ইমদাদুল হক মিলন
তেরো 888sport free betটা নাকি অশুভ। সবাই বলে আনলাকি থারটিন। আমার কাছে তেরোর চেয়ে শুভ888sport free bet আর নেই। আমার কাছে থারটিন মানে লাকি থারটিন।
আমরা দুভাইবোন দাদুর মুখের দিকে তাকালাম। আমি আর মিতু। আমি কথা বলবার আগেই মিতু বলল, কী রকম?
দাঁড়া, চা খেতে খেতে বলি।
দাদু কলিংবেল বাজালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এলো সানোয়ার। স্যার।
গ্রিন টি দে।
দিচ্ছি স্যার।
যেমন দৌড়ে এসেছিল সানোয়ার তেমন ভঙ্গিতেই দৌড়ে গেল। খুবই চটপটে কাজের ছেলে। আমাদের বাড়ির কাজের লোকজন প্রত্যেকেই চটপটে। অলস লোকজন দাদু, বাবা, দাদি, মা কেউ পছন্দ করেন না। তাঁদের দেখাদেখি আমার আর মিতুরও হয়েছে একই অবস্থা। ডাকের সঙ্গে সঙ্গে হাজির হতে হবে। কাজ করতে হবে দ্রম্নত। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই।
দাদিকে নিয়ে মা গেছেন ফুফুর বাড়িতে। আমাদের ওই একটাই ফুফু। বাবার ছোট। নাম আসমি। আমরা ডাকি ফুপি। ফুপির বাড়ি বেশি দূরে নয়। কাছেই। বনানীতে। বনানী কবরস্থানের ওদিকটায়। আমরা থাকি গুলশানে, ফুপি বনানীতে। তাঁরও দুই ছেলেমেয়ে। অনি আর ঐশী। আমি আর মিতু যেমন। বাবা আর ফুপি যেমন। অদ্ভুত মিল।
সানোয়ার চা নিয়ে এলো।
দাদু গ্রিন টি খান মগ ভরে। বহুদিন ধরে একই ব্র্যান্ডের গ্রিন টি খাচ্ছেন। বয়স হয়েছে সত্তরের মতো। এখনো দাদু বেশ ইয়াং। খুবই নিয়ম মানা মানুষ। সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠেন ঠিক ছটায়। আধঘণ্টা খবরের কাগজ পড়েন আর পানি খান চুমুকে চুমুকে। তারপর ট্রেডমিল করেন, সাইক্লিং করেন। সন্ধ্যায় কোনো কোনোদিন বাড়ির সুইমিংপুলে সাঁতার কাটেন। রাত আটটার মধ্যে ডিনার করে ফেলেন। দশটার মধ্যে ঘুম।
দাদুর ডায়াবেটিস আছে, প্রেশার আছে। কিন্তু হার্টের সমস্যা নেই। হার্ট ভালো আছে। সুগার-প্রেশার দুটোই কন্ট্রোলে থাকে নিয়ম মেনে চলেন বলে। খাওয়া-দাওয়া এদিক-ওদিক করেন না বলে।
ঠিক দশটায় অফিসে যান দাদু। আগে ফিরতে দেরি করতেন। এখন তিনটা-চারটার মধ্যে ফিরে আসেন। বড়জোর পাঁচটা। পাঁচটার মধ্যে ফিরবেনই। আবার কোনো কোনোদিন অফিসে যানই না। বাবাই সামলান সবকিছু। বিজনেস পুরোটাই বাবার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। বাবাও দাদুর মতোই দক্ষতায় চালিয়ে নিচ্ছেন এত বড় বিজনেস। তবে নিয়ম মেনে। স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে। এই একটা ব্যাপারে বাবাও দাদুর মতোই সচেতন।
আমি আর মিতুও তাঁদের ফলো করছি।
ফুপির বাড়ি অবশ্য একটু ঢিলেঢালা। ফুপা-ফুপি আমাদের মতো নিয়ম মানেন না। রাত জাগেন, পার্টি করেন। অনেকটা বেলা পর্যন্ত ঘুমান।
অনি-ঐশীও হয়েছে তেমন।
কাল ছুটির দিন। বাবা এখনো অফিস থেকে ফেরেননি। দাদু ফিরে এসেছেন তিনটার দিকে। এসে রেস্ট নিয়ে বাগানে এসে বসেছেন। মার্চ মাস চলছে। শেষ বিকালে এত সুন্দর হাওয়া বইছে! বাগানের গাছপালা, ফুলের ঝাড়, পায়ের তলার সবুজ ঘাসে পড়েছে শেষ বিকালের রোদ। ভারি সুন্দর পরিবেশ।
কোনো কোনো বিকালে এখানটায় এসে বসেন দাদু। বাগানে সুন্দর শেড করা আছে। চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। ছিমছাম স্নিগ্ধ পরিবেশ। তবে দাদু যে রকম বড়লোক আমাদের বাড়ি সেই তুলনায় কিছুই না। দাদুর চেয়ে কত কম টাকার মালিকদের কী রকম আলিশান বাড়ি গুলশান-বনানীতে, বারিধারা-ধানমন্ডিতে!
