হামচূপামূ হাফ্, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃজনভুবন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ভাববাদী রোমান্টিক কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। মানবতার কবি হিসেবে তিনি হয়েছেন নন্দিত, কখনো অভিধা পেয়েছেন প্রাচ্যের ঋষি কবি হিসেবে; আবার কখনো-বা জমিদার কবি হিসেবে নিন্দাও জুটেছে তাঁর কপালে। 888sport live football-চিত্র888sport live chat এবং সংগীতে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশানুরাগের কথা সুবিদিত। দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে মানুষের মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য রবীন্দ্রনাথ অনেক লিখেছেন – উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে 888sport live chat ও সাধনার মাধ্যমে নিজেকে করেছেন সংযুক্ত। রবীন্দ্রনাথের সামূহিক জীবনার্থ, জগৎভাবনা এবং 888sport live footballধারা অনুসরণ ও অনুধাবন করলে দেখা যায়, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অন্যায়-অত্যাচার-আগ্রাসন এবং মানবসত্তার অবমাননার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সতত-প্রতিবাদী এক অতন্ত্র সৈনিক। জন্মগত উচ্চ-আভিজাত্য, ঠাকুরবাড়ির গৌরবিত জীবনাচার, ব্রাহ্মধর্মদর্শন, ঔপনিষদীয় প্রতীতি এবং পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক চিন্তাস্রোত অঙ্গীকৃত করেই রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর রূপান্তরিত হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত সুজ্জিত হয়েছেন প্রগতিশীল সমাজচেতনা ও বিশ্ব-মানবমুক্তির সর্বজনীন দার্শনিক প্রত্যয়ে। ব্যুয়র যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২), জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৯১৯) থেকে আরম্ভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) মধ্যপর্যায় পর্যন্ত, যখনি বিশ্ব-মানবসমাজের কোনো অংশ অত্যাচারী শাসকের হিংস্র আগ্রাসনের শিকার, যখনি পৃথিবীর কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত, বিশ্ব-মানবিকতার অপ্রতিম প্রতিনিধি নিয়ত জাগর রবীন্দ্রনাথ তখনি প্রতিবাদে মুখর, দ্রোহিতায় শাণিত।

ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভারতবাসীর জন্য রবীন্দ্রনাথ 888sport app download apk ও গান লিখেছেন, লাঞ্ছিত আফ্রিকার পাশে দাঁড়িয়েছেন, স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের পক্ষে বিশ্ব-মানবঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন, জাপানি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যলগ্নে মৃত্যুশয্যায় শুয়েও প্রত্যাশা করেছেন মানবমুক্তির শেষ প্রতিরোধ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয়। ভিন্ন এই রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একদিনেই গড়ে ওঠেননি। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দর্শন থেকে ক্রমে তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল বিশ্ব-মানবতাবাদে। প্রসঙ্গত 888sport app download for android করা যায় হায়দার আকবর খান রনোর এই ভাষ্য : ‘দীর্ঘ সময় ধরে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তারও বিকাশ ঘটেছে। একথা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর পরিবেশের মধ্য থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রভাব বলয়ের মধ্যে ছিলেন জীবনের গোড়ার দিকে। তবে তিনি কখনই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কিশোর বয়সেই রবীন্দ্রনাথ রামরাজত্ব ফিরে পাবার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে 888sport app download apk লিখেছিলেন …। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর উত্তরণ ঘটেছিল বিশ্বমানবতাবাদে।’ রবীন্দ্রনাথের হয়ে-ওঠার পেছনে তাঁর পারিবারিক পরিবেশ এবং সমকালীন জাতিক-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর সৃজনভুবন এবং জীবনদর্শনের ওপরও এ দুইয়ের প্রভাব ছিল সীমাহীন।

স্বাধীনতা এবং বিশ্ব-মানবমুক্তির জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা হঠাৎ করেই দেখা দেয়নি – কিংবা তাঁর 888sport live footballে এর প্রভাব আকস্মিক কোনো বিষয়ও নয়। এ প্রসঙ্গে একটি গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে তাঁর কৈশোরক জীবনের সংশ্লিষ্টতার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত সেই গুপ্ত সংগঠন আর রবীন্দ্র888sport live footballে তার উত্তরপ্রভাব নিয়েই বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেই গুপ্ত সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা জানার পূর্বে বাংলায় গুপ্ত-রাজনীতির ওপর একবার দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।

দুই

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন ভারত শাসনের দায়িত্ব কোম্পানির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ইংল্যান্ডের রানীর হাতে ন্যস্ত করলো (২রা আগস্ট ১৮৫৮) অপেক্ষাকৃত ভালো সরকার (ÔBetter GovernmentÕ) গঠনের উদ্দেশ্যে। এর মূল্য লক্ষ্য ছিল ভারতবাসীর তীব্র অসন্তোষ প্রশমিত করা। ভারতবাসীর কাছে ‘Magna Charta’ হিসেবে গৃহীত হলো মহারানীর ঘোষণা (The Queen’s Proclamation) – যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত-শোষিত-নির্যাতিত ভারতীয়দের আস্থা ও আশ্বাস প্রদানের ঘোষণা এলো মহারানীর কাছ থেকে। প্রসঙ্গত উদ্ধৃত করা যায় ঐতিহাসিক জ.ঈ. গধলঁসফধৎ-এর এই অভিমত : ‘…all of whatever race on creed, may be freely and impartially admitted to offices in our service, the duties of which they may be qualified, by their education, ability and integrity, duly to discharge’ ঘোষণা দেওয়া হলেও ভারতীয়দের ওপর ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হলো না – বরং দিন-দিন বেড়ে চললো অত্যাচার, ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলো শাসক ও শাসিতের মধ্যে অবিশ্বাস, আক্রোশ ও হিংসা। যুগ্ম-বৈপরীত্যের (Binary-opposition) তত্ত্বসূত্রে ভারতবর্ষের জনসাধারণকে ঔপনিবেশিক প্রশাসন কালা আদমি (native), অসভ্য, ইতর, মূর্খ ও দাস হিসেবেই বিবেচনা করতো; আর নিজেদের ভাবত শ্বেতাঙ্গ, সভ্য, উন্নত, আলোকিত, জ্ঞানী, প্রভু ও আদর্শ ধর্মের মানুষ হিসেবে। সিপাহী বিদ্রোহের পর ঔপনিবেশিক প্রশাসনের এই মনোভাব ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে ব্যাপকভাবে। ইতিহাস এই শিক্ষা দেয় যে, পৃথিবীর দেশে-দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরাই অধিকাংশ গণ-আন্দোলনের মূল স্রষ্টা – ‘Reactionary rulers are often the creators of great public movement’ (F. H. O’Donnell)। সিপাহী বিদ্রোহ-পরবর্তী সময়ে ভারতীয়দের প্রতি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের শোষণ, প্রতিহিংসা ও দমননীতির প্রতিক্রিয়ায় ক্রমে ভারতের রাজনীতিতে চরমপন্থা ও গুপ্ত সংগঠনের উদ্ভব হলো – দেশের নানা প্রান্তে একে একে গঠিত হতে থাকলো গোপন সংগঠন। ঔপনিবেশিক সরকারের নিরবচ্ছিন্ন আক্রোশ ও চণ্ডনীতির প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতার জন্য আবেদন-নিবেদনের বিপ্রতীপে উগ্রপন্থী রাজনীতি ক্রমে শক্তি অর্জন করতে থাকে। ভারতের মুক্তি তথা স্বাধীনতা অর্জনই ছিল এসব গোপন সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য।

