পশ্চিম গগনে সূর্য। মা’কে সঙ্গে নিয়ে নিজের আবাস বিক্রি করে সেগুনবাগিচায় ফ্ল্যাটে উঠতে হলো ফজলকে। ফার্নিচার খুব সামান্য। ভাণ্ডার বই-পুস্তকের। একটা কামরায় সব বই ঢেলে রাখল। পরে র্যাক তৈরি করে সাজাবে। রান্নাঘরে কোনো তাক নেই। ফলে মিস্ত্রিকে ডাক দিতে হবে অচিরে।
রাস্তার পাশে পশ্চিমদিকের কামরা, তার শয়নকক্ষ, অথচ সকালটা কি নীরব। পাখ-পাখালির ডাক নেই। নেই গাড়ি বা রিকশার টুংটাং ধ্বনি। আর নেই পুলিশ লাইন্স-এর মার্চপাস্টের ড্রাম ও সানাইয়ের সুর। দশতলা মানে শ’ফিটের ওপরে অবস্থান। এমনটাই হওয়ার কথা। তবে ধারণা আর বাস্তব এক হয় না। কিছু মিল, কিছু অমিল।
সকালে নতুন জায়গায় রোদ দেওয়ার জন্যে বেরিয়ে ফজল প্রথম গলি ছাড়িয়ে দ্বিতীয় গলি ধরে এগিয়ে চলে। সামান্য পথ অতিক্রান্ত। থমকে দাঁড়ায়। বাঁয়ে দোতলা বাড়িটা এখনো টিকে আছে। এখনো ডেভেলপারদের খপ্পরে পড়েনি। রবীন্দ্রসংগীত888sport live chatী জাহেদুর রহিমের পৈতৃক বাড়ি। ষাটের দশকজুড়ে দুই রাহিম রবিগানে রাজত্ব করেছে 888sport appয়। জাহেদুর রহিম, সুদর্শন ভারি চেহারা – কণ্ঠটিও ভরাট। সঙ্গে চৌধুরী আবদুর রহিম। ফর্সা, গোলগাল রোমান্টিক চেহারা। দুজনের গায়কি ছিল পৃথক। যদিও বন্ধুত্ব নিবিড়। জাহেদের গলাটা ভরাট … রহিম কৌশলী ও সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী। ছায়ানট তখন কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে রমনা আর 888sport app শহর। পেছনে আছে উদীচী। আরো আছে ঐকতান। বুদ্ধিজীবী ভাব-জগতে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত রাজত্ব করছে। ভাব থেকে বাস্তবে ফিরে আসে ফজল।
এখানে বাঁক নিয়ে সরণিটা পড়েছে তোপখানা রোডে। প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকে। এই বাঁকের মুখে বেশ বড় একটা অশ্বথগাছ। ঝুঁকে আছে রাস্তার দিকে। গাছের গুঁড়ির চারপাশ কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটা কাঁচাবাজার। শুনেছি এই বাজার উঠে যাবে। সামনেই একটা ছ-তলা পাকা ভবন তৈরি হচ্ছে। কাজ শেষ হয়নি। এর শুরু, এই বাজারের সমাপ্তি।
কাঁচাবাজারটা আসলেই বেশ অস্বস্তি তৈরি করেছে। নতুন ভবনে জায়গা নিলে সবদিক শোভন হয়ে উঠবে। বাজারের উন্নতি হবে একধাপ। আসলেও এই ভৌত উন্নতির প্রয়োজন আছে। আর তা প্রকাশ করে সমাজের সম্পদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি।
ডানদিকে বাজারের নোংরা পরিবেশের জন্যে সে বাঁয়ে বাঁক নেয়। গলিটা রাজস্ব বোর্ডের দেয়ালে গিয়ে ঠেকে। দেয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট খুপরি। খুব অল্প খরচে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা। লম্বা একটা বেঞ্চ পাতা। তার পেছনে খাদ্য তৈরির জায়গা। অতি অল্পে গোছানো।
