চিত্রলেখা চৌধুরী
অনুলিখন : অভিজিৎ দাশগুপ্ত
সূচনা
[আমাদের খুব কাছেই থাকেন চিত্রলেখাদি। কতদিনের কত কথা জমে ওঠে ভেতরে ভেতরে। বহুদিন তারা জমাটবদ্ধ। মা-বাবা-শান্তিনিকেতন আরো কত কি! একদিন কথায় কথায় তিনি উন্মুক্ত করলেন 888sport sign up bonusর দ্বার। যন্ত্রবন্দি করা গেল তাদের। তারপর সেই সাক্ষাৎকারকে অনুলিখনের ভঙ্গিতে প্রকাশ করার এই প্রচেষ্টা।]
পূর্বকথা
আমার শৈশব তো সেই 888sport appsে। যদিও আমার নিজস্ব কিছুই মনে নেই। আমার মা নিভাননী বসু। মায়ের বাবা ভগবানচন্দ্র বসু ছিলেন ডাক্তার। তিনি ত্রিপুরার প্রথম এমবি। কর্মক্ষেত্র ছিল গোমোতে। রেলের ডাক্তার ছিলেন, তাই মায়ের ছোটবেলা কাটে গোমোতে। মায়ের দেশ ছিল চাঁদপুরে; মেঘনা নদীর ধারে ছিল বাড়ি; কিন্তু অল্প বয়সেই মা পিতৃহারা হন। তখন আমার দিদিমা শরৎকুমারী বসু মেয়েদের নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ি অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে চলে এলেন। সেইখানে ছিল গান-বাজনা-888sport live chat-888sport live footballের একটা ভীষণ রকমের চর্চা। তাঁরা লেখাপড়ার দিকে অত না গেলেও 888sport live chat-সংস্কৃতিচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। সেখানে গানের খুব চর্চা হতো। তাই সংগীত আর 888sport live chatের চর্চাটা মায়ের সেখান থেকেই হয়েছে, যা থেকে আমি একটু পেয়েছি।
আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন নোয়াখালীর লামচর গ্রামের জমিদার। আর বাবারা প্রায় সকলেই তখন ছিলেন অনুশীলন পার্টির মেম্বার। বাবার নাম নিরঞ্জন চৌধুরী। তিনি ছিলেন ম্যাথমেটিশিয়ান। অঙ্কে অনার্স নিয়ে স্কটিশ চার্চে পড়ার সময় ওঁর সহপাঠী ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। তাঁর ছিল কেমিস্ট্রিতে অনার্স এবং বোধহয় দুজন রুমমেট ছিলেন। আমার বাবার দিকের সকলেই সায়েন্সের লোক ছিলেন। জ্যাঠামশাই ছিলেন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। যে-সময় সত্যেন বোস ছিলেন ফিজিক্সের হেড। আমার দুই কাকার একজন ছিলেন কানপুর আইআইটির প্রফেসর আর অপর কাকা পেইন্টার। তিনি দিল্লি আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন।
জ্যাঠামশাই ভাইয়ের জন্য পাত্রী খুঁজতে খুঁজতে চাঁদপুরে এলেন। তা এখানে কয়েকটি পাত্রী দেখার পর হঠাৎই তাঁর নজরে আসে অসাধারণ সুন্দর পিঁড়ি-কুলা। এ-জিনিস দেখে তিনি বললেন, এই মেয়েটিকেই আমি দেখতে চাই। তারা জানাল, এত ছোট মেয়ে, কোথায় খেলাধুলা করছে। কিন্তু জ্যাঠামশাই মনস্থ করে ফেলেছিলেন এই মেয়েকে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন। জ্যাঠামশাই সেখানেই দিনক্ষণ-তারিখ ঠিক করে দেশে চলে গেলেন।
