রীতিমতো তিন পাতা পিডিএফে একটা মেইলে এসেছে। এরকম বাংলায় মেইল সচরাচর খুব কম আসে আমার কাছে। নির্বিবাদী মানুষ আমি, দেশের এক শীর্ষ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। মাঝেমধ্যে বাংলায় দুই-চারটে মেইল আসে, ছাত্রদের ডেডলাইন ফেল করাজনিত অপারগতা প্রকাশ করে। বাকিসব চিঠিপত্র ইংরেজিতেই পাই। বেশিরভাগই অফিসিয়াল মেইল। সেই আমার কাছে তিন পাতার মেইলে একটা গল্প চেয়ে চিঠি এসেছে।
মাঝেসাজে গল্প লিখি আমি। বিরাট 888sport live footballবোদ্ধা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার ঘুপচি গলিতে দুই-চারটে পোস্টও লিখি, প্রায়ই। তবে গল্প লিখে দেশোদ্ধার তো দূরে, সকালের নাস্তাও উদ্ধার হয় না। তাই ওই পথ যত কম মাড়ানো যায় ততই লাভ। এ-হেতু লেখালেখিতে এখন ইস্তফা দিয়েছি। সকালের নাস্তাটা নিজে বানিয়ে খেতে না চাইলে অনায়াসেই তা আমি পেতে পারি; কিন্তু নিজে বানিয়ে খুব আয়েশ করে খাব বলে সব ক্লাস দুপুরের পর নিয়েছি। এই সময়টা আমার বাড়ির লোকেরা বাইরে চলে যায়। আমি ল্যাপটপে গান বা কোরান ছেড়ে দিয়ে নাস্তা বানাই। কোনো-কোনোদিন নাস্তা বানাতে ইচ্ছা না করলে ফ্রিজে থাকা ভাত বের করে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে আচ্ছামতো মেখে খাই। কোনো-কোনোদিন আবার স্প্যাগেটি বানাই। বাসার তিনজন কাজের লোক হাঁ করে আমার এসব কর্মকাণ্ড দেখে। আড়ালে-আবডালে এরা আমাকে ‘পাগল’ বলে নিজেদের মধ্যে বেশ একটা আলাপ দেয়। এরা শুধু একা না, দেশখ্যাত আমার আর্কিটেক্ট স্বামী এবং আমার একমাত্র পুত্র – তারাও আমাকে স্বাভাবিক মনে করে না। মাঝখানে একবার ছেলে আমাকে সাইকো কাউন্সেলর সাজেস্ট করেছিল। আমি চোখ গরম করায় সে-কাজে সে ক্ষান্ত দিয়েছে।
সম্প্রতি নিজেকে আমি ‘নাদান লেখক’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। সেই ঘোষণাপত্রে ‘লিখতে পারি না কেন’ – এই জাতীয় গরুর রচনা লিখেছিলাম। সঙ্গে বাজারে পাওয়া যাওয়া আমার একমাত্র বইয়ের ঝাঁ-চকচকে একটা ছবিও সাঁটিয়েছিলাম। ফলাফল সাড়ে পাঁচশো অভিনন্দন, দুশো কনগ্রাচুলেশন, একশ ভালোবাসা লেখা রিঅ্যাকশন মানে কমেন্ট পেয়েছিলাম।
পরে ভেবেছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়ার পাঠকদের পাঠাভ্যাসবিষয়ক একটা পোস্ট দেব। কিন্তু জ্ঞানগর্ভ সেই পোস্ট দিতে গিয়েও ব্যাকস্পেস চেপে ডিলিট করে দেওয়াটাই শ্রেয় মনে হয়েছিল আমার কাছে।
এরপর থেকে গল্প লেখা চাঙ্গে উঠিয়ে রাখাই ভালো বলে মনে করেছি। আসলে আমি লোকাল লাঙ্গুয়েজে খুব স্বচ্ছন্দ। আইছি-খাইছি-গেছি – এসব ভাষায় আরাম লাগে। সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ভাষায় লেখা যায়, কিন্তু ভদ্রলোকের বইয়ে তো লেখা যায় না। এই দেশে 888sport live footballিক মানেই সুশীল একটা ভাব ধরে থাকা লাগে। অনেকে তেমন থাকেনও। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি হিসেবে লেখকদের আচার-আচরণ, সাজপোশাক হতে হবে সেইমতো – ভাবখানা এমন।
