যুগান্তকারী সেতারি বিলায়েত খাঁ প্রায় দুদশক আগে আমেরিকার নিউ জার্সিতে চলে গিয়েছিলেন। তবে কোনো জনপ্রিয় কিংবা মিডিয়া-মাতানো কর্মসূচি নিয়ে নয়। শোম্যানশিপের মেজাজও তাঁর ছিল না। ইউনিভার্সিটি টাউন প্রিন্সটনে বিলায়েতের সেতারবাজের বিশাল আর্কাইভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলার সঙ্গে, বিশেষত কলকাতার সঙ্গে, তাঁর সম্পর্কের গভীরতায় ভাটা পড়েনি কখনো। প্রায়ই আসতেন, বিশেষত শীতকালে (শেষের দিকে গরম সইতে পারতেন না একদম, মঞ্চের অধিক লাইটও না, এমনকী স্টেজ থেকে উঠেও যেতে হয়েছে দু-একবার, জন্মানো এবং জীবন কাটানো যে-দেশে সে-দেশের গরম সইছে না বলে দুঃখও করতেন)। এসে থাকতেন হেস্টিংসের বাড়িতে, কখনোবা রায়চকের শ্যামলিমা আবাসনের পাখিরালয় গোত্রের অন্তর্ভুক্ত তাঁর অতিশয় প্রিয় বাড়িটিতে।
বিলায়েত খাঁ কলকাতায় শেষ অনুষ্ঠান করেন এ বছরেরই পয়লা জানুয়ারি। 888sport apkনগরীতে সানাইসম্রাট বিসমিল্লা খাঁর সঙ্গে তাঁর সেতার বিমোহিত করে রেখেছিল হলের প্রত্যেক শ্রোতাকে। এরপরে ১১ জানুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন তিনি মুম্বাইয়ে। সেটাই সেতারসুলতানের শেষ অনুষ্ঠান। তারপরেই বিলায়েত খাঁ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, যে-কারণে মুম্বাইয়ের ৬ মার্চের অঙ্গীকারবদ্ধ অনুষ্ঠানটিও আর করতে পারেননি। তাঁর ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছে বলে চিকিৎসকরা সন্দেহ করেন ২২ ফেব্রুয়ারি। ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে চিকিৎসার জন্যে মুম্বাই নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার যশলোক হাসপাতালে ১৩ মার্চ রাত ১১টা ১০ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সেতারের নতুন দিকনিদের্শক এই অমর 888sport live chatী।
বিলায়েত খাঁর মরদেহ কলকাতায় আনা হয় ১৪ মার্চ রাত্রে। সঙ্গে আসেন স্ত্রী জুবাইদা (এলিজাবেথ), দুই ছেলে সুজাত খান আর হিদায়েত খান (দুজনই প্রতিষ্ঠিত সেতারবাদক)। সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের শবাধার, যেন আজীবন সৌখিন প্রকৃতির 888sport live chatীর নিজস্ব রুচিমাফিক তৈরি করা। তাতে পিতলের প্লেটে লেখা : উস্তাদ বিলায়েত খাঁ। মৃত্যু ১৩.৩.২০০৪। বিমানবন্দর থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় দক্ষিণ কলকাতার সানি টাওয়ার্সের ১১ তলায় এক গুণমুগ্ধের সুবিশাল ফ্ল্যাটে। কফিন রাখা হয়েছিল বিশাল হলঘরে। শবাধারের ঢাকনা ছিল খোলা। মরহুমের মাথার পেছনে ছিল বিলায়েত খাঁর ছবি – মাতা বসিরন বেগম ও পিতা ইনায়েত খাঁর প্রতিকৃতির পদপ্রান্তে রাখা। রাত না-কাটতেই সেখানে আসতে থাকে 888sport live chatীকে শেষবারের মতো দেখার জন্যে তাঁর স্বজন, সহ888sport live chatী, ভক্ত, বন্ধু ও ছাত্রছাত্রীর অনিঃশেষ মিছিল।
888sport apk download apk latest version জানাতে আসেন স্বনামধন্য সরোদিয়া আমজাদ আলি খান। বিলায়েত খাঁকে ‘সেতারের কিংবদন্তি’ আখ্যায় 888sport app download for android করে আমজাদ বলেন, ‘তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ইমদাদখানী ঘরানা, ইনায়েতখানী ঘরানা বা কখনো ইটাওয়া ঘরানার সেতারবাদক বলে। খানসাহেব ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। আসলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেই একটা ঘরানা হয়ে উঠেছিলেন। সেতারের দুনিয়া তাঁকে 888sport app download for android করবে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ ঘরানা হিসেবেই। সেতারবাদনকে অন্যমাত্রা দিয়েছেন বিলায়েত খাঁ।’ ভারতীয় রাগসংগীতকে বাদনশৈলীর মাধ্যমে যাঁরা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন, বিলায়েত খাঁ তাঁদের অন্যতম। যেমন দেশে-বিদেশে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন তিনি, তেমনই তাঁর ছাত্রছাত্রীও ছড়িয়ে রয়েছেন বিশ্বময়। এঁরা এবং তাঁর দুই সুযোগ্য পুত্র বিলায়েত খাঁর পরম্পরা বয়ে নিয়ে যাবেন বলে মনে করেন সরোদ-তারকা আমজাদ আলি খান।