একটু এগিয়ে বাঁয়ে গেলে কচি-কাঁচার মেলার প্রধান দপ্তর। বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে। ভারী ফটক। সে থমকে দাঁড়ায়। মনে পড়ে কচি-কাঁচার কর্ণধার দাদাভাই ওরফে রোকনুজ্জামান ভাইয়ের কথা। একহারা শ্যামলা চেহারার মানুষটি। মায়ামাখা মুখচোখ। সামান্য তোতলাতেন, ২৪ পরগনায় ছিল আদিবাস। ১৯৪৭-এ স্থানান্তর। তাঁর মূল কার্যালয় ছিল হাটখোলায় ইত্তেফাক অফিসের দোতলা। কচি-কাঁচার আসর নামের সাপ্তাহিক পাতাটির ভার ছিল তাঁর হাতে। অসম্ভব নীতিবান মানুষ ছিলেন। একজনের একটি গল্পে তাড়ি খাবার উল্লেখ ছিল। তিনি লেখককে ওই অংশটা বাদ দিয়ে সাজাতে বলেছিলেন। সে-কথা আজো মনে পড়ে ফজলের। সারা পূর্ববাংলায় কচি-কাঁচার মেলার শাখা ছিল অসংখ্য। আর তখন দেশগড়ার কাজের লোকের অভাব ছিল না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রচুর যুবক ও চাকুরে মানুষ পাওয়া যেত। আজ যা দুর্লভ। টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে হাজার হাজার মানুষ প্রতিযোগিতায় নামবে। না হলে কারো টিকিটি নেই।
কচি-কাঁচার মেলা-ভবন ছাড়িয়ে দু-পা না ফেলতেই ডানে চিটাগাং হোটেল। ফজল গত শতাব্দীর ষাটের দশকে পৌঁছে গেল। মনে পড়ে 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেক্স বিল্ডিং থেকে ফজল দুজন সহপাঠী নিয়ে এই হোটেলে আসত। তখন এই ভবন ছিল না। ছিল বাঁশের একটা ছাপড়া। অবশ্য বেশ প্রশস্ত। রাজস্ব বোর্ডের কর্মীদের দুপুর-ভোজনালয়। ফজল আর দু-বন্ধু আসত একটা পদের লোভে। সেটা রুইমাছের পেটি, যা থালার এ-মাথা ও-মাথা পার হয়ে যেত এবং পেটিতে এতোটা চর্বি থাকত যে অনেক সময় কিছুটা না খেয়েই উঠতে হতো। মুখ মজে যেত। জিভও নিতে পারত না। আজ হোটেল ছ-তলা পাকা ভবন। চিটাগাং হোটেল। খাবারের পুরনো ব্যবস্থাটা এখনো আছে একতলায়। উপরে হোটেল, আর ওটা এখনো সাধারণ মানুষের বিপদের বন্ধু। 888sport live chatকলা একাডেমি, দুর্নীতি দমন কমিশন বা রাজস্ব বোর্ডের সমান নামী চিটাগাং হোটেল। এটা একটা দিকচিহ্ন। পেছনেই বারোতলা 888sport appর কমিশনারের দপ্তর। এর বিপরীতে 888sport apps ভূতাত্ত্বিক ভবন। সবগুলি নামিদামি দপ্তর সেগুনবাগিচাকে উজ্জ্বলতা দিয়েছে।
ফ্ল্যাটে ফিরে উত্তর বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার নজর পাশের বাড়ির ছাদে আটকে যায়। সামান্য ছাদবাগান চোখে পড়ে। তবে এই ভবনটি একটি যুগের প্রতিনিধিত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিগত সত্তর-আশির দশকে গৃহনির্মাণ ব্যাংক সৌদি আরব থেকে তিনশো কোটি টাকা অনুদান পায়। আর চারতলা বাড়ি নির্মাণের সুযোগ তৈরি হয়। সেই সময় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের স্থপতি লুই আই কানের লাল ইটের তৈরি ভবনের একটা বড় প্রভাব পড়ে তরুণ স্থপতিদের মধ্যে। তারই অভিঘাতে এই পাঁচতলা ভবন সেগুনবাগিচা কমপ্লেক্স। এর দু-পাশে হাইরাইজ। মাঝে পাঁচতলা ভবনটি একটি যুগের প্রতিনিধি। পাশে প্রিয়প্রাঙ্গণও চোখ টানে। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া ভবনটি একটা বিশিষ্টতা পেয়েছে। এর পাশে ‘ইস্টার্ন উলানিয়া’ গড় স্থাপত্য-রূপ। তবে উচ্চতায় কুড়িতলা। তাই নজর এড়াবে না।
