হাসান আজিজুল হক
এবারের এই শরতের ছুটিতেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর একটা সুযোগ জুটল। দুলাভাই এসেছেন, তাঁর সঙ্গে এসেছেন তাঁর মহা আমুদে বন্ধু জহরভাই আর এক দম্পতি। এরা হলেন জহরভাইয়ের শ্যালক আর শ্যালকপত্নী। সদ্য বিবাহিত। ঠিক হলো প্রথমে যাব জহরভাইদের গ্রাম ভোঁতা, তারপর যাওয়া হবে পাশের গ্রামে ওঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে, সব শেষে জানুর শ্বশুরবাড়ি মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির দক্ষিণের পাড়ে জগদলে। দিন দশেকের ব্যাপার। আশেপাশের দু-চারটি গ্রাম ছাড়া কোথাও তো তেমন যাওয়া হয় না। কাজে-অকাজে যাই বামুনগাঁ, ক্ষীরগ্রাম, ধারসোনা, পুইনি, পলাশী, ইটে আর সব সময়েই নিগণ। আর যাই মামার বাড়ি মুরাতিপুরে, পাটনায়, কৈতনে। নাম জানি আশেপাশের সব গাঁয়ের অথচ যাওয়া হয় না। এদিকে আমি ঘুরে বেড়াতে চাই 888sport appsের গ্রামে গ্রামে, দেখে বেড়াতে চাই এক একটা গাঁয়ের চেহারা, গাছপালা, দিঘি-পুকুর, মসজিদ-মন্দির, বেদে, পাখমারাদের গাঁ-গুলো। তা আর হচ্ছে কই? বর্ধমান কাটোয়া এতটাই চিনি যে কাজে সেখানে যেতে হলেও বিরক্ত লাগে। আর আমার অদ্ভুত একটা ধারণা ছিল যে আমাদের এই যবগ্রাম ক্ষীরগ্রাম ছাড়া বাকি সব ধাপধারা গোবিন্দপাড়া, স্কুল-টিস্কুল তেমন নেই। সেসব গাঁয়ের লোকেরা, বিশেষ করে মুসলমানরা একেবারেই অশিক্ষিত, মূর্খ। কেন আমার এই ধারণা হয়েছিল? সে কি মনে মনে আমাদের গ্রামের সঙ্গে 888sport app গাঁয়ের তুলনা করতে গিয়ে? কোনো কোনো গাঁয়ের নাম শুনলেই মনে হতো ওই গাঁয়ে একজনও শিক্ষিত মানুষ নেই। একেবারে কুয়োর ব্যাঙ ছিলাম তো! বামশোর, ভূমশোর, কাফশোর, শিমূলে – এসব গ্রামে ঢুকলেই দেখা যায় রাস্তার যেখানে সেখানে অাঁস্তাকুড়, সারগাদা – মুরগি চরে বেড়াচ্ছে – সারগাদাগুলো আঁচড়ে আঁচড়ে যত বোদ-বাদারি সব ফেলছে রাস্তায়। হাঁটা যায় না সেসব রাস্তায়। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান সকলের বাড়িই মাটির তৈরি, খড়ের চাল, মাত্র দু-তিনটি বাড়িতে আছে টিনের চাল। সারা গাঁয়ে একটি, দুটি বা তিনটি। এগুলি সচ্ছল গৃহস্থের বাড়ি। হিন্দুপাড়া মুসলমানপাড়ার চেহারা একই, তবে তফাত প্রতিদিনের জীবনের আচারবিচারে একটু আছে বৈকি। সারকুড়ের অবস্থা হিঁদুপাড়ায় এত বিচ্ছিরি নয়। হিন্দুরা মুরগি পোষে না, দু-চারটে বাড়িতে হয়তো হাঁস পোষে। সেগুলি সারাদিন পুকুরেই। মুসলমানপ্রধান গ্রামগুলি গরুর মাংস খায়, তার হাড়হাড্ডি, নাড়িভুঁড়ি যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে। দুর্গন্ধ বের হয় গোটা পাড়া থেকে। মুসলমানরা নিজেরাই বলে, আমাদের বাড়ি সব ন্যাতা-জোবড়া, পা রাখা কঠিন বাপু। হিঁদুপাড়ার এই অবস্থা নয়, তারা গোমাংস খায় না। হিঁদুরা বলে, মুসলমানদের বাতকর্মের গন্ধও আমাদের থেকে আলাদা। পরিষ্কার দুরকম গন্ধ। ওরা মুরগি পোষেও না, খায়ও না। হাঁস পোষে কিন্তু খায় না। মুরগিকে রামপাখি বলে দু-চারজন ঘাড়ত্যাড়া মানুষ মুসলমানপাড়া থেকে মুরগি কিনে সন্ধেরাতে ফিস্টি করে, সঙ্গে কারণবারি থাকে। যাই হোক, এসব কারণে হিঁদুপাড়াটা একটু ছিমছাম থাকে। উঠানের এককোণে গাঁদা, দোলনচাঁপা, সন্ধ্যামণি এইসব ফুলগাছ। এসবের একটুও খুঁজে পাওয়া যায় না মুসলমানপাড়ায়। তাদের উঠোনগুলোয় ঝাঁটপাট পড়লেও, হিন্দুবাড়ির গোবর-নিকানো উঠোনের মতো তকতকে পরিষ্কার নয়। তবে মুসলমানরা খুব সাহসী, হঠকারী, দুর্ধর্ষ। সারা গাঁয়ে একঘর মুসলমান থাকলেও তার রোখ্ মরে না। গাঁয়ের সমস্ত হিন্দুদের বিপক্ষে একা দাঁড়াতে ভয় পায় না। যদি মরি একা মরব না, দু-একজনকে সঙ্গে নিয়েই মরব। হিঁদুরা বলে, দু-চারটে অক্ষর হজম হলেও ভাইসায়েবরা এমন হতো না। তবে অনুপাতটা একটু বেশি হলেও অক্ষর হজম তাদেরও তেমন হয়নি। মুসলমানরা বাহাদুরি করে বলে, অক্ষর লিয়ে করব কি, হাঁদু-মোচলমান সব শালাই করছে তো চাষবাস। অক্ষর ধুয়ে কি পানি খাব – ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব কারণে আমার মনে হতো বামশোর, ভূমশোর, কাফশোরে যাওয়া যাবে না।
এতক্ষণ যা বললাম তার মোটামুটি ছবিটা এরকম হলেও আমার ধারণাটা যে কত ভুল, পরে তা টের পেয়েছি। বামশোর, ভূমশোর, শিমূলে, কেশেরার মতো মুসলমানপ্রধান গ্রামে কত শিক্ষিত, প্রতিভাবান, রত্নের মতো মানুষ জন্মেছে আমার সময়ের আগে, সঙ্গে ও পরে তার অন্ত নেই।
যাই হোক, জহরভাই বা ওই দম্পতিকে ক-দিন আমাদের বাড়িতে দেখেও আমার মনে হয়েছিল ওঁদের ভোঁতা গ্রামটা দিনেও অাঁধার। ক-দিনের জন্যে এগাঁয়ে ওগাঁয়ে যাওয়া হবে, এটা ভেবেই খুব উত্তেজনা হলো। মার্টিন কোম্পানির ছোট লাইনের ট্রেনে চেপে ঘণ্টা দুই-আড়াইয়ের মধ্যে বর্ধমান শহরে পৌঁছনো গেল। ওখান থেকে বড় লাইনের ট্রেনে উঠতে হবে। বড় লাইনের ট্রেনে বোধহয় এই আমি প্রথম চড়লাম। এটা আবার কী অদ্ভুত জন্তু রে বাবা! ধাই ধপর, ধাই ধপর শব্দে এটা দেখছি চিতাবাঘের মতো দৌড়ুচ্ছে। তিন-চারটে স্টেশনের পর জামালপুর এসে গেল। এখানেই আমাদের নামতে হবে। দুটো গরুর গাড়ি অপেক্ষা করছে। নামেই গরুর গাড়ি। আমাদের এদিকে মোষের গাড়ি বলাই ভালো। এমন মাটি এখানকার যে চাষবাস করার জন্যে গরু তেমন কেউ কেনে না। মোষই ভালো। যে-গাড়িদুটো আমাদের জন্যে পাঠানো হয়েছিল, সে-দুটো মোষের গাড়ি। হাতির মতো প্রকান্ড একেকটা মোষ। কিন্তু জহরভাইদের গ্রামে যেতে এই মোষগুলিও খাবি খেতে লাগল। সে যে কী বিচ্ছিরি রাস্তা! বর্ষা কবে চলে গেছে, সারা রাস্তা এখনো কাদায় ডোবা, হাঁটার কোনো কথাই ওঠে না। দূরে দূরে এক একটা গাঁ, কোনো কোনো গাঁয়ের ভিতর দিয়েই রাস্তা। একইরকম, কাদায় ভরা। কোনো ভাঙায় গাড়ি নামছে, গাড়োয়ানরা নানান উৎসাহ দিয়ে কথা বলে হৈ হৈ করে চেঁচাচ্ছে আর মাঝে মাঝে খুব খারাপ কথা বলছে। মোষগুলোর বাবা-মাদের সঙ্গে কীসব নাকি করবে? তা কি সম্ভব? সব মিলে গোটা ছয়েক গ্রাম পেরোতে হলো আর কাদাভর্তি শরৎকালের বড় বড় মাঠ। মনে হচ্ছে আমরা সবাই হারিয়ে গিয়েছি, ভোঁতা গ্রামটা এ গ্রহেই নেই। একবার দেখলাম আমাদের গাড়ির মোষদুটি হঠাৎ হারিয়ে গেল। চেয়ে দেখি হারিয়ে যাওয়াই বটে – মোষদুটো গাড়িসুদ্ধ কাদায় নেমেছে – সেই কাদায় মোটামুটি ডুবে গেছে তারা, কোনোরকমে তাদের পিঠ আর শিরদাঁড়া দেখা যাচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে গাড়িটাকে কাদা থেকে তুলেও ফেলল। এ কি গরুর কর্ম। মোষদুটো কি পোষমানা বুনো মোষ?
