নাম সুখমন। জাতীয় পরিচয়পত্রে এমনই আছে। সেখানে একটা জন্মতারিখও লেখা আছে। তবে সেটা তার জন্মতারিখ ছিল কি না সে জানে না। এটা ভোটার তালিকা করা লোকের কৃতিত্ব। সুখমনের মায়ের বলা একটা কথা তার মনে গেঁথে আছে। তার জন্মের বছর মহাবন্যা হয়েছিল। তাদের জন্মভিটের নিচে নৌকা লেগেছিল। মায়ের কথাটা বিশ^াস করতে কষ্ট হয়। নৌকা এই উঁচু ভিটের ধারে লাগা কী করে সম্ভব? কিন্তু বিশ^াস না করে উপায় নেই, অনেকেই সেই বন্যা নিয়ে গল্প ফাঁদে। ছেলেকে নাতিকে ঘুম পাড়ায় সেই গল্প বলে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে সুখমনের বর্তমান বয়স ৪৫ বছর। বয়স ৪৫ হলেও শরীরে কোনো চিড় ধরেনি। হাঁটতে দৌড়াতে স্বাভাবিকের চেয়ে ভালোই পারে। গরু-ছাগলও পুষতে পারে। প্রয়োজনে কোমরে ফাঁসার বেঁধে ঝগড়াও করতে পারে; প্রতিপক্ষ হার না মানা পর্যন্ত পারে।
সুখমনের যখন জন্ম হয় তখন সে বাপ-মায়ের পঞ্চম সন্তান। খুশবর এক-এক করে চার ছেলের বাপ হওয়ার পর পঞ্চমবার হলো মেয়ের বাপ। সেদিক থেকে বড় আদরের হয়ে উঠল সুখমন। তার জন্মানোর বছর খুশবরের জমিনের ফসল উথলে উঠেছিল। গরুর দামড়া বাছুরও হয়েছিল। দুধ ফেটে পড়ছিল গাভির ওলানে। নতুন করে সুখ এসেছিল সংসারে। তাই মেয়ের নাম হলো সুখমন। সবাই অবশ্য সুকমন বলেই ডাকে।
সুখমনের বাবার পরিবারে সুখের অভাব কোনোদিনই হয়নি। কখনো পান্তা খেয়েছে, কখনো সবাই একসঙ্গে বসে ভাত ভাগ করে খেয়েছে। তবু সুখের অভাব হয়নি তাদের। আগের চারজন স্কুলের মুখ না দেখলেও সুখমনকে স্কুলে দেওয়া হলো। বাপের এক কথা, হাজার কষ্ট হলেও মেয়েকে সে পড়াবে। আগের ভুলগুলো এবার শোধরাবে। প্রথমে খুশবর স্কুলে দিয়ে এলেও পরে সুখমন একাই যেত।
সুখমনের আরেকটা গুণ সবার নজর কাড়ল। কারো বিপদের কথা শোনামাত্র ছুটে যেত। সে পাশের বাড়ির হোক আর পাশের পাড়ার হোক। কিছু করতে পারুক আর না পারুক, অন্তত পাশে গিয়ে বসে থাকবে, ভিড় করবে, খেদানি খাবে; এতেই সুখমনের সুখ। এই করতে করতেই সবার আপন হয়ে উঠল সুখমন। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, কাউকে সাপে কাটলে, কোথাও লোক জমায়েত হলে, অনেকেই এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে – সুখমন কোথায়। একসময় ঠিকই পেয়ে যায়; সুখমন দুঃখী দুঃখী মুখ করে বসে আছে বিপদগ্রস্তের কাছাকাছি। সুযোগ থাকলে
এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। এভাবেই সুখমন প্রাথমিক পাশ দিলো। প্রথম দিকে থেকেই পাশ দিলো। তবে মাধ্যমিকে যাওয়া হলো না। স্কুল অনেক দূরে। একটু ডাগর হতে না হতে বিয়েও হয়ে গেল। আর তখনই খুশবরের সংসারের সুখ গেল। সুখমন যখন এলো, তখন সুখ টগবগিয়ে এসেছিল খুশবরের সংসারে। সুখমন যখন গেল তখন সুখও গেল ধুলা উড়িয়ে।
দেখতে সুন্দর। কার্তিকীয় গড়ন। এক বাপের এক বেটা। সব ঠিক দেখেই বিয়ে দিলো খুশবর। খোঁজখবর যে একেবারে নেয়নি তা নয়। তবে খবরে ভুল ছিল। সেই কার্তিকের ভেতরেই শিব লুকিয়ে ছিল। সে ভাং-গাঁজা সব খায়। ভেতরের শিবটা পরে আর শিব থাকেনি। কখন যেন অসুর হয়ে উঠল। শারীরিক-মানসিক কষ্ট দিতে লাগল সুখমনকে। সাঁওতালপাড়া যায়। চুয়ানি খায়। মাতাল হয়ে এসে বউকে পেটায়। ঘায়েল না হওয়া পর্যন্ত পেটায়। সব মুখ বুঁজে সহ্য করছিল সুখমন। বাপের ওপর অভিমান করেই সহ্য করছিল। বলেওনি বাপকে। সকল কষ্ট বুকে চেপে বাপকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল।
