স্বদেশ ও সংগীত : রবীন্দ্রনাথ

সনৎকুমার সাহা

গীতবিতানের প্রবেশিকায় প্রথমেই চোখে পড়ে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া ‘বিজ্ঞাপন’। নিজেই তিনি এভাবে জানানো প্রয়োজন মনে করেছেন। এতে পড়ি, ‘…এই সংস্করণে ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা করে গানগুলি সাজানো হয়েছে। এই উপায়ে, সুরের সহযোগিতা না পেলেও, পাঠকেরা গীতিকাব্যরূপে এই গানগুলির অনুসরণ করতে পারবেন।’ তাঁর নির্দেশনার ওপর ভরসা করেই এখানে আমার কিছু বলার সাহস করা। গানের সুর-তাল-লয়, এসবে আমি একেবারে অজ্ঞ। অবশ্য শুনতে ভালোবাসি – বিশেষ করে তাঁর গান। অনুভবের গোটা বিসত্মার তারা ভরে দেয়। কিন্তু গানের ওপর কথা বলার অধিকার এতে মেলে না। ‘গীতিকাব্যরূপে’ গানগুলো যারা অনুসরণ করতে চায়, তাদের জন্যও গীতবিতানের দরজা খোলা, কবির এই আশ্বাসটুকুই আমার সম্বল। ‘ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা করে’ যে-বিষয়সূচি সাজানো, তাতে ক্রমানুসারে পাই –

১. ভূমিকা : প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে, ২. পূজা, ৩. স্বদেশ, ৪. প্রেম, ৫. প্রকৃতি, ৬. বিচিত্র, ৭. আনুষ্ঠানিক। এছাড়া আছে গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য : কালমৃগয়া, বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শ্যামা। তারপরে : ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, নাট্যগীতি, জাতীয় সংগীত, পূজা ও প্রার্থনা, আনুষ্ঠানিক সংগীত, এবং প্রেম ও প্রকৃতি। পরিশিষ্টে পাই ১. নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা, ২. পরিশোধ, ৩, ৪. 888sport app অচলিত ও অপ্রামাণ্য মোট ১৫টি গান, যা রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে সংযোজিত। এছাড়া গীতবিতানে রবীন্দ্রনাথের ওই নির্দেশনা ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। সেই সংস্করণে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, গানের শ্রেণিবিভাগ ‘আনুষ্ঠানিক’ পর্যমত্ম টানা। (গীতবিতান কালানুক্রমিকসূচী, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা, ১৩৯৯, বৈশাখ)। পরে গীতবিতান আরো সম্প্রসারিত হয়েছে। সে-অনুযায়ী পর্ব888sport free bet বেড়েছে। গান আরো যোগ হয়েছে। বোধহয়, এই সংযোজন-ক্রিয়া এখনো অসমাপ্তই। কারণ, নানা আয়োজনে, নানাজনের আবদারে রবীন্দ্রনাথের তাৎক্ষণিক রচনায় অনেক গান ছড়ানো-ছিটানো রয়ে যায়। তাদের সবগুলোর হদিস মিলেছে, এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। অবশ্য ভাবনার ক্রমবিকাশ ও ধারাবাহিক রচনার মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য একটা রূপ যে আমরা পাই, এ-কথা স্বীকার করে নিই। আকস্মিক কোনো বিস্ময় কোথাও লুকিয়ে আছে, তার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ বলেই মনে হয়।

আমি কিন্তু এখানে গীতবিতানের আঙ্গিক বা তার খুঁটিনাটি নিয়ে কোনো আলোচনায় বসিনি। এ-বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত। প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। বিদ্যা-বুদ্ধি নগণ্য। আমার কৌতূহল আপাতত কেবল স্বদেশ পর্যায়ের গান নিয়ে। সেই সূত্রে ‘জাতীয় সংগীত’ বলে পরে যে-একটা উপবিভাগের সংযোজন ঘটেছে তাকেও এইসঙ্গে যুক্ত করে। গানের ঐশ্বর্য নিয়ে কথা বলা আমার প্রধান লক্ষ্য নয়। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনা কখন কোথায় কীভাবে ফুটে উঠেছে, তাতে তাঁর ভাব-কল্পনা কোনদিকে কেমন আলোড়িত হয়েছে, এগুলোই আমার, যতটা পারি, বোঝার চেষ্টা করা। অবশ্য আনাড়িপনাই বেশি চোখে পড়বে। তবে, সংকোচের সঙ্গে বলি, তারপরেও কৌতূহলটা আমত্মরিক।

গীতবিতানের যে কালানুক্রমিকসূচী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদনা করেছেন, তার পেছনের যুক্তিও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ভূমিকায় তাঁর প্রশ্ন – ‘এইরূপ শ্রেণীকরণ দ্বারা (‘ভাবের অনুষঙ্গ’ রক্ষা করে) রবীন্দ্রগীতমানসের বিবর্তন-বার্তা কি আমাদের কাছে পৌঁছোয়? আঠারো বৎসর বয়সের প্রেমকাকলী ও প্রৌঢ় বয়সের প্রেমগীত কি কখনো শ্রোতার হৃদয়ে একইরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে? উনিশ বৎসর বয়স থেকে বহু বৎসর মাঘোৎসবের সময়ে নিয়মিতভাবে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেছিলেন – তাদের সঙ্গে পরবর্তীকালে স্বতঃউৎসারিত ধর্মসঙ্গীতের মধ্যে ‘ভাবের অনুষঙ্গ’ থাকতে পারে কি? বিভিন্ন বয়সের গানের রূপ ও রসের মধ্যে ভাবের অনুষঙ্গতা উপলব্ধি করা কি সম্ভব?…’ তিনি তাই রবীন্দ্রনাথের গানকে কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়েছেন। তবে নতুন করে গীতবিতান উপস্থিত করেননি। কেবল সূচিটাই তাঁর যুক্তি অনুসারে পুনর্বিন্যাস করেছেন। সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু জরুরি তথ্য, যেখানে যতটা পারেন, জুড়ে দিয়েছেন। যেমন, কোথায় কখন প্রথম ছাপা, কী সুর, স্বরলিপি কখন-কার করা ইত্যাদি। সব গানে প্রত্যাশিত সব তথ্য মেলেনি। যা-যতটুকু পেয়েছেন দরকারমতো উলেস্নখ করেছেন। রবীন্দ্রসংগীতের বিচার-বিবেচনায় বইটি খুব কাজের। অবশ্য গানের উৎকর্ষ বিচারে নয়, শ্রম্নতি-মাধুর্যের বিবেচনাতেও নয়, কেবল গানে স্থান-কাল-বিষয়-বিষয়ী সংগতি খোঁজার জন্য। সব জায়গায় যে সঠিক সিদ্ধামেত্ম তা পৌঁছোয়, এটা নিশ্চিত বলা যায় না। তবে গীতবিতানের সঙ্গে তার এই কালানুক্রমিকসূচী পাশে থাকলে আমাদের অনুভবে বাড়তি মাত্রা একটা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গানের বেলায় তৈরি হতে পারে। সঞ্চয়িতায় যেমন প্রতিটি রচনার নিচে স্থান-কালের উলেস্নখ আছে, গীতবিতানে তেমন নেই। গান গাওয়া, বা শোনার জন্য এতে কোনো বাধা পথ আগলে দাঁড়ায় না। বরং গায়ক বা শ্রোতা গানকে, এবং শুধু গানকেই, নিরঙ্কুশ মুক্তিতে নিজের অনুভবেও স্থায়ী করতে পারেন। গান বদলায় না। কিন্তু পরিবর্তমান বাসত্মবের প্রেক্ষাপটে তার বহুমুখী আলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিকে ছড়ায়। যোগাযোগের কোনো সুনির্দিষ্ট পথরেখা গীতিকার বা সুরকার এক ও অদ্বিতীয় বলে দাবি করতে পারেন না, যদিও ওই গানের কথা ও সুর অবিকল একই থাকে। বিখ্যাত এক গানে রবীন্দ্রনাথ মুক্তির স্বরূপ নিয়ে এও বলেছেন, ‘গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে।’ অবশ্য তার পরেই যোগ করেছেন, ‘আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,/ দুঃখ বিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।’ বোঝা যায়, এই মুক্তি এক বা দ্বিমাত্রিক নয়। এবং তা ক্রমাগত প্রসারমান। কারণ ‘সর্বজন’ কখনোই এক বিন্দুতে স্থির থাকে না। কাল স্বয়ং তা হতে দেয় না। এই মুক্তি যদি গানের সুরে ঊর্ধ্বে ভাসে, তবে তা প্রতিমুহূর্তে অনুভববেদ্য হয়েও প্রতিমুহূর্তে স্বয়ম্ভু। ‘ভাবের অনুষঙ্গ’ খুঁজতে রবীন্দ্রনাথও এমন করে ভেবেছিলেন কিনা জানি না। তবে এতে গান রচনায় স্থান-কালের তথ্য যে অবামত্মর হয়ে পড়ে, এ-কথাটা মানতে হয়।

রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যদি আমাদের অভিনিবেশ কেড়ে নেন, তবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কালানুক্রমিকসূচী নিঃসন্দেহে সঠিক পথ নির্দেশ করায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আমরা এর অসামান্য বস্ত্তনিষ্ঠায় অভিভূত হই। আমাদের জানার সীমা বাড়ে। কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথের ভাবমূর্তি আরো স্পষ্ট হয়। অকপটে স্বীকার করি, এই বইটি হাতে পেয়ে আমি বিশেষ উপকৃত হয়েছি।

আরো একটা কথা এখানে যোগ করি। রবীন্দ্রনাথ যে ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা করে গীতবিতানে গান সাজানোর কথা বলেছেন, তারও তো কোনো না কোনো বস্ত্তগত ভূমি থাকে। চৈতন্যও মানব অসিত্মত্বনির্ভর। এ-কথা বলেছেন প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। বস্ত্ত কিন্তু অনড় নয়। মানুষ যে তার ক্রমাগত রূপামত্মর ঘটায়, আপন চেতনাতেও ক্রমবিকশিত হয়, তাতেই তার সার্থকতা। তাহলে ‘ভাবের অনুষঙ্গ’ কি বলা যায় অপরিবর্তনীয়? তা যদি জাগতিক বিবেচনায় না হয়, তবে গীতবিতানকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে সাজাতে চেয়েছিলেন, কোনো যুক্তির আশ্রয় না নিয়ে কেবল সেভাবেই শুধু দেখি। অবশ্য অসীম 888sport apk download apk latest versionয়। কিন্তু এটিই চূড়ামত্ম সার্থকতার নিদর্শন, এবং তা অবিকল্প, এমন দাবি বা সিদ্ধামত্ম কিন্তু তাঁকেই খ-ন করে। একাধিক জায়গায় তিনি বলেন, অথবা, বলার ক্ষেত্র রচনা করেন যে, তিনি তাঁর ঈশ্বরকে ভালোবাসেন, কারণ তাঁকে (ঈশ্বরকে) অস্বীকার করার স্বাধীনতা ওই একই ঈশ্বর তাঁকে দিয়েছেন। এই স্বাধীনতাই মুক্তির পথ। অবশ্য সৃষ্টি ও ধ্বংস, অর্জন ও বিসর্জন, দুই-ই হতে পারে তার পরিণাম। অথবা বাসত্মবে সত্যানৃতে, কল্যাণ-অকল্যাণে মিশ্রিত হতে পারে তার ধারা। এখানে নিষ্ক্রিয় থাকাই মনুষ্যত্বের অপমান। আর অন্যায় করা, বা সহ্য করা মানুষী বৃত্তিতে কখনো প্রশ্রয় পেলেও তাকে প্রত্যাখ্যান করাতেই তার গৌরব; কর্মপথে জীবনে জীবন যোগ করাতে ঘটে মূল্য-সংযোজন। এমন মূল্য-সংযোজন তাঁর গান শোনার বেলাতেও হয়। তার জন্য ‘চিত্ত পিপাসিত’ থাকে। তবে গীতবিতানের বা কালানুক্রমিকসূচীর যে-কোনোটির নীতি আবশ্যিকভাবে মেনে নয়। গান গাওয়ায় বা গান শোনায় প্রত্যেকের স্বাধীনতা আপন-আপন রুচিনির্ভর। যদিও কা-জ্ঞানহীন স্বেচ্ছাচার সেখানে কাম্য নয়। রুচিও শৃঙ্খলা আর অনুশীলনের মুখাপেক্ষী।

ভণিতা ছেড়ে এবার তাঁর ভাবকল্পনায় স্বদেশের স্বরূপ খুঁজি। অবলম্বন হিসেবে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়েরও শরণ নিই। তবে আমার বলার কথায় ভুলভ্রামিত্মর দায় শুধু আমারই।

 

