সৌভিক রেজা
ম্যাক্সিম গোর্কির লেখায় (In America) একজন ‘নীতির পান্ডা’র সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যাঁর মতে :
জানেন তো, আমাদের দেশ একটিমাত্র আদর্শ নিয়ে বেঁচে আছে – সেটা হচ্ছে অর্থোপার্জন। এখানে প্রত্যেকেই ধনী হতে চায় এবং একজনের সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক হচ্ছে, কী করে তার কাছ থেকে কতগুলো সোনার দানা ছিনিয়ে নেওয়া যায়। সমস্ত জীবনটাই হলো মানুষের রক্ত আর মাংস থেকে সোনার দানা বের করার একটা পদ্ধতি। এদেশের জনসাধারণ এবং শুনেছি সব দেশের জনসাধারণ হচ্ছে সেই অপরিশুদ্ধ বস্ত্তপিন্ড, যা থেকে সেই হলদে ধাতুটি বের করা যায়। প্রগতি হচ্ছে জনসাধারণের শারীরিক শক্তিকে ঘনীভূত করা অর্থাৎ মানুষের মাংস-হাড় ও স্নায়ুকে সোনার দানাতে পরিণত করা। জীবনটাকে খুব সহজভাবেই সাজানো হয়েছে। (A Priest of Morality)
Life’s very simply arranged – এ-আদর্শটা এখন শুধু কোনো একটি দেশে নয়; বরং পৃথিবীর সবখানেই এ-আদর্শ সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের দেশের মানুষ শুধু মুখ থুবড়েই পড়ছে না, সে তার মানবিক আদর্শটাকে নিদারুণ হতাশার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে। হতাশাটা শুধু এ-কারণে তা নয় যে, সে সোনার দানার মালিক হতে পারছে না। সে যে আজ বিকল্প কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছে না, সেটাও একটা বড় কারণ। আর সেই বিকল্প পথের সন্ধান দিতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন :
আমার চারিদিকে হতাশার সর্বগ্রাসী একটা ব্যাপার দেখি। হতাশা বোধ হচ্ছে এক সংক্রামক ব্যাধি। ব্যক্তির হতাশা থেকে হতাশার মহামারি হয়। জীবনের মধ্যে হতাশাকে অমেবষণ করতে হয় না। জীবনের মধ্যে আশার বীজ অমেবষণ করতে হয়।
এ-কারণেই সরদার ফজলুল করিমের জীবনের কাছে, তাঁর রচনাকর্মের কাছে আমাদের ফিরে যেতে হয়। ফিরে যে যেতে হয় সেটাও একটা সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করলে তেমন একটা ক্ষতি নেই।
দুই
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক জাতিই আপনার সভ্যতার ভিতর দিয়ে আপনার শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে প্রার্থনা করছে।’ সরদার ফজলুল করিম হলেন ঠিক সেরকম একজন মানুষ। ১৯২৫ সালের ১ মে বরিশালের অাঁটিপাড়া গ্রামে সরদার ফজলুল করিমের জন্ম; তারপর অনেক বছর ধরে অনেক রাস্তা হেঁটে আজকের এ-অবস্থানে আসা – এটা তো একদিনে সম্ভব হয়নি। বলতে পারি তিনি নিজেকে নিজেই গড়ে তুলেছেন। জাঁ পল সার্ত্র তো গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন, মানুষ নিজেকে যেভাবে গড়ে তোলে সে বস্ত্তত তা-ই ছাড়া অন্য কিছু নয়। অবশ্য তাঁর আশপাশের অনেকে তাঁকে এই হয়ে-ওঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন, অনেকের কাছ থেকেই তিনি সহানুভূতি পেয়েছেন, সেসব কথা সরদার স্যার কখনো অস্বীকার করেননি। তবে নিজের ভেতরেও যদি নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার একটা আত্ম-প্রযত্ন না থাকে, শুধু সরদার ফজলুল করিম কেন, কোনো মানুষই তার নিজের ব্যক্তিত্বকে এরকম নির্বিকল্পভাবে গড়ে তুলতে পারে না। সেই আত্ম-প্রযত্নের ব্যাপারটি সরদার স্যারের মধ্যে বরাবরই ছিল। সেইসঙ্গে তাঁর মধ্যে ছিল সেরকম আত্মসচেতনতার বোধ। আত্মসচেতনতাহীন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকাটা কোনো কোনো সময় অনেক ক্ষেত্রেই বেশ নিরাপদ; কারণ তাতে নিজের দায়িত্বে জীবন-যাপন করার কষ্ট থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যায়। কিন্তু সরদার ফজলুল করিম ওরকম দায়িত্বহীন জীবনযাপনের প্রতি কখনো আগ্রহ দেখাননি – না তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে, না তাঁর অ্যাকাডেমিক জীবনে। সে-কারণেই নিজেদের পরিবারিক জীবন সম্পর্কে তিনি তাঁর 888sport sign up bonusকথায় এভাবে বলতে পেরেছিলেন :
