সমাজের আবর্তে

এ-গলি সে-গলি ঘুরিয়ে কামালকে নিয়ে বিধান গেল বিরাট একটা দোতলা বাড়ির সামনে। ওপরে-নিচে কটা ঘর এক নিমেষে গোনা যায় না। একরাশ ভয় এসে জুটল কামালের মনে। বুকটা দুরুদুরু করে কেঁপে উঠল। এমন জায়গায় সে এসে পড়েছে, এখানে যদি হাড়কাঠে ফেলে কাউকে বলি দেয়, তাহলে কেউ টেরই পাবে না। লোকজন যে একেবারে নেই, তা নয়, দু-চারজন লোক আসছে-যাচ্ছে। অলিতে-গলিতে দু-চার-ছটা মেয়ে বুকের কাপড় আলগা করে পথের লোকজনের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। কামাল তা লক্ষ করেছে। এতোদিন কামাল কোচবিহার শহরে যাতায়াত করছে, ভুলেও এ-পথে কোনোদিন পা বাড়ায়নি। তাহলে কোন কুক্ষণে বিধানের কথা বিশ্বাস করে এ-পথে পা বাড়াল?

বিধান বলল, আরে কী এতো চিন্তাভাবনা করছিস? এখানে কোনো ভয় নেই তোর। কেউ তোকে হাড়িকাঠে ফেলে বলি দেবে না। আসল লোকের কাছে তোকে নিয়ে এসেছি। চাকরি তোর একটা হবেই। একটু ধরে বসবি, তাহলেই ব্যাস। বিন্তি কাবার।

– তুই আমার সঙ্গে যাবি না? ভীতকণ্ঠে কামাল জিজ্ঞেস করল।

– ওরে বাব্বা! বলিস কি? চমকে ওঠার ভঙ্গিতে বিধান বলল – আমি ওখানে গেলে আর রক্ষে থাকবে না। একেবারে চিবিয়ে খাবে আমার মাথা। তার চেয়ে তুই একাই যা। ভুলেও আমার নামটা যেন বলিস না। আমার ওপরে একেবারে খড়্গহস্ত হয়ে আছে। তার ওপরে যদি শোনে তুই আমার পার্টনার, তাহলে আর রক্ষে নেই। এখানে ভয়ের কিছু নেই। মিস্টার রায় লোক হিসেবে খুব ভালো। হৃদয়বান। কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলবি, আপনার গুণগান চ্যাটার্জি সাহেবের কাছে অনেক শুনেছি।

– চ্যাটার্জি সাহেব আবার কে?

– তার ঠিকুজি জেনে তোর কোনো লাভ নেই। যা বলছি মন দিয়ে শোন। এখন তুই গিয়ে সোজা দোতলায় উঠে যাবি। গেলে দেখতে পাবি রুমের বাইরে সব নাম্বার দেওয়া আছে। সোজা গিয়ে ঢুকে পড়বি দশ নাম্বার রুমে। 

কামালের সঙ্গে বিধানের পরিচয় খুব একটা বেশিদিনের নয়। মাসদুই আগে শিক্ষকতার জন্য একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল কোচবিহার শহরে। সেখানেই পরিচয়। কথাবার্তা। হৃদ্যতা। ভালোবাসা। ক্রমে বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা পড়েছে দুজনে।

– আমি সামনের চা-দোকানে আছি – বলে বিধান ঢংঢং করে চলে গেল। কামাল নিজের জামাকাপড়  দু-হাত দিয়ে ঝেড়ে নিল। শহরের ধুলোবালি আঠার মতো জাপটে ছিল জামাকাপড়ে। তারপর পকেট থেকে চিরুনিটা বের করে ভালো করে মাথাটা আঁচড়ে নিল। হাজার হোক ভদ্রলোকের সামনে যাচ্ছে বলে কথা। তাকে যদি চেহারা দেখে, পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে ‘গেট আউট’ করে দেয়, সেই ভয়ে নিজেকে একটু পরিপাটি করে নিল কামাল; কিন্তু পরিপাটি করে নিলে কি হবে? তার সেই শতছিদ্র ছেঁড়া গেঞ্জি, ধার করে আনা পাতলা পাঞ্জাবির ভেতর থেকে মুখ বের করে জানান দিচ্ছিল। ধুতির মাঝখানের ছেঁড়াটা কোনোরকমে সামলে নিল কামাল। তারপর গটগট করে উঠে গেল দোতলায়।

দোতলায় একেবারে সিঁড়ির ধারে দশ নাম্বার রুম। কামালের বুক তখন ঢিপ্ ঢিপ্ করছে। কী বলতে কী বলে ফেলবে মি. চ্যাটার্জির কাছে – সেই ভয়ে। তারপর অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে কোনোমতে দরজায় লাগানো কলিংবেলের সুইচটা চাপ দিলো। খানিক পরে দরজাটা খুলে গেল। দোরের ফাঁকে এক 888sport promo codeমূর্তি দেখে সাপ দেখার মতো সাত হাত পিছিয়ে এলো কামাল। কোথায় মি. চ্যাটার্জি? এ তো মর্তের এক ঊর্বশী। হ্যাঁ, ঊর্বশীই বটে। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং। পটোলচেরা যুগল চোখ। প্রতিমার মতো মুখের বাঁধন। পরনে নীলাভ শিফন শাড়ি। সঙ্গে ম্যাচ করা ব্লাউজ। অপূর্ব সুন্দরী লাগল ঊর্বশীকে। তার লিপস্টিক লাগান ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে নিঃশব্দে ঝরে পড়ল মিষ্টি হাসি।

