হোসাইনি পরিবার। জামাল হোসাইনি বাবা, তার দুই ছেলে – সায়েফ হোসাইনি ডাক্তার, আর ছোট ছেলে অমিত হোসাইনি অর্থনীতিতে পিএইচ.ডি। সায়েফ ইএনটি বিশেষজ্ঞ, প্র্যাকটিস ভালো। অমিত অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, ভালো চাকরি করে। জামাল সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন অনেক আগে, ছেলেরা যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ে, আর বিয়ে করেননি। দারুণ গর্বিত পিতা জামাল সাহেব, অবশ্যই গর্ব করার বিষয়, একজন বাবার আর কি চাই, গর্ব করার জন্য। জামাল সাহেবের পরিবারে আরেকজন লোক আছে, সে হোসাইনি নয়। তার নাম আবু তাহের।
মাঝে মাঝে জামাল সাহেব ভাবেন, গর্বিত তো বটেই, কিন্তু তিনি কি সুখী? কেউ অসুখী হলে চট করে বলে দেওয়া যায়; কিন্তু সুখী কি না তার উত্তর মেলা খুব সহজ নয়। সুখ ও অসুখের মধ্যে সম্ভবত একটা অস্পষ্ট স্থান আছে, অন্যদের কাছে সেটা ব্যাখ্যা করা বিভ্রাটের কাজ। সেই যাই হোক, জামাল সাহেব নিজেকে মাঝে মাঝে সুখী ভাবার একটা কারণ হলো, তার মাঝারি সাইজের একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে রামপুরায়, নন্দকাননে। তিন রুমের অ্যাপার্টমেন্ট, সাদামাটা ঘর, সময়ের আঘাতে মাঝে মাঝে খসে গেছে বালি। তবুও নিজের বাসা।
এই বাড়িতে তিনি থাকেন বড় রুমটায়, একটা ঘর খালি পড়ে থাকে, আর একটা ঘর দিয়েছেন আবু তাহেরকে। আবু তাহের অনেক বছর ধরে এই সংসারে, বলতে গেলে ছোটকাল থেকেই, জামাল সাহেবের গ্রামের ছেলে। এখন সে চাকরি করে কোনো এক অফিসে, রাতে এসে রান্নাবান্না করে, ধরতে গেলে জামাল সাহেবের সংসারের সব দায়িত্বই তাহেরের। বাজার করা, ওষুধপথ্য কেনা, জামাল সাহেবকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, সব বিল পরিশোধ করা, আর রান্না তো আছেই। এইসব নিয়ে তাহেরের কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু তার আপত্তি অন্য জায়গায়, জামাল চাচা যে কেন তার থেকে বাড়ি ভাড়া নেন না, সে বুঝতে পারে না। মেসে একটা চৌকি ভাড়া নিয়ে থাকতে গেলেও তাকে অনেক টাকা গুনতে হবে, আর এখানে তো পাকা একটা রুম, চাকরিতে যে টাকা সে পায় তার থেকে কিছু ভাড়া দিলে জামাল চাচাও একটু স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন। আবু তাহের জানে, চাচা তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছেন বিদেশে অমিত ভাইয়ের পড়ার খরচ দিতে গিয়ে। এই বয়সে চাচার টানাহেঁচড়া দেখলে আবু তাহেরের কষ্ট হয়। তাহের ভাবে, হয়তো সে জামাল চাচার নিজের ছেলে নয়, বা চাচারা গ্রামের খান্দানি লোক, তার থেকে টাকা নেওয়া তাদের মানায় না। এই নিয়ে তাহের কখনো আর কথা বাড়ায়নি।
যারা আপন ছেলে তাদের সঙ্গে জামাল সাহেবের সম্পর্ক খুব সহজ নয়, যেমনটা আবু তাহেরের সঙ্গে। বড় ছেলে, ওর স্বভাবটা একটু ভীতু টাইপের। হঠাৎ হঠাৎ আসে বাবাকে দেখতে হয়তো ডাক্তারির কাজের ফাঁকে। আসে আবার তাড়াহুড়ো করে চলে যায়, মাঝে মাঝে এটা-ওটা খাবার হাতে করে নিয়ে আসে বাবার জন্য। এই পর্যন্তই। কলাবাগানে বড় একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকে, বউ এবং ছোট এক ছেলে ও এক মেয়ে, বয়স ছয় ও চার বছর। জামাল সাহেব একদিন বললেন, ‘সফি, তুই এসে প্রতিবার তাড়াহুড়া করে চলে যাস। একটা ছুটির দিন তো আসতে পারিস, একটু কথাবার্তা বলে সময় কাটাবো।’
