সবকিছুর একটা শুরু আছে। যেমন তার সঙ্গে শেষও। একমাত্র সময় কোথায় গিয়ে সমাপ্ত হবে কেউ বলতে পারে না। আমরা যেমন মহাশূন্যে হাঁটছি, তেমনি হাঁটছি সময়ের হাত ধরে। হাঁটি হাঁটি পা পা … শুরু হয় মা-বাবার হাত পাকড়াও করে। দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এটা একটা খেলার মতো। তবে হারজিত নেই। তেমনি লেখাপড়ার শুরুতে অক্ষর চেনা ও লেখা অনুশীলন করা। পড়তে হবে লিখতে হবে। তাই পড়ালেখা বা লেখাপড়া। প্রথমে অক্ষর চেনা, পরে লেখা। এই লেখার চেষ্টার শুরুকে বলে হাতেখড়ি।
পড়াশোনা করার জন্যে মাস্টারমশাই লাগে বা পণ্ডিতমশাই। আমার বয়স যখন পাঁচ তখন লেখাপড়ার কথা উঠল। এবার তো স্কুলে দিতে হবে। তা তো হবেই – কোরাস।
প্রথম ভাগ কেনা হলো। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের লেখা। বর্ণ-পরিচয় আগেই শেখা হয়ে গেছে। থাকি মামাবাড়ি, হাওড়া জেলার ঝামটিয়া গ্রামে। নিজ গ্রাম হুগলির সবলসিংহপুর। থাকা হয় কম। কারণ দু-পরিবার দু-শ্রেণির। দাদা শেখ মহম্মদ এহিয়া নিম্ন-মধ্যবিত্তের মানুষ। নানা শেখ কওসর আলী উচ্চবিত্তের। প্রায় শ’দেড়েক ধানি জমি। গ্রামে তিনতলা পাকা বাড়ি। কলকাতায় এক ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানির কম্পাউন্ডার, মানে গোরা ডাক্তারের সহকারী। মাইনে সেই ১৯৪০-এর দশকে তিনশো রুপি। ডালহৌসি স্কয়ারে এক ঢাউস দালানে অফিস। বেশ কয়েকবার কলকাতা গিয়ে নানার অফিসে গেছি। এখনো মনে পড়ে মিহিদানার লাড্ডুর কথা। খুব সুস্বাদু ছিল। আর ছিল লেমোনেড। বোতল খুললেই ভস্ করে শব্দ … আর ফেনা বের হওয়া। খাবার পর কয়েকবার ঢেঁকুর উঠত। স্বাদ টক-মিষ্টি। আজকের স্প্রাইটের মতো।
তো হতেখড়ি।
অক্ষর আমি আগেই চিনতাম।
তিনতলা মামাবাড়ির নিচতলায় দেয়ালে বাবা
একটা ছবিসমেত অক্ষরের চার্ট ঝুলিয়ে দিয়ে গেছেন। আমি নামতে উঠতে দেখতাম আর উচ্চারণ করতাম অ-এ অজগর ওই আসছে তেড়ে – আ-এ আমটি আমি খাবো পেড়ে … এভাবে প্রায় পুরো বর্ণমালাই আমার মুখস্থ। কিন্তু লেখা শুরু হয়নি, তাই এবার হাতেখড়ির পালা। অর্থাৎ নিয়ম মেনে লেখাপড়ার সময় এসে গেল। পড়ার সঙ্গে লেখা আর লেখার সঙ্গে পড়ার পালা।
ঝামটিয়া গ্রামে মাত্র এগারোটি পরিবার ছিল মুসলমান। বাকি সব সনাতনধর্মী। ধাড়া, বাগ, দোলুই, সামন্ত ইত্যাদি পদবিধারী। এদের সবাই কৃষিজীবী। মাটির ঘর, খড়ের ছাউনি। ভিটে বেশ উঁচুতে। কারণ জায়গাটা নিচু। প্রতিবছর ভাদ্র-আশি^ন মাসে তিন-চারবার বান আসত। তাই জায়গাটাকে বলা হতো হাজা অঞ্চল। পশ্চিম দিকে অর্ধচন্দ্রাকারে ছিল বিরাট বন্যানিরোধক বাঁধ। নাম ছিল কোম্পানির বাঁধ। দক্ষিণ হয়ে এটা পুবদিকের কিছুটা অংশ খালনা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঝামটিয়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়খাল এই খালনা ছুঁয়ে বয়ে গেছে। এখানে সাঁকো আছে। তাই খালনা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ওখানে একটা উচ্চবিদ্যালয়ও আছে। ছেলেমেয়ে দু-দলই একসঙ্গে পড়ত। এখান দিয়ে বাগনান স্টেশনে পৌঁছার পথ। তাই ঝামটিয়ার কাছে খালনা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই গ্রামের উত্তরে জয়পুর। আরেকটা নামি জায়গা। এখান থেকে বাসে করে কলকাতা যাওয়া যায়।