তাহলে বিধান কি তার সঙ্গে বিট্রে করল? দশটা টাকা পাওয়ার আশায়? একরাশ ঘৃণা এসে জড়ো হলো কামালের মনে। এভাবে অসহায় একটা ছেলেকে ঠকিয়ে তার কি লাভ হলো? কতটুকু মুনাফা হলো তার? পরক্ষণে মনে হলো, দুনিয়াটা তো এরকমই। না হলে পলাশ মিত্তির, সুজনবাবু, নিরোধ বাড়ুজ্জের মতো স্বনামধন্য লোক কীভাবে তাকে ঠকাল? সেখানে বিধান তো ভারী দশ টাকা নিয়েছে। হয়তো এভাবেই তার সংসার চালাতে হয়। ঘরে তার বিধবা মা, চার বোন। তাদের মুখে আহার জোগাবে কীভাবে? বিএ পাশ করেছে। কিন্তু চাকরির মুখ দেখতে পায়নি। অথচ জীবন থেকে আরো দশটা বছর গড়িয়ে গেল। এখন সে কী করবে? ওর একমাত্র পথ তো এই। কিন্তু পলাশ মিত্তিরের কিসের অভাব? সুচন্দন রায়ের তো দুশো বিঘে সম্পত্তি। নীরদ ব্যানার্জি তো নামকরা মন্ত্রী। তাঁরা কি করে ঠকাতে পারলে এই নিঃসম্বল কামাল চৌধুরীকে?

না না, বিধানদা তাকে নিশ্চয়ই ঠকাইনি। কোথাও ভুল হচ্ছে। ইনি হয়তো মিস্টার রায়ের স্ত্রী হবেন; কিন্তু কই, ঊর্বশীর কুন্তল কালো বেণীর মাঝে তো সিঁদুরের সড়ক নেই। তবে কি কোনো বোন-টোন হবে?

দুজনেই বাকহীন। নির্বাক, নিরুত্তর। কোনো প্রশ্ন করার সাহস হচ্ছে না দুজনেরই। তাই নির্বিকার, নিষ্পৃহ।

কামাল আরেকবার চোখ তুলে তাকাল ঊর্বশীর দিকে। ডাগর ডাগর দু-চোখে সে তাকিয়ে আছে কামালের দিকে। কামাল যেন তার কতদিনের চেনাজানা। কতদিনের পরিচিত। কামালের দিকে ওরকম করে কেউ কখনো তাকিয়েছে বলে কামালের মনে পড়ে না। তাই মুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ঊর্বশীর দিকে। ঊর্বশীর সমস্ত দেহ যেন আপন সৌন্দর্য বহন করে চলেছে; কিন্তু এই সুন্দর মুখে বেদনার ছাপ কেন? ক্লান্তির ভারে কেন সে জর্জরিত? চোখদুটি যেন তার ছলছল করছে। এমন অসীম সৌন্দর্যের অধিকারী ঊর্বশীর কি এ-রূপ মানায়? 

অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে একসময় কামাল বলল, আপনি কি মিস্টার রায়ের কেউ হন?

– না কামালদা! আমি মিস্টার রায়ের কেউ নই।

অপরিচিত মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনে কেমন যেন ভড়কে গেল কামাল। এরকম মিষ্টি-মধুর গলা কামালের পরিচিত বলেই মনে হলো; কিন্তু মেয়েটা কে – কিছুতেই মনে করে উঠতে পারল না। তাই সবিস্ময়ে বলল, আপনি আমাকে চেনেন দেখছি। কিন্তু আমি তো আপনাকে …।

– চিনি না। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মেয়েটি বলল – অথচ ছোটবেলা থেকেই তুমি আমাকে ভালোভাবে চিনতে।

ঠাস্ করে মাস্টারমশাই চড় মারলে, ছেলেবেলায় যেমন রাজ্যপালের নাম আচম্বিতে মনে পড়ত, ঠিক সেই মুহূর্তে কামালের মনে পড়ে গেল সব।

– তবে কি তুমি সেই মিনা? মানে মিনা চৌধুরী?

মুখে কোনো জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে মুখটা ঘুরিয়ে মৃদু হেসে শুধু সম্মতি জ্ঞাপন করল। তারপর দরজা ছেড়ে একটু সরে গিয়ে বলল – কামালদা! একটু ভেতরে এসে বসো। তারপর দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে বুকটা হালকা করে বলল – তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

দ্বিরুক্তি না করে কামাল ঘরে ঢুকল। মিনা সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলো। না কোনো সংশয়, কোনো ভয়, এতোটুকুও লাগেনি কামালের। মিনা তার পড়শী, আত্মীয়, গ্রামবাসী। সে কোনো অঘটন ঘটাবে না – এ-বিশ্বাস আছে কামালের। আর বিশ্বাস না-ই যদি থাকত, তাহলে এতো বড় দুনিয়াটা কি হাওয়ায় চলত?