ভোঁতায় দু-দিন ছিলাম। মোটামুটি মুসলমানদের গ্রাম। রাস্তা, পথ-ঘাট যাচ্ছেতাই নোংরা। একটা বড় পাকুড়গাছে হাজারখানেক শাদা বক বসে আছে। ওদের আঁশটে বিষ্ঠার গন্ধ সারাগাঁয়ের বাতাস জুড়ে পাক দেয়। বেশ বড়সড় উঠানওয়ালা বাড়ি জহরভাইদের। দু-তিন ভাইয়ের আলাদা আলাদা ঘর উঠানের পুবে আর পশ্চিমে। প্রথম কোঠাটার নিচে দুটি ঘর, উপরেও তাই। মাঝখানে সিঁড়ি। উপরের একটি ঘরে আমাদের জায়গা হলো। দিনের বেলাতেও ঘরটা অন্ধকার। মাটির ঘর ঠান্ডা হবেই। শরৎকালের বাতাসটা আবার একটু ঠান্ডা। এই ঘর থেকে তেমন আর কোথাও যাইনি। নিজের মনে লুকিয়ে থাকা যায়। জহরভাই কোথা থেকে একটা গ্রামোফোন আনলেন – সঙ্গে পাঁচ-সাতটা রেকর্ড। এই কটা মাত্র রেকর্ড দুদিনে বারবার শুনেছিলাম। ‘কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি’। পঙ্কজ মল্লিকের ভারি ভরাট গলার এই গান কতবার যে শুনেছিলাম তার শেষ নেই। আর ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দু-তিনটে গান – ‘শুকনো শাখার পাতা ঝরে যায়’, ‘প্রিয়ার প্রেমের লিপি লেখনী তরে, সুদূর দিগন্ত থেকে ফেলে দাও একখানি ঝরা শাদা পাখা, হে বলাকা।’ নিঝুম অাঁধার ঘরে লম্বা লম্বা দুপুরগুলি পার করে ফেলি। গানগুলো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তো বটেই, আজ এতকাল পরেও একইরকম মনে আছে : ‘সে শুধু নখরাঘাত হৃদয় কমলে, বেদনায় নীল হয়ে থাকা’।
এক বিকেলে সিঁড়ি বেয়ে শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ে মিহি গলায় বলল, নিচে জহরচাচা আপনাকে ডাকছে। জানু ঘরে ছিল, জিজ্ঞেস করল – ‘আমাকে?’ সেই সরু গলায় জবাব এলো, ‘না’। তবে কাকে? কোনো জবাব নেই – তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম – ‘আমাকে?’ জবাব নেই। আমি ফের জিজ্ঞেস করলাম – ‘আমাকে?’ শোনা যায় কি যায় না এমন গলায় মেয়েটি কোনোমতে বলল, ‘হুঁ’। আমি নিচে নেমে এলাম, দুলাভাই আর জহরভাই একটা নতুন বই নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। দুলাভাই বলছেন, আমাকে দে, আমি পড়ব। জহরভাই বলছেন, আগামী দু-তিন দিন এই বইয়ে হাত দিতে পারবি না। আমার পড়া হলে তখন নিস। অবিশ্যি আমার পাশে বসে থাকতে পারিস। আমি চেঁচিয়ে পড়ে তোকে শোনাই। দুলাভাই আর জেদাজেদি না করে শীতলপাটির ওপর বসে পড়লেন। পড়। দেখলাম জহরভাইয়ের হাতে একটা নতুন মোটা বই – নাম দেশে বিদেশে, লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। মহা উৎসাহ নিয়ে জহরভাই পড়তে লাগলেন, চাঁদনি থেকে একটা শর্টস কিনে নিয়েছিলুম। কামড়ায় উঠে দেখি এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বসে রয়েছেন আমার মুখোমুখি। আমি গাঁক গাঁক করে জিজ্ঞেস করলুম, গোয়িং ফার? পড়তে গিয়ে আনন্দ আর উৎসাহে ফেটে পড়ছেন যেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম তখনও জানি না। গদ্যও এরকম হয়? এত প্রসন্ন-হাসিভরা গদ্যভাষা তো জীবনে শুনিনি। আমি ভেবে দেখলাম, আজকাল আমি লিখি, 888sport app download apkই বেশি। সেই ক্লাস ফোর থেকেই তো লিখি আমি। আমার এই 888sport app download apkগুলো জহরভাইকে শোনালে কেমন হয়? তখন আমার সব 888sport app download apkই মৃত্যু, দুশ্চিন্তা, দুঃখ আর কষ্ট বিষয়ে লেখা। মৃত্যু, ওরে মৃত্যু আমার কই রে – দুরন্ত ঝড়ে ঘর যে আমার ভেঙে হলো ছারখার। মৃত্যুর দুঃখ, বিষাদ আর কষ্টে আমার তখন প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। এর কিছুদিন পরেই পথের পাঁচালী পড়ে ফেলেছিলাম। তখন ঠিক করলাম – নাঃ, আর 888sport app download apk নয়, গদ্যই লিখব। যাই-ই লিখতে যাই, পথের পাঁচালীর নকল হয়ে যায়। গাঁয়ের কূট বদমাশ কর্মহীন বুড়োরা শরৎচন্দ্রের বামুনের মেয়ে কিংবা পল্লীসমাজের কূটচাল চালা বুড়োদের মতো হয়ে যায়। তবে দুটো এক্সারসাইজ বড় খাতায় তোড়ে লিখে যাই আর শোনার লোক না থাকলে নিজের লেখা নিজেই পড়ি চিৎকার করে। নিচে রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে তারা শুনতে পাচ্ছে ঠিক! এই খাতাগুলি আমার সঙ্গেই থাকত। দুদিন পরে বিকেলবেলায় জহরভাই দেশে বিদেশে পড়ছেন, আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, আমিও লিখি। সেইসব লেখা দু-একটি শুনবেন? বলে খাতা খুলে পড়তে যাচ্ছি, জহরভাই বললেন, আরে রাখো তোমার লেখা। মুজতবা আলী পড়ছি এখন। তিনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে থাকলেন। বড় মনমরা হয়ে আমি উঠে গেলাম।
888sport app download apkর কথা তো একটু আগেই বললাম। যখন মৃত্যুচিন্তা ধারেকাছেও নেই – জীবনই তো একটানা চলবে – আশেপাশে মৃত্যুর কোনো ছায়া নেই, বোধহয় তখুনি পেয়ে বসেছিল মৃত্যু নিয়ে বিলাস। লেখার মজায় মহা আনন্দে কাটানোর জন্যেই হয়তো এই মৃত্যু নিয়ে হাহাকার। একই সঙ্গে গদ্য লেখাও চলছে। সে হচ্ছে পথের পাঁচালী আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মিশেল। দু-একটি বাক্য লিখি আর অবিকল শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রাম্য কুচুটে বুড়ো চরিত্রের মতোই হচ্ছে বুঝে কী যে আনন্দ পাই!
আমার বন্ধু সমরেশ বিকেল দুপুর সন্ধের সময় গলা জড়াজড়ি করে বসেই বলত, গল্প বল। তাকে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প বলে যাই। হেমেন্দ্র কুমার রায়, খগেন মিত্তির ইত্যাদির গোয়েন্দা আর শিকার কাহিনি, ঝিলে জঙ্গলে, নীহাররঞ্জন রায়ের কালো-ভ্রমর পড়া চলছে, সমরেশ দিনরাত গল্প শুনতে চাইলে আমার আর অসুবিধে কী। গল্পে ঠাসা আমার মাথা। এর আগে শ্রীকুমারদা আর আমি মিলে একটা বই লিখব ঠিক করি। ঠিক দুপুরবেলায় ধুলো-ময়লায় ভরা একটা তক্তপোশে দরজা বন্ধ করে লিখতে বসি। খানিকটা লেখার পরেই শ্রীকুমারদা বলতেন, এইবার তুই লেখ আমি বরং তোর পিঠে একটু তবলা প্র্যাকটিস করি – ব্যস, শুরু হয়ে গেল তেরে কেটে ধা, তেরে কেটে ধা। এদিকে আমি তখন দিগন্ত বিস্তৃত এক কলাবাগানের গল্প ফেঁদে বসেছি। আহা, কূলকিনারা মেলে না এই জঙ্গলের। আমি উপুড় হয়ে বসে লিখছি, তবলা প্র্যাকটিস শেষ করে শ্রীকুমারদা তখন আমার পিঠে বসে ঘোড়া চালাচ্ছে – আমি বলছি, শ্রীকুমারদা, এমন করে কি লেখা যায়? শ্রীকুমারদা, বেশ হচ্ছে বেশ হচ্ছে, বেড়ে লিখছিস, এখন একটু অলংকার যোগ করে দিচ্ছি দাঁড়া। তোর নায়কের অবস্থা সঙ্গিন – কোন দিকে যাবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। এইখানে একটা সংস্কৃত শ্লোক ঝেড়ে দিই : চিতাচিন্তর্দ্বয়ো মধ্যে চিন্তা নাম গরীয়সী – চিতা দহিতং নির্জীবং, চিন্তা দহিতং সজীবং। মানে বুঝতে পারলি – চিন্তা নির্জীব কাঠ দহন করে আর চিন্তা জীবিত মানুষকে দহন করে।
যাই হোক, এরকম করে কি বই লেখা যায়! ভাবলাম সমরেশকে বানিয়ে বানিয়ে যে গল্প বলি, সেগুলি নিয়েই একটা বড় বই লিখে ফেলি। এতদিনে ঠিক জায়গাটা পেয়ে গেলাম। যত চিল্লাচিল্লি, হৈচৈ করি সবার সঙ্গে, লিখতে বসতে হয় একা। আমি ঠিক তাই শুরু করলাম। বিকেলে যে গল্পটা সমরেশকে শুনিয়েছিলাম, রাতে সেটিই আবার লিখে ফেলি। কষ্টেসৃষ্টে ক-আনা পয়সা জোগাড় করে ঘোঁতাদার দোকান থেকে দুটি চমৎকার এক্সারসাইজ খাতা কিনে ফেললাম। 888sport alternative linkের নাম দেওয়া গেল কি হলো না? বাস্তবিক সেই রোমাঞ্চকর কাহিনিতে কোনো ঘটনাই বাদ পড়েনি। এই বইটা কিন্তু শেষ হয়েছিল, সম্ভবত আজো আমার বন্ধু সমরেশের কাছে রয়েছে। কবেই ঝরে গিয়েছে সে-লেখাটা কিন্তু সেই মৃত লেখাটা আজো সমরেশের কাছে রয়েছে জেনে আমার ভালোই লাগে!
জহরভাইকে কোনো লেখাই শোনানো গেল না। আমি আধো অন্ধকার কোঠাঘরে বসে থাকি। খাঁ-খাঁ করে চারিদিক। বাইরে দুপুরবেলা ঠায় দাঁড়িয়ে, গাছপালাগুলো একটা শ্বাসও ফেলে না। কী ভয়ংকর নিঃশ্বাস রোধ করে রাখা সময় এই দুপুর, কোনোদিন কি একবার নিঃশ্বাসও নেবে না? একি অদ্ভুত গ্রাম, শুধু নিঝুম তা নয়, মনে হয় একটা মরা গ্রাম। রাস্তায়, পথেঘাটে যে দু-চারজন মানুষ চলাচল করছে, তারা যেন সব মরা, মরা বাড়িঘর, বৈঠকখানা, গাছপালা কোথাও জীবনের কোনো সাড়া নেই। এ-বাড়ির মেয়েদেরও কোনো সাড়াশব্দ নেই। যে-মেয়েটির গলা আমি শুনেছিলাম, একটিমাত্র দুর্বল মিহি শব্দ ‘হুঁ’, ওইটুকুই ছিল জীবনের চিহ্ন। রাতে খাবার সময় আমরা সবাই নেমে এসেছিলাম, চওড়া বারান্দার একপাশে বসে আমরা চার-পাঁচজন খাচ্ছিলাম, পাশে একটা কাঁথা বিছানো বিছানা, সেখানে জহরভাইয়ের বড় ভাই আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিজের হাতে চাষবাস করলে যেরকম হাড়কাঠামো ক্রমেই জং-ধরা লোহার মতো হয়ে ওঠে, শুয়ে-থাকা মানুষটিকে আমার তেমনি পোড়া ইস্পাতের খাঁচা মনে হয়েছিল। হঠাৎ তিনি বাজখাঁই গলায় বললেন, ওরে, মার, মাথার তালুতে মার, মেরে ফ্যাল শালাকে, না হলে এখুনি আমাকে মারবে। বলে আবার একদম চুপ হয়ে গেলেন। জহরভাই একবার একটু বলবার চেষ্টা করলেন, দক্ষিণের মাঠে বিঘে দুই জমি নিয়ে খাঁদের সঙ্গে ঝামেলা চলছে।
