সোমেন চন্দের জন্মের পর একশ’ বছর পার হতে চললো। তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে, মৃত্যু ১৯৪২-এ, অর্থাৎ বেঁচেছিলেন মাত্র ২২ বছর। স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে নি, সেটাও অবশ্য ঘটতে পারতো, কারণ কৈশোরে তিনি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যে-রোগে সুকান্ত ভট্টাচার্য মারা যান, আরও কম বয়সে। মৃত্যুকালে সুকান্তের বয়স ছিল ২১ বছর; সুকান্তের জন্ম ১৯২৬-এ, মৃত্যু ১৯৪৭-এ। সুকান্ত অধিক পরিচিত, সোমেনের চাইতে। তার একাধিক কারণ আছে। সুকান্ত সোমেনের পরের লেখক; আবার সুকান্ত ছিলেন বাংলার রাজধানী কলকাতার, সোমেনের বসবাস মফস্বল শহর 888sport appতে। প্রকাশের সুযোগ রাজধানীবাসী সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্য বেশি ছিল, মফস্বলবাসী সোমেন চন্দের তুলনায়। গুণগত তুলনার প্রশ্ন অবান্তর, দু’জনেই ছিলেন অসাধারণ প্রতিভাবান; কিন্তু তাঁদের প্রকাশের মাধ্যম ছিল স্বতন্ত্র; সুকান্ত 888sport app download apk লিখেছেন; সোমেন ছিলেন কথা888sport live footballিক। এটা অনস্বীকার্য যে, 888sport app download apkর আবেদন সবসময়েই অধিক, গদ্যের তুলনায়; 888sport app download apk 888sport app download for androidে থাকে, উদ্ধৃত হয়, মুখে মুখে ফেরে; গদ্যের জন্য সে-সুযোগ কিছুটা হলেও কম। দু’জনের ভেতর গভীর ঐক্য ছিল আরেক জায়গায়, উভয়েই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেই শ্রেণীর সীমানা ও নিষেধ ভেঙে তাঁরা দু’জনেই বের হয়ে এসেছিলেন। তাঁরা বিপ্লবী ছিলেন। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নন, সমাজবিপ্লবী। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কমিউনিস্ট।
888sport cricket BPL rate-বাইশ বছরের দুই তরুণ, কৈশোর পার হয়ে যৌবনে মাত্র পা দিয়েছেন, ওই সময়েই তাঁরা চলে গেলেন। যক্ষ্মা রোগের তখন সুচিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না, থাকলে সুকান্ত হয়তো আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতেন। সোমেন তাঁর শারীরিক ব্যাধি কাটিয়ে উঠেছিলেন, কাজ করছিলেন দিন-রাত, পার্টির কাজ সারাদিন, লেখার কাজ রাতভর। বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, হারিকেনের আলোতে লিখতে হতো। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে সোমেন খেয়াল করেন নি, রাত কেটে কখন সকাল হয়ে গেছে। অত্যন্ত কর্মঠ এই যুবকের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে নি। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। যারা হত্যা করলো তাদেরকে দুর্বৃত্ত, গুন্ডা, ভাড়াকরা লোক ইত্যাদি বলার রেওয়াজ আছে; কিন্তু তারা আসলে ছিল রাজনীতিরই লোক, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির। চল্লিশের দশকে জাতীয়তাবাদীরা প্রবল ছিলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ও মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা এমনকি পরস্পরকে হত্যাও করতেন, দাঙ্গা পরিণত হয়েছিল স্বাভাবিক রাজনৈতিক ঘটনায়। হিন্দু সোমেন চন্দ কিন্তু মুসলমান জাতীয়তাবাদী কর্মীদের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান নি, যদিও তেমনটা ঘটতে পারতো, 888sport app শহর বেশ তপ্ত ছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার দরুন, সে-বিপদ নিয়ে সোমেন চন্দের অসাধারণ একটি গল্পও আছে। চিহ্নিত শত্রু হিসেবে সোমেন চন্দকে, রেল শ্রমিকদের চলমান এক মিছিলের সামনে থেকে টেনে বের করে, ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে কয়েকজন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী। নিজেদেরকে তারা দেশপ্রেমিক বলেই নিশ্চিন্ত জানতো, দেশবাসীও তাদেরকে ওই পরিচয়েই চিনতো, কারণ তারা ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দলের লোক, ফরওয়ার্ড ব্লক ও রেভ্যুলেশ888sport promo code সোশালিস্ট পার্টির সদস্য। এরা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ছিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে তাড়াবার লক্ষ্যে সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজ তখন ভারত সীমান্তের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। কমিউনিস্টরাও তো দেশের শত্রু ছিল না। তারা জেল খেটেছে, তাদের পার্টি নিষিদ্ধ হয়েছে, দিনের পর দিন তারা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করেছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা ছিল উগ্র, তাদের ভেতর অন্ধত্ব দেখা দিয়েছিল, তারা মনে করেছিল কমিউনিস্টরা দেশদ্রোহী। কমিউনিস্টরা ব্রিটিশের পক্ষের লোক, কাজেই ঘরের শত্রু বিভীষণকে নির্মূল করাটা জাতীয়তাবাদীদের জন্য ওই বিশেষ মুহূর্তে একেবারে প্রাথমিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঘাতক রাজনৈতিক কর্মীরা সোমেন চন্দকে চিনতো। সোমেন চন্দ তখন ইস্ট বেঙ্গল রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। সে-কাজ তিনি করতেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবেই। ৮ মার্চ ১৯৪২ সাল। সোমেন সেদিন একটি মিছিলের সামনে ছিলেন, মিছিলের সামনেই তিনি সাধারণত থাকতেন। মিছিল যাচ্ছিল শহরের সূত্রাপুরে, সেখানে ফ্যাসিস্টবিরোধী এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সোমেন ছিলেন আয়োজকদের একজন।
তবে ভ্রান্তি কেবল যে সুভাষপন্থীদের ক্ষেত্রেই সত্য ছিল তা মোটেই নয়। কমিউনিস্টরাও ভুল করেছেন। তাঁদের প্রথম ভুল এই যে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে তাঁরা নেতৃত্ব দিতে পারেন নি। সেটা শুধু ভুল নয়, অপারগতাও। অথচ তাঁরাই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। কেবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নন, ছিলেন তাঁরা পুঁজিবাদবিরোধীও। সাম্রাজ্যবাদ যে পুঁজিবাদেরই রাজনৈতিক রূপ, এটা তাঁরা জানতেন। এবং তাঁদের লড়াইটিতে আপোসের কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু তাঁরা জোর দিয়ে, সাহসের সঙ্গে, বলতে পারেন নি যে, দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব চাই, এবং সেটি ঘটবে জাতীয়তাবাদীদের নয়, কমিউনিস্টদেরই নেতৃত্বে। বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা। সে-পরিকল্পনাও তাঁরা করতে পারেন নি। তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন ‘কংগ্রেস-লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি এক হও’। ফলে জনগণের মনেও ধারণা হয়েছে যে, এঁরা ভালো মানুষ, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা এঁদের কাজ নয়। ভেবেছে, ‘আজাদীকে লিয়ে কংগ্রেস, রোটিকে লিয়ে কমিউনিস্ট’। কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপ্লবী মনে হয় নি, মনে হয়েছে বামপন্থী সংস্কারবাদী। বলা বাহুল্য, জাতীয়তাবাদীরাও সাম্রাজ্যবাদবিরোধীই ছিলেন। অতিঅবশ্যই। কিন্তু পুঁজিবাদকে তাঁরা যে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এমন নয়। সুভাষ বসু নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে জানতেন, সমাজতন্ত্রের কথা বলতেনও, কিন্তু তাঁর সমাজতন্ত্র মার্কস-এঙ্গেলসের সমাজতন্ত্র ছিল না, ছিল ভারতীয়। জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে আগে জাতীয়তাবাদী পরে সমাজতন্ত্রী হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। ইতিহাসে এমন ঘটনার বিস্তর প্রমাণ আছে। এমন কি শরৎচন্দ্রের মতো মনেপ্রাণে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লেখকও যে বিপ্লবের কথা সোৎসাহে বলেছেন সেটা সমাজতন্ত্রী নয়, ‘ভদ্রলোকের’ বিপ্লব বটে। তাঁর তৈরি সব্যসাচী ছিলেন ভদ্রলোকের বিপ্লবের মুখপাত্র। ভদ্রলোকরা পুঁজিবাদকে দুশমন হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত ছিল না, তাদের ভেতরে সামন্তবাদী পিছুটানও ছিল।
কমিউনিস্টদের আরেকটি প্রাথমিক অপারগতা এই যে, তাঁরা জাতি-সমস্যার মীমাংসার ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী ভূমিকা নেন নি। ভারতবর্ষ যে একজাতির দেশ নয়, বহুজাতির দেশ, সেটি তাঁদের অজানা ছিল না, জাতি গঠনে ভাষার ভূমিকাই প্রধান – এই ধারণাও তাঁরা নিশ্চয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছ থেকে, কিন্তু ওই জ্ঞানকে তাঁরা স্পষ্টভাবে দেশবাসীর কাছে নিয়ে যান নি। নিয়ে গেলে এবং ওই সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপর হলে ব্রিটিশ শাসনাধীনে সম্প্রদায় যে জাতি হয়ে গেল এবং হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে রক্তাক্ত করলো, যার পরিণতিতে সাতচল্লিশে দেশভাগ ঘটলো, সে-ট্র্যাজেডিটা হয়তো ঘটতো না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে সামনে নিয়ে আসার কাজটা তাঁরা করেন নি। দুই জাতীয়তাবাদী দল দুই দিক থেকে হইহই করে এগিয়ে গেল, তাতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিলো, লাখ লাখ মানুষ বাসভূমি থেকে উৎপাটিত হলো, এবং জাতীয়তাবাদীদের ‘দেশপ্রেমিক’ অস্ত্রাঘাতে সোমেন চন্দের মতো মুক্তিসংগ্রামীদের প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটলো। কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় অপারগতাটা হলো কৃষকদের কাছে যথোপযুক্ত রূপে যেতে না-পারা।
এরপরের দুর্বলতাটা হলো পথনির্দেশের জন্য সমাজতন্ত্রের পিতৃভূমি সোভিয়েট ইউনিয়নের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা। এটা বিশেষভাবে ঘটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে, হিটলারের সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণের সময়ে। ওই আক্রমণের দরুন বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে কমিউনিস্টদের দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে গেল; এতক্ষণ পর্যন্ত যা ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ দ্রুতই তা পরিণত হলো জনযুদ্ধে। হিটলার সোভিয়েট ইউনিয়নের শত্রু এবং হিটলারের শত্রু হচ্ছে ব্রিটিশরা; তাই ব্রিটিশরা আপাতত কমিউনিস্টদের শত্রু নয়, শত্রুর শত্রু হিসেবে তারা মিত্রসম, এই অবস্থান ভারতের কমিউনিস্টরা জোরেশোরে গ্রহণ করায় তাদের বিপদ এলো, ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচারে-জর্জরিত ও মুক্তির-জন্য-অস্থির জনগণের কাছ থেকে যেমন তেমনি আবার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদীরা লড়ছিলেন তাদের কাছ থেকেও। ব্রিটিশের সমর্থক বলে চিহ্নিত হয়ে কমিউনিস্টরা অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন, এবং জাতীয়তাবাদী লড়াকু সংগ্রামীদের কাছে হঠাৎ করেই তাঁরা মহাশত্রু হিসেবে দাঁড়িয়ে গেলেন। ওদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিতে কমিউনিস্টরাই মূল শত্রু, জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় অধিক অঙ্গীকারবদ্ধ, এই সত্যটাও মিথ্যা হয়ে গেল না। শ্রমিক ও ছাত্র ফ্রন্টে, এমনকি নৌবাহিনীর ভেতরও কমিউনিস্টদের তৎপরতার তুলনায় জাতীয়তাবাদীর কাজ অকিঞ্চিৎকর।
কমিউনিস্টরা যা করতে পারতেন তা হলো যুদ্ধপরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়া, লেনিনের পার্টি যেমনটা করেছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। তবে সে-রকম সাংগঠনিক শক্তি ও প্রস্তুতি ভারতের কমিউনিস্টদের ছিল না। তেমন অবস্থায় তাঁরা অবশ্য উদ্যোগ নিতে পারতেন সকল ব্রিটিশবিরোধী শক্তিকে একত্র করে একটি জাতীয় সরকার গঠনের। সেটা তাঁরা করেন নি। ওদিকে দেশের বাইরে চলে গিয়ে সুভাষ বসু যেহেতু যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার আওয়াজ তুলেছেন সত্যাগ্রহী