সবকিছুতে ভেক ধরে থাকাটা আমার জন্য একটু কষ্টকর। আমার পরিচিতজনেরা আমার এসব লেখালেখিতে খুব বিস্মিত। ফেসবুকে আমি কবে কী লিখেছি, সেগুলো বাবা-মা ও বড় ভাইয়াকে জানানোর পবিত্র দায়িত্ব তারা নিজ উদ্যোগেই নিয়েছেন। পরিজনদের আরেকটা গ্রুপ আছে, যারা ক্রমাগত আমার স্বামী ও সন্তানকেও তথ্য দেন। আমার আব্বা-আম্মার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। বড় ভাইজানসহ আমার ছেলে সাম্য ও স্বামী মোহিতকে আমি ব্লক করে রেখেছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুই-চার লাইন লিখব, তা নিয়েও যদি রাতদিন কৈফিয়ত দিতে হয়, এর চেয়ে অভিযোগকারীকে পরিত্যাগ করাতেই আমার আরাম।
সবার বিরাট বিস্ময় আমার ভাষা আর লেখার বিষয় নিয়ে। 888sport app শহরে বা হাইওয়েতে বেশ কয়েকবার পাবলিক টয়লেটে গিয়ে আমার ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা হয়েছিল, আঁতুড়ঘরের শালদুধও উঠে এসেছিল মুখে। পরে ফেসবুকে বাথরুম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে দুয়েকটা কথা লিখেছিলাম। আর যায় কই। আমি তো হুমায়ূন আহমেদের মতো বড় লেখকও না যে এসব যাপিত জীবনের সব ঘটনা অবলীলায় নিজস্ব ভঙ্গিমায় লিখে যাব। নিজের বিচারে আমি একজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত লেখক, যার আসতেও কাটে, যেতেও কাটে। জীবনে একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আর যা-ই হই মধ্যবিত্ত হবো না। আদতে আমি মধ্যবিত্তও নই। তবে চারপাশের পরিপার্শ্বের চাপে এখন আমি যে কোন বিত্তে আছি, এই বিচারটাই করে উঠতে পারছি না।
এরকম চরম কনফিউজড আমার কাছে গল্প চাওয়া আর কাঠবলদ বা গাছবলদের কাছে বুদ্ধি চাওয়া সমান কথা; কিন্তু 888sport live footballের যে ঝাণ্ডা উড়িয়েছিলাম এককালে, সেই পতাকার সম্মানের জেরেই গল্পখানা লিখে দেব বলে কথা দিয়েছি। এরপর মাসখানেক সময় চলে গেছে। গল্প না লিখে এই মাসখানেক সময় আমি কী কী করেছি, সেসব ভাবার চেষ্টা করছি ডেডলাইন মেইল পাওয়ার পর থেকে।
সং সেজে অসার হয়ে আপনি যখন সংসারে ঢুকে যাবেন, তখন নিরবচ্ছিন্নভাবে ভাবারও কোনো সুযোগ আপনার থাকবে না। আপনার মুঠোফোন মুহুর্মুহু বেজে উঠবে। একটু দায়িত্বশীল সংসারী মানুষ হলে সবাই সব নিয়ে হামলে পড়বে। একলা থাকা বা একলা হওয়ার সময় বা সুযোগ তখন কোনোটাই আপনার নেই এবং থাকবেও না।
শেষ কবে একলা হয়ে একটু ভাবতে বসতে পেরেছিলাম তাও আজ আর মনে নেই। একবার মনে হলো, আব্বা মারা যাওয়ার পর এসব সামাজিকীকরণ থেকে একটু মুক্তি পেয়েছিলাম। পরক্ষণেই মনে পড়ল, আব্বার হাসপাতালের বিল মেটানো, আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া, দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা; এমনকি বাড়িতে আসা অতিথিরা কী খেয়ে যাবেন – সেই বিষয় নিয়েও মঈনু আমাকে যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছিল। নিজের অসুস্থতাও ভুলে গিয়েছিলাম সে-সময়। বাপমরা সন্তানের শোক করার বাস্তবতাও নেই আমাদের অতি সামাজিক জীবনে। আর আব্বার মৃত্যুতে সোশ্যাল মিডিয়াতে তো রীতিমতো ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ রব উঠেছিল, আমি ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছিলাম কয়েকদিন।