১৫ মার্চ সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বিলায়েত খাঁর মরদেহ রবীন্দ্রসদনের সামনে রাখা হয়, সর্বসাধারণের 888sport apk download apk latest versionজ্ঞাপনের জন্য (গভীর রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন বিলায়েত, রবীন্দ্রনাথও শিশু বিলায়েতের 888sport live chatীসুলভ কথা আর ন…ম ম রে সা… গাওয়া শুনে বলেছিলেন, ‘ইনায়েত খাঁ! এই ছেলেটাকে সামলে রাখবে’, (কোমল গান্ধার পৃ. ৪৬)। বিকালে পার্ক সার্কাসে পিতা মহান888sport live chatী ইনায়েত খাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় সেতারসাধক বিলায়েত খাঁকে, তাঁর ব্যক্ত ইচ্ছানুসারে। বিলায়েত খাঁর 888sport app download for androidে প্রথম অনুষ্ঠানটিও হয় তাঁর শহর কলকাতাতেই। ‘নন্দন’-এর নিবেদনে ‘সুতানুটি পটকথা’ আয়োজিত চার দিনের উপস্থাপনসহ শাস্ত্রীয় সংগীতের আলোচনায় ছিলেন আমজাদ আলি খান। তারই শেষ দিনের অনুষ্ঠানটি (১৭ মার্চ) তিনি নিবেদন করেন সদ্যপ্রয়াত মহান888sport live chatী বিলায়েত খাঁকে 888sport apk download apk latest version জানাতে। আমজাদ নিজে তা জানিয়েছিলেন সকলের মন ছুঁয়ে যাওয়া সরোদ বাজিয়ে। উপস্থিত ছিলেন মরহুমের প্রথমা পত্নী মনীষা ও কন্যা ইমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু গুণিজন।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ১৫ ও ১৮ মার্চের উপরে বর্ণিত 888sport world cup rateগুলো ছাড়াও পত্রিকাটিতে ছাপা হয় উস্তাদ বিলায়েত খাঁর মহাপ্রয়াণে পণ্ডিত রবিশঙ্করের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। ‘ওর সংগীত ভালোবেসেছি, ভালো বলেছি : রবিশঙ্কর’ শিরোনামের 888sport world cup rateটি নয়াদিল্লি থেকে পাঠিয়েছেন সৌভদ্র চট্টোপাধ্যায়।
প্রতিবেদক লিখেছেন, ‘পণ্ডিতজীর চাণক্যপুরীর বাড়িতে খাঁ খাঁ করছে বিশাল হলঘর। বিলায়েত খাঁর সঙ্গে রবিশঙ্করের শেষ দেখা হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে, এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে। তারপর আর ফোনেও কথা হয়নি। কিন্তু উস্তাদের অসুস্থতার খবর পেয়ে রবিশঙ্কর, স্ত্রী সুকন্যা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। বিলায়েত খাঁর ছেলে সুজাত খান, শিষ্য অরবিন্দ পারেখের সঙ্গে মাঝে মাঝেই ফোন করে চিকিৎসাধীন 888sport live chatীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতেন পণ্ডিতজী। পরিচিতদের ফোন করে বিলায়েতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশও দিতেন সুকন্যা। গতকাল মাঝরাতে তিনি মুম্বাই থেকে পারিবারিক বন্ধুর মাধ্যমে শোকসংবাদটি পান। তখন অবশ্য রবিশঙ্করকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়নি। আজ সকালে ঘুম ভাঙলে পণ্ডিতজী জানলেন, বিলায়েত খাঁ আর নেই।’
খবরটা শুনেই রবিশঙ্কর ফিরে গেলেন বিলায়েতের সঙ্গে তাঁর সখ্যের দিনগুলোতে। তাঁকে তিনি প্রথম দেখেছিলেন ১৯৩৯ সালে ইলাহাবাদ সংগীত-সম্মেলনে এবং তাঁর বাজনাও প্রথম শুনেছিলেন সেখানেই (যখন বিলায়েতের বয়স ১১ আর রবিশঙ্করের বয়স ১৯)। একবছর আগে পিতাকে হারানো এই ছেলেটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সকলের মতো রবিও চিন্তিত হয়েছিলেন সেদিন। ‘কিন্তু কিছু সিনিয়র ছাত্রের থেকে শুনে, ওর মায়ের থেকে শুনে, দাদামশাইয়ের থেকে শুনে এমনভাবে রেওয়াজ করে কীভাবে এত বড়ো একজন 888sport live chatী হয়েছিল! এটা মির্যাকল।’
