আবুবকর সিদ্দিক
মেহনতি গণমানুষের সেই ফুঁসে ওঠা লড়াইয়ের আখের পরিণাম; – কী হলো তবে? তিরিশ-চল্লিশের দশকের সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলো! বিক্ষোভরত রেলশ্রমিকদের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন যুবকর্মী ও লেখক সোমেন চন্দ। প্রতিক্রিয়াশীল মালিকের ভাড়াটে গুণ্ডারা তাঁকে সূত্রাপুরের রাস্তায় ফেলে দিবালোকে খুন করে। সোমেন হত্যার প্রতিবাদে জন্ম নেয় অবিভক্ত বাংলায় প্রথম ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলন। সে-আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে। গণনাট্য, গণ888sport live football, গণসংগীত, গণসংস্কৃতি – লড়াকু বাম প্রগতিকর্মীরা সেই তখন থেকে যে মোকাবিলাফ্রন্ট গড়ে তোলেন, আমাদের এখানে বায়ান্নো-সাতষট্টি-আটষট্টি-ঊনসত্তর-সত্তর-একাত্তর তারই ধারাবাহিক অনুসৃতি। আমাদের প্রতিটি গণআন্দোলনের লড়াকু সহযাত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসেছে গণসংগীত। গ্রামেগ্রাঞ্জে-নগরেবন্দরে মেহনতি-শোষিত জনতার কণ্ঠে শোনা গেছে গণসংগীতের রণগর্জন।
তার পরপরই একাত্তরের সেই বহুকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। এবং সেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে কী যেন বাতজ্বরে ঝিমুনিতে পেয়ে বসেছে জাতিকে!
সর্বাঙ্গে উত্থানরহিত শনির দশা। মগজের কোন চোরারন্ধ্রে যেন দুরারোগ্য পচন ধরে বসে আছে!
খুব বেশি ব্যাপক বিষয়ে নয়, শুধু গণসংগীত ও সেই প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু কথা বলার আছে আমার। ধরা যাক, কোনো দৈবপাকের সুবাদে যদি সত্যিই তিনি আবার ফিরে আসতেন, তাহলে কী দশাটা হতো তাঁর এই হালের পণ্য পরিণামী ব্যবস্থাপনার যুগে? তাঁর মতো কট্টর পার্টিজান কর্মীর পক্ষে গণসংগীতকে পণ্যের বাজারে নিয়ে ফিরি করে বেড়ানো বা বিনোদনের মঞ্চে তুলে দিয়ে রূপীবানরের মতো নাচ দেখিয়ে হাততালি কুড়ানো; প্রশ্নই ওঠে না সে অধঃপতনের। তবে কি রোবটে পরিণত হতেন? উঁহু! একজন আপাদমস্তক চোখকান খোলা মানুষ ওরকম মহানির্লিপ্তিতে সমাধি নিতে পারতেন না কিছুতেই। অর্থাৎ শেষাবধি মহানিঃসঙ্গতার ব্যুহমধ্যে বসে ধুঁকে ধুঁকে আত্মক্ষয় করে যেতে হতো। সেই পরিণতির আংশিক আলামত চোখ এড়ায়নি তাঁর বয়স্য পার্শ্বচরদের। পার্টি পতিত। গণযুদ্ধের আদর্শগুলি কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। গণসংগীতের রেওয়াজ চালু থাকলেও ঝাঁজটা মরে গেছে। গলা বসে গেছে দোহারদের। অসিধারী ডিক্লাশড্ লড়–য়েরা মরচে ধরা তরবারি খাপে আটকিয়ে সিভিল সোসাইটির জটলায় মিশে গেছে।
‘বদলে দাও, বদলে যাও!’ গত একচল্লিশ বছর কতটুকু এগিয়েছি আমরা? কত পাল্লা বদলাতে পেরেছি নিজেদের? সোমেন চন্দের হত্যা থেকে বিশ্বজিৎ দর্জির হত্যা। বর্বরতার রোলমডেল অভিন্ন। একসূত্রে বাঁধা ছোটবড় প্রত্যক্ষপরোক্ষ দেশিবিদেশি সব অপকর্ম। ভূমিদখল-নদীদখল-ব্যাংকদখল-সেতুদখল সব স-ব আগ্রাসন অভিন্ন আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। বিশ্বপুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মোহিনী চোয়ালের অতলান্ত গহ্বরের মধ্যে আমরা সেই জন্মের আদি থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে সেঁধিয়ে যাচ্ছি। টের পেয়েও পাইনে। জেগে ঘুমোলে জ্ঞানপাপীর হুঁশ থাকে কি?
