888sport sign up bonusর ছায়াপাত

শাহীন আখতার

\ ৫ \

 

অনিতা সেনের 888sport sign up bonusকথা

সিলেটে এসে দেখি সাজসাজ রব। পার্টি সর্বশক্তি দিয়ে জাপানি আক্রমণ ঠেকাতে ব্যস্ত। চট্টগ্রামে বোমা পড়ায় অনেকেরই ধারণা – জাপানিরা আকিয়াব হয়ে চট্টগ্রামে ঢুকবে। ঘুম থেকে উঠেই চক-আউট হচ্ছে – আজ কে কোথায়। আমি ভাবলাম, চট্টগ্রাম-বর্মা বর্ডারই বুঝি আমার ডেসটিনি। ওখানে জাপানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলে সোভিয়েত যদি রক্ষা পায়, তাই তো করা উচিত। পৃথিবীর একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশটার প্রতি অসম্ভব মায়া তখন আমাদের। কল্পনায় দেখতাম যৌথ খামারে ট্রাক্টর চালাচ্ছি। মাটি খুঁড়ে আলু তুলছি। কান-888sport app উলের টুপি, কালো ওভারকোট আর কাদামাখা বুটে নিজেকে বেমানান মনে হতো না। কখনো ভাবতাম – পল রবসনের ‘মাই ওল্ড কেন্টাকি হোম, গুডনাইট’ গাইতে গাইতে বরফের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। খড়ের গাদায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছি কাস্তে আকৃতির ভঙ্গুর চাঁদখানার দিকে। ককেশাসের নির্মেঘ আকাশের দীপ্তিমান চাঁদ, যার নীল ধোঁয়াটে আলোটাও বরফের মতো ঠান্ডা হিম। কাছাকাছি রাসবেরির ঝোপ থেকে ক্রিস্টাল চোখে তাকিয়ে আছে একটি নেকড়ে-ছানা। জাতে হিংস্র হলেও স্বভাবে মায়াময় আর নিরীহ, সমাজতান্ত্রিক দেশের জন্তু তো! সেই প্রিয় জনপদ হিটলার তছনছ করে দিচ্ছে! আমি বললাম, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। স্নাইপার হতে চাই। অনেক সোভিয়েত 888sport promo code তো তাই হচ্ছে, আমার বয়সী ছাত্রী তায় কমসোমলের সভ্য যারা! খামারে হয়তো কাজ করছে, ডাক এলো। ট্রাক্টর থেকে নেমে কোটের বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেল যুদ্ধক্ষেত্রে। গ্রেনেডবোঝাই ক্যাম্বিসের থলে পিঠে মাইলকে মাইল বরফের ওপর দিয়ে হাঁটছে। রাতে ঘুমোচ্ছেও বরফের শয্যায়।

‘কমরেড, আপনি বড় বেশি কথা বলেন!’ আমাকে থামিয়ে দিয়ে কপট রাগে বললেন নেতা। ‘যুদ্ধ স্বপ্নবিলাস নয়। আপনি প্রচারকর্মী, এখনো সময় আছে সিরিয়াস হোন।’ ততক্ষণে সাপ্তাহিক জনযুদ্ধের কপি প্রায় নিঃশেষ। পিপলস ওয়ারের সম্পাদকীয় পড়ে দুর্লভছড়ার মণিপুরি মেয়েদের বোঝাতে হবে – জনযুদ্ধ কী এবং কেন। মনে মনে খানিকটা দমে গেলেও ভাবলাম – এ অসম্ভব নয়। আমি কি গোর্কির মাদার পড়ে পার্টির প্রতি অনুরক্ত হইনি! বালিশের তলায় থাকত বইখানা। কলেজে যাবার সময় ব্যাগে ভরে নিতাম। কখনো সঙ্গে নিতাম কাজী নজরুলের অগ্নিবীণা। টিফিন আওয়ারে পালাক্রমে বই দুটি থেকে জোরে জোরে পড়ে কান ঝালাপালা করে দিতাম ক্লাসের মেয়েদের। তা বলে তখন বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো হয়নি। অচিরেই দল ভারী হয়েছিল। সেই বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে চললাম দুর্লভছড়া। মণিপুরি মেয়েরা পান-গুয়া খায়ও বাবা – একেবারে ভাতের মতো। খেয়ে খেয়ে জিব অসাড়। তবে কানটা শার্প। আমি ঘরের দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে পিপলস ওয়ার থেকে একেক লাইন পড়ে বাংলায় তর্জমা করছি। চলছিল বেশ। হঠাৎ বলে, ‘ধেত্তোরি, সময় নষ্ট করছিস কেন বাপু! তুই ইংরেজিই পড়। আমরা উনানে ভাত চাপিয়ে এসেছি।’

পড়া লাটে ওঠে। তবু ভালো, অপমান তো করেনি! যে কমরেডরা বাঙালিপাড়ায় জনযুদ্ধের প্রচারে যেতেন, তাঁদের ঝাঁটার বাড়ি খাওয়া শুধু বাকি ছিল। সুভাষ বসুকে নিয়ে খারাপ কিছু বলেছ কি, দূর হও। হঠ্ যাও। বাড়ির মেয়েরাই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলত – ‘তোমরা ব্রিটিশের চর। ভাড়াটে দালাল।’ রাসত্মা, বাজার, চায়ের স্টল যেখানেই যাই একই ভৎর্সনা, গালাগাল। তর্জনী তুলে বলে – ওই যে আসছে জাপানি খেদানেওয়ালা…

আমি তো প্রচারকর্মী, আমাকে ভাবতেই হচ্ছিল – গ-গোলটা কোথায়। তখন সাপ্তাহিক জনযুদ্ধপিপলস ওয়ারের ফ্যাসিস্টবিরোধী প্রচারণা ত্রিমুখী, যার লক্ষ্য ঘুরে-ফিরে সেই সাম্রাজ্যবাদী জাপান। যেমন জাপানকে প্রতিহত করতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে একত্রিত করে রাজ-সমীপে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি। পার্টির নেতাকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তির আরজি, যাতে জাপ-বিরোধী প্রচার ও জনরক্ষা কমিটি গঠনে তারা অংশ নিতে পারেন। তৃতীয়ত জাপানিদের ঠেকাতে ভলান্টিয়ার দল গঠন ও জনরক্ষা বাহিনীতে শামিল হতে জনগণের প্রতি আহবান। সেই সঙ্গে অতি অবশ্যই পঞ্চমবাহিনী তথা সুভাষ বসুর ফরোয়ার্ড বস্নকের আস্ফালন রুখতে হবে। কারণ এ বাঁচা-মরার প্রশ্ন। তখনো যদিও 888sport appর কমরেড সোমেন চন্দ ছুরিতে নিহত হয়নি, আমরা শুনতাম পিস্তল হাতে পঞ্চমবাহিনী বলে বেড়াচ্ছে – ‘জাপানিদের সঙ্গে আমাদের নেতা আসছেন। কমিউনিস্টরা বাধা দিলে আমরাও ছেড়ে কথা কইব না।’ তারা হাতের পিস্তল দেখিয়ে বলে, ‘তাতে বুলেট পোরা আছে।’

চমৎকার! পার্টির এ ত্রিমুখী লড়াই আমি মনে মনে তারিফ করি। তারপরই খটকা। আমার পছন্দ নয় কি পিস্তল হাতে ‘পঞ্চমবাহিনী’র আস্ফালন? এরা যে দাদারই সগোত্রীয়! কমিউনিস্ট ঠেঙিয়ে ভারতে ঢোকার পথ কণ্টকমুক্ত করছে জাপানিদের, আইএনএ-র। কিন্তু তাতে আমার নন-কমিউনিস্ট মা আহ্লাদে আটখানা হতে পারেন, আমি কেন? আমার আর দাদার পথ-মত কি আলাদা নয়!