খুশবর যখন জানল, তখন অন্যজনের গরুর গাড়ি চেয়ে মেয়েকে একেবারেই নিয়ে এলো। সুখমন আসতে চায়নি। বাপের ওপর অভিমান করে নিজেকে শেষ করতে চায়। তবে বাপের কিরে-কসমের কাছে সে টিকতে পারল না। অবশেষে বোচকা বেঁধে চলে এলো বাপের বাড়ি। আর থেকেও গেল মাথা গুঁজে। স্বামী-সংসার ছিন্ন করল লোক ডেকে। এভাবেই কয়েক বছর গেল। এতদিনের ক্ষীণাঙ্গিনী হঠাৎ কেমন হয়ে উঠল। ঠিকরে পড়ে গায়ের রং। টানটান হয়ে উঠল ঝুলে থাকা শরীর। এতদিনের কড়ালি আজ ডাগর আর ডাসা হয়ে উঠল। কড়ালি দিয়ে আর কী-ই বা হয়? বড়জোর চুনে। এখন যা করবে তাই হবে। কারিগর ভালো হলেই হয়। নজর না ফেললেও পড়ে যায়। নজরকাড়া। তবে কোনোদিকেই খেয়াল নেই সুখমনের। খেয়াল নেই নিজের দিকে, শরীরের দিকে। কখন যে শরীরটা আটিল হয়েছে, আগের জামার মধ্যে আগের টিনটিনে শরীরটা এখন ফুলেফেঁপে হাঁসফাঁস করে। অস্থির হয় নিজেকে জানান দিতে। সেদিকে খেয়াল নেই সুখমনের। খেয়াল নেই মানুষের চাহনির দিকেও। সে শুধু তাকিয়ে থাকে মানুষের সুখ-দুঃখের দিকে। সবাই তাকে ডাকেও। সুখে ডাকে দুঃখে ডাকে। আবার কেউ না ডাকলেও সে নিজে থেকেই যায়। পাড়া হোক আর গ্রামেই হোক। মানুষের বিপদে তাকে যেন থাকতেই হবে। সবাই তার আপনজন। যারা শত্রু ছিল তারাও আপন। যারা বাঁকা চোখে তাকায়, তারাও আপন। যে মেয়েগুলো স্বামী তাড়ানো বলে ঠাট্টা করত, তারাও এখন সুখমনের পাশে বসে, গল্প করে। কখনো আবার পিঁড়ি টেনে বসে মাথায় বিলি কাটে। উকুন না থাকলেও দেখার ভান করে, তেল দিয়ে দেয়। সুখমন হাসে। সুখ খোঁজে।
মানুষের পাশে দাঁড়ানো সুখমনের নেশা হয়ে দাঁড়ালো। বিপদে-আপদে সবাই প্রথমে তাকেই ডাকে। ডাক্তার ডাকার আগেই ডাকে। কেউ প্রসব ব্যথায় কাতরাচ্ছে, সুখমনকে ডাক। কারো ছেলে জ¦র-চমক লেগেছে, সুখমনকে ডাক। মেডিক্যালে দুদিন থাকা লাগুক আর সপ্তাহ থাকা লাগুক, সুখমন ঠিক যাবে।
সুখমনের পিছুটান নেই। স্বামী-সংসার নেই। মনেও করতে চায় না, তার কেউ ছিল। হয়তো পেছন ভুলে থাকতেই এগুলো করে। কিন্তু শরীর তার ভুলে নেই। ভুলে নেই, এখন তার যৌবন। সমস্ত শরীরে জোয়ারের ঢেউ, দাপানি। শরীরের ধর্ম বড় বেহায়া ধর্ম। সমস্ত অঙ্গ-উপাঙ্গ জানান দিতে ব্যস্ত, আমরা নাবালক থেকে সাবালক হয়েছি। পৃথিবীর সবাই যেন ঘুঘু, আর সে একাই ঘুঘু ধরা ফাঁদ। সে ফাঁদের আড়ালে বসে আছে। চোখ সেলাই করা ঘুঘু। অন্ধ ঘুঘু করুণ সুরে ডাকে। প্রলোভন দেয় চরন্ত ঘুঘুকে। ঘুঘু ঘুরঘুর করে, সাহস পায় না বসতে।
তবে সাহস একজন দেখিয়েছিল। তামিজ খন্দকার। অবস্থাশালী মানুষ। গ্রামে মান্যি আছে। সুখমনের গ্রামেই বাড়ি। গ্রামের শেষ মাথায়। তামিজের এক ছেলে এক মেয়ে। ও দুটো রেখেই মারা গেল। তামিজ পরে আর বিয়ে করেনি। বাপ-মা সেজে সন্তানদের মানুষ করল। মেয়ের বিয়ে দিলো। ছেলের বিয়ের বয়স পার হলো। ছেলের বিয়ে দিতে চাইলেও করে না। তামিজ লোক লাগালো ছেলেকে রাজি করাতে। কাজ হলো না। তামিজ শেষে নিজেই ছেলেকে বলল – তুমি যাকেই বিয়ে করতে চাবে, তার সঙ্গেই দিব। পছন্দ থাকলে বলো। ফকিন্নির মেয়ে হলেও দিব। তখনো ছেলে চুপ। ছেলে চুপ থাকলেও বাপ আর চুপ থাকল না। সবাইকে অবাক করে মুখ খুলল খন্দকার। আগে পা চলল, তার পরে মুখ।