বিয়ের পর নোয়াখালীতে এসে ভাষা সমস্যায় পড়লেন মা; কিন্তু ভাব প্রকাশের সেই বাধা ঘুচে গেল শ্বশুরবাড়ির বিরাট লাইব্রেরি পেয়ে। প্রায় সারাদিন সেখানেই কাটাতেন। 888sport alternative link, কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ ইত্যাদির সঙ্গে প্রবাসী, বসুমতী ইত্যাদি পত্রিকার সহাবস্থান সেখানে। মা তো সেসব দেখে আত্মহারা। এদিকে মায়ের আঁকা ছবি দেখে আমার ঠাকুরমা-পিসিমা ভাবলেন, এর এত প্রতিভা রয়েছে, একে কোথাও শিখতে পাঠানো হোক। ওঁরা তখন সবাই মিলে ঠিক করলেন, মাকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে শিখতে পাঠানো হোক। তারপর একদিন বাবা মাকে নিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। আর সেটা ছিল দু-তিন দিনের রাস্তা।
পূজার ছুটি তখন। বাবার সঙ্গে মা এলেন কোনার্কে। মা গুরুদেবকে প্রণাম করলেন। রবীন্দ্রনাথের পাশের ঘরেই থাকার জায়গা হলো। সেখানে মা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতেন, গুরুদেব ভোরবেলা চারটের সময় বেরিয়ে যাচ্ছেন উত্তরায়ণের বাইরে গোলাপ বাগানে পায়চারি করতে।
১৯২৮ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত মা ছিলেন শান্তিনিকেতনে। প্রথম পাঁচ বছর কলাভবনে, পরে রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসুর নির্দেশে কলাভবনের প্রফেসর হয়েছিলেন। মা-ই ছিলেন কলাভবনের প্রথম লেডি প্রফেসর। গৌরীদি, যমুনাদি, রানিচন্দ মায়ের সঙ্গেই পাশ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউই পেইন্টিং সেভাবে করেননি। একদিন সব ছবিটবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গুরুদেব মা-কে বললেন, আমি তোমার নাম পালটে দেব। নিভাননী নাম থাকবে না। নাম হয়ে গেল চিত্রনিভা। তারপর থেকেই মায়ের নাম পালটে গেল।
আমাদের শান্তিনিকেতন
আমার একদম ছোটবেলার 888sport sign up bonus বলতে মায়ের কাছে গান শেখা। কোনোরকমে গানটা গেয়েই আমি কেঁদে ফেলতাম। ওইটুকুই যা মনে আছে। তারপর মার ইচ্ছা হলো, আমি যেন প্রপারলি গানটা শিখি। কিন্তু কোথায়? এই সময়ই ছোট কাকার বিয়ে উপলক্ষে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় আসা। মা আর বাবা ঠিক করলেন যে, যাওয়ার পথে আমাকে শান্তিনিকেতনে হোস্টেলে দিয়ে চলে যাবেন। তখন আমার বয়স পাঁচ-ছয়। কিন্তু এখানে এসে শুনল যে, এত ছোট বাচ্চা ওরা নেবে না। মাকে বলল, আপনি কিছুদিন থাকুন। ওর বয়স হোক, তখন ভর্তি করে দেবেন। কী আর করা, শান্তিনিকেতনে পাঞ্জাবি হাউস ভাড়া নেওয়া হলো। মা, ভাই আর আমাকে এখানে রেখে বাবা দেশে চলে গেলেন। কারণ বাবা তখন একটি অবৈতনিক স্কুল খুলেছেন দেশে।
আমার প্রথম শান্তিনিকেতনের কাহিনি স্বাধীনতালাভের দিন গৌরপ্রাঙ্গণে। সেদিন রাতে মা আমাদের দুজনকে নিয়ে সেখানে হাজির হন। রাতে সকলে জড়ো হয়েছিল সেখানে। এমনকি সাঁওতালরাও মাদলটাদল নিয়ে হাজির।
ইতোমধ্যে বাবা ফিরে এলেন। আমিও ভর্তি হলাম শান্তিনিকেতনে। তখন ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে আমি ড. বাগচি, সুধীরঞ্জন দাশকে পেয়েছিলাম ভিসি রূপে। 888sport app শিক্ষকের মধ্যে বাংলায় ছিলেন নলিনীদি, ইতিহাসে উমাদি, ম্যাথমেটিকসে বিশ্বনাথদা, ইংরেজিতে ললিতদা ও শিশিরদা, অরুণদা ছিলেন জিওগ্রাফির। তখনকার আশ্রমের পরিবেশই অন্যরকম ছিল। আমার মনে আছে, মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আমি ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতাম। পাশেই টিচারদের কোয়ার্টার। ললিতদা ওখান থেকে চিৎকার দিচ্ছেন, চিত্রলেখা পরীক্ষার আর কদিন। আমি হয়তো ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে বলতাম, সাতদিন।