‘বাবা, তুমি তো জানো, একদিন মাত্র ছুটি, বাড়িতে
এটা-ওটা কাজ লেগেই থাকে।’
জামাল সাহেব ফ্যাকাসে চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তা বাবা ঠিক। পুরুষ মানুষের কাজ তো থাকবেই।’
ছোট ছেলে অমিত অস্ট্রেলিয়া থেকে কালেভদ্রে ফোন করে। যখন ছাত্র ছিল, বিদেশে টাকা পাঠাতে একটু দেরি হলে হয়তো দিনে দুবার ফোন করতো। এখন ফোন আসে অনেক কম, হয়তো কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত। তবে অমিত খুব স্পষ্টবাদী আর কোনো কথা ওর মুখে আটকায় না।
হাই স্কুলে পড়ার সময় একদিন বাসায় এসে বললো, ‘বাবা, তোমাকে বিয়ে করতে হবে।’
জামাল সাহেব প্রথমে খুব করে বকাঝকা করলেন।
‘বেয়াদব ছেলে কোথাকার! তোর লজ্জা লাগে না বাপের সঙ্গে এসব কথা বলতে?’
তারপর শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন আমাকে বিয়ে করতে হবে?’
অমিত কিছুটা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো, ‘আমার বন্ধু সোহাগের মা মারা গেছে দুই বছর আগে, গত সপ্তাহে ওর বাবা আবার বিয়ে করেছেন। আর আমার মা মারা গেছেন কত বছর আগে, তুমি কেন বিয়ে করো না? একটা মা থাকলে আমাদের নিয়ে তোমাকে এত কষ্ট করতে হতো না।’
ছেলের কথা শুনে জামাল সাহেব হো হো করে হেসে ওঠেন, ‘পাগল ছেলে, সৎমা যখন লাঠিপেটা করবে তখন মজা বের হবে।’
একদিন হঠাৎ সায়েফের ফোন এলো, ‘বাবা, সামনের সোমবার বাংলা নববর্ষের ছুটি। আমরা বিকেলের দিকে তোমাকে দেখতে আসবো, নিলীন ও নিশাকেও নিয়ে আসবো।’
জামাল সাহেব তো খুশিতে আটখানা, শুধু বললেন, ‘বেশি দেরি করিস না বাবা, তাড়াতাড়ি এলে নাতি-নাতনির সঙ্গে একটু সময় কাটাতে পারবো।’
এরকম দিন সাধারণত তার জীবনে খুব একটা আসে না। এমনিতে তিনি সায়েফের বাসায় খুব যান না। সায়েফের বউ শ^শুরের মেহমানদারি করা খুব একটা পছন্দ করে না। রোববার থেকেই জামাল সাহেব আয়োজন শুরু করলেন। পুরনো সোফাগুলোর ধুলোবালু ঝেড়ে পরিষ্কার করালেন। নিলীন ও নিশার জন্য নিজে গিয়ে আইসক্রিম কিনে ফ্রিজে রাখলেন, এলো কোমল পানীয়। বাকি খাবার প্যাটিস, সমুচা, মিষ্টি এসব তাহেরকে দিয়ে সোমবার দুপুরে জামাল সাহেব কিনিয়ে আনালেন। তাহের তিনজনের জন্য চা বানিয়ে রাখলো ফ্লাস্কে। সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে তাহের নিজের কাজে বাইরে চলে গেল।
সায়েফ তার স্ত্রী আরিফা ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে সময়মতোই এলো। বাচ্চাদের ছোট্ট হাত চারটি ধরে জামাল সাহেব হোসাইনি পরিবারের সেই চিরন্তন উষ্ণতা অনুভব করলেন, ঠিক যেমনটা ছিল সফি ও অমির হাতের মুঠোয়, যখন ওরা ছোট ছিল। নিলীন ও নিশা দারুণ আড়ষ্ট হয়ে থাকে দাদাকে দেখে। ওদের আর দোষ কি? প্রতিবারেই ওদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করাতে হয়।
বউমাকে এবার অনেক মিশুক মনে হলো অন্যবারের তুলনায়। শ্বশুরের জন্য উপহার নিয়ে এসেছে দুটি সুন্দর কাগজের বাক্সে। এসেই বউমা অভিযোগ করলো, ‘বাবা তো আজকাল আমাদের দেখতে একদম যান না।’
জামাল সাহেব বললেন, ‘রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, মা, দেখো তো। এখন বয়স হয়েছে।’