একবার খুব অসুখ করল তামিজের। যাচ্ছেতাই অবস্থা। বউ নেই, ছেলেবউ নেই। মেয়েটা আঁতুরে। এমন সময় ত্রাণকর্তা হয়ে এলো সুখমন। তামিজকে সুখমন কাকা ডাকে। তামিজের ছেলে মামুনকে ভাই। টানা এক মাসের অসুখ থেকে সেরে উঠল তামিজ। যতটা ডাক্তার করেছে, তার অধিক করেছে সুখমন। আড়ালে-আবডালে সুখমনকে কেউ কিছু যে বলেনি, তা নয়। বলেছে মামুনকে নিয়ে। সুখমনের কানেও পড়েছে কথাটা। মনে তোলেনি। সুখমন এর চেয়ে আরো কঠিন কথা হজম করা মানুষ। তামিজ সুস্থ হলো, চলাফেরাও করতে লাগল। যেতে লাগল এ-পাড়া ও-পাড়া। কিন্তু অস্থিরতা কাটে না। একটা অসুখ গেল তো আর একটা জুটলো। শরীর আর মন, দুটোই দুই জাতের। একটার অসুখ সারে তো অন্যটার জাগে।
তামিজের ঘোরাঘুরির রোগ দিনদিন বাড়তে থাকে। এই ঘুরতে ঘুরতেই একদিন গেল খুশবরের বাড়ি। খুশবর ছিল না। সুখমন ছিল। তার ভাবিও ছিল। খুশবরের বারান্দায় কিছুটা স্বস্তি মিলল তামিজের। মিলল বিস্কুট আর চাপকলের ঠান্ডা পানি। শীতল হলো বুকের জ¦লন-পোড়ন। শুরু হলো যাওয়া-আসা। একদিন দুইদিন তিনদিন – এভাবে যখন কয়েকদিন চলল, তখন হঠাৎ একদিন সুখমন বলল – কাকা, এভাবে এলে মানুষ কানাকানি করবে। জানেনই তো, আমি ঘরপোড়া গরু।
কেন, কে কী বলল? তামিজ কোনো অবাক হয়নি। সে যেন জানত, এমন কথা একদিন উঠবেই। তাই অবাক হলো না সুখমনের কথা শুনে। বরং এর আগে অবাক হয়েছিল, এতদিন কথাটা উঠছিল না কেন।
কজনার নাম বলব। তা থেকে এভাবে না আসাই ভালো।
তাহলে কীভাবে আসব?
আপনি সহজ কথাতে প্যাঁচ কষেন। আপনি তো না বোঝার মানুষ নন?
আচ্ছা বুঝলাম। কালকে আর একবার আসব রে সুখি। তোর বাপকে বাড়ি থাকতে বলিস। কথাটা শুনেই ধক্ করে উঠল সুখমনের বুক। শেষের কথাটার মধ্যে কী যেন ছিল। শেষ কথা বলার সময় কেমন একটা হাসি ছিল তামিজের ঠোঁটের কোণে। যে হাসি এর আগে কখনো তার মুখে দেখেনি সুখি। পান খায় না তামিজ। তারপরেও এই বয়সেও টুকটুকে লাল ঠোঁট। হাসির সময় ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল আর ভেজা দেখাচ্ছিল। কথাটা বলেই আর থামেনি তামিজ। তামিজ গেলেও যেন শতশত তামিজ বসে থাকল সুখির চারধারে। সবার ঠোঁটেই ভেজা হাসি।
পরদিন তামিজ আসেনি। তার পরের দিনও নয়। তবে খবর ঠিকই পেল সুখমন। পরদিন তামিজ বাড়িতে না এলেও খুশবরকে খবরটি ঠিকই দিলো। খুশবরকে বাড়িতে ডেকে নিয়েছিল তামিজ। সে আড়ালের মানুষ নয়। সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছিল। সে সুখমনকে বিয়ে করতে চায়। দুই বিঘা জমি লিখে দেবে সুখমনের নামে। দুই বিঘা খুশবরকে দেবে আবাদ করে খেতে। আরো একটা দামি কথা বলেছিল, সে সুখমনকে রাজরানি করে রাখবে।