ভোঁতা গ্রামের সমস্ত 888sport sign up bonusই আমার কাছে তেতো আর বিস্বাদ। এর মধ্যে মাত্র একটি সন্ধ্যায় অন্য পাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিমন্ত্রণে যেতে হয়েছিল। হাতে হারিকেন নিয়ে পানি-কাদা বাঁচিয়ে কোনোমতে বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়ির ভিতরের উঠানটা বিরাট, বাইরে খামারবাড়িটাও বেশ বড়। কয়েকটা ভারী কাঠের চেয়ার আনা হয়েছিল, মাঝখানে একটা টেবিল, তার ওপর একটা হ্যাজাক লাইট। চারিদিকটা উজ্জ্বল আলোয় ভরা – গ্রামোফোনে শানাই বাজছিল। মনে যা ছিল, তা ওইটুকুই, আর কিছু নয়। পরের দিন ফিরে আসার সময় কয়েকটি ফটো তোলা হয়েছিল মনে পড়ে। কয়েকটি কিশোরী, দু-একজন ভাবি আর আমরা মিলে ছবি তোলা হলো। ক্যামেরা ছিল জহরভাইয়ের ভগ্নিপতির। ছবি-টবি তুলে তিনি বললেন, আর একটি ফিল্মই রইল। কিশোরীদের মধ্যে সেই মেয়েটিও ছিল, যার নাম আজও জানি না। একটু বেঁটে আর মোটাসোটা, মুখটা সুশ্রী। আমার 888sport sign up bonusতে কোনো একটা জলময় জায়গায় ছোট্ট একটা লাল শালুকের মতো সে ফুটে আছে।
ভোঁতা গ্রাম থেকে যাওয়া হয়েছিল জানুর শ্বশুরবাড়ি জগদল গাঁয়ে। মনে হতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অতিকায় নিরেট পাথর। গাঁয়ে ঢোকার পরেই সেই পাথর বুকের ওপর চেপে বসে। সেখানে চার-পাঁচদিন কোনোরকমে কাটিয়ে ফিরে আসা গেল গাঁয়ে। জহরভাই এখন আর সঙ্গে নেই – তবে তাঁর ভগ্নিপতি আর বোন আমাদের সঙ্গেই থাকলেন। দু-একদিন পরে যখন তাঁদের নিজের গ্রামে ফেরা হলো, কী কারণে জানি না, আমিও ওঁদের সঙ্গে বর্ধমান পর্যন্ত গেলাম। ঘণ্টাখানেক পরেই তাঁদের ট্রেন। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে গিয়ে স্ত্রীকে একটা বেশ আরামের চেয়ারে বসিয়ে তিনি বললেন, ক্যামেরার ফিল্মগুলো ফটোগ্রাফির দোকানে দিয়ে আসতে হবে প্রিন্ট করার জন্যে। চলো, আজিজুল, তুমি আর আমি গিয়ে কাজটা করে আসি। স্ত্রীকে বললেন, তুমি চুপচাপ বসে থাকো। আধঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব।
স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশা নিয়ে আমরা গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রোড ধরে কার্জন গেট পেরিয়ে তেঁতুলতলা বাজার পেছনে রেখে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। প্রায় রাজবাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। সেখানে একটা ছোট ফটোগ্রাফির দোকানের সামনে রিকশা থামিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ক্যামেরাটা আনলোড করতে গিয়েই ভদ্রলোক বললেন, আর একটা ফিল্ম বাকি আছে। আজিজুল, তুমি আমার দিকে মুখ করে এই চেয়ারটায় বসো। তোমার একটা ছবি তুলে দিই। আমি বসলাম তাঁর মুখোমুখি, দোকানের মালিক খুটখাট করে নানা কাজ করছেন। আমি দোকানটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। জীর্ণ দশা, তিনদিকের দেয়ালে ছোট ছোট ফ্রেমে নানান ফটোগ্রাফ টাঙানো। আমার পেছনদিকে দেয়ালে একটা বছর তিনেকের শিশুর ছবি বাঁধানো রয়েছে দেখছি। ফটো তোলা হলো একটা। ক্যামেরাটা ‘আনলোড’ করে ফিল্ম দেওয়া হলো মালিকের কাছে। আমরা চলে এলাম।
দিন পনেরো পরে আমার কাছে একটা খাম এলো। তাড়াতাড়ি সেটা খুলে দেখি আমার ছবির দুটো প্রিন্ট। এই আমার জীবনের প্রথম ছবি। নিজেকে দেখছি বাইরে থেকে। এটা আয়নায় দেখা নয়। এটা একেবারে অন্য। বোবা একটি ছেলে, হাফপ্যান্ট আর ফুলশার্ট পরনে। জামার হাতাদুটো একটু গোটানো। তখনকার স্কুলছাত্রদের স্টাইল। আমার চুল ভালো করে আঁচড়ানো নেই। চোখদুটি একটু বিস্ফারিত। গাঁইয়া ছেলেরা যেমন করে তাকায় আর কি! এই অপর, অজানা, অচেনা এখনো আমার কাছে আছে। বারো-তেরো বছরের এই ছেলেটা একদিন ছিল। কাল তাকে ক্ষয় করতে পারেনি। তার বয়স বাড়েনি, বাড়বেও না কোনোদিন। মাথার ওপর সেই তিন বছরের শিশু একটুও বাড়েনি। কাল এখানে থমকে আছে। দোকানটার দশা কী হয়েছে জানি না – নিশ্চয়ই তার আর চিহ্নমাত্র নেই কিন্তু আমার কাছে রয়ে গেছে অনড় সেই বাস্তবটা।
কোথাও বেড়াতে গিয়ে এত একঘেয়ে আমার কখনো লাগেনি। সম্বল বলতে গোটা তিন-চার পঙ্কজ, হেমন্তের গান আর একটামাত্র ঘাসফুলের মৃদু কণ্ঠ। বাড়ি ফিরে এসেই শুনি বনমালী ব্যানার্জি স্কুল ছেড়ে গেছেন। এবার আর গাঁয়ের মানুষদের কূটচাল নয়, তিনি নিজেই রেজিগনেশন দিয়ে স্কুল ছেড়ে গিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে ভাইপো আনন্দদা ছাড়াও তিনি আরো দু-চারজন যে ভালো ছাত্র এনেছিলেন তারাও স্কুল ছেড়েছে। গাঁয়ের ভদ্রলোকদের ডেকে স্কুলের হিসেব-নিকেশ পাই পয়সা চুকিয়ে দিয়ে গেছেন। এই প্রথম আমাদের স্কুলের একজন হেডমাস্টার সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিলেন। গড়িয়ে-পড়া, সোনার চশমা, সোনার চেন পরা সেই যে বয়স্ক ছাত্রটি – আমাদের থাকহরিদাসহ – যে চারজন ছাত্র সকাল-বিকেলবেলার কোচিংয়ে বনমালীবাবুর কাছে বসে পড়ত, তাদের চারজনই এবার ম্যাট্রিক পাস করেছে। একেবারে সেন্ট পার্সেন্ট পাস। লাথি-খাওয়া, হুড়মুড়িয়ে পড়া থাকহরিদাও এজন্যে মহাখুশি। আর একটি কথা – বনমালীবাবু যাবার পর কিন্তু স্কুল হেডমাস্টারহীন হয়নি – দুই কি তিনদিনের মধ্যে ছোট একটা চামড়ার স্যুটকেস ঝুলিয়ে খাটো ধুতি মোটা পাঞ্জাবি পরনে হাজির হলেন নতুন হেডমাস্টারমশাই অজিত চক্রবর্তী। কালো ছোটখাটো চেহারার ইস্পাতের মতো কঠিন মানুষটি – আবেগ নিয়ে কথা বলতে গেলেই যাঁর দু-তিন দিন না-কাটা দাড়ি কাঁটা দিয়ে উঠত, চমৎকার বাংলা ভাষায় বক্তৃতা না দিয়ে তিনি থাকতে পারতেন না, তিনি এলেন কান্ডারি হয়ে। বাড়ি এসেই শুনলাম, তিনি ক্লাস নাইনের ছেলেদের নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নিয়েছেন। আমার খবরও নিয়েছেন। কে এই ছেলেটা, মুসলিম, ওর বাবা কী করেন, ক্লাসে উঠতে না উঠতেই পেখম মেলে উড়ে বেড়াতে শিখেছে – হবে না, হবে না, ওদের কিস্সু হবে না। গভমেন্ট ওদের জন্য যতই করুন, ওরা সেই চাষবাসেই থাকবে। ছোঁড়াটার একটু খবর নিন তো, এসেই যেন আমার সাথে দেখা করে। শুনে আমি আর একটুও দেরি না করে, স্নান-টান সেরে প্যান্ট আর শার্ট পরে তৈরি। আজ মাথায় একটু বেশি তেল দিয়েছি, চুল বেয়ে তেল পড়ছে। তারপর লম্বা টেরি কেটে স্কুলে গেলাম। অফিসে হেডমাস্টার নেই, মাস্টারমশাইরা কেউ নেই। শুনলাম স্কুলের উত্তর দিকের জায়গাটায় যেখানে প্রচুর গাছ আর ছায়া আছে – সেখানে সবাইকে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী যে মর্মান্তিক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ স্যার উপাধি ত্যাগ করেছিলেন – সেই ঘটনা আলোচনার জন্য। গুটি গুটি পায়ে আমিও সেদিকে এগিয়ে গেলাম। শতরঞ্চি-টতরঞ্চি পেতে ছাত্র-শিক্ষক সব এক জায়গায় বসেছেন। রোগা-পটকা কালো হেডমাস্টার মশাই – কিন্তু কী প্রকান্ড তাঁর গলার আওয়াজ – খুব তীব্র আর উঁচু তারে বাঁধা – তিনি কিছু বলতে শুরু করেছিলেন, আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কথা থামিয়ে তিনি আমার দিকে চাইলেন, তুমি আজিজুল।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ছিলে কোথায় এ কদিন? মামার বাড়ির আবদার পেয়েছ! ক্লাস নাইন-টেনের কোনো ছেলেকে আমি একদন্ড ছাড়ব না। কী করে এত ছাত্র ম্যাট্রিক ফেল করে? খুব কড়া গলায় কথা বলছেন তিনি – কিন্তু আমি দেখলাম তাঁর দু-চোখে মায়া। ওঁকে দেখেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। মনে হলো এই মানুষটা আমাকে খুব ভালোবাসবেন। যাই হোক, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা নিয়ে তিনি কথা বলতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ যে কারো কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে, নিজেই বড়লাটকে চিঠিটি লিখেছিলেন সেই ঐতিহাসিক চিঠিটিকে অজিতবাবু নিজের মনের রঙে রাঙিয়ে আমাদের মধ্যে আবেগের চোটে কাঁপতে থাকা, দাড়ি কাঁটা দিয়ে ওঠা গলায় নিজেই বক্তৃতা তৈরি করে বলতে শুরু করলেন, রবীন্দ্রনাথ বড়লাটকে জানালেন, ওহে ইংরেজ, তুমি এদেশে যা খুশি করবে আর আমরা চুপ করে সহ্য করব? কিছুতেই ভারতবাসী তা করবে না। তুমি এই দেশকে চিনতে পারোনি। এখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছে, এখানে মুনি-ঋষিরা বলে গিয়েছেন শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ, আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থু। আমরা সেই জ্যোতির্ময় পুরুষকে দেখেছি। এ তোমার বন্দুক-কামানের ব্যাপার নয়। ইংরেজ, তোমাকে সুড়সুড় করে এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। কোথায় রবীন্দ্রনাথের চিঠি আর কোথায় এই বক্তৃতা। কিন্তু হেডমাস্টারের বক্তৃতায় আমাদের বুক ফুলে উঠল। এইখানে আর কিছু নিয়ে কেউ কোনো কথা বলল না।