ফরাসি বিপ্লবের (১৭৮৯-৯৪) সময় অমর বিপ্লবীরা যেমন ‘লা মার্সাই’ গান গাইতে গাইতে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, ঠিক তেমনিই গোপন সংগঠনের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ‘বন্দে মাতরম্’ বা দেশপ্রেমের গান গাইতে গাইতে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। দেশকে মাতৃজ্ঞানে অর্ঘ্য দিতে গুপ্ত সংগঠনের বিপ্লবীরা ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ – বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের কথাই ছিল তাদের সকলের অন্তরের কথা : ‘… অন্য লোকে স্বদেশকে একটা জড় পদার্থ কতকগুলো মাঠ, ক্ষেত্র, বন, পর্বত, নদী বলিয়া জানে; আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি।’ স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত গোপন সংগঠনের সদস্যরা অধ্যাত্মসাধনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে আত্মিক ও শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করতেন, যাতে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা জয়লাভ করতে পারেন।

বাংলায় গুপ্ত সংগঠন উদ্ভবের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮৭৭ সালে তিনি গঠন করেন গুপ্ত সংগঠন ‘স্বাধীনতার সাধক দল’। ইতালীয় রাজনীতিক মাৎসিনির ‘ইয়ং ইতালি’র আদর্শ এবং ‘কারবোনারি’ নামের গুপ্ত সমিতির কর্মপদ্ধতি ছিল স্বাধীনতার সাধক দলের মূল অনুপ্রেরণা। শিবনাথ শাস্ত্রীর নির্দেশে সংগঠনের সদস্যরা যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে গোপনে কারবোনারি গুপ্ত সমিতির কর্মপদ্ধতি ও আদর্শ প্রচার করতেন। ১৮৭৭ সাল-পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে একে-একে গঠিত হতে থাকে অনেক গোপন সংগঠন। এসব গোপন সংগঠনের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অরবিন্দ ঘোষ-প্রতিষ্ঠিত ‘Lotus and Dagger’ (১৮৯২), প্রমথনাথ মিত্র ও সতীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত ‘অনুশীলন সমিতি’ (১৯০২), অরবিন্দ ঘোষের নির্দেশনায় গঠিত ‘যুগান্তর সমিতি’ (১৯০৭), 888sport appর হেমচন্দ্র ঘোষের গুপ্ত সংগঠন ‘মুক্তি সংঘ’ (১৯২৮), মাস্টারদা সূর্য সেনের ‘যুগান্তর’ (১৯২৮) প্রভৃতি। দেশের বিভিন্ন শহরে এসব সংগঠনের শাখা গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমে গ্রামে-গঞ্জেও অনেক গোপন সংগঠন স্থাপিত হয় – দেখা দেয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষকবিদ্রোহ। সব সংগঠনেরই মূল লক্ষ্য ছিল দেশের মুক্তি। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যরা গোপনে দৈহিক শক্তিবর্ধনের সাধনায় ব্যাপৃত হন। ধর্মগ্রন্থপাঠ ও নিয়মিত শরীরচর্চা হয়ে ওঠে তাদের প্রাত্যহিক সাধনার বিষয়। ভারতবর্ষের সনাতন ধর্মাদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্যে এদের অনেকেই ছিলেন 888sport apk download apk latest versionবান – তারা ছিলেন উপনিষদ ও গীতার অমৃতময় বাণীর প্রতি একনিষ্ঠ বিশ্বাসী। অরবিন্দ ঘোষ বন্দে মাতরম্ (১৯০৬) পত্রিকায় ‘New condition’ শীর্ষক 888sport liveে লিখলেন : ‘সরকার যদি এদেশে প্রজার ন্যায্য অধিকার সর্বদাই অস্বীকার করে, তাহলে এর প্রতিক্রিয়ায় গুপ্ত হত্যা আর গুপ্ত কাজকর্ম অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।’ স্বাধীনতাকামী গুপ্ত সংগঠনগুলো অরবিন্দের এই বাণী পরমজ্ঞানে অনুসরণ করতো। এ লক্ষ্যে সহায়ক শক্তি-উৎস হিসেবে পাড়ায় পাড়ায় যুব সংগঠন (সাংস্কৃতিক, শরীরচর্চা, ক্রীড়া, নাট্য ইত্যাদি) গড়ে তুলতে উদ্যোগী হলো গুপ্ত সংগঠনগুলো। এ-সময় কলকাতা-888sport appসহ বাংলার অনেক শহরে স্থাপিত হলো অসংখ্য যুব-সংগঠন। এসব যুব সংগঠন গুপ্ত সংগঠনের কাজে গোপনে নানাপ্রকার সহায়তা করতো।

বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে গোপন সংগঠনগুলোর এই ধারায় আরেকটি সংগঠনের নাম বিশেষভাবে বলা যায় – এটি হচ্ছে ‘সঞ্জীবনী সভা’, তারই গোপন সাংকেতিক নাম ‘হামচূপামূ হাফ্’। এই গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গেই ছিল কিশোর রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘হামচূপামূ হাফ্’-ই হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রথম গুপ্ত সংগঠন।