পাশে ব্যাটারির গলি। এটা বড় রাস্তার সঙ্গে সংযোগকারী। একটা মোটর মেরামত গ্যারাজ বাঁদিকে। এরপর একটি ছ-তলা ভবন : এটি ওয়াইএমসিএ। খ্রিষ্টধর্মীয় সদস্যদের পান্থনিবাস। সব বড় শহরেই বিশ্বজুড়ে এর উপস্থিতি। যিশুর পথে আইস … তাদের সুবিধা দেবে ভ্যাটিক্যান। বাংলায় সব ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে ওরা খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করে বিএ পর্যন্ত লেখাপড়ার ভার নেয়। তখন চাকরির ব্যবস্থাও বাঁধা। এভাবে সারাবিশ্ব তাদের ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ। রামকৃষ্ণ মিশনকে এর সমান্তরাল যাত্রী বলা যায়। এমনকি অনুকূল ঠাকুরের অনুসারীরাও গড়ে তুলেছেন সৎসঙ্গ মিশন। এদের অবশ্য পরিপ্রেক্ষিত বড়। যে-কোনো ধর্মের ব্যক্তি এর সদস্যপদ পেতে পারেন। অনুকূল ঠাকুরের মন্ত্র বা বাণী সবই বাংলায়। এর মধ্যে তার জাতীয়তাবাদী চেতনা ফুটে ওঠে। বাংলা বাংলা করে আমরা দেশ তৈরি করেও বাংলাকে দূরে ঠেলতে ব্যস্ত। পয়সাওয়ালাদের সন্তান ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়ে। তাদের পরীক্ষা-কেন্দ্র লন্ডন। ওখানকার নির্দেশে চলে পাঠপরিক্রমা। মনে পড়ে ব্রিটিশ আমলে আমরা ইংল্যান্ডের ইতিহাস পড়তাম। এখনো তা পড়ানো হয় কি না খোঁজ নেওয়া হয়নি। দেশের
উচ্চ-ধনীর সন্তান দেশে থাকে না। কত যোগ্য ছেলেমেয়ে বিদেশকে সেবা দিতে যাচ্ছে। দেশের জন্যে থাকছে ঝড়তি-পড়তির দল। এরাও প্রশাসনে গিয়ে ক্ষুদ্র মনের মানুষই থেকে যায়। বরং নিজেকে শাসক মনে করে। যান্ত্রিক আচরণ। অনেকটা প্রভুসুলভ। এই ব্যক্তিটিই হয়তো যৌবনে খেলাঘর বা কচি-কাঁচার মেলা করত। বর্তমানে শাসকদলের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাজার করা ফজলের নেশা। কিন্তু ঘর গোছানোর তাগিদে ওদিকে বাধা। তাই ভবনের প্রহরা-সদস্যদের হাতে এই দায়িত্বটি সঁপে দেয়।
মাসখানেক অতিক্রান্ত। ফ্ল্যাটের দু-একজন করে পরিচিত হচ্ছে। তার ফ্ল্যাটের বিপরীতে 888sport app শহরের উপ-পুলিশ কমিশনারের বাস। ভদ্রলোকের ওপর বিশেষ করে 888sport app বিশ^বিদ্যালয় নজরে রাখার দায়িত্ব। খুবই জনপ্রিয় অফিসার। ব্যবহার খুব ভদ্র। মৃদুভাষী। চেহারাটা অবশ্য ভারি। কিন্তু সুদর্শন। বাড়ি শ্রীহট্ট। কিন্তু কথা শুনে বোঝার উপায় নেই। খুবই সচেতন।
একদিন সন্ধ্যায় এক যুবক, হবে ত্রিশ পেরিয়েছে, বাসায় হাজির। নিজেই পরিচয় দিলো : আকবর হোসেন, সুপ্রিম কোর্টে প্র্যাকটিস করি। শ্যামবর্ণ। চোখেমুখে দীপ্তি। বেশ ভালো লেগে গেল ফজলের।
– তুমি বাজার করতে পছন্দ করো?