আমাদের পরিবারকে মধ্যবিত্ত পরিবার বলা চলে না। নিম্নমধ্যবিত্ত বললে ঠিক হয়। বছরের খোরাক হয় কিংবা কিছু কম পড়ে। বাজারে গিয়ে তরিতরকারি বিক্রি করেছি ছোটবেলায়। বাবা কৃষিকাজ করতেন।
সরদার ফজলুল করিম বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তাঁর এ-লেখাপড়ার বিষয়ে নিজের পিতা-মাতার অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন :
আমার বাবা-মা নিরক্ষর এবং একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন। তাঁদের মতো লোকের কথা ছিল না আমাকে স্কুলে পাঠানোর। কিন্তু তারা আমাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। সেজন্য আমি এ-মাটির মানুষগুলোর কাছে ঋণী এবং এই দেশের মাটির প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা ভক্তি জেগে আছে।
যে-সময়টায় বাঙালি মুসলমান বিশ্ববিদ্যালয় জিনিসটা যে কী সেটা ঠিকমতো বুঝতেই পারেনি, সেই ১৯৪৬ সালে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরদার ফজলুল করিম দর্শন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করেন। অনার্সেও তিনি প্রথম শ্রেণি পেয়েছিলেন। ঠিক এ-সময়টায় তিনি বিলাতে পড়তে যাওয়ার ‘স্কলারশিপ’ পেয়েও তার ‘ইন্টারভিউ কার্ড’ ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। কেন এমন কাজ করেছিলেন? সরদার ফজলুল করিম তাঁর 888sport sign up bonusকথায় জানিয়েছেন :
ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে আমি কলকাতায় যাই।… রাইটার্স বিল্ডিংয়ে না গিয়ে আমি প্রথমে গেলাম কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে।… সেখানে মুজাফফর আহমেদ (যাকে আমরা কাকাবাবু বলতাম), নৃপেন চক্রবর্তী (যিনি পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন)। আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি।…’ ওঁরা শুনে হাসতে হাসতে ঠাট্টার ছলে বললেন, ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে ভেরেন্ডা ভাজবো?… কাঁথা-কম্বল নিয়ে পা©র্র্র্র্ট অফিসে চলে আসেন।’… তো কাঁথা-কম্বল নিয়ে পরের দিন আমি পার্টি অফিসে যাইনি কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম।
ওই বছরই 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে সরদার ফজলুল করিম শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ছাত্র অবস্থা থেকেই তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে অধ্যাপনা থেকে ইস্তফা দিয়ে আত্মগোপন করেন। এ-সময়টায় তিনি কলকাতায় কবি আহসান হাবীবের বাসায় থেকেছেন, কিন্তু সেখানেও পুলিশের ধাওয়া খেয়ে একপর্যায়ে নরসিংদীর চালাকচরে এসে আত্মগোপন করেন। সেখানকার জীবন-যাপন সম্বন্ধে তিনি বলছেন :
রাতে… এই যেমন ধরুন, কোনো একটা গরুর ঘর, তার মধ্যে বিছানাপত্র বিছিয়ে আমি থাকতাম। (চালাকচর) গরিব এলাকা ছিল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোন চাহিদা ছিল না আমার। হতো কোনোদিন একটি পুঁটিমাছ দিয়ে বা কোনোদিন পাটকাঠি দিয়ে শুঁটকি মাছ পুড়িয়ে তা দিয়ে কিছু ভাত খেলাম। সে এলাকায় সাধারণ মানুষ সবসময় ভাত খেতে পেতো না।… ওটা আবার কাঁঠালের এরিয়া ছিল। কাঁঠালের সিজনে, সকাল বেলা কিছু কাঁঠাল দিত, সেই কাঁঠালের কোষ খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম।