দাদু বলেন, আমি অতি সাধারণ অবস্থা থেকে এখানে এসেছি। আমি অপচয় পছন্দ করি না। লোক-দেখানো ব্যাপার আমার মধ্যে নেই। আমি একটা শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে চাই। আর দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করে যেতে চাই। আমার ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদেরও সেই শিক্ষা দিয়ে যেতে চাই। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াও। মানুষের সেবা করো।
আমাদের গ্রামে প্রচুর জমি কিনেছেন দাদু। স্কুল-কলেজ করেছেন, চাইল্ড হোম করেছেন এতিম শিশুদের জন্য। ওল্ড হোম করেছেন অসহায় বুড়ো মানুষদের জন্য। এখন চলছে আড়াইশো বেডের হাসপাতাল তৈরির কাজ। প্রায়ই বাবাকে নিয়ে, কোনো কোনো সময় আমাদের সবাইকে নিয়ে গ্রামে যান ওসব দেখতে। সাহায্যের আশায় এসে দাদুর কাছ থেকে কেউ কখনো খালি হাতে ফেরে না। অসহায় মানুষকে সাহায্য দাদু করবেনই।
আর একটা কাজ তিনি গত সাত-আট বছর ধরে করছেন। আমাদের জেলার যে-কোনো দরিদ্র মানুষকে বাড়ি করে দিচ্ছেন। বাড়ি করে দেওয়া মানে হয়তো একটুখানি ভিটেমাটি আছে কিন্তু ঘর বলতে গেলে নেই। যা আছে কোনো রকমে মাথা গোঁজা যায়। বর্ষা-বৃষ্টিতে সেই ঘরে বসবাস করা যায় না। শীতে বসবাস করা যায় না।
দাদুর লোকজন আছে। তারা খুঁজে খুঁজে এই ধরনের বাড়িঘরের কথা দাদুকে এসে বলেন। দাদু সেই পরিবারকে পাকা ঘর করে দেন, বাথরুম, টয়লেট, রান্নাঘর করে দেন। একটা চাপকল বসিয়ে দেন। আর নিজের জেলার কত ছেলেমেয়েকে যে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ান, ডাক্তারি পড়ান, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ান বলে শেষ করা যাবে না। নিজের টাকায় বিদেশে পাঠিয়েছেন অন্তত দু-আড়াইশো লোককে। টাকার অভাবে বিয়ে হয় না এমন মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন তাও দেড়-দুশো হবে।
আমাদের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে শ্রমিক হবে চার-সাড়ে চার হাজার। মাসের এক তারিখে তারা বেতন পাবে। তাদের চিকিৎসা ফ্রি। বছরের দুই ঈদে বোনাস। এছাড়া আরেকটা বড় ব্যাপার আছে। প্রতিবছরই লভ্যাংশের একটা অংশ শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ করে দেন দাদু।
চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাইতে আসা মানুষদের কথা তো বললামই না। কারো হার্টের অসুখ, যেতে হবে চেন্নাইয়ে। দাদু টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে যাবে দিলিস্নতে, টাকা দিচ্ছেন দাদু। কিডনি ট্রান্সপস্নানটেশন, দাদু ব্যবস্থা করছেন। অ্যাকসিডেন্টে পা কাটা গেছে, দাদু তার আর্টিফিশিয়াল পায়ের ব্যবস্থা করছেন। এক কথায় বলতে গেলে মানুষের জন্য কী করছেন না দাদু।