– আমি ছাড়া কে করবে? আমি বাসায় কোন কাজের লোক রাখি না। আমরা দুজন দুই ছেলেকে সামলে ঘরের সব কাজ করি।
ফজল বোঝে এ একেবারে আধুনিক মানুষ।
– অনেকদিন বাজারে যাইনি। চলো বাজারে যাই। অশ্বত্থতলায়।
– ওখান থেকে বাজার তো উঠে গেছে।
– কোথায় গেছে?
– নতুন বিল্ডিংয়ে। সরকারি ভবনে।
– তাহলে তো বউনি করতে যেতে হয়। চলো …
দুজন নতুনবাজার ভবনে হাজির। বেশ সাজানো হয়েছে। টালি দেওয়া দশ-বারোটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। ভেতরে দোকানের পসরা সাজানোর জায়গা। পিঠোপিঠি।
দু-সার কাঁচা-সবজির বিপণি।
এই অঞ্চলটা পেরিয়ে মাছের জন্যে বরাদ্দ। মাংস বাঁয়ে। সবশেষে মুরগির খাঁচা। ছোট বাজার। দোকান ঠাসাঠাসি। দোতলায় উঠে তারা দেখে মনোহারি ও গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দোকান। বাজার-বিন্যাস ভালো লাগল ফজলের।
সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে একটা গুনগুন গানের কলি কানে বাজে তার। ভারি ও ভাঙা কণ্ঠ; কিন্তু কান টানল।
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো…
আজ আমার প্রাণনাথ
আসিতে পারে…
গানের সুর টেনে নিয়ে যায় ফজলকে।
এখানে, এই জীবনযুদ্ধের বাজারে কুঞ্জ সাজাতে কে এলো?
সে আকবরকে নিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়ে দেখে, মাঝবয়সী একহারা চেহারার টুপি মাথায় এক দোকানি খদ্দের সামলাচ্ছে … আর মুখে গুনগুন করছে …
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে…
আলু তুলছে লোকটি … পাল্লার ফের দেখছে আর গুনগুন করে চলেছে। ব্যস্ত সময়। তাই ফজল আর আলাপ জুড়ল না। কোনো কিছু না কিনে আকবরকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়।
– কিছু কিনবেন না?
– না। দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়ে গেছে।
সিঁড়ি ভেঙে ডানে বাঁক না নিয়ে বাঁয়ে পা বাড়ালে ফজল জিজ্ঞেস করে, এদিকে কেন?
– আপনাকে আর একটা মনোহারি দোকান দেখিয়ে দিই।
যে-পথে এসেছিল আবার সে-পথ। ডানে ফলের দোকানগুলি পার হতেই দুটি মনোহারি দোকান। প্রথম দোকানে ঢুকে আকবর প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী শ্যামলা চেহারার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়।
– আমার বড়ভাই … আপনার দোকান দেখিয়ে দিলাম। কিছু লাগলে আসবেন।
– ঠিক আছে, স্মিত হেসে ভদ্রলোক সালাম দেয়।
– তাহের সাহেব চলি। নতুন বাজারটা ভাইকে দেখাতে এনেছিলাম, বলে আকবর।
– ঠিক আছে। আমার এখানে আসবেন। সব পেয়ে যাবেন। চাল, ডাল, আলু-পেঁয়াজ আছে। শুধু
তরি-তরকারি নেই।
নতুন বিপণি। সুসজ্জিত। অনেক উপাচার। দৃষ্টিনন্দন। ভালো লাগে ফজলের।
ফিরতে ফিরতে ফজল আকবরকে বলে, বাজারে একটা লোককে গান গাইতে দেখেছ?
