দেবেশ রায়
চার
২৩ জুন শেষরাত থেকে চন্দ্র সাঁতরা আর নিমাই ঢালির মতৈক্যঘটিত আবহাওয়ার যে-পূর্বাভাসের ভয়ে চন্দ্র সাঁতরা খালের জলে ফেলে রাখা পাইপ উদ্ধার করতে চাইল ও একটু দরকষাকষি করেও নিমাই ঢালি জলে নেমে গিয়ে ডুবে গেল – মাঝখানে একবার উঠে সে সাঁতরাকে ক্ষ্যান্ত দিতে বলেছিল কি না ও সাঁতরাই তাকে আরো একবার জলে নামতে বাধ্য করল কি না, পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে, এসব গল্পগুজব বাদ দিলেও তো সার কথাটা এই দাঁড়ায় যে, খালের জলে ডুবে নিমাই ঢালি মরে গেছে, যদিও চন্দ্র সাঁতরা ছাড়া আর-একজনও তাকে জলে নামতে ও না-উঠতে দেখেনি, তবু চন্দ্রও তো কখনো সেই কথা থেকে সরেনি, একবারের জন্যও না, এমনকি বডি পাওয়া না-গেলে ডেথকেস করা যাবে না – বড়বাবুর এই কথার পরও তো সাঁতরা টাল খায়নি, বলেছে, স্পট ঠিকই আছে, পাইপটা এখনো তো তোলা হয়নি – সেই পূর্বাভাস, অনুযায়ীই হাওয়া দিয়ে জল ঝরতেই লাগল ২৩ জুন সোমবার শেষরাত থেকেই, সুতরাং বিকেল থেকে রাত খরাও দিয়েছে বটে। ২৩ জুন সোমবার একটি কাগজই ওই জালি-ছবিটা ছেপেছিল বটে, খবর সবাই-ই দিয়েছে, কেউই বেশি দিতে পারেনি। নিমাই ঢালির নামটা কোনো কাগজই পায়নি। বড়বাবু নিশীথ দলুইয়ের নাম সব কাগজই দিয়েছে, বোধহয় একটি কাগজ নাম না দিয়ে বলেছে, ‘স্থানীয় থানা সূত্রে জানা যায়।’ ঢালির বউ-বাচ্চা ও বাড়ির খবর তখনো কাগজ জানে না। চন্দ্র সাঁতরার ব্যাপারও নয়।
কিন্তু ‘ডুবুরি ব্যর্থ’ এই ইঙ্গিতটুকুই তো যথেষ্ট। ২৩ সন্ধ্যার বাংলা নিউজে খাল-সংক্রান্ত কিছু ছবি ও কিছু মতামত দেখানো হলো – সল্টলেকের একজন প্রবীণ অধিবাসী ও একজন ওয়ার্কিং গার্লের। চন্দ্র সাঁতরা ও নিমাইয়ের বউকে খুঁজে বের করা হয়ে গেছে। খালঢালের ওই ঝুপড়িগুলো দেখে ফটোগ্রাফাররা যেন খেপে উঠল – কিন্তু তারা যে ‘মানুষ কী অবস্থায় থাকে’ এই কথাটা ছবিতে দেখাতে পারবে ভেবেছিল সেটা বোধহয় ততটা হলো না কারণ ছবি তোলার জায়গা তো রাস্তা থেকেই, কেউ তো আর খালে নেমে ছবি তোলেনি। একজন রিপোর্টার একটা হেডিং পর্যন্ত ভেবে ফেলল, ‘খাল খেল’।
২৪ জুন মঙ্গলবার এটা প্রথম পৃষ্ঠার বেশ ছড়ানো গল্প হওয়ার সব প্রস্ত্ততিই ২৩ জুন সোমবার সন্ধের মধ্যে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, ‘খাল খেল’ থেকে বদলে ‘খাল গিলল’ – হেডিং পর্যন্ত। জলমৃত্যু বলেই একটা কাগজ নাকি ‘দেবতার গ্রাস’ হেডিংও করেছিল।
কিন্তু ২৪ জুন কাগজে একটি শব্দও বেরোল না, আর চন্দ্র-নিমাই আবহাওয়াটাও আচমকা বদলে গেল, হাওয়া-বৃষ্টি চলে গেল বিকেলে।
২৩ জুন সোমবার রাত পৌনে বারোটার খবরে অনেকে প্রথম জানল, রাষ্ট্রপতি একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে কলকাতা শহর ও তৎসন্নিহিত কিছু এলাকাকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসেবে অধিগ্রহণ করেছেন।
পরে অনেকে বলেছেন, 888sport apps রেডিও নাকি এক ঘণ্টা আগে পাকিস্তান রেডিও থেকে জেনে খবরটা সবচেয়ে আগে দিয়েছে। পাকিস্তান টিভিতে নাকি বলেছে, ভারতের উচ্চতম রাজনৈতিক মহলে দুপুর থেকেই আরো ঠিকঠাক বলতে গেলে, লাঞ্চের পর থেকেই কিছু অস্বাভাবিক ব্যস্ততা লক্ষ করা যাচ্ছে, দর্শকরা যেন টিভিতে নজর রাখেন।
রাত বারোটার পরে অর্থাৎ ২৪ জুন, মঙ্গলবার শুরু হয়ে গেলে জায়গাগুলির নাম জানা গেল ও খবরটা দ্বিতীয়বার ট্রান্সমিশনের সময় একটা ম্যাপও দেখিয়ে দিতে পারল টিভি। কলকাতা করপোরেশন, বেহালা মিউনিসিপ্যালিটি, সোনারপুর মিউনিসিপ্যালিটি, মধ্যমগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি, পানিহাটি মিউনিসিপ্যালিটি, বরানগর মিউনিসিপ্যালিটি ও বালি। এই ‘বালি’ নিয়ে তখন থেকেই বোঝাবুঝির গোলমাল শুরু হয়ে গেল। ‘বালি’ মানে যদি বালিই হয়, তাহলে তা কেন হবে? কারণ, এই ঘোষণা যে পাশাপাশি এলাকাকে ওই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জড়ো করতে চেয়েছে, তাতে ‘বালি’ এলে আরো অনেক জায়গা আসতে হয়। গঙ্গার পশ্চিমপারের কোনো একটা জায়গাও নেই, তাহলে খামোখা ‘বালি’ থাকতে যাবে কেন। আর ‘বালি’ নামটিতে কী বোঝায়, বালি মিউনিসিপ্যালিটি বলা হয় না কেন, তাহলে কি বালি বলতে শুধু ‘বালিঘাট’ – ঝুঝতে হবে, মানে রেলস্টেশন? নাকি বালিগঞ্জের গঞ্জ ছাপা হয়নি?