সারা পাড়া বা গ্রাম জুড়ে একটা শোরগোল পড়েছিল এই নিয়ে। তামিজের মেয়ে-জামাই, ছেলে ও তাদের মুরুব্বি সম্বন্ধীয় দু-একজনকে ডেকে ঘরোয়া একটা মিটিংও বসিয়েছিল। লাভ হয়নি। বিয়ে ভেস্তে দিতে পারেনি। তামিজের এক জবান। – আমাকে দেখার মানুষ চাই। তোরা তো ঘুরেও দেখিস না। ঘুরে বসল সুখমনের বাবা-মা, ভাই-বোনও। সুখমনের ভরা যৌবন, সাঁতরানোর বয়স। তাকে কেন পানা পুকুরে ফেলতে যাবে? কিন্তু সারা দুনিয়া এক হলেও তো হবে না। সুখমন ভেতর ভেতর রাজি হয়ে গেল। নায়ক ফারুক দেখে বাপ-মা বিয়ে দিয়েছিল। ফিরে তো ঠিকই আসতে হলো। ছোড়া বুড়োর উৎপাতও কম সইতে হয়নি। তার চেয়ে তামিজের ঘর ঢের ভালো। অন্তত চোখ তুলে তাকানোর সাহস কেউ পাবে না। আবার রানির হালে থাকা যাবে।
সকল বাধা টপকে বলতে গেলে সুখমন জোর করেই বিয়ে করল তামিজকে। এ-পাড়া ও-পাড়া কিছুদিন কানাঘুষা চলল। আবার থেমেও গেল একদিন। তবে ঝামেলা হলো তামিজের বাড়িতে। তামিজের ছেলে মামুন মা বলে ডাকল না সুখমনকে। টানা নিল মেয়ে-জামাই। পাকা মাথার মানুষ তামিজ। সব সামাল দিলো এক-এক করে। নিজের নামে কিছু রেখে জমি-জিরাত যা ছিল সব লিখে দিলো ছেলে-মেয়ের নামে। সুখমনের নামেও দিলো। সুখমন না চাইলেও দিলো।
সুখমন এবার সত্যি সত্যিই সুখসাগরে ভাসল। কূল-কিনারা নেই। তবে দ্বীপ ছিল। সাঁতরে দ্বীপে উঠলেই ঝিরিঝিরি বাতাস পাওয়া যায়। সূর্য ওঠা দেখা যায়, ডোবা দেখা যায়। সেই দ্বীপের নাম তামিজ। তামিজেরও যেন বয়স কমে গেল। সুখমন কিছু দিলো আর কিছু নিল। দুজনের বয়স গড়ে এসে সমান হয়ে দাঁড়াল। সুখমনকে নিয়ে তামিজ শহরে যায়, সিনেমা দেখে। পার্কে যায়, নাগরদোলায় দোলে। মানুষ হাসে। কাউকে কেয়ার করে না তারা। তামিজ কিছুটা মুখ লুকালেও সুখমন এক ধাপ এগিয়ে। সে গতি দেয় তামিজের পালে। তামিজ ওড়ে। সুখমন সুতা ছাড়ে। লাটাই হাতে রাখে আবার রাখেও না। সুখমন জানে, ঘুড্ডি বেশি দূর যাবে না। সুতাতে টান বেশি হওয়ার উপায় নেই। ভোকাট্টাও হবে না। তবে ঘুড্ডি ওড়ে সুখমনের আকাশে।
সুখমন সবাইকে আপন করতে পারল একজন ছাড়া। মামুন। একই বাড়িতে থাকে, একসঙ্গে খায়, তবে কথা হয় না। মা বলে ডাকে না। সুখমন অবশ্য এতে দুঃখ করে না। সুখমন আর মামুন প্রায় সমবয়সী। বরং মামুন কয়েক বছরের বড় হবে। একসঙ্গে খেলেছে। কখনো কখনো সুখমনকে রাগিয়েছে। বাপের বউ হওয়ার কদিন আগেও মামুন সুখমনের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করেছে। সেই সুখমন এখন মামুনের বাপের বউ। মা বলতে মামুনের বাধে। সুখমন মনে মনে হাসে। তামিজ রাগে ছেলের ওপর। কখনো রেগে বলে – কেনরে বাপু, হোক তোমার বয়সের কিন্তু এখন তো তোমার মা। একটু সম্মান তো করতে পারো। ডাকতে তো পারো। বাপের কথা শুনে মাথা গুঁজে থাকে মামুন। উঠান থেকে বাইরে যায়। সুখমন মিটিমিটি হাসে।
সেদিন খেতে বসেও একটা কাণ্ড ঘটল। একসঙ্গে বসেছে তিনজন। সুখমন, মামুন ও তামিজ। সুখমন তামিজের পাতে ভাত দিলো, রুই মাছের পেটি দিলো। নিজেও নিল। মাছের বড় মাথাটা অবশ্য থেকেই গেল। সেটা কে খাবে তামিজ জানে। তবে সুখমন মামুনের পাতে ভাত, মাছের মাথা কিছুই তুলে তুলে দিলো না। মামুন নিজেও তুলে নিল না। আনমনে তাকিয়ে রইল সুখমনের দিকে। সুখমন তা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে গপাগপ করে খেতে লাগল। অবশেষে তামিজ বলল – কী হলো, মামুনের পাতে ভাত দাও।
পারব না, মামুন আমার কে হয়?