মঈনু আমার বাবার বাড়ির কেয়ারটেকার টাইপ। বহুদিন সে আমাদের বাড়িতে আছে। আব্বাও তার ওপর খুব ভরসা করতেন। মাঝেমধ্যে তাই তাকেই বাড়ির কর্তা বলে ভ্রম হয়। তো একদিন সময়-সুযোগ পেয়ে তাকে আচ্ছামতো ঝেড়ে দিলাম, ‘আব্বা মরার দিন এমন অহেতুকভাবে খাওন আনাও খাওন আনাও করতেছিলে কেন?’ জবাবে মঈনু যা বলল সেই কথা সত্যিই আমাকে একা করে দিয়েছিল, ‘মরাবাড়িতে শোকের লাইগা শক্তি লাগে, তাই খাওন লাগে। আর তোমার বাপ বাঁইচা থাকতে এই বাড়ি থিকা একটা পক্ষীও না খায়া গেছে না। আর এতো অথিত না খায়া যাইব?’ আমার বাবার সম্মান রক্ষার ধামাটা মঈনু আমাদের অগোচরেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। নেহায়েত ওর কাছে টাকা ছিল না। নইলে এটুকুর জন্যও আমাকে বলত না। শুনেছি আব্বার কবরে মঈনুই নেমেছিল আর বড় ভাইয়াকে সে-ই টেনে নামিয়েছিল। আমি মেয়ে বলে কবরস্থানে যাওয়া নিষেধ। কিন্তু পরদিন মঈনু আমাকে ঠিকই নিয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি যদি তোমার আগে মরে যাই, তাহলে আব্বার কবরের পাশে আমাকে একটু জায়গা দিতে বইলো।
এরপর চারদিনা, চল্লিশা, আম্মার ইদ্দত – এসবের ফাঁকে আমার আর একা হওয়া হলো না। বাপ মরে যাওয়ার পর বেশ গালভরা একটা লেখা লেখেছিলাম ফেসবুকে। সেখান থেকে ইনস্টা আর টুইটারেও লিংক শেয়ার করেছিলাম। ৮৯১ বার শেয়ার হয়েছে, রিটুইট হয়েছে ৯৭৫ বার। আদর্শ সন্তানের তকমা লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘুরে বেড়ানো আমি জানতামই না আমার বাবা লোক খাওয়াতে ভালোবাসতেন। হাতে চাল নিয়ে বারান্দায় বসে চড়ুইকে খাওয়াতেন। আমি আসলে মঈনুর কথা লিখতে পারতাম। সে সন্তান না হয়েও বাবার আদর্শ পুত্র, অন্তত আমার কাছে। কিন্তু তার কথা লিখলে ভাইয়া আমাকে তখনই কুঁচিকুঁচি করে ফেলত।
আব্বাকে নিয়ে ভাইয়ার বিস্তর অভিযোগ। আব্বা জীবিত থাকতেই সে বলত, তার চেয়ে মঈনুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আব্বার কাছে। আর আমি একটু লেখালেখি করি বলে আব্বা নাকি আমাকে মাথায় তুলেছেন, আর কখনো নামাননি। এবংবিধ কারণে আমি একটা অকালকুষ্মাণ্ড হয়েছি। ভাইয়ার এসব বালখিল্য অভিযোগ আমরা কেউই আসলে ধর্তব্যের মধ্যে নিই না। কারণ সে বছরে একবার দেশে আসে। এসে ১৫ দিন শ্বশুরবাড়ি, ১৫ দিন কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন আর ১০ দিন কাটায় বাড়িতে। তবে যে-কয়দিন বাড়ি থাকে, সে-সময়গুলোতে তার বন্ধুবান্ধবের জন্য রান্না করতে করতে আম্মার নাভিশ্বাস উঠে যায়, আর মঈনুর দিন পার হয় বাজার করতে করতে। ভাইয়ার বন্ধুবান্ধবও একদম তার মতো – বেআক্কেল এবং আবেগের ডিব্বাও। কবে কোন ক্লাস থ্রিতে থাকতে আম্মার হাতে চুই পিঠার পায়েস খেয়েছিল, সেই পায়েস নাকি আম্মা এই ৭০ বছর বয়সে তাদের বানিয়ে খাওয়াবেন। আবদারের শেষ নেই। এসব আবেগকে আমি অবশ্য ফাতরা আবেগই মনে করি। তাই ভাইয়ার সঙ্গে আমার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। আমার স্বামীকেই শুধু ভাইয়া একটু সহ্য করতে পারে। সে আপাদমস্তক বৈষয়িক বলে ওর সঙ্গে তার খুব মিল।
আব্বার দাফনের ২০ ঘণ্টা পর এই দুজন আব্বার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে হিসাবে বসেছিলেন। আমি সজোরে চিৎকার করায় আমার স্বামী মানে মোহিত আমাকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করল, এসব সে আর ভাইয়া ছাড়া আর কে দেখবে। বড় ভাবিও কিছুটা অপোজ করেছিলেন। তবে নিউজিল্যান্ড তাদের খুব দ্রুত ফিরতে হবে বলে মন থেকে মানা করেননি।
