১৪/এ আহিরীপুকুর রোড

একরকম হাওয়া দ্যায় রাস্তায় এই সময়। মনে হয় ঋতু বদলাচ্ছে। কোথাও কি একটা শব্দ হলো? জুবিলি শো হাউসে যখন বিস্ফোরণ হয়েছিল, এখান থেকে শোনা গিয়েছিল সে-আওয়াজ। বেড়ালছানাগুলি কিছু বোঝে না, খালি ছটফট করে। মাজাভাঙা পলাশ গাছটায় লাফ দিয়ে উঠতে চায় ওরা। এই পলাশ গাছে কোনোদিন ফুল ফুটবে না, ওরা জানে না।

এই সময় মিরপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ার বাসার জানালায় বসে, পুষ্পহীন পলাশ গাছটাকে দেখতে দেখতে আমার সেই বাড়িটার কথা মনে পড়ে খুব।

১৪/এ আহিরীপুকুর রোড। দেশে ফেরার আগে একবার দেখে আসতে চেয়েছিলাম যে-বাড়িটা। ওই বাড়ি ছিল আমার আব্বুর। ’৪৭-এ দেশভাগের সময় হাতবদল হয়। আমরা 888sport app চলে এলাম। বাড়ির খুব কাছেই শিশুপীঠে পড়তাম। হেঁটেই যাওয়া যেত। হেডমিস্ট্রেসকে আমরা বড় মাসিমা বলতাম। রবীন্দ্রনাথের কত 888sport app download apk শুনেছি তাঁর মুখে। একটা মনে আছে খুব, ‘বেলা যে পড়ে এলো জলকে চল’ শুনলেই বুকের মধ্যে কেমন করত। অনেক বন্ধু ছিল আমার। সবাইকে বলেছিলাম, আমি আবার ফিরে আসব। বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ছবি। সে নাকি খুব বড় একজন ফিল্মস্টারের মেয়ে। অন্যরা বলত; কিন্তু ছবির মুখে কোনোদিন ফিল্ম লাইনের কোনো কথাই শুনিনি। সেই ছবিকে বলেছিলাম, ফিরে এসে শুধু দুজনে মিলে গিয়ে একটা ইংরেজি ফিল্ম দেখব নিউ এম্পায়ারে। আমি তো ভেবেছিলাম কিছুদিনের জন্য 888sport app বেড়াতে যাচ্ছি, আবার ফিরে আসব। তাই এক বাক্স পুতুল চিলেকোঠায় লুকিয়ে রেখে চলে এসেছিলাম।

কিন্তু সে-বাড়িতে আর ফেরা হয়নি আমাদের। সারা ছোটবেলা আমি ওই পুতুলগুলির জন্য কাঁদতাম। রাতে শুয়ে মনে হতো, পুতুলগুলি আমায় খুঁজছে, বলছে সাল্লু, সাল্লু, আমাদের নিয়ে যাও, আমাদের ভয় করছে। আমার এক কাজিন আমাকে বলেছিল, দাঙ্গাবাজরা ওই বাড়িটা নাকি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে আমার মনে একটুও শান্তি ছিল না,  ভাবতাম আমি তো তিনতলার চিলেকুঠুরিতে রেখে এসেছিলাম পুতুলের বাক্স। আগুন কি তিনতলা অবধি ছড়াবে? অনেকদিন পর্যন্ত আমি আগুনের স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম পুতুলগুলি দাউদাউ করে জ্বলছে, কাপড়ের পুতুল কিছু, বেশি চিনেমাটির পুতুল, দু-একটা মাটির পুতুলও ছিল, আর ছিল চোখ খোলা বন্ধ একটা বিলিতি ডল, তার সোনালি চুল, দুদিকে বিনুনি করা, তাতে আবার গোলাপি রিবনের ফুল, নীল চোখ, জামাটাও মনে আছে এখনো, হালকা নীল রঙের, তাতে হলুদ পলকা ডট, পায়ে ছিল সাদা স্টকিংস, খুব প্রিয় ছিল এই পুতুলটা, একেক রাতে ওকে নিয়েই ঘুমোতাম। ওর জন্য আর বাকি সব পুতুলের জন্য আমার খুব কষ্ট হতো রাতে। নাকে ওদের পোড়া মাংসের গন্ধ পেতাম। মনে আছে সেইসময় কোনো মাংস খেতে পারতাম না। কেন খেতে পারছি না সে-কথা কেউ বুঝত না। আম্মি জোর করত, কিন্তু মাংস খেলেই আমি বমি করে দিতাম। খাওয়ার সমস্যা কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু ঠিক হলো না ঘুম।  রাতে ছটফট করতে করতে আম্মিকে আঁকড়ে ধরতাম। কিন্তু  বলতে পারতাম না আমার অস্থিরতার কারণ। আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জগতের আশপাশে আমার মন ঘুরে বেড়াত। ডাক্তার আমার অসুখ খুঁজে পেতেন না। পরে অবশ্য বইয়ের জগতে ঢুকে গেলাম। আহিরীপুকুরের কথা আর মনে পড়ত না। ভুলেই গেলাম বলতে গেলে।