মানে? এ আবার কেমন কথা।
মানে আবার কী? মামুন আমাকে কোনোদিন মা বলে ডেকেছে? যেদিন ডাকবে সেদিন দেব। সুখমন আনমনে হাসে আর মামুনের দিকে তাকায়।
ঠিকই তো রে বাপু। সুখমন না হয় তোমার বয়সীই হলো, তাই বলে আমি তো বিয়ে করেছি। তোমার এখন মা। ডাকতে আপত্তি কোথায়? বাপের কথা শুনে মামুন এবার বড় বড় করে তাকায়। তবে কার দিকে তাকালো বোঝা গেল না। সুখমনের হাসি এবার বাঁধ ভাঙল। আর সেদিকে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠল মামুন। টং টং করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল।
তাড়ালে তো। রাগানোর কী দরকার ছিল। তামিজও রেগে গেল সুখমনের ওপর।
বারে, আমি কী করলাম? সে কি কখনো আমাকে ডাকে?
ও একটু অভিমানী ছেলে। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তাকে ডেকে এনে খেতে দাও।
ক্ষুধা লাগলে ঠিকই খাবে। নিজে তুলে খাবে। তুমি এখন খাও। পরে দেখছি। তামিজ আর কথা বাড়ালো না। মুখ বুঁজে খেলেও ছেলের জন্য মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতানি রয়ে গেল।
ঘটনাটা ঘটল এর তিনদিন পর। দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় হড়কে পড়ে গেল মামুন। মাটির এই দোতলার প্রতিটি তির-বর্গা, পাটাতন, দরজা-জানালা, সিঁড়ি সব পইপই করে চেনা মামুনের। সিঁড়ি টপকে দৌড়ে উঠেছে আবার দৌড়ে নেমেছে কত বছর। কতবার সিঁড়ির কোনাও ভেঙেছে। মায়ের মার খেয়েছে, বাপের বকুনি খেয়েছে। কিন্তু গেল ত্রিশ বছরে একবারও পড়েনি মামুন। আজ পড়ল। পায়ের গোড়ালি নাকি থেঁতলে গেছে। চিড় ধরেছে হাড়ে। ডান হাতের কব্জিও গেছে। হাসপাতালে নিতেই ডাক্তার পুরো পা জুড়ে প্লাস্টার দিলেন। হাত কনুই পর্যন্ত। তিন সপ্তাহ ফুল রেস্ট। এই অবস্থায় বাড়িতে যখন ন্যাংড়া-নুলা হয়ে মামুন ঢুকল, তখন সুখমন কিন্তু ফিক করে হেসে উঠেছিল, তামিজ যা দেখতে পায়নি। মামুন পেয়েছিল। মামুনের রাগার কথা হলেও রাগল না। সেও বরং ফিক করে হেসে উঠেছিল। এতে খটকা লাগে সুখমনের। এ কেমন রোগীরে বাবা।
সুখমনের সেদিনের হাসি শেষ পর্যন্ত হাসি আর থাকল না। একটা কালো ছায়া হয়ে সামনে কী যেন দাঁড়িয়ে থাকে সারাক্ষণ। মামুনকে দেখাশোনার সমস্ত ভার পড়ল সেই সুখমনেরই ওপর। যেভাবে বিছানা নিয়েছিল তামিজ, ঠিক সেভাবেই বিছানা নিল মামুন। আর ঠিক সেভাবেই সেবাযত্ন করতে থাকে সুখমন। পার্থক্য এতটুকুই; তামিজকে তুলে খাওয়াতে হতো না, মামুনকে হয়। মামুন কোনোভাবেই বাঁ হাতে খেতে রাজি নয়। হাজারবার সাবান লাগালেও নয়। সুখমন অবশেষে হাতে চামচ তুলে দিয়েছিল। কিন্তু চামচ মুখে ওঠে না। হাত কাঁপে। চামচ গিয়ে ঠেকে নাকে। হেসে ওঠে সুখমন। হাসে তামিজও। অবশেষে তামিজই রাগ মিশিয়ে বলে – অত ঝামেলা করার দরকার কি? একটু তুলে খাওয়ালেই তো পারো।
ঠেকা পড়েছে বুড়ো ছেলেকে তুলে খাওয়াতে।
বারে, এতে দোষের কী? তামিজের কথাতে রাগলেও অবশেষে সুখমনকেই তুলে খাওয়াতে হয়। মামুনও খায়। পেট পুরে খায়। রুচি আসে মুখে।
সংসারের কাজকাম বলতে গেলে লাটে উঠল সুখমনের। অর্ধেক দিন যায় মামুনের ফরমায়েশ খাটতে। সুখমনের কেন জানি মনে হয়, মামুন ইচ্ছা করেই দিনদিন কাহিল হয়। অথর্ব হয়ে ওঠে। অথচ খেতে লাগলে এক থালার জায়গায় দুই থালা ভাত খায়। এভাবে তিন সপ্তাহ পার হলো। তবে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম নেয় না। তামিজ ঠেলে, সুখমনও ঠেলে। সময় হয় না মামুনের। আরো এক সপ্তাহ পার করে মামুন গেল ডাক্তারের কাছে। তবে একা গেল। একটা রিজার্ভ গাড়ি নিয়ে গেল। আর যখন ফিরে এলো তখন অবাক হলো সবাই। প্লাস্টার নিয়েই বাড়ি ফিরল। তামিজ সুখমন কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই মামুন বলল – আরো তিন সপ্তাহ।
