গত শতকের পঞ্চাশ-দশকের 888sport app শহর।
তখনো মোহাম্মদপুর আর মিরপুর উপশহর তৈরি হয়নি। নিউ মার্কেট হয়েছিল। ধানমন্ডি উঠছিল। আশেপাশে নতুন নতুন জনপদও। তবু তখনো পুরনো 888sport appয় চলে প্রাদেশিক রাজধানীর বাজার-সদাই আর নানা কায়-কারবার। মানুষ যায় চকবাজার, মৌলভীবাজার, ইসলামপুর, আরমানিটোলা, উর্দু রোড, ইংলিশ রোড, লালবাগ, পাঁচ ভাই ঘাট লেন, মিটফোর্ড হাসপাতাল, নবাবপুর। জগন্নাথ কলেজ। জেলা কোর্ট। অথবা বুড়িগঙ্গার সদরঘাট।
মুড়ির ডিব্বার মতো কয়েকটা বাস।
নিউ মার্কেট, আজিমপুর আর পলাশী ব্যারাক এলাকা থেকে সদরঘাটের দিকে যায়; ফিরে আসে। ঢাকেশ্বরী মন্দির বামে রেখে, দৈনিক আজাদ অফিস পার হলে লালবাগ থেকে শুরু হয়ে যায় পুরনো শহরের সংকীর্ণ পথে চলা। রিকশা, গরুর গাড়ি, ঠেলা গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, সাইকেল ও পথচারীদের সমবেত দুমুখীন ধীরপ্রবাহ ঠেলে পেটভর্তি যাত্রী নিয়ে যান্ত্রিক বাসের অসম্ভব যাত্রা। অনেকটা গর্ভধারিণী মায়ের মতো চলা। ড্রাইভার ছাড়াও তাকে সহায়তা করে একজন কনডাক্টর আর একজন হেলপার। এই হেলপার পদবিধারী সহায়কের একটি কাজ হচ্ছে বাসের গায়ে চাপড়ানি মেরে ড্রাইভারকে সংকেত দেওয়া – কখন গাড়ি ছাড়তে হবে আর কখন থামতে হবে। কারণ গাড়ির বামপাশে যেখানে বাসের পেছন দরজা, তা দেখার কোনো উপায় ড্রাইভারের নেই। হেলপারের প্রধান আরো দুটো কাজ আছে। হাত দিয়ে বাসের গায়ে প্রায় অবিশ্রান্তভাবে চাপড়ানো আর কর্ণবিদারী শব্দ করা এবং ক্ষণে ক্ষণেই ‘আবে, ঔ! ঔ!’ বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে লোকজনের মা-বোন-সাত পুরুষকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেওয়া। ভরসা এই যে, বাসটির বপু ও আওয়াজ সত্ত্বেও এটাকে যারা উপেক্ষা করে পথ জুড়ে থাকে তারা জায়গা করে দেবে এবং হেলপারের চাকরিটা টিকে থাকবে। হেলপাররা সচরাচর কিশোর বালক-জাতীয় হয়ে থাকে।
তবে ঘটনাটি আরো আগে ঘটে। প্রশস্ততরো এলাকায়, আজাদ অফিসের সামনে – সবুজ রং পানির পচা পুকুরের ধারে। সকালবেলার বাস। দূরত্ব বেশি না হলেও, লোকে বাসে চড়া পছন্দ করে; বা আধুনিকতার আলস্য। চাকুরে। ছাত্র। ব্যবসায়ী। বেশির ভাগই শক্ত-সমর্থ। তবে এদের মধ্যে মেয়ে থাকাটা ছিল অকল্পনীয়। যুগটাই তখন এমন।
বাসটি বেবি আইসক্রিমের মোড় থেকেই প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছিল। পলাশীর রেলক্রসিংয়ে লোকে যাত্রীরা বাদুড়ঝোলা হয়ে পড়ে। পেছনদিকে পাদানিতে হেলপার কোনোরকমে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু আজাদ অফিসের কাছের স্টপ থেকে সে আর উঠতে পারেনি। কীভাবে কী সংকেত শুনে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। বালক হেলপার ছুটন্ত বাসের পেছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করতে থাকে। ব্যাপারটা টের পায় কন্ডাক্টর। সে তখন ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে এবং যাত্রীদের নিশ্ছিদ্র ভিড়ের ভেতর দিয়ে নিজে গাড়ির বাইরে আসবার চেষ্টা করতে থাকে।
এ-সময়েই পচা পুকুরপাড়ে ছিল লুঙ্গি-গেঞ্জি-পরা, কাঁধে-গামছা আর চটি-পায়ে এক লোক; লোকটি ছিপছিপে তো বটেই তাকে রোগাটেও মনে হতে পারে। তবে বাইরে থেকে এ-লোককে চেনা কঠিন। লোকটি আসলে গ্রামের মানুষ। সেখানকার বাজারে তার আড়ৎ আছে; বেশ লোকও খাটায় : – ভিড়ভাট্টা ঢের দেখেছে। কালকে 888sport appর কোর্টে তার মামলার তারিখ পড়েছে। আজ উকিলের সাথে পরামর্শ আছে। পলাশী ব্যারাকে আত্মীয়ের সাথে তার বিছানায় একটা রাত কাটাতে হয়েছে। ভাবনায়-চিন্তায় হয়তো তার ভালো ঘুম হয়নি। এখন সে আপন মনে পায়চারি করছিল আর মেশওয়াক দিয়ে দাঁত মাজন করছিল।
তখনি বাসটা একটা ঝাঁকুনি লাগিয়ে তার সামনেই এসে যেন হুমড়ি খেয়ে থমকে পড়ে। লোকটাও থমকে দাঁড়ায়। বাসের ভেতরে তখন হচ্ছে ধস্তাধস্তি আর হল্লা। থামবার কোনো লক্ষণ নেই। বাস থেকে কেউ নামেও না। কারো নামবার কোনো লক্ষণও নেই। লোকটা বাসটাকে নিরীক্ষণ করে, পাদানিতে বাদুড়ঝোলা যাত্রীদের দিকে একবার তাকায়। তারপর হাতের মেশওয়াকটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে, এক পা এগিয়ে যায়। হঠাৎ সে জামা ধরে বাদুড়ঝোলা একজন যাত্রীকে টেনে নামিয়ে একটা প্রচণ্ড ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। এমনি করে সে পর পর কয়েকজন বাদুড়ঝোলা যাত্রীকে নামিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলে। দেখতে-না-দেখতে পাদানি খালি হয়ে যায়। এ-দিকে বাসের ভেতরের ধস্তাধস্তি আর হল্লা থেমে যায়। হেলপারও ফিরে আসে। তবে তার চোখ বিস্ময়ে বিমূঢ় এবং গোল গোল। কেউ কিছু বলবার সুযোগ পাবার আগেই, লোকটা নিজের দুহাতে দুহাত ঝেড়ে ফেলে। গামছাটা গুছিয়ে এ-কাঁধ থেকে ও-কাঁধে রাখে। তারপর অকুস্থল থেকে হেলে-দুলে হাঁটতে হাঁটতে পলাশী ব্যারাকের দিকে চলে যেতে থাকে। একবারও ফিরে তাকায় না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.