এরপর আত্মগোপন থাকা অবস্থায়ই প্রয়াত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের বাসা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সন্তোষ গুপ্ত নিজেও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। সরদার ফজলুল করিম কারাগার থেকে মুক্তি পান ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে। কারাগারেও তিনি সহবন্দিদের সঙ্গে ৫৮ দিনের অনশন ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরে কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত এ-দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে তাঁকেও করাচিতে থাকতে হয়েছে। তাঁর নামের আগে ‘সরদার’ থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক কর্মী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তাঁরা এই ‘লিলিপুট’ সর্দারকে যেমন ভালো বাসতেন, তেমনি কখনো-সখনো তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টাও বাদ দিতেন না। এ-সম্পর্কে অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তাঁর 888sport sign up bonusকথায় লিখেছেন :
সমারসেট হাউসে… পার্লামেন্টের বাঙালি মেম্বাররা সাধারণত উঠতেন… একবার সরদার ভাই এসেছিলেন, আমাদের সরদার ফজলুল করিম।… তাঁর ওখানে গিয়েও দেখি সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জমায়েত বটে। তবে এ আরেক কিসিমের। পাগড়ি মাথায়, পরনে লম্বা ঝুলের ঢোলা কামিজ, ঢোলা পাজামা পেশোয়ারি পাঠান। সবাই সীমান্তগান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের অনুগত কর্মী… রাজনৈতিক কারণে কারা-নির্যাতিত এক বাঙালি সরদারের সঙ্গে এঁরা মিলতে এসেছেন।… দেখবার মতো সে দৃশ্য। এদিকটায় ছ’ফুট/ সোয়া ছ’ফুট ইয়া ইয়া দশাসই জওয়ান পাঠান-নন্দন ওরা কয়েকজন, বিপরীতে বসে ছোটখাটো কৃশকায় মলিন অবয়বের এক বাঙালি সরদার। পলিটিক্যাল কথাবার্তা… আগ্রহে-888sport apk download apk latest versionয় ওঁরা শুনে গেলেন। কী বিষম অহঙ্কার আমার, – বাঙালিদের মুল্লুকেও তাহলে সরদার জন্মায়। সরদার ভাইয়ের মুখে বিনীত হাসি।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। এবার মুক্তি পান ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৬৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, সেপ্টেম্বর মাসে, তাঁকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে। অন্য কারাবন্দিদের সঙ্গে তিনিও ১৭ ডিসেম্বর মুক্তি পান। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে সরদার ফজলুল করিম আবারও শিক্ষক হিসেবে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এবার অবশ্য দর্শন বিভাগে নয়, রাষ্ট্র888sport apk বিভাগে। তাঁর 888sport sign up bonusকথায় সরদার স্যার বলছেন :
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আবার আমাকে নিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।… আমি স্যারকে বলেছিলাম… আমি তো দর্শনের লোক। পলিটিক্যাল সায়েন্সে তো আমার এমএ নেই। আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন? রাজ্জাক স্যার উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনি ফিলসফির উপর কি সব লেখালেখি করছিলেন না? ঐগুলা আমার দরকার।’ উনি বিশ্বাস করতেন, দর্শন ছাড়া রাজনীতি সম্ভব নয়।
‘পাকিস্তান হওয়ার কিছুদিন পর 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গিয়েছিলাম। 888sport appsের স্বাধীনতার পর অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আবার আমাকে নিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।’ ১৯৮৫ সালে 888sport app বিশ্বদ্যিালয় থেকে অবসর নেন। অবশ্য অধ্যাপক হিসেবে নয়, সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে।
তিন