কিন্তু বইয়ের জগতেও আমি বেশিদিন থাকতে পারলাম না। কলকাতার বাড়ি ছেড়ে 888sport appয় আসার পর থেকেই আব্বু কেমন মনমড়া হয়ে

থাকতেন। 888sport appয় এসে তিনি একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলেন। টুকটাক করে ভালোই চলছিল। কিন্তু আব্বুর যেন তেমন ব্যবসায় মন ছিল না। সারাক্ষণ উদাস হয়ে থাকতেন।

একদিন দোকানে থাকতে থাকতে বুকে ব্যথা। বাসায় আর ফিরলেন না আব্বু। মনে হয় অভিমান ছিল কলকাতা ছেড়ে আসার জন্য। 888sport appর বাসা কোনোদিন ঘর হয়ে ওঠেনি তাঁর কাছে। আর আব্বু চলে যেতেই আমি যেন সবার কাছে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠলাম। আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই আম্মিকে অস্থির করে তুলল।  আব্বু বেঁচে থাকলে কি স্কুল ছাড়িয়ে সাততাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হতো আমার? কেন চলে গেলেন আব্বু অসময়ে?

আসলে ওই আহিরীপুকুরের বাড়ি ছিল আব্বুর বড় সাধের বাড়ি। এক পড়ন্ত জমিদারের কাছ থেকে তিনি বাড়িটি কিনেছিলেন। তিনতলা বাড়িটির ল্যান্ডিং বরাবর রঙিন কাচের শার্সি। আর ছাদের চিলেকোঠাটি ছিল ছয়কোনা, যাকে বলে ষড়ভুজ, মৌচাকের মতো। ওটা অন্য চিলেকোঠাগুলির মতো ছিল না, যেখানে সাধারণত বাড়ির সব বাতিল জিনিস ঠাসা থাকে। পুরনো একটা সোফা ছিল আর একটা দোলনা চেয়ার। চারপাশটা রঙিন কাচ দেওয়া জানালায় ঘেরা ছিল। সে-সময় ওই পাড়ায় তিনতলা বাড়ি আর একটাও ছিল না। বেশিরভাগই দোতলা বা একতলা। চিলেকোঠার জানালায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে কোন সুদূরে মন চলে যেত, চোখ কোথাও আটকাত না। আম্মি কাজের বেটিকে দিয়ে নিয়মিত চিলেকোঠা ঝাড়ু দেওয়াতেন, তাই ঝুল, তেলাপোকা এসবের উৎপাত ছিল না। বাড়ির মধ্যে ওইটা ছিল আমার রাজত্ব। আমার পুতুলের বাক্স, 888sport app download apkর গোপন ডায়েরি – সব ওখানে থাকত। মেঝেতে একটা পাটি পেতে আমি 888sport app download apk লিখতাম। দুপুরবেলা রঙিন কাচ দিয়ে পড়া রোদ্দুরে ঘরটা কেমন নানা রঙের আলোয় ভরে উঠত। আম্মি বলত, ‘শীতে এই ঘর না-হয় খুব আরামের, কিন্তু গরমে কী করে যে থাকে সাল্লু, বুঝি না। আন্ডা রেখে এলে সেদ্ধ হয়ে যাবে, এত গরম।’

আমার কিন্তু ওই গরমটাও ভালো লাগত। বরং গরমকালটাই বেশি ভালো লাগত। গরমের ঝাঁজে একটা ঝিমঝিম নেশা হতো, কেমন অবশ হয়ে আসত শরীর। 888sport app download apkর খাতা বন্ধ করে তখন পুতুল খেলতাম। ছয় কোণের একটা কোণে আমি আমার পুতুল খেলার ঘর বানিয়েছিলাম। আম্মি সবাইকে বলত, ‘সাল্লু কেমন জুতোর বাক্স দিয়ে পার্টিশন করে পুতুলের শোবার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর বানিয়েছে।’