– গান! কই না তো।
– জোর গলায় নয় … চাপা সুরে গাচ্ছিল …
– আমি খেয়াল করিনি …
– অবশ্য বাজারের হাঁক-ডাকে তোমার খেয়াল না করারই কথা। লোকটা মনে হয় গ্রামীণ888sport live chatী। গান গেয়ে পেট চলে না, তাই দোকান দিয়েছে।
– কোন লোকটার কথা বলছেন?
– ওই যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে প্রথম যে-লোকটা পড়ে। গেঞ্জি গায়ে। মাথায় টুপি – পাতলা মতো … পরনে চেক লুঙ্গি।
– আমি ঠিক খেয়াল করিনি। তবে লোকটার চেহারা মনে পড়ছে। অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। মনে হয় ভাবের ঘোরে থাকে।
– ঠিক ধরেছ। আলু মাপছে, মনে হয় যেন আলুর কোনো ভর নেই। হাওয়ায় ভাসছে … আর লোকটা মনে হয় যেন অশরীরী কোনো আত্মার মতো।
– না। আমার ঠিক অতোটা মনে হয়নি। অবশ্য আপনি ভালোভাবে লক্ষ করেছেন … আপনার ওরকম মনে হতে পারে।
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো …
মনে মনে গুনগুন করতে করতে ফজলের অজান্তে কখন তা শব্দরূপ ধারণ করে।
আকবরের কানে যায়।
– গানটা ইদানীং খুব জনপ্রিয় হয়েছে। বলে আকবর।
– আসলে শাহ আবদুল করিম একটা প্রতিভা।
– তা ঠিক। লোকপ্রতিভা। কোনো লেখাপড়া নেই, ট্রেনিং নেই … অবশ্য লোকে বাউল-সম্রাট বলে।
দিন যায়, রাত যায়, যায় সপ্তাহ, মাস, বছর, দশক … দেখতে দেখতে ফজল অবসরে পৌঁছে। প্রথমে ফ্ল্যাটের কমিটির দায়িত্বে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লোকে তাকে ভালো মানুষ বলে বটে, নির্বাচনের সময় তার প্রতিফলন মেলেনি। আকবর প্রথমবার নির্বাচিত হলেও ঠোঁটকাটা বলে দ্বিতীয়বার আর জায়গা পায়নি।
প্রথম ঘটনাটা তার এখনো মনে পড়ে। স্থপতি খুব সুন্দর একটা নকশা করে প্রার্থনাসহ অর্থাৎ নামাজ পড়ার জায়গা মানে মসজিদ নির্ধারণ করেছিল।
কয়েক মাস না যেতেই দাবি উঠল যে, প্রার্থনা কক্ষটিতে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না … তাই পাশে কিছুটা জায়গা বাড়াতে হবে।
ফজল-আকবর সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা চালায়, সুন্দর জায়গাটা বেখাপ্পা হয়ে যাবে। এর মধ্যেই স্থান করে নিতে হবে। কেউ শোনে, কেউ শোনে না। শেষে গেল ভোটাভুটিতে।
ছ-জন মাত্র পূর্ব-নকশার পক্ষে ছিল। বাকিরা বিপক্ষে। মোট সদস্য নব্বই। ফল বেরোনোর পরদিন দুড়দাড় করে শুরু হলো দেয়াল ভাঙা। খুব উৎসাহের সঙ্গে কাজ চলতে লাগল।
ফজলের কাছে সেগুনবাগিচা এখন পুরনো হয়ে উঠেছে। তার আকর্ষণ শুধু কাঁচাবাজারের সেই দোকানদার। তার কাছে গেলে ভদ্রলোকের অনেক ক্ষতি হতো। খদ্দের এই দোকানের সামনে দাঁড়াত না। তাতে অবশ্য দোকানির ভ্রƒক্ষেপ নেই। আধ্যাত্মিক জগতের দুজনই মশগুল হয়ে উঠত। একজন শিক্ষিত। একজন স্বশিক্ষিত।