মাঝে একটিবার শুকনো নুড়ো দপ করে জ্বলে উঠে দিগি¦দিকে অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে বসেছিল। ষাটের দশকের সেই নকশাল আন্দোলনের কথা বলছি। চারু মজুমদারের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে এসে আমাদের কমরেড নজরুল ইসলাম 888sport appsেও গলাকাটার রাজনীতি চালু করেন। ছেলেদের হাতে হাতে মাও-সে-তুঙের রেডবুক ঘুরত তখন। বাতাস তাতানো কীসব ঝাঁজালো স্লোগান উড়ে বেড়াত মুখে মুখে : ‘গলাকাটা রাজনীতি চলছে চলবে,’ ‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস,’ ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।’ রাত জেগে পিকিং রেডিয়োর খবর শোনা হতো। তিরিশের প্রবীণ বিপ্লবী কালিপদবাবুর ফুলতলার বাড়িতে অনুষ্ঠিত ঘরোয়া আলোচনাচক্রে আমাদের একটি প্রশ্নের উত্তরে নজরুল ইসলাম তাঁর হাতের ‘লাল বই’ থেকে উদ্ধৃতি খুঁজে বের করে উত্তর দিয়েছিলেন। সেটা ’৬৯-এর দিকের ঘটনা। ১৯৭৪-এ রাজশাহীর তালাইমারীতে আমার বাসায় এক দুপুরে এসেছিলেন কমরেড নজরুল ইসলাম। চোখেমুখে নিঃসঙ্গতা। কিন্তু কথাবার্তায় একইরকম উদ্দীপনা। অন্যদের কথা কী বলবো! আমার মতো কলমসর্বস্ব মানুষও সেই ষাটের উত্তাল দিনে মাও-সে-তুঙকে চিঠি লিখে বসেছি আমার প্রকাশিতব্য গণসংগীতের বইয়ের জন্য আশীর্বাণী কামনা করেন। এরপর একাত্তরোত্তর ক্লাসিক বাম ফ্রাস্ট্রেশন নিয়ে অনেক কষ্টের 888sport app download apk লিখতে হয় আমাকে। সেগুলি আমার হে লোকসভ্যতা কাব্যে ছাপা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের মানুষ বেসরকারি-সরকারি দোতরফা বঞ্চনা-অত্যাচার-দুর্নীতির চাপে শ্বাসরুদ্ধকর জীবনযাপন করে আসছে। ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে না আসতেই গোদের উপর বিষম বিষফোঁড়ার মতো গজিয়ে উঠেছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের জঙ্গি সংগঠনগুলো, বহু বছর আগে ‘আমরা আছি তালেবান। আমরা যাবো আফগান।’ আওয়াজ তুলে খোলা রাজপথে মিছিল করতে দেখেছি এদের। ছাইচাপা থাকতে থাকতে জুতমতো বাতাস পেলে আবার জিগির তোলে কোরাসে। আজ আবার গর্ত থেকে গলা তুলে ইতিউতি তাকিয়ে রাও কাড়ার তালে আছে তারা। একাত্তরের যাবতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধের চিহ্নিত শত্র“ এরা। আরো সার কথা, প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে পৃথিবীতে যতরকম প্রতিক্রিয়াশীল এজেন্ট আছে, তাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক পক্ষ হচ্ছে এই ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী। এদের প্রতিহত করার জন্যে আজ অবশ্যই সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে সরাসরি মাঠে নেমে পড়ার দিন এসে গেছে আবার। পেটিবুর্জোয়া চর্চা থেকে বেরিয়ে এসে শাণিত হাতিয়ারের মতো ঝলসে উঠতে হবে বিপ্লবী পদে বাঁধা গণসংগীতকে। আর, গণসংগীতের সেই পুনর্বোধনী মঞ্চই পারে একজন নতুনতর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পুনরাবির্ভাবকে সম্ভবিত করতে। আমাদের বহুধা-উপদ্রুত জীবনের নেতৃত্বহীন সাংস্কৃতিক মঞ্চে আজ একজন নতুন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কণ্ঠে রণধ্বনি গর্জে ওঠার অপেক্ষা। সব থেকে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাঁর একক অস্তিত্বের আধারে তিনটি দুর্লভ গুণের ব্যতিক্রমী সমন্বয় ঘটেছিল : আমূল আপসহীনতা, অসাধারণ গায়কী ও সুদক্ষ সংগঠনক্ষমতা।
দুই