সব মিলিয়ে আমার দাদু ওয়াহিদ সাদিক এক বিস্ময়কর মানুষ।
আজ বিকালে সেই মানুষ কথা তুললেন তেরো 888sport free bet নিয়ে।
আমি আর মিতু দুজনেই আজ বাড়িতে। যে যার রুমেই ছিলাম। আমি ল্যাপটপে গেমস খেলছিলাম। মিতু তার রুমে ‘নিক’ চ্যানেলে কী একটা কার্টুন সিরিজ দেখছিল। সানোয়ার এসে আমাদের ডেকে নিয়েছে। দাদু ডাকছেন।
আমরা অবাক হইনি। দাদু এরকম মাঝে মধ্যে আমাদের ডাকেন। মজার মজার গল্প করেন। আমরা দুজনেই দাদুকে খুব পছন্দ করি। তাঁর গল্প শুনতে ভালোবাসি।
আজ বিকালে সানোয়ার এসে বলার পর দুজনেই ছুটে এসেছি বাগানে। দাদুর মুখোমুখি বসেছি। তখন দাদু তেরো 888sport free betর কথা তুললেন। চা আসার পর চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, তোদের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কেন আমার জন্য তেরো 888sport free bet লাকি, তাই না?
বললাম, হ্যাঁ তাই।
আমার আজ জায়গা-সম্পত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য সব মিলিয়ে কত টাকা জানিস?
মিতু বলল, কত?
তেরো হাজার কোটি।
বাপ রে!
আমি বললাম, বুঝেছি। এজন্যই তুমি বললে তেরো 888sport free bet তোমার জন্য লাকি। কিন্তু কাঁটায় কাঁটায় তেরো হাজার কোটি তুমি মেলালে কেমন করে?
হিসাব করে! অ্যাকাউন্টসের মোবারক সাহেবকে এই কাজে লাগিয়েছিলাম তিন মাস আগে। পাই টু পাই হিসাব বের করতে বলেছিলাম আমার অ্যাসেট এবং নগদ টাকার। যদিও আমি জানতাম অংকটা কাঁটায় কাঁটায় তেরো হাজারই হবে।
কী করে জানতে?
পিছনে আছে অদ্ভুত এক গল্প।
গল্পের কথা শুনে আমি আর মিতু বিপুল উৎসাহী হলাম। বলো না দাদু গল্পটা!
দাদু একটু উদাস হলেন। মগ তুলে গ্রিন টিতে চুমুক দিলেন। গল্প না, সত্য ঘটনা।
সেই ঘটনাই বলো।
বহু বছর আগের কথা, বুঝলি। আমি বিএ পাশ করে চাকরির আশায় ঘুরছি। বাবা মারা গেছেন। আমার আর কোনো ভাইবোন নেই। আমি আর মা। বাবা কেরানির চাকরি করতেন। মারা গেলেন হার্ট অ্যাটাকে। টাকা-পয়সা কিছুই রেখে যেতে পারেননি। গে-ারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের একটা ভাঙাচোরা পুরনো বাড়িতে ভাড়া থাকি আমরা। একটা মাত্র রুমে থাকি মা আর ছেলে। আমি টিউশনি করি, মা ঘরে বসে সেলাই-টেলাইয়ের কাজ করেন। আমাদের একমাত্র মামার নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে মুদিদোকান। তাঁর আয়-রোজগার ভালো। মামা আমাদের সাহায্য করেন। প্রত্যেক মাসেই কিছু কিছু টাকা দেন। আমি গে-ারিয়া থেকে হেঁটে যাই সদরঘাটে। সেখান থেকে বাসে করে যাই নিউমার্কেটে। মামা টাকা দিলে ওভাবেই ফিরে আসি।
মিতু বলল, কত আগের কথা দাদু?