সরদার ফজলুল করিম চিরায়ত গ্রিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো 888sport app download apk latest version করেই দেশের বিদ্বৎ সমাজে এবং সাধারণ পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। 888sport app download apk latest versionকর্ম ছাড়া তাঁর মৌলিক গ্রন্থের 888sport free betও কম নয়। এখানে একটি বিষয় লক্ষ করবার মতো, তা হচ্ছে সরদার ফজলুল করিমের বেশিরভাগ গ্রন্থই একাধিক সংস্করণের সুযোগ পেয়েছে। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : নানা কথা (১৯৭২), দর্শন-কোষ (১৯৭৩), প্লেটোর সংলাপ (888sport app download apk latest version : ১৯৭৩), প্লেটোর রিপাবলিক (888sport app download apk latest version : ১৯৭৪), অ্যারিস্টটল-এর পলিটিক্স (888sport app download apk latest version : ১৯৮৩), নানা কথার পরের কথা (১৯৮৪), এঙ্গেলস-এর এ্যান্টি-ডুরিং (888sport app download apk latest version : ১৯৮৫), আবক্ষ (১৩৯৫), রুমির আম্মা ও 888sport app 888sport live (১৯৮৯), নূহের কিশতি এবং 888sport app 888sport live (১৯৯৩), 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ (১৯৯৩), চল্লিশের দশকের 888sport app (১৯৯৪), রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট (888sport app download apk latest version : ২০০০), সেই সে কাল : কিছু 888sport sign up bonus কিছু কথা (২০০১), আরেক যুগে আর এক যুগোস্লোভিয়ায় (২০০৫) আমি রুশো বলছি (888sport app download apk latest version : ২০০৬), আমি মানুষ (২০০৯), শ্রেষ্ঠ 888sport live (২০১১) প্রভৃতি।
তিন (এক)
সরদার ফজলুল করিম দর্শনশাস্ত্রের একজন বিনম্র ও মেধাবী ছাত্র তিনি ছিলেন ঠিকই, তাই বলে শুধু শিক্ষকতাকেই নিজের জীবনের মূল চাওয়া-পাওয়ার কেন্দ্র হিসেবে কখনই ভাবেননি। সে-কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির একজন কর্মী হিসেবে আত্মগোপনের জীবন বেছে নিতে পেরেছিলেন। আবার পার্টির একজন বড় নেতা হওয়ার ইচ্ছা তাঁর মনের মধ্যে ছিল – এরকমটি কখনই আমাদের মনে হয়নি। সরদার স্যারের এই ‘বড়ো হওয়ার’ হিসাবটা অন্যদের চেয়ে একবারেই আলাদা; কারো দ্বারা প্রভাবিত না-হয়ে এটি তিনি সবসময়ই তাঁর মতো করে কষেছেন। তাঁর ‘প্রিয় রুশো’ যেমন মনে করতেন, ‘every man has his particular circle or horizon of which he is the center’। সরদারের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। যখন জেলজীবন থেকে তিনি তথাকথিত ‘স্বাভবিক’ জীবনে ফিরে এসেছেন, তখনো দেখতে পাই – অন্য কোথাও নয়, তিনি চাকরি নিয়েছেন বাংলা একাডেমীর মতো প্রতিষ্ঠানে। সেইসঙ্গে এও বলতে হয়, জ্ঞানচর্চার দিকে বিপুল আগ্রহটাই তাঁর জীবনকে অন্য একটা পরিমিতির দিকে নিয়ে গেছে সবসময়। তিনি কত বড় নেতা বা কর্মী, কত বড় শিক্ষক – এসব বিষয়কে কোনোদিনই সরদার স্যার তেমন একটা গুরুত্ব দেননি। তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চার বিষয়টাই সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে; যে-জ্ঞানের আলো দিয়ে নিজের পথটা নিজের মতো করে তিনি কখনো একা একা, আবার কখনোবা যৌথভাবে পার হতে চেয়েছেন। তিনি স্বতন্ত্র হতে চেয়েছেন ঠিকই; কিন্তু তাঁর বেলায় স্বতন্ত্র হয়ে-ওঠা মানে অন্য সকলের সঙ্গে নিজের ‘যোগ’টাকে নষ্ট করে একা একা উপড়ে উঠে যাওয়া নয়।
তিন (দুই)