এসব তো পরের কথা – কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক, কী ভুল, কী ঠিক, কেন ঠিক, কতটা ঠিক এই সব নিয়ে তো এরপর সব গোপন খবর ও বিশেষজ্ঞ-বিশ্লেষণ বেরোতেই থাকবে, ঘটতেই থাকবে, এ তো যেন রাস্তার কুকুর ভিআইপি রোডে ফেলে দেওয়া একটা গোটা লাশই পেয়ে গেছে, খেয়ে শেষ করেও মনে হয় না শেষ হলো, শুকনো খটখটে হাড়ে নিজের দাঁতের আওয়াজ তোলে, মাংসাশী আওয়াজ।
প্রথম ধাক্কাটা তো এলো খবরটা কী সেটাই বুঝতে। বুঝতে-বুঝতেই নিউজ এজেন্সি ও ইংরেজি কাগজগুলি ঘটনাটিকে 6:24 বলে ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। নিউইয়র্কের জোড়া মিনার ও পেন্টাগনের ছোট ছাদ ভেঙে দেওয়ার পর থেকে আমেরিকার কায়দায় মাসের 888sport free bet ও তারিখের 888sport free bet পরে লিখে খবর বোঝানো চালু আছে। সে-রাতের জন্য 6:24 পৃথিবীময় রটে গেলেও ওই ২৪ তারিখের কাগজে কিন্তু ছাপা হয়েছিল ২৩ বলেই, কারণ রাষ্ট্রপতি ২৩ তারিখ বিকেল ৪টা ৩৪ মিনিটে অর্ডিন্যান্সে সই করেছিলেন।
জানাতে-জানাতে মাঝরাত্রি কেন হলো – সেটা তো আরো বহু গল্প। কেন্দ্রীয় সরকারপক্ষের জবাব বরাবরই এতটা একরকম যে, সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক, উত্তরটা ঠিক করার আগে খবরটা ছাড়া হয়নি। কে কখন কোন খবর জানল সেটা দিয়ে তো আর প্রকৃত ঘটনাকাল নির্ধারিত হয় না, রাষ্ট্রপতি যে-সময়ে স্বাক্ষর করেছেন সে-সময়টাই ঘটনাকাল। কীভাবে জানানো হয়েছিল এই অর্ডিন্যান্স, কোনো সাংবাদিক সম্মিলন ডাকা হয়েছিল কি, ইন্টারনেটে দেওয়া হয়েছিল কি। সরকারপক্ষের উত্তর প্রস্ত্তত ছিল ও সেই অাঁটোসাঁটো প্রস্ত্ততিতে বোঝা যাচ্ছিল সামরিক অভিযানে যেমন প্রত্যেকটি মিনিটের মুভমেন্ট কী হবে তা বহু আগে থেকে ঠিক করা থাকে, এই অর্ডিন্যান্স পাবলিক-করার ব্যাপারেও কেন্দ্রীয় সরকার সে-রকম একটি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেছে, ক্যালেন্ডার না বলে অপরিবর্তনীয় টাইম-ট্যাবল বলাই বোধহয় বেশি ঠিক। ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওয়ার্কিং হ্যান্ডবুক (সংশোধিত ১৯৭৭)’-এ লেখা আছে, ‘অর্ডিন্যান্স পর্যন্ত কোনো সরকারি ঘোষণা প্রথম প্রকাশ করিতে হইলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে ‘জনসাধারণের অবগতির জন্য’ বলিয়া চিহ্নিত নোটিশ বোর্ডে সাঁটিয়া দিতে হইবে ও সেই সাঁটার সময়টিকেই সেই আদেশ জারির সময় বলিয়া ধরিতে হইবে।’
সরকারের এই জবাবের পর কেউই আর সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কার্যবিধি খুঁজে বের করে পড়েননি আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নোটিশ বোর্ডে অর্ডিন্যান্সটি টাঙানো সত্যিই হয়েছিল কী না, তাও কেউ যাচাই করে দেখেননি। মাসদুয়েক পরে দিল্লি থেকে প্রকাশিত এক সচিত্র সংবাদ-সাপ্তাহিকে এক শখের ফটো-জার্নালিস্টের একটি ফটো এসে – essay – ছাপা হয়েছিল, বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় – অবগত হতে কত গলিপথ সুঁড়িপথ গুঁড়িপথ সিঁড়িপথ! সত্যি প্রায় দশ-বারো ফুট চওড়া একটা নোটিশ বোর্ড আছে, একতলায় কাচে 888sport app। সময়ে সেই কাচ এতই ঘষে গেছে, তেলচিটে হয়ে গেছে, এতই অনচ্ছ যে, সে-কাচ বা কাচ থেকে কোনো আলো গতায়াত ঘটাতে পারে না।
১৯৭৭-এও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কার্যবিধি সংশোধনের সময় ১৯২১-এ প্রথম ঘোষিত এই বিধি (১৯১৯-এর ভারত শাসন আইন অনুযায়ী) সংশোধিত হয়নি। ’৭৭-এ কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছিল এক সন্দেহ, বা হয়তো এক অপ্রমাণিত সত্যের বশে। ১৯৭৫-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে-অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন তার আগে কি ক্যাবিনেটকে জানিয়েছিলেন? যা-হোক তখনো এই নোটিশ বোর্ডের ব্যাপারটি কারো নজরে আসেনি। গোপন নানা খবরের স্থায়ী আমানত হিসেবে বেশ কিছুদিন মিডিয়া এ নিয়ে