স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমি জগন্নাথ কলেজ থেকে মাত্র বিএ পাশ করেছি। একদিন, মাসের শেষদিকে ঘরে
টাকা-পয়সা নেই। মানে বাজারের পয়সাই নেই। না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা। মা বললেন, তোর মামার কাছে যা। যা দেয় নিয়ে আয়।
কেমন করে যাবো? বাসভাড়াও তো নেই।
মা বললেন, কষ্ট কর বাবা। হেঁটেই যা।
গে-ারিয়া থেকে নিউমার্কেট অনেক দূর। হেঁটে যেতে ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। লাগুক। হেঁটেই রওনা দিলাম। গরমের দিন। নিউমার্কেটে পৌঁছাতে সাড়ে এগারোটার মতো বেজে গেছে। রওনা দিয়েছিলাম দশটার দিকে। তখনকার দিনে রাস্তাঘাট ফাঁকা। আর আমি হাঁটিও বেশ জোরে। সকালবেলা নাশতা খেয়েছি একটুখানি গুড় আর মুড়ি। খিদাও লেগেছে খুব। মামা চা-বিস্কুট খাওয়ালেন আর তেরোটা টাকা দিলেন।
আমি অবাক। তেরো টাকা? হ্যাঁ।
এ আবার কেমন হিসাব? হয় পনেরো টাকা দেবেন, না হয় দশ কিংবা বিশ। তেরো টাকা দিলেন কোন হিসাবে?
তা আমিও বুঝিনি। যাহোক তেরো টাকাও কম টাকা নয়। মাসের শেষকটা দিন টেনেহিঁচড়ে চলে যাবে। মামা আবার মাসের শুরুর দিকে যেতে বলেছেন। আমি কয়েকটা টিউশনি করি। দশ টাকা করে পাই একেকটা টিউশনি থেকে। ওসব মিলিয়ে চলে যাবে।
চা-বিস্কুট খেয়ে পকেটে তেরোটা টাকা নিয়ে হাঁটা দিলাম। তখনকার দিনে শার্টের বুকপকেটের ভিতর, উলটোপাশেও পকেট রাখতো কেউ কেউ। আমার সেদিনকার শার্টটা ছিল তেমন। গরিব মানুষের টাকা নিয়ে অনেক ভয় থাকে। আমারও ছিল। এত কষ্টে পাওয়া টাকা যদি পকেটমার হয়ে যায়? এজন্য টাকা তেরোটা আমি সেই ভিতরের পকেটে রেখেছি।
কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে দাদু থামছেন। চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। উদাস হচ্ছেন তারপর আবার কথা বলছেন।
নিউমার্কেট থেকে বেরিয়ে, বুয়েটের পিছন দিককার রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছি। এসে ডানদিকের রাস্তা ধরেছি। আলিয়া মাদরাসা, আর বদরুন নেসা কলেজের ওদিকটা দিয়ে এসে বাঁয়ে ঢুকেছি। ওই দিকটা জেলখানার উত্তর দিক। গলিটা খুবই নির্জন। দুয়েকটা রিকশা যাচ্ছে। দুয়েকজন লোক চলাচল করছে। কয়েকটা দোকান আছে। লোকজন তেমন নেই দোকানগুলোতে। দুপুরবেলার রোদে ঝিমঝিম করছে চারদিক। তখনকার 888sport app এরকমই ছিল। গলির মাঝামাঝি আরেকটা সরু গলি। সেদিকটায় আসতেই…
দাদু থামলেন। আমি আর মিতু উদগ্রীব।
মিতু বলল, কী হলো ওদিকটায় আসার পর?
কোত্থেকে একজন লোক এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। যেন হঠাৎ উদয় হলেন। গলিটার ঠিক মুখে। একটা ছায়াময় জায়গায়। চারপাশে কোথাও আর কোনো লোকজন নেই। খাঁ-খাঁ নির্জন চারদিক। রাস্তায় রিকশাও চলছে না, মানুষও হাঁটাচলা করছে না। দিনের বেলাই যেন রাতদুপুর হয়ে গেছে। আমি আর ওই মানুষটি ছাড়া কেউ নেই।
কেমন দেখতে লোকটা?
একটু যেন উদ্ভ্রান্তের মতো। বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলা শিশুর মতো একটু যেন দিশাহারা। সাদা ফতুয়া আর সাদা লুঙ্গি পরা। দুটোই মলিন, জীর্ণ। কোথাও কোথাও ছিঁড়ে ফেঁসে গেছে। ছোটখাটো একজন মানুষ। তবে মানুষটা অ্যালবিনো।
মিতু বলল, অ্যালবিনো মানে?