‘সামনে আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব।’
আরিফাই ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে ছেলেমেয়েদের হাতে দিলো। শ^শুরকে আলাদা প্লেটে খাবার দিলো, নিজেরাও নিল। জামাল সাহেব ফ্লাস্ক থেকে চা ঢাললেন, এক কাপ সফিকে, আরেক কাপ আরিফাকে দিলেন। নিজেও নিলেন এক কাপ।
সারাটা সময় সায়েফ কেমন চুপচাপ বসে রইলো, তাকে খুব নার্ভাস মনে হলো। জামিল সাহেব ভাবলেন, বেকুব ছেলেটা বউয়ের সামনে কেন যে এত নার্ভাস থাকে! ছেলের জন্য জামিল সাহেবের খারাপ লাগে।
চা খেতে খেতে আরিফাই কথা তুললো, ‘বাবা, আপনাকে নিয়ে আপনার ছেলের খুব চিন্তা, আপনি তো সব জমা টাকাকড়ি অমিতের পড়ালেখায় খরচ করে ফেলেছেন। আপনার নিশ্চয় বেশ কষ্ট হচ্ছে। সায়েফেরও নতুন প্র্যাকটিস। একবার আপনি বলেছিলেন গ্রামে চলে যাবেন।’
আরিফা একটু থামলো। বোঝা গেল এরপর কী বলবে মনে মনে একটু রিহার্সাল করে নিচ্ছে – ‘আমরা বলছিলাম কি, আপনি যদি গ্রামের বাড়িতে থাকতে পছন্দ করেন, তাহলে আমরা রামপুরার বাড়িতে চলে আসব। ভাড়ার যে টাকাটা বাঁচবে সেটা আপনাকে পাঠিয়ে দেব, আপনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন। আর নন্দনকাননের স্কুলটাও নাকি খুব ভালো, আপনার নাতি-নাতনিদের ভবিষ্যতের জন্যও ভালো হবে।’
জামাল সাহেব আরিফার কথা শুনে বিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর নিজের মাথাটা একটু গুছিয়ে বললেন, ‘বউমা তোমরা এখন যে বাড়িতে থাকো, এটা তার অর্ধেক হবে। আমি নিজের স্বাছন্দ্যের জন্য তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমার দিন তো চলেই যাচ্ছে।’
জামাল সাহেব একটু থামলেন, দেয়ালে টানানো স্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখটা ছলছল করে উঠলো। চোখটা মুছে বললেন, ‘বউমা, আমি তো একসময় গ্রামেই চলে যাবো। আমি সায়েফকে বলে গিয়েছি, আমার মৃত্যুর পর যেন গ্রামের বাড়িতে আমাকে কবর দেওয়া হয়, ওর মায়ের কবরের পাশে।’
অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটলো। আরিফা হতাশ স্বরে শুধু বললো, ‘আপনার ভালোর জন্যই আমরা বলছিলাম।’
এতক্ষণ পর সায়েফের মুখ দিয়ে কথা বের হলো, ‘তোমাকে আগেই বলেছিলাম, বাবার সঙ্গে এসব কথা না ওঠাতে।’
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, এরপর আর কথাবার্তা খুব জমলো না। বাচ্চারাও অস্থির হয়ে পড়ছিল এই বদ্ধঘরে বসে থাকতে।
সায়েফ আরিফা, নিলীন ও নিশাকে নিয়ে চলে গেল। ঘরে বসেই জামাল সাহেব সায়েফের গাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন।
আরিফা হঠাৎ অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে কথা বলতে এলো কেন? এটা যে তার মৃত্যুর পর সায়েফ পাবে – এই নিয়ে তিনি কোনো পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেননি। জামাল সাহেবের মন বলে, এটা আবু তাহেরের পাওয়া উচিত। তাহেরই তাকে এতটা বছর ছেলের মতো আগলে রেখেছে। বেশ ক’বছর ধরে এ নিয়ে তিনি ভাবছেন; কিন্তু কিছু চূড়ান্ত করতে পারেননি। গত বছর যখন ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়ার মতো হলো, হাসপাতালে থাকতে হলো বেশ কিছুদিন, আবু তাহের ছুটি নিয়ে তাকে দেখাশোনা করেছে। ডা. সায়েফ হোসাইনিও একদিন হাসপাতালে এসেছিল।
