আনিসুজ্জামানকে এ-সময় পৃথিবীর খুব দরকার ছিল। এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন প্রযুক্তি আমাদের হাতের মুঠোয় আর কুসংস্কার আমাদের হৃদয়ে গেড়ে বসেছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আজ মুহূর্তে ছড়ানো যায় অবৈজ্ঞানিক গুজব, ঘটানো যায় ভয়াবহ রক্তপাত।
এই সময়ে আনিসুজ্জামানের প্রয়াণ খুব বড় ক্ষতি করে দিলো 888sport appsের, ভারতবর্ষের। এটা বললেও অত্যুক্তি হবে না, গোটা পৃথিবীর ক্ষতি হলো তাঁর প্রয়াণে, কারণ কে না জানে মৌলিক ভাবনা ও মুক্তচিন্তা কোনো দেশের মানচিত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না।
আনিসুজ্জামান আদতে একাধারে যেমন ছিলেন 888sport appsের গর্ব, ভারতবর্ষের সুহৃদ, অন্যদিকে তাঁর হৃদয়ে অবশ্যই ছিল আন্তর্জাতিক এক মানুষ। যে-মানুষটি সমস্ত দেশের মানচিত্রকে অতিক্রম করার মতো উদার ও মানবিক। তাঁর লেখায় বরাবর পেয়েছি একটা নির্মেদ আন্তর্জাতিকতার নিশানা।
বাঙালির আত্মপরিচয় গ্রন্থটি তিনি শুরুই করেছেন এইভাবে – “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) গোরা (১৯১০) 888sport alternative linkের নায়ক নিজেকে সগর্বে হিন্দু বলে প্রচার করে বেড়িয়েছিল যতক্ষণ না সে জানতে পারে যে আসলে সে আইরিশ পিতা-মাতার সন্তান – ভারতের সকল মন্দিরের দ্বার তার কাছে রুদ্ধ।’ প্রচণ্ড হতাশার মধ্যেও খানিকটা স্বস্তি লাভ করে গোরা তখন ঘোষণা করে : ‘আমি যা দিনরাত্রি হতে চাচ্ছিলুম অথচ হতে পারছিলুম না, আজ আমি তাই হয়েছি। আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত, সকলের অন্নই আমার অন্ন।’ 888sport alternative linkে যদিও কথাটা সেভাবে বলা নেই, গোরা আরেকটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারত, সে এখন প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে, তা ভারতবর্ষীয় নয় বা কেবল ভারতবর্ষীয়ই নয়, বরং জাতধর্ম-দেশকালের সীমানা পেরোনো মানুষ – বিশ্ববাসী।” এখানে আনিসুজ্জামানের নিজস্ব কণ্ঠস্বর এই বিশ্লেষণের মধ্যে কিন্তু আমরা শুনতে পাচ্ছি। তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গোরা একটু তলিয়ে ভেবে দেখলেই বুঝতে পারত যে সে একজন দেশকালের সীমানা পেরোনো বিশ্ববাসী, মানুষ।’ এই পরিচয়টা যে কতবড় আত্মপরিচয় আর কত বড় দায়িত্ব এ-কথা তিনি বারবার আমাদের মনে করিয়েছেন। মানুষ থাকার দায়িত্ব যে সব থেকে গুরুদায়িত্ব এবং মানুষ হবার পরিচয়টা যে আমাদের সমস্ত পরিচয়েরই ভিত্তি বাঙালির অস্তিত্বের শিকড় খুঁজতে গিয়ে তিনি কথাটি প্রথমেই তাই পাঠককে মনে করিয়ে দেন।
আনিসুজ্জামান একদিকে স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধ – তিনি দেশকে ভালোবাসতেন, সেই তিনিই ভারতের বন্ধু, এবং পৃথিবীর একজন আন্তর্জাতিক মুক্তচিন্তক নাগরিক। তিনি বহুবার বলেছেন, লিখেছেন যে, ‘একজন মানুষ একসঙ্গে অনেককিছু হয়।’
তিনি কলকাতায় একটি বক্তৃতায় একবার বলছেন, সেখানে আমি শ্রোতা ছিলাম। সেটা টাউনহলে ১৯৯৯ সালের কথা। তিনি বলছেন, ‘মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব দেশকে দুর্বল করে, পৃথিবীকে সমস্যায় ফেলে। 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধটা সেইজন্য পৃথিবীর পক্ষে একটা স্বাস্থ্যকর আন্দোলন ছিল কারণ ওটা ছিল একটা দেশের প্রভুত্ববাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে অনেক মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ। আমাকে তুমি দাবিয়ে রেখে দেবে এটা আমি মানব না, কোনো জনজাতিই মানবে না। এই দাবিয়ে রাখার ঘোরতর বিরোধী বলেই মুক্তিযুদ্ধের পথকে আমি মন থেকে ঠিক মনে করেছি।’ তিনি এমন একটা পৃথিবীকে আদর্শ মনে করতেন যেখানে কেউ কারুর ওপর প্রভুত্ব করবে না।
তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্র কখনো অন্তিম গন্তব্য বা মানবসভ্যতার মূল উদেশ্য নয়। রাষ্ট্র হলো মানবকল্যাণের একটি উপায় মাত্র। কিন্তু কীভাবে মানবকল্যাণ করবে রাষ্ট্র? আনিসুজ্জামানের কথায়, ‘মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তির মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্থাৎ জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় জগতের মুক্তি মানবকল্যাণের জন্যে প্রয়োজনীয়।’
ধর্ম নিয়ে যখন কথা বলতেন বোঝাতেন যে, ধর্ম কোনো বদ্ধ জলাশয় নয়, তা প্রবহমান নদীর মতো। বলতেন, ‘ইসলামে যে যুগে যুগে নবী-রাসুল পাঠানো হয়েছে তার তাৎপর্য হলো সময়ের সঙ্গে ধর্মের বহমানতা, হিন্দু ধর্মেও দেখবেন বিভিন্ন যুগে বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের কথা বলা আছে। এই যে যুগে যুগে নবী আসছেন, অবতার আসছেন এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে ধর্ম কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলাবে।’
বাংলাভাষার জন্য লড়াইয়ে সরাসরি যোগ দেন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পুরোধা ছিলেন অথচ উচ্ছ্বাসবর্জিতভাবে বর্ণনা দিয়েছেন যুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এত পুঙ্খানুপুঙ্খনুভাবে লিখলেন যে তাঁর একখানি গ্রন্থ পাঠ করলেই 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৃথিবীর পাঠকের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। যুদ্ধের প্রতিটি দিনরাতের রুদ্ধশ্বাস ডিটেইল যে-কোনো বিশ্বমানের তথ্যচিত্রকে হার মানাবে। ফিকশন লিখতেন না আনিসুজ্জামান; কিন্তু এত তথ্যকে উচ্ছ্বাসবর্জিত অথচ মনোগ্রাহী করে উপস্থাপনার তাঁর যে-টেকনিক তা অনেক কাহিনিকারের কাছে শিক্ষণীয় মনে হতে পারে। উচ্ছ্বাসবর্জিত তাঁর বর্ণনা কিন্তু কী অপরূপ স্তিমিত নির্মেদ আবেগ তাঁর বর্ণনায় – ২৯ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দখল করে নেয় চট্টগ্রামের খানিকটা অংশ, ক্রমাগত হামলা চালাতে থাকে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। যে-কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারেন আনিসুজ্জামানদের মতো মুক্তিযোদ্ধারা।
আর সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের অর্থ নৃশংস অত্যাচার ও অসম্মানজনক মৃত্যু। আনিসুজ্জামান তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছেড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যে চলে যাচ্ছেন ত্রিপুরার আগরতলার গোপন আস্তানায়। সেই চলে যাওয়ার বর্ণনায় তিনি লিখলেন, ‘ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পড়ে একবার পেছন ফিরে তাকালাম, সুউচ্চ ভবনগুলো দেখা যাচ্ছে। কেবল 888sport sign up bonus নয়, অনেক কিছু ফেলে যাচ্ছি। ভাবছি আরেকবার এসে কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে যাব। আবার ভাবছি, ফিরে আসতে পারব তো? পারলেও তা কবে – সে-জিজ্ঞাসার উত্তর জানা ছিল না।’ (আমার একাত্তর)