888sport appsের চলমান রাজনৈতিক কালবেলার পরিপ্রেক্ষিতে গণ888sport live chatী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আবশ্যিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমার কিছু ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি সংক্ষিপ্ত পরিসরে। আগ্রহী সংস্কৃতিকর্মীদের স্বাভাবিক চাহিদার কথা মনে রেখে এখন তাঁর 888sport live chatীজীবনের ছোট আলেখ্য দিয়ে সমাপ্তি টানবো এ-লেখাটির। প্রথমেই যে-তথ্যটি জরুরি হিসেবে উল্লেখ্য, সেটি হচ্ছে, ২০১২ সালটি হচ্ছে মহান গণসংগীত888sport live chatী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্মশতবর্ষ। ১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলা অঘ্রান মাসে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার মীরাশি গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। অঘ্রান তাঁর প্রিয় মাস। বিয়েও হয় এই মাসেই। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, অঘ্রানের ৫ তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়।
গণসংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অঘ্রান মাসপ্রীতির একটি বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। কারণ অঘ্রানই বাংলার কিষান-কিষানির ঘরে নতুন ফসল ওঠার মাস। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদে জমিদার। নাম হরকুমার বিশ্বাস। মায়ের নাম সরোজিনী দেবী। হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করার পর হেমাঙ্গ বিশ্বাস শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন। এখানে এসে তিনি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে দীক্ষা নেন। তারপর ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে তাঁর। পরিণামে প্রথম কারাবরণ জোটে তাঁর। এই অবস্থায়ই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। যাদবপুর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কারামুক্তি ঘটে তাঁর। পরে আবার তিনি গ্রেফতার হন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তেলেঙ্গানা বিপ্লব আন্দোলন চলাকালে। ১৯৫১ সালে তিনি মুক্তি পান। তিনি আজন্ম এবং আজীবন একজন আপসহীন শ্রেণিসচেতন প্রগতিযোদ্ধা। সে বিষয়ে পরে আলোচনায় আসছি। আপাতত জানানোর মতো জরুরি তথ্যটি হচ্ছে, যৌবনের শুরুতেই তিনি জমিদারপিতার প্রজাশোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গৃহত্যাগ করেন। জীবনে গণসম্পৃক্তির সূচনা সেই তখন থেকেই। সেই সূত্র ধরেই গণসংগীতচর্চায় হাতে খড়ি। এ-ব্যাপারে তিনি প্রথম দিকে উদ্বুদ্ধ হন প্রখ্যাত অসমীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার সংস্পর্শে এসে। সে সময়টা চল্লিশের দশক। কিছু পরে কলকাতার কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৯৪২-এর দিকে বাংলা প্রগতিশীল লেখক888sport live chatী সংঘের আমন্ত্রণে তিনি সংগীত পরিবেশন করতে কলকাতায় আসেন। এবং ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে জ্যোতিপ্রাদকে সঙ্গে নিয়ে সিলেট গণনাট্য সংঘ প্রতিষ্ঠিত করেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীতচর্চা নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনায় আসছি। ১৯৫৬ সালে চিকিৎসার জন্য চীনে যান তিনি। সেখানে আড়াই বছর ছিলেন। তাঁর এই চীনযাত্রার পেছনে রাজনৈতিক আগ্রহের একটা বড় ভূমিকা ছিল। মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে পরিচালিত নয়াচীনের কালচারাল রেভলিউশন সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ লাভ করেন সেই সফরে। ১৯৬১ সালে কলকাতাস্থ সোভিয়েত কনস্যুলেটের সোভিয়েত দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। কিন্তু মতপার্থক্যের কারণে সে-চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৭১ সালে তিনি মাসসির্ঙ্গাস নামে নিজের গণসংগীতের দল গঠন করেন। ১৯৮৭ সালের ২২ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্মপরিবেশ প্রভাব ফেলেছিল সিলেট অঞ্চলের প্রচলিত লোকসংগীতের ধারা আর তখনকার স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। তাঁর আবির্ভাবকালীন এই বিশেষ বাতাবরণ মনে রাখা দরকার। প্রগতিশীল রাজনীতির