বেড়াল অথবা বিড়াল
যা বিড়াল তাই বেড়াল। স্থানভেদে, জিহ্বাভেদে বেড়াল বিড়াল হয়ে যায়। কোথাও-কোথাও এই বিড়াল ভাষাতত্ত্বের রহস্যময় কারণে বিলাই নামে পরিচিত। এর চেয়েও বড় কথা, খাঁটি বাঙাল দেশে এই বেড়াল কিংবা বিড়াল কী করে মেকুর হয়েছিল?
অনেকদিন আগে আমি একটা গল্প বলেছিলাম আপনাদের, মনে আছে কি-না বলতে পারব না, সেই জন্যে আপনাদের অনুমতি নিয়েই সত্যঘটনামূলক গল্পটির সামান্য সারাংশ নিবেদন করছি।
এক বাড়িতে নবনিযুক্ত প্রাইভেট টিউটর বাড়ির শিশুটিকে ছবিছড়ায় জীবজন্তুর বই খুলে পড়াচ্ছেন, ‘এই দেখছো ব’য়ে হ্রস্ব-ই বি, ড়’য় আকার ড়া আর ল, এই হলো মেকুর।’
ভয়াবহ সমস্যা। শিক্ষক মহোদয় বঙ্গভূমির যে-অঞ্চল থেকে এসেছেন, সেখানে বেরাল বা বিড়ালকে ‘মেকুর’ বলে। সুতরাং বানান যা-ই হোক শিক্ষক ভদ্রলোক নিজেকে নিরস্ত করতে পারেন না ‘মেকুর’ বলা থেকে। মুখে উচ্চারণ করছেন বটে ব’য়ে হ্রস্ব-ই ইত্যাদি, কিন্তু চোখে দেখতে পাচ্ছেন ছবিতে যে- জন্তুটা রয়েছে সেটা স্পষ্টতই আশৈশব পরিচিত মেকুর নামক জীব। তাই উচ্চারণের বানান ব+ই, ড়+আ, ল এইসব বলছেন বটে, কিন্তু পুরো শব্দটা যেমন দেখছেন, যেমন জানেন, বলছেন, ‘মেকুর’।
সমস্যা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাড়ির যিনি কর্তা, প্রাক্তন 888sport appনিবাসী বঙ্গজ কায়স্থ, যিনি উচ্চারণে 888sport appই টান সযত্নে এবং সগর্বে রক্ষা করে যাচ্ছেন, তাঁরই পুত্রকে শিক্ষক মহোদয় পড়াচ্ছিলেন। ভদ্রলোক আবার বিড়াল-বেড়াল-মেকুর কিছুই জানেন না। তিনি জানেন বিলাই।
সেদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে দাড়ি কামাতে কামাতে তিনি পুত্রের পঠন-পাঠন শুনছিলেন। হঠাৎ শুনলেন, ‘ব’য়ে হ্রস্ব-ই বি, ড়’য়ে আ-কার ড়া আর ল, মেকুর।’
ভদ্রলোকের হাত থেকে রেজার পিছলিয়ে গিয়ে ব্লেডে গাল কেটে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি উঠে গিয়ে শিক্ষক মহোদয়ের হাত থেকে ছেলের বইটা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘স্পইষ্ট দেইখতেছেন বিলাইয়ের ছবি আর কইতেছেন মেকুর! কেমন ম্যাস্টার আপনে?’