দরজাটা বন্ধ করতেই ঘরের ভেতরটা কেমন হালকা আঁধারে ভরে গেল। কেমন যেন একটা নৈরাশ্য ও বিষাদের ভাব বিরাজ করছিল সেখানে। দুজনেই চুপচাপ। নীরব। কথাহীন।

অপরিচিত ঘরের এদিক-ওদিক গোয়েন্দাদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল কামাল। ঘরের একপাশের দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে আধুনিক ডিজাইনের খাট। সেই খাটে গদি, তোশকের ওপর সুন্দর রঙিন চাদর বিছানো। অন্য পাশে বড় কাচ লাগানো ড্রেসিং টেবিল। তাতে স্নো, পাউডার, লিপস্টিক ইত্যাদি সাজসজ্জার জিনিস থরে থরে সাজান। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ঝাড়বাতি ঝুলছে ছাদের আঙটায়। টেবিলের সামনে রাখা আছে দুটো বসার চেয়ার। আলনায় ঝোলানো আছে নানান রকমের দামি কাপড়চোপড়, শাড়ি, ব্লাউজ। ঘরের চারদিকে লটকানো আছে কয়েকটা নগ্ন 888sport promo codeর মূর্তি। মোটামুটি বেশ সুন্দর পরিপাটি করে ঘরটা সাজানো। আয়নার ওপর চোখ রাখল কামাল। তার সমস্ত শরীরের প্রতিফলন দেখতে পেল সেখানে। মিনা সরে এলো কাছে। তারও প্রতিফলন পড়েছে আয়নাতে। হয়তো তারই প্রতিফলন পড়েছে দুজনের চোখে-মুখে। মনের অন্দরে। ভেবে অবাক হয় কামাল। বিস্ময় বোধ করে। সত্যিই কি মেয়েটা তার গ্রামবাসী সতীশ চৌধুরীর কন্যা? মিনাদের আগেকার জীবন আর এ-জীবনের মধ্যে কত না বৈসাদৃশ্য! এই কয়েক বছরে কতটা না তারতম্য ঘটেছে মিনাদের জীবনে। যে-মিনা দু-বেলা দু-মুঠো অন্নসংস্থানের জন্য বাবার সঙ্গে মাঠে খাটত, পরের রেশন তুলে এনে দিত, গোবর কুড়িয়ে  ঘুঁটে করে বেচত, ছাগুন জাল দিয়ে খাল-বিল থেকে মাছ ধরে  বিক্রি করত বাজার – সেই মিনার আজ এতো পরিবর্তন! শুধু দৈহিক লাবণ্য নয়, সেইসঙ্গে সাজসজ্জায়ও। গলায় ময়নামতির হার। হাতে রুলি। কানে দুল। সব বানিয়েছে মিনা। গ্রামের চেয়ে এখানে হাজারগুণ সুখে আছে সে। সেখানে দু-বেলা দু-মুঠো আহারের জন্য সংগ্রাম করতে হতো। এখন তো সেটা হয় না। বোধহয় চাকরি-বাকরি করে। তাই এতো দম্ভ। এতো দেমাগ। কিন্তু এতো সৌভাগ্যের মধ্যে থেকেও মিনা তাকে দেখে কাঁদছিল কেন? তার তো কাঁদার কোনো কারণ নেই। তবে কি সে আসাতে মিনা অসন্তুষ্ট! মিনা খাটের ওপর কামালকে বসতে বলল। কামাল বসল বিছানায়। মিনা এসে কামালের কাছে বসল। জিজ্ঞেস করল – তা কামালদা! এদিকে কী মনে করে?

– তার আগে বলো, তোমরা গাঁ ছেড়ে রাতের বেলায় হুট করে চলে এলে কেন? এখানে বুঝি তোমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন আছে? তারা খবর দিয়েছিল নিশ্চয়ই। না হলে এ-বাজারে চাকরিটা কি সহজে পাও! কিন্তু একথা থাক। তোমার বাবা এখন কোথায়? তাঁকে তো দেখছি না। বাজারে গেছেন বোধহয়! একনাগাড়ে আরো অনেক আকাক্সিক্ষত কথা কামাল জিজ্ঞাসা করল মিনাকে।

মিনার ঠোঁটে মৃদু হাসি। সে হাসতে হাসতে বলল – তুমি সেই আগের মতোই আছ কামালদা! এতটুকু পরিবর্তন হয়নি তোমার মধ্যে। সেই একইরকম অনেক কথা। বাচন ভঙ্গি। কিন্তু জানো কামালদা! আমি অনেক বদলে গেছি। অনেক পালটে গেছি। সুধার লোভে অনেক সমুদ্র মন্থন করে বিষ খুঁজে পেয়েছি। আর বাঁচার তাগিদে তা আকণ্ঠ পান করে চলেছি।

কামাল বুঝতে পারল না মিনার তাত্ত্বিক কথাবার্তা। না বুঝেও মাথা নাড়ল। সে-সময় হঠাৎ মিনা জিজ্ঞেস করে বসল, আচ্ছা কামালদা, আমি আর আমার বাবা যেদিন গাঁ ছেড়ে চলে এলাম, সেদিন আমাদের কেউ খোঁজ করেছিল?

– না তেমন কেউ খোঁজখবর করেনি। তবে তোমাদের পালিয়ে আসার খবর রটিয়ে দিয়েছিল তোমার মা।

– কী বলে বেড়িয়েছিল আমার মা? কী রটনা করেছিল আমার নামে? হঠাৎ অগ্নিমূর্তি ধারণ করল মিনা।

– সে অনেক কথা। আমার তেমন মনে নেই। মা-মেয়ের মধ্যে পরবর্তীকালে বিপদের আশঙ্কা বুঝে ইচ্ছে করে কথাটা চেপে গেল কামাল।

কামালের ভাবসাব দেখে মিনা বুঝে গেল, ইচ্ছে করে কামালদা কিছু বলতে চাইছে না। তাই বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে সে বলল – না কামালদা! চেপে গেলে চলবে না। তোমাকে বলতেই হবে।

– তুমি কিন্তু ভীষণ একগুঁয়ে মিনা! সে-কথাটা এখন বলে কী হবে? এতে তুমি মনে দুঃখ পাবে। এছাড়া আর কোনো লাভ হবে না তোমার।