একদিন পার্টির স্টাডিসার্কেল হচ্ছে। ‘শুধু কি পঞ্চমবাহিনী, জনগণের একাংশও কি জাপানিদের চাইছে না? তারা তো বলছে – ব্রিটিশরাজ খতম হবার পথে আপনারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন কেন?’ আমি দুরুদুরু বুকে প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকাই। সে-সময় ধুপ করে পাকা আম পড়ে টিনের চালে। সঙ্গে সঙ্গে মন ছুটে যায় ওদিকে – এখনই তা না কুড়ালে নয়। কিন্তু ঘরে যেমন থমথমে ভাব! বোমা পড়লেও কেউ নড়ে বসবে না। শেষমেশ বাড়িঅলার রিটার্ডেড মেয়েটাই বুঝি থপথপ করে ছুটে গেল গাছতলায়। ঘরটা অসম্ভব গুমোট। সিলিং ফ্যানের প্রশ্নই আসে না। আমি কপালের ঘাম আঁচলে মুছে হীরেন মুখার্জির স্বাধীনতার শত্রম্ন জাপান ও রানী চক্রবর্তীর দেশরক্ষায় চীনা 888sport promo code বই দুটির নাম বস্ন্যাকবোর্ড দেখে টুকে নিই চটজলদি। যদিও কলকাতা ছাড়া বই দুখানা পাওয়া দুষ্কর।

‘আপনাদের কি ফের অ-আ, ক-খ থেকে শেখাতে হবে, কমরেড?’ ডাস্টারের চকের গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে নেতা সহসা গরম হয়ে ওঠেন, ‘এখানে সবাই পার্টি মেম্বার। মালয়, হংকং, বর্মায় কী হচ্ছে, জানেন না আপনারা? জাপানি ফৌজ ওখানে কী করছে?’ তারপর কে কী জানে – পিএমরা ভয়ংকর সব বর্ণনা দিলো। নতুন কিছুই নয়। সবই অনেকদিন ধরে ফৌজি আকবরস্টেটসম্যান পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। দাদার চিঠির কথা মনে পড়ল। মালয়ের ভারতীয়দের সঙ্গে জাপানিদের কোলাকুলি, মুসাফা। এটি সত্যের আরেক পিঠ। বললে ‘কুইসলিং’ উপাধি জুটবে। এমনিতেই পার্টি আমাকে ক্লাস ব্যাকগ্রাউন্ড ও চপলতার কারণে সন্দেহের চোখে দেখে। কঠিন কঠিন পরীক্ষার দিকে ঠেলে দেয়। দুদিন আগেই তো সুইসুতো নিয়ে ফেস্টুন সেলাই করতে বসতে হলো। কোনো রকমে তুরপুন সাইজের একখানা দশাসই সুচে বড় বড় ফোঁড় দিয়ে সারলাম। তারপর বলে কিনা প্রয়োজনে ভারতীয় সেনা বা গেরিলাদের রণসাজও তৈরি করতে হবে। জানে, এসব কাজ আমার ভারি অপছন্দের – তবু!

আমি জানি পার্টিতে আমার যা একটুখানি কদর, তা মণিপুরি-অহমিয়া মেয়েদের মাঝে আমার অসম্ভব জনপ্রিয়তার জন্য। কিন্তু দাদার কথাগুলো ততক্ষণে পেটের মধ্যে গুরুপাক খাবারের মতো গুড়গুড়িয়ে ডাকতে শুরু করেছে। শেষমেশ পেট ফুলে মরব নাকি? আমি ‘গানজি’? বলে হেসে ফেলি। এটি যে দাদার কথিত জাপানিদের ভাঙা, অসম্পূর্ণ হিন্দি বোল, হাসির গমকে কথাটা শেষ করতে পারি না। পিএমরা ভাবলেন আমি বুঝি গান্ধীজিকে নিয়ে রসিকতা করছি। যদিও এ-ধরনের সভায় রং-তামাশার স্থান নেই, ওরাও হাসতে লাগল।

ততদিনে গান্ধীর প্রতি ভীষণ বিরক্ত পার্টি। ফ্যাসিস্টবিরোধী যুদ্ধটাকে তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না। ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হবার পরই সম্ভবত হরিজন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন – ‘জাপানিরা যদি ভারত আক্রমণ করে বুঝতে হবে, ইংরেজরা এখানে আছে বলেই করেছে। ওরা এখন চলে গেলেই পারে। তারপর আমাদের ভালো-মন্দ আমরাই বুঝব। …আর আক্রমণ করলেই কী। ভারতবাসী আজ যে চরম দুর্দশার মধ্যে আছে, জাপান আক্রমণ করলে এর চেয়ে খারাপ অবস্থা হবে না নিশ্চয়।’

গান্ধীর কথা তো প্রায় ‘ফ্যাসিস্ট-দোসর’ সুভাষের কাছাকাছি, তাই পার্টির একমাত্র ভরসা প–তজি, মওলানা আজাদ। কংগ্রেসের বিশাল জনসমর্থন যদি কোনোক্রমে জনযুদ্ধের পক্ষে আনা যায়, তাই শতমুখে তাঁদের গুণগান করা হচ্ছে। যার ইতি ঘটে ১৯৪২-এর আগস্ট আন্দোলনে।

সেই দিনটির কথা এখনো আমার মনে আছে। আমরা তখন মৌলভীবাজারের ভানুগাছ যাচ্ছিলাম। সে নদী, জলা, ধানের ক্ষিত। এই বড় বড় জোঁক। নদী পেরিয়ে হঠাৎ মাঝরাসত্মায় শুনতে পেলাম আগস্ট মুভমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে গ-গোল। ‘কুইট ইন্ডিয়া। ইংরেজ ভারত ছাড়ো। ডু অর ডাই। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।’ সেই জোঁকে ভরা গ্রাম পর্যন্ত এ সমস্ত সেস্নাগান রাতারাতি পৌঁছে গেছে। পরদিন ভানুগাছে আমাদের পূর্বনির্ধারিত জনসভা। আত্মরক্ষা কমিটি গঠন, মেয়েদের ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষণ, লাঠি ছোড়া শেখানোর প্রসত্মাব আনা হবে। সব ঠিকঠাক। তখন তো পার্টি সেই সেস্নাগানটা দিতে শুরু করেছে – ‘চাল দাও, টাকা দাও, সেনাদলে ছেলে দাও।’ তাছাড়া আরো সব সেস্নাগান আমরা দিতাম তখন – জাপানি দস্যুদের রুখে দাঁড়াও। একতাবদ্ধ হও। দেশরক্ষায় মরবার জন্য প্রস্ত্তত হও। আর আইপিটিএর একটা গান ছিল তখন – ‘দেবে না জাপানি উড়োজাহাজ/ ভারতে ছুঁড়ে স্বরাজ।’