আমাদের স্কুলে হেডমাস্টারের কোনো কোয়ার্টার নেই। সেজন্যে আমরা একমাত্র শৈলজাবাবু ছাড়া আর কাউকে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে বাস করতে দেখিনি। শিবতলায় মহারানীর ভিটেতে এখনো থাকেন বটে সংস্কৃতের পন্ডিতমশাই। কাজেই অজিত চক্রবর্তী মশাইও তাঁর পরিবার নিয়ে এখানে বাস করতে পারেননি। রবিবারে রবিবারে বাড়িতে যেতেন। স্কুলের লাইব্রেরি ঘরটিকে ফাঁকা করে দেওয়া হলো, সেখানে বড় একটা খাট পেতে অজিতবাবু থাকতে শুরু করলেন। সে ঘরটা খুব মজার হয়ে গেল। আমরা যখন তখন তাঁর ঘরে যেতাম। তিনি গম্ভীর রাশভারী মানুষ ছিলেন না, সকলের সঙ্গেই কথা বলতেন। আর একটা কথা, তিনিই আমাদের স্কুলের প্রথম এম. এ. পাস হেডমাস্টার। তিনি বাংলা নিয়ে এম. এ. পাস করেছিলেন। সেজন্যে বেশ একটা অহংকার ছিল তাঁর। আমি বাংলায় ভালো বলে তিনি আমার সঙ্গে খুব কথা বলতেন। অনেক লেখকের নাম করতেন, যাঁদের নাম জীবনে শুনিনি। একালের বড় লেখকদের নাম জানতে হবে। 888sport live football না পড়লে কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকবি। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী মহাস্থবিরের নাম শুনেছিস, তারাশঙ্কর বলে কোনো লেখকের নাম জানিস। জীবনে প্রথম এইসব নাম শুনলাম। ওঁর ঘরে গেলেই কেমন একটা খোলা হাওয়া। বাইরের দুনিয়ার নানা খবর জানতে পারতাম। রুশ বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, স্বদেশী আন্দোলন, কত কী নিয়ে যে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। সে-সবই জীবনে প্রথম শোনা। আয়ারল্যান্ডের ডি. ভ্যালেরার কথা বলতে বলতে তাঁর গলার রগ ফুলে উঠত, তিন-চারদিনের না-কাটা দাড়ি কাঁটা দিয়ে উঠত।
একবার একটা বড় এক্সারসাইজ খাতার কথা বলেছিলেন। সেটা কেউ জোগাড় করে দিলে একটা 888sport alternative link লিখবেন। তাঁকে কোনোদিনই লিখতে দেখিনি। মাঝে মাঝে উপুড় হয়ে শুয়ে বলতেন, পা-দুটো একটু টিপে দে তো। একটা কটকটে ব্যথা হচ্ছে। আমার শরীরে তখন অনেক শক্তি, তবে শক্তি যতটা বা আছে, বিশ্বাস আছে আরও অনেক বেশি। তখন আমি কুস্তি শিখছিলাম, পাঞ্জা লড়তাম। পাঞ্জা লড়ায় আমার তখন খুব খাতির – একবার আমি একজনের সঙ্গে এক ঘণ্টা ধরে পাঞ্জা লড়েছিলাম। মাঝে মাঝে একটু থামি – সে-ও জোর দেয় না, আমিও না। একটু হাঁফ ছেড়ে নেওয়া আর কি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হারটা আমাকেই স্বীকার করতে হলো। আস্তে আস্তে নুইয়ে এলো আমার হাত। সেই সময় শেখা একটা কুস্তির প্যাঁচ যার-তার ওপর খাটাতাম। আমার চেয়ে অনেক বেশি বলবান কাউকে বলতাম, পেছন থেকে আমাকে ভালুকের মতো জড়িয়ে ধরতে। সে যখন আমাকে পিষে ধরেছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে – সেই সময় হঠাৎ সামনের দিকে হেঁট হয়ে আমার পা দুটোর মধ্যে যেখানে তার পা দুটো রয়েছে তার সেই পা দুটো দুই হাতে ধরে হ্যাঁচকা একটা টান দিতাম, যত বলবান হোক, সে আচমকা একেবারে চিৎ হয়ে পড়ে যেত। এই প্যাঁচটা আমি কাউকেই শেখাতাম না। পেয়েছিলাম আমার ছোটমামুর কাছ থেকে।
অজিতবাবু আমাকে পা টিপে দিতে বললেই আমি একেবারে তৈরি। তাঁর কালো সরু সরু ঠ্যাং দুটো দেখলেই মনে হতো এখুনি মট করে ভেঙে দিতে পারি। বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ সহজ হয়ে এলে খোলা খামারে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে তাঁর পা টিপে দিতে বলতেন। তাঁরও সরু সরু বাঁশের মতো পা-দুটি। গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো পা টিপতাম, তারাভরা কালো আকাশের দিকে চেয়ে কী যে ভাবতাম জানি না। অন্ধকারটা তরল, মনে কি হতো যে বেঁচে থাকাটা বড় ভালো? আমি মানুষ, মানুষ ছাড়া অন্য কেউ আর কি ভাবতে পারে যে বেঁচে থাকাটা খুব ভালো? আকাশের দিকে চেয়ে মনে হতো যে আকাশের মতোই অনন্ত জীবন আমার। কত কী ঘটবে এই জীবনে? শেষ আর হবে না।
অজিত মাস্টারমশাইয়ের একটা পা ধরে মোচড় দিতেই তিনি আরামের সঙ্গে বলতেন, আঃ, প্রতিভা যা স্পর্শ করে তাই সোনা হয়ে যায়। এই কথাটা শুনলেই খুব আনন্দ হতো আমার।
শরৎ হেমন্তের দিকে গড়াচ্ছে তখন, মাঠে গেলে পাকা আউশ ধানের গন্ধ পাওয়া যায়। কী একটা সাদা ফুল ঠিক সন্ধেবেলায় ফুটে অন্ধকার ভরে দিয়ে সুগন্ধ ছড়ায়। ঠিক এরকম সময়েই দুলাভাই এলেন বাড়িতে। আমি তখন তাঁকে নতুন হেডমাস্টারের কাহিনি শোনাই সাতকাহন করে। তিনি বললেন, একদিন আলাপ করতে হবে ভদ্রলোকের সঙ্গে। সন্ধের মুখে একদিন আমি আর দুলাভাই স্কুলের দিকে যাচ্ছি, গাবাকাটাদের ঘাটটা পার হচ্ছি, দেখি অজিত মাস্টারমশাই আসছেন বোর্ডিংয়ের দিকে। সঙ্গে আসছে তিন-চারটে ছেলে। দুজনে মুখোমুখি হতেই দুলাভাই কষ্ট করে একটু হেসে লম্বা একটা ইংরেজি বাক্য বলতে শুরু করলেন। সে ইংরেজিটা আমি বুঝিনি, মনে হলো কথাটা বোধহয় এই যে, আপনার মতো একজন বিশিষ্ট ভদ্রমহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করার জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছি। উত্তরে প্রায় একইরকম একটা বাক্য উচ্চারণ করলেন হেডমাস্টারমশাই। শুধু ‘আই’ বলার পরে একটা ‘অলসো’ ব্যবহার করে গড়গড় করে বিরাট একটা বাক্য আউড়িয়ে গেলেন। তারপর দুজনই বললেন, ‘সি ইউ’। ওঁরা পেরিয়ে যেতেই দুলাভাই বললেন ইংরেজিটা ভালোই বললেন, মুখস্থ করাই আছে, শুধু একটা গ্র্যামাটিক্যাল ভুল করে ফেলেছেন।
এর পরে গাঁয়ের লোকজন দুই ভাগ হয়ে গেল। কে বেশি জানে? হেডমাস্টার না জামাইবাবু। তিনি ইংরেজিতে এম. এ. পাস, হেডমাস্টারমশাই হাজার হলেও বাংলায় এম. এ.। দেখা যাচ্ছে দুলাভাইয়ের দিকেই দলভারি। স্কুলের ছেলেরা তো হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমাদের বাড়িতে সকালে, বিকেলে, সন্ধেয়। এমনকি
দু-একজন হিন্দু চাষিও এসে পড়ে সন্ধ্যার দিকে। বাবার সব নিষেধ উঠে গেছে। চন্দ্রগুপ্ত, মীর কাশিম প্লে দুটোই বাজাই ওরা শুনতে চাইলে। কত কি মন্তব্যই যে তারা করে! ওই তো মীর জাফর, ওই তো দায়ী সব সর্বনাশের জন্যে! ইংরেজ এসে দেশের সবকিছু নিয়ে গেল গো। বাংলার মাটি শেষ। এদিকে তেলার ভাই হেলা খুব ঝুঁকে পড়েছে দুলাভাইয়ের দিকে। দেখা যাচ্ছে শোবার ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে দুলাভাই পড়ছেন ঢাউস একটা 888sport alternative link। সেই 888sport alternative linkের নাম লা-মিজারেবল, ইংরেজি 888sport app download apk latest versionে মূল গোটা একটা সংস্করণ। বালিশের পাশে বইটা খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। বইয়ের দিকে চোখদুটো নামানো, দুলাভাইকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুমন্ত। বড় বড় চোখ নামানো তো, দেখা যাচ্ছে তাঁর জোড়াভুরু – বড়ো বড়ো চোখের পাপড়িগুলো বাঁকা আর লম্বা। ঠিক যেন ধ্যান করছেন। জানালা দিয়ে আমরা দেখছি। তাদের তো সম্ভ্রমের অবধি নেই। তবে বাইরে গেলেই নেশাটা একটু কেটে যায় – শ্রীকুমারদা গান বাঁধেন – মাজেম আলী খাঁ, হেলা ধোয় পা। মাজেম আলীর মাথা – হেলা ধরে ছাতা। উত্ত্যক্ত হেলা নানারকমে আপত্তি করে কিন্তু সবাই তাকে খেপিয়ে মারে। ছেলেটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আচ্ছা, অত বড় 888sport alternative link – শেষ করতে লাগবে কতদিন? দুলাভাই বলেছিলেন, এই 888sport alternative linkে পৃথিবীর সমস্ত 888sport alternative linkের মধ্যে বৃহত্তম একটি বাক্য আছে। একদিন তিনি আমাকে দেখিয়েও ছিলেন। বোধহয় আড়াই পৃষ্ঠাজুড়ে সেই বাক্যটা। একটা রাজসভার বর্ণনা বা ওইরকম কিছু। অত বড় বাক্য বুঝতে তো পারিনি।
একদিন দুলাভাইয়ের সামনেই বাবা আমাকে বললেন, তোদের হেডমাস্টারকে বলিস একদিন সন্ধেয় আমাদের বাড়িতে চা খেতে। ওরে বাবা, একে তো চক্কোবর্তী বামুন, তারপরে আবার মুসলমানদের বাড়িতে চা খেতে আসা! সারা গাঁয়ে তো ঢিঢি পড়ে যাবে। এসব বাছাবাছি তখন খুব চলত। ছোঁয়াছুঁয়ি একদম মানা। বাড়ি এসে খাবার তো কথাই ওঠে না। আমাদের বাড়িতে কোনো হিন্দু অতিথি এলে তার খাবারের ব্যবস্থা হতো কোনো হিন্দুর বাড়িতে – নন্দীদের বাড়ি বা ননুকাকার বাড়ি। তেমনি ওদের কোনো মুসলমান হাকিম বা পুলিশ-টুলিশ এলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো আমাদের বাড়িতে। দুলাভাই কিন্তু সহজ গলাতেই বললেন, তা বলে দ্যাখো না, চা-ই খাবে, অন্নগ্রহণ করতে তো হচ্ছে না। হেডমাস্টারের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আমার ভয় হতো না। একদিন মরিয়া হয়েই বলে ফেললাম চা খেতে আমাদের বাড়িতে আসতে। কথাটা শুনেই একটু থমকে গেলেন হেডমাস্টারমশাই। একে তো গাঁয়ের স্কুলের হেডমাস্টার, তার ওপর চক্কোবর্তী বামুন, এই গাঁ-টিও তাঁর নিজের গাঁ নয় – কে যে কীভাবে নেবে কথাটা তিনি আন্দাজ করতে পারছেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যাব আমি তোমাদের বাড়িতে একদিন সন্ধেবেলায়।
দু-তিনদিন পরে একদিন সন্ধেবেলায় তাঁকে নিয়ে এলাম আমাদের বাড়িতে। কাচা ধুতি আর ফুলশার্ট পরেছেন তিনি। মুখ-অাঁধারি রাত হতে তিনি আমার সঙ্গে বাড়িতে এলেন। বাবা নিগণ থেকে সেদিন আনিয়েছিলেন খুব ভালো সন্দেশ আর বড় বড় রাজভোগ। মাকে বলা হলো কয়েকটা লুচি বানাতে। বাড়িতে বরাবরই ভালো দার্জিলিং চা খাওয়া হয়। সেদিন লিপটন চায়ের একটা নতুন প্যাকেট খোলা হলো। বেশ সন্তর্পণেই বাড়িতে ঢুকলেন মাস্টারমশাই। বাড়িতে আমাদের বিরাট উঠোন – কোথাও একটি শুকনো খড় বা পাতা পড়ে নেই। পেয়ারা আর লেবুর গাছ আছে বাড়ির দুই কোণে। দক্ষিণমুখো চওড়া বড় বারান্দাটা বাঁধানো। সূর্যের আলো তো আসতই, সে তেমন খেয়াল করতাম না তবে চাঁদের আলোয় পুরো বারান্দাটা চকচক করত – অন্তত আকাশে চাঁদ থাকত যতক্ষণ ততক্ষণই ওই ভরা জ্যোৎস্না। আমি ঘুমোতে যেতে পারতাম না।
