ধর্ম-সম্প্রদায়ের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ পৃথিবীতে অসাম্প্রদায়িকতার জন্য ব্যাকুলতা সবসময়ই পরিলক্ষিত হয়। এর কারণ, ধর্ম বা সম্প্রদায়গত ভেদের ফলে মানুষ আলাদা হয়ে যায় মানুষ থেকে, সংসার থেকে, সমাজ থেকে, এমনকি দেশ থেকেও। তাই অসাম্প্রদায়িকতার সুপ্ত বাসনা মনের মধ্যে লালন করে চলে সাধারণ মানুষ, যদিও পুঁজিবাদী ভাবধারা ও ব্যক্তিগত
লাভ-লোকসানের শিকলে বাঁধা মানুষদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত পরাধীন থেকে যায় সাম্প্রদায়িকতার কাছে। এই কথাগুলি মনে এলো একটি গল্প-সংকলন হাতে পেয়ে।
মানুষের মৃত্যু হলে : সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প সংকলন গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মোরশেদ শফিউল হাসান এবং সোহরাব হাসান। এতে স্থান পেয়েছে ৫৮ জন কথা888sport live footballিকের গল্প।
বইটির মূল লক্ষ্য হলো এটা দেখানো যে, এদেশের 888sport live footballিক ঐতিহ্য মোটের ওপর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বারবার মনুষ্যত্বের পতাকা তুলে ধরেছে। সেই লক্ষ্যেই অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সচেতনতার সঙ্গে গল্পগুলি বাছাই করা হয়েছে।
বইয়ের প্রথম গল্প আবুল মনসুর আহমদের ‘ধর্ম-রাজ্য’। এ-গল্পে একজন লেখকের বয়ানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার একটি ছবি আমাদের সামনে ধরা দেয়। এই লড়াই শুধু হাতাহাতি নয়, বরং কাগজে-কলমে 888sport live football-রচনাতেও সমানভাবে বিদ্যমান। গল্পে উপস্থিত ব্রিটিশ বড়লাটও। কিন্তু মুখ্য বিষয় হলো, কোনো মনুষ্যত্বের ধার না ধেরেই কিভাবে ভারত উপমহাদেশের মানুষ একসময় একে অন্যের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল শুধু ধর্মের ছায়াতলে থেকে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে – তার প্রমাণ মেলে এই গল্পে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ভারতবর্ষের নামই হয়ে গেছে ‘ধর্ম-রাজ্য’। আর ধর্মের কারণেই এক দেশ ভেঙে তৈরি হয় ধর্মভিত্তিক দুই দেশ। এর জন্য বয়ে যায় রক্তের নদী। অবশ্য গল্পের পুরোটাই স্বপ্নের দৃশ্যের বর্ণনা, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। অবিভক্ত ভারতে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছিল তা যে এখনো প্রবহমান তা আমাদের অজানা নয়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ বহুলপঠিত গল্প। গল্পটির কাহিনি এমন, দেশভাগের সময় কলকাতা থেকে উদ্বাস্তুর মতো একদল চাকরিজীবী পূর্ববঙ্গে এসে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করে। এটা দেখে 888sport app উদ্বাস্তু আফসোস করে। তারপর একদিন সেই বাড়ি উদ্ধারে পুলিশ আসে। তাদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়িতে আস্তানা গেড়ে বসা ব্যক্তিরা বাড়িটি ছাড়তে নারাজ। একদিন তারা বাড়িটিতে একটি তুলসী গাছ দেখতে পায়। হিন্দু ধর্মের প্রতীক মনে করে তাদের অনেকেই চায় সেটাকে তুলে ফেলে দিতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা তা করতে পারে না, বরং গাছটির পরিচর্যা করে। একসময় বাড়িটি সরকারি দখলে চলে যায়। সবাইকে ছাড়তে হয় বাড়ি কিন্তু থেকে যায় তুলসীগাছটি। সাদামাটা কাহিনি হলেও এই গল্পে ধর্মীয় হানাহানির আড়ালে সম্প্রীতির যে আলো জ্বলে ওঠে মনে, তা সাধারণ বাঙালির মনে সবসময়ই বিদ্যমান ছিল, আছে। এদেশের কথা888sport live footballে বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে নানা ভাবে।