মানে! তামিজ চিল্লিয়ে উঠল ছেলের এমন কথা শুনে। তবে সুখমন বিস্মিত হলো না। সে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল – যেমন ডাক্তার তেমন রোগী। ভাবখানা এমন, যেন সারা পা চার ভাগ হয়েছে। চিরধরা পায়ে প্লাস্টার না দিলেও চলত।
তাহলে তুমিই তো বড় ডাক্তার। আগে বলতে? তাহলে অতগুলো টাকা পানিতে পড়ত না। মামুন রাগ দেখাল যেন।
তুমি এবার থামবে? দেখছই তো ছেলেটার বেহাল অবস্থা। তার ওপর তুমি যা-তা বলছ। তামিজ ঠিকই ছেলের পক্ষ নিল। এতে সুখমন ঝামটা মেরে রান্নাঘরে ঢুকল আটকিয়ে রাখা কাজের কাছে।
আস্তে আস্তে বড় ক্লান্ত হয়ে উঠল সুখমন। সংসারের ভারে নয়, মনের ভারে। নিজের কাছে নিজেকে বড় জগদ্দল মনে হতে লাগল। অসার লাগে। নিজেকে বয়ে বেড়াতে বড় ক্লান্ত লাগে। লোকটাও সংসারের সমস্ত ভার সুখমনের ওপর ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে যেন। যা একটু দেখাশোনা করে, তা বাইরে। বাড়ির ভেতরটা সম্পূর্ণ সুখমনের। তামিজ ফজরের নামাজ শেষে বাড়ির আশপাশ ঘুরে এর-ওর সঙ্গে গল্প করে। বেলা বাড়তেই সকালের খাবার খেয়ে ছোটে মোড়ের বাজারে। এক দুপুর আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরে। দুপুরের খাবার খেয়ে একটু গড়াগড়ি দিয়ে আবার আসরবেলা যায় বাজারে। আসে এশা পড়ে। এই তার রুটিন। সারা বাড়ি জুড়ে সুখমন একা। ঘরে মামুন। বড় উঠান আর দুই দুয়ারি বাড়ি। মাটির দোতলা হলেও চালার টিনে যখন রোদ পড়ে তখন বেশ ঝলমলে হয়ে ওঠে সারা বাড়ি। দোতলার চারিধার দিয়ে কবুতরের খোপ। শত কবুতর ডাকে। শুধু সুখমনের ভেতরে কিছু ডাকে না। কোনো ডাক যেন পৌঁছে না। ঝলমলে বাড়িটা আন্ধার ঠেকে। কিন্তু আন্ধারের কথা, এই অশনি ছায়ার কথা বলবে কাকে। কে শুনবে। ইদানীং মামুনের ক্ষুধা বেড়েছে। বাড়া ভাত নেয় কয়েকবার। মুখে ভাত তুলে দেওয়ার সময় সুখমনের হাত ভারি হয়ে ওঠে। কাঁপে। মামুনের ঠোঁটে আগুন। ও আগুন হাত বেয়ে সুখমনের সারা শরীরে পৌঁছে। গোস্ত খেতে গিয়ে মামুনের দাঁতে বিঁধে। আটিল দাঁত। সেটাও বের করে দিতে হয় সুখমনকেই। মামুনের ধারালো দাঁতে হাত লাল হয়। গোস্তর টুকরা বের করতে ব্যর্থ হলে মামুন সুখমনকে রাগায়। সুখমন রাগে। জ¦লে। রেগে বলে – নুড়া এনে ও-দাঁত ভাঙব এবার। তাহলে ঠিক বের হবে।
তাহলে এক কাজ করো, দাঁত নয় বাঁ হাতটাও ভেঙে দাও।
হ্যাঁ সেটাই করি। বাম হাতের কাজটা আর বাদ থাকে কেন? শব্দ করে হাসে মামুন।
হাসবে না খবরদার। সত্যি সত্যি মেরে দিব কিন্তু।
নিষেধ করেছে কে? গাল এগিয়ে দেয় মামুন। লাফ দিয়ে উঠে পড়ে সুখমন। মুখ না মুছিয়েই বাইরে চলে যায়। কোনো কাজেও মন বসল না। বাইরে গিয়ে নিমগাছের গোড়ায় গুম হয়ে বসে থাকল অনেকক্ষণ। শৈশব কৈশোর, প্রথম সংসার, পরের সংসার; কত কী। সামনে বোশেখের খরায় পোড়া বিস্তর মাঠ। সেদিকে এক ধেয়ানে তাকিয়ে থাকে। মাঠ ধিকিধিকি জ¦লে। জ¦লন্ত মাঠের ওপাশটা যেন দেখতে পায় না সুখমন। মাঠের ধিকধিকানি ফিরে আসে তার বুকে।