আমি সেদিন বাড়ি ছেড়ে নিজের বাসায় চলে এসেছিলাম। বড় ফুপু খুব মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিলেন, মরাবাড়ি ফেলে যেতে হয় না। আমিও তাকে পাল্টা ঝাড়ি দিয়ে বলেছিলাম, মরাবাড়িতে সম্পত্তির হিসাব করতে হয় বুঝি। ‘সম্পত্তি’ শব্দটা কানে যেতেই ফুপু চাঙা হয়ে ভাইয়ারা কোন রুমে তা জিজ্ঞাসা করতে করতে ছুটলেন সেদিকে। করিডোরের ওপাশ থেকে কে যেন ফুপুকে বলছিলেন, ভাইয়ের সম্পত্তিতে বোনের হক আছে, ছেড়ো না …। হায় রে মরাবাড়ি, আম্মার তুমুল কান্নার চেষ্টা আর মঈনুর ছোটখাটো শোকাতুর বিলাপই কেবল এই বাড়িকে মরাবাড়ি প্রমাণ করছে। ছোট চাচা আর মেজো ফুপা তো রীতিমতো রাজনীতি নিয়ে পড়ছেন, চীন কীভাবে সারাবিশ্বে করোনা ছড়িয়েছে, 888sport appsের মতো গরিব দেশ কী করে তার মাসুল দিচ্ছে, কেমন করে আব্বার মৃত্যু করোনাতে হলো – ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তর হিসাব করছেন তারা।
আব্বার মৃত্যু অফিসিয়ালি করোনাতেই হয়েছে – এই নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। আব্বা যেহেতু বিস্তর সম্পত্তি আর মৃত্যুপূর্ব ব্যাপক প্রতিপত্তি রেখে গেছেন, তাই করোনা উপেক্ষা করে হাজার মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছিল। আর আত্মীয়স্বজন কোন দিক থেকে কোথায় একটু কিছু দাবি করে বসতে পারবেন – সেই আশায় করোনায় মৃত একজনের বাড়িতে নিশ্চিন্তে ঘুরেফিরে বেড়িয়েছেন। ‘আমরার কিছুই অইতো না, আমরারে করোনা ধরছে না, সচিব সাবে বিবেচক মানুষ আছিলেন, আমরারে অসুখ-বিসুখ দিয়া যাইতেন না’ – এই আলাপগুলো আমরা হরহামেশা শুনেছি। আমার দূরসম্পর্কের এক চাচা শেষমেশ দাবিই করে বসলেন, আব্বা হাসপাতালের অবহেলায় মারা গেছেন, করোনায় নয়। আমিও খুশিমনে সেসব শুনে আনন্দিত হলাম।
কিন্তু আমি জানি, আব্বা আসলে আমার জন্য মরেছেন।
আব্বা আমার জন্য মরেছেন শুনে যারা নড়েচড়ে বসতেছেন, তারা একটু মোঘল বাদশা বাবরের গল্পটা মনে করেন। বাবর তার ছেলেকে নিজের আয়ু দিয়ে গেছেন। আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন কিছু। নইলে করোনায় যে আমার লাংস ৬৬ শতাংশ নষ্ট হয়েছিল, সেই আমি ১৯ দিনের আইসিইউজীবন থেকে বের হয়ে শুনি, আব্বা হাসপাতালে ভর্তি। তাঁর ইনফেকশন রেট খুব হাই বলে আমার আর জীবিত আব্বাকে দেখা হলো না। তাঁকে একটু স্যুপ বানিয়ে দেওয়া হলো না। আব্বা আমার কাছ থেকে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। হাসিখুশি আব্বার মুখ হোয়াটসঅ্যাপে দেখে আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। রেমডিসিভির ঘোরে আমি শুধু আব্বার কথা শুনেছি। তিনি আমাকে বলছেন, ‘ওঠ বাচ্চা।’ ডাবল মাস্ক, মাথায় আইসিইউ টুপি আর নীলচে গাউনের ফাঁকে আব্বার মুখ আমি দেখতে পাইনি। ১৯ দিন পর আইসিইউ থেকে ফিরে যখন স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে ঢুকলাম, আব্বা সে-সময় হাসপাতালে। মোহিতকে আমি বলেছিলাম, আব্বাকে আইসিইউতে কেন ঢুকতে দিয়েছ? এ-কথায় সে আকাশ থেকে পড়েছিল। করোনায় 888sport appsে আটকাপড়া আমার নিউজিল্যান্ড প্রবাসী বড় ভাই আব্বাকে তো তালা দিয়ে আটকে রেখেছিলেন। আব্বা কখনোই আমাকে দেখতে আইসিইউতে আসেননি। ইনফ্যাক্ট আমার কোনো আত্মীয়, এমনকি আমার সন্তানের পিতাও আসেনি। আমার জন্য একটা লোক রেখে দেওয়া হয়েছিল। সে-ই আমার দেখভাল করত। আইসিইউয়ের সামনে বসে থাকত।