কথা888sport live footballিক সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের যে-গল্পটি সংকলনভুক্ত হয়েছে তার নাম ‘হলুদ বাড়ি’। একটি পুরনো হলুদ বাড়ি ঘিরে হিন্দু-মুসলমান – এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাপন ও 888sport sign up bonus আঁকড়ে বেঁচে থাকার কাহিনি। এই গল্পে কোনো স্পষ্ট হানাহানি-মারামারি নেই, কিন্তু অজানা কোনো ভয়ে বা কারণে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আছে। প্রিয় আবাস ছেড়ে যাওয়ার মর্মযাতনা আছে। আবার এটাও দেখা যায়, সেই বাড়িতে যখন বহু বছর পর ফিরে আসে পুরনো বাসিন্দারা, একটু চোখের দেখা দেখার জন্য, তখন নাম বদলে যাওয়া বাড়ির মানুষগুলো তাদের ফিরিয়ে দেয় না, সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। কাছে টেনে নেয়। এ যেন দুই সম্প্রদায়কে ভিন্ন করে রাখার কৌশলী ভেদরেখা মুছে দেওয়ার গল্প। ভালোবাসা-সহানুভূতির গল্প।
সুশান্ত মজুমদারের গল্প ‘পুরনো অন্ধকার’-এ উঠে এসেছে ক্ষমতার আলোর নিচে থাকা গাঢ় অন্ধকারের ছবি। একজন সাধারণ চিকিৎসকের বেঁচে থাকার জন্য আপস করতে হয় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে। তাঁর সারাজীবনের কর্মসাফল্যে কিছু যায়-আসে না ক্ষমতার কীটদের। এই চিকিৎসকের মূল অপরাধ তিনি হিন্দু। তাই তাঁকে বেঁচে থাকার জন্য, পরিবারের নিরাপত্তার জন্য নত হতে হয় এসব রাজনীতিক নামধারী গুণ্ডাদের কাছে। একসময় যখন তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ক্ষমতার পরিবর্তন হলে তিনি কী করবেন? তিনি তখন নিরাবেগ কণ্ঠে জানান, সেই একই কাজ করবেন, যা এখন করছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক কোনো আদর্শ নয়, স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য অন্যের পদানত থাকতে হচ্ছে এমন বহু মানুষকে। দেশ স্বাধীন হলেও পরাধীনতার শিকল এখনো চেপে বসে আছে আমাদের গলায় ভিন্ন রূপে, ভিন্ন আবহে।
রওনাক করিমের ‘মাতৃভূমি’ গল্পেও উঠে এসেছে রাজনীতির নামে ধর্মীয় উন্মাদনার রুচি-বিকৃতির কাহিনি। যেখানে হিন্দু ও গরিব হওয়ার অপরাধে একটি পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হয়। মেয়েদের সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এলাকার রংবাজরা। গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাকেই বেছে নেয় কেউ কেউ মুক্তির পথ হিসেবে। এই গল্পেও সাম্প্রদায়িকতার উৎকট চিত্রের পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষের বীভৎসতা ফুঠে ওঠে।
দেশবিভাগ-পূর্ব সাম্প্রদায়িকতার নির্মম চিত্র আমরা পাই আবু ইসহাকের ‘বনমানুষ’ গল্পে। নতুন চাকরি নিয়ে গ্রাম থেকে কলকাতায় আসা এক তরুণের অফিসের সময় ধরার ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সে-সময়কার দাঙ্গার একটি সংক্ষিপ্ত ছবি উঠে এসেছে এই গল্পে। গল্পের নায়ক ঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত হওয়ার জন্য কলকাতার গলিঘুজি ঘুরে ঘুরে পেরেশান। কিন্তু এর মাঝেই চোখে পড়ে ড্রেনে পড়ে থাকা মানুষের লাশ, দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা, পুলিশের উপস্থিতি। এই চলার পথেই দাঙ্গাকারীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রমণীকে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো, গল্পের নায়ক কোট-প্যান্ট পরা, অর্থাৎ কোনো সম্প্রদায়ের লেবাস হিসেবে তকমা পাওয়া পোশাক পরে নেই সে। এর ফলে তার