সেগুনবাগিচা এক দশকে অনেকটা উচ্চতা লাভ করেছে। 888sport live chatকলা ছিল অর্ধনির্মিত। ওটা পরিপূর্ণ। আর্ট গ্যালারি ভবন চারতলা থেকে আটতলা। রমনা গার্ডেনকে আড়াল করে। সেগুনবাগিচার সৌন্দর্যে খ্যাংরাকাঠি হয়ে দুর্নীতি দমনের পেছনদিকে নির্মিত হয়েছে একটি ত্রিশতলার সরকারি ভবন।
সামনে ঈদ-উল-ফিতর। তার ঠিক দুদিন পর ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পদার্পণের ১লা বৈশাখ। গোটা দেশজুড়ে আনন্দমেলা। 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে রাত নেই, দিন নেই। ছেলেমেয়েরা নানা উপকরণ নির্মাণে নির্ঘুম। সেই যে মঙ্গলশোভাযাত্রা ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু – দুরু দুরু বুকে আজ তা প্লাবন। এরই জোয়ারে কিশোরগঞ্জে মিঠামইন থেকে অষ্টগ্রাম পর্যন্ত অঙ্কিত হয়েছে ১৪ কিলোমিটার সড়ক-আলপনা। রাজধানী থেকে আজ হাইওয়েও বাঙালিয়ানায় রেঙে উঠেছে। জাতিসংঘ দিয়েছে স্বীকৃতি। বাঙালি জাগছে। 888sport app ফাঁকা। ঈদোৎসবে।
কাঁচাবাজারে ঘুঘু চরে। ফাঁদের ভয়ে ওরা দোকানে ঢোকে না। দোকানের প্রবেশপথের বাঁদিকে চালের বস্তা সাজানো। কিছু চাল নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। না হয় সময় পেলে চড়ুই-ঘুঘু প্রতিযোগিতায় নামত।
ঈদের ছুটি শেষ। শহর ধীরে ধীরে সজীব হচ্ছে, বাড়ছে কোলাহল। খুলছে দোকানপাট। কাঁচা-সবজির জন্য ফজলকে বাজার টান দেয়।
বেলা দশটা।
ফজল বাজারে গিয়ে দেখে, পরিচিত সাধু দোকানদার অনুপস্থিত। সামনে কোনো সবজিও নেই। তার মানে দোকানি ফেরেনি। ঈদের ছুটি উপভোগ করছে।
সে অন্যদের কাছ থেকে সওদা নিয়ে বাড়ি ফেরে।
তিন দিন পর আবার বাজার।
এ-এক নিত্যনৈমিত্তিক খেলা। আগের কালে গল্পে চটের থলি থাকত বাজারির হাতে। আজ নির্ভার। দোকানি পলিব্যাগ দেবে। ছোটর পর একটা বড় ব্যাগ। মধ্যবিত্তরা এটা না দিলে চেয়ে নেবে। ভাবখানা এমন, এতো টাকার মাল খরিদ করলাম, যেন ব্যাগ দিয়ে যা উসুল করবে। সামনের দোকানে চৌদ্দ-পনেরো বছরের একজন ফর্সা কিশোর দোকান সাজিয়ে বসে। কোনোদিন দেখেনি।
– তোমার বস কোথায়?
– আমিই বস।
– এখানে যিনি বসতেন?
– তিনি তো মারা গেছেন।
– মারা গেছেন!
– হ্যাঁ। দিন সাতেক হবে। এখন দোকানটা আমি আর আমার বড়ভাই মিলে নিয়েছি।
শকটা হজম করতে ফজলের সময় লাগে। সে দোকানিকে 888sport live chatীভাই বলে সম্বোধন করত। আসল নাম কোনোদিন জিজ্ঞেস করেনি। বাড়ি কোথায়, ঠিকুজি কী … কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।
– আচ্ছা, উনার নাম কী ছিল বলো তো!
দোকানি ছেলেটি পাশের দোকানিকে জিজ্ঞেস করে, এই চাচার নাম কী ছিল?
– ভাণ্ডারি …
– ভাণ্ডারি!