বসার ব্যবস্থাটা বারান্দায় করলেই বোধহয় ভালো হতো। তা করা হয়নি, যে কেউ যখন তখন এসে পড়তে পারে এই ভয়ে। ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঘরের মধ্যে একটা টেবিল পেতে, ধবধবে শাদা টেবিল ক্লথে ঢেকে। দু-তিনটে চেয়ার ছিল, পেতে দেওয়া হলো। জানু বাড়িতেই ছিল, পরিবেশনের ভার তার ওপরেই। দামি পুরনো চীনামাটির থালা-বাসন সবই ছিল বাড়িতে। একটা বাটি ছিল, সরু সরু চিড় পড়ে গিয়েছিল সারা বাটিটাতে। ওটার বয়স নাকি একশ বছর হবে। এরকম খাওয়ার আয়োজন হলে কাঁসার পাত্র একদমই ব্যবহার হতো না। গ্লাসগুলো ঝকঝকে বিদেশি কাচের। মোট কথা, আমাদের বাড়ির মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এক ননু কাকা আর হেরম্ববাবুর বাড়ি ছাড়া গাঁয়ের কারো ছিল না। অজিতবাবু একটা চেয়ারে বসলেন, মুখোমুখি বসলেন দুলাভাই। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, কোনো অস্বস্তি বোধ করছেন না তো? একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। অজিতবাবু বললেন, যেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আছে সেখানে ঈশ্বর বিরাজ করেন। আপনারা আমাকে যা খেতে দেবেন তা আমি অমৃতজ্ঞানে খাব।
ঘরে আলো একটু কম দেওয়া হয়েছে, হারিকেন জ্বালানো হয়নি। বাবার একটা পিতলের ভারি সুন্দর টেবিল ল্যাম্প ছিল। তার আলোটা মোমের মতো নরম। জানু চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকল। আমাদের একটি গোল বড় ঘন নীল রঙের ট্রে ছিল। আসলে ট্রে নয়, বিশাল একটা নীল রঙের থালার মতো। আমরা খাঞ্চা বলতাম। তার উপরে গোটাকতক খালি হাফ প্লেট গুছিয়ে রাখা, পাশে বড় একটা প্লেটে চার-পাঁচখানা ফুলকো লুচি, গরম গরম দেবার জন্যে বেশি আনা হয়নি। মা আরো ভাজছে। পরে দরকার মতো আনা হবে। সঙ্গে পাতলা করে আলু ভাজা – সেটাও মনে হয় ঘিয়ে ছাঁকা। আর একপাশে নিগণ থেকে আনানো সন্দেশ। পাঁচ-সাতটা বড় রাজভোগ। চা পরে আনা হবে। মাস্টারমশাই বসে গেলেন। তিনি অন্তত দুলাভাইকে না নিয়ে বসবেন না। খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন মাস্টার মশাই। মনে হয় রাতের খাবার তাঁর হয়ে গেল। চা এলো আলাদা করে। চা-টা কাপে কাপে নিজে ঢাললেন বাবা। দার্জিলিং চায়ের সুগন্ধে ঘরটা ভরে গেল। তিনি চিনি একটু নিলেন, কিন্তু দুধ দিতে বারণ করলেন।
ঘণ্টাদুয়েক ছিলেন মাস্টারমশাই। আমাদের বাড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা গাঁয়ের লোকে জানলেও এমন একজন চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ এই বাড়িতে মিষ্টিমুখ করেছে শুধু নয়, রাতের খাওয়াটাও সেরে নিয়েছেন, সেই উনিশশো পঞ্চাশের দশকে এটা কম সাহসের ব্যাপার ছিল না। ছুতমার্গ কম ছিল না তখন। হাড়ে-মজ্জায় শক্ত গেরো। অন্ধকার একটা জায়গায় কোনো আলো ঢোকার উপায় ছিল না। কোনো হিন্দু 888sport promo codeকেই ছোঁয়া যেত না, তাঁরা বাড়িতে যেসব শাড়ি কাপড় শুকুতে দিতেন সেগুলোও ছুঁয়ে ফেলা যেত না। হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার নয় – সারা গাঁয়েই এরকম। অশিক্ষিত, গন্ডমূর্খ, নোংরা বামুনদেরও ছুঁতে পারত না হাড়ি-ডোম-মুচি। এমনকি শূদ্রবাড়ির বৈঠকখানায় নানা জাতের মানুষের জন্যে সারে সারে হুঁকো রাখা হতো। হুঁকোর অভাব হলে কল্কে খুলে হাতে দেওয়া হতো নিচু শ্রেণির মানুষকে। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ কিছুই মনে করত না। যেন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বাবা এত মান্যগণ্য মানুষ কিন্তু তিনিও এর বাইরে নন।
জানু একটা কালোপাড় শাদা তাঁতের শাড়ি পরে এসেছিল। হেডমাস্টারমশাই তাকে দেখেই বলেছিলেন, তোমাকে তো দিদি বলা যাবে না, মিসেস মাজেমও না। তোমাকে নাম ধরেই ডাকব। তুমিও তো একসময় আমার স্কুলের ছাত্রী ছিলে! হ্যাঁ, তা ছিলাম, তবে গাঁয়ের আর কোনো মেয়ে ছিল না। তোমাদের গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে কারো সঙ্গে তোমাদের কোনো তুলনা চলে না। আমরা বাংলার ইতিহাস জানি না।
বেদ-উপনিষদ, আর্য-অনার্য এইসব অনর্থক তর্ক! তোমরা মুসলমানরা যে আটশো বছর ভারত শাসন করেছিলে সে কি এমনি এমনি? আজ এই গাঁয়ের মুসলমানদের দিকে তাকানো যায় না। ইংরেজ আসার সঙ্গে সঙ্গে সহজেই বশ-মানা হিন্দুরা ইংরেজি-টিংরেজি কিছু শিখে নিয়েছিল – এখন করে খাচ্ছে। নিচু চোখে মুসলমানকে দেখার দিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা তো জানি তোমাদের সভ্যতা কত বড়, ঐতিহ্য কত বড় – ইতিহাসে কোথায় তোমাদের জায়গা! মুসলমানরা এখন সেসব ভুলে গিয়ে অশিক্ষা আর মূর্খতার গর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে।
অজিতবাবুর যে একটু বক্তৃতা দেবার ঝোঁক, তা আমি জানি। আমি দেখতে পাচ্ছি তাঁর গলার রগ ফুলে আসছে, দু-গালের দাড়ি কাঁটা দিয়ে উঠছে।
বাবা বললেন, আবার একবার আসবেন।
যখুনি ডাকবেন তখুনি আসব। মি. মাজেম, এখন আমি উঠব।
পরের দিন দারুণ উৎসাহ নিয়ে বারান্দার মিহি মোলায়েম রোদে বসে বোর্ডের বইগুলি দেখছি। আমি এখন একা এই বইগুলোর মালিক। শহীদুল ক্লাস এইটে ফেল করে স্কুলে আসছে না। একধরনের চাম-কাগজ জোগাড় করে বইগুলোর মলাট দিয়েছি। কিন্তু এখন সে বইগুলো মলাট খুলে একবার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। মলাট খোলা বইগুলোর ওপর হাত বোলাচ্ছি ঠিক যেন কাশ্মীরি চাদর আলতো করে স্পর্শ করছি। এখানে ইংরেজি টেক্সট রয়েছে, বাংলা টেক্সট রয়েছে। সংস্কৃতের একটা টেক্সটও রয়েছে, র্যাপিড রিডার ‘পালামৌ’ রয়েছে – নোট এখনো বেশি কেনা হয়নি, আমি ঠিক করেছি এস. ব্যানার্জির নোটই নেব, এম. সেন নয়।
এইসময় দুলাভাই এসে বসলেন শীতলপাটির ওপর, দেখি, এবারের বইগুলি। আমি তখন ইংরেজি বইটা খুলেছি। প্রথমেই প্যারাবল অব দি গুড সামারিটান, তারপরেই প্যারাবল অব দি গুড শোয়ার। প্যারাবল শব্দটা নিয়ে গোলমাল বাধল। এ শব্দটা তো আগে শুনিনি। তারপর পড়ে দেখছি, মোটামুটি বোঝা যায়। ইংরেজি ভাষার মূল চাবিকাঠিটি আমি পেয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমার শব্দের ভান্ডার একদম খালি। ইংরেজি ভাষা তো পড়িইনি এতদিন – শব্দের ঘাটতির জন্যে ইংরেজি এক একটা বাক্য বুঝি আবার বুঝি না। বাক্যের গঠনটা বুঝতে পারি, খোঁজো খোঁজো, সমাপিকা
ক্রিয়া-টা খোঁজো, বাক্যের অংশে হুম হুইচ হু যাই থাকুক না কেন, তার মধ্যে সমাপিকা ক্রিয়া থাকলেও কিছু এসে যায় না, খুঁজতে হবে মূল সমাপিকা ক্রিয়াটা। অ্যাকটিভ প্যাসিভ একরকম বোঝা যাবে। প্রিপজিশনের পাশে প্রিপজিশন দিয়ে তার মানে-টানে বদলালেও, সাঁটে একরকম বুঝে নেওয়া চলে।
আমি জিজ্ঞেস করার আগেই দুলাভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘প্যারাবল’ মানে কী? স্বীকার করতে হলো জানি না। ‘প্যারাবল’ মানে হচ্ছে ছোট্ট একটা উপদেশ দেওয়া গল্প। বাইবেলের গল্প, অত সহজ ইংরেজিতে আর কিছুই লেখা নেই। ভবিষ্যতে এইরকম ভাষাই লেখার চেষ্টা করবে। ভাষাকে কঠিন করলেই সব মাটি। গল্পটা এখন মনোযোগ দিয়ে পড়ো তো দেখি। দু-একটা শব্দের মানে না বুঝতে পারলেও ক্ষতি নেই। পড়লাম, গল্প হচ্ছে মোটামুটি এই : পথের পাশে এক মরণাপন্ন রোগী কাতরাচ্ছিল যন্ত্রণায়। একজন গেল তার পাশ দিয়ে, সে চেয়েও দেখল না তার দিকে। তারপর আরো একজন এলো, একবার রোগীটির দিকে তাকালও কিন্তু সে থামল না, চলে গেল। তারপর এলো একজন সমরিয়াবাসী – সামারিটান। সে রোগীটির কাছে এসে দাঁড়াল, তার সঙ্গে দু-একটা কথাও বলল, তারপর সে নিজে কাঁধে করে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। বাড়ি গিয়ে সেবা-শুশ্রূষা করে শেষ পর্যন্ত সারিয়ে তুলল। সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে তার নিজের বাড়ি যাবার আগে বিদায় জানাল। এই হলো গুড সামারিটান। এর মূল উপদেশটি হলো : মানুষের বিপদ উপস্থিত হলে তার পাশে দাঁড়াও, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও। অন্য প্যারাবলটাও খুব ভালো। এক কৃষক পাথরের ওপর বীজ ছড়াল, একটা চারাও বেরোল না সেখান থেকে। তারপর সেই কৃষক কাঁটাবনে বীজ ছড়াল, সেখানে গাছ বেরোল বটে – কিন্তু কাঁটাজঙ্গলে তারা বাড়তে পারল না, শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে ভালো ফসল পাওয়া গেল না। তৃতীয়বারে কৃষকটা বীজ ছড়িয়ে দিলো একটা চাষ করে তৈরি করা জমিতে। এবার ঠিকমতো চারা গজাল – শেষ পর্যন্ত কৃষক সেখান থেকে ভালো ফসল পেল। মোটামুটি এইরকম গল্পটা। লেখার তলায় লেখা আছে, অ্যাজ ইউ সো, সো ইউ রিপ। ‘রিপ’ কথাটার মানেটা দেখে নিলাম। উপদেশটাও ভালো করে বুঝতে পারলাম। দুলাভাই একটু সাহায্য করলেন।
মনে হয়, ভাষা বোঝার একটা ক্ষমতা ছিল আমার। বাংলায় আমি সেই পাঠশালা থেকে ফার্স্ট হই। দুর্গাশঙ্করবাবু এইজন্যে আমাকে খুব ভালোবাসতেন। একবার সরস্বতী পুজোয় কী কী লাগবে তার তালিকা প্রত্যেকবারের মতো এবারও দুর্গাশঙ্করবাবু লিখেছেন। খুঁটিনাটি প্রায় সব লিখেছেন, শুধু বাসক ফুলের ভালো নাম ‘দ্রোণ’ লিখতে ভুলে গিয়েছেন। আমি পাশেই ছিলাম। মনে করিয়ে দিলাম, মাস্টারমশাই ‘দ্রোণ’ পুষ্প যে বাদ পড়ল। তাই তো রে – তিনি তালিকার সব শেষে লিখলেন ‘দ্রোণ’, আর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আগের জন্মে ঠিক ‘বামুন’ ছিলি, শাপভ্রষ্ট হয়ে এবার মুসলমান হয়ে জন্মেছিস। আমি অবাক হয়ে বললাম, তা কি খুব খারাপ হয়েছে মাস্টারমশাই? তিনি এই কথায় সামান্য একটু লজ্জা পেলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