রবিশঙ্কর বলেন, ‘বিলায়েতের সঙ্গে তাঁর শৈলী চলে গেলেও তাঁর ঘরানার বাহক তৈরি আছে। ফৈয়াজ খান সাহেবের সঙ্গে গানের আগ্রা ঘরানা সত্যি শেষ হয়ে গিয়েছে। এক্সপোনেন্ট বা ধারকরাই তো ঘরানা বাঁচিয়ে রাখে। বিলায়েত খাঁর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ওঁর নিজের ঢংটা শেষ হয়ে গেল; কিন্তু ঘরানাটা শেষ হয়ে যায়নি। ওঁর পুত্র সুজাত খাঁ বাজাচ্ছে, ভাই ইমরত খান আছে, সৈয়দ পারভেজ বাজাচ্ছে, অরবিন্দ পারেখ আছে। এত ভালো ভালো সাগরেদ তৈরি করে গিয়েছে। এটাও তো বড় কথা।’ রবিশঙ্কর জানালেন, ‘১৯৪৩-৪৪ সাল থেকে আমি দিল্লিতে আসতাম অনুষ্ঠানের জন্য। সে-সময়ে বিলায়েতের সঙ্গে আমার খুব জমে গিয়েছিল। ’৬০-এর দশক পর্যন্ত কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লিতেও আমাদের একসঙ্গে সময় কাটত।’
আমরাও জানি, দুজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে ষাটের দশক থেকে। কারণ তখন থেকেই দুজন নতুন বিলায়েত খাঁ আর রবিশঙ্করের সৃষ্টি হতে থাকে। সেতারের অবয়বে নানারকম পরিবর্তন এনে সুপরিণত গায়কী অঙ্গের বয়ানসহ অনুষ্ঠান শুরু করেন বিলায়েত। অন্যদিকে রবিশঙ্কর শুরু করেন পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র, যন্ত্রী ও পপতারকা নিয়ে নানাবিধ মিডিয়াপ্রিয় তৎপরতা। একজন সেতারবাদনে অপূর্ব গায়কী অঙ্গ যোজনে সফল এবং দেশে অধিক জনপ্রিয়। আরেকজন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের মেলবন্ধনপ্রয়াসী এবং বিদেশে অধিক জনপ্রিয়।
খোলা কথা বলার লোক বিলায়েত অনুযোগ করতেন রবিশঙ্করজী সেতারের প্রতি একনিষ্ঠ না-থেকে ভুল পথে চলেছেন, দেশের উত্তর-দক্ষিণের এত মৌল মিল থাকা সত্ত্বেও যেক্ষেত্রে মেলবন্ধন হয় না সেক্ষেত্রে বিশ্বের পূর্ব-পশ্চিমের এত গরমিল মিটিয়ে মেলবন্ধন কামনা একটা অলীক কল্পনামাত্র, ফিউশন কেবল কনফিউশনই বাড়াতে পারে, আমি যেখানে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি সেতারের কাছে তিনি সেখানে সেতারকে বিকিয়ে দিয়েছেন নিজের কাছে, উনি সেতার থেকে কেবল নিয়ে চলেছেন আমি সেতারকে কেবল দিয়ে চলেছি।
সেতারের প্রতি একনিষ্ঠ না-থাকার কারণে বিরাট সেতারি হতে না-পারার কথা রবিশঙ্কর নিজেও বলেছেন তাঁর আত্মজীবনীর অনুলেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যকে, সত্তরের দশকের শেষের দিকে :
‘আরে ভাই, সেতারটা আমি বাজালামই বা কতটা! সবাই বলে, আমিও বুঝি যে, এতখানি জীবনে সব ছেড়ে-ছুড়ে যদি সেতারটা নিয়েই পড়ে থাকতাম তাহলে হয়তো বিরাট এক সেতারি হতাম। যৎকিঞ্চিৎ যা-ই বাজাই, আমার কপাল ভালো, গুরুদেবের আশীর্বাদ আছে, সারা জগতে কত সমাদর পেলাম, লোকেরা ভালোবেসে শুনতে আসে, আমিও ভালোবেসে ঢেলে দিই যা আছে আমার কাছে। আমি কিন্তু জানি, আমি কি এবং কোথায়।’ (পৃ. ২২৫, রাগ-অনুরাগ)।
ফিউশন সম্পর্কে বিলায়েত খাঁর মরণোত্তর প্রথম সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে রবিশঙ্কর বলেন, ‘আমি কোনো দিন ফিউশন মিউজিক করিনি। যা কিছু করেছি, সবটাই ভারতীয় রাগ ও তালের ওপর ভিত্তি করে। আমি পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র ও 888sport live chatীদের সঙ্গে কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। সৃষ্টিশীল লোক স্যুট পরে, পাজামা-পাঞ্জাবিও পরে। নিজস্বতা থাকলে তা কখনোই হারায় না।’
সদ্যপ্রয়াত বিলায়েত খাঁর বাজনার সঙ্গে তাঁর বাজনার তুলনামূলক কাটাছেঁড়ায় আজ আগ্রহী নন রবিশঙ্কর। তিনি বলেন, ‘এ বলতে অনেকক্ষণ সময় লাগবে। এর মধ্যে আমি ঢুকতে চাই না। ও বাবা ইনায়েত খাঁ সাহেব, ঠাকুর্দা ইমদাদ খান সাহেবের থেকে ঢং পেয়েছিল। নিজেরও অসম্ভব সৃজনশীল প্রতিভা ছিল। হি ওয়াজ আ জিনিয়াস। তাই ও নিজের ঘরানাকে এত সুন্দর সাজাতে পেরেছিল।’
ক্রিয়াসিদ্ধ 888sport live chat সেতারবাদনের এই ক্রিয়াত্মক দৃষ্টান্ত আর ঘরানার ব্যাপারে নিজের শিক্ষাজীবনের বিশেষ অসুবিধার কথাও বিস্তারিত বলেছেন রবিশঙ্কর তাঁর আত্মজীবনীতে। বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে যখন তিনি সেতারের তালিম নিতে শুরু করেন, তখন তাঁর চোখের সামনে কোনো দৃষ্টান্ত ছিল না। কারণ বাবা সেতারটা নিজে কখনো বাজাতেন না, যদিও শিখেছিলেন এবং জানতেন সবই। অর্থাৎ যেমন বসে বাজানো – যেমন করে উনি সরোদ বা বেহালা বা সুরশৃঙ্গার, রবাব, পাখোয়াজ, তবলা ইত্যাদি বাজাতেন (পৃ. ৩৩, রাগ-অনুরাগ)। অন্য