সরদার স্যারের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই যে-জিনিসটি দেখতে পাই, তা হচ্ছে চিরায়ত গ্রিক দর্শনের প্রতি তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহ। সে-আগ্রহ থেকেই তিনি একের পর এক 888sport app download apk latest version করেছেন – প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, অ্যারিস্টটল-এর পলিটিক্স। আবার শুধুই যে গ্রিক দর্শনের চর্চায়ই তিনি মগ্ন থেকেছেন এমনও নয়; সে-কারণেই দেখতে পাই, সরদার স্যার রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, আর তাঁর কনফেশান্সের বাংলা 888sport app download apk latest version যেমন করেছেন, সেসবের পাশাপাশি 888sport app download apk latest version করেছেন এঙ্গেলসের এন্টি-ডুরিং। রাজনৈতিক-দার্শনিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তিনি মার্কসবাদী, কিন্তু হেগেল-চর্চায়ও সরদার স্যার পরাঙ্মুখ ছিলেন না কখনই। এসব কারণে তাঁর কমরেডরাও কখনো কখনো তাঁকে বিদ্রূপ করছেন এই বলে, ‘হেগেল তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে’? সরদার এ-কথার কোনো জবাব দেননি। অন্তত এটুকু তিনি কিন্তু বলতেই পারতেন যে, ‘হেগেল আমাকে কার্ল মার্কসের কাছে নিয়ে যাবে’! সরদার স্যার, তাঁর দর্শনচর্চার ক্ষেত্রেই বলি, আর রাজনীতির ক্ষেত্রেই বলি, একটি বিষয়কে অন্যটি থেকে কখনই আলাদা করে দেখেননি; বরং সামগ্রিকভাবেই সবকিছুকে দেখতে চেয়েছেন। আর সে-কারণেই সক্রেটিস থেকে মার্কস – সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। এটিকে আমরা বলতে পারি সরদার স্যারের দৃষ্টিভঙ্গির অগ্রসরমানতা। সরদার ফজলুল করিম বিশ্বাস করেন :
আমি মনে করি যে প্লেটো এবং মার্কসের মধ্যে কোন কন্ট্রাডিকশান নাই। একটা সাধারণ কন্ট্রাডিকশান আছে। তা হলো প্লেটো হচ্ছেন আইডিয়ালিস্ট আর মার্কস হচ্ছেন রিয়ালিষ্ট। কিন্তু গভীরে ঢুকলে উভয়ের সাদৃশ্যই পরিস্ফুট হয়। মার্কস প্লেটোকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় আইডিয়ালিষ্ট মনে করতেন।
সেইসঙ্গে তিনি এও মনে করেন যে, ‘প্লেটো এবং মার্কসকে সরাসরি বিপরীত অবস্থানে দাঁড় করানো ঠিক না।’ মার্কস সম্পর্কে তিনি মনে করেন : ‘মার্কসের মহত্ত্ব হচ্ছে এই যে সে এক ঝটকায় কোন কিছুর অনস্তিত্ব বা অকার্যকারিতা ঘোষণা করে নাই। সে সবকিছুকে দ্বান্দ্বিকভাবে বিশ্লেষণ করেছে।’ এইভাবে এই দর্শন সরদারের কাছে শুধু রাজনৈতিক দর্শন হয়ে ওঠেনি। এটাকে আমরা বলতে পারি তাঁর জীবন-ভাবনা। যে-কারণে ফলাকাঙ্ক্ষাহীন জ্ঞানচর্চা কিংবা যাকে বলা যায়, নিছক জ্ঞানের জন্যেই জ্ঞানচর্চা, জ্ঞানের সন্ধান করা – এসব কখনই সরদারের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর চেষ্টা হচ্ছে সব মানুষকে নিয়ে জীবনের সার্থকতার সন্ধান করা।
চার
এ-কারণেই দেখতে পাই, সরদার ফজলুল করিম শুধুই যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শনচর্চা করে গেছেন তা কিন্তু নয়। নিজের দেশ, দেশের মানুষজন, দেশের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা – এসব কখনই বিস্মৃত হননি তিনি। অর্থাৎ যাকে বলি আমরা কেতাবি দার্শনিক, সরদার স্যার সেটিও কখনো ছিলেন না; আবার প্রায়োগিকতার নামে তিনি জ্ঞানচর্চাকেও তাচ্ছিল্য করেননি। যেটি তিনি করতে চেয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে – এ দুটোর সমন্বয় সাধনের চেষ্টা। নিজের জীবনে অন্তত এক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন – এটা বেশ জোরের সঙ্গেই আমরা বলতে পারি। সরদার স্যারের দৃষ্টিভঙ্গির অগ্রসরমানতার কথা আমরা ইতোপূর্বেই বলেছি। আজকাল আমাদের দেশের চারপাশ থেকে বেশ জোরেশোরেই রাজনীতিতে ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে রাজনীতিতে নানারকম সংস্কারের কথা; আর এসবের বাস্তবায়ন কীভাবে করা যায়, তার জন্যে ‘গোলটেবিল বৈঠক’ থেকে ‘অন্ধকার-বৈঠক’ – কতকিছুই না হচ্ছে! অথচ এ-সংস্কার যে একটা পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, এটি যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত – সেসব কথা কিন্তু কারো মুখ থেকেই তেমনভাবে শুনতে পাওয়া যায় না। সরদার স্যার সেই ১৯৮২ সালে লিখেছিলেন –