গ্রামে একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০ সালে। খাজুরদহ আর ঝামটিয়ার মাঝামাঝি দূরত্বে। উঁচু ভিটে। ঢালু ভিটের ওপর জমিতে বসান যেন। সামনেই আছে একটা নবীন বটগাছ। গরমকালে পাকা ফল খেতে পাখির মেলা বসে যেত। সেইসঙ্গে পাখির বিষ্ঠায় ভরে যেত সারা অঙ্গন।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাঁদিকে চৌকো একটা পুকুর। নাম কোম্পানির পুকুর। সম্ভবত কোম্পানির আমলে তৈরি। বেশ গভীর। জল স্বচ্ছ। পশ্চিমদিকে ঘাট। সবার কাজে লাগে।
গ্রামে একটি মাত্র নলকূপ। এটি দক্ষিণপাড়ার পশ্চিমদিকে পাকা বাঁধানো উঁচু ভিটেয়। বড় বান না হলে ডোবে না। সবাই এখান থেকে খাবার জল নিয়ে যায়।
দক্ষিণপাড়া আবার দু-ভাগে বিভক্ত। মূল ভাগে পড়ে পাড়ার প্রায় সবাই। মাঝে সামান্য চাতাল। এর ওপর দহলিজ। মানে পাড়ার বৈঠকখানা। এখানে সকালে ছোটরা মাস্টারমশাইয়ের কাছে লেখাপড়া শেখে – যারা তখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। ছোটদের পড়াতেন যোগীন্দ্রনাথ বাগ। বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি পার হয়ে গেছে। মাথায় শুভ্র চুল। দাড়ি-গোঁফ কামানো। কৃষ্ণবর্ণের চেহারা। ধুতি আর ফতুই পরে আসতেন।
মেঝেতে চাটাই বিছানো থাকত। একটা ছিল হাতলঅলা চেয়ার, মাস্টারমশাইয়ের জন্যে।
এখানে লেখাপড়া একেবারে প্রাথমিক। হাতেখড়ি থেকে শুরু করে এক থেকে একশ লেখা। পরে কিছু যোগ-বিয়োগ।
মাস্টারমশাইয়ের হাতে শোভা পেত একটা লিকলিকে কঞ্চির ছড়ি। কথা বললে টেবিল চাপড়ে থামানো হতো। যোগ-বিয়োগে ভুল হলে খুব রেগে যেতেন।
মাস্টারমশাইয়ের কান দুটো মাথার তুলনায় বেশ বড় ছিল। তিনি চলে গেলে আমরা হাসি-ঠাট্টা করতাম ভূতের ছানা বলে।
দহলিজটা বেশ বড় ছিল। ধনীদের দহলিজ তো! তো, আমরা বলতাম দলিজ। যেমন মসজিদকে বলত, মজিদ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এই দক্ষিণপাড়ায় কোনো মসজিদ বা মজিদ ছিল না। ঈদের সময় আমার নানাবাড়ির সামনে যে যৌথ মাঠ ছিল সেই মাঠের পশ্চিমদিকে ছিল একটা বড় অশ্বত্থ গাছ। আঞ্চলিক কথায় আসুদগাছ। তো এই আসুদগাছের পুবদিকে রেড অক্সাইডে মোড়া তিন ধাপের একটা সিঁড়ি ছিল। এটাই ঈদগাছ বা মজিদের বিকল্প। আমার নানাদের মধ্যে কোনো একজন নামাজ পড়াতেন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আমরা ছোটরাও কাতারবন্দি হতাম। মাথায় কারো ছিল টুপি, তবে বেশির ভাগ ছিল রুমাল বাঁধা। এমনকি বড়দের মধ্যেও তাই।
আমাদের বাড়িতে প্রথাগত ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বালাই ছিল না। নানি গোলাপজান বেগম নিয়মিত নামাজ পড়তেন। আর কাউকে তেমন করে দেখিনি। কেন জানি না এই পাড়াতেই ধর্মীয় অনুশাসনের কোনো রীতিনীতি দেখিনি। পুরুষরা থাকত কলকাতায় আর মহিলারা গ্রামে, তাই হয়তো পরিপূর্ণ কমিউনিটি বা সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি। সবাই চাকরি আর জমি-জায়গা নিয়ে ব্যস্ত। ধর্ম বা সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ড তেমন দেখিনি। তবে রোববারে ঈদ-পুজোর ছুটিতে যখন সবাই গ্রামে থাকত একটা ক্রিকেট টিম হয়ে যেত। এবং গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে বড়খালের কাছে একটা ক্রিকেট মাঠও ছিল। কিশোর আর সেয়ানদের সঙ্গে অনেক সময় বয়স্করাও ব্যাট চালাতেন। আর মাঠের চারদিকে আমরা ও গ্রামের বর্গক্ষত্রিয় ছোটবড় সবাই উপভোগ করতাম। রীতিমতো স্টেডিয়াম। তবে ওভাল বা ডিম্বাকৃতি নয়, আয়তাকার। সকাল নটায় খেলা শুরু হতো, চলত প্রায় বারোটা পর্যন্ত। মাঠে কোনো গাছপালা না থাকায় বিশ্রামের জায়গা ছিল না। তবে অনেক সময় গ্রীষ্মকালে বিকেল পাঁচটার দিকে খেলা শুরু হতো, সাঝের আঁধার না নামা পর্যন্ত চলত। আমরা ছিলাম হাততালি দেওয়ার দল। আর বল মাঠের বাইরে গেলে, বাউন্ডারি হলে কুড়িয়ে আনা। তাতেই আনন্দ ধরে না। বল কুড়িয়ে আনারও চলত প্রতিযোগিতা।