তখন ক্লাস হতো ভোর ছটা থেকে এগারোটা। আর বিকেলবেলায় ড্রয়িং, নাচ, গান, সেলাইয়ের ক্লাস। এগুলো সব কম্পলসারি। সেলাই করাতেন অমলা মাসি। শান্তিদার শালি। গানের ক্লাস নিতেন মোহরদি আর বীরেনদা। সুচিত্রাদি, বীরেন পালিতদা, প্রফুল্লকুমার দাশ, কমলা বসু, মোহরদিরা ছিলেন ক্লাসমেট। প্রফুল্লদা সে-সময় শান্তিনিকেতন থেকেই কলকাতায় চলে আসেন। তিনিও আমাকে মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে গান শিখিয়েছেন।
গানটা আমি ছোটবেলা থেকেই গাই। তাই শৈলজাদারা সমস্ত অনুষ্ঠানে আমাকে দিয়ে একটা সোলো গান গাওয়াতেন। যেমন মোহরদির একটা গান থাকতই। ক্ষিতিমোহন দাদু আমার গান খুব পছন্দ করতেন। মাকে বলতেন, কুমির যেমন হাঁ করলেই জল বেরিয়ে আসে মুখ দিয়ে, ও হাঁ করলেই গান বার হয়ে আসে। তখন সকলের উপস্থিতিতে মন্দিরে বক্তৃতা দিতেন ক্ষিতিমোহন সেন। মায়েদের যুগে বক্তৃতা দিতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ক্ষিতিমোহন দাদু তাঁর বক্তৃতা অনুযায়ী আমি কী গান গাইব তা বলে দিতেন শৈলজাদাকে। তিনি একবার মাকে বলেছিলেন, তোর মাইয়া যদি মাইয়া না হয়ে পোলা হতো, আমি ওরে চেলা কইরা লইয়া যেতাম সমস্ত দেশে-বিদেশে। আমি বক্তৃতা দিতাম আর ও গান গাইত।
ছোট থেকেই আমি রেডিওতে শিশুমহলে, গল্পদাদুর আসরে গাইতাম। অনেকদিন এমন হয়েছে, যে-ট্রেনে কলকাতায় যাচ্ছি, সেই ট্রেনেই শৈলজাদা আর ক্ষিতিমোহন দাদু চলেছেন কোনো কাজে। ওঁদের সঙ্গেই চলে গেলাম কলকাতায়। বাবা সে-সময় টাউন স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। আমি সে-সময় গান আর নাচ দুটোই সমানতালে করতাম। প্রথম জীবনে যেমন গানটা বেশি গেয়েছি, পরবর্তী জীবনে আবার নাচটাই বেশি করেছি। তাই ক্ষিতিমোহন দাদু সবসময় আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে শৈলজাদাকে জিগ্যেস করতেন, যার গলাও চলে পাও চলে, তাকে কী বলে শৈলজা? পাগলা!
আমরা যখন খুব ছোট, তখন নাচের ক্লাসে, মাস্টারমশাই কিন্তু খুব উৎসাহ দিতেন। বলতেন, তোমরা এত সুন্দর নাচো যে, বড়রাও তোমাদের মতো পারে না। আর আমরাও ভাবতাম খুবই ভালো নাচি আমরা। তাই শৈলজাদাকে আমরা বললাম বসন্তোৎসবে নাচব। ওঁর পাঞ্জাবি ধরে টানাটানি। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, যা তোরা রেজিস্ট্রারের কাছে যা। রেজিস্ট্রার ছিলেন সুরেন কর। তিনি শুনেই বললেন, যা যা, তোরা কী নাচবি। তোরা বড় হ, তখন নাচবি। তিনিও বিরক্ত। কিন্তু আমরাও কিছুতেই ওনাকে ছাড়ছি না, শেষে তিনি আমাদের রথিঠাকুরের কাছে যেতে বললেন। তিনি পারমিশন দিলে হবে।
আবার আমরা ছুটতে ছুটতে গেলাম উত্তরায়ণে। দেখি তখন রথিদা বাগানবাড়িতে বসে হাতের কাজ করছেন। কাঠের কাজ, চামড়ার কাজ করছেন। দরজা বন্ধ, জানালা খোলা। আমরা জানালা দিয়ে উঠেই ‘রথি দাদু রথি দাদু’ বলে ডাকছি। তিনি তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, ‘কী রে, তোরা কিছু বলবি?’