আমরা যাকে বড় মনে করি তাঁকে সাধারণত এই বলে আখ্যায়িত করি যে, তিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান ছিলেন।… এমন আপ্তবাক্য আমরা হক সাহেবের ওপর প্রয়োগ করেছি… শেখ সাহেবের ওপর প্রয়োগ করেছি। ভাসানীর ওপর প্রয়োগ করেছি। এবং এমন বাক্য আমরা জিয়া সাহেবের ওপর প্রয়োগ করছি।… চিন্তা করে দেখলে দেখা যাবে, এ বাক্যটি কেবল যে আতিশয্যের বাক্য তাই নয়। এ বাক্যটি নিন্দার বাক্য। যে ব্যক্তি নিজেই প্রতিষ্ঠান, তিনি তো কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীন নন।… এমন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বিকাশের প্রতিবন্ধক। আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত যে আইনগত, শাসনগত, সমাজগত, দলগত কোনো প্রতিষ্ঠান বিকশিত হয়নি… তার কারণ এসব ‘অতিপুরুষগণ’ – যাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বে বলে বিবেচনা করেছেন এবং যাঁদেরকে তাঁদের অনুসারী এবং স্তাবকগণ বুঝিয়েছেন, তাঁরা নিজেরাই এক একটা প্রতিষ্ঠান। (‘পোর্ট্রেট’)
তাহলে এর থেকে পরিত্রাণ কোথায়? এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সরদার স্যার বলেছিলেন :
আমাদের অতিপুরুষদের শক্তি এবং দান এবং অ-দানের অভিজ্ঞতায় যদি এ শিক্ষা আমাদের হয় যে, প্রতিষ্ঠানের উপর ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির উপরই প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি নির্বিশেষে এ কথা সত্য। (ওই)
আর সে-সত্যের ওপর ভর দিয়ে সরদার তাঁর এ-সিদ্ধান্ত জানাতে সেদিন দ্বিধা করেননি যে, আমাদের এই রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমাজের সাধারণ মানুষেরা যেদিন বুঝতে পারবে :
ব্যক্তির ভরসা ব্যক্তি, অতিপুরুষ নয়, ব্যক্তি তথা মানুষের ভরসা তাদের যৌথ শক্তির সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান – তবে
তাতেই আশা, তাতেই মঙ্গল।
আমরা আজ নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, সরদার ফজলুল করিমের এ-কথায় সেদিন কেউ গুরুত্ব তো দেননি, কেউ ধৈর্য ধরে শুনেছেন কিনা তাতেও সন্দেহ হয়। ১৯৮২ সালের কথা না-হয় বাদ দিলাম; ১৯৯০ সাল থেকেও যদি আমাদের রাজনীতিকগণ মানুষের এই যৌথ শক্তিকে গুরুত্ব দিতেন, তাঁরা যদি যার যার দলের ভেতরে নেতৃত্বের এ যৌথতার চর্চা করতেন; তবে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা আজ এতটা হয়তো তমসাচ্ছন্ন হতো না। তবে এও সত্যি, সরদার স্যার, যৌথতার এ-চর্চার বিষয়টি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। এখন যার অপপ্রয়োগ আমরা কতোভাবেই না দেখতে পাচ্ছি!
পাঁচ
চিন্তার ক্ষেত্রে সরদার স্যারের এ-অগ্রসরমানতা যেমন আমরা দেখতে পেয়েছি, তেমনি নীতির প্রশ্নেও তিনি ছিলেন নিজের আদর্শের প্রতি সমর্পিত একজন ব্যক্তি। ‘নিজের দেশ ছেড়ে যেতে আগ্রহী নই’ – এ-কারণ দেখিয়ে সরদার স্যার সেই চল্লিশের দশকে স্কলারশিপ পেয়েও বিলেত যাওয়ার কাগজপত্র নিজের হাতে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন (বিলেত দেশটা যে মাটির এইটা তিনি শুধু মুখেই নয়, কাগজে-কলমেও কষে দ্যাখান!)। আজকের দিনে যা আমরা চিন্তাও করতে পারি না – সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির একজন শিক্ষিত মানুষ, বিলেত যাওয়ার এরকম সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করতে পারেন, তা তিনি মুখে যতই ইঙ্গ-মার্কিনবিরোধী কথা বলুন আর স্লোগান দিন! 