আর পারলো না সুখমন। কতই আর বয়স। শরীরে টগবগে রক্ত। মন আর শরীর, দুই-ই দুই জিনিস। একটাকে বোঝানো যায়। আর একটা বড় গোঁয়ার। খুঁটা ভাঙতে চায়। কিন্তু তাকে আটকাতেই হবে। বাঁচাতে হবে নিজেকেই। তাই এক গনগনে দুপুরে তামিজ যখন ঘুমে কাদা তখন পালিয়ে এলো সুখমন। দুম করে বাপের বাড়ি এসে ঘরে খিল দিলো। অবাক হয় বাড়ির সবাই। দরজাতে ভাবি ধাক্কায়, বাপ ধাক্কায়। খোলে না। বাইর থেকে তারা চিল্লায়। অবশেষে ভেতর থেকে সুখমন বলে – ভয় নেই, মরব না। এই সুখমন এই দুনিয়ায় মরার জন্য আসেনি। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
ঠিক আছে তোর কাছে যাব না। দয়া করে দরজার খিলটা খুলে রাখ মা। খুশবর কথাটা বলল কাঁদো কাঁদো ভাবে। সুখমন খিল খুলে আবার গিয়ে শুয়ে পড়ে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে না। কেউ তাকে জ¦ালায়ও না। সবাই জানে সুখমন বড় জেদি। সে যা বলবে সেটাই। সুখমন উপুড় হয়ে পড়ে বালিশ ভেজায়।
বিকাল আর সাঁঝ হতে দিলো না তামিজ। ছুটে এলো সুখমনের কাছে। সুখমন তখনো শুয়ে। তামিজের আসা দেখে কিছুটা ভয় জাগলেও মনের মধ্যে স্বস্তি এলো খুশবরের। জামাইকে বারান্দায় চেয়ার দিলেও সে সোজা ঘরে গেল। সুখমনের পাশে বসে রাগ দেখাল – তুমি কেমন মানুষ, হ্যাঁ? একটা কথা বলেও তো আসতে পারতে? বিছানা নেওয়া একটা ছেলেকে রেখে কেউ এভাবে আসে?
বিছানা থেকে ওঠার ছেলে সে নয়। সুখমন উঠে বসল। চোখ দুটো বেশ ফোলা। সেদিকে বোধহয় তাকালো না তামিজ।
কী সব বলছ? সে কি ইচ্ছা করে পড়ে আছে? জানোই তো, তোমাকে ছাড়া তার কত মুশকিল।
জানি তো, সব জানি। জানি বলেই আর যাব না।
কী বলছ সব? মামুন তোমাকে খুব ভালোবাসে। আমার থেকেও ভালোবাসে।
বাসেই তো। তুমি চলে যাও, আমি যাব না।
বাজে কথা রাখো, এখনই আমার সঙ্গে চলো। আল্লার দোহাই লাগে।
দোহাই আমারও লাগে, তুমি চলে যাও। আমি যাব না। সুখমনের এমন নিরলস কথাবার্তা ক্রমশ শক্ত হতে থাকে। তামিজ বেশ বুঝতে পারে সুখমন কোনোভাবেই এখন যাবে না। সে কিছুটা নিরাশ হয়ে অবশেষে বলল – ঠিক আছে, আজ থাক। কাল সকালেই দয়া করে চলে এসো। এর উত্তরে সুখমন অবশ্য কিছু বলল না। তামিজ এতে ভরসা পেল। আর যাওয়ার সময় শ^শুর, সম্বন্ধির বউকে হাতে-পায়ে ধরে বলে গেল, অবশ্যই যেন বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়। তারাও ভরসা দিলো। তবে তামিজ সুখমনের এমন হঠকারিতার কোনো কূলকিনারা পেল না।
পরদিন সকালে গেল না সুখমন। বাপ, ভাই, ভাবি সবাই বোঝাল। পাড়া প্রতিবেশীও বোঝাল। তার একই কথা, সে আর ওই বাড়ি যাবে না। যেতে পারবে না। কিন্তু কেন যাবে না, তা বলে না সুখমন। আর এই না-বলাতে অনেক অকথা-কুকথা শুনতে হলো সুখমনকে। বাপ একদিন থাপ্পড়ও মারল। কাজ হলো না। তামিজ পরপর দুদিন এলো। সুখমনের কাছে নানা অপমান নিয়ে ফিরে গেছে। সুখমন ইচ্ছা করেই নানা কথা বলে অপমান করেছে, যাতে ঘৃণা জন্মে তার প্রতি। এমন আচরণে বড় অবাক হয় তামিজ। এ কেমন রূপ দেখছে সুখমনের। একদম আলাদা। তামিজ নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। মনে আশা জিইয়ে রাখে। রাগ ভাঙলে নিশ্চয় যাবে।
রাগ অভিমান কোনো কিছুই ভাঙল না সুখমনের। সে গেল না। তবে সাতদিনের দিন যা করল তা কেউ অনুমান করতে পারেনি। সে নিজে কাজীবাড়ি গিয়ে তালাক পাঠালো। সঙ্গে এই খবরও লোক মারফত পাঠাল, তামিজের লিখে দেওয়া জমি সে ফেরত দেবে। রেজিস্ট্রি অফিসে কবে যাবে সে যেন জানায়। বাজ পড়ল তামিজের মাথায়। একে ধরে ওকে ধরে। ভাঙা চাক আর জোড়া লাগে না। তার হাজার চেষ্টা বিফলে যায়। তবে একজন বড় নিশ্চুপ ছিল। মামুন। সে প্লাস্টার খুলে এনেছে এরই মধ্যে।