কিন্তু আব্বাকে আমি নিত্যই দেখতাম। আমার স্বামী ছেলে, ভাইয়া – এরা কেউই করোনাক্রান্ত ছাপোষা লেখক হতে চাওয়া এই আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন না, সে-বিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু আব্বাও যে কখনো আসেননি, তা আমি একেবারেই বিশ্বাস করিনি। আমি নিশ্চিত লুকিয়ে হলেও আব্বা আসতেন। আমার আইসিইউয়ের বেড নাম্বার ছিল ১৯। একটা অপারেশন থিয়েটারকে জরুরিভিত্তিতে আইসিইউতে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
১৮ নাম্বার বেডের মেয়েটাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে। অবশ্য এই ১৯ দিনে আমার চারপাশের অসংখ্য রোগী বদল হয়েছে। কাউকে কাউকে আমার খুব মনে আছে। মেয়েটা যেদিন মারা যায়, সেদিন তার স্বামী এসেছিল। খুব পাতলা একহারা গড়নের একটা কোমল পুরুষ। অতো কোমল হয়তো নয়, ওষুধের ঘোরে আমি ভুল দেখেছিলাম। লোকটা নার্সকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ক্যান আই কিস হার ফর দ্য লাস্ট টাইম?’ এমনসব প্রশ্নের উত্তরে কী বলতে হয় – এগুলো আমাদের ডাক্তার-নার্সদের শেখানো হয় না। ‘সংক্রমণ ছড়াবে, আপনি এখানে মাস্ক খুলবেন …’ – এসব আলাপ তুলে সবাই হা-রে-রে করে লোকটার দিকে ছুটে এলো। কমবয়সী আইসিইউ ইনচার্জ ছেলেটা রীতিমতো ধমক দিয়েই তাকে বের করে দিলো আইসিইউ থেকে। আহারে বেচারা, মেয়েটাকে নিশ্চয় কবরে নামানোর আগে চুমু দিয়েছিল। বেঁচে তো আছিই, আমার খুব ইচ্ছা, একদিন সেই আইসিইউটা ঘুরে আসার।
আমার বাঁ পাশের ২০ নম্বর বেডের রোগী ছয়বার বদলেছে। ছয়জনই মারা গেছেন। এর মধ্যে এক বৃদ্ধা এসেছিলেন। ‘আমার কিছু হয়নি, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও … বাড়ি নিয়ে যাও’ বলে সারাদিন চিৎকার করতেন। তাঁর কাছে সন্ধ্যাবেলা একটা মেয়ে এসে মিনিট বিশেক বসে থাকত। মেয়েটার চেহারা পর্যন্ত মনে আছে আমার – একহারা গড়ন, চোখদুটো খুব গভীর। আমি নিশ্চিত, সেই মেয়ের সঙ্গে কোনোদিন আমার আবার দেখা হয়ে যাবে। তখন তার কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব, ওই বৃদ্ধা আপনার কে ছিলেন? মেয়েটা সম্ভবত মাস্ক খুলত। তা না হলে এমন একটা চেহারা আমার চোখে কেন ভাসবে! কিন্তু আইসিইউতে তো মাস্ক খোলার অনুমতি নেই। আর সংক্রমণে তখন পৃথিবীটাই জর্জরিত। ২৬ বেডের এই আইসিইউতে প্রতিদিন একজন-দুজন মারা যেতেন। একদিন চোখের সামনে নয়জনকে মরে যেতে দেখলাম। একটু একটু করে আমি ঘোর ভেঙে উঠি আর দেখি সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একেকজনকে। কারো কারো কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ কানে যেত আমার। কেউ কাঁদত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। একটা কান্নার কথা স্পষ্ট মনে আছে। সেই কান্নার মধ্যে ছিল দুই শব্দ, ‘মা রে …!’