আলোকে লোকসংগীতের ট্র্যাডিশনাল সুরকাঠামোকে বিবর্তিত করেছেন গণজাগরণের হাতিয়ারে। আর ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের উন্মাদনাকে বৃহত্তর শ্রেণিসংগ্রামের মঞ্চে বের করে এনেছেন। তাঁর এই মুক্ত মানসিকতার নেপথ্যে সে-যুগে সংগ্রামী বিশ্বের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবের দিকে লক্ষ রাখা দরকার। আন্তর্জাতিক সর্বহারার মুক্তি-আন্দোলনে বিশ্বাসী হেমাঙ্গ বিশ্বাস মেহনতি মানুষের মুক্তির সুরে বেঁধে দিয়ে বাংলার লোকায়ত সংগীতেরও বৃহত্তর মাত্রায় নবমুক্তি ঘটান।
গণসংগীত আসলে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ার। এই সাংস্কৃতিক হাতিয়ার তাকে সাহস জোগায় সমাজ বদলের স্বপ বাস্তবায়িত করার ধ্রুব লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে। এই গোষ্ঠীচেতনাই তাকে মুক্তি দিয়েছে সংগীতের চিরাচরিত ব্যক্তিমালিকানা থেকে মানবতার বৃহত্তর পরিসরে বেরিয়ে আসতে। একদিকে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদ-পুঁজিবাদ, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক নিগ্রহ ও দেশীয় জোতদারি-মহাজনি শোষণ, ঘরে-বাইরে এই দ্বিমুখী দুশমন ছিল সেই যুগে গণসংগীতের দুটো মূল টার্গেট। খুব সুস্পষ্টভাবে হেমঙ্গ বিশ্বাস দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন : ‘স্বাদেশিকতার ধারা যেখানে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতার মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে, সেই মোহনায় গণসংগীতের জন্ম।’ তিনি আরো বলেছেন, গানগুলো তাঁর একার সৃষ্টি নয়, আন্দোলনকারী জনগণই এদের স্রষ্টা। বাংলা গণসংগীতের ধারা তাঁর হাত ধরে বিকাশের উচ্চমাত্রায় পৌঁছে গেছে। তিনি ছিলেন একাধারে গণসংগীতের স্রষ্টা, তাত্ত্বিক, সংগঠক। শীর্ণকায় এ-মানুষটি ছিলেন আজীবন আপসহীন লড়াকু। তিনি নিজে যে গণসংগীতের দল গড়ে তোলেন ১৯৭১ সালে, তার নাম দেন ‘মাস সির্ঙ্গাস্’। একনায়ক জেনারেল ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্পেনে চলমান গৃহযুদ্ধে শহিদ হন 888sport live chatী ও বৃদ্ধিজীবী সমাজ। সারা পৃথিবী থেকে প্রগতিশীল 888sport live chatী888sport live footballিক এই যুদ্ধে অংশ নিতে এগিয়ে আসেন। বাংলা তথা অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রগতিবাদী রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিককর্মীরা তাদের সমর্থনে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিরিশের-চল্লিশের দশকের ‘প্রগতি লেখকসংঘ’, ‘গণনাট্য আন্দোলন’ ইত্যাদি তারই ফসল।
এসমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল প্রণোদনা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ। তারই সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট এইসব প্রতিষ্ঠান। কৃষকশ্রমিকের মুক্তিআন্দোলনের শরিক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানেও সেই প্রগতিচেতনারই সুর। বাংলার প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিককর্মীদের মধ্যে সেদিন আরো ছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, রমেশ শীল, সলিল চৌধুরী, খালেদ চৌধুরী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিজন ঘোষ, তুলসী লাহিড়ী, শম্ভু মিত্র, অরুণ মিত্র, সুকান্ত ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, সুধন্য দাশগুপ্ত, নিবারণ পণ্ডিত, কলিম শরাফী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ। বস্তুত, সেই উত্তাল সময়ে কলকাতার বাইরেও সারা বাংলায় লড়াকু মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছিল গণসংগীতের উজ্জীবনী মন্ত্রে। 888sport app, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশালের জনপদে গঞ্জে-বন্দরে মুখর জনতা গণসংগীত গেয়ে ফিরেছে। এই ভিত থেকেই উঠে এসেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সুরেলা কণ্ঠ ও বিপ্লবী প্রতিভা তাঁকে দিয়েছিল নেতৃত্বের শিরোপা। বাংলা গণসংগীতের জগতে তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত গণনায়ক। অজস্র গান রচনা করেছেন তিনি।