খেলে গেলেও শেষ পর্যন্ত 6 : 23 বলেই অর্ডিন্যান্সটি পরিচিত হয়ে যায়। বম্বে থেকে প্রকাশিত একটি মাসিক লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনের ওই বছরের আগস্ট 888sport free betয় মলাটের ছবি করেছিল সুপারস্টার মাধুর্য বেদীর দুটো ন্যুড পাশাপাশি ছেপে – বাঁ-দিকেরটা তলপেট পর্যন্ত সামনে থেকে, বুক খোলা, নিচে ছাপা 23। ডান দিকেরটা তলপেট থেকে গোড়ালি, পেছন থেকে নিতম্ব খোলা, নিচে ছাপা 24 – মাধুর্যের দুই অঙ্গের মাপও বোঝায় যে 888sport free bet দুটি তা জানাতে ইঞ্চিসূচক (র্ র্ ) চিহ্ন দেওয়া ছিল।
যারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি কী নিয়ে 23 বা 24, বা যারা মনেও রাখেনি তারিখ নিয়ে সেই বানানো রহস্য, তারা এটাকে মাধুর্য বেদীর বুক ও পেছনের মাপ বলেই ধরে নিয়েছে। কলকাতা ও আশপাশের কিছু জায়গা নিয়ে নতুন একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা ইউনিয়ন টেরিটোরি বা সংক্ষেপে ইউ-টি, ২৩ জুন তৈরি হয়েছে নাকি ২৪-এ, এটা আগস্ট মাসের একটি লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনের মলাটে আসবে ভাষার চাইতে মাধুর্যের দু-পিঠের নগ্নতা মাপসহ মলাটে এসেছে ধরে নেওয়াই তো স্বাভাবিক।
খুব বিক্রি হয়েছিল 888sport free betটা, ভেতরে আরো আরো ছবি আছে ভেবে।
কিন্তু বুক যদি ২৪র্ হয়, তাহলে পেছন কেন ২৩র্, বাকি ইঞ্চিটা গেল কোথায়।
বসাকদা বলেছিলেন, ‘এখন ভাঁজে আছে, ইস্তিরির ভাঁজে, খুললে ২৪র্-ই পাবে।’
যারা শুনেছিল, তাদের কাছে কথাটা যথেষ্ট চাপা অশ্লীলতায় টলটল করছিল, যদিও তারা সম্ভবত কেউই এই প্রবাদের গল্পটা জানেন না। বসাকদা খাস উত্তর কলকাতার বসাক বাড়ির ছেলে, কলকাতার কোনো পুরনো ম্যাপে নাকি ওদের বাড়ির ছবি আছে। এখন, পাঁচ-সাত বা দশ পুরুষের পর বসাকদা গড়পারে এক ফ্ল্যাটে, বোধহয় পাঁচতলায় থাকেন। সেই ফ্ল্যাটে যাওয়ার পর বসাকদা বলেছিলেন, ‘আর কত সাউথে যাব, বল তো।’ আর, দু-এক মাস পর বলেছিলেন, ‘বড় আলো রে, চোখ ব্যথা করে। খাস উত্তর কলকাতার বসাকবাড়ির ছেলে বলে বসাকদা কিছু প্রবাদ পেয়েছিলেন, প্রায় মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে। প্রবাদ ওভাবে পাওয়া যায়, গল্পটা তো আর পাওয়া যায় না। তাছাড়া প্রবাদ নিজের গল্প নিজেই বানায়।
এই গল্পটা আমরা জানি। কী করে জানি সেসব বলতে হবে কেন? অন্তত এখানে গল্পটা বলা যাক।
সোনাগাছি যেখানে পূর্বে রাজবল্লভ স্ট্রিটে শেষ হয়েছে, ওই ১৫৮ আর ১৫৯ নম্বর আপার চিৎপুর রোডে অসংখ্য ওয়ান বাই ওয়ান বাই ওয়ান বাই এ, বি, সি, ডি করে করে তার উলটোদিকেই তো কুমোরটুলি। ওখানে একটা নম্বর আর নেই। তারপর দোতলা-চারতলা বাড়ির সঙ্গেই টালির ঘরের দোতলা-একতলাতেও সোনাগাছি ছড়িয়েই আছে মদন মোহনতলা পর্যন্ত। তাদের বেশির ভাগই হাফ- গেরস্ত – একেবারে লাইনের মেয়ে নয়। ওই রাজবল্লভ স্ট্রিটের মোড়টাতেই মামি বলে এক খুবই বুড়ি বেশ্যাকে নিয়ে অনেক গল্প আছে। সকালের দিকে সে বসত ট্রামলাইনের দক্ষিণে, দরিয়ার ওপরে পান-সিগারেট, নিচে চা-বিস্কুটের দোকানের পাশের ফুটপাথের এক কোণে – সেখানে কোত্থেকে খানিকটা রোদ এসে পড়ত, শীতকালের। বিকেলের দিকে মামি বসত ট্রামলাইনের দক্ষিণে। সেখানে পশ্চিমের রোদ খানিকটা পড়ত আর সন্ধ্যা হলে কুমোরটুলিতে হাত-পা সেঁকবার মতো আগুন পাওয়া যেত। সন্ধ্যায় মামি রয়েসয়ে দু-তিন পুর গুলি খেত। নতুন কেউ যদি ওই পাড়ার রীতি অনুযায়ী বুড়িকে ‘মাসি’ বলে ডাকত, বুড়ি তাকে বলত, ‘আমাকে মাসি ডাকিস নে বাপ! কত লোকের শ্যালি হব, বল বাপ। পিসিও বলিসনি, তোর পিতৃবংশের কালি লাগবে। বরং মামি বলিস। ও সেই শকুনি মামা বংশের দফারফা করে দিয়েছে রে। শকুনিরও একটা বউ ছিল গ। কিন্তুন এত্ত বড় মহাভারতে কত কোটি নাম আছে – দেব-দানব-রাক্ষস-খোক্কস-জীবজন্তু-মুণিঋষি-রাজাপ্রজা, কিন্তুন কোথাও তুমি শকুনির বউয়ের নাম পাবেনি। সে রাজরানীও ছিল তো। শকুনি গান্ধারের রাজা হয়েছিলেন না? যায়নি অবিশ্যি হস্তিনাপুর ছেড়ে। তার, সেই শকুনির বৌয়ের একটা ছেলেও ছিল গ। কিন্তুন এত-যে রাজধানী, এত-যে রাজমাতা, তার একটা আলাদা নাম দিলেন না ব্যাসঠাকুর। তা ছাড়া রাধাও তো কেষ্টর মামি। মামির সঙ্গে রসবস চলে। আমাকে মামিই ডাকিস বাপ, যদি ডাকতেই চাস।’