গান্ধীজি তাই বাধ্য হয়ে ডাক দিলেন ‘ভারত ছাড়’-এর। ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করার মতো শক্তি কংগ্রেসের অবশ্য ছিল না; কিন্তু সাধারণ মানুষ যেহেতু ওই রকমের একটা ডাকের জন্য অপেক্ষা করছিল তাদের দিক থেকে তাই ভালো সাড়া পাওয়া গেল। ওই মুহূর্তে কমিউনিস্টদের জনবিচ্ছিন্নতাটা বাড়লো এবং সুভাষপন্থীরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ‘বিশ্বাসঘাতক’ কমিউনিস্টদের ওপর। সেই ক্ষিপ্তদশারই শিকার হলেন 888sport appর সোমেন চন্দ। দেশের অন্যত্রও এমন ঘটনা ঘটেছে; কেউ কেউ নিহতও হয়েছেন; কিন্তু সোমেন চন্দ যেহেতু অনেক বেশি পরিচিত ছিলেন এবং কেবল রাজনৈতিক কর্মী নন, 888sport live footballিকও ছিলেন, তাই তাঁকে হত্যা করার ঘটনা ব্যাপক ও গভীর দুঃখের ও প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়েছিল।
কমিউনিস্টরা তখন আরও একটি ভুল করেছিলেন। সেটা হলো সুভাষ বসু ও তাঁর দলকে অমার্জিত ভাষায় আক্রমণ করা। তাঁদের বক্তব্য, বিবৃতি, প্রচারণায় নেতাজিকে বলা হচ্ছিল জাপানের দালাল, পত্রপত্রিকায় ব্যঙ্গচিত্র এঁকে দেখানো হচ্ছিল যে, সুভাষ রূপান্তরিত হয়ে গেছেন জাপানি সম্রাট তোজোর পালিত কুকুরে। দেশের অধিকাংশ মানুষ যে-সুভাষ বসুকে দুর্ধর্ষ বীর ও ত্রাণকর্তা হিসেবে দেখছিল তাঁকে এভাবে চিত্রিত করা সুভাষপন্থীদের জন্য তো নয়ই অন্যদের পক্ষেও মেনে নেওয়াটা সহজ হয় নি। ব্রিটিশকে চরমভাবে ঠেঙাচ্ছে দেখে তখন এমনকি হিটলারের প্রতিও বিস্তর মানুষের অনুরাগ সৃষ্টি হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতেই প্রতিহিংসাপরায়ণ অন্ধ জাতীয়তাবাদীরা সোমেন চন্দকে হত্যা করেছে। তারা বোঝে নি, তাদের বুঝবার কথাও নয় যে, ওই হত্যাকা-টি ঘটিয়ে দেশের সংস্কৃতি ও রাজনীতির জন্য তারা কত বড় একটা ক্ষতি করলো।
দুই
চল্লিশের দশকে 888sport app শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল অতিপরিচিত ঘটনা। শহরের বাসিন্দারা তখন মস্ত ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছিল। বিপদটা যে কেমন তার সজীব একটা ছবি আছে সোমেনের লিখিত ‘দাঙ্গা’ নামের গল্পটিতে। গল্পের নায়ক অশোক। বোঝা যাচ্ছে সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। গল্পের শুরুতেই দাঙ্গায় আতঙ্কিত শহরের একটি ছবি আছে। ভীতসন্ত্রস্ত একটি লোক খুব তাড়াতাড়ি রেলের লেভেল ক্রসিং পার হচ্ছিল।
তাহার হাতের কাছে বা কিছু দূরে একটা লোকও দেখা যায় না – সব শূন্য, মরুভূমির মতো শূন্য। দূরে পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে মাঝে মাঝে দুই-একটি সুদৃশ্য মোটরকার হুস করে চলে যায় বটে, কিন্তু এতো তীব্র বেগে যায় যে মনে হয় যেন এই মাত্র কেউ তাকেও ছুরি মেরেছে, আর সেই ছোরার ক্ষত হাত দিয়ে চেপে ধরে ছুটে চলেছে। নির্জন রাস্তায় মোটর গাড়ির এমনি যাতায়াত আরও ভয়াবহ মনে হয়।
অল্পকথার ভেতর দিয়েই শহরের মানুষের নিরাপত্তাহীনতার বাস্তবতাটাকে স্পষ্ট করা হয়েছে। সোমেন চন্দ কবি নন, কথা888sport live footballিক, কিন্তু 888sport app download apkর যে-গুণ, উপমার ব্যবহার, তা এই তরুণ গল্পলেখকের গল্পে খুব প্রয়োজনীয় অথচ খুব স্বাভাবিকভাবে চলে এসেছে। মরুভূমির মতো শূন্যতা, ক্ষত চেপে ধরে ছুরিকাহত মানুষের মতো মোটরগাড়ির ছুটে যাওয়া – এমন উপমা জনহীন রাস্তার ভয়াবহতাকে এক মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে নিয়ে আসে। এরকমের উপমা সোমেন চন্দের লেখায় আমরা সবখানেই পাই। উপমাগুলো বন্ধুর মতো অপেক্ষা করে থাকে, সাহায্য করবে বলে। সন্ত্রস্ত যে-লোকটি দ্রুত পথ পার হচ্ছিল তাকেও আমরা দেখতে পাই। ছবিটা সচল। ছবির এই সচলতা তৈরিতে 888sport live chatী সোমেনের বিশেষ দক্ষতা। সন্ত্রস্ত লোকটির বর্ণনা এই রকমের,
তার পরনে ছেঁড়া ময়লা একখানা লুঙ্গি, কাঁধে ততোধিক ময়লা একটি জামা, মাথায় একটা গামছা, মাথার চুলগুলি কাকের বাসার মতো উস্কোখুস্কো, মুখটি করুণ। তার পায়ে অনেক ধুলো জমেছে, কোনো গ্রামবাসী মনে হয়।
মানুষের অবয়ব, পোশাক, পরিস্থিতি, পর্যবেক্ষণ থেকে কোনো কিছুই বাদ পড়ে না তাঁর ছোটগল্পগুলোতে। সকলেই উপস্থিত ও প্রাণবন্ত। খুঁটিনাটি আছে, কিন্তু ঘটনার অগ্রগতি তাতে আটকা পড়ে থাকে না, খুঁটিনাটি আসে গল্পের অনুষঙ্গ হিসেবেই, কাহিনীকে সাহায্য করবে বলেই। আবার আশ্চর্য সংযম এই কথা888sport live footballিকের। সবকিছু বলেন না, অনুমান ও কল্পনা করবার কিছুটা দায়িত্ব দিয়ে দেন পাঠককে। যেমন গল্পের ওই লোকটির বেলাতে ঘটেছে, লোকটিকে যে গ্রামবাসী মনে হয় লেখক তা জানিয়েছেন, কিন্তু তাকে যে মুসলমান বলে মনে হচ্ছে সেটার উল্লেখ করেন নি। জানেন, সেটুকু পাঠক নিজে থেকেই বুঝে নেবে, বুঝে নিয়ে লোকটি সম্পর্কে আরও কৌতূহলী হয়ে উঠবে।
সন্ত্রস্ত লোকটা তো মাঠ ছেড়ে রাস্তায় পড়লো। এরপর কী হলো?
এমন সময় কথাবার্তা নেই দু’টি ছেলে এসে হাজির, তাদের মধ্যে একজন কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে লোকটার পেছনে একবার বসিয়ে দিলো। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল, ছেলেটি এতোটুকু বিচলিত হলো না, লোকটার গায়ে যেখানে-সেখানে আরও তিনবার ছোরা মেরে তারপর পালালো, কুকুর যেমন লেজ তুলে পালায় তেমনি ছুটে পালালো। লোকটা আর্তনাদ করতে করতে গেটের কাছে গিয়ে পড়লো, তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে, টাটকা লাল রক্ত, একটু আগে দেখেও মনে হয়নি এত রক্ত ওই কংকালসার দেহে আছে।
লেখকের পর্যবেক্ষণ আছে, তাঁর কল্পনাশক্তিও কাজ করছে। ছবিটা খুবই জীবন্ত ও দুঃসহ উঠেছে। সোমেন চন্দ নিশ্চয়ই জানতেন না যে এই গল্প লেখার বছর দুয়েকের ভেতরই তিনি নিজেই অচেনা ওই লোকটির মতোই নিহত হবেন, এবং সেটা ঘটবে ওই রকম ঘাতকদের ছুরিতেই। ছুরি মেরে ঘাতকরাও ওই ভাবেই পালিয়ে যাবে।
জানতেন না, কিন্তু টের পাচ্ছিলেন যে ওই রকমেরই একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নিয়ে শহরের মধ্যবিত্তদের নিজেদের বসতবাড়িতেই হৃষ্টপুষ্ট ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। বাইরে দাঙ্গা, গলির মুখ অবরুদ্ধ, সশস্ত্র পুলিশ ও মিলিটারী টহল দিচ্ছে, এরই মধ্যে নায়ক আশোকের আপন ছোট ভাই অজয় (গল্পের নায়ক যে লেখক নিজেই তার ইশারা গল্পের ভেতরেই আছে) এমন সব কথা বলছে যাতে অনুমান করা সংগত যে পারলে তখনই সে ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়বে, দু’চারজন মুসলমান মেরে এসে তবে শান্ত হবে। এই ভাইটি সম্পর্কে অশোকের মন্তব্য,
অজু একজন হিন্দু সোসালিস্ট। সম্প্রতি দাঙ্গার সময় জিনিসটির পত্তন হয়েছে। এই বিষয়ে শিক্ষা নিতেই সে পাগলের মতো ঘোরাফেরা করে। উচ্চস্বরে মানুষের সঙ্গে তর্ক করে, হিটলারের জয়গান করে, হানাহানিতেও প্রচুর আনন্দিত হয়।
একেবারে আপন ভাইয়ের হাতে না হলেও অজয়ের মতোই একজন বিভ্রান্ত জাতীয়তাবাদীর হাতেই তো অশোকের বেনামীতে গল্পটির লেখক সোমেন চন্দকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ‘হিন্দু সোশালিস্ট’ অজয়কে সম্বোধন করে কমিউনিস্ট অশোক যা বলেছে সেটা সোমেনও বলতে পারতেন তাঁর ঘাতকদের উদ্দেশে, যদি তিনি সময় পেতেন।
অশোক উত্তপ্ত স্বরে বলে,
ফ্যাসিস্ট এজেন্ট, বড়লোকের দালাল। আজ বাদ কালের কথা মনে পড়ে যখন ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-বোনেরা’ বলে গাধার ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক শুনবে কে? পেট মোটা হবে কার? স্টুপিড, জানিস দাঙ্গা কেন হয়? প্যালেস্টাইনের কথা জানিস? জানিস আয়ারল্যান্ডের কথা, মূর্খ!
অশোকের আরও কিছু কথা ছিল তার ভাইকে বলবার। কিন্তু বলতে পারল না, কারণ পাশের ঘর থেকে একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো। আর্তনাদটা তার মা’য়ের। মা অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছেন। রাত হয়ে গেছে, বাইরে দাঙ্গা চলছে, বাবা তখনো ঘরে ফিরে আসেন নি। মায়ের কঠিন দুশ্চিন্তা। ওদিকে মাসেরও শেষ, ঘরে টাকাপয়সা নেই। মায়ের এই উদ্বেগ, তার এই আর্তকণ্ঠ, এটি সোমেন চন্দের ‘বিত্তহীন মধ্যবিত্তে’র [অর্থাৎ নিম্নমধ্যবিত্তের] জীবনে অত্যন্ত দুঃসহ, মর্মান্তিক সত্য। নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনে সাধারণ সত্য হলো অভাব, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, সংকীর্ণতা, ঈর্ষা, ইত্যাদি। সোমেন চন্দ এই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেরই সন্তান, এর চিন্তা-দুশ্চিন্তা সবই তিনি জানেন, সেসব তিনি নিয়েও এসেছেন তাঁর গল্পে। না-আনলে তো গল্পগুলো দ্বিমাত্রিক হতো, হাওয়ায় ভেসে যেতো, মোটেই মূল্যবান হতো না। গোটা ব্যবস্থাটা পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক। আয়-রোজগার যা তার সবটুকু পিতাই করেন। পিতাই কর্তা। শাসক ও রক্ষক। তাঁকে ঘিরেই সংসার। এটা সোমেন তাঁর লেখাগুলোতে ভালোভাবেই দেখিয়েছেন। কিন্তু আবার পিতাদের অপারগতাও তাঁকে দেখাতে হয়েছে। সেক্ষেত্রে মায়েরা ও মেয়েরা একেবারেই অসহায়। কিন্তু সব মেয়েরা নয়। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। বেরিয়ে যায়। যেমনটা ‘সত্যবতীর বিদায়’ গল্পে ঘটেছে। সত্যবতী বৃদ্ধা, বিধবা, অসহায়। এসেছিল সৎপুত্রের বড় সংসারে, আশ্রয়ের আশায়। যখন দেখল আত্মসম্মান আর রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না তখন যেভাবে একলা এসেছিল ঠিক সে-ভাবেই বের হয়ে পড়লো।
এক পরিচ্ছন্ন ভোরবেলায় – বাড়ির একটা লোকও তখনো ঘুম থেকে ওঠে নি, কিন্তু দূরে বড়ো রাস্তায় ট্রাম-বাসের শব্দ প্রবল হয়ে উঠেছে – সত্যবতী তার কালো ইস্পাতের মতো শরীরে একখানি নামাবলী জড়িয়ে নববধূর মতো প্রকা- ঘোমটা টেনে, নিজের ছোট পুঁটুলিটা কাঁধে স্থাপন করে বেরিয়ে পড়লো।
নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছোট্ট মেয়ে রাণুও কিছু কম যায় না। ‘রাণু ও স্যার বিজয়শঙ্কর’ গল্পের প্রধান চরিত্র এই রাণু। পার্কে এসে সে তার পিতাকে হারিয়ে ফেলেছে। বৃদ্ধ স্যার বিজয়শঙ্কর তাকে আশ্বাস দিয়েছে পিতাকে খুঁজে দেবে। বিজয়শঙ্করের বাড়িতে এসে ধনসম্পদের শোভা দেখে রাণুর তো উচিত ছিল একেবারে হতভম্ভ হয়ে যাওয়া। কিন্তু সে তা হয় না। সে বলে, বড়লোকেরা দস্যি, ডাকাত, তারা গরীবদেরটা চুরি করে বড় হয়েছে। বিজয়শঙ্কর জানতে চায়, এসব কথা তাকে কে বলেছে? রাণু জানায়, তার বাবা। রাণুকে বিজয়শঙ্কর ধমকে দেয়, বলে ‘তোমার বাবা মিথ্যুক।’ শুনে রাণু বলে, ‘আপনি মিথ্যুক। আমার বাবাকে খুঁজে বার করে দেবেন বলেছিলেন, বার করে দিলেন কই? আমি সব বলে দেব, বাবাকে সব বলে দেব। বাবা, ও বাবা, আমাকে একা ফেলে তুমি কোথায় গেলে?’ বলে রাণু আর দেরী করে না। কাঁদতে কাঁদতে, বাবাকে ডাকতে ডাকতে, স্যার বিজয়শঙ্করের দোতলা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
সোমেন চন্দ নিজেও নিম্নমধ্যবিত্ত কারাগারে বন্দি থাকতে সম্মত হন নি। তবে তাঁর আস্থা ছিল নিজের ওপর, দৃঢ় ছিল তাঁর মতাদর্শিক অবস্থান। অশোক তার ছোট ভাইকে যেসব কথা বলেছে সেগুলো সোমেন চন্দের নিজের কথাও বইকি। তা কথাগুলো বলার মতো জোরটা অশোক পেলো কোথা থেকে? উৎস কী? উৎস তাঁর মতাদর্শিক অবস্থান। সেটি পরিষ্কার হয়ে যায় দু’ভাইয়ের তর্কাতর্কিতে। বাড়িতে অশোক হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আবেদন জানিয়ে লেখা ইশতাহার রেখেছিল, স্তূপ করে। অজয় তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, একেবারে পুড়িয়ে ফেলবে বলে। আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে করতে অশোক বলে,
‘অজু, তুই ভুল বুঝেছিস। চোখ যখন অন্ধ হয়ে যায় নি তখন একটু পড়াশোনা কর। তারপর পলিটিকস করিস।’
‘দাদা, তোমার কম্যুনিজম রাখো। আমরা ওসব জানি।’
‘কী জানিস, বল?’ অশোকের স্বরে উত্তাপ বাড়লো।
‘সব জানি। আর এও জানি তোমরা দেশের শত্রু।’
‘অজু, চুপ করবি!’