হাতেখড়ির অস্ত্র হলো সেøট আর পেনসিল। সেøট হলো পাথরের পাতলা ফলক। গাঢ় ধূসর। চারপাশে কাঠের ফ্রেমে বাঁধান। ছোট-বড়-মাঝারি সেøট হয়। যার যেটা ইচ্ছা এবং ট্যাঁকের ওপরও নির্ভরশীল। এই সেøটের পাথরের নামও সেøট-পাথর।
তো সেøটও কেনা হলো।
হরিদাসের দোকানে সেøট পাওয়া যায়। ওটা দোলুই পাড়ায়। হরিদাসের মুদিদোকান ঝামটিয়ায় একমাত্র দোকান। পাতলা একহারা চেহারা হরিদাসের। ফর্সা। চল্লিশের ওপর বয়স। মিষ্টভাষী। আমরা কখনো কখনো লজেন্স কেনার জন্যে যেতাম। দক্ষিণপাড়া থেকে দূরত্ব খুব একটা কম নয়। গ্রামের বসতি অংশের শেষ মাথায়। আমাদের হরিদাস বাবু বলা উচিত, কিন্তু গ্রামের সবাই একবাক্যে বলে হরিদাসের দোকান।
আমার ভাগে পড়ে মাঝারি আকারের সেøট। দাম ঠিক মনে পড়ছে না। আট আনা হতে পারে। তখন ছিল ৬৪ পয়সায় এক টাকা। এক আনা মানে চার পয়সা। তার মানে এখনকার পয়সার চেয়ে দাম বেশি। চার আনায় এক সিকি। তারপর আধুলি বা বত্রিশ পয়সা। তখনো ব্রিটিশরাজ। তাই ষষ্ঠ জর্জের মস্তিষ্কের প্রতিকৃতি থাকত ওপর পিঠে।
সেøটে লেখার জন্যে সেøট পাথরেরই পেনসিল থাকত। একে বলত খড়ি। আবার অনেকে চকখড়ি পেলে তা ব্যবহার করত।
গরমের দিনে দহলিজে খুব সকালে পাঠ শুরু হতো। দিনক্ষণ মনে নেই। তবে এক সকালে মা ও নানির সঙ্গে আমি বর্ণ পরিচয় ও সেøট হাতে হাজির হলাম যোগীন্দ্র মাস্টারমশাইয়ের সামনে।
মা-নানিকে দেখে মাস্টারমশাই খুব সমীহ সহকারে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নানি বললেন, এই আমার নাতি ফজলু, আপনার হাতে হাতেখড়ি দিতে চাই।
আমার এই ফজলুর রহমান নাম পরবর্তীতে আর থাকেনি। দেশভাগের পর চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর বাবা আমাদের সব ভাইবোনের নাম বদলে নিজের পছন্দমতো রাখেন। আমার নাম হলো বুলবন ওসমান। আমি যখন চট্টগ্রাম এম.ই স্কুলে ভর্তি হলাম তখন থেকে এই নামই রেজিস্টার্ড হয়ে গেল। আমাদের আগের নাম সবই ছিল নানার দেওয়া। যখন আমাদের এই নাম-বদল হয় মা সামান্য প্রতিবাদ করেছিলেন, আমার বাবার দেওয়া সব নাম … বলে। মা বাবার মতো নামি লোকের সঙ্গে কোনো বাহাসে যাননি। সব নাম তিনি মেনে নিয়েছিলেন।
তো আমি ঝামটিয়ার দখিনপাড়ার দহলিজে। মাস্টারমশাই গর্ব ভরে বলতে লাগলেন, আমার হাতে যার হাতেখড়ি হয় তারা সবাই বিএ-এমএ পাশ করে।
তারপর তিনি পাড়ার আমার জ্ঞাতি মামাদের এক এক করে নাম করতে লাগলেন। যারা সবাই বিএ-এমএ পাশ।
বললেন, এই ছেলেও এমএ পাশ করবে।
পরবর্তীকালে আমার সেই যোগীন্দ্র মাস্টারমশাইয়ের কথা সত্য প্রমাণিত হয়। আমি 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্বে অনার্সসহ এমএ পাশ করি।
তো হাতেখড়ি।
মাস্টারমশাই আমার বুকে ধরা সেøটটা টেবিলের ওপর রাখতে বললেন।
তারপর বললেন, পেনসিল হাতে নাও।
ডান হাতে সেøট পেনসিল ধরলাম।
তিনি আমার হাতের কব্জি ধরে ঘুরিয়ে বড় করে ‘অ’ অক্ষরটি লিখলেন। তারপর একইভাবে লিখলেন ‘আ’। এরপর হ্রস-ই ও দীর্ঘ-ঈ।
লেখা শেষে বললেন, বাড়ি গিয়ে এই চারটে অক্ষরের ওপর হাত বোলাতে থাকবে। শেখা হয়ে যাবে।