সেই মামি একদিন আগুন পোহাতে-পোহাতে বুড়ো কুমোরমশাইকে বলল, ‘কুমোরদাদা, এটা তোমার অধম্ম হচ্ছে।’ সূক্ষ্ম সব কাজের ব্যস্ততা ও মগ্নতার মধ্যে কুমোরমশায়দের ভালোই লাগত এমন রসালাপ। ‘বলো, মামিদিদি, কী অধম্ম?’ ‘ধরো, মা দুগ্গার তো পেছনে নেই। পুরোটাই সামনে।’ ‘পেছন না থাকলে আর সমুখ থাকবে কী করে মামিদিদি? মায়ের পেছন কতটা ভারি হলে, মা যে অসুরের ওপর অতটা ঝুঁকে পড়েছেন, সেটা সামলাতে পারছেন। আছে। বলতে পার, দেখা যাচ্ছে না।’ ‘হ্যাঁ, সেই কথাই হচ্ছে, জগজ্জননীর পেছন না থাকলে তো খুঁতো হয়ে যাবে। মা কি খুঁতো হতে পারেন? কিন্তু তোমাকে তো পেছনটা বানাতে হচ্ছে না কুমোরদাদা।’ ‘হ্যঁা, দেখতে চাও তো দেখাব। আমার আর কতটুকুন মাটি লাগবে মায়ের পেছন গড়তে। কিন্তু তুমি কি মাকে পেছন থেকে অঞ্জলি দেবে মামিদিদি, তাহলে আমার অধম্মটা কোথায়?’ ‘ঠিকই ধরেছ কুমোরদাদা, অধম্মটা ওই মাটির হিসেব নিয়েই।’ ‘সে কি আর বুঝিনি মামিদিদি, মায়ের সবটুকুই তো ধম্ম, ওই এক মাটিটুকুই তো অধম্ম, ফরেন। এন-আর-আইরা তো তোমার কাঠের বিটের ঠাকুর নিচ্ছে, ফোল্ডিং, নইলে প্লেনে মাল বুক করবে না। চাও, আমার কাছে তুমি মাটির হিসেবই চাও, কিন্তু মনে রেখ মামিদিদি, যে-ঠাকুরের ডলার নেই, সে-ঠাকুরের ধম্ম-অধম্ম সাজে না।’ ‘তা তোমার ওই ডলার কি শুধু কাঠের বিটই কেনে কুমোরদাদা, আমাদের গলির মেয়েগুলোর কাছে আসে না গ?’ ‘মামিদিদি, তোমার সঙ্গে কথা বলার এই এক বিপদ, কথায়-কথায় হাসি গিলতে হয়, নইলে হাতের কাজ পন্ড হয়। বল, কী বলছিলে ধম্ম-অধম্ম?’ ‘ধর, মা কালী তো বামপদ তুলেছেন বাবার বুকে? দক্ষিণপাদও হন কখনো কখনো, তখন শিবের শিথানও উলটে যায় -।’ ‘সে কি তোমার কাছে শুনব? ওই মাছুয়ার দেবদেবদের পিতিষ্ঠে মা ছিলেন – ডান-পা তোলা। লোকে বলত উলটোকালী। ওই দেবদেবরা তো জাতে গন্ধবণিক। ওই উলটোকালী পিতিষ্ঠে করে কায়েত হলো, পদবি নিল দেবদেব। তা এখন খবর কি গ উলটোকালীর? কিছু তো কানে আসে না।’ ‘আমার কানেও আসে না। বেশ মা বাঁ পা-ই তুললেন, তাতে অধম্মটা কী?’ ‘হ্যাঁ, ধর, এই চেনা মা-রা, মানে বারোয়ারির বল, ঠনঠনের বল, ফাটার বল, সব মায়েরই তো বাঁ পা তোলা। তাতে মাকে একটু কোনাচে ঠামে দাঁড়াতে হচ্ছে, ফলে তোমাকে দেখাতে হচ্ছে মায়ের আধখানা পেছন – বাঁ- দিকের তা, তুমি তো ওই পেছনের আদ্ধেকের খরচাও ধরছ। এদিকে মা-দুগ্গার তো পেছনের আদ্ধেকও নেই। তবে তো মা দুগ্গার পেছন থেকে মা কালীর আধখানা পেছনের খরচাটা তোমার বাদ দেওয়া উচিত।’ কুমোরমশাই বললেন, ‘মামিদিদি, তোমাকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। ঠি-ক ধরে ফেলেছ গো।’ ‘কুমোরদাদা, বেশ্যার আর হিসেব ছাড়া আছে কী? ভাগ্নেরা তো এক কম্মের রেটে আর এক কম্ম করতে চায়।’ ‘কিন্তু তোমার এই হিসেবটা মিলল না। মায়েদের পেছনের। আছে গো মামিদিদি আছে, এই পৃথিবীর গর্ভধারিণী, তাঁর কোমরের হাড় চওড়া না হলে চলে। কিন্তু সে কি তোমার পাবলিক করা যায়? ইস্তিরির ভাঁজে আছে, কুঁচির ভাঁজে – মা যখন ভাঁজ খুলবেন, তখন দেখবে সবটা পেছন ঠিক মাপমতো বেরিয়ে গেছে।’
২৩ জুন রাত বারোটার আগেই কলকাতা ও কিছু সন্নিহিত এলাকা নিয়ে ইউটি ঘোষিত হওয়ার পরই দ্বিতীয় ঘোষণা জারি হলো।
সংবিধানের যে ৬৯তম সংশোধনীর বলে কেন্দ্রীয় শাসনভুক্ত দিল্লির জনসাধারণকে বিধানসভা গঠনের অধিকার দেওয়া হয়েছে সেই একই অধিকার কলকাতা ইউনিয়ন টেরিটোরির জনসাধারণকেও দেওয়া হচ্ছে।
তৃতীয় ঘোষণাটি হতে-হতে রাত বারোটা পেরিয়ে যায়। বর্তমান ব্যবস্থা হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলকাতাই পুরনো পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ও নতুন কলকাতা ইউটির রাজধানী থাকবে।