দুই

গীতবিতানে তিনি যেভাবে গানের ডালি সাজিয়েছেন, (নিজেই ‘পূজা’ পর্বের প্রথম গানের শুরুতে জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘কান্নাহাসির দোল-দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা/ তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা – ’; তবে এ-গানকে ‘পূজা’র চলতি ধারণার সঙ্গে মেলাতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি ব্রাহ্মচেতনার ওপর দাঁড়িয়েও। ব্রাহ্মসংগীত রবীন্দ্রনাথ অনেক লিখেছেন। ‘পূজা’-পর্বেই আছে। তাদের পাশে রেখে পড়লে তফাৎটা সহজেই ধরা পড়ে। প্রথমেই এ-ধাক্কাটা দিয়ে তিনি ‘বোধহয়’ আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন, কোনো বাঁধা সড়কে একক নির্দিষ্ট লক্ষ্যেতাঁর পুজো যায় না। আধার-আধেয় যথেচ্ছ আত্মপরের সীমা ছাড়ায়। মুক্তির এই বিসত্মার আছে তাঁর নিজের সাজানো অন্য পর্বগুলোতেও। এ কি আমাদের চৈতন্যেও ওই মুক্তির হাওয়া বইয়ে দেবার অনুচ্চারিত সাধনা?) – তাতে ‘স্বদেশ’-পর্বে ভুক্তি888sport free bet সবচেয়ে কম; মাত্র ৪৬। সেখানে ‘পূজা’য় গান888sport free bet ৬১৭; ‘প্রেম’-পর্যায়ে ৩৯৫,      ‘প্রকৃতি’-খ– ২৮৩, এবং ‘বিচিত্র’ শিরোনামে ১৪০। বোধহয় তিনি মনে করেছেন পাঁচমিশেলি ভাব, তাই সুনির্দিষ্ট কোনো পরিচয় তাদের দেননি। আর একটি ভাগ ‘আনুষ্ঠানিক’। নামেই বোঝা যায়, এখানে যে-গানগুলো জায়গা পায়, তারা প্রকাশ্যে অনেকের সামনে গাইবার। কোনো বিশেষ ভাবের অনুষঙ্গে তাদের ফেলা যায় না। তাই এদের আর সব গান থেকে আলাদাই রাখি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের বিবেচনার অনুসরণে। এমনও হতে পারে, ‘আনুষ্ঠানিক’ হলেও তাদের বেশকটির সুনির্দিষ্ট কোনো ভাগে জায়গা পাবার যোগ্যতা আছে। এমন গান আছে ২১টি। ‘স্বদেশ’-পর্বের চেয়ে কম; কিন্তু ‘স্বদেশে’র মতো কোনো নির্দিষ্টতা দেওয়া নেই। তাই তুলনায় এদের টানি না। তবে কেন এরা আলাদা, সে-প্রশ্ন এড়াতে পারি না। হয়তো স্বদেশের সীমা খুঁজতে – তাঁর ‘স্বদেশের’ – এদের কোনো-কোনোটি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

পরের সংযোজন নিয়ে আগেই বলেছি। প্রতিটি শিরোনাম বিষয়বার্তা যথারীতি পৌঁছে দেয়। এখানে ‘জাতীয় সংগীত’-পর্বে পাই ১৬টি গান। ‘স্বদেশ’-খ–র ৪৬টির সঙ্গে যোগ করলে দাঁড়ায় মোট ৬২টি। গীতবিতানের যে-সংকলনটি আমার কাছে আছে, তা থেকে এই হিসাব। পরে নিশ্চয় আরো সংযোজন ঘটেছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কালানুক্রমিকসূচীতে (১৩৯৯ বঙ্গাব্দ সংস্করণ) দেখছি, ‘ – গীতবিতানের মোট গানের 888sport free bet ২২৩২। তন্মধ্যে ১৮৯০টি গানের স্বরলিপি আছে স্বরবিতানের ৬০টি খ–।’ এটিও প্রথম খ- প্রথম সংস্করণের (১৩৭৬) ভূমিকার পুনর্মুদ্রণ থেকে পাওয়া। অনুমান করি, পরের আটচলিস্নশ বছরে আরো কিছু সংযোজন ঘটেছে। তবে পর্ববিন্যাসে গান888sport free betর আপেক্ষিক অবস্থায় উলেস্নখ করার মতো হেরফের ঘটেছে, এমনটির সম্ভাবনা খুব কম বলেই মনে হয়। গীতবিতান যেমন পেয়েছি, তেমনটি ধরে নিয়েই কিছু বলার চেষ্টা করি। অবশ্য আগে যা বলেছি স্বদেশ-ভাবনাই এখানে আমার দেখার বিষয়। 888sport free betনুপাতে সংশিস্নষ্ট গানগুলো একত্রে নিচের দিকে হলেও 888sport live chat সিদ্ধিতেও, একই সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজ-মানসে অক্ষয় ছাপ এঁকে দিয়ে তাদের বন্ধনদশা মোচন করায় এদের বেশকটির অবদান তাঁর আর সব গানের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। সম্ভবত এদের আবেদন প্রেক্ষাপট বদলালেও অমর থেকে যাবে। যেমন থেকে যাবে প্রেম, প্রকৃতি ও পূজা পর্যায়ের অসংখ্য গানে। এসবে আমাদের চেতনায় ও অনুভবে তাদের মিলিত বিসত্মারে কোনো না কোনো স্থির বিন্দু তিনি স্পর্শ করেন। যে-অনুরণন তাতে জাগে, কালকে পরাসত্ম করে তা বিরতিহীন বেজে চলে। আধার, যুগ থেকে যুগামত্মরে, রূপ থেকে রূপামত্মরে অনিবার্য ধারায় বদলে যেতে থাকলেও।

গীতবিতানে ‘স্বদেশ’-খ– প্রথম গান ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। রবীন্দ্রনাথ ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা ছিলেন, এমন কথা বলা পাগলের প্রলাপ। তবে ‘ভাবের অনুষঙ্গ রক্ষা’য় এই গানে অগ্রাধিকার যে শত মানুষের ধারায় বাঙালির আত্মপরিচয়ের ও আত্মমর্যাদার বিশ্বনন্দিত স্বীকৃতি পায়, এ আমাদের অভিভূত করে। এই গান আজ গণপ্রজাতন্ত্রী 888sport appsের জাতীয় সংগীত। তার মুক্তিসংগ্রামে এ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণামন্ত্র। অথচ অবাক করে, এ কোনো বীরত্ব ফলায় না। অহংকারের, বা আত্মগৌরবের নিশান তোলার লেশমাত্র চেষ্টা এতে নেই। যা আছে তা এক সরল স্বীকারোক্তি, ‘মা, তোমায় ভালোবাসি’। কোনো কৃত্রিমতা এতে জৌলুস বাড়ায় না। সুর মাটিঘেঁষা। গগন হরকরার হাটে-মাঠে গেয়ে বেড়ানো গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে-রে’ – তার সুর অবিকল তিনি বসিয়েছেন এই ‘সোনার বাংলায়’। তার অণুতে-অণুতে তা মেশে। একই রকম আকুলতা ফোটে। কিন্তু সত্যবদ্ধ অভিমানের সংগত সংহতি দিগমত্ম পেরিয়েও ক্ষুণ্ণ হয় না। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সময় দেখেছি, অসংখ্য বিপন্ন মানুষ এই গান গেয়ে, অথবা, শুনে আত্মস্থ হচ্ছে, সাহস সঞ্চয় করছে; – যদিও চোখে জল। আমি গাইতে পারি না। কিন্তু মনে মনে এর কথা ও সুর অনুসরণ করতে গেলে এখনো আমার গলা বুজে আসে। যদিও মনে করি না, আমি খুব আবেগপ্রবণ। এই যে আমাদের সবার অনুভবে স্বদেশের শুদ্ধ প্রতিমা আতিশয্যহীন-পরিপূর্ণ, কিন্তু প্রাণময়ী করে তোলা, এতেই এ অপার করুণায়-শামত্ম মহিমায় চেতনার আকাশে ধ্রম্নব হয়ে জ্বলে। উচ্চকণ্ঠ শপথ বা গর্জন এতে মানায় না। তারা বরং এর ‘চরণপানে নয়ন করি নত’ তাদের কল্যাণময় সত্যের শক্তি খোঁজে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও কি এ-গান নিয়ে এভাবে ভেবেছিলেন? প্রশ্নটা মনে জাগে, কারণ, গীতবিতানে স্বদেশ-পর্যায়, তাঁর সুচিমিত্মত বিন্যাসে, এই গান দিয়েই শুরু। যদিও একে বিষয় করে তাঁর প্রথম রচিত গান এটা নয়। এবং তাঁর স্বদেশ-ভাবনা এক জায়গায় স্থির আছে, এমনটিও দেখি না।