মানুষ-শিশুর বিড়াল নিয়ে পড়াশুনোর গল্পের পরে বিড়াল-শিশুর পড়াশুনোয় যাই।
বিড়ালের চেয়েও মানুষ অনেক বেশি পছন্দ করে বিড়ালছানাকে। লাফ-ঝাঁপ, খেলাধুলো খুবই চমকপ্রদ, খুবই আকর্ষণীয়। সে বাড়িশুদ্ধ সবাইকে মুগ্ধ, মোহিত করে রাখে। কিন্তু একদিন সে-ও তো বড় হবে, হয় মাথা-মোটা, কান-ছেঁড়া হুলো হবে, নাহয় ছিঁচকে মেনি হবে। রসিক কবি ঙমফবহ ঘধংয বলেছিলেন না,
The problem with every kitten is that,
Eventually it becomes a cat.s
বিড়ালছানার আকর্ষণ বড় বেশি। আরম্ভ করেছিলাম বিড়ালের লেখাপড়া নিয়ে, আটকে গেলাম বিড়ালছানায়।
ইচ্ছে হলে বিশ্বাস করবেন, ইচ্ছা নাহলে বিশ্বাস করবেন না। এই ধরনের একটা গল্প বলি। গঙ্গারামের গল্প।
রাস্তা দিয়ে একটা বিড়াল যাচ্ছিল, হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে এক দঙ্গল রাস্তার কুকুর তাড়া করে এলো। বিড়ালটার ঘাবড়িয়ে যাওয়ার কথা, দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার কথা, কিন্তু সেসব চিরাচরিত আচরণ না করে সে সরাসরি পিছনের দুপায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে অবিকল কুকুরের গলায় ঘেউ ঘেউ করে গর্জন করতে লাগল।
কুকুরেরা এ-রকমটা আশা করেনি। তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যে যার মতো ল্যাজ গুটিয়ে পালাল।
আমার সহোদরপ্রতিম সুহৃদ গঙ্গারাম ওই পথে যাচ্ছিল। সে এইসব ঘটনাবলির সাক্ষী।
বিড়ালটি পাড়ার লোক হিসেবে গঙ্গারামকে বিলক্ষণ চেনে। সে গঙ্গারামকে বলল, ‘দেখলেন তো, কেমন ঘেউ ঘেউ করে কুকুরদের তাড়িয়ে দিলাম।’ বিড়ালটির মুখে পরিষ্কার বাংলা ভাষা।
অধিকতর অবাক হয়ে গঙ্গারাম বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’
‘কিছু নেই বোঝার’, এই বলে গঙ্গারামের সঙ্গে বিড়ালটি এরপর গঙ্গারামের বাসায় এসে সোফায় বসে পুরো দুঘণ্টা একাধিক ভাষা শেখার কী সুবিধে সেটা বলে গেছে।
কয়েকদিন হলো গঙ্গারামের স্ত্রী গঙ্গামনি পাড়ার এক বাড়ি থেকে একটা বিড়ালছানা এনে পুষছে। মেয়ে বিড়ালছানা, মানে মেনি বিড়াল। এখনো তার নাম রাখা হয়নি, ‘মেনি’, ‘মেনি’ বলেই তাকে ডাকা হয়।
সে মেনি বিড়ালছানাকে নিয়ে এই ভাষাবিদ বিড়ালটি কোথায় যে উধাও। গঙ্গামনির মন খুব খারাপ। গঙ্গারাম তাকে বোঝায়, ‘তোমার মেনি শিগগির ফিরবে। ওকে ভাষা শেখাতে নিয়ে গেছে। শিখলেই ফিরবে।’
সত্যিই মেনি দুদিন পরেই ফিরল। ফিরেই গঙ্গামনিকে নাকি বলেছে যে, ‘তোমরা ইংরেজি কিছু বোঝ না। আমি হলাম গিয়ে একা আর তোমরা বল কি-না মেনি (সধহু)।’
এইরকম উদ্ভট গল্প বলে আমাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে গঙ্গারাম ‘কাজ আছে’ বলে চলে গেল।
দুদিন পরে আবার এলো। তার হাতে একটা ছোট সাইনবোর্ড, তাতে লেখা, ‘ইবধিৎব ড়ভ ফড়মং’।
আমি তাই দেখে বললাম, ‘সে কী, তুমি কুকুরও পুষছো নাকি?’
গঙ্গারাম বলল, ‘না, কুকুর পুষছি না, কিন্তু এই নোটিশটা টাঙাচ্ছি পাড়ার বিড়ালদের ভয় দেখানোর জন্য। মেনি আসার পর থেকে বাসায় এত উৎপাত বেড়ে গেছে পাড়ার বিড়ালদের।’
কেমন একটা গোলমেলে হাসি হেসে গঙ্গারাম চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘মেনি আবার নোটিশটাকে টাঙাতে দেয় কি-না?’


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.