তিন

উনিশ শতকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি নানা ক্ষেত্রেই আধুনিকতার সূতিকাগার হিসেবে কাজ করেছে। বাংলায় গোপন বৈপ্লবিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে। ঠাকুর-পরিবারের প্রবল স্বদেশপ্রেম, প্রগতিশীল চেতনা, আধুনিক চিন্তাধারা, মৌলিক উদ্ভাবনশক্তি, সামাজিক সংস্কারবাসনা এবং সৃষ্টিশীলতা নানাভাবে বিকশিত হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ঠাকুর-পরিবার গ্রহণ করতো নানা উদ্যোগ। এসব উদ্যোগেরই একটি ফলিত রূপ হচ্ছে ‘হিন্দুমেলা’। ১৮৬৭ সালে (১২৭৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তিতে) ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ‘চৈত্রমেলা’ – পরবর্তী সময়ে এর নাম হলো ‘হিন্দুমেলা’, উত্তরকালে যা ‘ন্যাশনাল মেলা’ বা জাতীয় মেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্রথম চৈত্রমেলার সম্পাদক ও সহকারী সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নবগোপাল মিত্র। হিন্দুমেলার উৎসব তৎকালীন কলকাতায় হয়ে উঠেছিল প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব। ঠাকুর-পরিবার কর্তৃক প্রবর্তিত হিন্দুমেলার পরিচয় দিতে গিয়ে গবেষক পাঁচুগোপাল বক্সি লিখেছেন : ‘বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির অন্যতম বেগবান ধারা মেলার গ্রামীণ জীবনের উপাদান (texture) ও স্বাদ (flavour) রাজধানী শহরে আমদানি করে দেশবাসীর অন্তরে সংহতি ও স্বদেশানুরাগ উন্মেষের এই প্রয়াস ঠাকুর পরিবারের সন্তানগণের দূরদর্শিতা ও সমাজমনস্কতারই পরিচায়ক।’ কবিও এই উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন বাল্যকালেই। হিন্দুমেলা উপলক্ষে কেবল কলকাতা শহরেই নয়, সারা বাংলাতেই একটা সাড়া পড়ে যেত। রাজনারায়ণ বসু তাঁর আত্মচরিত-এ লিখেছেন :

১৮৬৭ সাল হইতে প্রতি বৎসর হিন্দুমেলা খুব জাঁকের সহিত করা হইত। কলিকাতার অনেক সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য ব্যক্তি এই মেলায় যোগ দিতেন এবং ওই মেলায় প্রদর্শনের জন্য নানা জিনিস পাঠাইতেন। নানাপ্রকার ফলমূল ও পুষ্প এবং 888sport live chatকার্য প্রদর্শিত হইত। আমার 888sport app download for android হয় বস্ত্রবয়নের এক নূতন যন্ত্র একবার মেলায় প্রদর্শিত হইয়াছিল। কিন্তু সে যে প্রকার যন্ত্র তাহা সাধারণের ব্যবহারের উপযুক্ত নহে। মেলা উপলক্ষ্যে ব্যায়াম, ক্রীড়া ও পাইকদিগের খেলা হইত এবং 888sport app download apkও পঠিত হইত। কেহ কেহ বক্তৃতা করিতেন। ১৮৭৫ সালে যে মেলা হয় তাহার সভাপতির কার্য আমি সম্পাদন করি। ওই মেলা কলিকাতার পারসির বাগান নামক বিখ্যাত উদ্যানে হইয়াছিল। এই মেলা উপলক্ষ্যে বরদাবাসী সুবিখ্যাত গায়ক মৌলাবক্সের গান হয় এবং যশোহরের নড়ালবাসী জমিদার রায়চরণ রায় ব্যাঘ্র শিকারে নৈপুণ্য জন্য এক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হয়েন। আমি সভাপতি স্বরূপে ওই পদক তাঁহার গলায় পরাইয়া দিই। মৌলাবক্স তাঁহার সংগীত ক্ষমতা দেখাইয়া সকলকে মুগ্ধ করিয়াছিলেন।

১৮৭৫ সালের হিন্দুমেলায় পাঠের উদ্দেশ্যে কিশোর রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘হিন্দুমেলার উপহার’ নামে একটি 888sport app download apk। এটিই ছাপার অক্ষরে কবির স্বনামে প্রকাশিত (দ্বিভাষিক অমৃতবাজার পত্রিকার ১৮৭৫ সালের ফেব্রুয়ারির বাংলা সংস্করণ) প্রথম 888sport app download apk। এ বছরেও হিন্দুমেলায় পৌরহিত্য করেন রাজনারায়ণ বসু। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাজ রে শিঙাবাজ্ এই রবে’ গানটির অনুকরণে এবং অভিন্ন ছন্দে তেরো বছর আট মাস বয়সী কিশোর রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ‘হিন্দুমেলার উপহার’। রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠিরের রাজ্যশাসন 888sport app download for android, পৃথ্বীরাজ ও দুর্গাবতীর আত্মত্যাগের সবিস্ময় প্রশংসা এবং ভারতের দুর্গতি ও মুক্তিলাভের ইঙ্গিত দিয়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ‘হিন্দুমেলার উপহার’।  ১৮৭৭ সালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ঔপনিবেশিক প্রশাসন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি, বরং তারা ‘ভারত-সম্রাজ্ঞী মহারানী’ ভিক্টোরিয়াকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। মহারানীর অভিষেকে ভারতীয় প্রতিনিধিরাও যোগ দেন। এ-সংবাদ শুনে বালক রবীন্দ্রনাথ তখন ব্যথিত হন এবং তিনি একটি জ্বালাময়ী 888sport app download apk রচনা করেন। নিজের সেই জ্বালাময়ী 888sport app download apk প্রসঙ্গে জীবন888sport sign up bonus গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :

লর্ড কর্জনের সময় দিল্লি দরবার সম্বন্ধে গদ্য888sport live লিখিয়াছি – লর্ড লিটনের সময় লিখিয়াছি পদ্য। তখনকার ইংরেজ গবর্মেন্ট রুসিয়াকেই ভয় করিত, কিন্তু চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সের বালক-কবির লেখনীকে ভয় করিত না। এইজন্য সেই কাব্যে বয়সোচিত উত্তেজনা প্রভূত পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও তখনকার প্রধান সেনাপতি হইতে আরম্ভ করিয়া পুলিশের কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত কেহ কিছুমাত্র বিচলিত হইবার লক্ষণ প্রকাশ করেন নাই। টাইম্স্ পত্রেও কোনো পত্রলেখক এই বালকের ধৃষ্টতার প্রতি শাসনকর্তাদের ঔদাসীন্যের উল্লেখ করিয়া বৃটিশ রাজত্বের 888sport live football সম্বন্ধে গভীর নৈরাজ্য প্রকাশ করিয়া অত্যুষ্ণ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করেন নাই। সেটা পড়িয়াছিলাম হিন্দুমেলায় গাছের তলায় দাঁড়াইয়া। শ্রোতাদের মধ্যে নবীন সেন মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। আমার বড়ো বয়সে তিনি একদিন এ-কথা আমাকে 888sport app download for android করাইয়া দিয়াছিলেন।