– থাক তোমাকে আর বলতে হবে না। অভিমানে মুখ ঘোরায় মিনা।

বাধ্য হয়ে কামাল বলল, তোমরা যে-রাতে বাড়ি ছেড়ে চলে এলে, পরদিন সকালে তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে তিনি বললেন – জানো বাবা! আমার মেয়েটা বাড়ি থেকে পালিয়েছে। একশবার ওর বাবাকে নিষেধ করলাম, মেয়েকে তোমার পাশ দিতে পাঠিও না। দেশের হালচাল খারাপ। চাকরির বাজার মন্দা। শুনলে না আমার কথা। বললে, আইএ পাশ করলে চাকরি পাবে। আমাদের সংসারে দুঃখ আর থাকবে না। দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাব। তাই পাশ দিতে মেয়েকে স্কুলে পাঠালে। বয়সের বশে মেয়ের আমার মন টলে গেল এক মোচনমান ছোঁড়ার সঙ্গে। মেয়ে বায়না ধরলে, হয় বিয়ে দাও, না হয় বিষ খাব। মোচনমান ছেলের  সঙ্গে  বিয়ে  দিলে  জাতবংশ, মান-মর্যাদা কি আর থাকবে? তাই মেয়েকে আমরা ঘরে তালা দিয়ে রেখে দিলাম। তারপর যা হওয়ার হলো। মেয়ে আমার কাটারি দিয়ে বেড়া কেটে পালাল। আর ওর বাবা যে কোথায় গেল কে জানে?

– মিথ্যে মিথ্যে, সব মিথ্যে

কথা। হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল মিনা। কামালদা! এসব মিথ্যে কথা। আমার মা দায় এড়াতে এসব কথা বলেছে। মা আমার শত্রু। চিরকালের শত্রু।

কামাল হতভম্বের মতো তাকিয়েছিল মিনার দিকে। রাগে-অভিমানে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে মিনার। নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হাপরের মতো ওঠানামা করছে তার বুক। রংচঙে ঠোঁটে একবার সজোরে হাত বুলিয়ে নিয়ে মিনা বলল, ওই গুণবতী সৎমা আমাকে এই পথে নামতে বাধ্য করেছে। ওর জ্বালায় আমার এই অবস্থা।

কামাল কিছু বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, তোমার সৎমায়ের জন্য তুমি গাঁ ছেড়েছিলে সেদিন?

রুষ্ট বাঘিনীর মতো হুংকার দিয়ে মিনা বলল, হ্যাঁ  কামালদা। মায়ের জন্য আমি বাধ্য হয়েছিলাম গাঁ ছাড়তে। কারণ পিতম্বর রায়ের কথায় মজেছিল আমার সৎমা।

– আমাদের গ্রামের প্রধান পিতম্বর রায়ের কথা বলছ তো? কামাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মিনার দিকে চেয়ে বলল, তাকে তো সেদিন দুর্নীতিবাজ, ভেজালকারী বলে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল।

– তা নিয়ে যাবে না! ভগবান কি চোখ বুজে সব সহ্য করবে? ওর মতো পাপী লোকেদের জন্য তো আমাদের দেশে এতো দুর্ভোগ। এতো অশান্তি। এতো হাহাকার। পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে, ঠিক করেছে। কথাটা শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।

– কিন্তু মিনা! টাকা-পয়সা দিয়ে পিতম্বর রায় পরদিন জামিনে বের হয়ে এসেছিল। গাঁয়ের লোকেদের ওপর এখনো অত্যাচার-অবিচার চালাচ্ছে।

– কী আর করবে কামালদা? এ-দুনিয়াটা চলে টাকার জোরে‌। সব মানুষই টাকার বশ। টাকার জোরে ওরা জেল থেকে খালাস পাবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? ওই টাকার জোরে একদিন পিতম্বর রায় আমার বাবার মাথা কিনে নিয়েছিল। আমার মায়ের তখন ভীষণ অসুখ। বাড়িটা বন্ধক দিয়ে বাবা পিতম্বরের কাছ থেকে দুশো টাকা ধার নিল। আর কপালটা আমাদের এমনই, টাকাটাও গেল, সেই সঙ্গে মাও চলে গেল। মাঝপথে বাবাকে এক মাস বেকার খাটিয়ে নিল পিতম্বর রায়। তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস ছিল না কোনো মানুষের। তাই তার এতো আধিপত্য। এতো বেপরোয়া ভাব। টাকা ছড়ালেই সবাই তার দরবারে হাজির হতো। তারা কোনো বিচার-বিবেচনা না করে ধরে নিয়ে যেত নিরপরাধ লোকজনকে। তাদের মারত, আটকে রাখত জেলে। তাই ভয়ে গ্রামের একটা মানুষও তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পেত না।

এই অবস্থায় বাবা ঠিক করেছিল, আমাকে নিয়ে কোথাও চলে আসবে। কিন্তু তাও আর হলো না। পিতম্বর রায় একদিন বাড়িতে এসে বাবাকে বোঝাল – তোর বউ তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে। এখন তো ঘরসংসার বলে কিছু নেই তোর। একেবারে নীড়হারা পাখি। ছন্নছাড়া জীবন; কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? আর কতদিন জোয়াল টানাবি ওই ছোট্ট মেয়েটাকে দিয়ে? ওর তো পড়াশোনা আছে। একটা ভবিষ্যৎ আছে। তার চেয়ে আমি বলি কি, তুই আমাদের কেকাকে বিয়ে কর। বিয়ে করলে তোর ঘরদোর সব আমি ফিরিয়ে দেব। বরপণ হিসেবে দাদাও একটা মোটা অঙ্কের টাকা দেবে। তোর আর অভাব বলে কিছু থাকবে না। সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরসংসার করতে পারবি। ভেবে দেখ ব্যাপারটা।