এই গানে আর একটা বিশেষত্ব আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গানটি উত্তমপুরুষ বহুবচনে নয়, একবচনে বাঁধা। স্বদেশও একবচন : ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাঁর অনুরূপ আরো বেশ কিছু গান এইরকম। যেমন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি, বারে বারে হেলিসনে ভাই’, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।… তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে, তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে’, ইত্যাদি। এতে কিন্তু বিচ্ছিন্ন এককে ভাবনা বাঁধা পড়ে না। ‘আমি’ মানে এখানে প্রত্যেক ‘আমি’। যখন এইরকম গান সব আমরা শুনি, তখন প্রত্যেকে তার সঙ্গে একাত্ম হই। সমবেত কণ্ঠে গাইলেও কোনো অসুবিধা হয় না। অনুভবে ঐক্য আপনা থেকে রচিত হয়। তবে একটা অতি বিখ্যাত গানের বাণীতেই কিন্তু সচেতনভাবে এর ব্যত্যয় ঘটানো হয় : ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ আমার মনে হয়, এখানে যতটা স্বদেশ-ভাবনা, তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের নৈতিক পথ বেছে নেবার। প্রশ্নটা ওঠে, যখন কল্যাণ-ভাবনা এক হলেও দুজনে ভিন্ন ভিন্ন পথ বেছে নিতে চান। সমষ্টি-ভাবনায় ব্যক্তিগত জীবনে, আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ এইরকম পরিস্থিতিতে সবসময় খুব একগুঁয়ে ছিলেন। একা হয়েছেন, একা থেকেছেন, কোনো আপস করেননি। তবে এইখানে ‘তোর’ সঙ্গে এখানে অন্য যে গানগুলোয় উত্তমপুরুষ-একবচনের মাধ্যমে প্রত্যেককে, এবং সেই সূত্রে সমগ্রকে ধরা যায়, তাদের একককে মেলানো যায় না। গৌতম বুদ্ধের ‘আত্মদীপো ভব’ – এই বুঝি এখানে সারকথা। সঠিক সমাধান কি রবীন্দ্রনাথ নিজের পথে সব সময়ে সৎ ও একনিষ্ঠ থেকেও বাতলাতে পেরেছেন? মনে হয় না। এটা অথবা ওটা, চেতনায় এই যৌক্তিক দ্বিভাজন অনেক সময়েই বাসত্মবের অনুমোদন পায় না। প্রায়শই তা বহুমাত্রিক। একে-অন্যে-পরস্পরে মিলে কোনো ভারসাম্যের কথাই, বোধহয়, বড়জোর ভাবা যায়। সেটিও কদাচিৎ চিরকালের সমাধান।

‘আমার সোনার বাংলা’র সূত্র ধরে আমাদের এই 888sport appsে গণচেতনায় বিপুল প্রভাববিসত্মারী আর একটা গানের কথা আপনা থেকে মনে জাগে। এই আলোচনায় হয়তো সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয়। রবীন্দ্রনাথেরও নয়। তবু শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ ঘটলেও একে এড়িয়ে যেতে পারি না। গানের কথা ও আবেগ আমাকে পরাসত্ম করে। অবশ্য এটিও কালজয়ী গান – আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো 888sport cricket BPL rateে ফেব্রম্নয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি।’ শহীদ আলতাফ মাহ্মুদের সুর। এখন নিজেই সে স্বয়ংসিদ্ধা। যা খেয়াল করি, তা হলো, এখানেও গানের কথা উত্তমপুরুষ, একবচনে। এবং এই ‘আমি’ও ‘আমার সোনার বাংলা’র এককের মতো ব্যতিক্রমহীন সমগ্রের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিনিধি। সুরের কোমলতা, গভীরতা ও সংযম ‘সোনার বাংলা’র পাশে এতটুকু বেমানান নয়। আমাদের অসিত্মত্বের মর্মমূলে ঢেউ তোলে। সেখানে একই রকম আত্মোপলব্ধির আলো ফোটে। একজনের নয়, সবার। শিক্ষাদীক্ষা যার-যেমন হোক না কেন। এ-গান যেমন যতটা গাই – ‘সোনার বাংলা’ও জাতীয় সংগীতে যতটা গাই – তাতেই কিন্তু এরা পূর্ণতা পায়। শোক-অথবা-ভালোবাসার উচ্চারণ মহাশক্তি ধারণ করে। বাড়তি বীরত্ব ফলাবার প্রয়োজন করে না। তেমন করলেই এই দুই গানের অপার মহিমা ক্ষুণ্ণ হতো। 888sport cricket BPL rateের গানে জানতে পাই, শেষাংশে আছে বহুর উদ্দেশে সংগ্রামী আহবান। তেমনটি জুড়ে গাওয়া হলে, আমার মনে হয়, গান লক্ষ্যভ্রষ্ট হতো। সাময়িক উত্তেজনা অব্যক্ত বোধের অতলস্পর্শী হবার পথরোধ করত। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে দেখেছি, কোথাও ‘সোনার বাংলা’ গাওয়া হলে গায়ক ও শ্রোতা, অনেকের চোখে জল। এখনো তেমন হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। এটা দুর্বলতা নয়, ন্যাকামি নয়, পূর্ণপ্রাণে আত্মস্বার্থহীন বোধের অকুণ্ঠ অঞ্জলি।