এসব গান, সেস্নাগান সত্ত্বেও সেদিন জনসভায় লোক বিশেষ হয়নি। মঞ্চে মাইক ফিট করে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে যথাসময়ে বক্তৃতা শুরু হলো। এদিক-ওদিক থেকে ঢিল পড়ছে। মলিনা দত্ত বলে একজন কমরেড মঞ্চের সামনের সারিতে বসা ছিল। ওখানেই ঢিল পড়ে ওর কপাল ফেটে দরদরিয়ে রক্ত পড়ছে। তারপরও সভার কাজ চলছিল। ঢিল পড়ছে বৃষ্টির মতো। অসম্ভব চেঁচামেচি। মাইক কেড়ে নিয়ে বক্তাকে যখন জুতার মালা পরিয়ে টেনে নামিয়ে ফেলল, আমরা পেছনের উয়িং তুলে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেলাম। স্বেচ্ছাসেবক ছেলে একেকটা ছিল জানবাজ। এলাকার বলে পথঘাটও চেনে ভালো। পথ আর কোথায়। মাটির রাসত্মা – নুনের মতো জলে মিশে গেছে। টর্চ হাতে আগে-আগে স্বেচ্ছাসেবকদল। তাদের কারো হাতে গাছলাঠি। আমরা জল-কাদা ভেঙে যখন রেলস্টেশনে পৌঁছি, তখন মধ্যরাত। স্টেশনের ঠুলি-পড়া মিটিমিটি আলোয় টেনে টেনে জোঁক ফেলতে হচ্ছে গা থেকে। রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না। এত রাতে চুন পাব কোথায়? আমাদের যেখানে রাতে থাকবার কথা, ওরাও ভয়ে আশ্রয় দেয়নি।

পার্টির তখন চরম একঘরে অবস্থা। হুঁকো-নাপিত বন্ধ হবার জোগাড়। আক্রমণ আসতে লাগল জোরেশোরে। কমিউনিস্টরা আগস্ট মুভমেন্টে পার্টিসিপেট করেনি। এদের উৎখাত করো। লোকের বাড়ি গেলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। সর্বহারাদের জনযুদ্ধের সারকথা বোঝাতে গেলে ঝাঁটা হাতে তেড়ে আসে। পার্টি বলে, ট্রাই অ্যান্ড ট্রাই অ্যাগেইন। আমরাও ট্রাই করে যাচ্ছি। মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। মিটিংয়ে চড়াও হয়ে জোরে জোরে টিন বাজিয়ে গাইছে ‘রাধে রাধে বলতে হবে, কমিউনিস্টদের মারতে হবে, তবেই দেশ স্বাধীন হবে।’ ‘Down with Soviet Union, Down with Communist Party. সুভাষ বোস কি জয়। স্বাধীন ভারত কি জয়।’ তাতেও জ্বালা মেটে না। আমাদের কান ধরে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। রীতিমতো গুণ্ডামি আরকি। স্কুল-কলেজের ওঁচা ওঁচা ছেলেরা করত এসব। ওরা নাকি মিলিশিয়া। যখন দেখল – কমিউনিস্টদের তো অসম্ভব ডিভোশন! এভাবে তো দমানো যাবে না। তখন শুরু হলো আমাদের চরিত্র হনন। এমনিতে তখন কমিউনিস্ট একটা ট্যাবু। কমিউনিস্টদের পারিবারিক জীবন নেই। স্ত্রী হচ্ছে কমন প্রপার্টি। ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। আমরা তখন কমিউনের মতো করে থাকতাম সিলেটের একটি ভাড়াবাড়িতে। সেখান থেকেও পাততাড়ি গুটাতে হলো।

সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশি জুলুম যত বাড়ছে, আমরাও পাবলিকের হাতে তত মার খাচ্ছি। তবে আন্দোলনটা বরাবরের মতো অহিংস থাকেনি। ডাক-তার-টেলিগ্রাফের লাইন ছিন্ন করা, রেললাইন উপড়ানো, থানা ঘেরাও-অগ্নিসংযোগ। ব্রিটিশরাজের প্রতি চরম আক্রোশ যাকে বলে। রাজও তখন ভয়ানক হিংস্র। মিছিলে গুলি চালিয়ে পাখির মতো মানুষ মারছে। পার্টি তখন সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করলেও সত্যাগ্রহীদের অ্যাকশন সাপোর্ট করেনি। অলইন্ডিয়া কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি পিসি যোশী তখন সরাসরি বলেই দেন – ‘এ সংগ্রামে স্বাধীনতা আসবে না। আসবে জাপানিরা।’ মা চিঠি পাঠালেন – ‘চলে আয়। কাদের সঙ্গে আছিস তুই! যারা দেশপ্রেমিকদের বলে জাপানের দালাল, তারা দেশপ্রেমের কী বোঝে?’

কে আসলে দেশপ্রেমিক? মা বা পার্টির মতো আমি তখন আর নিশ্চিত নই। এ বলে আমায় দেখো, ও বলে আমায় দেখো। আমি কাউকেই দেখছিলাম না। শুধু দাঁত কামড়ে পড়েছিলাম। আর মনে মনে নিজেকে মন্ত্রণা দিচ্ছিলাম – কোনো ক্রমে সাম্যবাদী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। বামবিচ্যুতি সাংঘাতিক জিনিস। পচা মাছের মতো দুর্গন্ধময় বা আরেকটু এগিয়ে বললে মৃত্যুর সমতুল।

তবে এত মৃত্যু, জেল-জুলুমও নেওয়া যাচ্ছিল না। আমার বিবমিষা হচ্ছিল। কদিন আগেই জনরক্ষার কাজে জোড়হাট গেছি। তখন কংগ্রেস নেত্রী কুসুমলতার সঙ্গেও বৈঠক হয়েছিল। গহপুর থানা আক্রমণ করতে গিয়ে কুসুমলতা শহীদ হয়েছেন শুনে সেই রাতে আর ঘুম হলো না। সারারাত রক্তাক্ত দেহে কুসুমলতা আমার সামনে দিয়ে মিছিল করে গেলেন।

আমাদের তখন থাকবার জায়গা নেই। রাসত্মায়ও বেরোতে পারি না। দেশের লোকের হাতে কমরেডদের হত-আহত হবার খবর আসছে প্রতিদিন। পার্টির তখন কড়া নির্দেশ – যারা দুর্বল চিত্তের, পারিপার্শ্বিক যাদের কব্জা করে ফেলছে, তারা যেন ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। যদিও আমাদের কেউ কেউ বন্দে মাতরম ধ্বনি দিয়ে বিক্ষোভে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমার মনে হলো, পার্টির এ ফরমান একা আমারই উদ্দেশে। আমি বিলি করবার মতো কিছু ইশতেহার আর কয়েক বান্ডিল জনযুদ্ধ নিয়ে সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি শিলংয়ের বাসে চড়ে বসলাম।

বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। মাকে তেমন চিন্তিত মনে হলো না – দশের যা হবে, তাঁরও তাই হবে। ভগবানের অশেষ কৃপা  – নিরো দেশে নেই। দেশে থাকলে রেললাইনের ফিসপেস্নট উপড়াতে গিয়ে গুলি খেত নির্ঘাৎ। ও ভারতের বন্ধু, আগুয়ান মুক্তিদাতা জাপানিদের সঙ্গে নিরাপদেই আছে। মা ইকমিক চুলোয় ভালো-মন্দ রাঁধলেন সারাদিন। আমি স্নানাহার সেরে দিলাম লম্বা ঘুম। চোখ মেলে দেখি মেঝেতে বসে মা জনযুদ্ধের কপিগুলো উলটেপালটে দেখছেন। ঘোর বিপদ আসন্ন। তাড়াতাড়ি চোখ বুজলাম। চিৎকার শুনে উঠে বসতে হলো। ‘এসব কী?’ মা একেবারে ক্ষক্ষপে টং। ‘কমিউনিস্টদের আর কাজ নেই? নেতাজির সাপোর্টারদের পঞ্চমবাহিনী বলতে লজ্জা করে না ওদের?’