কথায়, বিলায়েত খাঁর মতো সেতারের কোনো ঘরানা পাননি রবিশঙ্কর; ঘরানা বানানওনি তিনি। বরং কৃতির বিষয়ে ক্ষেত্রবদল তাঁর পরিবারের সকলেরই যেন দ্বিতীয় প্রকৃতি। ব্যাপারটা আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন – ভ্রাতা উদয়শঙ্করের চিত্রের লোক হয়ে নৃত্যে যাওয়া, স্বয়ং রবিশঙ্করের নাচের লোক হয়ে বাদনে যাওয়া এবং পুত্র শুভশঙ্করের (মাতা অন্নপূর্ণার শিক্ষায়) বাদনের লোক হয়ে ছবিতে যাওয়ার পরম্পরাটা যেন সম থেকে সমে আসার একটা আওর্দা, যেন একটা আবর্ত সম্পূর্ণ করা। (পৃ. ২১৮, রাগ-অনুরাগ)।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই, সাহাবদাদ খাঁ থেকে চারপুরুষের ঘরানাদার বিলায়েত খাঁ তাঁর কোমল গান্ধার নামক আত্মকথায় বলেছেন, ‘তিনি রবিশঙ্করজীর চেয়ে ঘরানায় তো বটেই বাজনায়ও বড়’ (পৃ. ৩৮)। বিলায়েত আরো বলেছেন, ‘মঞ্চে তিনিই সিনিয়র, বয়সে রবিশঙ্কর সিনিয়র হলেও।’ এই বিবেচনাতেই ‘ভারতরত্ন’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বিলায়েত খাঁ, যেহেতু খেতাবটি সিনিয়রকে পরে দেওয়া হয়েছে। রবিশঙ্করজী নিজে অ্যাওয়ার্ডটি নেওয়ার পরে নাকি বলেছেন, ‘ভারতরত্ন’ বিলায়েত খাঁরও পাওয়া উচিত ছিল। আবার তিনি খেতাবটি বিলায়েত খাঁর প্রত্যাখ্যান করার পরেও নাকি বলেছেন, ‘বেশ করেছে বিলায়েত খেতাবটি নেয়নি, কেন দেয়নি ওকে আগে?’ বিলায়েত খাঁর মতে, এসব কথা বলা অর্থহীন। তাঁর আগে খেতাবটি নিতে অস্বীকার করাটাই উচিত ছিল রবিশঙ্করজীর, যেহেতু তিনি নিজে একজন বড় সংগীতজ্ঞ – খেতাবদাতাদের মতো বিষয়বস্তুমূর্খ নন (বিলায়েতের মতে ভারতের বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠতম চারজন যন্ত্র888sport live chatী হলেন বিসমিল্লা খাঁ, আলি আকবর খাঁ, বিলায়েত খাঁ ও রবিশঙ্কর)। আজীবন প্রতিবাদী ও প্রত্যাখ্যানকারী চরিত্রের অধিকারী বিলায়েত খাঁর বোধের অতীত যে, রবিশঙ্কর অন্য তবিয়তের মানুষ।
রূপায়ণাপেক্ষ 888sport live chat গান-বাজনায় কম পটু লোকজন অধিক পটু 888sport live chatীদের অডিশন নেবে, মূল্যায়ন করবে – কেবল তত্ত্বীয় ডিগ্রির বাহানায় – এটা 888sport live chatীর অবমাননা। অতএব 888sport live chatী বিলায়েত খাঁ নিজে আক্রান্ত না হয়েও ক্রিয়াসিদ্ধ 888sport live chatীদের ইজ্জত বাঁচানোর জন্যে প্রতিবাদী হয়ে রেডিওতে বাজানো ছেড়ে দিলেন নিজের পরিণত 888sport live chatীজীবনের শুরুতেই, সেই ১৯৫০ সাল থেকে (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩)। 888sport live chatী বিলায়েতের মর্যাদামতো সম্মানী দেয় না টেলিভিশন। তাই টিভিতে বাজানোও বর্জন করলেন, যখন তিনি কৃতি-খ্যাতিতে 888sport live chatীজীবনের মধ্যগগনে। বোধগম্য কারণে রেডিও-টিভির যাবতীয় অ্যাওয়ার্ডও বিলায়েত সমানে প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮)। অথচ রবিশঙ্কর বিলায়েতকে ফ্যান্টাস্টিক, জিনিয়াস, অতুলনীয় সেতারিও বলেন, ‘ভারতরত্ন’ও অগ্রে গ্রহণ করেন- যেহেতু তিনি নির্বিবাদী-নির্বিকার চরিত্রের মানুষ (মেজাজী বিলায়েতের ক্ষোভ : রবিশঙ্করজী নিজে জেনে-বুঝেও কেন বলে ওঠেন না – বিলায়েতের মাপের সেতারির পরে মঞ্চে ওঠা তাঁর পক্ষে শোভন হয় না)।
প্রতিবেদক বলেন, বিশ্বমঞ্চের তুলনায় ভারতেই বিলায়েতের খ্যাতি বেশি কেন, এ নিয়েও তাঁর মরণোত্তর সাক্ষাৎকারে কোনো মন্তব্য করতে চান না রবিশঙ্কর। তাঁর উত্তর, ‘ভারতে কেন ওঁর জনপ্রিয়তা বেশি, তার বিচার অন্যরা করবে। শালীনতাই বলুন, বা আচরণবিধি, আমি এটায় বিশ্বাস করি। বিতর্ক এড়িয়ে আমার যা বলবার, তার খানিকটা রাগ-অনুরাগ-এ বলার চেষ্টা করেছি। এখন আর কিছু বলতে চাই না।’