মনে আশা জাগে যে, তাকে কেউ হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে ভাববে না। যার মানে দাঁড়ায়, ধর্মীয় পরিচয় ও বিশেষ কোনো পোশাক-সাজসজ্জা সে-সময় মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এসব বিভেদে আগে অতটা জর্জরিত ছিল না ভারত উপমহাদেশ। বরং দিনের পর দিন পাশাপাশিই কেটেছে এই অঞ্চলের দুই প্রধান ধর্মের মানুষসহ 888sport app জাতি-সম্প্রদায়ের দিন। এক্ষেত্রে ব্রিটিশরাজের বুনে দেওয়া সাম্প্রদায়িকতার বীজ ধীরে ধীরে চারা থেকে মহীরুহ হয়ে আজ বিষবৃক্ষে পরিণত।
এমন বেশ কিছু গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে মানুষের মৃত্যু হলে : সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প সংকলন। বইটির সব গল্প পড়ার পর এটা মনে হয়, শুধু ধর্মের ভিত্তিতেই সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায় না, এর পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে ভাষা, বর্ণ, গোত্রীয় বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও। আবার এটাও মনে আশা জাগায় এবং মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটে, সকল পশুত্ব ও নিকৃষ্টতার বিপরীতে মনুষ্যত্বেরই জয় হয়।
বইটিতে যাঁদের গল্প সংকলিত হয়েছে, তাঁরা হলেন – আবুল মনসুর আহমদ, মাহবুব-উল আলম, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ইসহাক চাখারী, সায়ফুল আলম, আবু ইসহাক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আবুবকর সিদ্দিক, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হায়াৎ মামুদ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, রশীদ হায়দার, মতিয়া চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, শামসুজ্জামান হীরা, সেলিনা হোসেন, হরিপদ দত্ত, হুমায়ূন আহমেদ, পূরবী বসু, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, তাপস মজুমদার, মুস্তাফা পান্না, জাফর তালুকদার, আবু করিম, শহীদুল জহির, মঞ্জু সরকার, মোরশেদ শফিউল হাসান, রওনাক করিম, সুশান্ত মজুমদার, আফসান চৌধুরী, ইমদাদুল হক মিলন, সোহরাব হাসান, নকিব ফিরোজ, রফিকুর রশীদ, শাহীন আখতার, তসলিমা নাসরিন, নাসরীন জাহান, ইমতিয়ার শামীম, সালাম আজাদ, আনিসুল হক, জাকির তালুকদার, মশিউল আলম, ধ্রুব এষ, মনি হায়দার, আহমাদ মোস্তফা কামাল, রাখাল রাহা, প্রশান্ত মৃধা, আফসানা বেগম, সাগুফতা শারমীন তানিয়া, স্বকৃত নোমান, সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম, পিওনা আফরোজ, মোজাফ্ফর হোসেন ও অরবিন্দ পান্তি।
বইটির উল্লেখযোগ্য সংযোজন একেবারে শেষ দিকে লেখকদের খুব সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এটি নিঃসন্দেহে কাজের কাজ এই অর্থে যে, খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও গল্পকারদের জন্মসাল থাকায় একটা ধারণা পাওয়া যায় তাঁদের সময়ে সাম্প্রদায়িকতার রূপ কেমন ছিল – সে-সম্পর্কে। অবশ্য কোনো কালেই সাম্প্রদায়িকতা নামক অপশক্তির খুব বেশি রূপবদল ঘটেনি; যা কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, তা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রূপবদল করে চলা সাম্প্রদায়িকতার বাঁধন হয়তো কখনোই পুরোপুরি আলগা হবে না, কিন্তু এর মাঝেই আমাদের মনুষ্যত্ব ও বিবেককে সজাগ রাখার ইঙ্গিত দেয় মানুষের মৃত্যু হলে : সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প সংকলন।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.