অজয় নিজের মনে গুম গুম করতে লাগলো।
অশোক তার জোরটা পেয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে।
ছেলের এই রাজনীতির ব্যাপারটা অজয়ের মা’ও জানেন। ছেলেকে তিনি বলেন, ‘তোদের রাশিয়ার কী হলো শুনি? পারবে জার্মানীর সঙ্গে?’
শোক বাইরের দিকে চেয়ে বলল, ‘পারবে না কেন? বিপ্লবের কখনো মরণ হয়?’
মা হা করে চেয়ে রইলেন, একটু পরেই চুপি চুপি বললেন, ‘হ্যাঁ রে এ কী সত্যি?’
‘কী মা?’
‘এই যে উনি বললেন, জার্মানি রাশিয়ার সব নিয়ে গেছে, একেবারে আমাদের দেশের কাছে এসে পড়েছে?’
অশোক হো হো করে হেসে উঠলো, ‘এঁরা হিটলারের চেয়েও লাফিয়ে লাফিয়ে চলেন।’
উনি হচ্ছেন তাঁর স্বামী, অশোকের পিতা। পিতার তুলনায় মা দেখা যাচ্ছে অগ্রগামী। মেয়েদের তো বটেই ছেলেদের সঙ্গেও মা’য়ের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ, বাবার তুলনায়। সোমেন চন্দ তাঁর মা’কে হারান জন্মের অল্প পরেই, চার বছর বয়সে, পিতার দ্বিতীয় স্ত্রীকেই তিনি মা বলে জানতেন, এবং ওই মা’য়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল গভীর নৈকট্যের। সোমেনের হাতে রচিত 888sport live footballিক জগতেও দেখি মেয়েরা যতটা উজ্জ্বল ছেলেরা ততটা নয়। ধরা যাক, ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন’ নামের গল্পটির কথা। শ্রীবিলাস অন্ধ, তার জগৎ খুবই সীমিত, কিন্তু সে খুবই দাপুটে। তিন তিনটি ছেলেমেয়ে ও অন্ধ স্বামীকে নিয়ে সংসারটা চলে স্ত্রী বিন্দুর আয়ে ও পরিচালনায়। বিন্দু বড়লোকের বাড়িতে কাজ করে। বাইরের জগতের যা খবর সেটুকু সে-ই নিয়ে আসে। দুঃসহ সংসার জীবন, তবু প্রাণ আছে, এবং প্রাণ থাকার একমাত্র কারণ ওই বিন্দু।
সোমেন চন্দের একটি মাত্র 888sport alternative linkই পাওয়া গেছে, তারও বড় অংশটা গেছে হারিয়ে। বন্যা নামের ওই 888sport alternative linkের শুরু কিশোরী মালতীকে দিয়ে। 888sport alternative linkের প্রথম বাক্যটি এরকমের, ‘সন্ধ্যার আগে তালবনের নীচে বর্ষার জল দেখিয়া মালতী নিশ্চয় স্বপ্ন দেখিতেছিল।’ মনে হচ্ছিল কাহিনীটি মালতীকে কেন্দ্রে রেখেই গড়ে উঠবে। সেটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু সোমেন পারেন নি। মালতী গল্পের কেন্দ্রে থাকে নি। দুই কারণে। প্রথমত পিতৃতান্ত্রিকতার বাস্তবতায় 888sport alternative linkের জগৎটা স্বভাবতই ঝুঁকে পড়েছে মালতীকে পেছনে রেখে যুবক রজতের দিকে। দ্বিতীয় কারণ 888sport alternative linkে রজতকে তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন তাঁর নিজের মুখপাত্র হিসেবে। রজত সম্পর্কে তাঁর 888sport live footballিক-সুহৃদ নির্মলকুমার ঘোষকে তিনি লিখেছেন, ‘সে আমার 888sport alternative linkের নায়ক, ইচ্ছা করেই আমি তাকে (শুধু তাকেই) অস্বাভাবিক করেছি, তার কারণে, যা আমি বলতে চাই নইলে তা বলা হয় না। একটা নতুন বলিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ওর ওপরই বেশী ছায়াপাত করেছে।’ রজতের একটা মতাদর্শ রয়েছে, বলছেন তিনি। আরও বলছেন যে, রজতের মতাদর্শটা পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না, অনেকখানিই ‘চেপে’ যেতে হয়েছে, বলেছেন যে, লেখক হিসেবে তিনি ‘পুরোপুরি খোলা’ হতে পারেন নি। এর কারণ হলো মতাদর্শটি কমিউনিজম। রজতকে কমিউনিস্ট হিসেবে উপস্থিত করার ব্যাপারে অসুবিধা ছিল। সরকার পছন্দ করতো না। বই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে এমন ঝুঁকি ছিল। কারণ সরকার ছিল ঘোরতর কমিউনিস্ট-বিরোধী, এবং কমিউনিস্ট পার্টি তখন ছিল নিষিদ্ধ। নির্মলকুমার ঘোষ একাধিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, একটি পত্রিকা সম্পাদকীয়তে বঞ্চিত মানুষের দুঃখাবসানের জন্য বিপ্লব যে আবশ্যক, এমন কথাও বলা হয়েছিল। সোমেন তাঁকে লিখেছেন, ‘খুবই ভালো লাগলো, আমি নিজেই অনুভব করছি যেন।’ কিন্তু এমন কি বিপ্লব-সমর্থক ওই সম্পাদককেও সোমেন চন্দ এটা খোলাসা করে বলতে পারেন নি যে বন্যা 888sport alternative linkে তাঁর কল্পনার নায়কটি একজন কমিউনিস্ট। এর কারণ নির্মলকুমার ঘোষ বিপ্লবের পক্ষে হলেও ছিলেন কমিউনিস্ট-বিরোধী। মালতী প্রসঙ্গে যা বলছিলাম। মালতী যে একজন কমিউনিস্ট হবে সেটা তো সম্ভব ছিল না; মালতীকে দিয়ে কাহিনীর শুরু হলেও সে যে প্রধান চরিত্র হবে না এটা ছিল একেবারেই অবধারিত।
অশোক একটি ছোটগল্পের নায়ক; তাই চকিতে এক ঝলকে তার কমিউনিস্ট পরিচয়টা জানানো গেছে। সেটা না জানালে দাঙ্গার ওই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অশোকের জোরটা কোথা থেকে এলো সেটা বোঝানো যেত না। ওই জোরটা ছিল বলেই না ছোট ভাইটিকে সে ফ্যাসিস্ট বলতে পেরেছে; দাঙ্গার বিরুদ্ধে ইশতাহার বিলিতে তার সাহসের কোনো অভাব ঘটে নি। মা তাকে বারবার বলেছেন কিছুদিন মামাবাড়িতে কাটিয়ে আসতে। মারামারি কমলে তবে আসতে পারত। অশোক যায় নি। সে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে এবং দাঙ্গার বিরুদ্ধে কাজ করতে চেষ্টা করেছে। সে জানে দাঙ্গা হচ্ছে জনবিরোধী একটা ষড়যন্ত্র।
শেষ দৃশ্যে দেখা গেল অশোক চলেছে তার সাইকেলে চড়ে। যাবে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী একটি মিটিং-এ। এক জায়গায় দেখে নির্জন পথের মাঝখানে খানিকটা রক্ত। দেখে সে থামে। ‘অশোকের চোখে জল এলো, সবকিছু মনে পড়ে গেল। সে চারদিকে ঝাপসা দেখতে লাগলো, ভাবলো, এই চক্রান্ত ব্যর্থ হবে কবে।’ অশোক কিন্তু জানে চক্রান্তটা এমনি এমনি বন্ধ হবার নয়, চক্রান্তকে বন্ধ করতে হবে। আর সেজন্যই তো সে ছোটাছুটি করছে। সে তো একজন কমিউনিস্ট।
দাঙ্গা-বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে ঘরে ফিরতে বাবার বিলম্ব দেখে মা যখন কাতর হয়ে এক পর্যায়ে ভগ্নস্বরে কাঁদতেই শুরু করে দিয়েছেন অশোক কিন্তু তখনও সাহস হারায় না, বরং নিজের কী কর্তব্য সেটা বুঝে নিয়েছে।
মাটির দিকে চেয়ে অশোক মনে মনে বললে, ‘আগামী নূতন সভ্যতার যারা বীজ, তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে আমি যোগ দিয়েছি, তাদের সুখ-দুঃখ আমারও সুখ দুঃখ। আমি যেমন বর্তমানের সৈনিক, আগামী দিনেরও সৈনিক বটে। সে জন্য আমার গর্বের সীমা নেই। আমি জানি আজকের চক্রান্ত সেদিন ব্যর্থ হবে, প্রতিক্রিয়ার ধোঁয়া শূন্যে মেলাবে। আমি আজ থেকে দ্বিগুণ কর্তব্যপরায়ণ হলাম, আমার কোন ভয় নেই।
তিন
আটকে-পড়া দশাটা খুব ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে সোমেনের সবচেয়ে-আলোচিত গল্প ‘ইঁদুর’-এ। গল্পের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারটিকে গলির ভেতর চেপে ধরে রেখেছে যে শত্রু সেটি দাঙ্গা নয়, দাঙ্গার চেয়েও যা স্থায়ী সেই দারিদ্র্য। গল্পের শুরুতেই নায়ক সুকুমার জানাচ্ছে যে, তাদের বাসাতে ইঁদুরের উৎপাত এতটাই বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না। ‘তাদের সাহস দেখে অবাক হতে হয়।’ ইঁদুরগুলো বাস্তবিক সত্য। তারা আছে, নিম্নমধ্যবিত্তের বাড়িতে যেমনটা থাকা স্বাভাবিক। আবার তারা রূপকও। পুঁজিবাদের রূপক। যে পুঁজিবাদ উৎপাত করে, কুরে কুরে খায়। ইঁদুরদের তৎপরতায় কোনো বিরতি নেই। জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। পাগল হবার দশা। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন সুকুমারের মা।
এর মধ্যেই ঘটলো এক ঘটনা।
মা’য়ের ডাকাডাকিতে সাড়া দিয়ে মায়ের অঙ্গুলি নির্দেশে সুকুমার যা দেখল তাতে বিস্মিত হবার কারণ থাকলেও সে বিস্মিত হতে চাইল না। সে দেখতে পেল,
আমাদের ক্বচিৎ-আনা দুধের ভাড়টি এক পাশে হা করে আমার দিকে চেয়ে আছে আর তারই পাশ দিয়ে একটা সাদা পথ তৈরি করে এক প্রকা- ইঁদুর দ্রুত চলে গেল।
দৃশ্যটি দেখে সুকুমার একটি দার্শনিক অবস্থান গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু মা জানেন ঘটনার তাৎপর্যটা কেমন ভয়াবহ। তাঁর নিজের কোনো দোষ নেই, তবু পরিণতির আতঙ্কে তিনি কেঁদেই ফেলেন। বাবা ফিরলেন সন্ধ্যার পরে। তাঁর ভাব দেখে মনে হলো তিনি হতভম্ব হন নি, দুঃখও পান নি। বরং বললেন, বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে। ‘আরে, মানুষের জান নিয়েই টানাটানি দুধ খেয়ে আর কী হবে বলো।’
দেখতে পেলুম, বাবার মুখটি যদিও শুকনো তবু প্রচুর ঘামে তৈলাক্ত দেখাচ্ছে, গায়ের ভারী জামাটাও ঘামে ভিজে ঘরের ভিতর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরেই বাবা তাঁর সুর বদলালেন। তিনি গালাগাল শুরু করলেন। “সময়ের পদক্ষেপের সঙ্গে স্বরের উত্তাপও বেড়ে যেতে লাগলো।” মা কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। তাতে বাবার রাগ আরও চড়লো। শেষ পর্যন্ত মা বললেন, “এত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। চেঁচামেচি করে পৃথিবী সুদ্ধ লোককে নিজের গুণপণার কথা জানানো হচ্ছে, খুব সুখ্যাতি হবে।”
শুনতে পেলুম, এরপরে বাবার গলার স্বর বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে বোমার মত ফেটে পড়লো। – ‘তুমি যাবে? এখান থেকে যাবে কিনা বলো। গেলি তুই আমার চোখের সামনে থেকে? শয়তান মাগী।’
এর পরে আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘শয়তান মাগী, বেরিয়ে যা।’
আটকে-পড়া নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষদের এই ছবি আমাদের কিছু কম পরিচিত নয়, এ নিয়ে সোমেন চন্দের আগেও কেউ কেউ লিখেছেন। লেখা হয়েছে তার পরেও। সুকুমারের মা যে চলে যাবেন না তার কারণ যাবার জন্য তাঁর কোনো জায়গা নেই। এবং পরে, গভীর রাতে, বাবা যে মা’কে আদর ভরে নাম ধরে ডাকবেন, এবং সে-ডাক শুনে সুকুমারের মনে যে চমৎকার একটা প্রতিক্রিয়া হবে এবং ‘মনে মনে’ সে যে তার প্রৌঢ় পিতাকে তার ‘বয়স ফিরিয়ে’ দেবে, এও খুব একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। তবে গল্পে ব্যতিক্রম আছে। একটি ব্যতিক্রম হলো ‘এক দিন এক অলস মধ্যাহ্নের সঙ্গে’ সুকুমারের প্রেমে-পড়া। প্রেমে-পড়ে একটি স্বপ্ন-দেখা।
আকাশের নীলিমায় দুই চোখকে সিক্ত করে আমি দেখতে পেলুম চওড়া রাস্তার পাশে পাশে সারি সারি প্রকা- দালান, তার প্রতি কক্ষে সুস্থ সবল মানুষের পদক্ষেপ, সিঁড়িতে নানা রকমের জুতোর আওয়াজ। […]
সে আরও দেখে,