তবে গীতবিতানে স্বদেশ-পর্যায়ে সব গানই উত্তম বা মধ্যমপুরুষ – একবচনে নয়। আরো একটা বিষয় খেয়াল করি, এই অংশে ৪৬টি গানের ভেতর ২৮টিই লেখা ১৯০৫ থেকে ১৯১১-র ভেতর; – বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে তা চলাকালীন গোটা কালখ–। এখানে স্বদেশের প্রত্যক্ষ স্বরূপ আগের অখ- বাংলা। আসাম-বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা নিয়ে প্রশাসনিক অঞ্চল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নয়। বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র বঙ্গভূমি। যে-আঘাত লাগে স্বাভাবিক আত্মপরিচয়ে ও মানবিক আত্মসম্মানে, তারই স্বতোৎসারিত শুদ্ধ অভিমান ও ন্যায়সিদ্ধ প্রতিবাদ থেকে এই গানগুলোর সৃষ্টি। কোটরবাসী তিনি থাকেন না। ক্ষমতার নির্লজ্জ অত্যাচার বলে যা মনে করেন, তা মেনেও নেন না। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় গানে বাঙালি কণ্ঠকে তিনি সরব করেন। বাংলার ভাবৈশ্বর্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ তাতে সুর জোগায়। আরো কটি গানের শুরু এইরকম: ‘নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে’, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না। দু বেলা মরার আগে, মরব না, ভাই, মরব না \’, ‘আজি 888sport appsের হৃদয় হতে কখন আপনি,/ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান –  তুমি কি এমনি শক্তিমান!’ এসব গান আমাদের কাছে পুরনো হয় না। বারবার শুনি। বারবার উঠে দাঁড়াই। মন জাগে। তবে কাউকে ঘৃণার লেশমাত্র নেই।

এই সময়ের এমন সব গানে বহুবচনে আত্মঘোষণা তুলনায় কম। তবে নিখাদ প্রেরণা আমাদের ঋদ্ধ করে সেসবেও। যেমন এই গানগুলো, ‘এখন আর দেরি নয়, ধর্ গো তোরা হাতে হাতে ধর্ গো।’ ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে,/ মোদের ততই বাঁধন টুটবে।’ ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু এখন, ওগো কর্ণধার। / তোমারে করি নমস্কার।/ এখন বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর – ’ বিশেষ দুরভিসন্ধি পরাসত্ম করার আত্মনিষ্ঠ শপথ নিয়ে এসব গান। ওই ঘটনার রেশ মুছে গেছে। নতুন নতুন সংকট দৃষ্টি আমাদের বারবার ভিন্নমুখী করেছে। জীবনের প্রেক্ষাপট বদলে গেছে তুমুল। তবে তাঁর ওই ঘটনাসৃষ্ট গানগুলো এখনো আমাদের একই রকম অনাবিল করে, সংহত করে, কল্যাণবোধে উজ্জীবিত করে, নির্ভয় হতে শেখায়। তিনি নিজে ওই বৃত্তে বাঁধা থাকেননি। ঘটনার বহুমুখী ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের সমষ্টিজীবনে অন্ধবিশ্বাস, আচারসর্বস্বতা ও সংকীর্ণ অমানবিক অভ্যাসের দাসত্ব যে মুখব্যাদান করে নিজেদের জাহির করতে থাকে, তাতে তিনি ক্রমশ সক্রিয় কর্মকা- থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন, যদিও ন্যায়-অন্যায় বোধ তাঁর লুপ্ত হয় না, বরং তা আরো বৃহৎ থেকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রসারিত হয়ে চলে। গোটা ভারতবর্ষের ওপর তিনি দৃষ্টি ফেরান, বালক বয়সেই পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক আবহে যাকে তিনি এক আদর্শিক প্রস্থানভূমি হিসেবে প্রশ্নহীন স্বপ্নকল্পনায় সরল সমীকরণে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। উনিশ শতকের শেষভাগে প্রাচ্যবিদদের এই ভারতভূমির অতীত মহিমাকীর্তন ও তার আগে অজ্ঞাত প্রত্ন আবিষ্কারে ঐশ্বর্যের সমারোহ এই পরিচয়ে গৌরবের রাজটীকা পরিয়ে দিয়েছিল। বাসত্মবে পরাধীনতা ও সর্বগ্রাসী বিপন্নতা ওই অতীতের মোহকে আরো প্রবল করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথের আপন পরিম-লে তার প্রভাব ছিল তুমুল। শুধু তাই নয়, ভাবনা-কল্পনায় নেতৃস্থানীয় একটা জায়গাও চলে এসেছিল ওই বৃত্তে। এই আবহাওয়ায় বালক রবীন্দ্রনাথের মনোগঠন তাঁকে হিন্দুমেলার ভাবাদর্শ থেকে প্রথম যৌবনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ধ্যান-ধারণা ও কর্মসাধনার পরিকল্পনার দিকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রত্যক্ষের অবনমিত জীবনের বাধ্যতার গস্নানি থেকে মুক্তির আর্তিও তাতে যোগ হয়েছিল। প্রাক-বঙ্গভঙ্গ পর্বে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিমত্মায় ভারতভূমিই ছিল সমসত্মটা জুড়ে। তার প্রতিফলন ঘটে ওই সময়ে লেখা তাঁর দেশাত্মবোধক গানগুলোয়। গীতবিতানে এরকম মোট নয়টি ‘স্বদেশ’-অংশে জায়গা পেয়েছে। এমন আরো ষোলোটি গান আছে পরে সংকলিত ‘জাতীয় সংগীত’-বিভাগে। তবে বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী দ্বান্দ্বিক বাসত্মবতায় রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি আঘাত-দীর্ণ ও সার্বিক কল্যাণ-এষণায় উন্মুখ। উদাত্ত আহবান আছে অবশ্যই কিন্তু আকাশকুসুম রচনা কোথাও নেই।

‘জাতীয় সংগীত’-শাখায় রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে কম বয়সের গান ‘তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ।’ তিনি তখন ষোলো বছরের। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের অনুমান, ‘গানটি ‘সঞ্জীবনী সভা’র প্রেরণায় রচিত।’ এছাড়া এখানে তাঁর সতেরো বছরের রচনা তিনটি। একটির শুরু, ‘ভারত রে, তোর কলঙ্কিত পরমাণুরাশি/ যত দিন সিন্ধু না ফেলিবে গ্রাসি তত দিন তুই কাঁদ্ রে।’ এদের কোনোটিতেই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনার কোনো পরিচয় নেই। তবে বিবেকানন্দর সঙ্গীত কল্পতরু সংকলনে এরা জায়গা পেয়েছে। আঠারো বছর বয়সের তাঁর একটি গান অবশ্য যথেষ্ট পরিচিত। সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়। বেতার-ইলেকট্রনিক মাধ্যমেও বাজে। গানটি ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন,/ এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন – ’ এখানে যে-উন্মাদনা আছে, তা প্রেরণা জাগায় অবশ্যই। তবে একে রাবীন্দ্রিক বলা যায় না। তাঁর পঁচিশ বছরের একটি গানে দেশবাসীকে পরোক্ষ, কিন্তু অধৈর্য ভৎর্সনা একে বিশিষ্ট করেছে। যদিও বানীর সীমাতেই এ আটকা থাকে। গানের কথামুখ : ‘কেন চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে।/ এরা চাহে না তোমারে চাহে না যে, আপন মায়েরে নাহি জানে।/ এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না – মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভাণে \’ সব গানই এখানে এরকম স্পষ্ট। তাঁর চলিস্নশ বছরে লেখা একটি গানের শুরু এরকম : ‘হে ভারত, আজি তোমারি সভায়, শুন এ কবির গান।/ তোমার চরণে নবীন হরষে এনেছি পূজার দান।/ এনেছি মোদের দেহের শকতি, এনেছি মোদের মনের ভকতি,/ এনেছি মোদের ধর্মের মতি, এনেছি মোদের প্রাণ -।’ যা লক্ষণীয়, এরকম কোনো গানই গতানুগতিকতার বাইরে যায় না। এবং এদের প্রত্যেকটিরই বিষয়ভূমি, তখনকার ভারতবর্ষ।