যে-মানুষের সবকিছুই লালচে সাদা। দেখলে মনে হবে শরীরের ওপরকার চামড়াটা নেই। মাথায় চুল আছে। তবে একদমই সাদা। দাড়িগোঁফ, ভুরু আছে। সাদা। চোখের পাপড়ি সাদা। ছোট কুতকুতে চোখ সারাক্ষণ পিটপিট করছে। রোদের দিকে তাকাতে পারে না। শরীরে লোম আছে কিন্তু বোঝা যায় না। চামড়ার মতো রং লোমের।
আমি বললাম, বুঝেছি বুঝেছি। ওরকম মানুষ আমি দেখেছি। জীবজন্তুর মধ্যেও অ্যালবিনো হয়। তবে রেয়ার। অ্যালবিনো কচ্ছপ আছে, জিরাফ হরিণ আছে। কুমির আছে। ইন্টারনেটে এসব পাওয়া যায়। তারপর কী হলো বলো দাদু।
আমি আনমনা ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছিলাম, বললেন, এই ছেলে, দাঁড়া।
দাঁড়ালাম। বললেন, তোর বাঁ-দিককার ভিতর পকেটে তেরোটা টাকা আছে। দিয়ে দে আমাকে।
আমি হতভম্ব। বাকরুদ্ধ। বলে কী? আমার কাছে তেরোটাই টাকা আছে। মামা দিয়েছেন। পকেটমারের ভয়ে সেই টাকা যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি ভিতর পকেটে। আমি ছাড়া পৃথিবীর কারো এ-কথা জানবার কথা না। এই লোক তা জানলেন কী করে? কী করে পরিষ্কার বলছেন তেরো টাকাই আমার কাছে আছে আর ওই পকেটেই আছে? এ তো অবিশ্বাস্য ঘটনা!
আমি কথা বলতে পারি না, নড়তে পারি না। পাথর হয়ে গেছি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি তাঁর মুখের দিকে।
তিনি চোখ পিটপিট করে বললেন, চিমত্মা করিস না। দিয়ে দে, দিয়ে দে। ভালো হবে।
আমার যে কী হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। যন্ত্রের মতো হাত ঢোকালাম ভিতর পকেটে। টাকা তেরোটা বের করে তাঁর হাতে দিলাম। বাসায় যে একটা পয়সাও নেই, এই টাকা নিয়ে গেলে বাজার হবে, মা-ছেলে খাবো, কিছুই মনে রইল না।
টাকা হাতে নিয়ে লোকটা তাঁর কুতকুতে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীর-শান্ত গলায় বললেন, তোর এই তেরো টাকার সঙ্গে শুধুই শূন্য যোগ হতে থাকবে। তুই যতদিন বেঁচে থাকবি শূন্য শুধু বাড়বে। যা যা।
লোকটা হনহন করে গলির ভিতর হারিয়ে গেলেন।
আমার পা চলছে না। আমি দাঁড়িয়ে আছি। কী রকম যেন একটা ঘোর লেগে গেছে। মিনিটখানেক লাগল সেই ঘোর কাটতে। সচল হলাম। গে-ারিয়ার দিকে হাঁটা দিলাম। শুধু সেই লোকটার কথা ভাবি আর হাঁটি। কোত্থেকে এলেন তিনি? কোথায় চলে গেলেন? কী করে জানলেন আমার ওই পকেটে তেরোটা টাকাই আছে? আমিই বা কেন অমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম তাঁর কথায়? কেন টাকাটা তাঁকে দিয়ে দিলাম? মাকে গিয়ে এখন কী বলবো? এত কষ্ট করে এতদূর হেঁটে গে-ারিয়া থেকে নিউমার্কেটে এলাম, তেরোটা টাকা দিলেন মামা আর সেই টাকা এইভাবে একটা লোককে দিয়ে দিলাম? এখন কী হবে? মা ছেলে কী খাবো আমরা? কীভাবে চলবো এই কয়েকটা দিন?