ট্রাকটর চলছে, মাঠের পর মাঠ পার হয়ে – অবাধ্য জমিকে ভেঙে-চুরে দলে-মুচড়ে, সোনার ফসল আনন্দের গান গায়, আর যন্ত্রের ঘর্ষণে ও মানুষের হর্ষধ্বনিতে এক অপূর্ব সংগীতের সৃষ্টি হলো। একদা যে বাতাস মাটির মানুষের প্রতি উপহাস করে বিপুল অট্টহাসি হেসেছে, সেই বাতাসের হাত আজ করতালি দেয় গাছের পাতায়।
শহরে ও গ্রামে উন্নতি হয়েছে। একত্রে। প্রাচুর্য এসেছে উৎপাদনের ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য ফিরেছে মানুষের, আনন্দ সর্বত্র। ছবিটি পুঁজিবাদী উন্নতির নয়; সম্পূর্ণ বিপরীতে যে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা, তার। মালিকানা, বোঝাই যাচ্ছে, ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক। এমন উন্নতির খবর পাওয়া গেছে সোভিয়েট দেশে। নোংরা, অন্ধকার, দুর্গন্ধময়, জনাকীর্ণ, অসুস্থ, কলহমুখর গলিতে, ইঁদুরের অত্যাচারে-অতিষ্ঠ কারাগারসম ঘরসংসারের দমবন্ধ-করা বসবাস থেকে অব্যাহতির ছবিটা সুকুমার যে শুধু কল্পনাতেই দেখে তা নয়, বাস্তবেও তার সন্ধান পায়। পায় মেহনতী মানুষের খোলামেলা, প্রাণবন্ত, কৌতুকস্নিগ্ধ সান্নিধ্যে। এরা সবাই রেলের শ্রমিক। শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য, এবং সদস্য হওয়ার জন্য গর্বিত। এদের মধ্যে হিন্দু আছে, আছে মুসলমান। আছে শশধর, রয়েছে ইয়াসিন। দাঙ্গা এখানে অকল্পনীয়। অথচ শহর তখন দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত।
রেলওয়ে ইয়ার্ডে মেহনতী এই মানুষদের সঙ্গে থেকে সুকুমার টের পায় যে তার মধ্যাহ্নের ট্রাক্টর-স্বপ্নটির ভিত পাকা হচ্ছে। মধ্যরাতে একদা যে সুকুমার মনে মনে তার পিতাকে যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিল, মনে মনেই আজ সে ভিন্ন একটি কাজ করে। কাজটি এরকমের।
ইতিহাস যেমন আমাদের দিক নেয়, আমিও ইতিহাসের দিক নিলুম। আমি হাত প্রসারিত করে দিলুম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিনন্দনে আমি ধন্য হলুম। তাদেরকেও ধন্যবাদ, যারা আমাকে আমার এই অসহায়তার বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। সেবাব্রত নয়, মানবতা নয়, স্বার্থপরতা, অথচ শ্রেষ্ঠ উদারতা নিয়ে এক ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক অনুশীলন।
ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যে-ইতিহাসকে সুকুমার চিনতে পেরেছে সে-ইতিহাস অগ্রগতির, আর সে-অগ্রগতি অন্ধ গলিতে বসবাসের নয়, প্রাচুর্যের জগতে প্রবেশের। একা নয়, সকলের সঙ্গে মিলে। সুকুমারের শ্রমিক-বন্ধু ইয়াসিন বলে, সুকুমারের অন্যবন্ধুরা বলাবলি করছে সুকুমার একটা ব্যারিস্টার হলো না কেন? শুনে সবাই হাসে। জোরে জোরে হাসে। ওরা জানে সুকুমার ব্যারিস্টার হবার গুণ রাখে, কিন্তু কখনোই সে ব্যারিস্টার হবে না। সুকুমারও হাসে, সেও জানে ব্যারিস্টার হবার স্বপ্ন তার জন্য নয়; তার স্বপ্ন মুক্তির যে-স্বার্থপরতা সেই স্বার্থপরতার। অগ্রগতির। যে-অগ্রগতির কারিগর হচ্ছে মেহনতী মানুষ।
সুকুমারের পিতা এবং অশোকের পিতা একই শ্রেণীর বন্ধনে আবদ্ধ। ইতিহাস-পরিত্যক্ত নিম্নমধ্যবিত্ত তারা। তাই মেহনতী মানুষের ইতিহাস-গড়ার শক্তিতে তাদের অবস্থা নেই, আস্থা জাতীয়তাবাদী বীরদের বীরত্বে। যাদের মধ্যে সোভিয়েটের ওপর ঝাঁপিয়ে-পড়া হিটলার ছিলেন প্রধান।
সুকুমার বলছে, তার পিতা এক সময়ে তার কাছে এলেন। এসে বললেন,
তোমরা থিয়োরিটা বার করেছ ভালোই, কিন্তু কার্যকরী হবে না। আজকাল ওসব ভালোমানুষি আর চলবে না। এখন কাজ হলো লাঠির। হিটলারের লাঠি, বুঝলে প-িত মশাই।
কমিউনিস্টরা পারবে না বলেই তাঁদের ধারণা। এবং না-পারলেই ভালো, এমন একটা মনোভাব। এঁরা নিগৃহীত, তাই বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী। প্রতিশোধ চান, চান ক্ষতিপূরণ। চোটপাট করেন ঘরের ভেতর, স্ত্রীর ওপর। সুকুমারের বাবা আরও বলেন,
‘তোমাদের রাশিয়া কেবল সাধুরই জন্ম দিয়েছে, অসাধু দেয় নি; কেবল মার খেয়ে মরবে। লেনিন তো মস্ত বড় সাধু ছিলেন যেমন টলস্টয় ছিলেন। কিন্তু ওরা লাঠির সঙ্গে পারবেন কী? কখনো না।’ […]
এক হিটলারের দম্ভে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
নিজেকে তিনি হিটলার হিসেবে কল্পনা করে থাকবেন। কিন্তু তাঁর এবং তাঁদের হিসাবে তো মস্ত বড় একটা ভুল ছিল। হিটলার জিতেন নি, তাঁকে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয়েছে, আত্মহত্যাই করতে হয়েছে, শেষ পর্যন্ত। ‘ইঁদুর’ গল্পটি লেখা ১৯৪২-এ, হিটলারের আত্মহত্যা ঘটেছে এর তিন বছরের মধ্যেই। জিতেছে ওই রাশিয়াই, কারণ সে-দেশের মানুষ তখন আর জাতীয়তাবাদী ছিল না, সমাজতন্ত্রীতে পরিণত হয়েছিল। সুকুমারের পিতারা এটা অনুধাবন করতে পারেন নি যে, স্বদেশী হিটলার-প্রেমিকরা কত ভয়ংকর হতে পারে। যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করছিল তারা তো হিটলারপন্থীই ছিল, দুই দলে বিভক্ত তারা একে অপরকে মারছিল। মারছিল তারা নিরীহ মানুষকেও, আরও অধিক মাত্রায়। সুকুমারের পেছনে যিনি আছেন, সুকুমার যার ছায়া, সেই সোমেন চন্দ যে দেশপ্রেমিক উন্মত্ত হিটলারানুরাগীদের হাতে নিহত হবেন সেটা সুকুমারের পিতারা কতটা আন্দাজ করতে পারছিলেন কে জানে। করবার কথা যে নয়, সে তো আমরা জানি। বিশ্বাসের যে জোরে ‘দাঙ্গা’ গল্পের অশোক তার মা’কে বলেছিল, বিপ্লবের কখনো মৃত্যু হয় না, সে-বিশ্বাস সোমেন চন্দেরও। ব্যক্তি সোমেন চলে গেছেন, কিন্তু যে-বিপ্লবী শক্তির ওপর সমাজতন্ত্রীদের অবিচল আস্থা ছিল সেই শক্তিটা রয়ে গেছে। সোমেনের মৃত্যুর পরে বিপ্লব ঘটেছে চীনে, ঘটেছে কিউবাতে, এবং বিশ্বজুড়ে মানুষ আজ লড়াই করছে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে হাঁকিয়ে দিয়ে সামাজিক মালিকানার নতুন বিশ্ব গড়ে তুলবে বলে। সে-সংগ্রামে সোমেন আছেন, আছে তাঁর অশোক, রয়েছে তাঁর সুকুমার। বড় হিটলার আত্মহত্যা করেছে, ছোট ছোট হিটলাররা এখন সোমেন চন্দের লেখা-গল্পের ভয়াবহ রকমের উৎপাতসৃষ্টিকারী ইঁদুরগুলোর মতোই ধরা পড়ার এবং মারা যাবার অপেক্ষায় রয়েছে। সবাই মিলেই মারবে তাদেরকে।
সুকুমার এগুচ্ছিল নতুন ইতিহাসের পথ ধরে, যেমন এগুচ্ছিলেন সোমেন চন্দ নিজেও। অত্যন্ত উঁচুমাপের প্রতিভাবান সোমেন চন্দ লেখা শুরু করেন সতেরো বছর বয়সে। ওই বয়সে শরৎচন্দ্রেরও 888sport live footballযাত্রা শুরু। সোমেন চন্দ শরৎচন্দ্রের ধারাতেই লিখতে পারতেন। পল্লীজীবনের বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। প্রথম পর্যায়ে তাঁর ‘রাত্রিশেষ’, ‘স্বপ্ন’, ‘গান’, ‘পথবর্তী’, এসব গল্পে শরৎচন্দ্রের ধাঁচ আছে। সোমেন সেটা ধরতে পেরেছেন, এবং সেখানে থাকতে চান নি। ইতিহাসের ভেতরে থেকেই তিনি লিখেছেন, কিন্তু ইতিহাসকে বুঝতে চেয়েছেন। ইতিহাসকে তিনি বুঝতে পেরেছেনও। আর সেখানেই তাঁর নতুনত্ব। কীভাবে যে বোঝা যাবে প্রথমে সেটা বুঝতে পারছিলেন না; ফলে ওই অল্প বয়সেই তাঁর ভেতর অবসাদের লক্ষণ দেখা দিচ্ছিল। টের পাচ্ছিলেন যে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার। ৯ই নভেম্বর ১৯৩৮-এ নির্মলকুমার ঘোষকে লেখা চিঠিতে সোমেন বলছেন, ‘বছর খানেক সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কোন পথ খুঁজে পেতাম না, এখন কতকটা পেয়েছি, বলে মনে হচ্ছে।’ এই পথটা কমিউনিজমের। এর কথা নির্মলকুমারকে পরিষ্কারভাবে তিনি বলেন নি। না-বলার কারণ ছিল; কারণটা হলো নির্মলকুমার কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না, বরং তাদের বিরোধীই ছিলেন। পথের সন্ধান পাওয়ার ঘটনাটা ঘটেছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের কয়েকজনের সাক্ষাৎ পেয়ে। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে বেশ কিছু জরুরি বই পড়েছেন। পড়েছেন র্যালফ ফক্স ও ক্রিস্টোফার কডওয়েলের লেখা মার্কসবাদী রচনা। 888sport appতে ওইসব বই পাওয়া তখন মোটেই সহজ ছিল না। র্যালফ ফক্সের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রচনা, দি নভেল অ্যান্ড দি পিওপল তো প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৭ সালে; ওই বইয়ের খবর তিনি তখনই পেয়েছেন, পেয়ে সংগ্রহ করেছেন, এবং গভীর মনোযোগে পড়েছেন। পড়েছেন ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ইলিউশন অ্যান্ড রিয়ালিটি। এঁরা দু’জনেই তাঁদের রচনায় 888sport live footballের পেছনে যে-ইতিহাস থাকে ও ছিল, তার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উভয়েই ছিলেন কমিউনিস্ট, গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। শুধু তাই নয়, স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে ফ্রাঙ্কোর জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের হয়ে যুদ্ধের জন্য যে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠিত হয়েছিল তার সদস্য হয়ে এঁরা সামনাসামনি যুদ্ধ করেছেন। এবং প্রাণ দিয়েছেন। দু’জনেই ছিলেন অল্পবয়সী; র্যালফ ফক্সের বয়স তখন ৩৭, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের আরও কম, মাত্র ৩০। এঁদের প্রাণদানও যুবক সোমেনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। অনুপ্রেরণাদায়কদের মধ্যে আরও একজন ছিলেন। তিনি জন কর্নফোর্ড। 888sport app download apk লিখতেন। কর্নফোর্ডও ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনিও ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিলেন এবং সেই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এঁর উল্লেখও পাওয়া যায় সোমেনের লেখাতে। কর্নফোর্ড বেঁচে ছিলেন মাত্র ২১ বছর, সুকান্তের সমান, সোমেনের চেয়ে বছরখানেক কম। ১৯৩৭-এ এঁরা শহীদ হয়েছেন, সোমেন তাঁদের কথা শুনেছেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ব্রিটিশ গণমাধ্যম চেপে রাখতে পারে নি ওই খবর। শহীদ হয়েছেন স্প্যানিশ লেখক গার্সিয়া লোরকাও। তাঁর বয়স তখন ৩৭। লোরকার খবরও জানা ছিল সোমেনের। সোমেনের অভ্যাস ছিল মাঝেমধ্যে 888sport app download apk লেখারও। তাঁর যে তিনটি 888sport app download apk উদ্ধার করা হয়েছে তাদের একটি বাম ‘শুভদিনের সংবাদ শোন’। 888sport app download apkটি এরকমের :
র্যালফ ফক্সের নাম শুনেছো?