পুরো সেøটজুড়ে চারটে স্বরবর্ণ জ্বলজ্বল করছে। অ আ ই ঈ। আমি অপলক চোখে নিজের লেখার দিকে চেয়ে আছি। যদিও এটা আমার হাতে লেখা নয়। তবু সেøট পেনসিলটা তো আমার হাতে ছিল। তাহলে আমার লেখাই বা নয় কেন! আমি যন্ত্র আর মাস্টারমশাই হলেন যন্ত্রী। দুজনের অস্তিত্বই তো আছে! আমার মাঝ দিয়ে এই চারটি বর্ণের প্রকাশ। পেছনে আছেন মাস্টারমশাই যোগীন্দ্রনাথ বাগ। প্রবাদপ্রতিম আর্জেন্টাইন ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা একটি গোলকে আখ্যা দিয়েছেন : ঈশ্বরের হাতের গোল। মাস্টারমশাই সেই ঈশ্বরের হাত দিয়ে আমাকে স্বরবর্ণ ধরিয়ে দিলেন। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ গুরু-শিষ্য পরম্পরা। গুরু হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। আমার হাতেখড়ি শুরু হলো। ঘরে ফিরে মায়ের নির্দেশমতো অক্ষরের ওপর হাত বুলোতে লাগলাম। লেখাপড়ার ব্যাপারে মা খুব কড়াকড়ি করতেন। জ্ঞানী বাবা ছিলেন বলতে গেলে উদাসীন। পরবর্তীকালে দেশভাগের পর দেখেছি তিনি মাঝে মাঝে উদয় হতেন এবং আমাদের নানারকম পরীক্ষা নিতেন। সব ভাইবোনের। আমার ওপর নজরটা পড়ত বেশি। একে বড়। তার ওপর কিছুটা মেধাবী। এরপর এই চারটে স্বরবর্ণ শেখা হলো। পরদিন আরো চারটে : ই ঈ উ ঊ। হৃস ই, দীর্ঘ ঈ, হ্রস উ, দীর্ঘ ঊ।
সপ্তাহখানেকের মধ্যে স্বরবর্ণ চেনাজানা হয়ে গেল। লিখতেও পারি। মাস্টারমশাইয়ের দাগিয়ে দেওয়ার মতো অত সুন্দর হয় না। তাই তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, সুন্দর করে লেখ … আমি চেষ্টা চালাতাম। মাস্টারমশাই ছাড়তেন না : আরো ভালো করে লেখ …
আমার প্রচেষ্টার খামতি নেই।
এরপর শুরু হলো ব্যঞ্জনবর্ণ।
এখানে অক্ষরের 888sport free bet অনেক, তাই কালক্ষেপণও অনেক। ব্যঞ্জনবর্ণে আবার পাঁচ বর্ণে এক সার। ক খ গ ঘ ঙ। তেমনি চ ছ জ ঝ ঞ। এভাবে চলল চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত। চন্দ্রবিন্দু মানে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো অর্ধবৃত্তাকার। তার মাথার ওপর একটা বিন্দু : এই হলো চন্দ্রবিন্দু। তো সব অক্ষরজ্ঞান খতম। এবার বাংলা ভাষার নাড়ি-নক্ষত্র জানা যাবে। তবে এখানেই শেষ নয় : পরে আসে যুক্তাক্ষর। মানে দুই বা ততোধিক বর্ণের মিলন। যুক্ত হওয়া। এটা বাংলা ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য। যেটা ইংরেজিতে নেই। এছাড়া আছে য-ফলা, রেফ, একার, ঐকার, উকার … ইত্যাদি। ক-এ মূর্ধন্য ষ-এ খ – এভাবে তিনটি অক্ষরের যুক্ত হওয়াও আছে। ভাষা হিসেবে বাংলা বেশ কঠিন। শিক্ষকদেরও অভিধান দেখতে হয়। অক্ষরের ভুলভ্রান্তি পরখ করার জন্যে। বেশ সময় গেল অ আ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত শিখতে।
এই অক্ষরজ্ঞান হওয়ার পর থেকে দোতলা থেকে নামার সময় নিচে দেয়ালে টাঙানো অক্ষর-চার্টের দিকে চোখ পড়ত আর আমি উচ্চরণে আওড়ে চলতাম … উট চলেছে সারি সারি … শিয়াল ডাকে গহিন বনে … এই গহিন শব্দটা আমাকে খুব ভাবাত। গহিন মানে কী? এটা কি গভীর বনে? না অন্য কিছু! পরে কলকাতা থেকে বাবা গ্রামে এলে আমি জেনে নিই। বাবা জানালেন, গহিন মানে ঘন-জঙ্গল। গভীর বনাঞ্চল। বাবা বাংলা ভাষার অধ্যাপক, সুতরাং আমি খুব ভরসা করতাম। প্রায়ই দোতলা থেকে নামতে নামতে উচ্চরণে আওড়াতাম, শিয়াল ডাকে গহিন বনে। গহিন শব্দটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। ঝামটিয়ায় গহিন তো দূরের কথা কোনো বনাঞ্চলই নেই। আমি তাই মনে মনে দূর কোনো জায়গা কল্পনা করতাম, যেখানে গহিন বন আছে। সেখানে পৌঁছে যেতাম। এরপর রবীন্দ্রনাথের : কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে … গানটা শুনলেই মনে হতো তিনি এই বয়সে এমনি করেই হয়তো গহিন কোনো বনে হারিয়ে যেতেন। পরবর্তী জীবনে এই অনুভূতি নিয়ে লিখেছেন গানটি।