আপনাআপনি বাংলা ভালো শিখতে পেরেছিলাম বলেই ইংরেজিটা এত তাড়াতাড়ি সড়োগড়ো হয়ে গেল। আমাদের সিলেকশনে প্যারাবল দুটোর পরেই চার্লস কিংলেকের মরুভূমিতে রাত-সংক্রান্ত একটা লেখা ছিল। তাঁর ইংরেজিটা অনেক কঠিন, প্রচুর শব্দের মানে জানি না, দু-একটা বাক্য এমন জটিল যে সেগুলিকে কিছুতেই সিধে করতে পারি না। তবে রাতের মরুভূমির এমন একটা বর্ণনা ছিল যে মনে হয়েছিল, জীবনে অন্তত একটা রাত মরুভূমিতে কাটাতে হবে। অন্য একটা গদ্য ছিল – সেই অ্যারিএডনি মিনোটারের গল্পটা। পারসিউসের হাতে একটা সুতোর বান্ডিল দিয়েছিল অ্যারিএডনি। গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে মিনোটারের সঙ্গে লড়াই করে তাকে হত্যা করার পর সুতোর খেই ধরে পারসিউস ফিরে এসে অ্যারিএডনিকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে করে পালিয়ে এলো।
রবার্ট লিন্ড-এর গদ্যের নাম ‘অন ফরগেটিং’। কী কী বিষয় মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় তাই নিয়ে ভারি সুন্দর একটা লেখা। একটা হলো চিঠি লেটার বাক্সে ফেলতে ভুলে যাওয়া। চিঠিটা পোস্ট করার জন্যেই কোর্টের পকেটে চিঠিটা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল – তারপর প্রথম লেটার বাক্সোটা পেরিয়ে যাওয়ার পরেই চিঠিটার কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক আছে, এর পরের লেটার বাক্সে নিশ্চয়ই ফেলব। আবার একই ঘটনা ঘটল। লেটার বাক্সো দেখার পরেই ভুলে যাওয়া আর মাঝপথে এসেই মনে পড়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত চিঠিটা পকেটে নিয়েই বাড়ি ফিরে আসা। কিংবা ওষুধ খেতে ভুলে যাওয়া। লিন্ড আশ্চর্য মানছেন যে ওষুধ খেতে ভুল হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। বেশির ভাগ ওষুধ খেতে হয় খাওয়ার আগে কিংবা পরে – এটুকু মনে না পড়ার তো কোনো কারণই নেই। অথচ এই ভুলটা সবার বেলাই ঘটে। এই 888sport liveের শেষে আছে একটা চমৎকার কল্পকাহিনি। এই কল্পকাহিনির ফাঁদে পড়ে অনেকে – বিশেষ করে যারা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। সারাদিন কোনো একটা গাছের আড়ালে ছিপ ফেলে একাগ্র হয়ে বসে আছে একটা মানুষ। প্রতি মুহূর্তে ভাবছে, এইবার ফাতনাটা নড়ে উঠবে। বড়শির কাঁপন থেকেই বোঝা যাবে কী মাছ এসেছে টোপ গিলতে, সেটা পাঁচ সের, না দশ সের। কল্পনায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে ছিপওয়ালা মানুষটা। ফাতনাটা আধা ডুবতেই ব্যস, দারুণ একটা টান – এই প্রথম টানটা সামাল দেওয়া কঠিন। করকর শব্দে সুতো বেরিয়ে যাচ্ছে – যাক যতদূর যেতে পারে, আটকানোর দরকার নেই। হয়তো মাঝপুকুরে চলে গেল, এটাই তার মরণ টান। উল্টোদিকে হুইল ঘুরছেই। মাঝামাঝি গিয়ে সে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তখন শুরু হয়ে গেল ইঁদুর-বেড়ালের খেলা। মাছ দৌড়ায়, ক্লান্ত হয়, একবার থামে, তারপর আবার টান – বড়শিটা যেন মুখ থেকে ফস্কে না যায়। শেষ পর্যন্ত, ঘণ্টাখানেক ধরে এই খেলার শেষে হয়তো দেখা গেল সে এসেছে, মরার মতো ক্লান্ত, তখন একটা গোল-জাল দিয়ে তাকে পুকুর থেকে তুলে নেওয়া – উঃ, তারপর সেকি তার পুচ্ছতাড়না!
যে লোকটির ছিপের ফাতনায় সারাদিন একটি কাঁপন ওঠে নাই – নিশ্চল হয়ে আছে পৃথিবী, গাছের পাতাটি পর্যন্ত কাঁপছে না, দুপুরের রোদ ম্লান হয়ে এসেছে, তারপর শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা নেমে এলো। আর বসে থেকে লাভ নেই – লোকটা শান্ত মনে, আগামীকাল আবার আসবে ভেবে ছিপ বড়শি, হুইল গুছিয়ে মাছের সুগন্ধি চারগুলিকে নিয়ে উঠেছে বাড়ি ফিরবে বলে। ট্রেনটা নির্বিকার দৌড়ুচ্ছে আর লোকটিকে দিবাস্বপ্নে পেয়ে বসেছে। সে ভাবছে পুকুরের সবচেয়ে বড় মাছটা বড়শি গিলেছে, লড়াই শেষ করে সে কাছে এসে পড়ছে – এইবার পাড়ে উঠল বলে। দিবাস্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে সে নিজের স্টেশনে নামল, ট্রেনেই রয়ে গেল ছিপ, সুতো, হুইল, মাছ ধরার সব সাজ-সরঞ্জাম। এরাই হলো জাত-ভুলিয়ে মানুষ। লিল্ড-এর এই 888sport live আমি ভুলতে পারি না। হিলেআরি বেলকের ফ্রেঞ্চ রিভোলিউশন থেকে মেরি অাঁতোয়াৎ নামে একটা 888sport live ছিল। তার ভাষা কঠিন, বজ্র অাঁটুনিতে বাঁধা – কিন্তু কী যে সুন্দর সেই ভাষা। সপ্তদশ লুই আর মেরি অাঁতোয়াৎ দুজনেরই গিলোটিন হবে। প্রজাদের রুটি কেনারও সঙ্গতি নেই শুনে রানী নাকি বলেছিলেন, রুটি মেলে না তো কেক খেলেই পারে ওরা। এই লেখার শেষ হচ্ছে রাজা-রানী দুজনকেই গিলোটিনের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে – তারপর শেষ লাইন, ‘নাউ দি ব্লেড ফল্স’।
নাইন-টেনের নেহাত পাঠ্যবই থেকে এইসব আমি পেয়েছিলাম। বিখ্যাত শিকারি জিম করবেটের কাহিনির একটা অংশ, ‘দি ম্যান ইটার অব কুমায়ুন’। একই গুহার মধ্যে ঘুমন্ত চিতাবাঘের সামনে দাঁড়িয়ে রাইফেলটাকে এক যুগ ধরে ঘোরাচ্ছেন করবেট – রাইফেলটাকে বাঘের দিকে তাক করতে তাঁকে প্রায় পূর্ণ বৃত্ত ঘোরাতে হবে। কতক্ষণ লাগল এই কাজটা করতে – অনন্তকাল – পড়তে পড়তেই অনন্তের অনুভব ঘটে যায়। বাঘিনী মানুষের অনেক ক্ষতি করেছে – প্রায় দেড়শ মানুষ মেরেছে। শাস্তি তাকে পেতেই হবে। শেষ পর্যন্ত কুমায়ুনের এই মানুষখেকো করবেটের হাতেই মারা পড়ে। জিম করবেটের লেখা আমি আজও পড়ি – মাই ইন্ডিয়া পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল জাঙ্গল লোর বইটা। 888sport app download apkর মতোই স্নিগ্ধ সুন্দর।
সিলেকশনের 888sport app download apkগুলি কী ছিল একটু বলি। রবার্ট হেরিকের 888sport app download apk ছিল ‘টু এ ড্যাফোডিল’, জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে একটা আশ্চর্য দার্শনিক পর্যবেক্ষণ। তারপরেই ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘দি ড্যাফোডিল’ আর ‘সলিটারি রিপার’। পৃথিবী রুক্ষ ধূসর আর রসকষহীন হয়ে যাওয়ার ফলে এই 888sport app download apkগুলো আজকের পৃথিবীতে কি ভালো লাগবে না? ‘উই আর সেভেন’-এর মতো 888sport app download apk? বা ‘ওড টু অ্যান অটামন’ বা ‘টু এ স্কাইলার্ক’ বা ‘হোম দে ব্রট হার
ওয়ারিয়র ডেড’?
ওইদিন সকালবেলায় দুলাভাইয়ের সামনে বসেই কি আমি এসব দেখে নিয়েছিলাম? মোটেই না। কালোগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম, শুধু দেখছি আলো আসছে, ছোট্ট একটা রন্ধ্র দিয়ে। মোটকথা, পৃথিবীটা দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল। বাস করার জগৎ আর বইয়ের জগৎ। সেই বোধহয় শুরু হয়ে গেল দুই জগতের মধ্যে লুকোচুরি খেলা। তাতে অনেক আঘাত আছে, রক্তক্ষরণ আছে, প্রবল ভয়ানক আনন্দও আছে। কেবলই আপস করতে হয়। দুই জগৎকেই এক জায়গায় আনতে হয়।
গাঁয়ের ছেলেরা আমার এত তাড়াতাড়ি ইংরেজিটা মোটামুটি শিখে ফেলায় ভীষণ অবাক হয়ে গেল। তখনকার দিনে ইংরেজিটা ছেলেদের কাছে বিভীষিকা। অঙ্ক অতটা নয়। আইজুল যে ইংরেজি আর অঙ্কে এত কাঁচা ছিল সে অত তাড়াতাড়ি শিখে ফেলল! এ কি ম্যাজিক নাকি। কোথা থেকে তার জামাইবাবু এলেন, মন্ত্রগুপ্তির মতো আইজুলের কানে কানে কিছু জানিয়ে দিলেন আর অমনি সে গড়গড় করে ইংরেজি বলতে লিখতে শিখে গেল? প্রত্যেকের ইচ্ছে হতো দুলাভাইয়ের কাছে গিয়ে একটু তাকতুক শিখে আসুক। কিন্তু সে হবে কী করে? তিনি তো আর ছেলেদের নিয়ে পড়াতে বসতে পারেন না। সেজন্যে তাঁকে মাথার মণি করে রেখে আমাকে ধরে বসল, তাহলে তুই আমাদের শেখা। আমরা মাসে দশটা করে টাকা তোকে দেব। পড়া না রে! ব্যস, আমি হয়ে গেলাম আমার সমবয়সী বন্ধুদের শিক্ষক। এমনকি ক্লাস টেনের একটা ছেলেও আমার কাছে ধর্না দিয়ে পড়ল। পড়া না বাবা! এমন করছিস কেন। দেখা গেল এককড়ি, গোপেশ্বর, মানিক মোদক, আগুড়িদের ছেলে সত্যনারায়ণ, হেলা আমার ছাত্র হয়ে গেল। ওদের কাছ থেকে কি টাকা নেওয়া যায়? এককড়ি, গোপেশ্বরকে একরকম বোঝানো গেল – টাকা ফাকা দিতে যাস না কিন্তু। তবে দুই ক্লাসের নিচের ছাত্র সত্যনারায়ণ আর খোঁড়া মানিককে কিছুতেই বোঝানো গেল না। সমরেশ আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সে আমার ছাত্র হবে না তো হবে কে? তার বাবা ধনঞ্জয় নন্দী ভীষণ গম্ভীর মানুষ। তিনি পর্যন্ত আমাকে বললেন একদিন, আমার হাবলটাকে একটু-আধটু দেখিয়ে-শুনিয়ে দাও। আশ্চর্য, গাঁয়ের লোকও আমাকে মাস্টার মনে করতে লাগল। সন্ধেরাতে ওদের নিয়ে বসতাম – নটার সময় ওদের ছেড়ে দিয়ে আমার নিজের পড়াশোনা।
কাঁটারির সেই গোপাল নামের ছেলেটা একদিন আমার কাছে হাজির। সে এতদিন ক্লাস সেভেনে গগাচ্ছিল। আমার সঙ্গে লংজাম্পে যে মাঝে মাঝেই ফার্স্ট হতো, এ-দুবছর ক্লাস সেভেনে থাকতে থাকতে সে শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে। শুকনো মুখে সে একদিন আমার কাছে এসে বলল, আইজুলদা, তুমি আমাকে পড়াও। ফি বছর ইংরেজিতে ফেল করছি। বাবা স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নেবে বলেছে। দোহাই, আইজুলদা তুমি আমাকে পড়াও। এই দ্যাখো, তোমার প্রথম মাইনে পর্যন্ত সঙ্গে এনেছি। এই বলে সে দশ টাকার একটা নোট আমার দিকে এগিয়ে ধরল। আগে টাকা নিজের পকেটে রাখ গোপাল। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আইজুলদা কিরে? আমি আবার কবে তোর আইজুলদা হলাম? আইজুল বলেই তো ডাকতিস!