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার চাকরি পর্যন্ত সরদার স্যার ছেড়ে দিয়েছিলেন সেটি তো আমরা ইতোপূর্বেই বলে নিয়েছি। আবার ১৯৪৯-৫০ সালে 888sport app সেন্ট্রাল জেলে আটক রাজবন্দিদের সঙ্গে দাবি আদায়ের জন্যে একটানা প্রায় ৩০ দিন তিনি অনশন করেছিলেন। কীভাবে এটি তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়েছিল? সে-ঘটনার কথা জানাতে গিয়ে কী বিনয় সহকারেই না এ-মানুষটা বলেছিলেন, ‘এ-কারণে নয় যে, আমি বিপ্লবী বা সাহসী ছিলাম। আমার সামনে ছিল অপর সাথীদের দৃষ্টান্ত।’ আমাদের বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা কমরেড মোজাফফর আহমদ তো শুধু শুধু বলেননি, ‘তোমাদের সরদার স্যার তো বিনয়ের অবতার!’ বিনয়ী বলেই এমনতরো কথা বলতে পারেন :
আমি হলাম মোস্ট নন-অ্যামবিশাস পারসন।… ছোটবেলায় বড় ভাই একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, বড় হয়ে তুই কী হবি? আমি কুলি হতে চেয়েছিলাম। আমার 888sport sign up bonusতে ছিল বরিশাল লঞ্চঘাট। সেখানে কুলিরা কী সুন্দর কাজ করছে। অন্যের মাল তুলছে। এসব তখন আমার কাছে সাংঘাতিক ব্যাপার।
সরদার স্যার বিনয়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কেননা সত্যিকারের ‘জ্ঞান’ মানুষকে তো বিনয়ী হতেই শেখায়। আবার এও ঠিক যে, সরদার ফজলুল করিম একবারে শিরদাঁড়া-ভাঙা আর হাত-কচলানো মার্কা বিনয়ী ছিলেন না কখনই। সে-কারণেই মার্কিন দূতাবাসের এক সেক্রেটারির মধ্যাহ্নভোজের নেমন্তন্ন ভদ্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ইয়োর টাইম ইজ ভ্যালুয়েবল অ্যান্ড মাই টাইম ইজ অলসো ভ্যালুয়েবল। লেট আস নট ওয়েস্ট আওয়ার টাইম। এই সময়কার সুশীল বুদ্ধিজীবীদের বেলায় এমন উত্তর আমরা ভাবতেও পারি না। বরং বিদেশি দূতাবাসে নিমন্ত্রণ পেলে নিজেদের জীবন ধন্য হয়েছে বলেই মনে করেন!
ছয়
সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার এতোবড়ো বিপর্যয়ের পরেও সরদার ফজলুল করিম নিজেকে একজন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট বলতে দ্বিধা করেননি। তাঁর ভাষায় ‘আই ওয়াজ অ্যা কমিউনিস্ট বাই মাইসেলফ। আই ওয়াজ নট অ্যা কমিউনিস্ট বাই মেম্বারশিপ।’ নিজেকে আশাবাদী মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেও তিনি অকপটে এইটাও স্বীকার করে বলেছিলেন :
আমার পরিচয় আমি তৈরি করি নাই। রাজনৈতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী এসব পরিচয় আমার দেওয়া নয়। আমি কৃষকের পোলা। আমি শুধু বাপের ঋণ শোধ করতে চাই।
বাপ-মায়ের ঋণ যেমন তিনি শোধ করতে চেয়েছেন, তেমনি জীবনের ঋণও। সে-কারণেই জীবনকে নানাভাবে তিনি বুঝতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, জীবনকে বুঝে নিতে পারবার একটা বড়ো উপায় হচ্ছে, ‘জীবন যাপন করা।’ তাই বলে জীবনের প্রতি তাঁর তেমন কোনো আসক্তি নাই-ই; বরং জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি মোহমুক্ত। তিনি যেমন মৃত্যুর জিকির করতে নারাজ, তেমনি অমরত্বের পেছনেও তিনি ছুটতে চান না। বরং চারপাশের জীবন- জগৎকে কেন্দ্র করেই যে একজন সচেতন মানুষের জীবন আবর্তিত হয়, সেটিই তিনি বারবার নানাভাবে বলে চলেছেন। এক 888sport liveে তিনি বলেছেন :
আজকের পৃথিবী ক্ষুদ্র বটে। আবার বিচিত্ররূপে বৃহৎও বটে। রাশিয়ার ব্যাপার যেমন রাশিয়ার ব্যাপার, তেমনি আমাদেরও ব্যাপার। আমেরিকার ব্যাপার যেমন আমেরিকার ব্যাপার, তেমনি আমাদের ব্যাপার। যেমন 888sport appsের, তেমনি পৃথিবীরও। আবার এও সত্য যে, রাশিয়ার ব্যাপারে আমাদের ব্যাপার হলেও রাশিয়ার কোন সরকার বা ব্যবস্থা ডুবলে বা আদর্শগতভাবে ব্যর্থ হলে আমাদের ডুবতে হবে কিংবা আদর্শগতভাবে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হতে হবে, তেমন কোন স্বতঃসিদ্ধ কথা নেই।