হাসপাতালের বেডে শুয়েই জামাল সাহেব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। ভালো হয়ে বাড়িতে ফিরে উকিলের কাছে গিয়ে উইলটা চূড়ান্ত করে ফেলবেন। অ্যাপার্টমেন্টটা আবু তাহেরই পাবে তার মৃত্যুর পর। বাড়িতে এসে আবার সেই দোটানায় পড়লেন। সমাজের নিয়ম – হোসাইনি পরিবারের বাড়ি হোসাইনির ছেলে পাবে, এরপর ছেলের ছেলে। এই রীতি থেকে বের হওয়ার মানসিক ঝুঁকি তিনি কি সইতে পারবেন? যা হোক, ব্যাপারটা আবার বিবেচনার লিস্টে চলে গেল। কিন্তু আরিফা কি কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে? নাহলে হঠাৎ অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে কথা বলতে চলে এলো কেন?
আবু তাহের এখনো বিয়ে করেনি। গ্রামে মেয়ে দেখছে বিয়ে করার জন্য। জামাল সাহেবও গ্রামে তার পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন আবু তাহেরের জন্য মেয়ে খুঁজতে। একদিন জামাল সাহেব আবু তাহেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু, বিয়ের পর তুই চলে যাবি না তো?’
‘চাচা, কোথায় যাবো? আমার আর কে আছে? আপনার বউমা এলে আপনি আমাদের চলে যেতে বলবেন না তো?’
‘নারে না। তুই আমার ছেলে, তোদের চলে যেতে দেব কেন?’
দুদিন পর সায়েফের আবার ফোন এলো। প্রথমে জামাল সাহেব ভাবছিলেন আরিফা হয়তো আবার আসতে চাইছে। না, তা নয়। সায়েফ জানালো, অমিত দেশে এসেছে।
‘বাবা, অমিত কি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? ও ফোন করে জানালো, ও নাকি দেশে বিয়ে করতে এসেছে।’
জামাল হোসাইনি অভিমানের স্বরে শুধু বললেন, ‘সফি, ও তো ফোন করেনি। ওর বিয়ের কথা শুনে খুশি হলাম। তুই ওকে আমার দোয়া দিস।’
জামাল সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, হোসাইনি পরিবারের ছোট ছেলের বিয়ে, অথচ তিনি জানেন না।
দিন চারেক পরে অমিতের ফোন এলো।
‘বাবা কয়দিন হয় আমি দেশে এসেছি। আমি বিয়ে করেছি। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। আজ সন্ধ্যা ছয়টায় তুমি গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেলে চলে এসো। আমরা একসঙ্গে খাবো, তখন সব কথা হবে।’
‘অমি, হোটেলে কেন? বাসায় চলে আয়, আর বউমাকেও নিয়ে আয়।’
‘না বাবা, বাসাতে তুমি ছাড়া তো আর কেউ নেই। তাছাড়া হোটেলে তোমাকে নিয়ে একটু ভালো-মন্দ খাবো। তুমি ওয়েস্টিনেই চলে এসো, আমি লবিতে তোমার জন্য ওয়েট করবো।’
‘আচ্ছা, আসবো।’
জামাল সাহেব মনে অভিমানের বিরাট ঝড় নিয়ে হোটেল লবিতে ঢুকেছিলেন, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সব অভিমান উবে গেল।
বাপ-ছেলে মুখোমুখি। তিনি তাকিয়ে দেখলেন ছেলের দিকে, ঠিক যেন তার মায়ের চেহারা পুরুষালি গড়নে, রংটাও তেমন ধবধবে সাদা। অমিতই কথা শুরু করলো, ‘বাবা, তোমাকে ফোনেই বলেছি, আমি বিয়ে করেছি। বউয়ের নাম নীলা। নীলাও অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। এ-বছর মাস্টার্স শেষ করেছে। তোমাকে বিয়েতে ডাকিনি কারণ আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাইনি। তবে ভাই-ভাবি গিয়েছিল।’
‘অমি, তুই কোথায় বিয়ে করেছিস? কার মেয়ে? আর বিব্রতের কথা বলছিস কেন?’