কাঁটারি গাঁ-টা ছোট। এই গাঁয়ে শুধুমাত্র প্রান্তবাসী কোটালরা থাকে। নিজেদের এরা নিজেরাই ছোট করে রেখেছে। কখনো কারো সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলে না। এই গোপালও দেখছি তাই। কখনো গলা চড়িয়ে কথা বলতে শুনিনি তাকে। এখন থেকে তুমি আমাকে পড়াবে, আমার মাস্টারমশাই হবে। তোমাকে কেমন করে নাম ধরে ডাকি? গরিব গোপালের টাকাটা নিতেই হলো। কত কষ্ট করে জোগাড় করেছে। না নিলে খুব তার ছোট লাগবে নিজের কাছে। তাই নিলাম টাকাটা। কিন্তু আর কোনোদিন আমাকে টাকা দেবার চেষ্টা করবি না কিন্তু গোপাল।
ব্যস, ছাত্র পড়ানোর জন্য পুরোদস্ত্তর আমার একটা ব্যাচ তৈরি হয়ে গেল। দোতলায় আমার ঘরটা বেশ বড়। একপাশে আমার বিছানা, প্রস্রাবের গন্ধে ভরা। তার পাশে একটা বড় শীতলপাটি বিছিয়ে দিই। ওইখানেই সব পড়ে, হৈ-হুল্লোড় করে। এই হেলা, আমার পিঠটা একটু দলাই-মলাই করে দে তো! আমি উপুড় হয়ে শুই। হেলা খালি পায়ে আমার পিঠের উপর হেঁটে বেড়ায়। সে দলাই-মলাইয়ের বাবা। খানিকটা পরেই বলি, থাক হেলা, আর দরকার নেই। পা-দুখানা বটে তোমার!
আমি ওদের ট্রানস্লেশন করতে দিই। ছোট-বড় বাক্য কেমন করে তৈরি হয় বলে দেবার চেষ্টা করি। দেখি, ওরা টেন্সের ব্যাপারটা বেশ তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করে ফেলল। কোনো কোনো ভার্বের আবার দুটো করে পাস্ট পার্টিসিপল হয়। দুটোই ঠিক। শুধু খেয়াল রাখবে, কোন টেন্সের কোন রূপটা হচ্ছে ফিউচার কনটিনিউয়াস, ফিউচার পারফেক্ট কনটিনিউয়াস নিয়ে খুব ঝামেলা। আমি নিজে কিন্তু পুরো বুঝতে পারি না। আগে ঠিক করবি এখন, আগে, না পরে। এইটা ঠিক হয়ে গেলে কোন ফর্মটা বেছে নিতে হবে সেটা ঠিক করবি। এই কাজটা করতে গিয়ে আমি মানেসহ অনেক ভার্ব মুখস্থ করাই। ক্লজ আর ফ্রেজের তফাত বলে দিই – কত রকমের সেন্টেন্স্ হতে পারে – সিম্পল, কমপ্লেক্স আর কম্পাউন্ড নিজে যতটা বুঝি ওদেরকে সেটা বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করি। এতে শুধু ওরা শেখে, তা নয় – আমি নিজেও শিখি, অ্যাকটিভ প্যাসিভ সেন্টেন্স্ আয়ত্ত হয়ে যায় – কিন্তু ছাপানো বইয়ের গদ্য বা 888sport app download apk বুঝতে গেলে সব গুলিয়ে যায়। শেখা বিদ্যের সঙ্গে ঠিক ঠিক মেলে না। কাঁটা সব জায়গাতেই আছে। দলের মধ্যে এককড়ি আর গোপেশ্বর বেশ এগিয়ে, মানিক মোদক চালাক বেশি, বোঝেও ভালো। সত্যনারায়ণটা কিছুতেই এগোতে পারছে না। এই দলের মধ্যে সমরেশকে ডাকি না। তার জন্যে আলাদা ব্যবস্থা। সে হঠাৎ হঠাৎ আমার গলা ধরে বসবে, অড়হরের জঙ্গলের আড়ালে গলা ধরাধরি করে বসব – এক আনার বাদাম কিনে দুজনে খাব।
মাসখানেক পেরিয়ে গেলে সমরেশকে ডাকি। কাঁটারির গোপালের একমাস পড়া হলো। যেদিন একমাস পূর্ণ হলো, সেদিনই সমরেশকে ডাকলাম। হেলাটা বয়সে একটু ছোট, গোপালের কাছ থেকে প্রথম দিনে পাওয়া সেই দশ টাকার নোটটা বার করে হেলার হাতে দিয়ে বলি, যা ঘোঁতাদার দোকানে। বিকেলে মন্ডা সন্দেশ তৈরি হচ্ছিল দেখে এসেছি। ক-টাকা করে যেন সের রে? দুই-আড়াই টাকা হবে বোধহয়। যা, তিন কিলো নিয়ে আয়। আজ সবাই পেটভরে মিষ্টি খাব। হেলা টাকা নিয়ে দৌড়ুল। গোপাল তখনো আছে। সে হাঁ করে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে, তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। হুল্লোড় লেগে গেল বাড়িতে। বাবা এখন আমাকে কোনো কিছুতেই বারণ করেন না। আমরা হৈ-হুল্লোড় করছি, তিনি একবারও বিরক্ত হন না। আমার মনে হয়, বাবা এসব বিষয়ে আমাকে সমর্থনই করেন। আমি ওদের কাছে টাকা নিই কি নিই না, কোনোদিন জিজ্ঞেসও করেননি। এই সময়টাতেই সিগারেট খেতে শিখে গেলাম কি? ঠিক মনে পড়ছে না।
সাপের মতো শুকনো গাছে গা ঘষাঘষি করে খোলসটা কি বদলে নিলাম? মনে হয় তাই, আমি অন্য একটা জগতে ঢুকছি। আছি এই জগৎটাতেই. কিন্তু এর মধ্যেই তৈরি হচ্ছে অন্য একটা জগৎ। বোঝানো কঠিন। অন্য কোথাও যাচ্ছি। তার পথ সকাল-সন্ধ্যা জুড়ে। কখনো সে দূরে যায়, কখনো সে কাছে আসে। কুন্ডলী পাকিয়ে তখন আমি তার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি, নেশুড়ে চোখে জেগে যাই, বাইরে এসে ঠিকমতো পথ ঠাহর করতে পারি না। শরীরে কখনো কখনো তীব্র উত্তেজনা টের পাই, কখনো অস্থির অতিষ্ঠ হয়ে এক একটা খারাপ কাজ করে ফেলি, লাল আলোর পৃথিবী থেকে বের হয়ে আসার জন্যে। ভীষণ অবসাদ হয়। এখন একেবারে নিয়ম করে স্কুলের লাইব্রেরিতে যাই। মনীন্দ্রবাবু বারণ তো করেন-ই না, আলমারির তালা খুলে দিয়ে বলেন, দ্যাখ, কী কী বই নিবি। আমি প্রথমেই হাতে পেলাম এরিখ মারিয়া রেমার্কের বইটা অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, অবন ঠাকুরের নাতি মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের 888sport app download apk latest version। খুব ভালো 888sport app download apk latest version। পরে আমি ওর ইংরেজি 888sport app download apk latest versionের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। কোথায় কোন এক যবগ্রামে পড়ে আছি কুয়োর মধ্যে ব্যাঙের মতো। পৃথিবীটা বড়, সেটা আন্দাজ করতে পারতাম – কিন্তু কত বড়? এই বড় পৃথিবীটা আসলে নিস্তব্ধ ছিল এতদিন – সন্ধের আকাশের মতো বা তারাজ্বলা অন্ধকার আকাশের মতো। এখন ধারণা হচ্ছে, মহা কলরোলের মধ্যে এই জগৎটা সব সময়েই টগবগ করে ফুটছে। আমারই মতো কোটি কোটি মানুষ এই পৃথিবীতে, তারা খেলছে, আনন্দ করছে, চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ করছে, প্রতিনিয়ত মরছে, মারছে, রক্তের বন্যা বয়ে দিচ্ছে। জেগে ওঠার পর থেকে একবারও কি তার নিশ্চিন্ত ঘুম নেই! বই পড়তে পড়তেই এক একটা দেশ জেগে উঠেছে, এখানে-ওখানে-সেখানে, হাজার হাজার, কোটি কোটি, মানুষে পশুতে জন্তুতে কানায় কানায় ভরা সব দেশ – তার কাছে কত তুচ্ছ আমাদের যবগ্রাম। তবু বুঝতে পারি, আমারও একটা ঠাঁই আছে এখানে। আমি আজও ঠাঁই হারাইনি। সেখানে থেকেই আমি বুঝতে পারি, পৃথিবী লাটাইয়ের মতো ঘুরছে। আমার চারপাশেই ঘুরছে ভাবলে দোষ কী?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওপরে লেখা এই বই অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। যুদ্ধের 888sport live football হিসেবে মহৎ এই 888sport alternative link। বোঝা যায়, লেখক নিজেই এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধ একরকম শেষ, পশ্চিম রণাঙ্গন শান্ত – আঠারো বছরের কিশোরটি ট্রেঞ্চে নিরাপদেই ছিল। সে কি পত্রশূন্য একটি গাছে যে ছোট্ট পাখিটা ডাকছিল তাকে দেখতে গিয়ে একটু মাথা উঁচু করেছিল? টুকটাক এখানে ওখানে গুলি হচ্ছিল, আচমকা তাদের একটি এসে লাগল কিশোরটির শরীরে। মৃত্যু হলো তার। নিজস্ব গোটা একটা পৃথিবী নিয়ে ছেলেটি মারা গেল। ফ্রন্টের ক্যাম্পের জীবনের যে ছবি এখানে এনেছেন রেমার্ক, তার তুলনা হয় না। যুদ্ধ শত্রুতা বন্ধুত্ব হিংসা নিষ্ঠুরতার এক আশ্চর্য ক্ষমাহীন জগৎ। যে দুজন বিছানা ভিজিয়ে ফেলে রাতে তাদের শাস্তি হচ্ছে একদিন একজন ওপরের বাংকে শোবে, পরের দিন অন্যজন ওপরে শোবে। দ্যাখো, কেমন লাগে। দুষ্টু ছেলেরা ফিস্টি করে খাবে একবাড়ির একটি হাঁস – সেটা চুরি করে আনা – কিংবা ভ্যানে চরে ফ্রন্টে যাচ্ছে কিংবা ফিরছে। মাথার ওপরে তার – তার এলেই যারা ভ্যানে দাঁড়িয়ে আছে, তারা সাবধান করে দেওয়ার জন্যে চেঁচাচ্ছে, সাবধান তার। সাবধান তার – সাবধান তার – সাবধান তার। তখনো যুদ্ধে সাধারণ রাইফেল ঘোড়া ইত্যাদির ব্যবহার হতো – ঘোড়াদের মৃতদেহের স্তূপ, পাশেই মানুষের লাশের স্তূপ। এই যুদ্ধের 888sport alternative linkটিকে জীবনে ভুলতে পারা গেল না। তৃষ্ণা জেগে উঠল, এই একখানা বই পড়তে গিয়েই মনে হলো, হাজারটা বই একবার পড়ে জেনে নিতে হবে এই 888sport alternative linkে যা যা আছে, তা বোঝার জন্যে। আয়ত্ত করে নিতে হবে গোটা বিশ্ব।
অবাক কান্ড দু-নম্বর বইটা পেয়ে গেলাম ওই রেমার্কেরই, থ্রি কমরেডস, অশোক গুহের 888sport app download apk latest version। অশোক গুহের 888sport app download apk latest version খুব ভালো হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এই 888sport alternative link। দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে আর তাদের বাহন লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা একটা জিপগাড়ি। সে গাড়ি দেখলেই হাসি পায় – এ-গাড়ি চলে কী করে, দেখলেই মনে হয় চালু করলেই তো এ-গাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। তিন বন্ধুর একজন মোটর মেকানিক – সে-গাড়িটার ইঞ্জিন-টিঞ্জিন সব বদলে এমন করে রেখেছিল কোনো গাড়িই তাকে পেছনে ফেলতে পারত না। প্রেমের গল্পই বটে, এমন আশ্চর্য গল্প আমি যেন কখনই পড়িনি। দুই বন্ধুই ভালোবাসত মেয়েটিকে – কিন্তু কখনো তাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ থাকত না। কারও ভাগে কিছু কম পড়ত না।
পোড়-খাওয়া মানুষ জীবন এমন করেই কাটায়। থ্রি কমরেডস – তিন সঙ্গী এই বইটার নাম। শুনেছি রেমার্ক সংসার করেননি। ইউরোপের হোটেলে হোটেলে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর দি ব্ল্যাক ওবেলিস্ক নামের তৃতীয় বইটা আমি কখনো পাইনি।