‘হ্যাঁ, আমরা বসন্ত উৎসবে নাচব।’
‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তোদের জন্যই তো বসন্তোৎসব। তোরা না নাচলে আর কে নাচবে।’
আমরা জানালাম শৈলজাদা বারণ করছেন। তিনি আমাদের সংগীতভবনে যেতে বললেন। সে-মুহূর্তে টেলিফোন করে তিনি শৈলজাদাকে নির্দেশ দিলেন, ছোটদের মতো করে একটা নাচের অনুষ্ঠান করে দিতে। তাতে আমরা নাচব। সঙ্গে সঙ্গে শৈলজাদা ‘মোরা অকারণে চঞ্চল, ডালে ডালে দোলে…’ আমাদের উপযোগী গান ঠিক করে সংগীতভবনের মেয়েদের শিখিয়ে দিলেন। নাচের মাস্টারকে বললেন, আমাদের নাচ শিখিয়ে দিতে। সেবার সবাই বলেছিলেন, বাচ্চাদের নাচটাই সব থেকে ভালো হয়েছে। আসলে বাচ্চারা যেমন করে তেমনই ভালো লাগে।
শান্তিনিকেতনে তখন প্রচ- গরম পড়ত। গাছ প্রায় ছিলই না। তখন কোনোদিন বৃষ্টি হতো না। এটা একটা ঘটনা যে, আমরা সকলে গাছের তলায় ক্লাস করতাম। আমাদের সময় বর্ষাকালে একদিন কি দুদিন বৃষ্টি হতো। সেদিন আমাদের রেনি ডে। টিচাররা আমাদের নিয়ে কখনো কোপাই নদীর ধারে, কখনো খোয়াইয়ে যেতেন। আমরাও গান করতে করতে তাঁদের সঙ্গে হাঁটা দিতাম।
আবার এমনও হয়েছে, গ্রীষ্মকাল, আমগাছে পাকা পাকা আম ঝুলছে। আমরা পেড়ে নিতাম। আর দারোয়ান লাঠি নিয়ে তেড়ে আসত। এই এই নামো নামো করত। তখন রথিদাকে গিয়ে বলত। তিনি আবার হেসে বলতেন, হ্যাঁ, ওরাই তো আম খাবে। খাবে না কেন। ওদের ছেড়ে দাও, কিচ্ছু করবে না। তিনি এমনই মানুষ ছিলেন। খুব উদার আর গুণী। আর ছিলেন প্রতিমাদি। আমার গান খুব ভালোবাসতেন। মাকে বলতেন, নিভা তুমি ওকে সন্ধের সময় নিয়ে এসো। ওঁর গান শুনলে আমার খুব ভালো লাগে। ওঁর প্রিয় গান ছিল ‘সুখী, আঁধারে একেলা ঘরে…।’ ওঁদের মেয়ে পুপেদির সঙ্গে আমার মায়ের খুব ভাব ছিল। দুজনের দেখা হলেই 888sport sign up bonusচারণায় কেটে যেত সময়।
অবনীন্দ্রনাথ এলে উত্তরায়ণে উঠতেন। মা তখন ওনার কাছে যেতেন ছবি বিষয়ে কথা বলতে। বিশেষ করে ওয়াশের ছবি আঁকার সময়। তিনি বাচ্চাদের অনেক বইটই লিখেছেন, কিন্তু খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন। বাচ্চাদের সঙ্গে যে খুব গল্প করতেন, তা নয়। নন্দলাল বসু আবার ছোটদের সঙ্গে বেশ মিশতে পারতেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তুই আমাকে ‘আঁকিয়ে দাদু’ বলে ডাকবি।
আমার সংগীত শিক্ষা হয়েছিল বিবিদি, শৈলজাদা, শান্তিদেব ঘোষের মতো মানুষদের কাছে। আর ক্লাসিক্যাল সংগীতে শিক্ষক ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। বিবিদি মানে ইন্দিরা দেবী স্বরলিপি ধরে গান শেখাতেন। কাজেই খুব ছোট থেকে আমি স্বরলিপি লিখতে-পড়তে শিখে গেছি। তিনি এত সুন্দর করে শেখাতেন যে, তিনি যখন গেয়ে উঠতেন ‘মাধবী শাখায় উঠিতেছে দুলি দুলি তোমার পুরানো আখরগুলি’, তখন বাইরের মাধবীলতা দেখতাম আর শিখতাম। সত্যি মনটা কেমন করে উঠত।