সেই সারি সারি লাশের মধ্যে আব্বা এলেন। তাঁর শরীরও গাউনে মোড়া। আব্বাকে আমি হাসি দিয়ে বললাম, ‘ভেন্টিলেশনের এই নল খুলে দিতে বলেন।’ শ্বাসনালিতে ভেন্টিলেশন টিউব দিলে কেউ কথা বলতে পারে না জানি। কিন্তু আব্বার হাত ধরে প্রতিদিনই আমি অনেক কথা বলেছি। আব্বা আমাকে খালি ডাকতেন, ‘ওঠ বেটা।’
আমাকে বেটা ডাকায় ভাইয়ার খুব রাগ ছিল আব্বার ওপর। সে সবসময় আব্বার একমাত্র বেটা হতে চেয়েছিল। আব্বা ভাইয়াকে নাম ধরে ডাকতেন। আর জ্ঞান হওয়া অবধি আমি বেটা ডাকটাই শুনতাম। আমার ভাইয়া বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছেলে, নামকরা ডাক্তার। বিদেশেও তার দারুণ নামডাক। অথচ আমার মতো টেনেটুনে এমএ পাশ করা একটা মেয়ে আমার সচিব বাপের কলিজার টুকরা ছিলাম। কেন ছিলাম? এখনো তা জানি না। ভাইয়া বোর্ড স্ট্যান্ড করার পর আব্বা দুই মণ মিষ্টি বিলিয়েছিলেন। আর আমি যখন ম্যাট্রিকে ৫১২ নম্বর পেয়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করলাম, রেজাল্ট শুনেই আব্বা তাঁর পিএসকে বললেন, আজ রাতেই দুটো নেপালের টিকেট বুকিং দাও।
আব্বা তখন ফরেন মিনিস্ট্রির
যুগ্ম-সচিব। রেজাল্টের আগের দিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পাশ করবি বেটা? আমি মাথা কাত করেছিলাম কেবল। পাশ করব কি না সে-বিষয়ে আমিও নিশ্চিত ছিলাম না, বরং খানিকটা সন্দিহানই ছিলাম। পরীক্ষার খাতাগুলোতে যে প্রায় তেমন কিছুই লিখিনি, তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে! সেবার ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল থেকে একমাত্র আমিই সেকেন্ড ডিভিশন পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিল অরিত্রি, ও ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার রেজাল্ট জানার পর সেই যে সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছিল, আর তাকে দেখিনি। অরিত্রি আর আমার ভাইয়া একই ক্যাটাগরির মানুষ। ভাইয়া সে-সময় লন্ডনে ডিডি করছিল, রয়েল স্কলারশিপ নিয়ে। আমার রেজাল্ট জেনে সে আমাকে একরকম ত্যাজ্য করে দিলো। কথা বলেনি বছরখানেক। আব্বার কল্যাণে সেবারও ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সুযোগ পেলাম। যত খারাপ ফল করি না কেন, সচিবের মেয়েকে তো আর বের করে দেওয়া যায় না।
রেজাল্টের দিনই লাজলজ্জা এবং সমস্ত প্রশ্ন থেকে বাঁচাতে আব্বা আমাকে নিয়ে নেপালে উড়াল দিলেন। সাতদিন নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরলাম আমরা। আম্মা যেহেতু ভাইয়ার দলের লোক, তাই আমি সেখানে বরাবরই গৌণ। তিনি নিজে ইন্টারমিডিয়েট পাশ ছিলেন বলেই হয়তো চিকিৎসা888sport apkে উচ্চতর ডিগ্রিধারী ছেলের কদর তাঁর কাছে খানিকটা বেশিই ছিল।
আব্বা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বেটা, এমন কানের কাছ দিয়ে পাশ করে তুই কী করতে চাস? তুই তো সারাদিন পড়িস, কিন্তু পরীক্ষায় কিছু লিখিস না কেন? আমি আব্বাকে আমার পড়ার রহস্য বললাম, বলতে পারলাম আমার ১৯ বছর বয়সে। তখন আমি অনার্সে ভর্তি হয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নম্বর আমার ছিল না। আব্বা তাঁর অর্থবলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পছন্দমতো ইংরেজি 888sport live footballে আমাকে ভর্তি করেছিলেন।