‘বাবা ওরা অন্য ধরনের পরিবার। নীলা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হামজা সাহেবের ছোট মেয়ে। দেখো না, বিয়ের অনুষ্ঠানে হামজা সাহেব কি কাণ্ডটাই করলেন! বেশি মদ খেয়ে চিৎকার-টিৎকার করে, পরে সবার সামনে বমি করে দিলেন।’
‘আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে। তুই একদিন নীলাকে নিয়ে বাসায় আয়, আমি একটু বউমাকে দেখি।’
‘না বাবা আমাদের একদম সময় নেই, দুদিন পরই সিডনির ফ্লাইট। আর দেখার কি আছে? নীলার দুইটা কান, একটা নাক আর দুইটা চোখ আছে, ঠিক ভাবির যেমন।’ বলে অমিত হো হো করে হেসে দিলো।
বাবা বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘তুই দেখছি আগের মতোই ফাজিল রয়ে গেছিস, স্বভাবটা আর বদলালো না।’
‘বাবা, তোমার মনে আছে, একবার আমি তোমাকে বিয়ে করার জন্য বলেছিলাম?’
বলে অমিত আবার হাসলো। বাপ-ছেলের কথা আরো কিছুক্ষণ এভাবে চললো।
একসময় আমিতের ফোন এলো, ওর জন্য গাড়ি বাইরে অপেক্ষা করছে। অমিত দাঁড়িয়ে বাবাকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরলো। তারপর দুজনে হোটেলের গেট পর্যন্ত একসঙ্গে এলো। অমিত বাবাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলো। জামাল সাহেব দেখলেন, গাড়ির ড্রাইভারের সিটে একজন তরুণী বসা, সম্ভবত নীলা। একটু পরে গাড়িটা সশব্দে চলে গেল। জামাল সাহেব ভাবলেন, অমিত ঠিকই বলেছে, নীলারও দুটি কান, একটি নাক আর দুটি চোখ আছে। এই ছেলের স্বভাবটা আর পাল্টালো না!
জামাল সাহেব রাস্তায় আরেকটু হেঁটে সামনে এলেন, রাস্তার ওপারেই রামপুরা যাওয়ার টেম্পোস্ট্যান্ড। একটা টেম্পো কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে যাত্রী তুলছে। রাস্তা পার হতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়লো সামনের উঁচু বিল্ডিংটার উপর, দশ-পনেরো তলা হবে, ওপরে বিরাট নিয়ন সাইনে লাল লেখা – ‘হামজা টাওয়ার’। জামাল হোসাইনি মনে মনে হাসলেন, তার গর্বের ঝুড়ি এখন আরো ভারি, এখন তিনি হামজা সাহেবের বেয়াই। আগে কতবার গুলশানের এই পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন, কই বিল্ডিংটা তো কখনো এভাবে তার চোখে পড়েনি। টেম্পোতে উঠেও জামাল সাহেব হামজা টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.