দুদিন পর বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, পার্টি অফিসে যাব, ‘এই অনিতা শোন’ বলে আমার স্কুল সহপাঠী উমা জানালা দিয়ে ডাকল। ওদের টিনশেডের বাড়িটা ছিল পাহাড়ের কোলে, রাসত্মা থেকে বেশ খানিকটা নিচুতে। ঘরের আকাশি নীল পর্দা-টানা জানালাটা ফুটপাত বরাবর। ওর ডাক শুনে আমি ঝুঁকে দাঁড়িয়েছি। ‘তোকে নাকি মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছিল? অ্যাবরশনও হয়েছে কোনো এক হসপিটালে?’ উমার কথা শুনে আমি রাসত্মার ওপর কেঁদে ফেললাম। ইঙ্গিতটা গোরা সৈন্যদের নিয়ে – সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি। সিলেটে থাকতেই শুনেছি – ইস্টিশনের আলো-আঁধারে যে নিরন্ন মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে, দালালেরা ওদের গোরা সৈন্যভর্তি বগিতে তুলে দেয়। আত্মরক্ষা কমিটির সঙ্গে 888sport promo codeর ইজ্জত রক্ষা আন্দোলনও ততদিনে জোরদার হচ্ছে।

উমার কথার রহস্য অবশ্য আরো পরে বুঝেছি। শিলং তখন দেশি-বিদেশি মিলিটারিতে ভর্তি। সেই সঙ্গে কিছু ব্রিটিশ, আমেরিকান কমিউনিস্টও আসে। গোপনে পার্টির সেলে মিট করে ওরা। একজনের নাম রবার্ট। সে আর্টিস্ট ছিল। খুবই আত্মভোলা। তার জন্য কোর্ট মার্শালে নানা রকম শাসিত্ম পেতে হয়েছে। আরেকজনের নাম ছিল জন বার্ড। সে কবি, আমেরিকান। এরা আমাদের অটোগ্রাফ দিয়ে গেছে। রবার্টের প্রেমে পড়ে রঞ্জিনী নামের যে মেয়েটি, সে এত মোটা ছিল যে, ওকে টেন হুইলার বলা হতো। রঞ্জিনীর নাকি রবার্টকে দেখলে ফ্রেঞ্চ গেরিলাদের কথা মনে পড়ত। সাহেবের সঙ্গে প্রেম, আমি শুনে বললাম, পার্টির বারোটা বেজে যাবে। জাপানিরা কোহিমা অব্দি চলে এলে রবার্টকে ফ্রন্টে যেতে হয়। ও ছিল ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডের এক প্রিস্টের সন্তান। নিজে কমিউনিস্ট, আর্টিস্ট। এরকম 888sport live chatীমনের কমিউনিস্ট ছেলেদের শিলংয়ে দেখা পেলাম সেইবার, যাদের যুদ্ধ করবার জন্য দূরদেশে পাঠানো হয়েছে।

যুদ্ধে মারা যায় রবার্ট। আমি যখন যুদ্ধশেষে দাদার খোঁজে কোহিমায় যাই, তখন ওয়ার সেমেটারিতে ওর কবরটা দেখি। তখনো কোহিমার পথের ধূলিবালিতে বুলেটের ছড়াছড়ি। টিনের বেড়া বুলেটের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। গাছের ডালপালা উড়ে গেছে ফিল্ডগানের গুলিতে। কোহিমাতে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে হাতাহাতি লড়াই হয়নি। সে বসিত্ম, ধানক্ষিত, মিলিটারি ক্যাম্প, পাহাড়ের খাঁজ – সর্বত্র। রাসত্মার ধারে, পার্কে, স্টেডিয়ামে যাদের 888sport app download for androidে 888sport sign up bonusস্তম্ভ, এরা সবাই দাদার প্রতিপক্ষের সৈনিক। তবু মৃত্যুপুরী অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়ালাম। আমি সদ্য পাতা সিঁড়ি দিয়ে যখন ওয়ার সেমেটারিতে উঠি, তখন বেলা পড়ে গেছে। সিঁড়ির দুধারে চওড়া চওড়া সিমেন্ট-বাঁধানো ধাপ, মাঝে কাঁচা মাটি। তাতে লেমন কালারের কচি ঘাস সবে মাথা তুলেছে। একেকটা ধাপে একেক রেজিমেন্টের সারিবদ্ধ কবর। প্রতিটা কবরের মাথায় একটা করে ক্রুশ। তাতে লেখা নিহত সৈনিকের নাম, রেজিমেন্টের নম্বর। ওখানেই রবার্টের কবরটা আমি গোধূলিবেলায় আবিষ্কার করি। ওর পদবিটা তো জানতামই। রেজিমেন্টের নামও অজানা ছিল না। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে, ফুল আনিনি বলে খুব আফসোস হচ্ছিল। পরমুহূর্তে মনে হলো – রবার্ট মারা যাবার আগে দাদার বুকে গুলি চালায়নি, কে বলতে পারে। প্রায় চার হাজার আইএনএ মারা গেছে এই কোহিমা-ইম্ফল ফ্রন্টে। কথাটা ভাবতেই মাথাটা ঘুরে ওঠে। টলতে টলতে উঠি শেষ ধাপে। ওখানে বিশাল খাড়া 888sport sign up bonusস্তম্ভের গায়ে লেখা – হোয়েন ইউ গো হোম, টেল দেম অফ আস, অ্যান্ড সে – ফর দেয়ার টুমরো, উই গেভ আওয়ার টুডে।

পশ্চিমিদের জন্য ‘টুডে’ই গোটা জীবন। দিন হিসেবে মৌজে বেঁচে থাকো। ভারতীয়দের কাছে দীর্ঘ জীবনও মৃত্যুতে শেষ হয় না। পূর্বজন্ম-পরজন্ম মিলিয়ে অনন্ত সেই জীবনের পরিসর। মা মারা গেছেন পরজন্মে দাদাকে কোলে ফিরে পাবার আকাঙক্ষা নিয়ে। সে-সময় দাদার নিরুদ্দেশের কষ্টটা আর ছিল না। যেটুকু যন্ত্রণা ছিল, তা শারীরিক – মৃত্যুযন্ত্রণা।

বিয়ালিস্নশের অক্টোবর মাসে মা ছিলেন অসম্ভব আশাবাদী। ছেলের গরবে গরবিনী মা আমার। স্বামীর জেলখাটাটা ছিল মহার্ঘ্য। আমি শিলং পৌঁছে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম – ভারতরক্ষা আইনে বাবাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন অনির্দিষ্টকালের কয়েদবাস। কংগ্রেসকে সাপোর্ট করা ছাড়া তিনি ভারত অ-রক্ষার কোন কাজটি করেছেন? শিলংয়ে রেললাইন নেই যে, বাবা লাইন উপড়েছেন। ডাকঘর পোড়ানো, ডাক-টেলিগ্রাফের তার কাটা বা তার চুরি করে কালোবাজারে বিক্রি – এসবও করেননি। তাহলে কেন? তিনি গান্ধীর অসহযোগের ডাকে সাড়া দিয়ে কোর্ট কামাই দিয়েছেন।