আর তাই তো দেখি যে-জীবন মানুষ যাপন করে চলে, তার শত প্রতিকূলতা মেনে নিয়ে তিনি সে-জীবনেরই জয়গানে মুখর থাকছেন, যার কারণে আমরা তেমনভাবে খুব একটা অবাক হই না, যখন তাঁকে বলতে শুনি :
জীবনের অর্থই জীবন। জীবন জীবিত থাকে আর মৃত্যু মারা যায়। বাচ্চা মারা গেলে মা কাঁদে এটা একটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। তথাপি এ-বাচ্চা মারা যাওয়াটা একজন ব্যক্তির extinction, এটা মানুষের extinction নয়। এরকম ভাবনা নিয়েই আমি বেঁচে আছি।
এই বেঁচে থাকাটা শুধু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকা নয়, বরং এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা যে ‘মানুষ তথা জনতাই ইতিহাস তৈরি করে।… কারো প্রতিরোধ এবং প্রতিবন্ধকতাই মানুষের বিকাশকে রুদ্ধ করে রাখতে পারবে না।’ কাকে বলে ’বুদ্ধিজীবী’ – এমন প্রশ্নের উত্তরে সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন :
বুদ্ধিজীবী বলতে আজ আর কোন একটি আদর্শের অনুসারী ব্যক্তিকে বুঝায় না। এই বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই রয়েছে শ্রমজীবী অর্থাৎ ব্যাপকতর মানুষের সংগ্রামের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য শত্রু এবং এই বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই রয়েছে শ্রমজীবীর সুহৃদ, মিত্র। এই উভয় অংশের স্বার্থ এবং চিন্তাগত বিরোধই নানা আবরণে 888sport appsের বুদ্ধিজীবীর চিন্তাজগৎকে আকীর্ণ করে আছে।
সাত
সরদার ফজলুল করিমের জীবনের খতিয়ান থেকেই বুঝে নিতে পারা যায় তিনি কোন পক্ষের? নিজের বিদ্যা ও বুদ্ধিকে পণ্যময় করে তোলার প্রচেষ্টা থেকে তিনি সবসময়ই বিরত থেকেছেন। কারণ তিনি যে-দর্শনে বিশ্বাসী তা শুধু ‘উন্মাদের ভবিষ্যদ্বাণী বা দুর্বলচিত্তের আত্মসান্ত্বনা’ নয়। তিনি সত্যি-সত্যিই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘জীবন মাত্র একটা : লড়াইয়ের হোক সে জীবন’! আর এইভাবেই তিনি পিতা-মাতার প্রতি তাঁর ঋণ শোধ করতে চেয়েছেন : ‘যাঁরা কিনা তাঁদের পুত্রকে চাষের কাজে না-লাগিয়ে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। আজকের এ-সময়ে এমন একজন ‘সৎ ও সামাজিক শিক্ষক’ পাওয়া দুর্লভ।
রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন :
মানুষ বিনাশ করতে পারে, কেড়ে নিতে পারে, অর্জন করতে পারে, সঞ্চয় করতে পারে, আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু এজন্যেই যে মানুষ বড় তা নয়। মানুষের মহত্ত্ব হচ্ছে মানুষ সকলকেই আপন করতে পারে।… মানুষের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ঠ তাঁরা পরিপূর্ণ বোধশক্তির দ্বারা এ-কথা বলতে পেরেছেন যে, ছোট হোক বড় হোক, উচ্চ হোক, নীচ হোক, শত্রু হোক মিত্র হোক, সকলেই আমার আপন।
চারপাশের মানুষকে এভাবে আপন করে নেওয়ার কথা সরদার ফজলুল করিমের রচনায় আমরা বারবার দেখতে পাই। তাঁর রচনায় শুধু নয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-যাপনের মধ্যেও এ-ব্যাপারটি কত বিচিত্রভাবেই না সত্যি হয়ে উঠেছে! এর মধ্যে শুধু যুক্তি নয়, আবেগেরও একটা ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। সে-আবেগকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। সরদার ফজলুল করিম এটিও আমাদের শেখাতে চেয়েছেন যে : ‘মানুষের আবেগকে যুক্তি দিয়ে সবসময় বোঝা যায় না। আবেগকে বুঝতে হলে আবেগের গভীরে যেতে হয়।’ আবেগের সেই গভীরে যাওয়ার সাধ্য আমাদের কজনারই-বা রয়েছে!

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.