বিলায়েত খাঁর ‘গায়কী অঙ্গ’ সম্বন্ধে পণ্ডিতজী কী বলেছেন সেটা পাওয়া যাবে বর্ণিত বইটির ৫৮ পৃষ্ঠা থেকে ৬২ পৃষ্ঠার মধ্যে। তাঁর বক্তব্যের সারকথাগুলো এখানে দেওয়া গেল। সেই যুগেই শুরুর দিকে বীণে, রবাবে, সুরশৃঙ্গারে এবং পরে সুরবাহারেও ধ্রুপদ-ধামার গায়নের প্রায় সমস্তটাই নকল করা হতো। ক্রমে ক্রমে বীণকারগণ গানের পুরোপুরি নকল করা ছাড়াও নানারকমের বোলের সৃষ্টি করলেন। যন্ত্রসংগীতে এই বোলের বৈশিষ্ট্য বাদ দিলে সমস্তটাই গলা বা গানের নকল। এসব বলে রবিশঙ্কর বোঝাতে চাইলেন যে আলি আকবর খাঁ এবং তিনি সেই ১৯৪০ থেকেই যা বাজিয়ে আসছেন তার ঝালা আর বোলের কাজ বাদ দিলে প্রায় সবটাই গানের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ তাঁরা সবাই গায়কী অঙ্গই বাজাচ্ছেন – ঢোলক অঙ্গ বা করতাল অঙ্গ বাজাচ্ছেন না। বিলায়েত খাঁ একটা গানের আস্থায়ী বা তালের ফেরৎ গলায় গেয়ে পরক্ষণেই সেটার নকল সেতারে বাজিয়ে এবং মুখে বলে বলে বোঝান যে এটা সেতারের ‘গায়কী অঙ্গ’। অনেকে এতে খুব ইমপ্রেস্ড হন। এটা বুজরুকি। কেননা সকলেই এই গায়কী অঙ্গই বাজান, তবে গলায় গান না বা মুখে বলেন না (তাহলে কি প্রকারান্তরে এ-ই দাঁড়াল যে বিলায়েতের এই ঢংটা বস্তুত সবাই যা বাজায় তাকে কেবল নিজের বাজ বলে প্রতিষ্ঠিত করার একটা কৌশলমাত্র? অনেকে এতেও বিভ্রান্ত হবেন)।
এ সমস্ত বলার পর পুস্তকে রবিশঙ্কর অবশ্য এ-ও বলেন, ‘তবে হ্যাঁ, এটা আমি তো বারবার বলেছি যে, বিলায়েত অনেকখানি মিড় টেনে দ্রুত লয়ের খেয়াল ঢঙের তানের যে ভেরিয়েশন করে, সেটা অপূর্ব ও চমৎকার এবং সেটা ওঁর একটা নিজস্ব জিনিসই বলতে পারেন। নিশ্চয়ই সেটা গানের একটা অঙ্গ’ (পৃ. ৬১)। প্রসঙ্গটির অন্তে রবিশঙ্কর লেখেন, ‘উলটোটাও সত্য। গায়করাও নকল করে এসেছেন সেতারের বোলের কাজ – নুম তুম তা-না-না-না-না, রি-রে-না-না ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে, যেমন ধ্রুপদ গানে। খেয়ালিয়ারা যখন তারানা গান তখন তাঁরা সেতারের বোল-বিস্তার ব্যবহার করেন, যেমন নিসার হুসেনের দির দির দির ত্রিদোম ত্রিদোম ইত্যাদি (পণ্ডিতজীর উহ্য প্রশ্নটি হলো- এটা কি তবে গায়কের ‘বাদকী অঙ্গ’?)। অনেকের মত আবার বিপরীত। অর্থাৎ তারানা-গানের নকল করে সেতারে রেজাখানী গৎ অথবা দ্রুত গতের উদ্ভব হয়। রবিশঙ্করের শেষ মন্তব্যটি হাস্যরসাত্মক – ‘এখন ভাই কে সঠিক বলতে পারে যে, ডিম আগে সৃষ্টি হয়েছে, না মুরগি?’
‘গায়কী অঙ্গ’ – শব্দবন্ধটিকে হাস্যরসাত্মক অথবা অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হয় না আমার। কেননা সংগীতবিদ ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দৌহিত্র, ‘ইমদাদখানী স্কুল অফ সিতার’-এর প্রতিষ্ঠাতা (১৯৪৮), আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেতারি, বিমলাকান্ত রায়চৌধুরী কর্তৃক রচিত ভারতীয় সংগীতকোষ গ্রন্থে (১৯৬৫) বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে (পৃ. ১৫-১৭, ১২০-১২৩)। এই সংগীত-কোষকারের মতে, সুদীর্ঘকালের প্রচলিত মসীদখানী সেতারবাজ যেসব পরিবর্তনের মাধ্যমে ইমদাদখানী বাজে উন্নীত হয়েছে, তার প্রধান একটি হলো – সেতারে, কণ্ঠের সমস্ত প্রকার তানের প্রচলন, যেসব গায়কী অঙ্গ মসীদখানী বাজে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ছিল না। এ-কারণেই সেতারি এই কোষকার পরিবর্তিত পদ্ধতিটিকে, অনেকের মতো, ‘আধুনিক মসীদখানী’ না-বলে ‘ইমদাদখানী বাজ’ বলে ১৯৪০ সাল থেকেই প্রচার করে আসছেন। তাঁর এবংবিধ প্রচার সংগীতবিশেষজ্ঞ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও সমর্থন করেন বলে গ্রন্থকার জানান :
‘ইমদাদখানী’ পদ্ধতির প্রচলন সম্বন্ধে মনীষী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় গ্রন্থকারকে লেখেন – ‘আপনি ইতিহাসের সমর্থনে ‘এমদাদখানী চাল’ কথাটি ব্যবহার করতে পারেন। এইভাবেই ‘ঘরানা’ ‘ংঃুষব’ ‘চাল’ ‘রীতি’র জন্ম হয়েছে, 888sport live footballে, চিত্রে, সংগীতে, স্থাপত্যে’ (পৃ. ১৭)।
বিলায়েত খাঁ তাঁর পূর্বপুরুষের বাদনপদ্ধতিকে নিজ উদ্ভাবিত অঙ্গ দ্বারা সমৃদ্ধিশালী করছেন বলে সেই ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই তাঁর আলোচ্য সংগীতকোষে উল্লেখ করেন কোষকার (পৃ. ১৫)। রবিশঙ্কর নিজেও সেতারি বিমলাকান্ত রায়চৌধুরীকে ঠবৎংধঃরষব লোক অভিহিত করে লেখেন, ‘ওঁর একটি সড়হঁসবহঃধষ ড়িৎশ হলো গিয়ে ভারতীয় সংগীতকোষ। আমি তো এত ভালো ভারতীয় সংগীতের তথ্যপূর্ণ বই এখন অবধি দেখিনি।’ (পৃ. ১৭১, রাগ-অনুরাগ)।