হিন্দুমেলার উৎসবে উদ্দীপনাময় 888sport app download apk রচনা রবীন্দ্রনাথের কৈশোরক আবেগ-সংক্ষোভের কথাই প্রকাশ করে। এই আবেগ-সংক্ষোভই সমকালে গুপ্ত সংগঠন হামচূপামূ হাফ্-এর প্রতি তাঁকে বিশেষভাবে আগ্রহী করে তোলে। হিন্দুমেলায় রবীন্দ্রনাথ অনেকটা নবীন নেতার মতো অংশগ্রহণ করতেন। প্রসঙ্গত 888sport app download for android করা যায় নবীনচন্দ্র সেনের ভাষ্য। নবীনচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন : ‘নেশনাল মেলা দেখিতে গিয়াছিলাম। উদ্যানের এক কোণায় প্রকাণ্ড এক বৃক্ষতলায় … দেখিলাম সাদা ঢিলা ইজার চাপকান পরিহিত একটি সুন্দর নবযুবক দাঁড়ায়া আছেন। … বৃক্ষতলায় যেন একটি স্বর্ণমূর্তি স্থাপিত হইয়াছে। … সহাসিমুখে করমর্দন কার্যটি শেষ হইলে তিনি পকেট হইতে একটি নোটবুক বাহির করিয়া কয়েকটি গীত গাহিলেন ও কয়েকটি 888sport app download apk গীতকণ্ঠে পাঠ করিলেন। মধুর কামিনী-লাঞ্ছিত কণ্ঠে এবং 888sport app download apkর মাধুর্যে ও স্ফুটনোন্মুখ প্রতিভায় আমি মুগ্ধ হইলাম।’ নবীনচন্দ্র সেনের এই ‘সুন্দর নবযুবক’ এবং ‘স্ফুটনোন্মুখ প্রতিভা’ যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তা লেখাই বাহুল্য। কিন্তু বিস্ময়কর তথ্য এই যে, Vernacular Press Act, 1878 জারির কারণে সেদিনের কোনো পত্রিকা বা সাময়িকপত্র বালক-কবি রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের রচনা প্রকাশ করতে সাহস করেনি।

চার

সুতীব্র দেশানুরাগের কারণেই হিন্দুমেলার পাশাপাশি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার একটি গোপন স্বাদেশিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এই গোপন সভাটিরই সাংকেতিক নাম ‘হামচূপামূ হাফ্’। এর প্রকাশ্য নাম ছিল ‘সঞ্জীবনী সভা’। রাজনারায়ণ বসুর জামাতা কৃষ্ণকুমার মিত্র সঞ্জীবনী নামে একটি সাপ্তাহিক সাময়িকী সম্পাদনা করতেন। পত্রিকার এই নামেই প্রতিষ্ঠিত হয় সঞ্জীবনী সভা। হিন্দুমেলা হয়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক সম্মিলন। সাংস্কৃতিক সম্মিলন  তো দেশ স্বাধীন করতে পারে না, তার জন্য চাই বিপ্লবী সংগঠন। গোপনে বৈপ্লবিক কাজ করার উদ্দেশ্যেই ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে গঠিত হলো ‘হামচূপামূ হাফ্’। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : ‘উত্তেজনার ইন্ধন জোগালো ‘সঞ্জীবনী সভা’। হিন্দুমেলার উৎসব তখনো বছরে বছরে বসে; সেটা হয়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক-সম্মেলন। কিন্তু মেলার লোকে তো আর দেশ স্বাধীন করতে পারে না; তার জন্য চাই বিপ্লব। তলে তলে বৈপ্লবিক কাজ করবার জন্য গুপ্ত সমিতি স্থাপিত হল, তারই নাম সঞ্জীবনী সভা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু প্রভৃতি ছিলেন এর পাণ্ডা। সে সভায় নিজের রক্ত দিয়ে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করতে হত; সাংকেতিক ভাষার ব্যবহার হত – ঐ ভাষায় সঞ্জীবনী সভাকে বলা হত ‘হামচূপামূ হাফ্’।’

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোপন সংগঠন হামচূপামূ হাফ্। ব্যক্ত হয়েছে যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য এটিই হচ্ছে বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রথম গোপন সংগঠন। কলকাতা শহরের ঠনঠনের এক গলির মধ্যে একটা পোড়ো বাড়ির গোপন কুঠুরিতে বসতো হামচূপামূ হাফের সভা। সভা আরম্ভ হতো ঋগ্বেদের মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে। সবার সামনে থাকতো বেদির ওপর মড়ার মাথার খুলি, লাল জবা আর খোলা তলোয়ার। সভার সদস্যদেরও হাতে থাকতো খোলা তলোয়ার। সভায় উপস্থিত সদস্যদের ‘ভারত উদ্ধারের দীক্ষা’ পর্বে নিজের রক্ত দিয়ে প্রতিজ্ঞাপর্বে স্বাক্ষর করতে হতো। সকলেই সাংকেতিক ভাষায় কথা বলতো। হামচূপামূ হাফ্ সম্পর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবন888sport sign up bonusতে লিখেছেন :

আদি ব্রাহ্মসমাজ পুস্তকাগার হইতে লাল রেশমে জড়ানো বেদমন্ত্রের একখানা পুঁথি এই সভায় আনিয়া রাখা হইয়াছিল। টেবিলের দুই পাশে দুইটি মড়ার মাথা থাকিত, তাহার দুইটি চক্ষুকোটরে দুইটি মোমবাতি বসানো ছিল। মড়ার মাথাটি মৃত-ভারতের সাংকেতিক চিহ্ন। বাতি দুইটি জ্বালাইবার অর্থ এই যে, মৃত ভারতে প্রাণ সঞ্চার করিতে হইবে ও তাহার জ্ঞানচক্ষু ফুটাইয়া তুলিতে হইবে। এ ব্যাপারে ইহাই মূল কল্পনা। সভার প্রারম্ভে বেদমন্ত্র গীত হইত – সংগচূধ্বম সংবদধ্বম্। সকলে সমস্বরে এই বেদমন্ত্র গান করার পর তবে সভার কার্য্য আরম্ভ হইত।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো অনুরূপ কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সত্তর বছর বয়সপূর্তি অনুষ্ঠানের অভিভাষণে জানিয়েছেন এই কথা : ‘জ্যোতিদাতা এক গুপ্ত সভা স্থাপন করেছেন, একটি পোড়ো বাড়িতে তার অধিবেশন, ঋগ্বেদের পুথি, মড়ার মাথার খুলি আর খোলা তলোয়ার নিয়ে তার অনুষ্ঠান, রাজনারায়ণ বসু তার পুরোহিত; সেখানে আমরা ভারত উদ্ধারের দীক্ষা পেলাম।’ জীবন888sport sign up bonusর ‘স্বাদেশিকতা’ পর্বে হামচূপামূ হাফ্ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বিশদ লিখেছেন। গুপ্ত এই সভার উদ্দেশ্য, কার্যাবলি এবং তার পরিণতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘জ্যোতিদাদার উদ্যোগে আমাদের একটি সভা হইয়াছিল …। ইহা স্বাদেশিক সভা। কলিকাতার এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসিত। সেই সভার সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল। বস্তুত তাহার মধ্যে ঐ গোপনীয়তাই একমাত্র ভয়ঙ্কর ছিল। আমাদের ব্যবহারে রাজার বা প্রজার ভয়ের বিষয় কিছুই ছিল না। আমরা মধ্যাহ্নে কোথায় কী করিতে যাইতেছি, তাহা আমাদের আত্মীয়রাও জানিতেন না। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋক্মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপিচুপি – ইহাতেই সকলের রোমহর্ষণ হইত, আর বেশি-কিছুই প্রয়োজন ছিল না। আমার মতো অর্বাচীনও এই সভার সভ্য ছিল। সেই সভায় আমরা এমন একটি খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে, অহরহ উৎসাহে যেন আমরা উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ আমাদের কিছুই ছিল না। এই সভায় আমাদের প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো।’ রবীন্দ্রনাথ যদিও একে খ্যাপামি বলেছেন, তবু রাজনারায়ণ-জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো মানুষের কাজকে একদম খ্যাপামি বলে উড়িয়ে দিতে চান না গবেষক পাঁচুগোপাল বক্সি। তিনি লিখেছেন : ‘… দেশের উন্নতিসাধন করবার জন্য এবং দেশের সমস্ত খর্বতা দীনতা অপমানকে দগ্ধ করে ফেলার উদ্দেশ্যেই দেশপ্রেমিক রাজনারায়ণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। এই পদক্ষেপ সুবিবেচিত ও তাঁর তেজস্বিতার পথে সামঞ্জস্য। এ প্রয়াস ‘অসাধ্য প্ল্যান’ হতে পারে কিন্তু এর মধ্যে এক ফোঁটা কৃত্রিমতা বা ভড়ং ছিল না। রাজনারায়ণের মতো উচ্চ শিক্ষিত সমুন্নত ব্যক্তিত্ব ভাবনা-চিন্তা না করে দেশোদ্ধারের অভিপ্রায়ে ‘খ্যাপামি’ করবেন এ-কথা ভাবাই যায় না।’