আমরা যখন আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাই, তখন মনে হয় যে, কত জরুরি জিনিস নেওয়া হলো না; আর সেই বাড়ি ছাড়া যদি এমন হয় যে আর বেঁচে বাড়ি ফিরব কি না জানি না, তখন তো এটাই মনে হয়, আর ফিরতে পারব তো? কত কী পড়ে রইল! তাঁর জ্ঞান কখনো তাঁর মর্মস্পর্শী আন্তরিক মনের অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। কারণ জ্ঞানটা তাঁর ছিল খাঁটি। আর জ্ঞানকে তিনি কখনো বদ্ধ কুয়োর মতো অপরিবর্তনীয় মনে করেননি। পরিবর্তন জ্ঞানের ধর্ম – এটা শেখা তাঁরই গ্রন্থ পাঠ করে। জ্ঞান তাঁর বর্ণনা থেকে মেদটা ঝরিয়েছিল; কিন্তু তাঁর আন্তরিকতাকে ঢেকে দেয়নি।
আমরা অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভারতবর্ষ বা 888sport appsের সমস্ত মানুষ, যারা বাংলা পড়তে পারি, তারা যদি আনিসুজ্জামানকে গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে ভূখণ্ডের চেহারাটায় আজ শুভ পরিবর্তন দেখতে পেতাম সকলে।
বলতেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বিদেশি শক্তির হাত থেকে মুক্ত হলেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। দেশে স্বাধীন পরিবেশ তৈরি করবার দায় এখন ভারত 888sport appsসহ প্রায় প্রত্যেকটি দেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর ন্যস্ত রয়েছে।’ 888sport promo codeশক্তিতে এত বিশ্বাস করতেন যে, মনে করতেন 888sport appsের সর্বত্র মুক্তচিন্তার প্রভাব আসবে মেয়েদেরই হাত ধরে। কারণ কুসংস্কার, হানাহানি সবচেয়ে ক্ষতি করে মেয়েদের।
888sport appsের প্রধানমন্ত্রী মাননীয়া শেখ হাসিনা তাঁকে এবং তাঁর দর্শনকে যথোচিত মর্যাদা দিয়েছেন – এই কথাটি উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে, অনেক সময় এমন হয় না, আনিসুজ্জামানের মতো ব্যতিক্রমী চিন্তাবিদদের ভয় পেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রশাসকরা তাঁদের দমিয়ে দিতে চেষ্টা করেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এই ভূখণ্ডের অশেষ সৌভাগ্য যে সেটা এক্ষেত্রে হয়নি। আনিসুজ্জামান রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত মর্যাদা পেয়েছেন। ফলত আমাদের মতো অগণিত পাঠককুল তাঁর গ্রন্থ এবং তাঁর চিন্তার কাছাকাছি আসতে পেরেছি অনেক সহজে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আনিসুজ্জামান অনেকের মতো আমারও আনিসদা হয়ে গিয়েছিলেন। এত দেশ-বিদেশের বিরল সম্মানে যিনি ভূষিত তিনি, তবু আমার ছোট পত্রিকা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অর্পণ করা ‘প্রথম আলো সম্মান’ গ্রহণ করেছিলেন তাঁর চিরাচরিত আন্তরিক উষ্ণতায়। আনিসুজ্জামান আচরণে ছিলেন অ্যারিস্টোক্র্যাট। তাঁর লেখার মতো তাঁর ব্যবহারেও উচ্ছ্বাস-আতিশয্য ছিল না; কিন্তু হৃদয়-স্পর্শ-করা আন্তরিকতার উত্তাপ ছিল একশভাগ। তাঁর প্রয়াণে আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন শিক্ষককে ও দাদাসুলভ আন্তরিক স্নেহময় মানুষকে হারালাম, তাঁর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি উজ্জ্বল মুহূর্ত 888sport sign up bonus হয়ে রইল; কিন্তু তাঁর মতো করে তাঁর ভাষায় বলতে পারি যে, তাঁর প্রয়াণের পর ব্যক্তিগত 888sport sign up bonus ছাড়াও আমাদের জন্য রইল অনেককিছু। তাঁর চিন্তার কিছু স্পর্শ থেকে গেল আমাদের কাছে।
একজন ভারতবাসী হিসেবে আমি আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে নতমস্তকে তাঁকে প্রণাম জানাচ্ছি কালি ও কলম পত্রিকার মাধ্যমে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.