আলোচ্য প্রসঙ্গটি সম্যক উপলব্ধি করার জন্যে আফতাবে-সেতার বিলায়েত খাঁর গড়ে ওঠার বিশেষ পর্বগুলোর সম্যক অনুধাবন প্রয়োজন। 888sport appsের গৌরীপুরের সংগীতবিদ ও সংগীতের পৃষ্ঠপোষক জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সভাবাদক ইটাওয়ার সেতারি ইনায়েত খাঁর পুত্র বিলায়েত খাঁর জন্ম পিতার কর্মস্থলে, ১৯২৮ সালে। উত্তর প্রদেশের এই মানুষটি তাই নিজেকে গৌরীপুর-কলকাতায় মাখামাখি বাংলার লোক বলতেন (পৃ. ৪৪, কোমল গান্ধার)। বাংলার মানুষ রবিশঙ্কর যেমন বলেন, ‘আমি পারতপক্ষে উত্তর প্রদেশের লোক, কাশিতে জন্ম আমার’ (পৃ. ২৩২, রাগ-অনুরাগ)। বিলায়েত প্রথম সেতার হাতে নেন পাঁচ বছর বয়সে, ১৯৩৩ সালে। পিতা নাড়া বেঁধে শেখাতে শুরু করেন ১৯৩৪ সাল থেকে। তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যদের নাছোড় অনুরোধে শিশুপুত্রকে মঞ্চে বাজাতে হয় ১৯৩৬ সালে। আট বছরের শিশুটিকে তার প্রথম অনুষ্ঠানে সামলে নিয়েছিলেন তবলার কিংবদন্তি আহমেদজান থেরাকুয়া খাঁ সাহেব, তাঁর কুশলী বাদনের ছত্রছায়ায় (প্রকৃতির কী বিচিত্র লীলা! থেরাকুয়া খাঁর জীবনের শেষ অনুষ্ঠানে নব্বই বছরের শিশুটিকে সামলে নিয়েছিলেন সেতারের কিংবদন্তি বিলায়েত খাঁ, তাঁর অলৌকিক বাদনক্ষমতায় (পৃ. ৭২, কোমল গান্ধার)।
বিলায়েত তাঁর পিতার কাছে সেতার শেখার পঞ্চম বছরেই ইনায়েত খাঁ ইন্তেকাল করেন। দশ বছরের ছেলেটিকে শেখানো ছেড়ে বাদক-পিতা পরলোকে চলে গেলেন যেন ছেলেটির গায়কদের হাতে গড়ে ওঠার জন্যেই – যাতে গায়কী ঢংটি শৈশব থেকেই বিলায়েত খাঁর অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং পরিণত বয়সে সে এক অভূতপূর্ব ঢঙের সেতারিরূপে আবির্ভূত হতে পারে এবং সকলে বলে ওঠে – সেতারে খেয়াল গাইছে বিলায়েত। বাস্তবিকই বিলায়েত খাঁর ১৯৬২ সালের তিলক কামোদের রেকর্ডটি শুনে শ্রোতার মনে হয়েছে যেন সেতারে গান বাজছে। এ ধারায় তাঁর গড়ে ওঠার পর্বগুলো ধরা আছে বিকাশশীল 888sport live chatীর চল্লিশের এবং পঞ্চাশের দশকের ধ্বনিমুদ্রিকাগুলোতে। বিবর্তনটি এতোই স্পষ্ট যে, ষাটের দশক থেকেই দাদার নামের ‘ইমদাদখানী ঘরানা’ নবনামাঙ্কিত হতে থাকে পৌত্রের নামের ‘বিলায়েতখানী ঘরানা’ বলে।
আব্বার মৃত্যুর পরে আম্মার নজরদারিতে বালক-বিলায়েতকে তালিম দিতে ঘিরে বসে গিয়েছিলেন তাঁর খেয়ালিয়া নানা বন্দে হুসেন খাঁ, গাওয়াইয়া মামা জিন্দে হুসেন খাঁ আর ততবাদক চাচা ওয়াহিদ খাঁ। মামা গানের রেওয়াজ করাতেন। নানা শেখাতেন খেয়াল, ঠুমরি, ধ্রুপদ, ধামার, দাদরা, সাদরা, কাজরি, হোরি প্রভৃতি। চাচা হায়দ্রাবাদ থেকে দিল্লি এসে প্রতি মাসে আট দিন করে থেকে প্রতিভাবান ভাতিজাটিকে শেখাতেন সুরবাহার। এঁরা সকলে মিলে চাইল্ড প্রডিজি বিলায়েতের রোজকার রেওয়াজের মেয়াদ বাড়াতে বাড়াতে চোদ্দ ঘণ্টায় তুলে ফেলেন। স্মর্তব্য যে, পাশের ঘরের মুমূর্ষু কন্যার পিতাকে শেষবারের মতো দেখার বারংবার প্রেরিত আর্জিটিকে উপেক্ষিত এবং পিতা-পুত্রীকে পরস্পরের অন্তিমদর্শন থেকে বঞ্চিত করেছিল রোজকার রেওয়াজের যে-অলঙ্ঘনীয় মেয়াদ – ইমদাদ খাঁর সেই দৃষ্টান্তমূলক
রেওয়াজটি ছিল দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা আয়ুর চার-মোমবাতির, অর্থাৎ আট থেকে দশ ঘণ্টার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সেকালে মোমবাতি গুণেই গায়ক-বাদকের রেওয়াজের হিসাব নেওয়া হতো। বলা হতো – অমুক উস্তাদ অত মোমবাতির রেওয়াজী। (তবে কি রোজ চার থেকে ছয় ঘণ্টা বেশি রেওয়াজের জোরেই দাদার ঘরানাটার দখল নিয়েছে নাতি? আসলে জীবনভর কঠোর রেওয়াজের ওপর থাকাও বিলায়েত খানের বহুল আলোচিত একটি বৈশিষ্ট্য)। সে যাক। সার কথাটা হলো, গায়ক-বাদকের সম্মিলিত তালিমের প্রক্রিয়াতেই সংবেদনশীল বয়সের বালকের মনের নির্জ্ঞান স্তরে ঘটে গিয়েছিল বাদকী ও গায়কীর রাসায়নিক অঙ্গমিলন। এটাই কালে কালে বিলায়েত খাঁর একটা বড় অবদান হয়ে উঠল – তাঁর ভাষায়, ‘সেতারকে একদম গলা করে দেওয়া’।