হাতেখড়ি শেষ। পড়তে পারি লিখতে পারি, কিন্তু কোনো স্কুলে বা মাদ্রাসায় আমার ভর্তি হওয়া হয় না। ঝামটিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়, সবলসিংহপুরে ঘরের পাশেই সবলসিংহপুর জুনিয়র মাদ্রাসা। এটি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৬ সালে। কোথাও ভর্তি না হওয়ার কারণ আমাদের পরিবারের কোনো স্থিতি নেই। ন-মাস ঝামটিয়ায় তো তিন মাস সবলসিংহপুরে।
সবলসিংহপুরে কম থাকার কারণ পরিবেশ। মাটির বাড়ি। উঠোন প্রায় নেই বললেই চলে। ঘরের পাশে নতুন পুকুর কিন্তু ক্ষুদে পানায় সবুজ জল … খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। আমাদের পাড়ার কোনো এক পূর্বপুরুষের নামে মেহেদিমহল্লা। জানি না এই মেহেদি কবে এবং কোথা থেকে এসেছিলেন। আমার বাবা 888sport live footballিক শওকত ওসমানও পূর্বপুরুষের কোনো হদিস করতে পারেননি। সুতরাং আমার পক্ষেও জানা সম্ভব হলো না। গ্রামে বর্তমানে বয়স্ক কোনো লোকের অস্তিত্ব নেই যে নতুন করে খোঁজখবর চালাব। তবে নামের ধরন শুনে মনে হয় এরা বিহার বা উত্তর প্রদেশ থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। আমার নানাবাড়ি বা মামাবাড়ির ক্ষেত্রেও তাই। তবে তাদের চেহারা জানান দিত যে, তাদের পূর্বপুরুষ বাঙালি ছিল না। সবার চেহারা ছিল পুরু ফর্সা। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে। আমার দাদি বা ঠাকুরমা ছিলেন খাঁটি বাঙালি চেহারার। একহারা বা পাতলা বলাই শ্রেয়। রংও
কৃষ্ণকলি। মুখশ্রী ছিল সুন্দর। দাদা অবশ্য ভিন্ন চেহারার। রোদে পুড়ে তামাটে। কিন্তু বংশধারায় ফর্সা ছোটখাটো মানুষ। আমি যখন দেখছি, তখন কিছুটা কুঁজো হয়ে গেছেন। যদিও বয়সের ভার নয়, জীবনযুদ্ধের পরিণতি। সংসারের বহন ক্ষমতার কমতি ছিল। তাই প্রায়ই পালিয়ে বেড়াতেন। কখনো সাতদিন, কখনো মাস। শুনেছি ছয় মাস পর্যন্ত অনুপস্থিতির কথা। দাদি নিরীহ মানুষ। কিন্তু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে স্বামীকে নিশ্চয় কথা শোনাতেন। তার মধ্যে একটা কথা এখনো আমার কানে বাজে :
খায় দায় –
বলপাই ধায়।
বলপাই কিছু দূরের একটি গ্রামের নাম। জানি না বলপাই গিয়ে তিনি কী বল পেতেন। মনে উঁকি দেয় ফ্রয়েড। দাদার কোনো প্রেম ছিল নাকি? আবার ভাবি, প্রেম করতে ফুইসা লাগে। সেদিক থেকে দাদা শেখ মহম্মদ এহিয়ার দর বেশি হতে পারে। অর্থাৎ দরবেশ। আদরযত্ন পেতেন। অনেক সময় নির্ধন ব্যক্তিও মুসলিম পরিবারে বিবাহযোগ্য মেয়েকে দিয়ে সেবাযত্ন করতো। দরবেশদের এই একটা সুযোগ-সুবিধা ছিল। এই রহস্য ভেদ করতে পারিনি। কারণ ১৯৪৭-এর ভারত বিভাগ। ১৯৪৮-এ দাদা মৃত্যুবরণ করেন। আর আমাদের বিচ্ছেদটি হয়ে যায় চিরকালীন এবং হঠাৎ। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।
দাদা মারা যান ম্যালেরিয়ায়। শুধু নিজ দাদা নন, বড়দাদা শেখ মহম্মদ ইরশাদও দাদার মৃত্যুর পনেরো দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেন। দাদার দিক থেকে আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ি। দাদার জন্যে ততটা নয়, বড়দাদার জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল। তিনি না থাকলে কলাপাতায় বাবার লেখাপড়া হতো না। আমরা সবাই এই বড়দাদার কাছে চিরঋণী। বড়দাদার জীবন ছিল একটা ট্র্যাজিক জীবন। দাদি মারা যাওয়ার পর এক পুত্রসন্তান নিয়ে বাস করতেন। এই চাচা ছিলেন বাবার বয়সী। তাই বড়দাদা বাবাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। আরো কারণ হলো, বাবার ব্রিলিয়ান্ট ক্যারিয়ার।