শুনেছো কডওয়েল আর কর্নফোর্ডের
নাম?
ফেদরিকো গোর্সিয়া লোরকার কথা
জানো?
এই বীর শহীদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে
দিলো,
সবুজ জলপাই রং হলো লাল,
মা-র বুক হলো খালি।
তবু বলি, সামনে আসছে শুভ দিন।
চলো, আমরাও যাই ওদের রক্তের
পরশ নিতে,
এ রক্ত দিয়ে লিখে যাই
শুভ দিনের সঙ্গীত।
888sport app download apk হিসেবে মোটেই উন্নত মানের নয়, কিন্তু তরুণ মনের অঙ্গীকারটা লক্ষ্য করবার মতো। অত্যন্ত প্রতিভাবান ওই বিপ্লবী লেখকদের আন্তরিক অনুরাগী ও উৎসাহী পাঠক সোমেনও কি জানতেন যে তাঁদের মতো তাঁকেও প্রাণ দিতে হবে, ওই ফ্যাসিস্টবিরোধী সংগ্রামেই এবং মাত্র ২২ বছর বয়সেই? ঔপনিবেশিক, অতিশয় অনগ্রসর 888sport app শহরে? বিশ্বযুদ্ধের লক্ষণভারাক্রান্ত ইউরোপের ওই তরুণ কমিউনিস্টদের মতোই সোমেনও লড়ছিলেন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সোমেনের জন্য জ্ঞানলাভের সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। ধ্রুপদী বিপ্লবী 888sport live football তো অবশ্যই, এমন কি সমসাময়িক ওই কমিউনিস্ট তরুণদের লেখা পাওয়াটা কষ্টসাধ্য ছিল সোমেন চন্দদের জন্য; পেলেও পড়ে বোঝাটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। সাহায্য করবার মতো লোকের অভাব ছিল। নিম্নমধ্যবিত্ত সোমেন এমনকি উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগও পান নি। ম্যাট্রিক পাস করার পরে কোনোমতে ভর্তি হয়েছিলেন 888sport appর মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে; সেখানে এক বছরের বেশি থাকা হয় নি। খরচ জোগানোটা কঠিন ছিল, তদুপরি শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে ফক্স পড়েছেন অক্সফোর্ডে, কর্নফোর্ড কেম্ব্রিজে। কডওয়েলের জন্ম লন্ডনে, তাঁর পিতা ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক, কডওয়েল কেবল যে 888sport live football বিষয়ে লিখেছেন তা নয়, উড়োজাহাজ বিষয়েও তাঁর বৈজ্ঞানিক লেখা আছে; বই লিখেছেন ক্রাইসিস ইন ফিজিক্স নামে। এঁদের মতো সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক সুযোগ সোমেন কেমন করে পাবেন? কোথা থেকে পাবেন? পান নি। তবে যেটুকু পেয়েছেন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।
তাঁর গল্পের সুকুমারের মতোই সোমেনও নিযুক্ত ছিলেন পথানুসন্ধানের ‘ক্লান্তিহীন বৈজ্ঞানিক’ অনুশীলনে। যে জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করেছিলেন তার সাহায্যে ও তাগিদে তিনিও সুকুমারের মতোই বড় একটা জগতে চলে গিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সোমেন চন্দের জগৎটা সুকুমারের চেয়ে বড় ছিল। সুকুমার বলছে, “আমি ফিরে এলুম। সাম্যবাদের গর্ব, আর ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে নিয়ে আমি ফিরে এলুম।” সুকুমার ফিরে এসেছে রেল-শ্রমিক কমরেডদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে। ওই গর্ব, ওই আশা, ‘সোনার মতো ফসল’ সে পেয়েছে তাদের সাহচর্য থেকে। সুকুমার জ্ঞানী হয়ে উঠেছে। জ্ঞান সে লাভ করেছে যেমন বই পড়ে, তেমনি মেহনতী মানুষদের ভেতর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে।
জ্ঞানের এই দুই উৎস সোমেন চন্দের স্বল্পস্থায়ী জীবনেও প্রবলভাবে কাজ করেছে। শরৎচন্দ্রের মতো করে লেখা যাবে না, সামন্তবাদের প্রতি পক্ষপাতসম্পন্ন রচনা যে তার জন্য নয়, সোমেন সেটা বুঝেছেন। বিত্তহীন মধ্যবিত্তদেরকে নিয়েই তিনি লিখছিলেন; সেখানেই যদি থাকতেন তবে সে-জীবনের ক্লান্তিতে ভরপুর ও শ্বাসরুদ্ধকর একঘেয়েমি নিয়েই তাঁকেও লিখতে হতো, আটকে থাকতে হতো ছোট একটি বৃত্তে; রয়ে যেতেন ‘ইঁদুর’ গল্পের প্রথম অংশের ভেতরেই, তাঁর আগের ও পরের অনেক লেখকই যেমনটা রয়ে গেছেন। গল্পের দ্বিতীয় অংশটা আর লেখা হতো না। দ্বিতীয় অংশের সমাপ্তিটা 888sport app download for androidযোগ্য। সেটি এই রকমের : ইঁদুর-মারা কলে কয়েকটি ইঁদুর ধরা পড়েছে। ছেলেপিলে সবাই ছুটে এসেছে। উপস্থিত ছেলেদের মধ্যে যারা সাহসী তারা কেউ লাঠি, কেউ বড় বড় ইট নিয়ে বসেছে রাস্তার ধারে। ব্যাপার আর কিছু নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে। ইঙ্গিতটা এই রকমের যে বাকিগুলোও ধরা পড়বে। সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সহযোদ্ধা এক কমিউনিস্ট কর্মী অনিল মুখার্জীকে সোমেন বলেছিলেন, “সারাদিন রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে না থাকলে আমি আজকাল লিখতে পারি না।” লিখবেন কী করে? নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে যেটুকু লেখার তা তো ইতিমধ্যেই লেখা হয়ে গেছে; তিনি নিজেও লিখেছেন, নতুন জীবনের খোঁজ না পেলে লেখার উপাদান আসবে কোথা থেকে? সোমেন চন্দের বক্তব্য 888sport app download for android করিয়ে দেয় সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি উক্তিকে। মৃত্যুর অল্প কয়েক দিন আগে সুকান্ত তাঁর এক আপনজনকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তিনি জনতার কবি হতে চান। আরও লিখেছিলেন, “জনতা বাদ দিলে আমার চলবে কি করে? তাছাড়া কবির চেয়ে বড় কথা আমি কমিউনিস্ট […] সুতরাং সংকোচে নিজের অপমান।”
মেহনতীদের জীবন নিয়ে অভিজ্ঞতা ও বই পড়া থেকে সোমেন লেখক হিসেবে অগ্রযাত্রার রসদ পেয়ে গেছেন। নইলে তাৎপর্যপূর্ণ অমন সব রচনা তিনি রেখে যেতে পারতেন না। শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা নিয়েছেন ম্যাক্সিম গোর্কির কাছ থেকেও। গোর্কি ছিলেন রুশ বিপ্লবের 888sport live footballিক প্রস্তুতিতে দায়বদ্ধ লেখকদের অন্যতম। সোমেন চন্দের অন্য একটি গল্পের নায়কের নামও সুকুমার; এবং এই সুকুমারও কমিউনিস্ট কর্মী, যে জন্য পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, রাত্রিবেলাতে বসতবাড়ি ঘেরাও করে। গল্পটির নাম ‘একটি রাত’। সুকুমারের কাছে সারাদিন অনেক লোক আসে। আসে কারখানার শ্রমিকও, যাদের মধ্যে হিন্দু আছে, আছে মুসলমান। এরা রাশিয়া, লেনিন, এসব নিয়ে আলোচনা করে। একদিনের ঘটনা। ঘরে সবাই আছে, সুকুমারের মা’ও আছেন। সুকুমার বললো,
‘আপনারা পাভেলকে চেনেন?’
‘পাভেল?’
‘সে কি গোর্কির ‘মা’ পড়েন নি?’
‘হুঁ, পড়েছি, পড়েছি।’
‘ইনিই সে পাভেলের মা, সেই মা।’ সুকুমারের মা’র দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো।
এর কয়েকদিন পরেই দেখা গেল অনেক দিন পরে এক সন্ধ্যায়, প্রদীপ জ্বালিয়ে, সুকুমারের মা একখানা বই খুলে বসেছেন। সুকুমার ঘরে ঢুকে দেখে মা বই পড়ছেন। মলাট দেখেই চিনতে পেরেছে সেটি গোর্কির সেই 888sport alternative link। ‘একটি রাত’ গল্পটিতে সুকুমারের নিজের পাঠাভ্যাসের কথাও আছে। যে-রাতে পুলিশ তার বাসা ঘেরাও করবে এবং তাকে গ্রেফতার করবে সে-রাতে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আলো জ্বেলে সে একটি বই পড়তে বসেছে। বইটি আর কারো নয়, র্যালফ ফক্সের বটে। বইয়ের ইংরেজী নাম দি কলোনিয়াল পলিসি অব ব্রিটিশ ইমপেরিয়ালিজম। সুকুমারের চোখ গিয়ে পড়ে সেই জায়গাটিতে যেখানে লেখা আছে, “সাম্রাজ্যের রাজধানী আড়ম্বরপূর্ণ দিল্লী নগরীর প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রাসাদগুলো নিঃসম্বল কৃষকদের শোষিত অর্থে নির্মিত।” সদ্য-ঘুম-ভাঙা চোখে সুকুমার কথাগুলো পড়ছিল, এরই মধ্যে এসে হানা দিলো ওই সাম্রাজ্যবাদেরই একদল চাকর-বাকর, দেশি পুলিশ।
বাংলা 888sport live footballের কোনো বই সোমেন চন্দকে অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানা যায় না। তবে বাংলার তরুণ লেখকরা প্রগতিশীল 888sport live football রচনায় এগিয়ে আসছেন দেখে তিনি আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা যে তিনি উৎসাহের সঙ্গে পড়েছেন সেটা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। ১৯৪০-এর ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা চিঠিতে তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু অমৃতকুমার দত্ত’কে জানাচ্ছেন, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় লেখক হতে পারেন, তাঁর লেখায় প্রগতির ছাপ আছে। […] তবে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ মনে হয় ক্ষীণ, আর পড়া লেখাও কম।” সোমেন জানেন, যে-ধরনের লেখার প্রত্যাশায় তিনি রয়েছেন তার জন্য দুটোরই দরকার হবে। রাজনীতি চাই, এবং চাই পড়ালেখা। জ্ঞান ও প্রেরণা আসবে দু’দিক থেকেই। তরুণ সোমেন চন্দ দু’টোই সংগ্রহ করছিলেন। তরুণ এই লেখক জানতেন যে কমিউনিস্টরা বুর্জোয়াদেরকে অবশ্যই পরাভূত করবে; নৈতিকতার ক্ষেত্রে তো বটেই, জ্ঞানের ক্ষেত্রেও। কমিউনিস্ট পার্টির তিনি সার্বক্ষণিক কর্মী হয়েছিলেন, ঠিক করেছিলেন নারায়ণগঞ্জে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে থাকবেন। পার্টির সহযোদ্ধারা তাঁকে নিবৃত্ত করেছেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে তাঁর কাজটা আরও বেশি জরুরি। সোমেন সেখানেই রয়ে গেছেন। এবং কর্তব্যপালনরত অবস্থাতেই প্রাণ হারিয়েছেন। বন্ধুর কাছে লেখা ওই চিঠিতেই আছে : “বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা করো। সৌখিন 888sport live football করার আর সময় নেই।” সোমেন চন্দ মোটেই সৌখিন 888sport live footballিক ছিলেন না, যেমন ছিলেন না সৌখিন কমিউনিস্ট। কর্মের উভয় ক্ষেত্রেই ছিলেন বৈপ্লবিক। ওই চিঠিতেই তিনি লিখছেন, “কলকাতায় গেলে মানিকবাবুর সঙ্গে দেখা করবো।” মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সোমেন চন্দের চেয়ে বার বছরের বড়। লেখক হিসেবে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত, কিন্তু তরুণ এই লেখকের ভেতর এমন আত্মবিশ্বাস আছে যে অগ্রজ লেখককে পরামর্শ দেওয়াটা তাঁর পক্ষে মনে হয়েছে যেমন কর্তব্য তেমনি সম্ভবপর।