মক্কেলদের তাতিয়েছেন, যার যার এলাকায় গিয়ে থানা পোড়াতে, অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে, সৈনিকদের রসদ সাপস্নাই বন্ধ করবার জন্য যা যা করা দরকার – সব করতে। তা তা কী – প্রশ্ন করবার লোক কোথায় যে জবাব মিলবে! অগত্যা মেনে নাও অনির্দিষ্টকালের কয়েদবাস। বাবা যদিও ‘এ’ ক্লাসের রাজবন্দি, জেলখানার পাকা দালানে থাকতেন, বাড়ি থেকে দুধ আর ফলমূল ছাড়া অন্য কিছু অ্যালাউ করত না জেলার। ডায়াবেটিসের রোগী। আমরা চাইতাম তাঁর প্রোপার ডায়েট, যা কেবল ঘরের রান্না খাবারেই সম্ভব। বারকতক জেল-হাসপাতালে রাখার আবেদন করেও তখন ব্যর্থ হই। তারপর স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হলে তাঁকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সে-সময়কার কথা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে। চর্মরোগের চিকিৎসা চলছে ক্ষতস্থানে নারকেল ছোবড়া ঘষে আয়োডিন ঢেলে। অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন বাবা। এতটুকু উ-আ করেননি সে-সময়। রেডিও শোনাটা শুধু মিস করতেন।

বাবাকে জেল-হাসপাতালে দেখে বাড়ি ফিরবার পথে যেতাম পার্টি অফিসে। ওখানে তখন ‘আন্তর্জাতিকতা’র হাট বসেছে। শুধু দূরদেশের রেডিওবার্তা নয়, সশরীরে আন্তর্জাতিক যোদ্ধারাও হাজির। ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে এমন নিবেদিতপ্রাণ! রবার্ট, জন বার্ড কাউকেই জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হয়নি। আদর্শের টানে এসেছে। স্বভাবেও কেমন প্রাণবন্ত, খোলামেলা। ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় মেঝেতে বসে পড়ত। রঙের ডাববায় তুলি ডুবিয়ে আঁচড় টানত জনযুদ্ধের পোস্টারে। একই থালা থেকে লঙ্কা বেছে মুঠোভরে মুড়ি খেত। শিলংয়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠায় আমার আর রঞ্জিনীর স্কুলটিচার, পাড়া-পড়শি অনেকেই ছিলেন সাহেব-মেমসাহেব। ঘর থেকে পা বাড়ালেই চোখে পড়ত – পাইনের ছায়ায় গোরা নর-888sport promo codeর হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাওয়া, পেরাম্বুলেটরে ফুটফুটে শিশু, শেকলবাঁধা বুলডগ, ফক্সটেরিয়ান, স্পেনিয়েল। ওরা রাজার জাত। আমরা পরাধীন নেটিভ। গায়ের রং, খাদ্যাভ্যাস, কেতা-কায়দা সবকিছুতেই আমাদের যোজন যোজন ফারাক। রবার্টরা সেই দূরত্বটা যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। কমিউনিস্ট যে! আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী তো। আজকের গেস্নাবালাইজেশনের সঙ্গে তা মেলানো যাবে না। করপোরেট দুনিয়ার ভ্রাতৃত্ববোধের সঙ্গেও নয়। আমরা ছিলাম লড়াইয়ের মিতা। ব্যবসার পার্টনার নয়।

তা সত্ত্বেও উমার কথাগুলো আমি ভুলতে পারিনি। চোখের সামনে ভাসত ওদের জানালার আকাশি নীল নোংরা পর্দাটা। একদিন পার্টি অফিস থেকে ফেরার পথে রঞ্জিনীকে বললাম কথাটা। ও বিশেষ পাত্তা দিলো না। আমাকে তখন বাধ্য হয়ে বলতে হলো – ওর জন্য পার্টির দুর্নাম হচ্ছে, আমাদের চরিত্র হনন করছে লোকে। দেশি কোনো কমরেডকে ভালোবাসলে এমনটি হতো না, ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘বিদেশি বলে ভালোবাসা যাবে না কেন?’ রঞ্জিনী আমার সঙ্গে জেরা শুরু করে। ‘আমরা কি আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী নই?’ আমি বললাম – ‘আমাদের একটা সমাজ আছে তো!’ ‘তাতে কী। আমরা তো সেই সমাজের খোলনলচে বদলাতেই চাই।’ ‘যতদিন না বদলায়…’ বলতে গিয়ে আমি থেমে যাই। আমি কি সিলেটের কমরেডদের সঙ্গে থেকে কনজারভেটিভ হয়ে যাচ্ছি? শিলংয়ের স্টুডেন্টদের মধ্যে কাজ করে রঞ্জিনী। থাকেও আসামের রাজধানী শিলং শহরে। মনটা তাই এতটা আন্তর্জাতিকতামুখী। শরতের পাইনের ছায়ায় ওর পাশাপাশি হাঁটতে আমার খুব ভালো লাগছিল। জেলরোড-লাবান-বুলরোড – এসব জায়গার রাসত্মাগুলোতে খুব চড়াই-উতরাই। আর ও তো অসম্ভব মোটা। তাই চড়াই বেয়ে ওঠার সময় ওর কাঁধে হাত রেখে পেছন থেকে ঠেলছিলাম। উতরাইয়ের সময় সেভাবে পেছন থেকে টেনে ধরতে হচ্ছিল, যাতে গোল ড্রামের মতো ও গড়িয়ে না যায়। কষ্ট হলেও ও হেঁটে হেঁটে ঘাম ঝরিয়ে তখন সিস্নম হতে চাইছিল। ঢ্যাঙা-পাতলা রবার্টের সঙ্গে মানানসই হতে হবে তো। একই কারণে রাতের খাবার বাদ দেয় রঞ্জিনী। মুখে বলত অন্য কথা। আমিও সায় দিয়ে বলি – আইডিয়াটা মন্দ নয়। কত মানুষ না খেয়ে থাকে! আমাদের যদি সর্বক্ষণ পেটভরা থাকে, কেমন করে ভুখা ইনসানের কষ্ট বুঝব? আমার তখন রঞ্জিনীর প্রেমের গল্প খুব শুনতে ইচ্ছে করছিল। রবার্টের সঙ্গে কী কথা বলে, কী করে। কমরেড যতই রোমান্টিক হোন, রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk ছাড়া তার মুখে অন্য কোনো ভালোবাসার কথা শুনিনি কখনো। হাত ধরা তো দূরস্ত, চোখে চোখ পড়লে রাঙা হয়ে ওঠেন। তাও এক চোখ সামান্য ট্যারা বলে অনির্দিষ্ট সেই চাহনি। রবার্ট কি রঞ্জিনীকে মায়াকোভস্কির 888sport app download apk শোনায়, শোনো! যদি তারাগুলো জ্বলে ওঠে, তার মানে – কারো প্রয়োজনে? ওদের শারীরিক সম্পর্কই বা কতদূর? আমাকে কেন স্কুলফ্রেন্ড উমা রাসত্মায় দাঁড় করিয়ে অ্যাবরশনের কথা বললো?