স্কুল লাইব্রেরির বইগুলি প্রায় সবই বাংলায় 888sport app download apk latest version। ইংরেজি বই ছিল না। কিন্তু কে কিনেছিলেন এই বইগুলি। তার মধ্যে এত আলো ছিল? এখানেই পেয়ে গিয়েছিলাম দস্তয়ভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, দি ব্রাদার্স কারামাজভ – আমার বয়সে ওইসব পড়া উচিত ছিল কিনা জানি না। স্কুল থেকে নিয়ে গোর্কির মা (888sport app download apk latest version পুষ্পময়ী বসু) আমি অন্তত তিনবার পড়েছি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এই সময়েই আমি পড়ে ফেলেছিলাম তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস 888sport alternative linkটা। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য পাঁচখন্ডে এর 888sport app download apk latest version করেছিলেন – এই বই অন্তত মূল থেকে অনেক দূরে ছিল সন্দেহ নেই, সে-কথা এখন বুঝি, কিন্তু পাঁচ খন্ডে ওয়ার অ্যান্ড পিস আমি পড়ে শূন্য হাতে ফিরিনি। পিটার চরিত্রটি আমি আজও ভুলিনি। আমি বুঝতে পারি ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট ওই বয়সে পড়াটা আমার উচিত নয়। কিন্তু যে-ছেলেটি দেনা করে শোধ দিতে না পারার অপরাধবোধ থেকে বুড়িটাকে কুড়ুল দিয়ে মেরে ফেলল, চলেই তো আসত সে – তখুনি অন্য ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বুড়িটার ছোট বোন। এই অনাবশ্যক খুনটা করার তার প্রস্ত্ততি বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না – নিজে বাঁচার জন্য করতে সে বাধ্য হলো। জোড়া খুন করে ফেলল এক ছাত্র। বাকি 888sport alternative linkটা তো নিষ্করুণ অবিরাম দহন – আর কিছু নেই। পাপবোধ আত্মদহন তখনো বোঝবার বয়স আমার হয়নি। কিন্তু মনে তো রয়েছে যে আমার পরিচয় ঘটেছে মানুষের জীবনের এত অসহ্য কষ্ট আর যন্ত্রণার সঙ্গে।
আমাদের স্কুল লাইব্রেরিতে শিশু-কিশোরদের জন্যে কিছু বাংলা বই ছিল। সে-সব আমি সিক্স-সেভেনেই পড়েছিলাম। ঝিলে জঙ্গলে, ভোম্বল সর্দার, কাজললতা, হেমেন্দ্রকুমার রায় আর দস্যু মোহন সিরিজের বই, নীহাররঞ্জন গুপ্তের কালো ভ্রমর। এর মধ্যে দু-চারটে অদ্ভুত বই – ঠাকুরমার ঝুলি, ছোট্ট পমির অভিযান, হিমালয়ের তুষার মানব, রিপ ভ্যান উইঙ্কেল – এইসব নানা বই। কোনো কোনোটা খুবই ভালো লাগত। অথচ আশ্চর্যের কথা, এত 888sport app download apk latest versionের বিদেশি বিখ্যাত বই থাকলেও, বাংলা বই কেন এত কম ছিল তা জানি না। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিশ্চয় ছিল, ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার ছেলেবেলা, জীবন888sport sign up bonus, দু-একটা রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk আর 888sport alternative link, কিশোর রবীন্দ্রজীবনী। আর ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রায় সব 888sport alternative link। তারপর একদম স্টপ – বাংলা বই আর নেই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটা জানতে পেরেছিলাম ‘ডাইনি’ বলে একটা গল্প পড়তে গিয়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম কোনোদিন শুনিনি। জীবনানন্দ দাশের নামও না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর প্রবোধ সান্যালের নামদুটো জানা গিয়েছিল পাঠ্যবই থেকে। আগে গল্পগুচ্ছ প্রথম খন্ড পাঠ্য ছিল, আমাদের সময়ে আর ছিল না। অথচ এই স্কুলের লাইব্রেরিতেই 888sport app download apk latest versionে পড়েছিলাম ডিকেন্সের এ টেল অফ টু সিটিজ, ডেভিড কপারফিল্ড, নিকলস্ নিকলকি, অলিভার টুইস্ট আর বোধহয় আলেকজান্ডার ডুমার, দি ব্ল্যাক টিউলিপ।
বেছে বেছে এই বইগুলির নাম লিখলাম, তার একটাই কারণ – দীর্ঘ জীবন পার করে এসেও ভুলতে পারলাম না বইগুলো। পাথরে খোদাই হয়ে থাকার মতো – যেন জীবনের চিরপ্রাপ্তি তখনই ঘটে গিয়েছে। তা না হলে বইয়ের তালিকা তৈরি করতে গেলে যেসব বইয়ের কথা এখন মনে পড়ছে, তার তালিকা এত তাড়াতাড়ি শেষ হবার কথা নয়। প্রতিদিন একটা বা দুটো বই দেখা তো হতোই। এসব বইয়ের কথা এখন উল্লেখ না করাই ভালো। তবে এটুকু বলা যায়, তখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রায় সব 888sport alternative linkেরই সংক্ষিপ্ত সংস্করণ পড়া হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk পড়া হয়েছিল, গল্পও কিছু পড়েছিলাম – কিন্তু 888sport alternative link নয়। আর রাজ্যের আজেবাজে বই, দু-একটা সামাজিক 888sport alternative link, ডিটেকটিভ গল্প, অভিযান কাহিনি। বলতে ভুলে যাচ্ছি শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দু-একটি 888sport alternative link – মানে না মানা, অভিনয় নয়। সেসব সিনেমার গল্প। প্রথম সিনেমা দেখেছিলাম মানে না মানা – কাঁচা কাহিনি, তবু খুব ভালো লেগেছিল। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের একটা বড় গল্প সংকলন বেরিয়েছিল – বোধ হয় তাতে ভালো গল্প অনেক ছিল। ওই সময়টা গ্রামে গ্রামে তাঁবু খাটিয়ে সিনেমা দেখানো হতো। চার আনা টিকিট – তখন কিন্তু বিখ্যাত ছবি অনেক দেখেছি। জহর গঙ্গোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী সান্যাল, রবীন মজুমদার, সন্ধ্যারানী, কানন দেবী, মলিনা – এঁরা সব প্রধান চরিত্রে।
উত্তম-সুচিত্রা তখনো এইসব দূর গাঁয়ে পৌঁছুতে পারেননি। কেন যে ভালো লাগত তা ঠিক বুঝতে পারি না। ওই কাঁচা বয়সটা মানুষ কী করে পার করে? 888sport alternative linkগুলো গল্পে ঠাসা। গল্পই নেই তবে 888sport alternative link কিসের? এই সময় মহা নামকরা ঔপন্যাসিক ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় – তাঁর চিতা বহ্নিমান পড়তে শুরু করেছিলাম একদিন সকালে – বেশ মনে পড়ছে মুগ্ধ মনে যখন 888sport alternative linkটার শেষটা পড়ছি, তখন বিকেলের সূর্যের আলো ঝিকিমিকি করছে। এইভাবেই শেষ করেছিলাম শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় নয় 888sport alternative link। তবে এরকম সারাদিন ধরে পড়েছিলাম আর একটি 888sport alternative link – সে এক আলাদা অভিজ্ঞতা, খুব ভালো কিছু পড়ার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। বইটা ছিল দি ব্ল্যাক টিউলিপ – এক দুর্লভ ফুল, কালো টিউলিপ। এই ফুল অপার্থিব কোন সাধনায় ফুটবে? কে ফোটাবে তাকে? সন্ধেবেলায় ফুটেছিল সেই ফুল – তখন অন্ধকার নেমে এসেছে।
একটা কথা আজকাল খুব মনে হয়, গোগ্রাসে গাদা গাদা বই পড়া কতটা ভালো? বুক ফুলিয়ে এই কথাটা বলা কি উচিত – আমি প্রত্যেকদিন একটি করে বই শেষ করি? একটা লাইব্রেরি শেষ হতে আর একটা লাইব্রেরি ধরি। আমার এমন ধারণা হয়েছে, নিজের অভিজ্ঞতাই আমাকে শিখিয়েছে, মোটেই ওরকম করে বই পড়া ঠিক নয়, হাতির মতো দিনে আড়াই মণ ঘাস খাওয়ার চেয়ে সিংহের মতো কয়েক কিলো মাংস খাওয়াই ভালো। বই পড়ার একটা খারাপ দিক হলো, যে-কোনো নেশার মতো এটাও নেশা। নেশায় যারা পড়ে তারা অকর্মার ধাড়ি হয়ে যায়। সর্বকর্মে অনিচ্ছা, সকাল দুপুর রাতে চরম অলস মানুষরাই এরকম বই পড়ে। তাতে মানও থাকে – শুধু এরকম কথা বলার সুখ ছাড়া যে জীবনে আমি দশ পনেরো হাজার বই পড়েছি। তাতে হয়েছে কী? যে লোকটা পড়েছে তার কি চারটে হাত-পা গজিয়েছে, নাকি চুলের তলায় শিং গজিয়েছে?
জীবন যখন দু-ভাগ করে ফেলেছিলাম, চোদ্দ বছর বয়সে – জীবন কাটানোর জন্যে প্রতিদিনের বাইরের জগৎ আর বই পড়ার ভেতরের জগৎ। প্রতিদিনের জগৎ আর কতটুকু বদলাত? খুব সামান্য আর এত ধীরেসুস্থে যে ধরাই পড়ে না নিজের কাছে। কিন্তু ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট পড়ে আমি যেমন ছিলাম তার থেকে একটু ভিন্ন অবশ্যই হয়েছিলাম। যেন ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প হয়ে গিয়েছে, সব জিনিস আগের জায়গায় নেই। কিন্তু খুঁজছি পাগলের মতো? খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না। এরকম বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু বদলে গিয়েছি, বিরক্ত বিব্রত বোধ করেছি। নিশ্চিন্ত মনে ধরতে পারি এমন একটা কিছু পাবার ইচ্ছা অস্থির উল্টোপাল্টা ভেতরের জগতের উপরে একটা ঠান্ডা প্রলেপের মতো। দু-দুটো মানুষ খুনি রাশকলনিকভকে পাপ অপরাধের জন্য সারাজীবনের চরম শাস্তি পার করিয়ে তাকে পৃথিবীর মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে তুলে দিলে তার প্রেমিকার হাত ধরে, হাজারবার পোড়া নিখাদ ইস্পাতের মতো, সেই বয়সে অতটা না বুঝলেও কিছু তো নিশ্চয়ই বুঝেছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইলে রোহিণী কি শান্তি পেয়েছিল তার নির্মম মৃত্যুর পরেও! নাকি সে অতৃপ্ত আত্মা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে? জীবন যেমন দেখায় তেমন নয়, যেভাবে কাটে বলে মনে হয় সেরকমও নয়। কোনো ভালো বই পড়লে একটু অন্য মানুষ হয়ে ওঠে কি সে?
আমি ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে এখন!

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.