বিপ্লবের প্রতিপক্ষ যে কেবল সাম্রাজ্যবাদ নয়, পুঁজিবাদও, এবং পুঁজিবাদই যে সাম্রাজ্যবাদের ভেতরে কাজ করে এই লেখক তা স্পষ্ট করেই জানতেন। এটি সবাই কিন্তু জানতেন না, জানতে চাইতেনও না। জাতীয়তাবাদীরা তো পুঁজিবাদকে বিবেচনার মধ্যেই আনতে চাইতেন না, কারণ ভেতরে ভেতরে তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন পুঁজির অনুরাগী। সময় পেলে সোমেন চন্দ তাঁর ওই জ্ঞানকে 888sport live footballে যে আরও সুন্দরভাবে নিয়ে আসতেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই। নির্মলকুমার ঘোষকে তিনি লিখছেন যে, পুরাতন একটি বই তিনি সংগ্রহ করেছেন এবং পড়েছেন। বইটি যোসেফ ম্যাজিনির লেখা উঁঃরবং ড়ভ ধ গধহ। বইটি পড়ে তাঁর মনে একটি ভয় দেখা দিয়েছে। সেটি হলো এই যে, ম্যাজিনির, বইতে, এবং আরো অনেকের লেখায় সোশালিজমের আভাস সত্ত্বেও ইটালিতে যেমন ফ্যাসিজমের দৌরাত্ম্য চলছে ভারতেও কী একই ঘটনা ঘটবে? এখানেও কী দরিদ্র মানুষ লাঞ্ছিতই হবে? “কাল নয় ব্রিটিশের হাত থেকে ছাড়া পেলো, পড়শু পড়বে গিয়ে ধনীর হাতে?” এটি ১৯৩৮-এ লেখা একটি চিঠি, লেখকের বয়স তখন ১৮। কিন্তু যে ঘটনা ঘটবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন এটি সত্যি সত্যি ঘটেছে। ঠিক নয় বছর পরে, ১৯৪৭-এ, উপমহাদেশ যখন স্বাধীন হয়েছে তখন। ওই স্বাধীনতা সোমেন দেখে যেতে পারেন নি। দেখলে মর্মাহত হতেন।
এর অল্প কয়েকদিন আগে নির্মলকুমারকেই লেখা আরেকটি চিঠিতে সোমেন বলছেন, “আমাদের এই দারিদ্র্যপীড়িত, দুঃখক্লিষ্ট জীবনে বৃহত্তর চিন্তার মিশ খাইয়ে আশার কথা শোনাবে কে? ক্যাপিটালিজম আর ইম্পেরিয়ালিজমের অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ। প্রথমটির বিরুদ্ধে কোন লেখককে অভিযান করতে হলে দ্বিতীয়টির বিরুদ্ধেও করতে হয়। সুতরাং বই প্রকাশের পরদিনই বন্ধ।” বোঝা যাচ্ছে তাঁর কাছে প্রধান শত্রু অন্য কেউ নয়, ক্যাপিটালিজমই। এই বোধ সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের অনেকের মধ্যেই সেদিন কার্যকর ছিল না। ছিল না বলেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সুভাষপন্থীরা সোমেন চন্দকে হত্যা করতে সঙ্কোচ করে নি। তাদের হাত কাঁপেনি। সুবিধা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের। সাম্রাজ্যবাদীরা হেসেছে।
ওই চিঠিতে আরও আছে : “জমিদারদের তো অনেকেই গাল দিলো, শুধু গাল-ই, উদ্ধার বের করুক না কেউ। কিন্তু মূলে কী আছে কেউ কি জানে না? জানলেও জানাবার সাহস তাদের কোথায়?” আমরা কিন্তু জানি যে মূলে কী আছে অনেকেই জানতো না, আর যারা জানতো তারাও বলতে সাহস করে নি। সাহস না করার কারণটা কিন্তু কেবল ব্রিটিশের ভয় নয়। ভয় নিজেদের স্বার্থহানিরও। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে অবস্থান নিলে সমাজ বিপ্লবকে এগিয়ে আনা হতো,
সে-বিপ্লব জাতীয়তাবাদীদের কেউই চায় নি। কমিউনিস্টরা চেয়েছে। কিন্তু সমাজ বিপ্লব ঘটাবার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। জাতি সমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ায় অপারগতা ছিল; শ্রেণী চেতনাকে তীব্র করার যে ইতিহাস-নির্দিষ্ট দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে ছিল সেটা পালনেও তাঁরা অপারগ হয়েছেন। আর সে জন্যই সোমেন চন্দদেরকে প্রাণ দিতে হয়েছে, এবং উপমহাদেশে পুঁজিবাদ নিজের অগ্রগতির জন্য পথ পরিষ্কার করে নিয়ে এখন ফ্যাসিবাদের রূপ ধারণ করেছে, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে মেহনতী মানুষকে শোষণ করবার জন্য। জাতীয়তাবাদীদের কথিত দেশপ্রেম কতটা যে হাল্কা ছিল তা নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
চার
শ্রেণীচেতনাকে তীক্ষè করা তো বটেই, আরও একটা জিনিসের দরকার ছিল। সেটি হলো শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্য আনয়ন। ভারতবর্ষ কৃষিপ্রধান দেশ, সেখানে কৃষককে না জাগালে বিপ্লব সম্ভব হবার কথা নয়; সম্ভব হয়ও নি। কৃষককে জাগাবার পথ ছিল শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবর্তী অংশের সঙ্গে কৃষকের সংযোগ ঘটানোর ভেতর দিয়ে। ‘ইংগিত’ নামের গল্পটিতে সোমেন চন্দ সেই সত্যটিকেই তুলে ধরেছেন।
শহরের কাপড় কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে; তাদেরকে পরাভূত করতে ব্যর্থ হয়ে মালিক পক্ষ লঞ্চ নিয়ে এক গ্রামে চলে গেছে। সেই গ্রামের মানুষ এক সময়ে তাঁতের কাপড় বুনতো; কিন্তু যুদ্ধের ও দুর্ভিক্ষের কারণে এখন তারা দুর্দশাগ্রস্ত। ভরসা কৃষি। অনেকেই বেকার। অসহায়। তাদের এই অসহায়ত্বকে সুযোগে পরিণত করে কারখানার ম্যানেজার এসেছে কাজের লোভ দেখিয়ে গ্রামবাসীকে লঞ্চে করে শহরে নিয়ে গিয়ে কারখানা চালু করবে বলে। গ্রামের কিছু অসহায় মানুষ সেখানে গিয়ে দেখে ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন; শত শত মানুষ নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে; আর সমস্ত মানুষ যেন একটি মানুষে তার সঙ্গে পরিণত হয়েছে, যে বলছে যে তারা ধর্মঘটী শ্রমিক, তাদেরকে তাড়াবার জন্যই গ্রাম থেকে কৃষকদের নিয়ে আসা হয়েছে। ওই মানুষটির কথাগুলো এই রকমের :
ভাইসব! আপনাদের চোখে পৃথিবী যেমন, আমাদের কাছেও তাই; আপনাদের যতখানি শোষণ দুঃখ দুর্দশার কষ্ট সহ্য করে চলতে হয়, আমাদেরও তাই। আমাদের ঘর নেই, বাড়ি নেই, আজ এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে কোথাও দাঁড়াবার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই -। চাষী ভাইরা, দোহাই আপনাদের ভাই-এর মুখের ভাত এমন করে কেড়ে নেবেন না। একথা মনে রাখবেন আজ যারা আমাদের লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে, কাল তারা আপনাদেরও সেই লাথি থেকে রেহাই দেবে না। বন্ধুগণ, আমরা আপনাদের ভাই, ভাই-এর কথা বিশ্বাস করুন – আপনারা এ কাজে যোগ দেবেন না, দোহাই আপনাদের, যে লোক আপনাদের ভাই-এর মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছে তার উল্লাসকে আর বাড়াবেন না।
শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কৃষকদের উদ্দেশে এমন পরিষ্কার বক্তব্য বাংলা 888sport live footballে কমই শোনা গেছে। শ্রমিকে-কৃষকে সংগ্রামী ঐক্যটা ব্যাপক হারে গড়ে উঠলে এদেশের ইতিহাস ভিন্ন পথে এগুতো। হয়তো বিপ্লবই ঘটে যেত।
বাস্তুচ্যুত হয়ে গ্রাম থেকে কৃষকের শহরের কারখানার দিকে রওনা হবার অবি888sport app download for androidীয় কাহিনী আছে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে। সে-গল্প ১৯২৬ সালে লেখা। গল্পের নায়ক গফুরও ‘ইংগিত’ গল্পের প্রধান চরিত্র রহমতের মতোই এক সময়ে তাঁতি ছিল। তাঁত হারিয়েছে ইংরেজের কারণে। জমি ও আবাস হারালো জমিদারের অত্যাচারে। মাতৃহীন কন্যাটিকে নিয়ে অজানা ও অনিরাপদ কারখানা অভিমুখে গফুরের অতিঅনিবার্য যাত্রা। শরৎচন্দ্রের ওই গফুরের বারো বছর পরে সদ্যবিবাহিত রহমতও এসেছে কারখানায়, তবে নেহায়েত অনিচ্ছুক অবস্থায় নয়, বুকে আশা নিয়ে। আশাটা উপার্জনের। এসে মুখোমুখি হয়েছে শ্রমিক ধর্মঘটের, যেটি গফুরের সময়ে সত্য হয়ে দেখা দেয় নি। কিন্তু যেটা গফুরের গল্পে মোটেই নেই সেটা হলো শ্রমিকদের ঐক্য, তাদের ভেতর শ্রেণীচেতনার বিকাশ, এবং তাদের দিক থেকে কৃষকদেরকে নিজেদের কাছে টানবার চেষ্টা। ধারণা করবার খুব সঙ্গত কারণই রয়েছে যে গল্পের ওই শ্রমিকদের ধর্মঘটের পেছনে ট্রেড ইউনিয়ন ছিল, এবং সে-ট্রেড ইউনিয়ন কমিউনিস্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শ্রমিকদের যে ঐক্য, লড়বার এই যে মনোভাব, সর্বোপরি কৃষকদের প্রতি শ্রেণীগত স্বার্থসচেতন হবার ওই যে আহ্বান সোমেন চন্দ তাঁর গল্পে নিয়ে এসেছেন অন্যকোনো লেখক তাঁর কালে সেটা করেন নি। শরৎচন্দ্রদের পক্ষে তো করবার কথাই নয়। শরৎচন্দ্রের বিপ্লবী সব্যসাচী অনেক দুঃসাহসিক কাজই অতি সহজে করেছেন বলে জানা যায়, কিন্তু তিনি যে কৃষকের পক্ষের লোক নন এটা অন্যেরা যে বলে দেবে সে জন্য তিনি অপেক্ষা করেন নি, তিনি নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন। সশব্দে।
রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছিল। মেহনতীদের রাজনৈতিক আন্দোলন যে সুবিধা করে উঠতে পারে নি এটা ঠিক; কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের কেউ কেউ যে নিজেদের আন্দোলনের সংকীর্ণতার বিষয়ে সজাগ হয়ে উঠছিলেন তার খবর সোমেন রাখতেন, এবং সেটা তিনি তাঁর লেখাতেও নিয়ে এসেছেন বৈকি। যেমন ‘প্রত্যাবর্তন’ গল্পে। পঁচিশ বছর পরে গ্রামের ছেলে প্রশান্ত নিজ গ্রামে। স্বদেশী করতো, জেল খেটেছে, আন্দামানে গিয়েছিল কিনা জানা যায় না, যেতেও পারে। যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। পঁচিশ বছর পরে গ্রামের অন্ধকার পথে বাল্য বন্ধু কৃষক কালু মিঞার সঙ্গে তার দেখা। কালু মিঞা তাকে তার ঘরে নিয়ে গেছে। তারপর একসময়ে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তুমি আজকালও স্বদেশী কর?’ শুনে প্রশান্ত মনে মনে হাসে। সে বলে, “সেদিন বড় ভুল করিয়াছিলাম বন্ধু, একলা পথ চলিয়াছিলাম। তোমাদের কথা ভাবি নাই, আজ আর সেই ভুল হইবে না।” এই উপলব্ধিতে পৌঁছবার একটি বস্তুগত কারণও আছে। পঁচিশ বছর পরে গ্রামে ফিরে প্রশান্ত দেখে যে তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ তো
নেই-ই, বাড়িঘরও নেই। কৃষক কালু মিঞাই তার একমাত্র বন্ধু যে অবশিষ্ট আছে।
বড় গল্প ‘বনস্পতি’। গল্পের প্রকা- বটগাছটি দুইশ’ বছরের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার ও পরিবর্তনের সাক্ষী। গ্রামের নাম পীরপুর। স্বদেশী আন্দোলনের সময় সে গ্রামের রাজেন মিত্রের ছেলে সতীন মিত্র “কলিকাতা শহরে কোন্ এক সাহেবকে মারিতে গিয়া নাকি ধরা পড়িয়াছে।” নয় বছর পরে সেই সতীন মিত্রকে দেখা গেল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গ্রামে এসে কৃষকদের সঙ্গে মিলছে। তাদেরকে নিয়ে জটলা করছে। তারপর ওই বটতলাতেই একদিন কৃষকদের এক সমাবেশে সতীনের বক্তৃতা শোনা গেল। হায়দর নামে এক কৃষকের ছেলে, নাম বসির, সতীনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সতীন বলেছে,
ভাইসব, সমাজের যারা পরগাছা – যারা আমাদের গায়ের রক্ত শুষে শুধু বসে খায়, তাদের উপড়ে ফেলার দিন এসেছে আজ। ভাইসব, আমাদের জিনিস দিয়েই ওরা মোটর হাঁকায়, ব্যাংকে লাখ লাখ টাকা জমা রাখে, কিন্তু আমরা না খেয়ে মরি। এ অত্যাচার কেন আমরা সহ্য করবো? কেন সহ্য করবো?