হামচূপামূ হাফ্ যে বেশি কিছু করতে পেরেছে তা নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কার্যক্রমের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে দেশোদ্ধারের ব্রতের কথা পাওয়া যায়, কিন্তু বাস্তব কোনো কার্যক্রম পাওয়া যায় না। বোঝা যায়, একটা আবেগ কাজ করেছে বটে, কিন্তু সে-আবেগ বাস্তবায়নের কোনো ফলিত রূপ ছিল না। হামচূপামূ হাফের কার্যক্রম সম্পর্কে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবন888sport sign up bonusতে তিনি লিখেছেন :

ভারতবর্ষের একটা সর্বজনীন পরিচ্ছদ কী হইতে পারে, এই সভায় জ্যোতিদাদা তাহার নানা প্রকারের নমুনা উপস্থিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ধুতিটা কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে অথচ পায়জামাটা বিজাতীয়, এই জন্য তিনি এমন একটা আপস করিবার চেষ্টা করিলেন যেটাতে ধুতিও ক্ষুণ্ন হইল, পায়জামাও প্রসন্ন হইল না। … তিনি পায়জামার ওপর একখণ্ড কাপড় পাট করিয়া একটা স্বতন্ত্র কৃত্রিম মালকোঁচা জুড়িয়া দিলেন। সোলার টুপির সঙ্গে পাগড়ির সঙ্গে মিশাল করিয়া এমন একটা পদার্থ তৈরি হইল যেটাকে অত্যন্ত উৎসাহী লোকেও শিরোভূষণ বলিয়া গণ্য করিতে পারে না। এইরূপ সর্বজনীন পোশাকের নমুনা সর্বজনে গ্রহণ করিবার পূর্বেই একলা নিজে ব্যবহার করিতে পারা যে-সে লোকের সাধ্য নহে। জ্যোতিদাদা অমøানবদনে এই কাপড় পরিয়া মধ্যাহ্নের প্রখর আলোকে গাড়িতে গিয়া উঠিতেন – আত্মীয় এবং বান্ধব, দ্বারী এবং সারথি সকলেই অবাক হইয়া তাকাইত, তিনি ভ্রƒক্ষেপমাত্র করিতেন না। … রবিবারে রবিবারে জ্যোতিদাদা দলবল লইয়া শিকার করিতে বাহির হইতেন। … মানিকতলায় পোড়োবাগানের অভাব নাই। আমরা যে-কোনো একটা বাগানে ঢুকিয়া পড়িতাম। পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসিয়া উচ্চনীচনির্বিচারে সকলে একত্র মিলিয়া লুচির উপরে পড়িয়া মুহূর্তের মধ্যে কেবল পাত্রটাকে মাত্র বাকি রাখিতাম।

কীভাবে স্বল্প খরচে স্বদেশি দিয়াশলাইয়ের কারখানা স্থাপন করা যায়, কীভাবে দেশি কাপড় তৈরি করা যায়, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে দেশি পণ্য কীভাবে জনপ্রিয় করা যায় – এসব বিষয়ই ছিল হামচূপামূ হাফের মূল লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনটি মাঝে মাঝে প্রচারপত্রও বিলি করতো। দেশি কাপড় উৎপাদন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কৌতুককর মন্তব্য পাওয়া যায় এভাবে : ‘খবর পাওয়া গেল, একটি কোনো অল্পবয়স্ক ছাত্র কাপড়ের কল তৈরি করিবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত; গেলাম তাহার কল দেখিতে। সেটা কোনো কাজের জিনিস হইতেছে কি না তাহা কিছুমাত্র বুঝিবার শক্তি আমাদের কাহারও ছিল না। কিন্তু বিশ্বাস করিবার ও আশা করিবার শক্তিতে আমরা কাহারও চেয়ে খাটো ছিলাম না। যন্ত্র তৈরি করিতে কিছু দেনা হইয়াছিল, আমরা তাহা শোধ করিয়া দিলাম। অবশেষে একদিন দেখি ব্রজবাবু মাথায় একখানা গামছা বাঁধিয়া জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত। কহিলেন, ‘আমাদের কলে এই গামছার টুকরা তৈরি হইয়াছে।’ বলিয়া দুই হাত তুলিয়া তাণ্ডব নৃত্য – তখন ব্রজবাবুর মাথার চুলে পাক ধরিয়াছে।’ অবশেষে একদিন বন্ধ হয়ে গেল হামচূপামূ হাফ্। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘অবশেষে দুটি-একটি সুবুদ্ধি লোক আসিয়া আমাদের দলে ভিড়িলেন, আমাদিগকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াইলেন এবং এই স্বর্গলোক ভাঙিয়া গেল।’