নিজে সুর দিয়েছেন। নিজেরই গড়ে তোলা স্কোয়াড নিয়ে নগর-জনপদের পথে-প্রান্তরে গেয়ে ফিরেছেন সেসব গান। অনেক গানই কালজয়ী সৃষ্টির মহিমা লাভ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই আনখচুল দায়বদ্ধ 888sport live chatীকর্মী অধুনাতন করপোরেট বাণিজ্য বাজারে কপালে বাঁধা লাল ফেটিসর্বস্ব পণ্যে পরিণত হননি বা পণ্য হতে দেননি তাঁর গানকে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আবির্ভাবকালীন রাজনৈতিক পশ্চাৎপটের কথা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। বোম্বাইয়ের নৌবিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানা বিপ্লব, মালাবার লড়াই, কাকদ্বীপ লড়াই ইত্যাদি গণসংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম একজন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হয়ে ওঠে।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অমর গণসংগীতগুলির মধ্যে প্রথমেই মনে পড়বে তেভাগা আন্দোলনের বিখ্যাত সেই গানটি :
কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান।
কিষান ভাই রে
কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান ॥
ফল কাটার সময় হলে কাটবে সোনার ধান
দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান রে।
শান দিয়ো জোরসে দিয়ো দিয়ো বারে বার
হুঁশিয়ার ভাই কভু তাহার যায় না যেন ধার রে –
তবে ‘জন হেনরী’ই তাঁর সবচেয়ে পরিচিত ও জনপ্রিয় গান। তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি দীর্ঘ ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’ পালা। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতাকে ভুয়া অভিহিত করে তৎকালীন বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ব্যঙ্গ করে তিনি লেখেন :
মাউন্টব্যাটেন সাহেব
ও তোমার সাধের ব্যাটন
কার হাতে থুইয়া গেলায় ও
*** ****
নয়াদিল্লীতে মোর কলিতে
আইলা কল্কি অবতার – কী বাহার
পতিত ভারত করিতে উদ্ধার
বড় বড় নেতা দিলা পায়ে ধরনা
তপস্যায় লভিলেন বর অন্নপূর্ণা…
মাউন্টব্যাটেনকে ‘রঘুপতি রাঘব মাউন্টব্যাটেন’ বলে বিদ্রুপ করেছেন।
তাঁর গানের মূলধারাটি রাজনৈতিক হলেও আর্তমানবতার জন্য সেবামূলক গানও বেরিয়ে এসেছে তাঁর লেখনী তথা কণ্ঠ থেকে। নিজের জন্মমাটি হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের মানুষ চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে যখন ম্যালেরিয়ার মহামারিতে উজাড় হতে থাকে, তখন তিনি তাঁর নিজের বাঁধা গান নিয়ে ছুটে গেছেন তাদের পাশে :
বাইন্যাচঙে প্রাণ বিদরায় ম্যালেরিয়া মহামারী
হাজার হাজার নর888sport promo code মরছে অসহায়
শান্তি ভরা সুখের দেহ
শূন্য আজি নাই রে কেহ
মৃত সন্তান বুকে লইয়া কান্দে বাপমায় ॥
১৯৪৭-এর স্বাধীনতাজনিত দেশভাগের ফলে তাঁর স্বভূমি সিলেট তথা পূর্ববঙ্গ পরভূমি হয়ে যায়। এই মর্মবেদনা তাঁকে জীবনভর যন্ত্রণা দিয়েছে। তিনি গান লেখেন, ‘পদ্মা কও কও আমারে।’ এদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল গণআন্দোলনে একাত্মতা বোধ করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনে 888sport appর রাজপথে ছাত্রদের রক্ত ঝরানোর 888sport app download for androidে লেখেন :
শোনো দেশের ভাই-ভগিনী, শোনো আচানক কাহিনী
কান্দে বাংলা জননী 888sport app শহরে।