বাসায় আসতে আসতে দুপুর পেরিয়ে গেল। রোদে পুড়ে গরমে ঘামে মুখটা শুকিয়ে গেছে। আমার একটা অভ্যাস ছিল মা-র সঙ্গে কখনো মিথ্যা বলতাম না। কোনো রকমের চালাকি, ছলচাতুরী মা-র সঙ্গে কখনো করিনি। ভুল করে, অন্যায় করে মা-র কাছে তা স্বীকার করতাম। কোনো কিছু লুকাতাম না।
এই ঘটনাও লুকালাম না। বলে দিলাম মাকে।
শুনে মা ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার হাত ধরে মায়াবী গলায় বললেন, আয় খেতে বস। ঘরে যা ছিল তাই রান্না করেছি। চাল-ডালের সঙ্গে সবজি-টবজি মিলিয়ে খিচুড়ি করেছি। খেতে মজাই লাগবে। চিমত্মা করিস না। পাশের বাড়ির হেনার মা-র কাছ থেকে কয়েকটা টাকা ধার আনবো। কয়েকদিন চলে যাবে আমাদের। তারপর তুই তো টিউশনির টাকা পাবিই।
খেতে বসে মা বললেন, বাবা, এই ঘটনা কাউকে বলো না। যতদিন পারবে চেপে রাখবে।
কেন যে মা কথাটা বললেন, আমি বুঝলাম না। তবে এই এত এতগুলো বছর আমি কিন্তু চেপে রেখেছি। কাউকে বলিনি।
আমি বললাম, দাদিকে বলোনি?
না।
আমার বাবাকে, ফুপিকে?
আরে না। তোর দাদিকেই যে-কথা বলিনি তা ছেলেমেয়েকে বলতে যাবো কেন?
তা ঠিক।
এখন আমার সত্তর বছর বয়স। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন বয়স বাইশ-তেইশ বছর। এতদিন ঘটনা আমি চেপে রেখেছি।
তাহলে আজ আমাদের বললে কেন?
বলতে খুব ইচ্ছা করলো। কেন যে এই ইচ্ছাটা এতো তীব্রভাবে করলো তাও বুঝলাম না।
তার মানে এখন তুমি দাদিকেও বলবে? বাবাকে ফুপিকে, মাকে ফুপাকে, সবাইকে বলবে? অনি ঐশীকে?
নাও বলতে পারি।
কেন?
জানি না। হয়তো তোদের দুজনকে বলবার পর আর কাউকে বলতে ইচ্ছা করবে না।
দাদু একটু থামলেন। চায়ে বড় করে চুমুক দিলেন।
আমি বললাম, তার পরের ঘটনা বলো। তেরো টাকা ওই লোক ওইভাবে নিয়ে গেল। কেমন করে জানলো তোমার ওই পকেটে তেরো টাকাই আছে। শুনে তোমার মাও কিছু বললেন না। মানা করলেন ঘটনা যেন তুমি কাউকে না বলো। আমার প্রশ্ন হলো, লোকটা জানলো কী করে তোমার ওই পকেটে তেরোটা টাকাই আছে?
এটাই রহস্য। এটাই অলৌকিক ব্যাপার।
মিতু বলল, তোমার মা কেন ঘটনাটা কাউকে বলতে মানা করলেন?
তাও জানি না।
আমি বললাম, আর ওই লোক যে তেরো টাকা হাতে নিয়ে বলে গেল, এই তেরোর সঙ্গে শুধুই শূন্যের পর শূন্য যোগ হয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবে…
মিতু বলল, তা তো এসেছেই। দাদু এখন তেরো হাজার কোটি টাকার মালিক।
দাদু, সত্যি কি তোমার জীবনে তারপর থেকে তেরোর সঙ্গে শুধুই শূন্য যোগ হতে লাগলো?
দাদু মাথা নাড়লেন। লাগলো। পরের মাসেই তেরো হাজার টাকা পেলাম আমি।
বলো কী? ওই দিনে তেরো হাজার টাকা? সে তো অনেক?