হামচুপামূ হাফ্ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দৃষ্টিগ্রাহ্য ভূমিকা পালন করেছে, এমনটা বলার কোনো সুযোগ নেই। তবে একথা বলতেই হবে যে, ভারতের প্রথম এই গুপ্ত সংগঠন ঐতিহাসিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কিশোর রবীন্দ্রনাথের চেতনায় দেশের মুক্তি ও স্বাদেশিকতার যে ছাপ এঁকে দেয়, উত্তরকালে তাঁর সৃজনভুবনে তা সঞ্চার করে দূরসঞ্চারী প্রভাব। কতগুলো কারণে হামচূপামূ হাফের গুরুত্বকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। হামচূপামূ হাফ্ বাংলা তথা গোটা ভারতবর্ষে গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রাজনারায়ণের চেতনাতেই প্রথম বৈপ্লবিক ভাবনার উদয় হয়, ক্রমে যা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলায়। এই গুপ্ত সমিতি স্থাপনের পরপরই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে একে একে গঠিত হয় অনেক গুপ্ত সংগঠন। এই সমিতির অনেক নিয়মেরও প্রভাব পড়েছিল অন্য গুপ্ত সংগঠনগুলোর ওপর। যেমন মন্ত্রগুপ্তি। প্রতিটি সংগঠনে মন্ত্রগুপ্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো। হামচূপামূ হাফের সদস্যদের মতো অন্য সংগঠনের সদস্যরাও আপন বুকের রক্তে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করেন। হামচূপামূ হাফ্ ও অন্য গুপ্ত সংগঠনগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। সে-উদ্দেশ্য হলো, বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জন। স্বাদেশিক চেতনা ছিল সব গুপ্ত সমিতির সাধারণ লক্ষণ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে জাতীয় পোশাকের প্রচলন করতে চেয়েছেন, তা গৃহীত না হলেও তাঁর চেতনার জাতীয় মুক্তি ও স্বাদেশিকতাকে তো স্বীকার করতেই হবে। হামচূপামূ হাফের সভ্যরা দেশীয় কাঁচামাল, কুটির888sport live chat, লোকপ্রযুক্তি ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন; তারা ভেবেছিলেন, এর মাধ্যমে জনসাধারণের মনে বিলেতি পণ্য বর্জনের চেতনা সৃষ্টি হবে। এই গুপ্ত সংগঠনের কার্যাবলির মূল্যায়ন করতে গিয়ে গবেষক পাঁচুগোপাল বক্সি লিখেছেন : ‘হামচূপামূ হাফ্-এর উদ্যোগে স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদনের পরিকল্পনা (Scheme) গ্রহণ করা হয়। তার ফলে যে দেশলাই বা বস্ত্রখণ্ড (গামছা) তৈরি হয় তা উন্নতমানের বা ব্যবহার্য নাও হতে পারে কিন্তু এই পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার মূলে যে মহৎ উদ্দেশ্য ও ‘দেশের প্রতি জ্বলন্ত অনুরাগ’ নিহিত; তার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সভার সভ্যগণ নিজ নিজ উপার্জনের দশমাংশ স্বদেশি সামগ্রী উৎপাদনের জন্য দান করে দেশের কল্যাণ কামনায় ত্যাগ স্বীকার ও লোকহিতৈষণার অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।’

হামচূপামূ হাফ্-এর এক বছর পরে ১৮৭৭ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকা। দ্বিজেন্দ্রনাথ-সম্পাদিত ভারতী পত্রিকারও মূল দর্শন ছিল স্বদেশচেতনা ও মানবমুক্তি। ভারতীকে হামচূপামূ হাফ্-এর উপজাত বা by-product হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। হামচূপামূ হাফ্-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তেমনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন ভারতী পত্রিকার সঙ্গেও। ১৮৯৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হামচূপামূ হাফ্-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ স্বাদেশিক চেতনার অনেক 888sport live football রচনা করেছেন – 888sport app download apk-গান-888sport alternative link-নাটক-888sport liveে প্রকাশ করেছেন স্বদেশবন্দনা ও মানবমুক্তির কথা। গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে কৈশোরক সংশ্লিষ্টতা এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে সর্বদা প্রভাবিত করেছে – এমন ধারণা অমূলক নয়।

পাঁচ

হামচূপামূ হাফ্-এর সভায় পাঠ এবং সমবেত গানের জন্য সভ্যরা 888sport live footballকর্ম রচনা করতেন। এক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন রাজনারায়ণ বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণকুমার মিত্র এবং কিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সংগঠনের আদর্শের সঙ্গে মিল থাকলে যে-কোনো লেখকের রচনাবলি পাঠ বা গান গাওয়া হতো। হামচূপামূ হাফ্-এর সভায় সমবেত গানের জন্য রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন জাতীয় সংহতি ও উদ্দীপনাময় এই স্বদেশসংগীত :

এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন,

এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্রটি জীবন –

     বন্দে মাতরম্ ॥

আসুক সহস্র বাধা, বাধুক প্রলয়,

আমরা সহস্র প্রাণ রহিব নির্ভয় –

    বন্দে মাতরম্ ॥

আমরা ডরাইব না ঝটিকা-ঝঞ্ঝায়,

অযুত তরঙ্গ বক্ষে সহিব হেলায়।

টুটে তো টুটুক এই নশ্বর জীবন,

তবু না ছিঁড়িবে কভু এ দৃঢ় বন্ধন –

   বন্দে মাতরম্ ॥

সম্মিলিত গণচেতনা, জাতীয় সংহতি এবং ঐক্যবদ্ধ জনশক্তি যে আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য জরুরি বিষয় – এই উপলব্ধি কিশোর রবীন্দ্রনাথের এই গানটিতে প্রতিফলিত।

উত্তরকালে রবীন্দ্রনাথ অনেক স্বদেশসংগীত রচনা করেছেন – দেশপ্রেমের গান লিখে সৃষ্টি করেছেন জাতীয় উদ্দীপনা। ‘আজি 888sport appsের হৃদয় হতে’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আজ সবাই জুটে আসুক ছুটে’, ‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক’ – এসব গানে রবীন্দ্রনাথের গভীর স্বদেশচেতনা প্রকাশ পেয়েছে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য কবি জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য সমর্পণের সংকল্প ঘোষণা করেছেন :

হে ভারত, আজি তোমারি সভায় শুন রে কবির গান।

তোমার চরণে নবীন হরষে এনেছি পূজার দাম।

এনেছি মোদের দেহের শকতি, এনেছি মোদের মনের ভকতি,

এনেছি মোদের ধর্মের মতি, এনেছি মোদের প্রাণ –

এনেছি মোদের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য তোমারে করিতে দান ॥

বাংলাকে খণ্ড খণ্ড করে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে খর্ব করার ষড়যন্ত্র ঔপনিবেশিক প্রশাসন আরম্ভ করে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এর প্রতিবাদে গোটা বাংলায় শুরু হয় তীব্র গণ-আন্দোলন। কিন্তু জনরোষকে তোয়াক্কা না করে ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বাংলাকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ঘোষণা জারি করে ব্রিটিশ প্রশাসন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। অনেকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন এই গণ-আন্দোলনের পুরোভাগে। তিনি অংশগ্রহণ করেছেন মিছিলে, সকলের সঙ্গে সেøাগান উচ্চারণ করেছেন, সমবেত কণ্ঠে দেশজননীর সংগীত গেয়েছেন, আর লিখেছেন বাঙালির স্বদেশপ্রেমের চিরায়ত এই গান :