রঞ্জিনী সরল হলেও স্বভাবে চাপা। তখন ওর সময়ই-বা কোথায় আমার সঙ্গে গল্প জমাবার! পরে ও যখন আমার দ্বিতীয়বারের কোহিমা সফরের সঙ্গী হয়, তখন লম্বা বাস জার্নিতে অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু তখন তো রবার্ট মৃত। কোহিমার ওয়ার সেমেটারির কচি ঘাস আর কাঁচা মাটির নিচে শুয়ে আছে।

 

ওয়ার সেমেটারি

হঠাৎ দেখলে ময়নামতি ওয়ার সেমেটারিকে ছবিতে দেখা কোহিমা, ইম্ফল, চাটগাঁরটার যমজ মনে হয়। একই চেহারায় চারটি সমাধিক্ষেত্র যেন বড়সড় কোনো প্রাকৃতিক তা-বে চার জায়গায় ছিটকে পড়েছে। ছবির মতো সাজানো টিকিটবিহীন দর্শনীয় স্থান। ফটো তোলায় নিষেধ নেই। পায়ে হাঁটার বাঁধানো পথ ছেড়ে ঘাসের কার্পেট না মাড়ালেই হলো। বা ফুল ছিঁড়ে, ডাল ভেঙে, চিপস, আইসক্রিমের খোসা ফেলে সমাধিক্ষেত্রটির অমর্যাদা যেন করা না হয়, তার জন্য এক-দুজন কর্মচারী ঘরোয়া পোশাকে টহল দিচ্ছে, যদিও সেমেটারির প্রবেশধারে এসব নির্দেশ বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের বরাত দিয়ে।

সাবিনা জড়ানো পদক্ষক্ষপে গেটের ধারের বিশাল তাম্রফলকের সামনে দাঁড়ায়। এ সমাধিক্ষেত্রে শায়িত – ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান, ভারতীয় তো অবশ্যই, চবিবশজন জাপানি যোদ্ধা। জাপানিরা হয়তো জখম হয়ে ধরা পড়েছে। তারপর ময়নামতি সামরিক হাসপাতালে আনার পথে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। সাবিনা ফের মৃত সৈনিকের তালিকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। ও কি আশা করছে – গিল্টি করা তাম্রপাতে আইএনএর মৃত ফৌজের 888sport free betটা থাকবে? বা সারবাঁধা সমাধিফলকের মোজাইক নকশায় তাঁদের নাম, মৃত্যুর সন-তারিখ, রেজিমেন্ট, জাতীয়তা? সাবিনার এ-সফর লক্ষ্যহীনই বলা যায়। গাঁয়ের বাড়িতে টানা সাতদিন থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে হয়তো। নাকি অন্ধের মতো অনিতা সেনের অনুকরণ? তা হবেও বা। বই পড়তে পড়তে প্রভাবিত হওয়াটা ওর ছোটকালের অভ্যাস – নীহার বানু তো আকছার তা বলে বেড়ান।

‘…ফর দেয়ার টুমরো, উই গেভ আওয়ার টুডে’ – এপিটাফ পড়ার সময় সাবিনার মনে হয় ওর সঙ্গে আরেকজনও পড়ছে। এখন না হলেও অতীতে তো সত্যিকারে পড়েছিল অন্য এক সেমেটারিতে, যখন ওটার কাদামাটি শুকায়নি বা কার্পেটের মতো ঘাস গজায়নি। সাবিনার ঘাড়ের কাছে সেই ‘আরেকজনের’ উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়া। আমাদের টুডের বিনিময়ে তোমাদের আগামী – কথাটা মৃত ও জীবিত উভয়ের জন্যই প্রতারণামূলক নয় কি! আর ওর এ-ভাবনাটাও কি পোড়-খাওয়া অনিতা সেনের মতো হয়ে যাচ্ছে না!

সাবিনা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে বিশালাকৃতির ক্রুশচিহ্নটা পেরিয়ে যায়। ঢুকে পড়ে এক তরুণ যুগলের সেলফিতে। ওরা মজা পেয়ে কানাকানি করে হাসে। শোকার্ত তো নয়ই, চেহারায় গির্জায় উপাসনাকারীর করুণ গাম্ভীর্যটুকুও নেই, যা শান্ত-মনোরম-নিপাট সমাধিক্ষেত্রটি আশা করে।

অনুচ্চ টিলার সবুজ সমতলভাগে আরো অনেক কবর, যা গুলমোহর, পাম, মেঘশিরিষ, কড়ই ইত্যাদি বৃক্ষসহ, বুনো ঝোপঝাড়ের কারণে চোখে পড়ে নাই। এ আড়ালটুকুর জন্যই হয়তো দর্শনার্থীর ভিড় তুলনায় এখানে বেশি। বেশিরভাগই সমাধিফলকের ফুটন্ত ফুলের ঝাড় সামনে রেখে ফটো তোলায় ব্যস্ত। দলের লোকদের বকাঝকাও করছে ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে। ছুটির দিনের ফুরফুরে মেজাজের তরুণ দর্শনার্থীর ভিড়ে নিজেকে আবিষ্কার করে সাবিনা অস্বসিত্মবোধ করে। ও আর তরুণ নয়, জোড়-বেঁধে আসেনি, ফুরফুরে মেজাজে নেই – এ সবের জন্য নয়, বরং তথ্যে ভারাক্রান্ত বলেই। গতরাতে ওর গুগল সার্চিংয়ে বেরিয়েছে – সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারে ভারতীয় ফৌজ ছিল ২৫ লাখের বেশি। যার একটা উলেস্নখযোগ্য অংশ হয়তো যুদ্ধে গেছে বেকারত্বের কারণে। বাঙালির মতো নন-মার্শাল জাতির ভলান্টিয়াররা কোনোভাবে শখের সৈনিক হতে পারে না। পেটের দায়ে যুদ্ধে গেছে। আসন্ন দুর্ভিক্ষও সেনাদলে যোগদানে প্ররোচিত করেছিল। তাছাড়া সব যুগেই কিছু বেপরোয়া ছেলেপেলে থাকে। মনটা ওদের এমন, যেন মাথার ওপর যুদ্ধ নয়, মেঘ দেখে ময়ূরের মতো পেখম মেলে দিয়েছে।

এভাবে ভাবলে, সাবিনার মনে হয়, এ সমাধিক্ষেত্রের তরুণদের প্রতি করুণা অনুভব করা যায়, তাঁরা যদিও ওর বাবার বিরোধীপক্ষ, বর্মার রণাঙ্গনে লড়াই করে শহীদ হয়েছে।

এ মৃত যোদ্ধাদের প্রতি মোয়াজ্জেম হকের মনোভাব কেমন ছিল, বিদ্বেষপরায়ণ না ক্ষমাশীল – আজ আর জানবার উপায় নেই।

 

‘তুমি কি মনে করো – মৃত মানুষের প্রতি শত্রম্নতা থাকে, সে যদি দুশমনও হয়?’ তিতু মামার পালটা প্রশ্ন শুনে সাবিনা ঠান্ডা পানির গেলাশ টেনে নেয়। ওয়ার সেমেটারি থেকে ওকে লোকাল বাসে কুমিলস্না শহরে আসতে হয়েছে। তারপর রিকশা ধরে ঠাঠা রোদে বাসা খোঁজাখুঁজি। বাগিচাগাঁও এলাকাটা তেমন বদলায়নি যদিও।

‘কত বছর পর মামার বাসায় আসছো, কও দেখি মেয়ে?’ প্রশ্নটা করে মামি হাসনা বেগমও হাল ছেড়ে দেন। কেউ মনে করতে পারে না – ও সবশেষ কবে এসেছিল। তাছাড়া এটা এমন কিছু জরুরি বিষয়ও নয়।

‘এ কি কম দিনের কথা! এর মধ্যে দু-দুবার দেশ বদলে গেল। বড় একটা যুদ্ধ গেল।’ খাবার টেবিলে মামা আগের প্রসঙ্গের জের ধরে বলেন। বউয়ের ঘনঘন বাগড়া দেওয়া সত্ত্বেও তিনি যে আববার জীবনের মৃত অধ্যায়, আজাদ হিন্দের আলোচনাটা আঁকড়ে আছেন – সাবিনার খুব ভালো লাগল। ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে এর সাজসজ্জাও যেন একটু একটু পছন্দ হচ্ছে ওর। বড় বড় সূর্যমুখী ছাপার জানালার পর্দা, কুশিকাঁটার লেসের টেলিফোনের ঢাকনা, বেতের চেয়ার, কুঁচিদার ঘোমটা পরানো সাদা-কালো টেলিভিশন, দেয়ালের কাবা শরিফ।