বঙ্গভঙ্গ এক ঝটকায় রবীন্দ্রনাথের চট্কা ভাঙে। এই আঘাতই তাঁর শ্রেষ্ঠ স্বদেশ সংগীতের প্রেরণা। মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, সবকিছু অণুতে-অণুতে মিশে যায় তাঁর গানে। এমন একটা বিশিষ্টতা তারা পায়, এমন মহিমার শিখরচূড়া তারা স্পর্শ করে, যাদের মনে হয়, পূর্ণ প্রাণের আয়োজন। আমাদের চেতনার সমসত্মটা তারা ভরে ফেলে। আগের গানে এই একৈকামিত্মক-একাত্মতার অভাব ছিল। কখনো কখনো মনে হয়েছে, পূর্বনির্ধারিত একটা ছকে তিনি পা ফেলছেন। যেন এমনটিই করণীয়। অথবা এমনও হয়েছে, তাঁর অপূর্ণবিকশিত প্রতিভাকে তিনি অননুভূত, কিন্তু অনুমোদিত কোনো রূপকল্পের নির্মাণে প্রয়োগ করছেন। মনে কোনো প্রশ্ন জাগছে না। কারণ যে-পরিম-লে তাঁর জীবনযাপন, সেখানে পারিপার্শ্বিক আয়োজনে তেমনটিই চল। এটা ওই পর্বে তাঁর অনেক ব্রাহ্মসংগীতের বেলাতেও সত্য। গান ও সুর রচনায় তাঁর অলোকসামান্য মেধার কুশলতাকে তিনি কাজে লাগাচেছন। কাজ তৈরি হয় আদি ব্রাহ্মসমাজে উপাসনা-গীতের চাহিদায়। তিনি তাদের একজন। পারিবারিক ঐতিহ্যে ব্রাহ্ম। আপন চেতনায় উদ্ভূত প্রশ্ন বা সমাধান অবামত্মর। স্বদেশ ও তাঁর সৃষ্ট সংগীতের সম্পর্কও যেন ছিল তখন এরকমই। একেবারে গোড়ার দিকে চোদ্দো বছর বয়সে এখন পর্যমত্ম তাঁর প্রাপ্ত দ্বিতীয় গান ‘জ্বলজ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ।’ গীতবিতানে এটা নাট্যগীতি-অংশে আছে। কিন্তু ওই সময়েই স্বদেশ বা জাতীয় ভাবনাতেও একে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই গানের উৎপত্তি বিষয়ে জানাচ্ছেন, ‘…জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সরোজিনী’ নাটক ১২৮২ অগ্র. ১৮৭৫ নভেম্বর। সরোজিনী মুদ্রিত হবার সময় রামসর্বস্ব প–ত প্রম্নফ দেখিতেন। প্রম্নফ দেখিবার সময় তিনি জোরে জোরে পড়িতেন। পাশের ঘরে বালক রবীন্দ্রনাথ পড়াশোনা করিতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁহার জীবন888sport sign up bonusতে লিখিয়াছেন – ‘…রাজপুত মহিলাদের চিতা প্রবেশের যে একটা দৃশ্য আছে, তাহাতে পূর্বে আমি গদ্যে একটা
বক্তৃতা রচনা করিয়া দিয়াছিলাম। … গদ্য রচনাটি এখানে একেবারেই খাপ খায় নাই বুঝিয়া, কিশোর রবি একেবারে আমাদের ঘরে আসিয়া হাজির। তিনি বলিলেন – এখানে পদ্য রচনা ছাড়া জোর বাঁধিতে পারে না।… আমি সময়াভাবের আপত্তি উত্থাপন করিলে, রবীন্দ্রনাথ অল্প সময়ের মধ্যেই ‘জ্বল্ জ্বল্ চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ’ এই গানটি রচনা করিয়া আনিয়া আমাদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন।’… মূলের গানটি ৩৬ পঙ্ক্তি। গীতবিতানে মাত্র ১৬ পঙ্ক্তি।’ (সম্পাদিত, গীতবিতান, কালানুক্রমিকসূচী, কলকাতা, ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ, পৃ ৩৫-৩৬)। ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথের গান রচনার হেঁসেলঘরের একটুকরো ছবি এতে ভেসে ওঠে, মনে হয়। তবে প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের গানে শুরু থেকেই তিনি স্বয়ম্ভু। আত্মচেতনায় অনুভবের সততা গানের কথা ও সুরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরদায়-বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় – অসামান্য সৃষ্টিকলায় যে ফুটে ওঠা, তা প্রথম থেকে শেষাবধি বিরতিহীন চলে। কোনো পুনরাবৃত্তি ঘটে না। জাগ্রত অনুভবে নতুন নতুন কল্পপ্রতিমা আমাদের প্রাণ ক্রমাগত জাগিয়ে তুলতে থাকে। তুলতেই থাকে। তাঁর জীবন যতদূর, ততদূর। অবশ্য পূজার গানেও বাসত্মব অভিজ্ঞতা তাঁকে বিশ্বাসের গতানুগতিকতায় বেঁধে রাখতে পারে না। নইলে বাহাত্তর বছর বয়সে কেন তিনি গাইবেন, ‘পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে!… হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে \’