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার এই চাচা ২৪ বছর বয়সে মারা যান। যক্ষ্মায়। তখন যক্ষ্মাকে বলা হতো রাজরোগ। মানে যেহেতু ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, যক্ষ্মা হলে রোগীকে বাঁচান যেত না। কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে রক্ত উঠত। সে খুব কষ্টের জীবন। একে ক্ষয়রোগও বলা হতো। কারণ ঘুসঘুসে জ্বর হয়ে রোগী ক্রমশ ক্ষীণ-শীর্ণকায় হয়ে যেত। চলা-ফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলত। মারা যেত খুব ধীরে ধীরে। আজ যেমন ক্যান্সার। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে অনেক ক্যান্সার রোগীকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু শেষদিকে ধরা পড়লে আর বাঁচানো যায় না। যেমন বাঁচান যায়নি আমার একমাত্র বোন লাইলীকে। ক্যান্সার থাকা অবস্থায় মারা যায়।
আগে বলাই হতো : যার হয়েছে যক্ষ্মা, তার নেই রক্ষা।
আগে লোকে অভিশাপ দিত : তোর মাথায় বাজ পড়ুক। তেমনি বলত, তোর যক্ষ্মা হোক।
আগে দেশে-গ্রামে বড় বড় গাছ বিশেষ করে তালগাছ থাকায় বজ্রপাতে মানুষ কম মারা যেত। এখন অনেক বেশি মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছে। যেমন প্রাণ যায় হার্ট অ্যাটাকে বা স্ট্রোকে। এসবই আধুনিক যুগের পরিবেশ নষ্ট করার ফল। খাবার জলও কিনে খেতে হয়। তা-ও সবসময় জীবাণুমুক্ত নয়।
২৪ বছরের জোয়ান ছেলেটি মারা যাওয়ার পর বড়দাদা তার মাটির দোতলা বাড়িটি ভাইপোর নামে লিখে দেন। আমরা বড়দাদার সেই বাড়ির দোতলায় থাকতাম। নিচে দু-দাদা
থাকতেন। দুজনই তামাক খেতেন। আমরা রাতে শুনতে পেতাম হুঁকোর ভুড়ুক ভুড়ুক টান। আর ভেসে আসত তামাকের সুবাস। দুজন নামাজ পড়তেন দ্বৈতস্বরে। আমার অনেক সুরা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আর মা শিখিয়েছিলেন সুরা ফাতিহা। এখনো সব হুবহু মনে আছে। বাবার সহধর্মিণী হিসেবে মাকে নামাজ পড়তে দেখিনি। একেবারে শেষ জীবনে নামাজ পড়তেন নিয়মিত। তবে রোজা রাখতে পারতেন না।
দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন মা। ৮৬ বছর বয়সে মারা যান। আমার চোখের সামনে। প্রতিটি ক্ষণ নিখুঁত মনে আছে। মাকে নিয়ে লিখতে গেলে পৃথক পুস্তক রচনা করতে হবে। জানি না সম্ভব হবে কি না। নৈতিকতার বিচারে মাকে কোনোমতেই বাবার চেয়ে কম বলা যাবে না। ভীষণ দৃঢ়চেতা ছিলেন। সত্যি কথা বলতে একটুও কুণ্ঠা দেখিনি।
তো বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া।
হাতেখড়ি হয়েছে অনেক দিন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়নি। যোগীন্দ্রনাথ মাস্টারমশাইয়ের যে কাজ ছিল তা অনেক আগেই শেষ। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ দু-খণ্ডও শেষ।
রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠ ছিল চিত্রিত। 888sport live chatাচার্য নন্দলাল বসুর উডকাট চিত্র। কি শক্তিশালী অংকন। সেই যুগের কাঠের ব্লকের ছাপা আজকের অফসেটের চেয়ে পষ্ট ও শক্তিশালী। আসলে সব জায়গায় নির্ভর করে মেশিনের পেছনের মানুষটি।