সেদিনই আব্বাকে বললাম, আমি কেবল গল্প, 888sport alternative link আর 888sport liveই পড়ে গেছি এতোদিন। আমি যত বই পড়েছি, অনেক 888sport live footballিকও অতো বই পড়েননি, আব্বা। আমার কথায় আব্বা সেই প্রথম খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। আমাকে দেওয়া তাঁর সব টাকা দিয়ে আমি যে বই কিনে দেউলিয়া হয়েছি, সেই রহস্য জানিয়ে দিয়েছিলাম তাঁকে। আমার খাটের নিচে, কাপড়ের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, চেস্ট ড্রয়ার – সব খুলে খুলে মেলে তিনি আমার বই দেখলেন। আলমারিভর্তি বই দেখে আব্বা মঈনুকে ডেকে বললেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার মোহিতকে ডাকতে। আমার ঘরজুড়ে একটা বুকশেলফ বানিয়ে দিতে তাকে ডেকেছিলেন আব্বা। তখনই মোহিতের সঙ্গে পরিচয়। আমার প্রথম, শেষ এবং বীতশ্রদ্ধ হওয়া প্রেম। একটি সন্তান আর আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে যাকে আমি গত ১৭ বছর ধরে সহ্য করে গেছি এবং এখনো যাচ্ছি।
হাসপাতালে আব্বা বলতেন, জানি মোহিতের জন্য তোর কোনো ভালোবাসা, 888sport apk download apk latest versionবোধ, প্রেম – কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবু একসঙ্গে থাকিস। ছেলেটা তোর কদর তো করে। আব্বাকে আমার কোনোদিন ডিম ভেঙে কুসুমটা দেখানো হলো না। সেমি-সেলিব্রেটি, লেখক-বউকে সামাজিক কারণেই মানুষ কদর করে। এটা তেমন আলাদা কিছু না।
করোনাঘেরা সেই ঘোরের একদিন আমার পাশের বেডে ১৭ বছরের এক ছেলে মারা গেল। আমার অর্ধচেতন মন কেবল এক মায়ের আহাজারি শুনছে। কেউ একজন বলেই যাচ্ছেন, মনুর মা শক্ত হও, মনুর মা …। নিশ্চয় ছেলেটার নাম মনোয়ার ছিল, বাবা-মা আদর করে মনু ডাকতো। ছেলেটার বয়স ছিল ১৭। আমার সাম্যর বয়সী। ছেলেটার বয়স যে ১৭ ছিল, সেটা ওর মায়ের কান্না থেকে জেনেছি। চিৎকার করে নোয়াখালীর ভাষায় কাঁদছিলেন ওর মা। সেই কান্নায় খুব সুললিত বিলাপ ছিল। ভালো কোনো মিউজিক ডিরেক্টর এই সুর শুনলে নির্ঘাত অস্কার পাওয়ার মতো গান বানিয়ে ফেলতেন। নিদেনপক্ষে আইফা বা গ্রামি অ্যাওয়ার্ড।
সেদিন রাতেই আব্বা এসেছিলেন। এসে খুব কষে ধমক দিলেন আমাকে, ‘বেটা ওঠ। এখনি উঠে পড়।’ টিনএজ একটা ছেলেকে একা ফেলে এই যে স্বার্থপরের মতো হাসপাতালের আইসিইউতে একলা পড়ে আছি – এটা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। আব্বাকে কী করে বোঝাই যে আমার ভেতরটা ক্ষয়ে গেছে অনেক আগেই। সন্তান-সংসার কিংবা আব্বা-আম্মা – এসব কেবলই মায়া। এখন মায়ার টানেই কেবল পড়ে আছি আমি। আমার আসলে জিপসি হওয়া উচিত ছিল। অথবা কোনো দ্বীপদেশের মেয়ে হওয়ার ভাগ্য হলে দারুণ হতো বিষয়টা। একের পর এক মাছ ধরার নৌকায় চেপে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতাম আমি। মনের কোণে থাকা নিজের এসব স্বপ্নের বহু বছর পর মোয়ানা নামে একটা সিনেমা দেখে বলে উঠেছিলাম, আরে, এই মেয়েটাই তো আমি হতে চেয়েছি! কিন্তু সচিব বাবার মেয়ে বলে যে আদবকেতা আর প্রটোকলের বেড়াজালে আমি বড় হয়েছি, মনের মধ্যে যে-ক্ষোভ চেপে রেখেছি, তাতে আমার অসম্ভব উদার বাবাকেও মাঝেমধ্যে অসহ্য মনে হতো। সাম্যর ভেতর কোনো সুর আমি বুনতে পারিনি। তাই ও বাপের নেওটা। মাকে কেবল ঘরে থাকা এক নিদারুণ অভিমানী মহিলা ভেবেই বড় হয়ে গেল ছেলেটা। আমিও তো কোনোদিন নিজেকে প্রকাশ করতে পারলাম না ছেলের কাছে।