মামা ধার্মিক হয়েছেন সম্প্রতি। ছেলের হাতে তসবিহ, মাথায় গোলটুপি – হাজি চান জিন্দা থাকলে খুশি হওয়ার চেয়ে অবাকই হতেন বেশি। দুটি মেয়ে জন্মানোর পর তিনি মানত করেছিলেন ছেলে হলে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠাবেন। ছেলে এমন জাহিল, মাদ্রাসায় যাওয়ার নামে গায়ে ওর জ্বর আসত। পীড়াপীড়ি করলে বাড়ি থেকে যেত পালিয়ে। বিয়ের দিনেও একমাত্র শ্যালককে দেখতে পাননি মোয়াজ্জেম হক। তখন তিতু মিয়ার বয়স এগারো কি বারো, বিয়ের মজলিশে ছেলের অসুস্থতার কথা ঘটা করে জানানো হলেও কারো বুঝতে বাকি নেই – সে বর্তমানে পলাতক। পরের বার গিয়ে দেখেন বান্দা হাজির। তবে অসম্ভব দুরন্ত আর বাচাল। আজাদ হিন্দ নিয়ে প্রশ্ন করে করে নয়া দুলাকে অস্থির করে তুলছিল।

‘দুলাভাই, এ নিয়ে কথা বলা পছন্দ করতেন না।’ তিতু মামা পাকা দাড়িতে খিলাল করতে করতে বলেন। সাবিনা কোল থেকে হাতব্যাগ নামিয়ে বেতের সোফায় হেলান দেয়। ও জানে তা। কিন্তু আববার যুদ্ধকালীন নোটবইটা তো মামাকে পড়তে দিয়েছিলেন। হয়তো অস্থির বা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে। ওটা কি নীহার বানুকে দেওয়া যেত না? এ নিয়ে কদিন ধরে ভেবে ভেবে সাবিনা অস্থির – তিনিও তো তখন নববিবাহিত স্বামীর অতীত জানতে মোয়াজ্জেম হককে ত্যক্ত-বিরক্ত করছিলেন! মোয়াজ্জেম হক বুদ্ধির বলিহারি। বউকে শরৎচন্দ্রের পথের দাবী উপহার দিয়ে নোটবইটা দিলেন ঘর-পালানো শ্যালককে, যে আবার লোহার সিন্দুক থেকে রুপার সিক্কা, সোনার মোহর সরিয়ে হাজি চানের পূর্বপুরুষের রত্নভাণ্ডার সেই বয়সেই ফাঁক করে দিয়েছিল। যা গেছে গেছে, এখন আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তখন নোটবইটা পড়ে থাকলে মামার যদি কিছু মনে থাকে, সে আশায় অডিও রেকর্ডার সঙ্গে নিয়ে এসেছে সাবিনা। ওটা চেইন তোলা হাতব্যাগে আছে। বের করার মওকা মিলছে না।

‘তখন তো পাকিসত্মান হয়ে গেছে।’ তিতু মিয়া বলেন, ‘সহযোদ্ধারা প্রায় সব ওইদিকে। দুলাভাইয়ের সম্ভবত মনটাই ভেঙে গেছিল।’

দেশ ভাঙা, মন ভাঙার গল্প তো অনেক। আর যাই হোক মোয়াজ্জেম হককে তো নিজের দেশ ছেড়ে রিফিউজি হতে হয় নাই! শুধু দেশের নামটা পালটে গিয়েছিল, আর অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে গিয়েছিল। তারপর আরো ছোট সাবিনাদের সময়ে। এ নিয়ে তো মনে কোনো খেদ নেই! স্বাধীনতাই বড় কথা। আর এ-স্বাধীনতার জন্য কম লোক জীবন দিয়েছে? এই ময়নামতি সেনানিবাসেই তো ’৭২ সালে গণকবর আবিষ্কার হয়েছে। তাঁদের 888sport app download for androidে 888sport app-চাটগাঁ হাইওয়ের পাশের 888sport sign up bonusসৌধটি, যার মাইলখানেক দূরত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেমেটারি – ঔপনিবেশিক শাসকের ভাড়াটে ফৌজদের পুষ্পিত কবর।

‘ওরা সবাই ভাড়াটে কিনা – তোমার আববারে জিগাও।’ সাবিনাকে রাগতে দেখে হাসতে হাসতে বলেন তিতু মামা। তাঁর অনুমান ওখানে আজাদ হিন্দ ফৌজ, যাদের তখন ডাকা হতো জিফস – জাপানি-ইন্ডিয়ান ফিফথ কলাম বলে, ওরাও আছে। মারাত্মক আহত হয়ে বা অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় হয়তো ধরা পড়ে মারা গেছে। তাছাড়া দুদিক থেকেই আসা-যাওয়ার স্রোত ছিল তখন। জাপানি বিমান থেকে লিফলেট-পুসিত্মকা ফেলা হলে যেমন ব্রিটিশপক্ষ ছেড়ে আজাদ হিন্দে গেছে, যুদ্ধের শেষাবস্থায় মিত্রপক্ষেও এসেছে। প্রলোভন তো ছিলই। আর বুঝতেও পারছিল যে, হেরে যাচ্ছে। খাবার পাচ্ছে না, ওষুধ পাচ্ছে না, পায়ে জুতা নেই, ইউনিফরম ছেঁড়া। বাঁচার জন্য মানুষ কী না করে!

‘প্রলোভনে পড়েছিল ‘জিফস’রা?’

‘কেন জিফসরা মানুষ না?’ মামা বিরক্ত হয়ে পুনরাবৃত্তি করেন, ‘বাঁচার জন্য মানুষ কী না করে!’

‘তাঁদের তাজিমসহকারে গোর দিয়েছে ব্রিটিশরাজ?’

‘কেন জাপানিদের দেয় নাই! মরার সঙ্গে শত্রম্নতা কী?’

‘এসব আপনি আববার নোটবইয়ে পড়েছেন?’ ঝোপ বুঝে কোপ মারা সাংবাদিকের স্বভাব। তবু সাবিনাকে রেকর্ডারের দিকে হাত বাড়িয়ে ব্যাগের চেইন বন্ধ করে দিতে হয়। এত বছর আগে কী পড়েছেন – মামার মনে নেই। আর এসব মামুলি তথ্য এমনিই জানা যায়, যুদ্ধফেরত সৈনিকের নোটবই পড়বার দরকার হয় না।

তিতু মামা আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলে মামি হাসনা বেগম চা নিয়ে আসেন। এখনো বেশ শক্ত-সমর্থ, শরীরের বাঁধুনিও মজবুত। তিনি টেবিলে চা রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলে ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢোকে। নিচু দেয়ালের গা ঘেঁষেই রাসত্মা। গাড়ির বিশেষ আনাগোনা নেই। অবিরাম রিকশা চলে। একসময় কুমিলস্নার রিকশার খুব নাম ছিল, প্রশস্ত সিট আর রঙিন নকশার জন্য – সাবিনার মনে পড়ে।

‘তোমার বাচ্চা কেমন আছে?’ মামির প্রশ্ন শুনে সাবিনার কাপের চা ছলকে ওঠে। একটু আনমনা ছিল বোধ হয়।

‘ভালো। সে আর বাচ্চা নাই। অস্ট্রেলিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতে গ্র্যাজুয়েশন করে চাকরির ধান্দা করছে।’

‘তোমার আগের সংসারের ছেলেই তো?’