বাবা বিয়ে করতে রাজি ছিল না। আমি বাবাকে বোঝালাম। সংসারে একটু সুখের আশায় বাবাকে রাজি করালাম। বাবার বিয়ে হলো। বাড়িতে এলো সৎমা। কদিন যেতে না যেতেই আমরা বুঝতে পারলাম, একটু সুখের অন্বেষণে আমরা না বুঝে কালসাপ নিয়ে এসেছি বাড়িতে। সংসারের ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করে বেড়াত মা। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার নামে মিথ্যে বদনাম রটিয়ে দিলো সৎমা – স্কুলে যাওয়ার নাম করে আমি নাকি টাকা-পয়সার জন্য শহর-নগর করে বেড়াই। রাতবিরাতে বাড়ি ফিরি। এমনি আরো অনেক কিছু। পাড়াপড়শীরা সকলে সাক্ষী দিলো আমার বিপক্ষে। গ্রাম পঞ্চায়েতের বিচারে আমার দোষ সাব্যস্ত হলো। লোকে আমাদের একঘরে করে রাখল। আমরা ঠিক করলাম, এ-গাঁয়ে আর থাকব না। মামার বাড়ির কাছে একটা জায়গা নিয়ে কুঁড়েঘর বেঁধে থাকব। তবুও আর এখানে নয়। এসব ব্যাপারে মাকে ঘুণাক্ষরে কিছু না জানিয়ে বাবা আমাদের ভিটেবাড়িটা বেচে দিলো সোনা দাসের কাছে। গ্রাম ছাড়ার আগে আমার বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে ফেলল বাবা। সোনার গহনাও গড়তে দিলো; কিন্তু সে-বিয়ে আর হলো না।

– হলো না মানে? কামাল আগ্রহের সঙ্গে জানতে  চাইল – তুমি কি সেই ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হওনি?

– না কামালদা। আমি রাজি ছিলাম। ঘরসংসারে সুবিধা-অসুবিধা, সুখ-দুঃখের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলাম; কিন্তু পিতম্বর রায় বোধহয় আমার এই বিয়েতে রাজি ছিল না। কোথা থেকে যে খবর পেয়েছিল কে জানে? ঘুণাক্ষরে আমরা তা উপলব্ধি করতে পারিনি। বুঝতে পারলাম আমার বিয়ের রাতে। বিয়ের দিন সন্ধ্যাবেলায় আমার বাবা সোনার দোকান থেকে আমার জন্য গড়া গয়নাগুলো নিয়ে আসছিল। কিন্তু পথে পিতম্বর রায়ের গুণ্ডারা বাবার হাত থেকে সোনার জিনিসগুলো ছিনিয়ে নিল। বাবা এসে কেঁদে পড়ল বরের বাপের পায়ে; কিন্তু কাজ কিছু হলো না। বরের বাবা ভীষণরকম অমানুষ। রগচটা। টাকা-পয়সা ছাড়া অন্য কিছু চেনে না। মানুষকে মানুষ বলে ভাবে না।

বাবাকে তাই সরাসরি বলল, আগে তিন ভরি সোনা, চার হাজার টাকা দাও, তবে এই বিয়ে হবে; কিন্তু টাকা কোথায় পাবে বাবা? তাই বর নিয়ে চলে গেল বরের বাবা। বাবা আকুল হয়ে পিতম্বরের পায়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ল। পিতম্বর আমাদের ঘরের দাওয়ায় তখন বসে ছিল। তাকে করজোড়ে বিনীতভাবে বাবা বলল, আমাকে এই বিপদ থেকে তুমি রক্ষা করো প্রধান সাহেব।

তুমি রক্ষা না করলে আমরা মাঠে মারা যাব।

পিতম্বর  বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আরে সতীশ! অতো কিছু ভাবিসনে।

তোর মেয়েকে আমি রক্ষা করব। ওকে ঘরের রানি করে আমি বাড়িতে নিয়ে যাব। এখন তুই বল, তুই রাজি আছিস কি না?

মা বলল – দাও না; কাকা যখন বিয়ে করতে চাইছে, তখন তো ভালোই হলো। মিনাকে কাকার হাতে তুলে দিলে আমরাও একটু সুখে-শান্তিতে থাকতে পারা। আর কাকা যখন বলেছে, দু-বিঘে…।

– চুপ কর হারামজাদি! বাবা মাকে ধমক দিয়ে বলল, মিনাকে আমি গলা টিপে মেরে ফেলব। তবুও তোর কাকার সঙ্গে আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দেব না।  

বাবা ও মায়ের মধ্যে যখন এই বাকবিতণ্ডা চলছিল, তখন আমি ঘরের ভেতরে কনের সাজে চোখের জল ফেলছিলাম, আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

ঠিক সে-সময় পিতম্বর রায় বাবাকে উদ্দেশ করে বলল, তোর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দিবি কি না, তোর মেয়ে পাঁচ-দশটা বাড়িতে গিয়ে গতর ভাঙিয়ে খাবে কি না, সেসব একটু চিন্তাভাবনা করে দেখ। আমাকে না হয় কদিন পরে জানাস।

এই অশালীন, অযাচিত কথা সহ্য হলো না বাবার। চিৎকার করে বাবা বলে উঠল, বাড়ি থেকে এখুনি বেরিয়ে যা, শালা হারামি। না হলে তোকে আমি খুন করে ফেলব। তোর হাতে মেয়েকে দেওয়ার চাইতে ওর গলায় পা তুলে দিয়ে মারা অনেক ভালো। তবু তোর মতো চোরের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দেব না। তুই একটা সমাজবিরোধী। হাজার হাজার মণ চাল, সরষের তেল, চিনি, মজুদ করে রাখিস। কালোবাজারি করিস। টাকার জোরে জেল থেকে বেরিয়ে আসিস। তোর সঙ্গে আমার মেয়েকে কখনোই বিয়ে দেব না। এটা আমার সাফ কথা। তুই এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। অনেক সর্বনাশ করেছিস আমার। না হলে এখানেই তোকে খুন করে ফেলব।