সুখমন এখন ছোট ছোট সুখ জমা করে; মাটির ব্যাংকে পয়সা ফেলার মতো। চারদিকে এখন তার অনেক সুখ। তার সুখ পড়ে থাকা শীতের পাতাতে, পড়তে থাকা পাতার ঘূর্ণিতে। তার সুখ কঞ্চিতে শিমের ডগা জড়িয়ে দেওয়াতে। সুখ ছাগলের দড়িতে, মশারির দড়িতে, মশার কামড়ে। সুখ ভেজা লাকড়িতে চুলা ধরাতে, ধোঁয়াতে নাক-চোখের পানিতে। সুখ খোলা থেকে হাঁস-মুরগির ডিম তোলাতে, বেচাতে। মড়কলাগা আর মরতে বসা মুরগি জবেহ করাতেও সুখ। আহারে সুখ! সুখ বড়ই সস্তা। অথচ কতই না দাম দিয়ে তাকে কিনতে গিয়েছিল। সুখমন বুঝে গেছে, দাম দিয়ে ও-বস্তু কেনার নয়।
যখন সুখমনের আরো দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার বয়স, তখন সুখমন বড় গাছাড়া। দুনিয়ার সব ভেসে যাক, টিকে থাক সে। অথচ একদিন ছিল, দুনিয়ার সব টিকে থাক, ভাসলে ভাসুক সে। আর এখন, দুই কদম ফেলে যদি কাজ হয় তবে তিন কদম সে দেবে না। হাঁস, মুরগি, ছাগল – এই তার জগৎ। তার জগৎ বড় ছোট। সেখানে তার রাজত্বও। কেউ কেউ এসেছেও তার পাশে দাঁড়াতে। পাতিনেতারা ঘুরঘুর করেছে বিধবা ভাতার কার্ড করে দেওয়ার জন্য। সুখমন পাত্তা দেয়নি। বরং খেঁকিয়ে তাড়িয়েছে।
আষাঢ়ে বিকেল হলেও গুমোট ভাব খুব একটা নেই আজ। সুখমনের মনটাও বেশ ফুরফুরে। আজ সকালেই তার ছাগলের বাচ্চা হয়েছে। তিন-তিনটে বাচ্চা। সেসব নিয়েই ব্যস্ত আছে সুখমন। আর লায়েক হয়ে ওঠা খাসি দুটো ধারেকাছেই ফিচলেমি করছে। ছাগলের বাচ্চাকে আদর করতে করতে খাসি দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে আগামী কুরবানি ঈদের কথা। এমন সময় পাশের বাড়ির শামসুল ছুটতে ছুটতে এসে বলল – এই সুখমন শুনেছিস?
– কী শুনব?
– ও আল্লা তুই যে দুনিয়ার খবর কিছুই রাখিস না। কড়ইতলা কামরুলকে সুফিয়ান চাকু মারিছে। মুনে হয় বাঁচবে না। ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে।
– ও আচ্ছা।
– ও আচ্ছা মানে? এটা কোনো কথা হলো। তুই যাবি না? কাউকে ঢোঁড়ায় কামড়ালেও তো তাকে বাঁচাতে জান দিতি? এখন এতবড় ঘটনা শুনেও এভাবে বসে থাকবি?
শামসুলের এত কথা শুনেও সুখমনের চোখে-মুখে কোনো পরিবর্তন আসে না। একদম স্বাভাবিক। সেটা দেখে আরো অবাক হলো শামসুল। এমন সময় দুটো দাঁড়ক হাতে নিয়ে খাসির দিকে হাঁটতে থাকে সুখমন।
– কীরে কোথায় যাস?
– খাসি দুটা বাঁধি ভাই। শিমের গাছগুলো কেবল মাচা নিয়েছে। সুযোগ পেলেই সাবাড় করবে।
– মানুষের জীবনের থেকে শিমের গাছই বড় হলো? শামসুলের এই কথা শুনে অনেক কথা মনে এসেছিল সুখমনের। তবে কোনো কথাই বলল না। নিরাসক্তভাবে খাসির গলাতে দড়ি পরাতে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে শামসুল এবার জোর পা ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
– কী হলো ভাই, তুমি কামরুলকে বাঁচাতে গেলে না?
– নারে, তোর ভাবি বাড়িতে নাই। ঘুঁটেগুলো বাহিরে পড়ে আছে। বর্ষালি দিন, কখন কী হয় বলা যায় না। ভিজলে তোর ভাবি এসে রাগ করবে।
সুখমন তখন খাসির গলায় দড়ি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বাঁধছে। একটি গিঁট দিলেই চলত। তবে গিঁটের পর গিঁট দিয়ে চলল। গিঁট দিতেই থাকল দড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.