‘আমার না, আমার হাজবেন্ডের।’

‘তোমারে মা-ই তো ডাকে?’

‘না, আন্টি।’

তারপর আবার কি না কি জানতে চান, সে সুযোগ হাসনা বেগমকে দেওয়া যাবে না। সাবিনা বাড়িটা ঘুরে দেখার নাম করে উঠে পড়ে। সামনে একচিলতে বাগানের পরই রাসত্মা। তাও অযত্নে বেড়ে ওঠা কয়েক পদের পাতাবাহারের গাছ ছাড়া বাগানে কিছু নেই। বাসার বাউন্ডারি দেয়ালে কাঁথার মতো লতানো মানিপস্ন্যান্টের আচ্ছাদন নিয়ে বলারই বা কী আছে। গাছের ছায়া পেলে ও এমনিই হয়। ওরা দুটি কামরা পেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকটায় যায়, যা বাঁশঝাড় আর বড় বড় ফলগাছে, ঝোপঝাড়ে দিনের বেলায়ও অন্ধকার হয়ে আছে। কাঠবিড়ালি নয়তো বেজি শুকনো পাতায় মচমচ করে জঙ্গলের ভেতরে দৌড়ে চলে যায়। ছেলেমেয়ে দুটি কাছে থাকে না, কাজের বাঁধা লোকও নাই, মামা মসজিদে বা বাজারে গেলে হাসনা বেগমের ভয় করে না?

‘ভয় কি, আলস্নার থাকতে?’ বলে হাসনা মামি হাসেন।

তিনি এতটা আলস্নাভক্ত সাবিনার জানা ছিল না। ও জানত – হাসনা বেগমের বাপের বাড়ির মেয়েরা তিন জেনারেশনের শিক্ষিত। দাদি অবসরে পুঁথি নকল করতেন। কবি আলাওলের পদ্মাবতী অনুলিপি করেছেন যখন, পেটে ভালোই বিদ্যা ছিল। তখন তো ছাপা বইয়ের খুব আক্রা। অবশ্য তাঁর একটা বদখেয়াল ছিল – হাসনা বেগম পান রাঙানো ঠোঁট নেড়ে বলেন, সামনে যা পেতেন কলম-দোয়াত নিয়ে নকল করতে বসে যেতেন।

একে কি বদখেয়াল বলা যায়? সাবিনা বাঁকা করে হাসে – হাসনা বেগমের দাদা বা বাবা-চাচারা বলতেন হয়তো। ঘরে এমন নকলনবিশ মহিলা থাকলে, পুরুষের যত্নআত্তির খামতি তো হয়ই।

‘তুমি বিশ্বাস করবা কি না জানি না,’ সাবিনাকে অবাক করে দিয়ে বাংলায় অনার্স হাসনা বেগম বলেন, ‘দাদির বদখেয়াল আমিও পাইছি।’

‘তার মানে পুঁথি নকল?’

পুঁথি আর এ যুগে কই। ক্যারিয়ারের শুরুতে তিতু মামা যখন লোয়ার কোর্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট জাজ ছিলেন, যখন তাঁর স্টেনোগ্রাফার ছিল না, তখন হাসনা বেগম বিচারের রায়ের অনুলিপি করতেন। মামার হাতের লেখা খারাপ বলে তাঁর কষ্টই হতো কাজটা করতে। যেদিন ফাঁসির রায় নকল করতেন, সে রাতে ঘুম হতো না। মনে হতো তিনিও পাপের ভাগীদার। খুনখারাবি যাই করুক, লোকটাকে তো বিচারের এজলাস বসিয়ে ঠান্ডা মাথায় সেই খুনই করা হচ্ছে।

সাবিনা চট করে হাসনা বেগমের মুখের দিকে তাকায়। মনে হয় না – এ ধার করা বুলি। ফাঁসির রায় নকল করতে করতে যে কারো এমন উপলব্ধি হতেই পারে। সাবিনা এক জলস্নাদের ইন্টারভিউ করেছিল, যে মৃত্যুদ–র ঘোরবিরোধী। তবু হাসনা বেগমের মুখে এমন কথা শুনবে ও আশা করেনি। একে গায়ে পড়া স্বভাব, হিসাব করে কথা কন না বলে সবাই তাঁকে এড়িয়েই চলে।

মসজিদ থেকে মামার আসতে দেরি হচ্ছে। সাবিনারও বাড়ি ফেরার অসম্ভব তাড়া। হাসনা মামি যেন এ দুইয়ের মাঝখানে গল্প জুড়ে দিয়ে মধ্যস্থতা করছেন। রান্নায় হাতযশ না থাকলেও আপ্যায়নে ত্রম্নটি নেই। দুপুরে টেবিলভর্তি খাবার ছিল। কথা বলতে বলতে দেয়ালের উঁচু তাক থেকে তেঁতুলের আচার, বরইয়ের আচার নামাচ্ছেন। কোনোটারই তেমন স্বাদ নেই, তার ওপর বয়মের ঢাকনার গায়ে ছাতা পড়া। এমন মানুষের হস্তলিপি কেমন কে জানে?

তা তা কাগজে বিচারের রায়ের অনুলিপি শুধু নয়, হাসনা বেগমের অভ্যাসটা এমন দাঁড়ায় যে, দুই খ–র শ্রীকান্তও নকল করেন, যার কোনো দরকার ছিল না। আরেকটা দরকারি অথচ বিবর্ণ নথি, জায়গায় জায়গায় কালি লেপ্টে হরফগুলি ঢেকে গেছে, তারও অনুলিপি করেছেন, যখন চোখের দ্যুতি ভালো ছিল। তিনি আমের মোরববার ঘন শিরা চামচে তুলতে তুলতে বলেন, ‘বুঝছ তো মেয়ে, লেখাটা তোমার আববার!’

‘আববার নোটবই?’

‘নোটবই না কী, পড়া যাচ্ছিল না। অনুমান করে করে লিখতে হইছে।’

আজ অর্ধেক দিন মামার অনুমানের কথাই শোনা হলো। আজাদ হিন্দ নিয়ে মামির অনুমানটা কেমন, কে জানে। তবু এর নকল যদি পাওয়া যায়!

সে এক কা-, খড়ের গাদায় সুই খোঁজার মতো। বাদআসর মসজিদ থেকে ফিরে মামাও নোটবইয়ের তালাশে নেমে পড়েন। ছেলেমেয়ের বেবিক্লাস থেকে বিএ-এমএ পর্যন্ত যাবতীয় পাঠ্যবই, 888sport app দরকারি-অদরকারি কাগজ, অনুলিপিকর্ম সব স্টোররুমে তালা মেরে রেখেছেন হাসনা বেগম। বই নাকি এমন বিদ্যা, যা বেচতে নেই। বেপারীরা ঠোঙা বানিয়ে এর অমর্যাদা করে।

এ তো পাগলের মতো কথা! তবু এ পাগলেরা আছে বলেই, সাবিনা হাসনা মামিকে সহাস্যে সাধুবাদ জানায় – দুনিয়াটা এখনো টিকে আছে।

বাচ্চাদের দুটি মলাটহীন রুলটানা পাতলা খাতায় মোয়াজ্জেম হকের নোটবইয়ের অনুলিপি। সাবিনা আর খুলে দেখে না। তখনই ব্যাগে ভরে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। r (চলবে)