পরিণত বয়েসের বিলায়েতের মতেও, বাদকী আর গায়কীর এই নিকট-সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হয়েছে তাঁর বিকাশমান সময়ে নানা আর মামার গানের প্রভাবে। তাঁদের খেয়াল, আস্থায়ী, ধ্রুপদ, ধামার শুনতে শুনতে তাঁর ভেতরে ভেতরে ফুলের মতো ফুটে উঠতে চাইছিল অনেক অনেক রূপ। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সেতারের ভেতর থেকে অনেকগুলো কাজই ভালো রকম বেরোচ্ছিল না। তাই বিলায়েত প্রথমে একটি জুড়ির তার এবং পরে একটা পঞ্চমের তার বার করে দিলেন তাঁর সেতার থেকে। ফলে একটা জুড়ি, একটা পঞ্চম, একটা চিকারি, একটা ছোট চিকারি আর একটা মধ্যমে মিলে পাঁচ তারের হয়ে গেল সাত তারের সেতার (আমীর খসরুর তিন তারের সেতারে দুটি তার যোগ করেছিলেন সম্ভবত মসীদ খান। এর সঙ্গে সেতারে আরো দুটি তার যোগ হয় গোলাম মহম্মদ খান কর্তৃক উদ্ভাবিত সুরবাহারের অনুকরণে)।
ল¤¦া মিড় আর দ্রুত তান আদায়ের জন্যে এভাবে পুরো স্ট্রাকচারের ওপর ধীরে ধীরে বিবর্তন ঘটিয়ে ১৯৬৫ সাল নাগাদ সেতারের গোটা প্যানোরামাটাই বদলিয়ে নিয়েছিলেন বিলায়েত খাঁ। তাঁর মতে, তন্ত্রকারের জন্যেও গানের তালিমটা খুবই জরুরি। তিনি বলেন, তালিমটা না-পেলে ভোকাল ঢঙে গায়কী যতই কপি কর, আবছা-আবছা একটা খাপছাড়া ভাব আসবেই আসবে। আসলে কপি করে এটা হয় না। যন্ত্রের ভেতর দিয়ে গাইতে হবে। গাইবে কী করে, তেমন তালিম না থাকলে? হাঁড়িতে না-থাকলে চামচে আসবে কোত্থেকে?
আসলে ইমপ্রেশনেবল্ বয়সে গায়ক-ট্রেনারদের হাতে পড়ে ক্যারিয়ার-গায়কই হবার ইচ্ছে হয়েছিল বিলায়েতের। হয়েও ছিলেন গায়ক তিনি, প্রায় পেশাদার। গানের প্রোগ্রাম তো করতেনই, রেকর্ডও করেছিলেন অনেক। পঞ্চাশ সালের গোড়াতেই (কোমল গান্ধার পৃ.২০) একদিন কনফারে›েস গানবাজনা করে মহাজাতিসদন থেকে ভোররাতে ঘরে ফিরতেই তাঁকে গান ছেড়ে দিতে বললেন তাঁর ক্যারিয়ার-প্ল্যানার ও প্রধান ট্রেনার – অর্থাৎ মাতা বসিরন বেগম, যিনি ১৯৭৮ সনে পরলোকগমন পর্যন্ত সর্ববিষয়ে পুত্রের পথনির্দেশ করতেন (বিলায়েতও সর্বদা মায়ের নির্দেশ পালন করে চলতেন)।
সেদিন থেকেই মাতৃভক্ত পুত্র গানকে সেকেন্ডারি করে দিয়ে বাজনাকে প্রাইমারি করে নেন। তবে বাজাতে বাজাতে মাঝে-মধ্যে গেয়ে-শুনিয়ে শ্রোতাদ্রের ধরিয়ে দিতেন যে যেটা তিনি গলার ভাষায় গাইছেন সেটাই তাঁরা সেতারের ভাষায় শুনছেন। রেওয়াজেও আম্মাই তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন সার্বক্ষণিক। ছেলে ঘুমে ঢলে পড়লে হাতে-রাখা টেবিল ফ্যানের তারের ছোঁয়ায় জাগিয়ে ফের রেওয়াজ চালু করে দিতেন পুত্রের। অনেক পরে একদিন পুত্রের গান বন্ধ করার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন মাতা। গায়ক বন্দে হুসেনের বেটি হওয়া সত্ত্বেও বাদক ইনায়েত খাঁর পত্নী হিসেবে বসিরনের লয়্যাল্টি ছিল স্বামীর ঘরানার প্রতি। তিনি বলেন – ‘ম্যাঁয় গাওয়াইয়া চাহতি নেহি, ম্যাঁয় সেতারিয়া চাহতি।’ এ কারণেই পরে তিনি বলে-কয়ে বিলায়েতের সুরবাহার বাদনও বন্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন – যাতে সে কেবল সেতারের সাধনাতেই একনিষ্ঠ হয়ে থাকে। তাই ছিলেন বিলায়েত আজীবন। পুত্রকে মাতা এ-ও স¥রণ করিয়ে দেন যে অন্য আওরত হলে উলটোটাই ঘটত – নিজের পিতৃবংশের 888sport live chatের দিকেই টানত সন্তানকে, স্বামীর পিতৃবংশের 888sport live chatটি ছাড়িয়ে (কোমল গান্ধার পৃ.২০)। তাহলে বলতে হয় যে বিলায়েত খাঁর সেতারে ‘গায়কী অঙ্গ’ গড়ে উঠেছে তাঁর শৈশব-কৈশোরে প্রাপ্ত তরিবত থেকেই, নিজের বিশেষ প্রবণতা আর সংগীতের বিশেষ চর্চার নির্ধারিত ফসলরূপে – যেটাতে স্বভাবতই অভিনব একটা এককত্ব বর্তেছে।
সেতার-ভাস্কর বিলায়েত খাঁর সামগ্রিক অর্জনের মূল্যায়নে বোদ্ধামহল বিগত অর্ধ শতকের বিবেচনা-পুনর্বিবেচনায় যেসব বিষয়ে মোটামুটি একমত হয়েছেন, তার সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণ দিয়েই এই লেখাটি শেষ করব।