করোনা থেকে যখন একটু একটু সেরে উঠতে লাগলাম, তখন আব্বা আসা বন্ধ করে দিলেন। আমার পাশের বেডে এলেন এক ভদ্রমহিলা। মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশ বুঝতে পেরেছি। তাঁর ছেলে অনেক লড়াই করে এই বড় হাসপাতালে মাকে ভর্তি করিয়েছে। দেখতাম, তাঁর মা প্রতিদিন ইশারায় তাঁকে টাকার কথা বলতেন। আইসিইউর এতো খরচ … উঠতে টাকা, বসতে টাকা – এসব কেমন করে মেটাবে ছেলে! ছেলেটা প্রায় সারাদিনই মায়ের বেডের কাছে বসে টুকটুক করে গল্প করত। ডাক্তার,
নার্স – সবাই খুব রাগারাগি করত এতে। তবে ছেলেটা এসবের তোয়াক্কা করত না। তার মা শুধু বিলের কথা বলত। আর সেসব একপাশে সরিয়ে রেখে ছেলেটা শুধু গল্প করত মায়ের সঙ্গে। একদিন ভাতভাজির কথা বলেছিল। আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছিল তখন। সে-সময়ও আমার ভেন্টিলেশন ট্র্যাক খোলেনি। তাই ছেলেটাকে বলতে পারিনি, আমাকে একদিন দিও। পাঁচদিনের মাথায় সেই ছেলের মা-ও মারা গেলেন। ডাক্তারদের বিধিনিষেধ, বকাঝকা উপেক্ষা করে মায়ের কপালে চুমু দিলো ছেলেটা।
আর বিড়বিড় করে কীসব বলতে লাগল … কেউ একজন এসে বিল প্রসেসিংয়ের জন্য তাড়া দিলো তাকে। কীভাবে সে বিল দিয়েছিল জানি না, আদৌ বিল দিতে পেরেছিল কি না, তা-ও জানতে পারিনি। তবে সেই ঘোরের মধ্যেই মনে পড়ে লাশটা সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ছিল আমার বিছানার পাশে …
ছেলেটা মনে হয় বিল আনতে গিয়েছিল, নাকি অন্য কোথাও উদাস হয়ে বসেছিল? জানাই হলো না গল্পগুলো।
আমাকে যেদিন আইসিইউ থেকে স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যায়, সেদিন চোখে আলো লাগছিল বলে সাদা চাদরটা দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছিলাম। অনেক লোক ছুটে এসেছিল – কোন বেডের, কখন মারা গেছি, বয়স কত, বেড একটা খালি হয়েছে শুনে অ্যাডমিনে সিটের জন্য ছুটল এক ছেলে। চোখ বন্ধ করে আমি সব শুনছিলাম। একজন ইন্নালিল্লাহ পড়লেন। একজন কী একটা দোয়া পড়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমাকে বহনকারী আয়া-বুয়ারা এতোই অবাক হয়েছিলেন যে ভাষাই হারিয়ে ফেলেছিলেন প্রায়। ক্লিনিংয়ের এক খালা বলেছিলেন, মরি নাই আমি ঘুমাচ্ছি মুখ ঢেকে …
আব্বাকেও নিশ্চয় এমনভাবেই বের করেছে। মুখ ঢেকে পুরো প্যাকেজিং শেষ করে। মৃত্যুর পর যে-কোনো মানুষ কেবল একটা লাশ হয়ে যায়। একটা মৃতদেহ মাত্র। আমার অমন ডাকসাইটে সচিব বাবারও কোনো নাম ছিল না, তিনি কেবল লাশ হয়ে গিয়েছিলেন।
আব্বার শেষ সময়টা কেমন ছিল, আমার জন্য যেমন লোক রাখা হয়েছিল, আব্বার জন্যও অবশ্যই তেমন একজন ছিল। এখন আমি সেই লোকের কথা মনেই করতে পারি না। অনেক কিছু মনে নেই আমার। তখন শুধু আব্বাকে দেখতাম চারপাশে। আব্বাও নিশ্চয় আমাকে দেখতেন। আব্বা এই অবুঝ আমাকে সমাজ-সংসারে মানিয়ে নেওয়ার বুঝ দিতেন নিশ্চয়। আব্বার কি ভেন্টিলেশন ট্র্যাক লাগানো হয়েছিল? শেষদিকে মঈনু কয়েকবার গিয়েছিল শুনেছি। আমাকেও তখন সে দেখতে যেত। আর বলত, তুমি সুস্থ হয়া চাচাজিরে নিয়া বাসায় ফিরবা।
আমি বাসায় ফেরার ১২ দিন পর আব্বা চলে গেলেন। জীবনের কত জমানো রাগ-অভিমান … না-বলা, চেপে রাখা গল্পগুলো তাঁকে আর বলাই হলো না। হাসপাতালের ১৮ নম্বর বেডের সেই ছেলেটা তার মায়ের বিল মেটাতে পারলো কি না, সেই গল্পেই আমার সব গল্প থেমে গেছে। তাই আর কিছুই লেখা হলো না …


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.