বলেছি, বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা তাঁর স্বদেশ-চেতনাকে পুরোপুরি বাংলাকেন্দ্রিক করে তোলে। বাসত্মবের অভিঘাত ও আবেগের সততা তখন এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ গানগুলো তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। এমনকি বিবেকশুদ্ধ প্রতিবাদে কোনো কোনো গান বাসত্মব জীবনে ভিন্নতর অবস্থাতেও একশভাগ খাপ খেয়ে যায়। ঘটনার উৎসভূমি ছাড়িয়ে তারা
স্থান-কালের বন্ধন অতিক্রম করে যুগে যুগে অমানিত মানুষের কণ্ঠে সুসম্বন্ধ ও সর্বোত্তম সুরারোপিত ভাষা জুগিয়ে চলে। কিন্তু বাসত্মব বহুদ্বান্দ্বিক। বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ রূপ কোথাও কোথাও গণমানুষে বিভাজন বাড়ায়, অসহিষ্ণু দলীয় স্বার্থ অন্যায়কেও প্রশ্রয় দেয়। এদের সঙ্গে তিনি তাল মেলাতে ব্যর্থ হন। একটু একটু করে পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে আসেন। কিন্তু সচেতন স্বদেশ-ভাবনা আরো প্রসারিত, আরো জাগ্রত, আরো সংহত হতে থাকে। কৈশোর থেকে ভারতবর্ষ তাঁর কাছে ছিল এক পূর্বনির্ধারিত স্থির বাসত্মব। আবার তিনি ওই ভারতবর্ষে দৃষ্টি ফেরান। কিন্তু এ-ভারত কোনো স্থিরচিত্র নয়। সবকিছু তাতে মীমাংসিতও নয়। তার হয়ে ওঠায়-হতে থাকায় তাঁরও একটা ভূমিকা আছে। যেমন আছে আর সবার। ঘটমানতার যে-ধারা, ন্যায়-অন্যায়ের যে-মিশ্রণ, সেসব থেকে পথের রেখা খোঁজা জরুরি। শুধু নিজের জন্য নয়, আর সবার ভাবনাকে আকৃষ্ট করার জন্যও। এই তাগিদ থেকে তিনি লেখেন দুটো বিখ্যাত 888sport app download apk – ‘ভারততীর্থ’ ও ‘অপমানিত’। ‘ভারততীর্থে’ পড়ি, ‘হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগোরে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ আরো পড়ি, ‘ – এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু-মুসলমান-/ এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃস্টান। এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার। /এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।…’ (খেয়াল করি, সবার ভেতর ব্রাহ্মণকেই মন শুচি করতে বলছেন। তার মানে, ব্রাহ্মণের অশুচিতাই দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়।) আর ‘অপমানিত’তে তিনি সরাসরি ধিক্কার দেন, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’ দুটো 888sport app download apkতেই সংক্ষেপিত আকারে সুরারোপ করা হয়। তবে ‘ভারততীর্থ’ গীতবিতানে থাকলেও তাতে ‘অপমানিত’ নেই। বোধহয় রবীন্দ্রনাথ এতে সুর দেননি, সে-কারণে। তবে এই দুটো গানই বঙ্গভঙ্গ-রদের কালে তাঁর চেতনায় স্বদেশভাবনার স্বরূপ স্পষ্ট চিনিয়ে দেয়। এছাড়া বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলন শুধু কথায় নয়, সুরেও তাঁকে মাটির কাছাকাছি টানে। ‘আমার সোনার বাংলা’র কথা আগেই বলেছি। এছাড়া বাউল, সারিগান, ভাটিয়ালি, এসব সুরও তিনি অবলীলায় নানা গানে উলেস্নখযোগ্যভাবে মেশাতে থাকেন। স্বদেশ ছাড়া ভিন্নভাবের গান হলেও।

‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে – ’ গানটি তিনি রচনা করেন বঙ্গভঙ্গ-রদের সমসময়ে। গোটা ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে তখন তাঁর প্রসারিত দৃষ্টি। ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী’ – উদাত্তকণ্ঠে তিনি তাদের সমসত্মটাকে এই গানে ধরতে চান। ২৮ ডিসেম্বর, ১৯১১ কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে এটা প্রথম গাওয়া হয়। তবে তাঁর প্রথম পর্বের রচনায় যে ভারতের গৎবাঁধা ছবি ফুটে ওঠে, এখানে তা থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন পুরোপুরি। তাঁর স্বপ্নকল্পনার ভারতবর্ষ এখানে সার্বিক সংহতি ও পূর্ণতা পায়। আরো একটা বিষয়, এরই অনুষঙ্গ হিসেবে, আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। যাকে তিনি বলছেন ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ সে-ই আবার ‘স্নেহময়ী তুমি মাতা’। যে-ভাগ্যবিধাতৃতে 888sport promo code-পুরুষ দুয়েরই প্রকাশ দুরকম বাসত্মবতায়, তাকে তিনি অনায়াস সরলতায় এই গানে ফুটিয়ে তোলেন।

এখানে আরো একটি তথ্য প্রাসঙ্গিক মনে করি। বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরমে’ সুর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গানের গলার খ্যাতি ছিল। তখন তো মাইকের ব্যবহার চালু হয়নি। খোলা জায়গায় চড়ায় গাওয়াই চল ছিল। বোধহয় কোনো এক কংগ্রেস অধিবেশনে ‘বন্দেমাতরম’ – গাইতে গিয়ে তাঁর গলা ভেঙে যায়, সুকণ্ঠও সেই সঙ্গে তিনি হারিয়ে ফেলেন। এখন যে তাঁর গানের ও আবৃত্তির দীর্ঘবাদন আমরা শুনি, তা তাঁর গলা ভেঙে যাবার পর বৃদ্ধ বয়সের। কণ্ঠস্বর-ধারণ-যন্ত্রও ছিল অনুন্নত মানের। তবু তাঁর গায়ন ও আবৃত্তিশৈলীর আন্দাজ একটা বোধহয় পাই। গলার সুর হারিয়ে যাওয়ায় তাঁর নিজের আক্ষেপ ছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কথা থেকে এটা জানতে পাই।

 

বঙ্গভঙ্গ-রদের রেশ কেটে যাবার পর স্বদেশ পর্যায়ে সংকলিত তাঁর গানের 888sport free bet তেমন উলেস্নখ করার মতো নয় : মোট নয়টি। প্রেক্ষাপটের যে-পরিবর্তন আগের পর্বে শুরু হয়েছিল, তা বজায় থাকে। এখানে গানের 888sport free bet না বাড়ার একটি কারণ সম্ভবত একাধিক মাধ্যমে তাঁর স্বদেশ-ভাবনাকেও মিশিয়ে ফেলা। স্বদেশ ও মানবজীবন মিলেমিশে একাকার। শ্রীনিকেতনের এক বার্ষিক উৎসবের ভাষণে তিনি বলেন, ‘দেশ মৃণ্ময় নয়, সে চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত।…’ প্রাকৃতিক দান ও উপাদান মাত্র, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মারী বীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্যকথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে ‘তৈরি নয়, মানুষের তৈরি।’ এরকম সরাসরি যেখানে তিনি কথা বলেন, অথবা কাজে হাত লাগান, সেখানে গানের পরোক্ষ ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ে। তাছাড়া তিনি নাট্যকলায় ও কথা888sport live footballেও তাঁর বক্তব্যে অস্পষ্টতা রাখেন না। বিতর্কিত অথবা নিন্দিত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও তিনি আপন সত্যে অটল থাকেন।