হস্তকৌশলের বিচারে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ ছিলেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে পটু সেতারবাদক। তাঁর বাজনার পাশে, ধ্বনিমুদ্রিকায় ধৃত, পিতামহ ইমদাদ খাঁর ও পিতা ইনায়েত খাঁর বাজনাকেও প্রাথমিক পর্যায়ের বলে মনে হয়। বিলায়েতের বাজনার ব্যাপ্তি, গভীরতা ও বৈচিত্র্য এককথায় অতুলনীয়। তবে একথা ঠিক যে তিনি তাঁর পিতার মতো জোরদার দ্রুত বোল অঙ্গের তান-তোড়া তেমন বাজাতেন না। বিলায়েত নিজেই বলেছেন, ‘তাঁর পিতা ডান হাত প্রধান বোল অঙ্গের তান-তোড়ায় উৎকর্ষ সাধন করে গিয়েছেন বলে তিনি আর সে দিকে ঝোঁক দেননি।’ এ কারণেই বাম হাতের মিড়যুক্ত দ্রুত ওঠানামা করা একহারা তান ও দুরূহ জটিল মিড়প্রধান খেয়াল অঙ্গের তানের উৎকর্ষের দিকে মনপ্রাণ সঁপে দিয়ে অসাধারণ সাফল্য লাভ করতে পেরেছেন বিলায়েত।
সব মিলিয়ে এই ‘বিলায়েতখানী’ সেতারবাদনশৈলী অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ একটি শৈলী হয়ে দাঁড়ায় ষাটের দশকের শেষের দিকেই। বিলায়েতখানী এই বাজ সাবেক যে-কোনো সেতার-বাজ বা শৈলীর চেয়ে সর্বাংশেই উন্নত। শাস্ত্রে যন্ত্রসংগীতকে শুষ্ক সংগীত বলা হয়েছে। এই শাস্ত্রবাক্য সেকালের পশ্চিমি ‘মসীদখানী’ বাজ বা পূরবী ‘রেজাখানী’ বাজের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রযোজ্য হলেও ‘বিলায়েতখানী’ বাজের ক্ষেত্রে বাক্যটি বিলকুল প্রযোজ্য নয়। কেননা বিলায়েতের বাজনা সর্বদাই রসে ভরপুর। উন্নত ও মধুর ধ্বনির জন্যে তা সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে অতিশয় আকর্ষণীয়। কারণ আলাপ, খেয়াল ও ঠুংরি গায়কদের কণ্ঠের সব ধ্বনি, সব অলঙ্কার সেতারে উৎপাদন করার নিবেদিতচিত্ত-সাধনায় সফল হয়েছিলেন বিলায়েত।
তাঁর অভীষ্ট এই বাজটি সাধারণ সেতারে পরিস্ফুট হচ্ছিল না বলে বিলায়েত খাঁ তারযন্ত্রটির দুটি নতুন সংস্করণ পরিকল্পন ও বাস্তবায়ন করেন। প্রথম সংস্করণটি ছিল মন্দ্রপঞ্চম ও একটি জুড়ির তার বাদ দিয়ে পাঁচ তারের সেতার। দ্বিতীয় ও শেষ সংস্করণ হলো- মন্দ্রপঞ্চমের জায়গায় গান্ধার স্বরে বাঁধা সরু একটি তার জুড়ে দেওয়া ছয় তারের সেতার। এই নতুন সেতার আজ গান্ধার-পঞ্চম সেতার নামে পরিচিত। বিলায়েত খাঁ পরিকল্পিত সেতারে প্রধান বাজের তার অর্থাৎ নায়কী তার ও জুড়ির তারের মধ্যে বেশ খানিকটা ব্যবধান। ফলে দ্রুত তান বাজানোর সময় জুড়িটি অত বাজে না। কাজেই তান অনেক পরিষ্কার শোনায়। দুই জুড়ি ও মন্দ্রপঞ্চমযুক্ত সাবেক সেতারে এই তারগুলো তানকারির সময় অতিমাত্রায় বেজে তানের স্বরগুলোকে আচ্ছন্ন করে ফেলত। দীর্ঘ মিড় বাজানোর জন্যেও উস্তাদ বিলায়েত খাঁ সেতারের গঠনপ্রণালিতে কিছু সংশোধনী আনেন। সেতার ব্রিজ-এর উপরাংশের সংস্কার করে তাঁর সেতারে বিশেষ ধরনের এক জোয়ারির সৃষ্টি করা হয়। সব মিলে গান্ধার-পঞ্চম সেতার এমনি একটি চারিত্র্য পায় যে তাতে কোনো আনাড়ি মিজরাবের আঘাতও বিলায়েত খাঁ নামটি স¥রণ করায়।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হস্তকৌশলের অধিকারী, নতুন সেতার ও সেতারবাজ-এর উদ্ভাবক ও প্রচারক, ভারতের শীর্ষ সেতারবাদক উস্তাদ বিলায়েত খাঁ তাঁর 888sport live chatীজীবনের প্রথম ভাগে ভারত জুড়ে দরবারি কানাড়া, ইমন, পুরিয়া, শঙ্করা, ভঙ্কার, ঝিঁঝোটি, দেশ, তিলক কামোদ ইত্যাদি রাগের সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ রূপায়ণ পেশ করে সর্বশ্রেণির শ্রোতাদের বিসি¥ত করেন। দ্বিতীয় ভাগে আবার তাঁদের বিমোহিত করেন তিনি ভৈরবী, পিলু, খামাজ, মাঝ-খামাজ ও পাহাড়ি ইত্যাদি রাগাশ্রিত ধুন ও রাগমালিকাতে অপেক্ষাকৃত লঘু ঠুংরি চালের ঐন্দ্রজালিক আদাকারিতে।
তাই উস্তাদ বিলায়েত খাঁর যবনিকার ওপারে চলে যাওয়াকে অন্যকথায় বলা যায় – সেতারের ইতিহাসের মহত্তম অধ্যায়টির মঞ্চে যবনিকা টেনে দেওয়া।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.