ফজলের কাছে খুব অবাক লাগল। ভাণ্ডারি এদেশে কোথায় নাম আছে? ভাবে, সম্ভবত মাইজভাণ্ডারির অনুসারী ছিলেন, তাই লোকে নাম দিয়েছে ভাণ্ডারি। আবার অনেক সময় সাধক নিজের নাম বলি দিয়ে পূজ্যর নাম নিয়ে খুশি হয়। যেমন অনেকের নাম আছে চিশতি। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি ঘরানার মুরিদ। নিজের নাম কুরবানি দিয়ে হয়ে দাঁড়ায় চিশতি।
ফজল জীবনের পুরনো পাতাগুলি উল্টে চলে। এখানে একটা লোক যে উধাও হয়ে যেতে পারে তার ধারণায় আসে না।
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজার আর 888sport live chatীভাই তার কাছে একটা মালার ফুলের মতো গাঁথা ছিল। ফুলটা শ্বেতপদ্ম। মাথায় গোল সাদা টুপি। মুখে সাদাকালো দাড়ি। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, সাদাকালো চেক লুঙ্গি … যা একসময় চট্টগ্রামের সওদাগরদের একচেটিয়া পোশাক ছিল। অবশ্য সওদাগরদের কোমরে থাকত চওড়া বেল্ট। বলতে গেলে এটা ব্যাংক। আঞ্চলিক ভাষায় সওদাগররা সংক্ষেপে সদর হয়ে গেছে। সদর একটা আভিজাত্য বহন করে। হবেই না বা কেন, মধ্যযুগের চাঁদ সওদাগরের কাহিনি তো সারা বাংলা 888sport live footballে একচ্ছত্র রাজত্ব করে গেছে।
বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি কে না জানে? এই লোককাহিনি live chat 888sportেও ভালো বাজার পায়। এমনকি বেদের মেয়ে জোছনা তো দু-বাংলায় মাত।
888sport sign up bonusর পাতা উল্টোতে শুরু করে ফজল।
প্রথম দিন শুধু গুনগুনানি শুনেছিল : তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো…
পরের দিন। বাজারে পৌঁছে শোনে অন্য সুর : কান্দে হোসেন হায়রে হায় … কলিজা মোর ফাইটা যায় … ইমামকে যে রাইখা আইলাম প্রাণের মদিনায় গো … ইমামকে যে রাইখা আইলাম প্রাণের মদিনায় …
– আপনি কি যাত্রা করেন?
সরাসরি প্রশ্ন করে ফজল।
– না, গান করি, ভরাট অথচ খানিকটা ভাঙা কণ্ঠে বলেন ভদ্রলোক।
– তাহলে তো আপনি 888sport live chatীমানুষ। এই বিপণি জগতে এলেন কী করে?
– রামপ্রসাদ তহশিলদারিতে যোগ দিয়েছিলেন কেন?
– পেটের দায়ে।
– তাহলে ধরে নেন আমি শখে দোকানদারি করি …
ফজল সূক্ষ্ম ঠেসটা ধরতে পারে। বুঝে ফেলে মাল সেয়ানা। কথা বলতে গেলে ভেবেচিন্তে বলতে হবে।
– কোথায় গান করেন?
– বাঁধাধরা কিছু নেই। যারা ডাকে – সময় পেলে যাই। না হয় যাই না …
– আপনি এটাকে প্রফেশন হিসেবে নিতে পারতেন। তাহলে এই একঘেয়ে কাজ করতে হতো না।
– আপনি কী করেন?
– মাস্টারি।
– ওটা একঘেয়ে নয়?