আমাদের গ্রাম সবলসিংহপুর। গোটা গ্রাম ভিটের পাশে বাঁশঝাড়ে পরিপূর্ণ। কাঁঠালগাছ দু-একটা উঁচু ভিটেয় বাঁচে। তবে তালের সারি দেখার মতো। যেখানেই রাস্তা, দুপাশে তালগাছ। ছোট গাছ খুব ঘন পাতায় ছাওয়া। তালপাতার গায়ে কালো রঙের বর্ডার আর তা করাতের মতো। মানুষজন কাছে ঘেঁষতে পারে না। গ্রীষ্মকালে কাঁচা তাল পেড়ে শাঁস আর রস খাওয়া বড় আনন্দের উপকরণ। আর ভাদ্রমাসে পাকা তাল পড়ার ধুম। ধপ্ করে পড়লেই যার কানে যাবে দেবে দৌড়। যে পাবে তার। অনেক সময় দুজন মিলে টানাটানিও হয়। তখন একজন বয়স্ক কেউ মধ্যস্থতা করে। এই বলে যে, এর পরেরটা অপরজন পাবে। এই বিধান সবাই মেনে চলত।
গ্রামের উত্তরদিকে ধানিজমির ক্ষেত। দক্ষিণে বসতি।
পশ্চিমে-পুবে কোনো দিকে ফাঁক নেই। শুধু ফুটবল খেলার একটা মাঠ আছে। তার পাশে আছে খিলাফত কাজীদের খনন করা দিঘি। বেশ বড় এবং জল স্বচ্ছ। বাঁধানো ঘাটের পাশে ছোট ছোট সাদা রঙের ক্ষুদে শালুকের ফুলসমেত ঘাস ছিল। ঘাটের পাশে গেলে গায়ে জড়িয়ে যেত আর কাঁটা কাঁটা পাতায় গা চুলকাতো। তাই এপার-ওপার করা ছাড়া ঘাটের পাশে বা দিঘির চারদিকে নামা যেত না।
আমাদের গ্রামেও বান হতো ঝামটিয়ার মতো। এটিও নিচু অঞ্চল। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী মুণ্ডেশ্বরী। সে সময় এটা খুব শীর্ণ নদী ছিল। দুপাশে ঢালু, আর বালিতে পা পর্যন্ত দেবে যেত। এখন নদীর ওপর একটা সাঁকো হয়েছে। কাঠের। এটা ওপারের গ্রাম হরিশচকের সঙ্গে যুক্ত করেছে। হরিশচকের উত্তরে লতিফপুর গ্রাম। এখন শুনছি এই গ্রামকে লোকে লতিফপুর বলে। এটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। ব্রিটিশ শাসন এই ভারতকে শুধু ভাগই করেনি, হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়কে চিরশত্রু বানিয়ে গেছে। যেমন 888sport appয় মহাকালীকে করা হয়েছে মহাখালি।
উত্তরের মাঠের পর গ্রামের নাম সমকপুর। আমি দাদি গুলেদান বেগমের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ওই পাড়ায় গেছি। এখানে দাদির দ্বিতীয় মায়ের বাবার বাড়ি। দাদির মা ছোটখাটো ফর্সা মানুষ, প্রায় দাদিরই বয়সী। মিষ্টভাষী ছিলেন। আমাদের খুব আদর করতেন। প্রথমেই পাওয়া যেত সরবত। এটা আমাদের গ্রামগুলির প্রায় চল ছিল। বাড়িতে কেউ এলেই প্রথমে সরবত দেওয়া। আর লেবু থাকলে লেবুর সরবত। হেঁটে ঘেমে যাওয়ার পর পাখার বাতাস আর সরবতে গা জুড়িয়ে যেত। গ্রামবাংলায় তখন এটাই ছিল রেওয়াজ। আর সরবত করার অবস্থা না থাকলে বাতাসা আর এক গ্লাস জল। কোনো কুণ্ঠা নেই। সামর্থ্য ধরে আপ্যায়ন। কারো ঘরে বাতাসও না থাকতে পারে। তখন শুধু এক গ্লাস জল।
হাতেখড়ি হয়ে গেছে। এখন সবকিছু পড়তে লিখতে পারি। নানা পার্বণের সময় বাবা ছোটদের গল্পের বই এনে দিতেন। আমি পড়তাম, দু-বছরের ছোট আমার মেজভাইও আমার কাছ থেকে সব শিখে নিয়েছে। বলতে গেলে আমি তখন কানাইমাস্টার। শুধু শিক্ষার্থী হিসেবে বেড়ালছানাটি ছিল না, ছিল ছোট ভাই। সে তখন মেজ। কারণ আমার তৃতীয় ভাইও জন্ম নিয়েছে। তার চেহারা বেশ ভারি। অনেকটা নানার মতো। বাপ-দাদার বংশধারা পায়নি। আমরা ভাইবোনেরা সবাই দু-বছর অন্তর এ-ধারায় এসেছি। দু-বছর পর চার নম্বর ভাইও জন্ম নিল। এখন আমরা বেশ বড় একটা দল। আমি লিডার। ওদের আর আলাদা করে হাতেখড়ি হয়নি। এর মধ্যে অনেক গল্প-888sport app download apkর বই জমা হয়ে গেছে। ছোটদের জন্যে ধারাপাত অ আ-র বইও ছিল।
ছোটদের শাহ্নামাও হাতে পেলাম। আমি জোরে জোরে পড়তাম। আর যুদ্ধে সোহরাবের মৃত্যুর ঘটনা পড়তে আমার গলা আটকে আসত। দেখতাম নানির চোখে জল। রুস্তম- সোহরাব পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিক কাহিনি। এই কাহিনির নাম শাহ্নামা। ইরানের অন্যতম নামী কবি ফেরদৌসীর রচনা।