কলকাতা থেকে এখন তো সব কাগজই ছাপা হয়। যে কাগজটি তাদের ফাইল থেকে ডুবুরির ছবি ছেপে দিয়েছিল তারা ফলোআপ স্টোরি হিসেবে প্রথম পৃষ্ঠাতেই অ্যাঙ্কর করছিল – দ্বিতীয় ঘোষণার পরই সেটা পাঁচের পাতায় বক্স হয়েছিল, একটু ছেঁটে। তৃতীয় ঘোষণার পর সে-বক্সও তলিয়ে গেল। একটি ইংরেজি কাগজ প্রথম ঘোষণার পরই চন্দ্র সাঁতরা নিমাই ঢালির স্টোরিটাকে তিনের পাতায় ‘লোক্যাল ব্রিফস’-এর তলায় গুঁজে রাখল। আর একটি বাংলা কাগজ ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ বলে সেটাকে প্রথম পৃষ্ঠাতে আট কলমে ঠেলে দিলো। তৃতীয় ঘোষণার পর চন্দ্র সাঁতরা-নিমাই ঢালি অতলে তলিয়ে গেল।
মিডিয়ার লোকজন ততক্ষণে ফোনে-মোবাইলে নেতাদের মন্ত্রীদের বা যাকে পায় তাকে খুঁজছে। চ্যানেলগুলির ক্যামেরাম্যানরা ক্যামেরা নিয়ে গাড়িতে বসে গেছে। রিপোর্টাররা কোনো হদিসই করতে পারছে না কারো। কী যে হলো তাও বুঝতে পারছে না নিউজ বা এডিটের লোকজন। কেউ বলছে, পশ্চিমবঙ্গে এখন রাষ্ট্রপতির শাসন শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলছে, রাষ্ট্রপতির শাসন তো ঘোষণা করা হয়নি। ওই তো ইনডাইরেক্টলি হয়ে গেল। এখনকার মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে – মুখ্যমন্ত্রী কি রাজ্যপালের কাছে গেছেন বা যাচ্ছেন?
‘রাজভবনে’র সিকিউরিটি অফিসার ফোনে বললেন, রাতে কাউকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার নতুন কোনো নির্দেশ তাঁদের কাছে আসেনি। কনট্যাক্টের জন্য এমন মরিয়া দশায় অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যায়। একজন রিপোর্টারের মনে পড়ে, যেন মুখচেনা ছিল রাজ্যপালের সেক্রেটারির সঙ্গে – ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটা সায়েন্স- সেশনে আলাপ হয়েছিল একমাত্র এই কারণে যে, ব্রিটিশ 888sport apkী অ্যানড্রু ওয়াইলসের সেই বক্তৃতায় মাথা গুনে মাত্র ন-জন শ্রোতা ছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিলের লোক, আর-দুজন ছিল এই রিপোর্টার ও তার ক্যামেরাম্যান। বাকি ছ-জন সত্যিকারের শ্রোতাদের মধ্যে একজন ছিলেন এক তামিল মহিলা, মাথায় ফুলটুলসহ, আর এই আইএএস ভদ্রলোক যিনি মুখচেনা ছিলেন রিপোর্টারের। সমস্ত বিষয়টিই অঙ্কের। এই ওয়াইলস ভদ্রলোক নাকি এমন একটি অঙ্ক কষে দিয়েছেন যা প্রায় পৌনে চারশো বছর কোনো বৈজ্ঞানিক কষতে পারেননি। ওই পাজল, কুইজ মিস্ট্রি এ-সব শুনেই চ্যানেল থেকে এই রিপোর্টার গিয়েছিল, মানে, তাকে পাঠানো হয়েছিল। বলাও হয়েছিল – যদি কিছু কুইজ ওর মুখ থেকেই পাওয়া যায়! সে তো হাজির হয়ে বোঝে – ওখানে তার পোশাক-আশাক, ওই ক্যামেরা, ক্যামেরাম্যান, আলোর শেডার এ-সব বেমানান শুধু নয়, একেবারে ধর্ষণ। একমাত্র রক্ষা যে তাদের কেউ লক্ষই করল না আর এই রিপোর্টার একেবারে শেষের দিকের একটা সারিতে তার ওই ক্যামেরা-ক্যামেরাম্যানট্যান নিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল। ঘরের অপরপ্রান্তের দেয়ালে সাদা বোর্ডে কালো মার্কার দিয়ে সেই ওয়াইলস ভদ্রলোক, যাঁর মুখ থেকে নাকি রিপোর্টারের কয়েকটা ম্যাথমেটিক্যাল কুইজ নেওয়া একটা কাজ, দুর্বোধ্য সব চিহ্ন আর ভাষায় যা লিখে যাচ্ছেন আর কখনো-কখনো ঘুরে তাঁর শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে জোরে-জোরেই হাসছেন ও কখনো-কখনো তাঁর ওই ছ-জন শ্রোতা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হেসে উঠছেন, সে-ও বেশ জোরেই, সেগুলিকে নেহাত অনুমানে রিপোর্টার অঙ্ক বলে ভেবে নিচ্ছিল। এর পরে একটা অ্যাসাইনমেন্ট আছে, ‘তুই তো থিয়েটার রোডে যাচ্ছিস, তাহলে প্রেস ক্লাবের খেপটাও মেরে আসিস’, সেখানে নাকি পাবলিক ইন্টারেস্ট বেশি, ক্রিকেট খেলার ব্যাপার। কিন্তু চ্যানেলে গিয়ে তো এখানকার ব্যাপারটা বোঝানোই যাবে না। মাঝখানে কফি ব্রেক হওয়ায় সেই রিপোর্টার মুখচেনার সুবাদে ওই আইএএসের কাছে গিয়ে বলে, ‘স্যার, আমাকে আপনি বাঁচান।’ যা হোক, তিনি অট্টহাসি চেপে বললেন, ‘আরে, এখানেও খাসখবর! আপনারা কি কোনো একটি জায়গাকেও সেক্রেড রাখবেন না?’ হ্যাঁ, সেক্রেড-শব্দটিই বলেছিলেন, কারণ রিপোর্টার প্রথম শুনে ভেবেছিল উনি সিক্রেট বলেছেন। সে চট করে বলতে পেরেছিল, আমি না হয় স্যার চাকরি বাঁচাতে এসেছি, কিন্তু আপনি স্যার কেন। এতে কাজ হয়েছিল। ‘আরে, ওয়াইলস তো এফএলটি সলভ করেছে। আমি ক্লাস নাইন থেকে বছর পাঁচেক চেষ্টা করেছিলাম। সবাই-ই যেমন করে। তাই চাক্ষুষ দেখতে এলাম।’ তিনিই শেষ পর্যন্ত জানালেন – এফএলটি মানে ফেরম্যাট’স লাস্ট থিয়োরেম। তিনিই ওই সাহেবের কাছে গিয়ে টিভিকে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। সাহেব দুই হাত উলটে বললেন, ‘ম্যাথমেটিক্স হ্যাজ বিকাম এ ফাস্ট ট্রাক টু স্টারডম।’ ততক্ষণে রিপোর্টার আলো জ্বেলে ক্যামেরা চালু করে দিয়েছে। সাহেব বলছেন, ‘বিবিসি ট্রান্সমিটেড অ্যান ইন্টারভিয়, বাট ইউ নো, ফিগারস্ ক্যান্ট স্পিক, দে আর লাইক ফ্রগস, জাম্পিং আনইকুয়াল লেঙ্থস উইথ এভ্রি লিপ।’ সাহেব হাত দিয়ে ব্যাঙ লাফানো বোঝান। ততক্ষণে ব্রেক শেষ। ক্যামেরা গুটোতে গুটোতে রিপোর্টার শোনেন, ওই আইএএস বলছেন, ‘ওই যে তামিল মহিলাকে দেখছেন, একেবারে টপ্ ম্যাথমেটিসিয়ান, বাঙ্গালোর থেকে এসেছেন, শুধু এই লেকচারের জন্য।’
এই আইএএস ভদ্রলোক এখন রাজ্যপালের সেক্রেটারি। তাঁকে ওই রিপোর্টার ফোনে ধরে ফেলতে পারল দুটি কারণে – রাজ্যপালের সেক্রেটারির কথাটা কারো খেয়াল থাকে না, একটু গোলমেলে সিনিয়র অফিসারদের রেখে দেওয়া হয়। তা ছাড়া এ ভদ্রলোকের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি ও তিনি অনেক রাত পর্যন্ত মদ খান ও বই পড়েন। সেই ভদ্রলোকই উলটে রিপোর্টারকে বললেন, ‘আরে তোমাকে পরিচয় দিতে হবে না, তোমার কথা জীবনে ভুলব না, আমরা জীবনের সবচেয়ে মজার ঘটনা – ওয়াইলসের লেকচারে খাসখবর। কিন্তু কী হয়েছে বলো তো – এত রাত্রে আমাকে রাজভবনে ডাকছে কেন? আমি তো তাদের গাড়ির জন্য ওয়েটই করছি।’ উনি এই রিপোর্টারের কাছেই শুনলেন – কলকাতা ইউটি হয়ে গেছে বিধানসভাসহ। আর ওঁর কাছে ‘রাজভবনে’র গাড়ি আসছে শুনে চ্যানেলের গাড়িতে ক্যামেরা নিয়ে রিপোর্টার চলল ‘রাজভবনে’র গেটে।
কোনো মন্ত্রী বা নেতাকে ফোনের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। এ তো তাঁদের জীবনমরণের ব্যাপার। তাঁরা মন্ত্রী আছেন কী নেই, কাল রাইটার্সে যাবেন কী যাবেন না, তাঁদের সরকার বা বিধানসভায় তাঁদের 888sport free betগরিষ্ঠতা আছে কী না – এসব তো আজ, এখনই, মানে আজ রাত্রির মধ্যেই জানাজানি হয়ে যেতে হবে, অর্থাৎ কাল সূর্যোদয়ের আগেই।
রাতে মুখ্যমন্ত্রীকে পাওয়ার শেষ সময়, সাধারণ একটি দিনে, সাড়ে নটা। সেটা গরমের সময় দশটা হয়ে যায়। একবার তাঁর একতলার দু-কামরার ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলে তিনি দুর্ভেদ্য। তাঁর আত্মীয়জন, বন্ধুবান্ধব এঁরাও এ-সময় তাকে ফোন করেন না বা কথা বলতে তাঁর বাড়ি যান না। সকলেই জানেন, এটা তাঁর পড়াশুনোর ও নিজস্ব কাজের সময়। এখন না-হয় তিনি মুখ্যমন্ত্রী। পঁচিশ বছর আগে যখন তাঁর বয়স পঁচিশ ও তিনি মন্ত্রী হতে শুরু করেছেন – তখন থেকেই তিনি এই রুটিনটা সবাইকে মেনে নিতে বাধ্য করেছেন। বয়সে বড়, নামডাকওয়ালা নেতারাও তাঁর এই নিয়ম মেনে চলেন। এ নিয়ে এই এতগুলো বছরে তাঁর শত্রুরা বা তাঁর দলের শত্রুরা, কোনো কেচ্ছা রটাতে পারেনি। তাঁকে দেখলে বা তাঁর কাছ থেকে একেবারে আধুনিক কোনো বিদেশি ফিল্মের কথা শুনলে বা এমনকী প্রকাশ্য ভাষণে তাঁর নির্ভুল 888sport app download apk-উদ্ধৃতি শুনলে বোঝা যায় তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা মডেল আছে – সে-মডেলে ‘প্রাইভেসি’ একটি অবশ্য পালনীয় ধর্ম। বা, হয়তো মডেল নয়। গভর্নমেন্ট মানে তো নিয়মে-বাঁধা কাজ। এই প্রাইভেসি গুণের জন্যই হয়তো মুখ্যমন্ত্রীকে, এ-রাজ্যের যুবক, নাগরিক, ভদ্র ও শিষ্টাচারবিশিষ্ট প্রতিনিধি বলে ভাবতে সহজেই ভালো লাগে। হয়তো মুখ্যমন্ত্রিত্বে পৌঁছুনোর একটা কোনো পথ আছে, নিশ্চয়ই আছে। নইলে, বলতে গেলে প্রতিদিন চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় বারো ঘণ্টাই মুখ্যমন্ত্রী নিরুদ্দেশ তো আর থাকতে পারেন না।