আমি আর ঘরে ভেতর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারলাম না। চোখদুটো মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে পিতম্বর রায়ের চোখে চোখ রেখে বললাম, এসো না মিনসে! তোমার সঙ্গেই আজই বিয়ের পিঁড়িতে বসব আমি। 

পিতম্বর রায় ভাবল, এ-বিয়েতে আমি রাজি আছি। তাই সে উঠোন থেকে ঘরের দাওয়াতে উঠছিল। সে-সময় দিলাম এক ঠেলা। পিতম্বর রায় গড়িয়ে পড়ে গেল উঠানে।

এরই মধ্যে গোলমাল শুনে পাড়ার লোকজন সব জড়ো হলো আমাদের বাড়িতে। তার কিছু সাগরেদ তাকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করাল। পিতম্বর রায় তার দু-হাত দিয়ে নিজের জামাকাপড় ঝেড়ে নিয়ে রাঙাচোখে হুংকার দিয়ে বলল, এর ফল তোদের ভুগতে হবে। একথা বলেই সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে হনহন করে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।

গ্রামের লোকজন বলল, বড় ভুল করলে সতীশভাই! পিতম্বরের সঙ্গে তোমাদের এই ব্যবহার করা উচিত হয়নি। পিতম্বর লোক ভালো না। ওর হাতে প্রশাসন আছে। টাকা আছে। ও তোমাদের ওপর প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না।

সেদিন রাতে বাবা আর আমি অনেক ভেবেছি। এরা সবাই স্বার্থপর। এরা সবাই ভীতু। না হলে সামান্য একজন লোককে এরা এতো ভয় করে চলে? সবাই মিলে একজন লোককে শায়েস্তা করার ক্ষমতা পর্যন্ত রাখে না। মুখে এই করব, সেই করব; কিন্তু কার্যত কিছুই করতে পারে না। এটাই তো এখনকার সমাজের নিয়ম।

কামাল বিছানায় বসে তন্ময় হয়ে শুনছিল মিনার জীবনকথা। মিনার অভিজ্ঞতার কথা। এ কোনো রূপকথার গল্প নয়, বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ কথা, যার মূল্য অসীম। বড় হৃদয়বিদারক।

সেই ঘোর কাটিয়ে একসময় মিনা বলল, তারপর কলকাতার জীবনকাহিনি আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না। আর কোনো দাদার সামনে তার বোন সেসব কথা বলতে পারবে না। তবুও বলছি, কলকাতায় এসে রোজগারের অনেক চেষ্টা করেছি। কত রকম চাকরি পেয়েছি। বাবুদের বাড়িতে কাজ করেছি। যারা কাজ দিয়েছে, তারা কী চেয়েছে, কী রকম জোর করেছে, কীভাবে আমি পালিয়ে বেঁচেছি, তা ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না। তারপর অনেক সমুদ্র মন্থন করে যখন সুধার সন্ধান পেলাম না, তখন বাধ্য হয়ে বিষপান করছি। একথা বলে হু-হু করে কাঁদতে লাগল মিনা। কামাল তাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। আর ঠিক সেসময় হঠাৎ ঘরের কলিংবেলটা বেজে উঠল। সম্বিত ফিরে পেল দুজনেই। মিনা উঠে দাঁড়াল। স্বগতোক্তি করে বলল, মাগিটা আবার জ্বালাতে এসেছে।

কামাল জিজ্ঞেস করল, কে? কে এসেছে?

– আমাদের মাসি এসেছে। যিনি এই পতিতালয়ের মালকিন। কথাটা বলেই মিনা টেবিলের কাছে গেল। আঁচলের চাবি দিয়ে ড্রয়ারটা খুলল। দুটো পাঁচ টাকার নোট বের করে সদর দরজাটা একটু ফাঁক করল। মাসি উঁকি মেরে দেখল কামালকে। মিনার হাত থেকে ছোঁ মেরে দশ টাকা নিয়ে বলল, ভালো একটা দামি নাগর জোগাড় করেছিস দেখছি।  

এ-কথা বলে মিনার পাতানো মাসি চলে গেল। মিনা ফের দরজায় খিল দিতে যাচ্ছিল। কামাল গর্জে উঠল, বন্ধ করো না। আমি বেরিয়ে যাব।

মিনা অনুরোধের সুরে বলল, একটু বসো না কামালদা! খানিকটা পরে না হয় যেও।

– না, আমি আর এক মুহূর্ত এখানে বসব না। আগে যদি জানতাম এটা একটা বেশ্যালয়, তাহলে এ-পথে কোনোদিন পা বাড়াতাম না। আর তোমার মতো একটা ভদ্র পরিবারের মেয়ে যে বারবণিতা, একথা ভাবতেও আমার অবাক লাগে। আমার ঘৃণা হয়। তোমার মতো মেয়ের মুখ দেখাও পাপ।

কামালের কথা শুনে হো-হো করে হেসে উঠল মিনা। সেই হাসির উচ্ছল স্রোতে কামালের বলিষ্ঠ বক্তব্যের বাঁধ ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।

– আমি বেশ্যা, বারবণিতা, মন্দা, অসতী, অপবিত্র! কিন্তু হিরের টুকরো কামালদা! তুমি এই অন্ধ গলিতে কেন এসেছ? সুধা খেতে, মধু লুটতে, নাকি ভালোবাসা কিনতে? 