আমরা ভুলিনি ’৬২-এর শিক্ষাআন্দোলনের বা আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলন উপলক্ষে লেখা তাঁর গান। ১৯৮১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানের দল ‘মাস সির্ঙ্গাস্’ নিয়ে 888sport appsে এসেছিলেন। 888sport app, গাজীপুর ইত্যাদি জায়গায় গান শুনিয়ে বেড়ান তিনি। তখন থেকেই এখানকার বামপন্থী কর্মীদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন।
একনজরে তাঁর প্রধান-প্রধান প্রকাশনার নাম : বিষাণ (গানের সংকলন, ১৯৪৩), চীন দেখে এলাম, সীমান্তপ্রহরী (888sport app download apkর সংকলন, ১৯৬১), কুলখুরার চোতাল (অসমিয়া কাব্য, ১৯৭০), শঙ্খচিলের গান (গান স্বরলিপিসহ, ১৯৭৫), আবার চীন দেখে এলাম (১৯৭৫), আকৌ চীন চাই আহিলো (অসমিয়া, প্রথম খণ্ড ১৯৭৫, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৭৭), লোকসঙ্গীত সমীক্ষা (বাংলা ও অসমিয়া, ১৯৭৮), হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান (১৯৮০), চীন থেকে ফিরে, জীবন 888sport live chatী জ্যোতিপ্রকাশ (অসমিয়া, ১৯৮৩)। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মেনাক বিশ্বাসের সম্পাদনায় বের হয় আরো দুটি গ্রন্থ : উজান গাঁও বাইয়া ও গানের বাহিরানা।
এছাড়াও বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তিনি। উৎপল দত্তের রাইফেল ও তীর নাটকের সংগীত পরিচালনা করেছেন। লাল লণ্ঠন, রাইফেল, তেলেঙ্গানা প্রভৃতি নাটকের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। লালন ফকির live chat 888sportেও সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব নেন। এই সিনেমায় তাঁর সুরে গেয়ে হেমন্ত মুখ্যোপাধ্যায় রাষ্ট্রীয় 888sport app download bd লাভ করেন।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা মহসিন শস্ত্রপাণির একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য 888sport app download for android করতে পারি এখানে। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর রচনায় ও সুরে এবং গায়কী ঢঙে বাংলার গণসংগীত নতুন মাত্রা লাভ করেছে।’ (‘হেমাঙ্গ বিশ্বাস/ গণ-সংস্কৃতির পতাকাবাহক,’ মহসিন শস্ত্রপাণি, ইত্তেফাক, ১৪.১২.২০১২)।
তিন
এই লেখাটির সূচনা হয়েছিল একধরনের নির্বেদ ও বীতরাগ দিয়ে। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাধের স্বাধীনতার রক্তমূল্য দলিত করতে মেতেছি আমরা এই আত্মঘাতী জাতি। যে-দাহের মধ্য দিয়ে ধুইয়ে ধুইয়ে ধিকিধিকি জ্বলে ওঠে গণসংগীতের শিখা, তার ওপর জল ঢেলে দিচ্ছে বর্ণচোরা নগদলোভীদল। তবুও আমরা প্রতীক্ষা করছি শোষিত মানুষের আবার একটি জাগরণের। আরেকটি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সম্ভাবনা ও আবির্ভাবের পথ চেয়ে ক্ষণ গুনছে জাতি। ফুরিয়ে যায়নি তাঁর আগ্নেয়কণ্ঠে উচ্চারিত নতুনতর গণবিপ্লবের গণসংগীতের অভিযানের সম্ভাবনা।
পরিশেষে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে উৎসর্গ করে আমার সদ্যরচিত একটি 888sport app download apkর অর্ঘ্য দিয়ে বিদায় নিচ্ছি সবার কাছ থেকে :
হবিগঞ্জের জালালী কইতর
হবিগঞ্জের জালালী কইতর পাখ মেললো ঐ
সিলেটী নীল আশমানসীমা পুড়িয়ে –
উড়াল দিল মুক্ত স্বাধীন সর্বহারা মানবতার দিগন্তে।
শীতবিহানের উষ্ণ রোদে তপ্ত গেরুবাজ;
আক্রোশে আর বিদ্রোহে আর রণচণ্ডী ঝাঁজে
সফেদ শাদা শুভ্র রোঁয়া ফুলে ফুঁসে ওঠে।
রক্তচোষা কুসীদজীবী মহাজন আর জালিম জোতদার
যেখানে যত খুনচাটা সব শ্রেণীশত্র“ গণদুশমনদল
সবার নামে ঐ শোনো দেয় মোকাবিলা ডাক!
আগুনঝরা গানে গানে বিদ্রোহ আর জেহাদে হাঁক দেয়!
বলে, কাস্তেটা শান দাও!
খতম করো মালিক-শোষক পুঁজিপতি-সাম্রাজ্যবাদী
বুর্জোআদের খতম করো ভাই!
গুঁড়িয়ে দাও হায়েনাদের দুর্গকারাগার!
বিপ্লবের অগ্নিবাণী ঠোঁটে নিয়ে পংখি উড়াল দেয়
এই বাংলার আকাশবাতাস কাঁপিয়ে দিয়ে
যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী মুক্তিব্যালাড ছড়িয়ে দেয়
লড়াকু এক অমর গণগায়ক।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.