কেউ-কেউ দিল্লিতে ফোন শুরু করল – পার্টি অফিসে, পার্লামেন্টারি অফিসে, নেতাদের বা এমপিদের বাড়িতে। কিন্তু ‘শোচনা হ্যায়’-এর বেশি কিছু জুটল না। এক সংবিধান বিশেষজ্ঞ বেশ স্পষ্ট করেই বললেন – ‘অর্ডিন্যান্স ও তৎসহ গভর্নমেন্ট অর্ডারগুলি মিলিয়ে দেখতে হবে। কনস্টিটিউশন্যাল প্রসিডিয়র ঠিক আছে কি? আর, এই অর্ডিন্যান্সের কার্যকারিতা কবে থেকে তা বলা হয়ে থাকলে ঘোষণা তো আগেও হতে পারে। যখন শুনলেন অর্ডিন্যান্সেই বলা হয়েছে ২৪ জুন থেকে এটা কার্যকর হবে তিনি বললেন – তাতে তো সাংবিধানিক কোনো অসুবিধে নেই। কলকাতা শহরটাকে ইউটি করা হলো, বিধানসভাসহ – সেটা হয়ে গেছে। এর পর তো এক্সিকিউটিভদের কাজ। সে তো এক লাইনের একটা জিওর ব্যাপারে যে বিজ্ঞপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত এখনকার ব্যবস্থাই চলবে না। না। আমার তো মনে হচ্ছে না, এর মধ্যে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা আছে। সরকার তার ক্ষমতার বেশ ভেতরে থেকেই কাজ করেছে।’
পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের ও মন্ত্রীদের কারো বয়সই মধ্যপঞ্চাশের কম নয়। দু-একজন মন্ত্রী বা ফ্রন্টের নেতা থাকতে পারেন চল্লিশের এদিক-ওদিক। ফলে সব পার্টির সব নেতাই শরীর নিয়ে খুব সাবধান। চায়ে চিনি কেউই খান না।
প্রত্যেকেই হয় সকালে না-হয় রাতে আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটেন। এক কাগজে বেশ সরেস রিপোর্ট বেরিয়েছিল – এক মন্ত্রী সন্ধে সাতটা নাগাদ পাইলটসহ সল্টলেকে ঢোকেন, একটা বিশেষ জায়গায় গাড়ি থেকে নামেন, তারপর বাড়ি পর্যন্ত হাঁটেন, তাঁর সিকিউরিটি তাঁর পেছনে-পেছনে হাঁটে। তাঁর সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গে পেটের গোলমাল, অ্যাসিডিটি আর গ্যাসের সমস্যা অনেক বেশি। প্রত্যেক রাতেই নেতাদের ইসবগুল খেতে হয়, নইলে সারাদিন আত্মবিশ্বাস রক্ষা করা কঠিন। ডাক্তাররা সবাইকেই বলেন, যতটা পারেন টেনশনের বাইরে থাকবেন। তার একটা খুব সহজ উপায় হচ্ছে – অকারণে রাত না-করা। প্রতিদিন তো আর ইলেকশন বা দলত্যাগ হচ্ছে না। প্রতিদিন তো আর মন্ত্রিসভা বাড়ানো হচ্ছে না। এই সব কারণে সব পার্টির নেতারাই সাধারণ দিনে রাত দশটা-এগারোটায় ঘুমিয়েই পড়েন। এমনই একটা টেনশনহীন সাধারণ দিনে চন্দ্র সাঁতরা ও নিমাই ঢালির একশো শতাংশ ঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সকালে-ঝরা রাতে-খরার উজ্জ্বল একটি রাতে, পশ্চিমবঙ্গ যে ভাগ হয়ে গেল, তা জানা যাবে কী করে?
কেউ জানবে না যে তারা বিভক্ত পশ্চিমবঙ্গে ঘুমুচ্ছে?
শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি যা হওয়ার তাই হলো – সবার ঘুমই একসঙ্গে ভাঙল। ‘রাজভবনে’র গেটে রাজ্যপালের সেক্রেটারির সঙ্গে চিফ সেক্রেটারি ও হোম দুজনকেই পাওয়া গেল। মিডিয়ার সাজসজ্জা তো প্রায় সেনাবাহিনীর মতো। নানা সাইজের ক্যামেরা বসিয়ে ও কাঁধে নিয়ে, নানা সাইজের স্পিকার নিয়ে – লাঠির মতো লম্বা, টেনিস বলের মতো গোল, ফলকের মতো সরু আবার একটা বইয়ের মতো দেখতেও। সিকিউরিটি মিডিয়াকে আটকে রেখেছিল। সেক্রেটারিরা প্রায় সাজানো মঞ্চে ঢোকামাত্র কত-যে আলো জ্বলে উঠল। তখন, মানে ২৩ জুন, সোমবার, মধ্যরাতেও তো চন্দ্র সাঁতরা ও নিমাই ঢালির পূর্বাভাসমতো জল-হাওয়া চলছিল – সকালে ঝরা, রাতে খরা। টিভিতে যখন এই ছবির ট্রা্ন্সমিশন হবে তখন ‘রাজভবনে’র সিঁড়ি চুড়ো সব মিলিয়ে ‘গ্রেভ অ্যান্ড গ্রিম’ লাগবে। কলকাতার রাজনৈতিক খবরে কোনো টেনশনই আনা যায় না। সেই এক মার্কসের দাড়িমুখ আর ইন্দিরা গান্ধীর ক্যালেন্ডারের ছবি আর উদ্বেগহীন সব নেতার মুখ। ওই মুখে টেনশন খেলবে কী করে?