বাকি এই গানকটির কোনোটায় প্রার্থনা আছে, আহবান আছে কোনোটায়, এমনকি এক-একটিতে হতাশা বা পথ খোঁজাও আছে। এখনো তারা আমাদের চেতনায় অভিঘাত হানে। এবং আর একটা ব্যাপার, তাঁর বাণীর মর্মধ্বনি দেশ-কাল অতিক্রম করে অনুরণিত হয়ে চলে অনিঃশেষ। ভিন্ন ভিন্ন বাসত্মবতাতেও সাড়া জাগায়। কথা ও সুর পুরনো হয় না। সংকটে-সমত্মাপেও সহমর্মিতার ঢেউ তোলে, যেমন তোলে এই পর্বের আরো অনেক গানে।

আহবান আছে, এমন গান, ১. সংকোচের বিহবলতা নিজের অপমান, সংকটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ,… ২. নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার -/ জানি জানি তোর বন্ধনডোর ছিঁড়ে যাবে বারে বার \/ বারে বারে তোরে ফিরে পেতে হবে বিশ্বের অধিকার \… ৩. চলো যাই, চলো, যাই চলো, যাই -/ চলো পদে পদে সত্যের ছন্দে/ চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে।/… দূর করো সংশয়শঙ্কার ভার,/ যাও চলি তিমিরদিগমেত্মর পার।… ৪. শুভকর্মপথে ধর’ নির্ভয় গান।/… প্রার্থনার আকুতি শুনি – ১. প্রাণ দাও, প্রাণ দাও, দাও দাও প্রাণ দাও হে, জাগ্রত ভগবান হে, বা, ২. ….এস’ মঙ্গল, এস’ গৌরব, এস’ অক্ষয়পুণ্য’ সৌরভ, এস’ তেজঃসূর্য উজ্জ্বল কীর্তি-অম্বর মাঝ হে বীরধর্মে পুণ্যকর্মে বিশ্বহৃদয়ে রাজ হে।… বোধহয় বলে দেওয়ার প্রয়োজন করে না, রবীন্দ্রনাথের ‘জাগ্রত ভগবান’ কোনো ব্যক্তিগত প্রার্থনার সীমিত ভগবান নন, তিনি নৈর্ব্যক্তিক সত্য ও কল্যাণ।

তবে এই প্রামেত্মর দুটো গানে সমসাময়িক সামাজিক-সাম্প্রদায়িক অশামিত্ম সরাসরি প্রভাব ফেলেছে, যদিও তা এমনভাবে আত্মীকৃত যে, মানবজীবনের যে-কোনো গস্নানি ও অপচয়ের সামূহিক লজ্জা ও অপমানের সামনেও আর্ত, কিন্তু, দীপ্ত কণ্ঠে গাওয়া যায়। মিথ্যা বিশ্বাসের বিড়ম্বনাকে এক ঝটকায় এ উপড়ে ফেলতে বলে : ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো। /একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো \’ কিন্তু কোথায় তা? ধ্রম্নব বিশ্বাসের অবশেষটুকুও নেই। ‘নিরুদ্দেশের পথিকে’র ডাকেই তাই কান পেতে থাকা : ‘নিরুদ্দেশের পথিক আমায় ডাক দিলে কি – দেখতে তোমায় না যদি পাই নাই-বা দেখি।’ আরো বলেন, ‘ভিতর থেকে ঘুচিয়ে দিয়ে চাওয়া পাওয়া, ভাবনাতে মোর লাগিয়ে দিলে ঝড়ের হাওয়া বজ্রশিখার এক পলকে মিলিয়ে দিলে সাদা কালো \’ অনুভব যেমনই হোক, রবীন্দ্রনাথের কোনো গান আবেগে ভেসে যায় না। তারপরেও এ-গানের সদিচ্ছা, নিরাসক্ত আকুতি ও নির্মোহ দৃষ্টি একে আলাদা করে চেনায়।

খাঁটি জিনিস হয়েরে মাটি নেশার পরমাদে \’ শেষ দুটো চরণ, ‘মসত্ম-বড়োর লোভে শেষে মসত্ম ফাঁকি জোটে এসে, ব্যসত্ম আশা জড়িয়ে পড়ে সর্বনাশের ফাঁদে \’ দেশজুড়ে হৈ-চৈ-আন্দোলন – ঘোলাজলে ফন্দিবাজদের মাছ ধরার চেষ্টা, এসবে উত্ত্যক্ত হয়েই বোধহয় কবি তাঁর ধৈর্য হারান। তাঁর বিরক্তি যথার্থ। বোধহয় তার কারণ অস্থির সামাজিক পরিবেশে সব সময় থাকে। এখন বোধহয় আরো বেশি। তাই পুরো প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এখানে 888sport live chatের দূরত্ব নেই। প্রত্যক্ষের শোধন ঘটে না। হয়তো রবীন্দ্রনাথও তা আগেই ধরতে পারেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, এর কোনো স্বরলিপি নেই।

তবে একটা গান ‘স্বদেশ’-পর্যায়ে থাকা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়। গীতবিতানে রবীন্দ্রনাথের এটা আনার কোনো সুযোগ ছিল না। তাঁর জীবনের শেষ পয়লা বৈশাখের রচনা। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ পাঠের পর এটি গাওয়া হয়। গানটি ‘ওই মহামানব আসে’। ‘সভ্যতার সংকটে’র অমিত্মমে তিনি মহামানবের আগমনের আশা জাগান। তারপরেই এই গান। ‘সভ্যতার সংকটে’র কেন্দ্রীয় বিষয় তখনকার ক্ষত-লাঞ্ছিত ভারতবর্ষ। তার সূত্র ধরে আসে মহামানবের বার্তা। রবীন্দ্র-ভাবনায় এই মহামানব কোনো একক বাসত্মব ব্যক্তি নন। তা সমুদয় মানবের ধারা। ‘ভারততীর্থে’ প্রেরণার উৎস ওই ভাব-কল্পনাতেই। মহামানবের আর এক ধারণা তিনি দিয়েছেন, – যিনি ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’। এটাও সামূহিক কল্পনা। স্বদেশে এই মহামানবের জাগরণের আশা তিনি শেষ জন্মদিনেও হারাননি। স্বদেশও কিন্তু আর মানচিত্রনির্ভর থাকে না। বাসত্মবে তখনকার মানচিত্র আর নেই। ছোট-বড় নানা ওলটপালট ঘটেছে। কিন্তু সব জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশের – তাঁর মহামানবের – ক্রমবিকাশমান ধারার দিকেই আমাদের দৃষ্টি। এবং তা যুগ-যুগামত্মর পেরিয়েও অনিঃশেষ।

গানটি পরে গীতবিতানে আনুষ্ঠানিক সংগীত-পর্বের অমত্মর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এ তাঁর স্বদেশেরই কাঙিক্ষত প্রকাশমান রূপ। r