বোঝা গেল সতীন মিত্র আর জাতীয়তাবাদী নেই, সমাজতন্ত্রের পথ ধরেছে। হয়তো-বা কমিউনিস্টই হয়ে গেছে। কিন্তু তার সেদিনের বক্তৃতা বেশিদূর এগোতে পারে নি। লাঠি হাতে মস্ত জোয়ান একদল লোক বটতলার বাঁধানো জায়গাটিতে উঠে অনবরত লাঠি চালাতে শুরু করে দিয়েছে। সতীন মিত্র চিৎকার করে শুধু এইটুকু বলতে পেরেছে : “ভাইসব, এদের চিনে রাখুন, এরা সেই জমিদারদেরই ভাড়াটে গু-া, লাঠি চালিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করতে এসেছে।” এর বেশি আর বলা হয় নি। লাঠির ঘা খেয়ে নিচে পড়ে গেছে। রক্তে তার শরীর এবং মাটি লাল হয়ে গেল। শ্রোতাদের আরও কেউ কেউ মাটিতে পড়ে রইলো। অন্যরা পালিয়েছে। এটি ১৯৩৯ সালের ঘটনা। সোমেন তাঁর এ-গল্পটি হয়তো ১৯৪০-এ লিখেছেন। তিনি জানতেন না, কেউ জানতো না যে, দেড় দু’বছরের মধ্যে গল্পের সতীন মিত্রের মতোই তিনি নিজেও মারা যাবেন, একই ভাবে, সামাজিক বিপ্লব-বিরোধী মানুষদের হাতে।
পাঁচ
সোমেন চন্দ বিপ্লবী ছিলেন, ছিলেন লেখকও। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বন্ধু অমৃতকুমার দত্ত’কে তিনি লিখেছেন,
গত কয়েকদিন রেল-শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটুও সময় পাই না। তবু লিখতে হবে, মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য আমাদের লিখতে হবে।
আরও লিখেছেন ওই চিঠিতে,
র্যালফ ফক্সের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এ না হলে কি মহৎ 888sport live footballিক হওয়া যায়? স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের সমর্থনে তাঁদের আত্মবিসর্জন ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে বইকি। আছেও। ওই যুদ্ধে যাঁরা আত্মবিসর্জন দিয়েছেন আন্তর্জাতিকভাবেই তাঁরা 888sport app download for androidীয় হয়ে আছেন। কিন্তু সোমেন চন্দ? তিনিও তো ওই একই পথের যাত্রী ছিলেন। কিন্তু তাঁকে তো বিশ্বের মানুষ জানে না। তা বাকি বিশ্ব কতটুকুই বা আমাদেরকে জানে? আমরা নিজেরাই তো আমাদের ইতিহাসের চর্চাতে অত্যন্ত বিমুখ। তদুপরি আমাদের ইতিহাস তো দ্বিখ-িত হয়ে গেছে। সোমেনের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরই, ১৯৪৭-এ ঘটেছে আমাদের ইতিহাসের অতিমর্মান্তিক এক ঘটনা; এবং এপার ওপারে যে জাতীয়তাবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে তারা তো নিজেরাই পুঁজিবাদী, যে জন্য তারা সাম্রাজ্যবাদীদেরকে আপনজন ভাবে, এবং সমাজতন্ত্রীদেরকে মনে করে তাদের নিকৃষ্টতম শত্রু। অথচ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দিয়ে গেছে সেটা কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের কারণে নয়, করেছে ওই সমাজতন্ত্রীদের কারণেই।
কিন্তু সোমেন চন্দ গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রধান কারণ তিনি লেখক ছিলেন; এবং তিনি বিপ্লবীও ছিলেন, এবং তাঁর লেখক সত্তা ও বিপ্লবী সত্তা ছিল অভিন্ন। লেখক হিসেবে তিনি অত্যন্ত উঁচু মাপের ছিলেন, যে-উচ্চতা তিনি অর্জন করতে পারতেন না যদি একই সঙ্গে বিপ্লবীও না হতেন। বিপ্লবী বলেই সমাজের দ্বন্দ্বগুলোকে পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছেন। সুস্পষ্ট পক্ষপাত ছিল দুর্বলের প্রতি। কিন্তু সে-পক্ষপাত একজন 888sport live chatীর। অর্থাৎ তাতে 888sport live chatীর দূরত্ব থেকেছে। থেকেছে বিস্ময়কর সংযম। কোথাও ভাবাবেগ নেই, উচ্ছ্বাস ঘটে নি কোনো প্রকারের। অতিশয়োক্তি করেন নি। সে জন্য তাঁর ভাষা খুবই ঝরঝরে, সর্বক্ষণ প্রবহমান। তাঁর ছোট গল্পগুলোতে এবং 888sport alternative linkটিতেই দেখা যায় অল্পকথায় গুছিয়ে গল্প বলবার অসামান্য ক্ষমতা। তাঁর কাহিনী উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। উৎকণ্ঠা সৃষ্টিতে তাঁর ভাষা সহায়ক হয়। বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য বিশদকে তিনি ভোলেন না। প্রয়োজনে খুঁটিনাটির বর্ণনা দেন, সে-বর্ণনা কাহিনীকে বাস্তবিক করে তোলে, কিন্তু কখনোই কাহিনীকে ভারাক্রান্ত করে না।
আমরা যদি বলি তিনি ছিলেন অসাধারণ রকমের প্রতিশ্রুতিশীল, তবে তাতে বিপদ থাকবে পৃষ্ঠপোষকতার। কিন্তু ঘটনাটা সত্য। দীর্ঘজীবন লাভ করলে তিনি যে পরিমাণে ও গুণে আরও বেশী সৃষ্টি রেখে যেতে পারতেন তাতে সন্দেহ করাটা মূঢ়তা হবে। কিন্তু যা রেখে গেছেন তা পরিমাণে কম হলেও গুণে অসামান্য। সুকান্ত ভট্টাচার্য সম্পর্কে যা সত্য সেটি সত্য সোমেন চন্দ সম্পর্কেও। উল্লেখ্য যে সোমেন চন্দের সব লেখা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পাওয়া গেছে ২৪টি গল্প ও ১টি অসম্পূর্ণ 888sport alternative link। 888sport alternative linkটির বড় অংশই হারিয়ে গেছে। আর আছে ২টি একাঙ্কিকা ও ৩টি 888sport app download apk।
সোমেন চন্দ মাত্র দু’টি একাঙ্কিকা লেখার সময় পেয়েছিলেন। তবে ওই দুই একাঙ্কিকাতে যে রকমের প্রাণবন্ততা আছে সেটি তাঁর সকল রচনার ভেতরই বিদ্যমান। প্রাণবন্ততাটা এসেছে কাহিনীতে চরিত্রের সঙ্গে ঘটনার এবং চরিত্রের সঙ্গে চরিত্রের দ্বন্দ্বে। দ্বন্দ্বের প্রকাশ বিশেষভাবেই পেয়েছে সংলাপে। সংলাপের ব্যাপারে সোমেন ছিলেন খুবই সতর্ক। তাঁর চরিত্রগুলো প্রত্যেকেই নিজের নিজের ভাষায় কথা বলে, এবং বলার মধ্য দিয়ে কাহিনীকে অত্যন্ত সজীব করে রাখে।
আর আছে উপমা। তাঁর যে তিনটি 888sport app download apk আমরা পেয়েছি সেগুলোকে উল্লেখযোগ্য বলা যাবে না, তবে 888sport app download apkর যা সাধারণ গুণ, ছন্দস্পন্দ ও উপমা, সে দু’টি গুণ তাঁর গদ্যরচনাতে সুন্দরভাবে উপস্থিত। তাঁর ভাষার কথা আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের এই আলোচনাটিতে আমরা যে সকল রচনাংশ উদ্ধৃত করেছি সেখানেও ভাষার বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে উপমার সুন্দর ব্যবহার চোখে পড়বে। আরও কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। ‘বনস্পতি’ গল্পে সিপাহী অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এক সিপাহী এসেছে পীরপুর গ্রামে, আশ্রয় নিয়েছে বিখ্যাত সেই বটবৃক্ষে। তার সঙ্গে তুলনা দেয়া হয়েছে সিংহের। “সে যেন কোন পলায়নপর সিংহ, পালাইতেছে বটে, কিন্তু তবুও তাহার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে।” অন্যসব গল্পের নানা স্থানে আমরা পড়ি : ‘সেই মরুভূমিতে কাহার হাতের স্পর্শ, ঐ জ্যোৎসার মত নরম, হাত বুলাইয়া যাইতেছে।’ ‘লম্বা একটা লোক হঠাৎ কোথায় সাপের মত সরে পড়লা।’ ‘বুড়ো হবার আগেই গরুর মত শান্ত বৌটাকে লাথি গুঁতো মেরে যমের বাড়ি পাঠিয়েছে।’ ‘এখন সমস্ত বাড়িটাই বিদেশে প্রথম আসা বালকের মত স্তব্ধ।’ ‘বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে এক ঝাঁক সৈন্য চমৎকার এক-একটি বলির পাঁঠা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’ ‘বাড়ির সামনে … শেফালী গাছটি ছোলা মুরগির মতো আজো বেঁচে আছে।’ ‘অনুভব করিল এখনও যেন সে কারও ফুলের মতো বুকে মুখ রাখিয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলিয়াছে।’ ‘বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিল সেখানে, অন্ধকারের সারি তখনও ঠেলাঠেলি করিয়া মরিতেছে।’ ‘একেবারে সামনে একটা লোকের মধ্যে পেছনের সকল শক্তি যেন একত্রিত হইয়াছে।’ ‘রক্তবর্ণ আকাশ যেন রণক্ষেত্রে তাহার প্রতি চাহিয়া বিস্তর অশুভ কামনা করিতেছে।’ ‘ওই কলরবের মতো আগুনের যদি কোন শাখা থাকিত তবে সারা পৃথিবী পুড়াইয়া ফেলিত।’ ‘গলার স্বরও আজ ভয়ে পালাইয়াছে।’ ‘মৃত্যুকে লইয়া জীবনের কাড়াকাড়ি।’ ‘পৃথিবীর কাতর প্রার্থনা যেন ঝড়ের পায়ে দারুণ লুটোপুটি খাইতেছে।’ ‘বটগাছের শত ডালের ভেতর রক্তের জোয়ার আসে।’ ‘একদা যে বাতাস মাটির মানুষের প্রতি উপহাস করে বিপুল অট্টহাসি হেসেছে সেই বাতাসের হাত আজ করতালি দেয় গাছের পাতায়।’ এরকম উপমা পাওয়া যাবে সোমেন চন্দের লেখার পাতায় পাতায়। তারা বন্ধুর মতো অপেক্ষায় থাকে, পাঠককে সাহায্য করবে বলে।
উপমার পাশাপাশি রূপকও পাওয়া যাবে। ‘ইঁদুর’ গল্পের গোটাটাতেই যে রূপক সে-কথা উল্লেখ করেছি। ওই গল্পের ভেতরেও রূপক পাওয়া যাবে। তারই একটি,
একটু আগিয়ে দেখি লাইনের ওপর অনেকগুলো ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় গভীর ধ্যানে বসেছে যেন। আমার কাছে তাদের মানুষের মতো প্রাণময় মনে হল। এখন বিশ্রাম করতে বসেছে। ওদের গায়ের মধ্যে কতো রকমের হাড়, কত কলকব্জা, মাথার ওপর ওই একটি মাত্র চোখ। […] হাসি নেই, কান্না নেই কেবল কর্মীর মতো রাগ। এমন কর্মী পুরুষ আর আছে?