শালীনতা বজায় রেখে চিৎকার করে মিনা জানতে চাইল কামালের কাছে। কামালকে চুপচাপ দেখে মিনা আবার বলতে শুরু করল, তোমাদের মতো ভদ্রবেশী শ্বাপদদের জন্যই তো আজ আমাদের এই অবস্থা। পেটের দায়ে তো আমরা আজ তোমাদের ভোগবিলাসী, শ্রেয়সী, মক্ষীরানি, প্রিয়তমা।

প্রতিবাদ করে কামাল বলল, না, তোমাদের মতো মেয়ের নেশায় আমি এখানে আসিনি। এসেছিলাম চাকরির আশায়। ঘরে আমার মা, ভাই, বোন সব অনাহারে আছে। তাদের অনাহারে রেখে আনন্দ করতে তোমাদের এখানে আসিনি।

– সে-কথা তো সবাই বলে। মিনা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ঘরে সদ্য বিবাহিত বউ রেখে এখানে আসে সবাই। আর তুমি ভারি অনাহারের কথা বলছ! তুমি আসলে এসেছ তোমার পশুত্ব নিবারণ করতে। মাঝপথে আমার পরিচয় পেয়ে তুমি বিক্ষুব্ধ। আসলে তুমি একটা ভদ্রবেশী পশু।

অনেকটা নরম হয়ে কামাল বলল, বিশ্বাস করবি মিনা! এটা পতিতালয় বলে আমি জানতাম না। বিধান আমাকে চাকরির প্রলোভনে ভুলিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে।

– বিধান! চোখ দুটো কপালে উঠল মিনার। একসময় অস্ফুট স্বরে জানতে চাইল, বিধান তোমাকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে?

জবাবে কামাল বলল, হ্যাঁ, সে-ই তো বলল, মিস্টার রায় তোর একটা চাকরি নিশ্চয়ই করে দেবে। তোর কোয়ালিফিকেশন যা আছে তা দেখলেই লুফে নেবে।

তা শুনে আক্ষেপের সুরে মিনা বলল, একশবার নিষেধ করেছি বিধানকে, দয়া করে কোনো লোক ঠকাস না। তোর যা টাকার দরকার আমার কাছ থেকে নিয়ে যাস। শুনলে না কথা। তবুও দালালি করে। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আমার ক্ষতি জোগাড় করে দেয়।

একথা বলে কিছুক্ষণের জন্য কিছু একটা ভাবল মিনা। তারপর স্তব্ধতা কাটিয়ে একসময় বলল, তুমি কিছু মনে করো না কামালদা। তোমাকে না বুঝে আমি অনেক কথা বলে ফেলেছি। আঘাত দিয়েছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করো।

কামাল বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। দোষটা কিন্তু আমার। কোনোকিছু না জেনে-বুঝে আমি মিছেমিছি তোমাকে উত্তেজিত করেছি। আমাকে মাফ করে দিও।

– জানো  কামালদা!  বিধানের মাথায় একটু ছিট আছে। ও বলে, কাজ না করলে পয়সা নিতে নেই। তাই আমার খদ্দের জোগাড় করে দেয়। বিনিময়ে হাতে কিছু পয়সা পায়। ঘরে ওর বিধবা মা, চার বোন। আমার বেশ্যাগিরির পয়সায় ওদের চলে। বাবুদের বলে একটা চাকরিও জোগাড় করে দিয়েছিলাম বিধানকে। কিন্তু ওর ভাগ্য এতোটাই খারাপ যে, সে-চাকরিটাও গেল। ওর নামে মামলা আছে, তাই কোম্পানি ছাঁটাই করে দিয়েছে ওকে।

– ওর নামে মামলা কেন? কী করেছিল ও?

– সে অনেক কথা। বিধান আমাকে সব বলেছে। ওর বাবা স্কুলমাস্টার ছিলেন। হঠাৎ গাড়িচাপা পড়লেন। সেই সঙ্গে সংসারে জ্বলে উঠল আগুন। অনেক হাঁটাহাঁটি করেও পিএফ-এর টাকা বুঝে পেল না। বাবুদের হিসাবে সময় নেই। এক বছর, দু-বছর, তিন বছর কেটে গেল, তবু কোনো আশার মুখ দেখতে পেল না বিধান। যোগ্যতা থাকলেও স্কুলমাস্টারের চাকরির মুখ দেখত পেল না। এদিকে টাকার অভাবে সংসার আর চলে না।  মায়ের কঠিন অসুখ। বিবাহযোগ্য তিন বোন ছেঁড়া কাপড় পরে বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। পাড়ার কেউ ধার দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিল বিধান। এক বোঝা কাঁসার থালা নিয়ে যখন সিঁদের কাছে এসেছে, তখন নাকি ওর মনে পড়েছিল ওর বাবার কথা। বাবা তার দিকে আঙুল তুলে বলছে – হ্যারে খোকা! এজন্য কি তোকে লেখাপড়া শিখিয়েছি? এজন্য কি সব কিছু খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছি? এসব কথা মনে পড়তেই হাত থেকে কাঁসার জিনিস ঝনঝন শব্দে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। ‘চোর চোর’ বলে সবাই ওকে ধরে ফেলেছিল। গায়েও হাত তুলেছিল অনেকে। আবার কথার জুতোও মেরেছিল। বিধান যে  ভেতরে ভেতরে এমন সাধু চোর তা কে জানে? যেমন আমি বারবণিতা, তাই আমাকে তোমরা কত কি বলো, কত মুখ খারাপ করো; কিন্তু ভেবে দেখেছ কি, আমি কেন বারবণিতা? কেন বিধানদা চোর? এর উত্তর তোমরা কোনোকালে দেবে না। এটা আমরা জানি। তোমরা আইনের প্রশাসক, জীবনের বিশ্লেষক নও। তোমরা আইনের চোখে আমাদের দোষ দেখবে, কিন্তু কেন দোষ করলাম – তা দেখবে না।