চিফ সেক্রেটারি বেশ খাটো, তার ওপর সামনে এক গোছ চুল মেহেদি করা। আচমকা ফটোতে মনে হয়, কোনো মহিলা। তাঁর দু-এক পা পেছনে হোম সেক্রেটারি। রাজ্যপালের সেক্রেটারি এঁদের চাইতে পা-দুই পেছনে পায়চারি করছিলেন। ওঁর সেই ছায়া পায়চারি আর হোম সেক্রেটারি লম্বা মাথায় সামনে দুই হাত জড়ো করা। এই এত রাতেও এঁদের পোশাক এমন যেন অফিসে এসেছেন। এঁরা কি দু-বেলা শেভ করেন?
চিফ সেক্রেটারি বললেন, ‘আপনারা তো সব জেনেই এসেছেন। কলকাতা করপোরেশন ও আশপাশের কয়েকটি মিউনিসিপ্যালিটি নিয়ে একটি ইউনিয়ন টেরিটোরি তৈরি হয়েছে। উইথ এ লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লি। প্রশাসন বা সরকারের কোনো অদলবদল ঘটেনি।’ চিফ সেক্রেটারি মাটিতে চোখ রেখে শুনতে লাগলেন, ‘আপনাদের কেন ডেকেছিলেন, রাজ্যপাল? মুখ্যমন্ত্রীও কি আসবেন? এটা করার পারপাজটা কী, আপনি এখন কোন গবমেন্টের সেক্রেটারি?’
রিপোর্টাররা নিজেরাই থেমে গেলেন। চিফ সেক্রেটারি বললেন, ‘পরিস্থিতিতে বা প্রশাসনে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। সবকিছুই সংবিধান অনুযায়ী চলছে ও চলবে।’
সরকারপক্ষের এক দলের এক মন্ত্রী তাঁর বাড়ির লোকজন নিয়ে বাগনানে গিয়েছিলেন এক নিকট আত্মীয়ের গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠানে। তিনি সেই বাড়িতেই টিভিতে এই খবর দেখে ওখান থেকে তাঁর দলের অফিসে ফোন করেন। ফোনের ঘরে যিনি শোন তিনিই এসব খবর দেওয়া-নেওয়ার লোক নন। একজন প্রবীণ নেতা অফিসের একটি ঘরে শোন। তিনি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছেন। মন্ত্রীও তাঁকে ঘুম থেকে তুলতে বলতে পারেন না। শেষে তিনিই ফোন করলেন তাঁর চাইতে বয়সে বেশ ছোট এক মন্ত্রীকে, অন্য দলের। সে হয়তো ঘুমোয়নি আর ঘুমোলেও তাকে ডেকে দিতে বলা যায়। তবে, তিনি বাগনানে বসে খবর জানার পর এত অস্থির হচ্ছেন, ওরা কি কলকাতায় বসে না জেনে পারে? না জেনে যে পারে এটা তিনি জানেন। রাত সাড়ে দশটার স্টার নিউজ – ব্যস, সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। নইলে শরীর রাখবে কী করে। মন্ত্রী তো খবর শুনেই বাগনান থেকে কলকাতার দিকে বেরিয়ে পড়তে পারতেন – সপরিবার বা একা।
তিনি বেরিয়ে পড়তে চাইছিলেন, প্রথমে সবাইকে নিয়ে, তারপর একাই। তারও পরে তাঁর স্ত্রী গোপনে জানিয়ে দেন, ওখানে সবাই থেকে গেলে তো শোয়ার অসুবিধে হবে। তখন মন্ত্রী আবার চলো, তোমরা রেডি হও, বলেন।
তিনি, মন্ত্রী ঠিক জোর বা বিশ্বাস পাচ্ছিলেন না। তিনি কি এখনো মন্ত্রী আছেন? তাঁর ড্রাইভার যদি অস্বীকার করে তাঁকে নিয়ে যেতে? বা বুঝতে তো পারছেন না, টেক-ওভার হয়ে গেল কী না। কে কাকে টেক ওভার করবে, সেটা যে তাঁর কাছে খুব স্পষ্ট, তা নয়। কিন্তু টেক ওভার-টোভার তো এমন মাঝরাতেই হয়। হয়তো মিলিটারি নেমেছে। তারা তো বুঝবে না, তিনি মন্ত্রী ছিলেন বা আছেন। এক লোক্যাল থানাকে ফোন করা যায় – তাদের তো এসকর্ট দেওয়ার কথা ডিস্ট্রিক্ট বর্ডার পর্যন্ত। টেক-ওভার যদি হয়ে থাকে, তাহলে এসব নিয়মকানুন কি কেউ মানে? মন্ত্রী যেন ক্রমেই বুঝতে থাকেন, তিনি যে-ক্ষমতা ভোগ করেন, তা একটা ব্যবস্থার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা তাঁর অর্জিত নয়।
আবার, এমন একটা অনিশ্চয়তাবোধের জন্য নিজের ওপর বিরক্তই হচ্ছিলেন। তাঁর নিজেকে এতটা বিপন্ন মনে হচ্ছে কেন। এ তো তাঁর একার কোনো ব্যাপার নয়।
এ মন্ত্রী ছাত্র-আমলে রাজনীতিতে আসেন, তারপর কলেজে অধ্যাপনা করতেন ও সেই পেশার সম্পৃক্ত রাজনীতি করতেন, তারপর ভোটে দাঁড়িয়ে যেতেন, লিয়েন নিয়ে মন্ত্রী হয়ে আসছেন। বছর দশেক তো মন্ত্রী আছেন। এখনো লিয়েনটা ছাড়তে পারেননি। চাকরি নেই – এটা ভাবতে পারেন না। মন্ত্রিত্ব তো চাকরি নয়। অথচ, এখন, এই মুহূর্তে তিনি সবচেয়ে বিপন্ন বোধ করেছেন – তিনি হয়তো আর মন্ত্রী নেই এই ভয়ে। তিনি নিজে বুঝতে পারছিলেন না, রাজনীতি কোনো দিনই তাঁকে এমন কোনো জোর দেয়নি, যাতে তাঁর নিজের ওপর কোনো আলাদা বিশ্বাস তৈরি হয়। r (চলবে)

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.