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল –

পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥

বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ –

পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির

                                                          ভাষা –

সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান ॥

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন –

এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান ॥

সংগীতের মতো বিভিন্ন 888sport app download apkকেও রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিক চেতনার নিপুণ প্রকাশ ঘটেছে। চিত্রা কাব্যের ‘নগরসংগীত’ 888sport app download apkয় যেসব চিত্রকল্প ও খণ্ডছবি নির্মিত হয়েছে, তাতে স্পষ্টতই হামচূপামূ হাফ্-এর 888sport sign up bonus কাজ করেছে বলে ধারণা করা যায়। ‘বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ জীবন-আহুতি ঢালিয়া’, ‘দিতেছে অস্থি, দিতেছে রক্ত, সকল শক্তিসাধনা’, ‘বিপ্র ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র, মিলিয়া সকলে মহৎ ক্ষুদ্র/ খুলেছে জীবনযজ্ঞ রুদ্র’ – এসব চিত্রে হামচূপামূ হাফ্-এর প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়। শোষক ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এখানে উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী – যার বিকশিত রূপ, অনেকাংশে যেন, পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ 888sport app download apkয়। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন এই দ্রোহভাষ্য :

হাতে তুলি লব বিজয় বাদ্য

আমি অশান্ত, আমি অবাধ্য,

যাহা কিছু আছে অতি অসাধ্য

        তাহারে ধরিব সবলে।

আমি নির্মম আমি নৃশংস

সবেতে বসাব নিজের অংশ,

পরমুখ হতে করিয়া ভ্রংশ

       তুলিব আপন কবলে।

মনেতে জানিব সকল পৃথ্বী

আমারি চরণ-আসনভিত্তি,

রাজার রাজ্য দস্যুবৃত্তি

       কোনো ভেদ নাহি উভয়ে।

ধনসম্পদ করিব নস্য,

লুণ্ঠন করি আনিব শস্য,

অশ্বমেধের মুক্ত অশ্ব

       ছুটাব বিশ্বে অভয়ে।

হামচূপামূ হাফ্-এর অন্যতম উৎসাহী সদস্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সংগঠন দেশের মুক্তির জন্য যে ব্রত গ্রহণ করেছিল, তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার স্বদেশবাসীর প্রকৃতি বদল, দেহ ও চরিত্র গঠন। দেহে-মনে শক্তি অর্জিত না হলে, দেশোদ্ধারে সফলতা পাওয়া যাবে না। তাই চৈতালি কাব্যের ‘বঙ্গমাতা’ 888sport app download apkয় কবি স্বদেশের কাছে প্রত্যাশা করলেন সংগ্রামের জন্য যথার্থ বাঙালিকে : ‘পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে/ মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে/… পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে/ বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।/ প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে/ সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।/ শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে/ দাও সবে গৃহহাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।/ সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,/ রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।’ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ‘আফ্রিকা’ 888sport app download apkয় কবি ঘোষণা করেন সুতীব্র ক্ষোভ : ‘এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে,/ নখ যাদের তীক্ষè তোমার নেকড়ের চেয়ে,/ এল মানুষ-ধরার দল।/ গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।/ সভ্যের বর্বর লোভ/ নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।’ ত্রিশের দশকে পৃথিবীজুড়ে ফ্যাসিবাদী উন্মত্ততায় রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন – ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন সংগ্রামের বাণী। প্রান্তিক কাব্যের ১৮-সংখ্যক 888sport app download apkয় ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কবির উদাত্ত যুদ্ধ-ঘোষণা :

নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস –

বিদায় নেবার আগে তাই

ডাক দিয়ে যাই

দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।

রবীন্দ্রনাথের 888sport app download apk ও গান থেকে এমন বহু উদাহরণ উপস্থাপন করা যায়, যেখানে প্রকাশিত হয়েছে কবির গভীর দেশানুরাগ, প্রকাশিত হয়েছে উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কবির সুতীব্র ক্ষোভ। 888sport app download apk ও সংগীতের মতো রবীন্দ্রনাথের 888sport alternative link, ছোটগল্প, নাটক, 888sport liveেও অভিন্ন চেতনার সাক্ষ্য বর্তমান। প্রসঙ্গত তাঁর ঘরে-বাইরে, গোরা, চার অধ্যায়, মুক্তধারা, রক্তকরবী এসব রচনার কথা উল্লেখ করা যায়। এসব রচনার মধ্যে তাঁর কৈশোরক দেশানুরাগের 888sport sign up bonus আবিষ্কার করা সম্ভব।

চার অধ্যায় 888sport alternative linkে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গোপন কর্মকাণ্ড তথা ব্রিটিশ-কথিত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথে মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। হিন্দু-জাতীয়তাবাদ থেকে বিশ^-জাতীয়তাবাদে উত্তরণই গোরা 888sport alternative linkের কেন্দ্রীয় ভাবপরিমণ্ডল।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই গোরার জীবন আরম্ভ হয়েছে হিন্দু-জাতীয়তাবাদী চেতনায়, কিন্তু পরিণতিতে সে পৌঁছেছে বিশ^-মানবতাবাদে। শোষিত মানুষের মুক্তির আকুলতা এবং বন্ধন-ছেঁড়া মানবতা আনন্দলীলার রূপায়ণই মুক্তধারা নাটকের কেন্দ্রীয় অন্বিষ্ট। রক্তকরবী নাটকে 888sport live chatিতা পেয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে শোষক ও শোষিতের শ্রেণিদ্বন্দ্বের রূপক ছবি। এ-নাটকের যক্ষপুরী মূলত পুঁজিবাদী সমাজের রূপকাভাস। প্রসঙ্গত 888sport app download for android করা যায় রক্তকরবী নাটক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই ভাষ্য :

কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবী এই দুই জাতীয় সভ্যতা মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে, এ সম্বন্ধে বন্ধুমহলে আমি প্রায়ই আলাপ করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে কেবল উজাড় করে দিচ্ছে।  তা ছাড়া শোষণজীবী সভ্যতার ক্ষুধাতৃষ্ণা দ্বেষহিংসা বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষসেরই মতো। আমার মুখের এই বচনটি কবি তাঁর রূপকের ঝুলিতে লুকিয়ে আত্মসাৎ করেছেন, সেটা প্রণিধান করলেই বোঝা যায়। নবদূর্বাদলশ্যাম রামচন্দ্রের বক্ষসংলগ্ন সীতাকে স্বর্ণপুরীর অধিশ^র দশানন হরণ করে নিয়েছিল সেটা কি সেকালের কথা, না একালের? সেটা কি ত্রেতাযুগের ঋষির কথা, না আমার মতো কলিযুগের কবির কথা? তখনো কি সোনার খনির মালেকরা নবদূর্বাদলবিলাসী কৃষকদের ঝুঁটি ধরে টান দিয়েছিল? … রামায়ণ মুখ্যত মানুষের সুখদুঃখ বিরহ-মিলন ভালোমন্দ নিয়ে বিরোধের কথা; মানবের মহিমা উজ্জ্বল করে ধরবার জন্যেই চিত্রপটে দানবের পটভূমিকা। এই বিরোধ এক দিকে ব্যক্তিগত মানুষের, আরেক দিকে শ্রেণীগত মানুষের; রাম ও রাবণ এক দিকে দুই মানুষের ব্যক্তিগত রূপ, আরেক দিকে মানুষের দুই শ্রেণীগত রূপ। আমার নাটকও একই কালে ব্যক্তিগত মানুষের আর মানুষগত শ্রেণীর।

উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্পে উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থানের কথা জানা যায়। রবীন্দ্র-ছোটগল্পে উপনিবেশিত বাংলার যে ছবি চিত্রিত হয়েছে, সেখানে পাঠক অনায়াসেই আবিষ্কার করে নিতে পারেন রবীন্দ্রনাথের উত্তর-ঔপনিবেশিক মনোভাব। এ প্রসঙ্গে ‘পোস্টমাস্টার’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘একরাত্রি’, ‘দিদি’ প্রভৃতি গল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। কালান্তর গ্রন্থের ‘সভ্যতার সংকট’ 888sport liveে বিশ^-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছেন এই অমোঘ বাণী : ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন-না-একদিন ইংরেজকে ভারত-সাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জনাকে। একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে, তখন এ কী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দুর্বিষত নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে? জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ^াস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ^াস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে থাকি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ^াসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। … এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে …।’

১৯৪১ সালের ৩০শে জুলাই, যেদিন রবীন্দ্রনাথের দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়, সেদিন সকালে, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও, রবীন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবতার অগ্রযাত্রার সংবাদ। ভোরবেলা অন্তরঙ্গ আপনজন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ সস্ত্রীক কবিকে দেখতে গেলেন। কবি প্রথমেই তাঁদের কাছে জানতে চান সোভিয়েত ইউনিয়নের রণাঙ্গনের অবস্থা। প্রসঙ্গত, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের 888sport sign up bonusর 888sport app download for android নেওয়া যাক :

যেদিন অপারেশন করা হয় সেদিন সকালবেলা অপারেশনের আধ ঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে তাঁর এই শেষ কথা : ‘রাশিয়ার খবর বলো।’ বললুম, ‘একটু ভালো মনে হচ্ছে, হয়তো একটু ঠেকিয়েছে।’ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘হবে না? ওদেরই তো হবে। পারবে, ওরাই পারবে।’

– এভাবে, জীবনের অন্তিম-লগ্নেও বিশ্বমানবের বন্দনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আন্তরিক, সকল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবিকতার বিজয়ে পরম আশাবাদী। সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ প্রতিরোধ-পথযাত্রা মহাত্মা গান্ধী বা এরূপ অন্য মনীষীর মতো নেতিবাচক ছিল না। ফ্যাসিস্ট-আগ্রাসনের প্রতিবেশে বাস করেও গান্ধী যখন ঘরে বসে অসহযোগ আর স্বদেশি আন্দোলনের কথা বলেন, আর চরকায় কাটেন সুতা, তখন রবীন্দ্রনাথ প্রখর বাস্তববাদী সমাজমনস্ক রাজনীতিবিদের মতো সচেতন-ইতিবাচক ভূমিকায় আবির্ভূত হন। নিছক শান্তিবাদী বা Pacifist-দের মতো রবীন্দ্রনাথ কখনো বলেননি – ‘আমি সমস্ত রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে’, কিংবা গান্ধীর মতো বলেননি – ‘আমি সমস্ত রকম হিংস্র সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের বিরোধী।’ বরং দেখি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যপর্যায়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে জরুরি তারবার্তা পাঠান রবীন্দ্রনাথ, হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে সক্রিয় হওয়ার জন্য আমেরিকার কাছে অনুরোধ করেন তিনি – এবং এভাবেই সমকাললগ্নতার সীমানা পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান কালোত্তীর্ণ মানবিক-অমরাবতীতে।

বাংলার প্রথম গুপ্ত সমিতি হামচূপামূ হাফ্ গঠন এবং এই সংগঠনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংশ্লিষ্টতা তাঁর চেতনায় দ্রোহী ভাব ও বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্মেষে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। রবীন্দ্রনাথ সংগঠনের নাম উল্লেখ না করেও কথাটা জ্ঞাপন করেছেন কালান্তর গ্রন্থের ‘রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত’ শীর্ষক লেখায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘বালককালের অনেক প্রভাব জীবনপথে শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হয়ে থাকে; প্রত্যক্ষ না থাকলেও তাদের প্রণোদনা থেকে যায়।’ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে কবির সত্তর বছরপূর্তি উপলক্ষে শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ যে অভিভাষণ দেন, সেখানে তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টিতে হামচূপামূ হাফ্ নামক গোপন সংস্থাটির প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে :

… এই সকল আকাক্সক্ষা উৎসাহ উদযোগ – এর কিছুই ঠেলাঠেলি ভিড়ের মধ্যে নয়। শান্ত অবকাশের ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে এর প্রভাব আমাদের অন্তরে প্রবেশ করেছিল। রাজ-সরকারের কোতোয়াল হয় তখন সতর্ক ছিল না, নয় উদাসীন ছিল, তারা সভার সভ্যদের মাথার খুলি ভঙ্গ বা রসভঙ্গ করতে আসেনি।

সহায়কপঞ্জি

          ১.        জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩৬৩। জীবন888sport sign up bonus, কলকাতা : বিশ্বভারতী।

২. পাঁচুগোপাল বক্সি, ২০১৪। হামচূপামূ হাফ্ ও রবীন্দ্রনাথ, কলকাতা : পুনশ্চ।

৩.       প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ১৩-। রবীন্দ্রজীবনকথা,  কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।

৪. প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, ১৩৫০। ‘কবি-কথা’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ 888sport free bet, ১৩৫০।

৫. বিশ্বজিৎ ঘোষ, ২০১২। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ, 888sport app : গদ্যপদ্য।

          ৬.       রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৪০২। রচনাবলী (২য়, ৩য়, ৯ম, ১১তম ও ১২তম খণ্ড), কলকাতা : বিশ্বভারতী।

          ৭.       রাজনারায়ণ বসু, ১৪১২। আত্মচরিত, কলকাতা, চিরায়ত প্রকাশন

          ৮.       হায়দার আকবর খান রনো, ২০১৭। রবীন্দ্রনাথ : শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে, 888sport app : ছায়াবীথি।

         ৯.       F.H. O’Donnell, 1910. A History of the Irish Parliamentary Party, London.

        ১০.       R.C. Majumdar, 1961. An Advanced History of India, Calcutta.