– শিক্ষকতায় ছুটিছাটা পাওয়া যায়।
– আমিও ইচ্ছা হলে দোকান না বসাতে পারি।
– কিন্তু খদ্দেররা …
– অন্য দোকানে যাবে। দোকানের অভাব আছে নাকি। আপনি দেশের বাইরে যেতে চাইলে এনওসি লাগবে। আমার তা লাগে না।
মনে মনে ফজল ভাবে তাই তো, এটা তো সে কখনো ভাবেনি? সে তো রাষ্ট্রের দাস। অথচ এই কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা স্বাধীন নাগরিক। তার অন্তর্গত আভিজাত্য ঠুনকো। মনে হলো লোকটার পায়ে সালাম ঠুকে।
888sport sign up bonusর পাতা উল্টোতে থাকে ফজল। দশ-পনেরো বছরের 888sport sign up bonus … কম সময় তো নয়, দেখা হলেই তাদের আলাপ জমে যেত। দোকানি888sport live chatী তাকে পেলে বেচাকেনা কমিয়ে দিত। আলু মাপতে মাপতে কথা বলত। তার সেই মেদহীন বেঁকে যাওয়া লম্বাটে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ 888sport sign up bonusপটে ভেসে ওঠে। মনে পড়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা উঠেছিল।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ … কথাটা শেষ করতে পারেনি ফজল … 888sport live chatীভাই বলে বসেন, রামকৃষ্ণ তো কোনো নাম নয়, ওই সাধকের নাম তো গদাধর চাটুজ্জে।
দুটো পদই অচেনা ফজলের। সে ব্যাপারটা বুঝতে না দিয়ে বলে, গদাধর তো বিষ্ণুর চিহ্ন … রামকৃষ্ণ তো কালিসাধক।
– সে তো রানী রাসমণির দৌলতে গদাধরের গদি লাভ। বেলুড় মঠের জন্য একজন পুজারির খোঁজ করছিলেন রানী। ঘটনাচক্রে গদাধর গদি লাভ করেন।
– যাই বলেন, সনাতনধর্মীদের মধ্যে তার অনেক প্রভাব আছে।
– তা থাকবে না কেন। ওকে সবাই ভালোবাসে। তিনি চার বছর একটানা ইসলাম ধর্মের চর্চা করেছেন। তেমনি খ্রিষ্টান ধর্ম। এভাবে গবেষকদের মতো কেউ কাজ করেছেন? তারপরই তিনি উচ্চারণ করলেন : যত মত … তত পথ। তাঁর মতো বাংলায় আরো অনেক সাধক ছিলেন – যেমন লোকনাথ, অনুকূল ঠাকুর, বামাক্ষ্যাপা … মতুয়া সাধক … নামটা মনে আসছে না …
– তবে রামকৃষ্ণ সবার ওপরে উঠে গেলেন।
– সেটা বুদ্ধিজীবীদের বদৌলতে। তাছাড়া নরেন দত্ত বা বিবেকানন্দের মতো শিষ্য পেয়ে তিনি উপরে উঠেছেন। আজ সারা বিশ্বে রামকৃষ্ণ মিশন ছড়িয়ে আছে। 888sport free betও তো দেড়শোর ওপরে।
এসব কথা শুনতে শুনতে ফজল অবাক হয়ে যেত। তার মনে হতো, সে যেন ১৮৯৩ সালের শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে পৌঁছে গেছে … তার সামনে দোকানির বেশে স্বামী বিবেকানন্দ ভাষণ দিয়ে চলেছেন। বিবেকানন্দ ভারতীয়দের ডাক দিয়েছেন : ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত স্থির হয়ো না … ভারতের সেই স্বাধীনতার ডাকের প্রতিধ্বনি শুনতে পায় ফজল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে –
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম … এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম …
জয় বাংলা…
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নানারূপে সংঘটিত হয়। সে মনে মনে বিশ্লেষণ করে।
ফজল ভাবে, এমন এক সাধকের সন্ধান সে এই সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারেই পেয়েছিল … যার নাম সে জিজ্ঞেস করেনি। বাড়ি কোথায় তা-ও জিজ্ঞেস করেনি। কেমন শিক্ষক সে? নিজের প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায় না।
জীবন মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। এখনো ফজল সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারে যায়। ভাণ্ডারির দোকানটি ভিন্ন মানুষে ভরে গেছে। কোথাও কোনো ফাঁক নেই। শুধু ফজলের মনের ভাণ্ডারটির একটি অংশ শূন্য।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.