সোমেন চন্দের একাঙ্কিকা দু’টিতে চমৎকার নাটকীয়তা রয়েছে। গল্পে যে নাটকীয়তা পাওয়া যায় এখানে তা আরও বড় হয়ে উপস্থিত। সংলাপও চমৎকার। ‘বিপ্লব’ নামের নাটিকাটিতে কিশোর মন্টু নাটকীয়ভাবেই ঘোষণা করে যে সে হচ্ছে মাও সে-তুঙ, ‘চেয়ারম্যান অব দি সোভিয়েট ডিস্ট্রিকট সব চায়না’। শুনে তার অভিভাবক, জ্যাঠামশাই ধমকে ওঠেন, ‘কী বলছিস বলরাম। সোভিয়েট ডিস্ট্রিক্ট? নিরীশ্বর সাম্যবাদ? ভদ্রবেশী গু-ামি।” উল্লেখ্য যে নাটিকাটি ১৯৪০-এ লেখা। চীনে তখন বিপ্লবী আন্দোলন চলছে, কিন্তু বিপ্লব ঘটেনি। নাটিকাটিতে সবচেয়ে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন যখন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক যুবক প্রবেশ করে এবং আবিষ্কার করে যে জ্যাঠামশাইয়ের কন্যাটি তার বাল্যকালের বন্ধু। এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। মন্টু চিনতে পারে যে যুবকটি আর কেউ নয়, তার প্রিয় ‘কমরেড ঘোষ’ বটে। কমরেড ঘোষ ওরফে অনল তার বাল্যবান্ধবী কমলকে বলে, “কমল, এবার আগুন জ্বালো, জ্বেলে দাও আগুন পুরনো বীজের গায়ে, পুরনো বীজ ধ্বংস হোক, আগুন জ্বালো অনেকের বিলাস আর খেয়ালে কোটি কোটি মানুষের বঞ্চনায় সঞ্চিত পাপে।” পরিণতিতে দেখা গেল অনল যেন হাওয়ায় ভর দিয়ে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে আর কমল তার গলা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরেছে।
প্রস্তাবনা নাটিকাটিতে নন্দিতা সোম এসেছে পরিক্রমা নামের সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকের অফিসে। নন্দিতার একটি 888sport live ওই সাপ্তাহিকে ছাপা হয়েছে এবং সেটা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। 888sport liveটি ধর্ম বিষয়ে; তাতে ধর্মপ্রচারকদের আসল উদ্দেশ্য উন্মোচন করে দেওয়া হয়েছে। ছোটখাটো নানা ঘটনার পরে নন্দিতা সম্পাদককে একা পেয়ে তার নিজের কথাটা পাড়ে।
নন্দিতা। (নিচের দিকে চেয়ে) সুদর্শনবাবু।
সুদর্শন। বলুন।
নন্দিতা। (অত্যন্ত সংকোচে) সুদর্শনবাবু, আপনার কাছে একটা কথা ছিল।
সুদর্শন। (দারুণ উৎসাহিত হয়ে) বলুন।
নন্দিতা। লেখাটার পারিশ্রমিক –
সুদর্শন। ও, সে-কথা আবার আপনাকে বলতে হয়? তার জন্য আবার কত কী ভাবছিলেন বলুন তো? হা-হা – সেজন্য আবার এত ইয়ে – (পকেট থেকে নোট বার করে টেবিলের উপর রাখলেন) হা-হা-হা।
সুদর্শনের হাসিটা দেখে আমরাও হাসি, যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। কৌতুকের এই বোধটা সোমেন চন্দের সহজাত। গল্পগুলোতে এবং 888sport alternative linkটিতেও
সে-বোধকে প্রশ্রয় দেবার খুব একটা সুযোগ তিনি পান নি। তবে নানা জায়গায় ওই কৌতুকবোধ সংযতভাবে কাজ করেছে। ধরা যাক, ‘সংকেত’ গল্পের দালালকিসিমের ছোট মৌলভী’র বর্ণনার সেই অংশটি যেখানে বলা হচ্ছে যে, সকলেই জানে যে “ছোট মৌলভী নবাবের সঙ্গে বসিয়া খানা খাইয়াছে এবং নবাব তাহার হাতে চুমা খাইয়াছেন।” এমন উক্তি সহজে ভুলবার নয়। মানুষের দুঃখই তাঁর লেখায় প্রধান সত্য, কিন্তু তার ভেতরে কর্কশতা নেই, আছে বরং এক ধরনের প্রসন্নতা, যার প্রধান কারণ লেখকের আশাবাদ। পরাজিতের মনোভাব তাঁর রচনার কোথাও পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাঁর আশাবাদ অবাস্তবিক নয়, জীবনের কঠিন কঠোর বাস্তবতাকে তা উপেক্ষা বা অস্বীকার করে না, বরং তাকে বিবেচনায় নিয়েই তৈরি হয়। তাঁর প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’। সেটি লিখেছেন তিনি সতের বছর বয়সে। গল্পের ঘটনাটি মর্মান্তিক দুঃখের। ভীষণ ট্র্যাজিক। কিশোর তপুর মা নেই, বাবা তাকে নিয়ে গেছেন আসামের পাহাড়ি এলাকায়, 888sport slot gameের জন্য। সেখানে সমবয়স্কা বাসন্তীর সঙ্গে তপুর পরিচয়। তপুর সঙ্গে একটি ক্যামেরা ছিল, সেটি দিয়ে বাসন্তীর ছবি তুলতে গেছে সে; বাসন্তীকে বলেছে একটু পিছু হটতে। পিছু হটতে গিয়ে বাসন্তী পড়ে গেল গভীর খাদের ভেতর। ‘বাসন্তী, বাসন্তী’ বলে তপু পাগলের মতো ডাকাডাকি করেছে। “কেহই উত্তর দিল না। কতকগুলো প্রতিধ্বনি তাহাকে ব্যঙ্গ করিয়া উঠিল। তপনের মুখ বিবর্ণ। সে কাঁদিয়া উঠিল, মাটি আঁচড়াইতে লাগিল।” কাহিনীর এখানেই শেষ। কিন্তু এর পরে লেখকের নিজের কথা আছে, বলবার। তিনি লিখছেন,
অকালে যে ফুলটি ঝরিয়া পড়িল তাহারই কাহিনী লিখিতে কেন আমার এত আগ্রহ। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হইয়া আসে তবু কলম থামে না। কেমন বলিব, ইহা যে আজও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।
দুঃখ আছে, বঞ্চনা খুবই সত্য, কিন্তু এরই মধ্যে মানুষের প্রতি মানুষের যে অনিবার্য সহানুভূতি ও সমবেদনা রয়েছে আশার জায়গাটা সেইখানেই। ‘দৃষ্টি ঝাপসা হইয়া আসে তবু কলম থামে না।’ এই জন্যই মানুষ চেষ্টা করে একে অপরকে সাহায্য করতে, এবং দুঃখের বস্তুগত কারণগুলো সরিয়ে ফেলতে। চেষ্টার ওই তাগিদেই সোমেন চন্দ 888sport live footballে ছিলেন, ছিলেন রাজনীতিতে। কেবল যদি 888sport live footballে থাকতেন তাহলে তাঁকে প্রাণ দিতে হতো না, কিন্তু তাঁর পক্ষে তো রাজনীতির বাইরে থাকা সম্ভব ছিল না, কারণ তাঁর সেই দার্শনিক দৃষ্টিটি ছিল যেটি তাঁকে বলে দিয়েছিল যে তাঁর সময়ে মানুষের ওপর মানুষের যে-শোষণ চলছিল তার প্রধান কারণটি রাজনৈতিক। সমাজের বদল চাই, এবং তার জন্য প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লবের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকটা রাষ্ট্রীয়।
ছয়
সোমেন চন্দের সময়ে সমাজ বদলের জন্য যাঁরা লড়ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন সমাজতন্ত্রী; তবে তাঁদের অনেকের ভেতরই প্রচ্ছন্ন হলেও একটি বোধ ছিল, সেটা পরাজিতের। সোমেন চন্দ কিন্তু পরাজিত হতে রাজি ছিলেন না। সে জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের সম্মুখ সারিতেই ছিল তাঁর অবস্থান, এবং ওই অবস্থানের কারণেই ঘটেছে তাঁর প্রাণদান।
অসংশোধনীয় রূপে আশাবাদী এই লেখক আঠারো বছর বয়সে, ১৯৩৮ সালে, সুহৃদ নির্মলকুমার ঘোষকে জানিয়েছিলেন তাঁর আশাবাদের কথা।
বিপ্লবের অনুভূতি কেবল আমার নয়, আরও অনেক 888sport live footballিকের মনেই জেগেছে মনে হয়, তার মধ্যে হয়তো অনেকেই প্রকাশ করতে পারছে না, বা অনেকের কণ্ঠই ক্ষীণ হয়ে গেছে, তথাকথিত 888sport live football-ডিক্টেটরদের গোলমালে, কিন্তু সেই অনুভূতির অস্তিত্ব আছে অনেকের মধ্যেই – এইসব দেখে মনে হয়, আগামী দশ বছরে 888sport live footballের ইতিহাস হবে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়, একটা বৈপ্লবিক অপূর্ব সৃষ্টি।
বলার তো অপেক্ষা রাখে না যে, তাঁর সে আশা পূরণ হয় নি। পূরণ হবে কী, তিনি নিজেই তো চলে গেছেন চার বছরের মধ্যেই। জয় হয়েছে 888sport live footballের কথিত ডিক্টেটরদের, প্রধান হয়ে উঠেছে বুর্জোয়া ধারাটি, যে-ধারা বড় জোর উদারনৈতিক। কিন্তু উদারনীতি তো বিপ্লবী নয়, উল্টো সে বিপ্লববিরোধী। উদারনীতি সামাজিক মালিকানায় মোটেই বিশ্বাস করে না, ব্যক্তিমালিকানাকে রক্ষা করতে চায়। সমাজপরিবর্তনকামী প্রগতিশীল ধারাটি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এবং তার মূল কারণটা রাজনৈতিক। সোমেন চন্দদের রাজনৈতিক আন্দোলন পর্যুদস্ত হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে বিপরীত ধারা। তারই প্রতিফলন দেখছি অর্থনীতিতে, এবং সংস্কৃতিতেও। 888sport live footballেও।
পুঁজিপন্থীদের ওই বিজয়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক প্রমাণ ও চিহ্ন হচ্ছে ১৯৪৭-এর দেশভাগ। ১৭৫৭-এর পরে ওটিই বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সেটি যে ঘটবে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেছে সোমেন হত্যার ভেতরে। যাঁরা তাঁকে মারলেন তাঁরাও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলেন। কিন্তু পুঁজিবাদবিরোধী ছিলেন না। মুক্তির জন্য কেবল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হওয়াটা মোটেই যথেষ্ট ছিল না, প্রয়োজন ছিল পুঁজিবাদবিরোধিতারও। কমিউনিস্টরা লড়ছিলেন একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে; কিন্তু তাঁদেরও দুর্বলতা ছিল। জাতিসমস্যা ও শ্রেণীসমস্যার মীমাংসার বিষয়টাকে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় ও প্রত্যাশিত অগ্রণী ভূমিকাটা গ্রহণ করতে পারেননি। প্রধান হয়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদীরা। জাতীয়তাবাদীদের নিজেদের ভেতর প্রচ- বিরোধ ছিল, হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও মুসলমান জাতীয়তাবাদীরা পরস্পরের রক্তপাত ঘটিয়েছে। কিন্তু তারা একাট্টা ছিল কমিউনিস্টবিরোধিতার ব্যাপারে। সাতচল্লিশের তথাকথিত স্বাধীনতা আসলে ছিল ক্ষমতাহস্তান্তর; শাসক ইংরেজ তাদেরই সৃষ্ট ও অনুগত ধনিক শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। দেশী ধনিকদের মতোই বিদেশী ওই শাসকদেরও ভয় ছিল সমাজবিপ্লব না ঘটে, কমিউনিস্টরা না চলে আসে। ওই ক্ষমতাহস্তান্তরের পরিণতি আমরা দেখেছি, এবং এখনো দেখছি। এপারে যেমন ওপারেও তেমনি রাষ্ট্রশাসন করছে পুঁজিপন্থীরা; তারা যে-উন্নতি ঘটাচ্ছে সেটা তাদেরই স্বার্থে; এবং সে-উন্নতির বোঝা বহন করতে গিয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে মেহনতী মানুষ। এমনটা নিশ্চয়ই কাক্সিক্ষত ছিল না।
সোমেন চন্দ যখন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে কর্মরত তখন এই 888sport app শহরেই একইভাবে কাজ করছিলেন লীলা নাগ ও অনিল রায়। তাঁরা দু’জনেই ছিলেন 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ইংরেজী বিভাগের। সহপাঠী ছিলেন তাঁরা। 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে দু’জন মাত্র ছাত্রী নিয়ে, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন লীলা নাগ। লীলা ও অনিল একসাথে কাজ করতেন; বিয়েও করেছিলেন একে অপরকে। তাঁদের কাজটা ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক। যতটা না সামাজিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। ইংরেজ সরকার ১৯৩১ সালে লীলা নাগকে গ্রেফতার করে। ইংরেজী 888sport live footballের ছাত্রীটি ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসনের যেভাবে বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন সরকারের পক্ষে সেটা সহ্য করা সম্ভব হয় নি, বিনাবিচারে তারা তাঁকে আটকে রাখে একটানা সাত বছর। লীলা নাগই সম্ভবত ভারতবর্ষের প্রথম 888sport promo code যিনি বিনাবিচারে ও রাজনৈতিক কারণে এতদিন কারাভোগ করেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে এসে লীলা নাগ পুনরায় রাজনীতিতেই যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর কাজের মধ্যে একটি ছিল জয়শ্রী নামে মেয়েদের একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনা। সে-পত্রিকা থেকে থেকে সরকারি রোষানলে পতিত হয়েছে। কিন্তু লীলা নাগ এবং সোমেন চন্দ তো একসাথে কাজ করতে পারেন নি। 888sport app শহরের ওয়ারী এলাকায় লীলা নাগ যখন 888sport promo code শিক্ষা মন্দির নামে বিদ্যালয় স্থাপন করেন (পরে সেটি শেরে বাংলা মহিলা কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে) তখন খুব কাছেই, নারিন্দায়, সোমেন চন্দরা গড়ে তুলছিলেন প্রগতি পাঠাগার নামে কমিউনিস্টদের সংস্কৃতিচর্চার একটি গোপন কেন্দ্র। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ছিল। লীলা নাগ সুভাষপন্থী ছিলেন, ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা তিনি পালন করেছেন; আর ওই ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মীরাই তো হত্যা করলো সোমেন চন্দকে। ইতিহাস হাসছে; হাসাটাই স্বাভাবিক।
অত্যন্ত পশ্চাৎপদ 888sport app শহরে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের বুদ্ধিজীবীরা; পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসুরাও ছিলেন। দুই ধারা এক হয় নি। এক হওয়া সম্ভব ছিল না। লীলা নাগের ধারা আর সোমেন চন্দের ধারাও এক হয় নি, বরং এক পক্ষ আরেক পক্ষকে উৎখাত করতে চেয়েছে।
লীলা নাগরা পূর্ববঙ্গে থাকতে পারেন নি, সোমেন চন্দের পারিবারিক আপনজনদেরও কেউ এখন এখানে নেই, সবাই পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। সোমেন চন্দের সঙ্গে বামপন্থী ধারার যে লেখকরা ছিলেন, যেমন কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অচ্যুৎ গোস্বামী, সদানন্দ সেন, অমৃতকুমার দত্ত, তাঁরা কেউই 888sport appতে থাকতে পারেন নি। রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেন জেল খেটেছেন, এবং ১৯৭৫-এর পরে মারা গেছেন পশ্চিমবঙ্গে, প্রবাসী অবস্থায়।
তবে সোমেন চন্দদের ধারাটি আছে। ক্ষীণ অবশ্যই, কিন্তু নিঃশেষিত নয়। সোমেন চন্দদের বাড়ি ছিল নরসিংদী এলাকায়; ১৯৬৯-এ ওখান থেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন তরুণ আসাদ, সোমেন চন্দদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। এবং সোমেন চন্দের মতোই তিনিও শহীদ হয়েছেন, যদিও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে নয়, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের হাতে। ওই ফ্যাসিবাদীরাও কিন্তু জাতীয়তাবাদীই ছিল। পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদী। তবু সত্যটা তো এই যে পৃথিবী জুড়েই সমাজ পরিবর্তনকামী মানুষ এখন পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এবং পরিষ্কার হয়ে গেছে এই সত্য যে, ওই লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নাই। সোমেন চন্দ যা বুঝেছিলেন অনেক আগেই।
সহায়ক গ্রন্থ
১. সোমেন চন্দ রচনাবলী, সম্পাদনা বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলা একাডেমি, 888sport app, ১৯৯২।
২. হায়াৎ মামুদ, সোমেন চন্দ, বাংলা একাডেমি, 888sport app, ১৯৮৭।
৩. হায়দার আকবর খান রনো, বাংলা 888sport live footballে প্রগতির ধারা, দ্বিতীয় খ-, ছায়াবীথি, 888sport app, ২০১৮।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.