এই বইয়ের নাম অনুসরণ করেই বাবা তাঁর আত্মজীবনীর নাম রাখেন রাহনাম। দু-খণ্ডে প্রায় আটশো পৃষ্ঠার বই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই আটশো পৃষ্ঠা লিখেও তিনি তাঁর কলকাতার জীবনই শেষ করতে পারেননি। তাঁর 888sport app download for androidশক্তি ছিল অতি প্রখর। জন্ম থেকে কলকাতা পর্বই শেষ করতে পারেননি। এই পুস্তক রচনা করতে করতেই তিনি সেরিব্র্যাল ইনফার্কসানের শিকার হন। এটি ঘটে ২৭শে সার্চ ১৯৯৮ তারিখে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর চিকিৎসাভার গ্রহণ করেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে আর ফেরানো যায়নি। ১৪ই মে সকাল সাড়ে সাতটায় পরলোকগমন করেন তিনি।
তো আমার হাতেখড়ি তো হলো কিন্তু বিদ্যালয়ে আর ভর্তি হওয়া হয় না। ঝামটিয়া আর সবলসিংহপুরের টানাপড়েনে পড়ে আট বছর পার করে ফেলেছি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছাড়া। তখনকার দিনে নিয়ম ছিল পঁচিশ বছরের পর কোনো সরকারি চাকরি মিলবে না।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেল। বাবা চলে গেছেন চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে। তাই আমরা আরো দোটানায় পড়ি। সবার ইচ্ছা আমরা ভারতবর্ষে থেকে যাই। বাবা চট্টগ্রামে চাকরি করবেন আর মাঝে মাঝে ছুটি-ছাটায় ঘরে ফিরবেন। এইরকম একটা সিদ্ধান্ত মোটামুটি নেওয়া আছে।
১৯৪৯ সাল। আমি ন-বছরের বালক। কৈশোর ছুঁতে আর বাকি নেই। এবার আর সিদ্ধান্তহীনতা নয়, পরিবার থেকে ঠিক করা হলো, আগামী বছর মানে ১৯৪৯-এর জানুয়ারিতে ঝামটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে আমাকে।
আমার হাতেখড়ি অনেকদিনের পুরনো ঘটনা। এবার ঘাড়ে জোয়াল চাপবে। নিয়মিত ঘানি টানতে হবে বিদ্যালয়ের। আমার স্বাধীন জীবনের পরিসমাপ্তির সময় এসে গেল। আর মনটা খারাপ হতে থাকে। এতোদিনের স্বাধীন-জীবনের দায়হীন-জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। রাতে ভালো করে ঘুম হয় না। ঝামটিয়ার দখিনপাড়ার দক্ষিণে অবারিত মাঠ … তাল-খেজুরের সার … মামাবাড়ির দুটি বাগান … বড়খালধার … রাতে শেয়ালের ডাক … শালিক। পাখির বাচ্চা ধরার কসরত … তাল কুড়োনো … কড়ে-ডাং খেলা … বানের সময় ডিঙি চড়ে এদিক-ওদিক যাওয়া … বাবালা গাছের শক্ত আঠা সংগ্রহ করে লজেন্সের মতো চুষে খাওয়া … মামাদের ছোটবাগানে গরু প্রবেশ করলে তালের বাট দিয়ে পেটান … ছোট গোল জাল দিয়ে লালফড়িং চাপা দিয়ে ধরা … তারপর পেছনে চোরকাঁটা প্রবেশ করিয়ে ছেড়ে দেওয়া … এই প্রক্রিয়ার নাম ছিল শূলে চড়ান … ফড়িংটা কিছুদূর গিয়ে পড়ে যেত। আর আমাদের ফূর্তি … সব গ্রামে দেখা বাক্সের মধ্যে বায়োস্কোপ দেখার মতো। আগ্রার তাজমহল দেখ … ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখ … কাবাঘরের ছবি দেখ … কালীঘাটের মন্দির দেখ … এ-সবই কালীঘাটের পটচিত্রের বায়োস্কোপ সংস্করণ। সিনেমা মানেই live chat 888sport – এখানে পুরো ছবিঘরটি গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছোচ্ছে। ছবি স্থির। কিন্তু live chat 888sport।
আহা আজ যদি আমার হাতেখড়ির গুরু যোগীন্দ্রনাথ বাগ মাস্টারমশাইয়ের ছবি দেখাতে পারতাম! কত আনন্দ হতো। দেখি একবার চেষ্টা করে যদি কারো কাছে সেকালের কোনো ক্যামেরায় তাঁর ছবি থাকে! জানি সবই দুরাশা। তবু চেষ্টা করতে দোষ কি? আহা, এইচ.জি. ওয়েলসেব টাইম মেশিনে চেপে ক্যামেরা হাতে যদি আবার মাস্টারমশাইয়ের সামনে পৌঁছোনো যেত!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.