হ্যাঁ অনেক। যেখানে আমি চারটা টিউশনি করে মাসে পাই চলিস্নশ টাকা। সেখানে একসঙ্গে তেরো হাজার।
শুনি ঘটনা।
আমার বাবা ছিলেন খুবই দরিদ্র ঘরের মানুষ। অতিকষ্টে ম্যাট্রিক পাশ করে কেরানির চাকরিটা পেয়েছিলেন। জায়গা-সম্পত্তি যেটুকু ছিল তাঁদের পড়াশোনায় আর বোনদের বিয়েশাদিতে খরচ হয়ে গেছে। আমার দাদার দিক থেকে বাবা পাননি কিছুই। মা সামান্য একটু জমি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার সম্পত্তি থেকে। তাও চাষের জমি নয়। বাড়ির একটুখানি অংশ। মামা সেটুকু নিজে কিনে রাখলেন। প্রস্তাবটা মা-ই তাঁকে দিয়েছিলেন। ছেলেটাকে নিয়ে আমি খুবই কষ্টে আছি। আমার ভাগের সম্পত্তিটুকু তুমি নিয়ে ন্যায্য দাম যা হয় আমাকে দিয়ে দাও। ছেলেটা বিএ পাশ করে বসে আছে। চাকরি-বাকরি হচ্ছে না। যেটুকু টাকা পাবো ওই দিয়ে সে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করুক।
সেই জমির দাম বাবদ মামা তেরো হাজার টাকা দিলেন। গ্রামের মাতববররা তেরো হাজারই সাব্যস্ত করে দিয়েছিল।
তার মানে সেই লোকের কথাই ফলতে লাগল? তেরোর সঙ্গে প্রথমেই তিনটা শূন্য যুক্ত হয়ে গেল?
ঠিক তাই। তেরো হাজার টাকা হাতে পেয়ে মা যেমন চমকেছিলেন, আমিও ঠিক তেমন চমকালাম। আরে, সেই লোক যা বলেছেন তা-ই দেখি হচ্ছে!
ওই তেরো হাজার টাকা আমার হাতে দিয়ে মা বললেন, চাকরি-বাকরির চেষ্টা আর করিস না। আমার জীবনের শেষ সম্বল তোকে দিলাম। এই দিয়ে ব্যবসা শুরু কর। তোর জীবন বদলে যাবে।
আমি ব্যবসা শুরু করলাম।
মিতু বললো, কী ব্যবসা?
কন্ট্রাকটরি। 888sport app শহরের রাস্তাঘাট মেরামতের কাজ। ড্রেন তৈরির কাজ। এখন যেটা সিটি করপোরেশন, তখন সেটা ছিল মিউনিসিপ্যালিটি। ওখানে কন্ট্রাকটরি শুরু করলাম। একটার পর একটা কাজ করি। তিন-সাড়ে তিন বছর পর দেখি আমার হাতে তেরো লাখ টাকা। কন্ট্রাকটরি কাজের বিল পেয়েছি আর চেক ব্যাংকে জমা দিয়েছি। কোন ফাঁকে এতগুলো টাকা হয়ে গেছে টেরই পাইনি।
মা আমাকে বিয়ে করিয়ে দিলেন।
তখন ভাবছি শুধু কন্ট্রাকটরিই করবো না। অন্য বিজনেসও করতে হবে। ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা খুবই জমজমাট হয়ে উঠেছে। আমিন নামে আমার এক বন্ধু বড় কাপড়ের ব্যবসায়ী। তাঁর সঙ্গে ইনভেস্ট করলাম পাঁচ-সাত লাখ টাকা। একদিকে কন্ট্রাকটরি আরেকদিকে কাপড়ের ব্যবসা। টাকা আসছে দুদিক থেকে। বছর সাতেকের মধ্যে দেখি আমি হয়ে গেছি তেরো কোটি টাকার মালিক। বিশাল ব্যাপার।
মা তখনো বেঁচে আছেন। একেকবার হিসাব দেখি আর মাকে জানাই। মা মিটিমিটি হাসেন। আমি জানতাম এমনই হবে। ওই যে তিনি বলেছিলেন তেরোর সঙ্গে শুধু শূন্য যোগ হতে থাকবে। দেখ ঠিক তাই হচ্ছে। যখনই কয়েক বছর পর ওই টাকা জায়গাজমি ধনসম্পত্তির হিসাব করবি, দেখবি ওই তেরোর সঙ্গে শূন্যের পর শূন্য বাড়ছে। তবে বাবা একটা কাজ করিস। তাহলো মানুষের উপকার। অসহায় মানুষকে সাহায্য করিস। একেবারে হাত খুলে করবি। বিপদে পড়া কোনো মানুষ যেন তোর কাছে এসে খালি হাতে ফিরে না যায়।
