দাকে জানতাম হাঁটতে পারে না, হাঁটতে গেলে অন্য মানুষের সাহায্য লাগে, তারাও দেখলাম সাহায্য ছাড়াই তখন তুর-তুর করে নিচে নামছে দোয়াদরুদ পড়তে-পড়তে। বিশেষ করে আমাদের চৌদ্দতলায় একজন নানি থাকেন। তিনি কাজের লোকের সাহায্য ছাড়া একেবারে চলাফেরা করতে পারেন না। কাজের মানুষ না থাকলে তার ছেলের বউ বা নাতনি তাকে সাহায্য করে। সেদিন আমার চোখের দিব্যদৃষ্টি যেন খুলে গেল। দেখলাম আমাদের সেই নানি তর-তর করে সিঁড়ি বেয়ে সকলের আগে নিচে নেমে যাচ্ছেন! আলস্না আমাকে সেদিন আরো যা দেখালেন আমি ভুলতে পারব না, ম্যাডাম।

আলস্না আরো কী দেখালেন, ম্যাডাম? রাজিয়া বানু মওকা বুঝে বেশ জোর গলায় এবার বলে উঠলেন।

রাজিয়া বানু এবার ইচ্ছে করেই সাদিয়াকে ম্যাডাম বলে ডাকলেন। তাহলে ব্যাপারটা বেশ গুরুত্ব পায়।

তার কথার উত্তরে হঠাৎ যেন বোবা হয়ে সাদিয়া মেয়েটি রাজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখের পাতা স্থির হয়ে গেল। মুখ বেঁকে গেল একদিকে।

রাজিয়া এবার যেন ধমক দিয়ে বললেন, কী দেখলেন সাদিয়া? স্পষ্ট করে বলুন কী দেখলেন?

দেখলাম, দেখলাম, দেখলাম, উঃ, আলস্নারে –

মহিলা এবার রাজিয়া বানুর চোখের সামনে ফিট লাগল।

এই এক ঝামেলা! মনে-মনে ভাবলেন রাজিয়া বানু। কিন্তু তার বাইরেটা থাকল শাকআলুর মতো ঠান্ডা। এখন তাকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ মহিলার ফিট না ভাঙে। এ এমন এক ফিট যেখানে সহানুভূতি দেখালে চলবে না। থাকতে হবে নিরেট, নির্বিকার, নিশ্চিন্ত।

চোখে-মুখে পানি না দেবার পরেও সাদিয়া আসেত্ম-আসেত্ম আবার মাথা তুলে তাকাল। তারপর হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। ডুকরে বলল, হে খোদা, আমার মৃত্যু দাও! আমি মরতে চাই!

এবার রাজিয়া বানুর গলার স্বর খুব নরম শোনালো। তিনি মৃদু কণ্ঠে বললেন, কেন মরতে চান, মা? এই বয়সে কেউ কি মরতে চায়? এত সুখের সংসার ছেড়ে –

সুখ? সাদিয়া এবার আগুন চোখে রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, সুখ? আমার সুখ দেখলেন আপনি? সুখ? আমি সেদিন যা চোখে দেখেছি সেই দৃশ্য চোখে দেখলে পৃথিবীর কোনো 888sport promo code সুখী হবে? আপনি সুখী হবেন? কথা বলতে-বলতে টেবিলের কোনা খামচে ধরল সাদিয়া।

আপনি কী চোখে দেখলেন সেদিন, মা?

আমি – আমি –

এবার  থপ করে চেয়ারে বসে পড়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সাদিয়া।

রাজিয়া বানু তাকে কাঁদতে দিলেন। কাঁদুক। ইচ্ছেমতো কাঁদুক। ওষুধের চেয়ে বেশি কাজ করবে।

কাঁদতে-কাঁদতে হেঁচকি তুলতে-তুলতে সাদিয়া বলে চলল, আমি ভীতসন্ত্রস্ত বিকারগ্রসেত্মর মতো দশতলা থেকে ন’তলা,  ন’তলা থেকে আটতলা, তারপর আটতলা থেকে সাততলা, আর সাততলায় নেমেই দেখি আমার স্বামী আন্দালিব সাততলার নাজমাকে পাঁজাকোলে উঠিয়ে তর-তর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে! আর নাজমা আমার স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে চুপ করে পড়ে আছে। আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না, ম্যাডাম। এটা কি সত্যি দেখছি, না মিথ্যে? এটা কি বাস্তব নাকি কল্পনা? উঃ, এই দৃশ্য দেখার আগে আমার কেন মৃত্যু হলো না, ম্যাডাম? চাক্ষুষ দেখার পরেও আমি কেন এতদিন বেঁচে আছি? কেন, কেন?

হতাশাগ্রস্ত গলায় এবার ঘড়-ঘড় করে বলে চলল সাদিয়া, তা-র-প-র থেকে আমার আর কিছু ভালো লাগে না রে, ম্যাডাম! দিনদুনিয়া কিচ্ছু আর ভালো লাগে না। দিন-রাত্তির সব সমান লাগে। এত বছর লোকটার সঙ্গে সংসার করছি, এত বছর সুখে-দুঃখে তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছি, সব যেন ফুৎকারে কোথায় মিলিয়ে গেল রে!

মাথার চুল টানতে-টানতে এবার বিলাপ করে চলল সাদিয়া।

বলতে লাগল, এই ভূমিকম্প তো সাধারণ ভূমিকম্প নয়, এ যে আমার জীবনের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে গেল, ম্যাডাম। এর চেয়ে নেপালের মতো বাড়িঘরের ধসে আমি কেন ডুবে গেলাম না! আসল ভূমিকম্পও তো এর চেয়ে ভালো ছিল আমার কাছে।

তা অবশ্য ভালো ছিল! রাজিয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মনে-মনে বললেন।

সাদিয়া বলল, এখন আপনি বলে দিন আমি কী করব? কীভাবে বেঁচে থাকব? বেঁচে থাকার ইচ্ছেও তো আমার আর নেই। এমনকি বাচ্চাদের মুখ চেয়েও না। পিস্নজ, ম্যাডাম আমাকে বলে দিন আমি কী করব?

তার প্রশ্ন শুনে রাজিয়া বানু চুপ করে থাকলেন। এসব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই। কিন্তু তবু তাকে ভান করতে হবে যেন আছে!

অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে, ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে, ঠান্ডা হলো সাদিয়া। তারপর রাজিয়া বানুর দিকে ভেজা চোখদুটো তুলে বলল, তারপর থেকে আমার সংসারে যাবতীয় যা কিছু আছে, ছেলেমেয়ে, স্বামী, আসবাব, ঘরদোর, বিছানা, বালিশ, হাঁড়িকুড়ি, চেয়ার-টেবিল সবকিছু থির-থির করে নড়ছে! ক্রমাগত নড়ছে। দিন নেই, রাত নেই, চবিবশ ঘণ্টা নড়ছে। থির থির থির থির থির থির থির থির। নড়ছে, নড়ছে নড়ছে।

রাজিয়া বানু এবার হাঁ করে তার ক্লায়েন্টের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই নাটকের যিনি আসল কালপ্রিট, সেই সুবেশধারী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাবাজি বাইরের কনসালটিং রুমে তার স্ত্রীর মাথা থেকে মিথ্যে ভূমিকম্প অনুভূতি ছাড়ানোর জন্যে ধৈর্য ধরে বসে আছেন!

তাকে কি এবার তিনি ভেতরে ডেকে পাঠাবেন?

রাজিয়া বানু ভাবতে লাগলেন।