শৈলজাদা আবার এ¯্রাজ বাজিয়ে শেখাতেন। উনিশ-বিশ হলেই ছড় দিয়ে মাথায় মারতেন। একবারের ঘটনা, রেডিওতে গান করতে যাচ্ছি। বাবা নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। মাঠের অন্যদিক থেকে শৈলজাদা আসছেন সংগীতভবনের দিকে। ওইখান থেকেই শৈলজাদা ডাকছেন ‘নিরঞ্জন নিরঞ্জন’ বাবার নাম ধরে। কাছে এসে আমাকে বললেন, তুই কোথায় যাচ্ছিস। আমি বললাম, অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান গাইতে। তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, সে কি তুই অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান করতে যাচ্ছিস, আর আমাকে গানটা একবার শুনিয়ে দিয়ে যাচ্ছিস না। তা আমি বললাম, এই গানটা আপনার কাছেই শিখেছি, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’। শৈলজাদা নাছোড়। তক্ষুনি মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে গানটা শোনালাম। কোথায় কী একটা সুর কম লাগছে, কোথায় একটা টপ্পার দানা খারাপ হচ্ছে – সব করেটরে দিয়ে বললেন, এবার যা।
শান্তিদা সে-সময় সুরুলে গান শেখাতেন। তিনি সাইকেল করে ফেরার সময় চিৎকার করে বলতেন, চিত্রা এখন তো পুজোর ছুটি পড়ছে, তুমি আমার কাছে গান শিখতে আসবে। বিকেলবেলা ৩টা থেকে ৪টা। প্রত্যেকদিন। আমি তখন এইট-নাইনে পড়তাম। বিশেষ করে গরমের ছুটির সময়। আমি হয়তো খেয়েদেয়ে একটু ঘুমাচ্ছি। মা ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিত। তিনি খুব মুডি লোক তো, যত গান ওনার মনে আসত, গড়গড় করে সব শিখিয়ে দিতেন। শৈলজাদা যেমন একটা গানই একমাস ধরে শেখাতেন। শান্তিদা আবার যে-গানটা নিতে পারবে তাকে তিনি মাথায় তুলে রাখতেন। আমাকে সে-সময় তিনি দিনে বোধহয় দু-তিনটি গান করে শিখিয়ে দিতেন। পরবর্তীকালে আমি যত গান রেডিওতে গেয়েছি বেশিরভাগ গান শান্তিদার।
ক্লাসিক্যাল সংগীতে আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এসেছিলেন ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমি সমস্ত ক্লাসিক্যাল গান শিখেছি। তিনি একা শেখাতেন। ৭টা থেকে ৮টা মালবিকা রায়কে (কানন), তারপরের এক ঘণ্টা আমাকে। দেবতার মতো মানুষ ছিলেন তিনি।
আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব এসেছিলেন ভিজিটিং প্রফেসররূপে। মা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন। তখন আমি ছোট। তিনি ভোরবেলা উঠে সরোদ বাজাতেন। এত অপূর্ব সুর কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে, আমিও উঠতে পারতাম না। একদিন আশ্রমের মেয়েদের গান শুনতে চাইলেন তিনি। সকলেরই গলা কেঁপে যাচ্ছে ভয়ে। মোহরদি, বাচ্চুদি সকলের। আমি তখন বাচ্চা মেয়ে। ফ্রক পরে বসে আছি। আমার তখন ভয়ডর কিছু নেই। আমি ভাবলাম যে, এ দাদুটা তো বাজনা বাজায়। গান তো আর জানে না আমার মতো। সেজন্য আমি গলা খুলে গাইতে শুরু করলাম – ‘জাগো সকল অমৃতেরও অধিকারী’। পুরোটা গাইলাম। তখন তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে মাকে বললেন যে, একে শেখানোর জন্যই আমাকে আরো বেঁচে থাকতে হবে।
একবার তিনি পুজোর ছুটিতে লাইব্রেরির বারান্দায় বাজাবেন। আর আশ্রমবাসী গৌরপ্রাঙ্গণ ঘিরে বসেছে। যখন বসেছেন তখন একটা সাদা ধবধবে ড্রেস। তন্ময় হয়ে বাজাতে বাজাতে দুঘণ্টা বাদে আমরা দেখি, ওনার সমস্ত শরীর সবুজ হয়ে গেল। সাদাটা সবুজ হয়ে গেল। শ্যামাপোকা। গাছপালা থেকে বেরিয়ে ওঁকে ঘিরে ফেলেছিল। ওনার ওপর আলো পড়ছে। আমরা অন্ধকারে। পোকাগুলো যাবে কোথায়! আসল কথা হলো, তিনি দুঘণ্টা ওই সবুজের মধ্যে বসে বাজালেন, কোনো হুঁশ নেই। যখন উঠলেন তখন ঝেড়েঝুড়ে উঠলেন। একেই বলে সাধনা!

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.