আমি মায়ের সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগলাম।
ব্যবসা তখন শুধু বাড়ছেই। তেরো কোটি হয়ে গেছে একশ তিরিশ কোটি। বড় বড় কনস্ট্রাকশনের কাজ করি। একটা টেক্সটাইল মিল করলাম। বছর দুয়েক পর কার্গো কিনলাম দুটো। সেদিক থেকেও আসতে লাগল দেদার টাকা। শুরু করলাম গার্মেন্ট ব্যবসা। 888sport appsে গার্মেন্ট ব্যবসা মাত্র শুরু হয়েছে। তিন বছরও যায়নি, দেখি আমার অ্যাসেট হয়েছে তেরোশো কোটি টাকার।
একটা ব্যাংক করলাম চার বন্ধু মিলে। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বাড়ছে একটার পর একটা। সি গোয়িং শিপ হয়েছে আটটা। আমি এগোচ্ছিই। কোনো ব্যবসায়ই লস নেই। সত্তর বছর বয়সে এসে আজ হিসাব দেখলাম, আমি তেরো হাজার কোটি টাকার মালিক। ওই যে এক দেবদূতের মতো মানুষ সাতচলিস্নশ-আটচলিস্নশ বছর আগে তেরো টাকার রহস্যটা তৈরি করে গেলেন, তেরোর সঙ্গে শুধু শূন্য বাড়তে থাকার কথা বলে গেলেন, আমার জীবনে হুবহু তাই ঘটলো।
দাদু থামলেন।
আমি আর মিতু হাঁ করে তাকিয়ে আছি দাদুর মুখের দিকে। এ তো অবিশ্বাস্য ঘটনা! এমন ঘটনাও ঘটে মানুষের জীবনে?
দাদু বললেন, এই ধরনের ঘটনা লোকে বিশ্বাস করে না। আমার জীবনে না ঘটলে আমিই বিশ্বাস করতাম না।
আমি বললাম, সত্যি অবিশ্বাস্য ঘটনা দাদু। তোমার মুখে না শুনলে আমরাও বিশ্বাস করতাম না। এ কেমন রহস্য? কী করে ঘটে এই রকম ঘটনা?
দাদু বললেন, ঘটনাটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। সেই লোককে নিয়ে অনেক ভেবেছি। ভেবে কূল-কিনারা পাইনি। কোত্থেকে এসেছিলেন সেই মানুষ? কোথায় চলে গেলেন আমাকে অমন রহস্যের মধ্যে ফেলে?
তুমি কি আর কোনোদিন ওই লোককে খুঁজতে ওদিকে গিয়েছিলে?
একবার-দুবার না, বহুবার গিয়েছি। আশপাশের গলিঘুঁজি সব তন্নতন্ন করে ফেলেছি। ওখানকার প্রত্যেকটা বাড়ি, প্রত্যেকটা দোকানপাটের লোকজনকে জিজ্ঞেস করেছি তাঁর কথা। বর্ণনা দিয়েছি। কেউ কিছুই বলতে পারেনি। অমন মানুষ তারা কেউ নাকি কখনো দেখেইনি। দীর্ঘদিন মানুষটাকে আমি খুঁজেছি। না, কোথাও আর দেখিনি তাঁকে। তারপর একসময় আমার ধারণা হলো, তিনি আসলে এই পৃথিবীর কোনো মানুষই না। সে অন্য পৃথিবীর মানুষ।
মিতু বলল, এলিয়েন?
আরে না, ওসব না। তোদের ওই এলিয়েন-ফেলিয়েন অন্য জিনিস। ওসব না। আমি কোথায় যেন একবার পড়লাম, আমাদের এই চলমান পৃথিবীর ভিতরই হয়তো আছে আরেক পৃথিবী। অতি রহস্যময় পৃথিবী। সেখানেও আছে কিছু মানুষ। কখনো কখনো তাঁরা এসে পড়েন আমাদের এই পৃথিবীতে। কিছু রহস্য তৈরি করে দিয়ে চলে যান। তিনি ছিলেন তেমন একজন। r


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.