 একথা বলে দম নিতে একটু থামল মিনা। তারপর একসময় উদাস কণ্ঠে বলল, এর উত্তরে আমি গর্বের সঙ্গে  বলছি, আমরা দু-বেলা দু-মুঠো আহারের জন্য এ-পথে নামতে বাধ্য হয়েছি। বিধানদার মতো দেবতুল্য ছেলে আজ তাই আসামি। আমার মতো শত শত মেয়ে আজ পেটের দায়ে এই পথে নামতে বাধ্য হয়েছে। তাহলে দোষটা কি আমাদের, না তোমাদের?  নাকি তোমাদের সমাজের?

কামাল নিরুত্তর। কোনো জবাব দিতে পারল না। জবাব দেওয়ার সামর্থ্যতার নেই। তাই ফ্যালফ্যাল করে মিনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলতে হয়তো ইচ্ছে ছিল, ও-কথা বলো না মিনা! ওরা শুনলে তোমাকে বিরোধী বলবে। হয়তো তোমার প্রতি অবিচার করবে। কিন্তু একথা বলার সাহস পেল না কামাল।

অনেকদিন পরে মনের মতো একটা মানুষ আজ মিনা পেয়েছে। তাই তার সমস্ত অভিযোগ, সুখ-দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, উজাড় করে দিতে চায়। এ-কথা বলে হয়তো মিনা কিছুটা শান্তি পাবে মনে। তার কাছে পরিবর্তনের কিছু গল্পগাঁথা  শুনে হয়তো নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারবে। কারণ এখন সান্ত্বনা ছাড়া তার জীবনে আর কিছু নেই। একটা সুখের সংসার, ছেলেমেয়ের মা হওয়ার বাসনা, কবে মুছে গেছে তার জীবন থেকে।

মিনা বলল, জানো কামালদা। বিধানদা প্রায়ই বলে, আমাদের আত্মহত্যা করারও স্বাধীনতা নেই। জানতে পারলে পুলিশ নাকি ধরে নিয়ে যাবে। তাই ভাবি, এ-সংসারে তাহলে আমরা কী করতে এসেছি? এরা খেতে দেবে না, পরতে দেবে না, শান্তিতে মরতেও দেবে না। তাহলে এসব মানুষকে নিয়ে এরা কী করবে, ভোগবিলাসে লিপ্ত করবে, নাকি পাশ্চাত্য দেশে কেজি দরে বিক্রি করবে?

– না না, তা কেন হবে? কামাল বলল, আমরা নিশ্চয়ই একদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। বিশ্ব মাঝে আবার আমরা শ্রেষ্ঠ আসন লবো।

– কবে? কবে কামালদা? একথা তো শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে। এখনো তো কোনো পরিবর্তন লক্ষ্যগোচর হলো না। হবে বলেও মনে হয় না। বিধানদা ঠিক কথাই বলে। এরা সবাই স্বার্থপর। নিজেদের স্বার্থের জন্য, নিরাপত্তার জন্য এরা আইন করে।

– মিনা! তোমার বিধানদার কথা অবশ্য ঠিক। কিন্তু কী করার আছে বলো? আইনকানুন, সংবিধান তো সকলকে মানতে হবে। তবে এটাও ঠিক, এই ভারতবর্ষে একটা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ন্যায়সম্মত গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠত হবে। যেখানে তোমরা আমরা কেউ কষ্ট ভোগ করব না। কেউ চুরির দায়ে জেলে যাব না। কেউ খেতে না পেয়ে আত্মহত্যা করবে না। কেউ তোমাদের ওই পিচ্ছল পথে পা বাড়াবে না।

– আচ্ছা কামালদা! আমাদের 888sport apk কি এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারে না যে, মানুষ হাওয়া খেয়ে বাঁচবে। তাহলে এই দুনিয়ায় কেউ এ-জিনিসটা আমার, ওই জিনিসটা আমার, বলে হস্তগত করতে পারবে না। তাহলে প্রত্যেকেই খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবে।

এক সপ্তাহ পর টাটা কোম্পানি থেকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেল কামাল। কাগজটা দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। এ কী করে সম্ভব? জয়েন করার দিন সকাল সকাল খেয়ে কামাল পৌঁছে গেল কলকাতার অফিসে। সেখানে বড়সাহেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি মিনা চৌধুরীর কেউ হও?

সে-কথা শুনে চোখ দুটো ছলছল করে উঠল কামালের। ব্যথিত কণ্ঠে সে বলল, হ্যাঁ স্যার! মিনা আমার বোন। এক মায়ের পেটের ভাইবোন আমরা।

– তবে তোমার নাম কামাল কেন?

– না স্যার! আমার নাম কামাল নয়। আজ থেকে আমি কমল চৌধুরী।

সাহেব বললেন, ঠিক আছে। তার কথাতেই তোমাকে চাকরিটা করে দিলাম।

অনেক বছর হলো, চৌরঙ্গীর গলি থেকে বিদায় নিয়েছে মিনা। অপরিণত বয়সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেছে সে; কিন্তু আজো কামালের মনে আছে একটা মুসলিম পরিবারকে বাঁচাতে নিঃস্বার্থভাবে একটা হিন্দু পরিবারের মেয়ে কীভাবে আত্মদান করে গেছে।