সেই প্রথম পার্টিশন শব্দটা শুনি আমি। খুব মজার মনে হয়েছিল শব্দটা। আসলে আম্মির মুখে সব কথাই খুব মিষ্টি লাগত। খুব মিঠাস ছিল গলায়। কখনো চেঁচিয়ে কথা বলতে পারত না। কাজের বেটিদের সঙ্গেও নয়। তবু তারা সবাই আম্মিকে খুব মানত।

888sport appয় চলে আসার পর মায়ের গলা থেকে সব মিঠাস ঝরে গেল। বিশেষ করে আব্বু ওইভাবে চলে যাওয়ার পর সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। যে আম্মি কখনো একা বাড়ির বাইরে বের হয়নি, তাকে গিয়ে আব্বুর ব্যবসার হাল ধরতে হলো। তবে ব্যবসাটা চাল-ডালের নয়, বইয়ের ব্যবসা। পুরনো বই, পুঁথি এইসব কেনাবেচা হতো আব্বুর আমলে। আম্মি আস্তে আস্তে একটা পুরনো প্রেস কিনল, আমার সেই ঘরোয়া শান্ত আম্মি। মানুষ পরিস্থিতির চাপে কত কী পারে ভাবলে অবাক হতে হয়। আল্লাহতায়ালা সবার মধ্যেই অনেক শক্তি দিয়েছেন, বিশেষ বিশেষ সময়ে তা বেরিয়ে আসে। আমি শুধু ভাবছিলাম সব সম্ভব, শুধু কলকাতায় সেই বাড়িটায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব।

দুই

কলকাতায় যাওয়া হলো অবশ্য অনেক বছর পরে। বিয়েরও অনেক বছর পার করে। তখন ছেলের বয়স চোদ্দো, মেয়ের নয়। আমার স্বামীর কিছু কাজ ছিল ওদেশে, তার মধ্যে একটা ছিল তার আব্বার ভিটেয় চেরাগ আর আগরবাত্তি জ্বালিয়ে আসা। বসিরহাটের দুর্গানগর গ্রাম। সেখানে সে-ও ছেলেবেলার অনেকটা সময় কাটিয়েছে। তারপর ছাড়তে হলো পার্টিশনের সময়ে আমাদের মতোই।

কলকাতা যাওয়ার নামে আমার বুক নেচে উঠেছিল যেমন, তেমনি এক তীব্র অভিমানও কাজ করেছিল। সেখানে তো আমার বাড়িই আছে, তাহলে কেন আমাকে পাসপোর্ট-ভিসা করে যেতে হবে? আরো অভিমান হয়েছিল যে, নিজের আব্বার ভিটেয় আগরবাত্তি জ্বালানোর কথা বলল 888sport live chatী-পাপনের পাপা, কিন্তু একবারও আমার কলকাতার বাড়ির নাম করল না। আমার মনে হলো, ভাগ শুধু দুই দেশের নয়, 888sport promo code-পুরুষের মধ্যেও হয়। একজনের কাছে আর একজনের কথা পৌঁছায়  না।

888sport appর এয়ারপোর্ট তখন তেজগাঁওতে। ছোট্ট এয়ারপোর্ট। কোনো ঝামেলা নেই। এখন তো এয়ারলাইন্সগুলি কিপ্টে হয়ে গেছে। কিন্তু সে-সময় মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথে কত খাবার যে দিলো ওরা। স্যান্ডউইচ, কমলা, অরেঞ্জ জুস, আইসক্রিম, সন্দেশ, কাজুবাদাম। 888sport live chatী ছোট বলে আবার ওর জন্যে বিরাট একটা চকলেট। আমার যদিও কিছু  খেতে ইচ্ছে করছিল না। বুকের ভেতরে কেমন ফাঁত ফাঁত করছিল। সত্যি আমি কলকাতা যাচ্ছি? আম্মি, আব্বুর কথা মনে পড়ছিল খুব।

কলকাতায় আমরা উঠেছিলাম আমার মাসিশাশুড়ির বাড়ি। পার্ক সার্কাসে, কর্নেল বিশ্বাস রোডে। নিঃসন্দেহে তাঁরা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনতলা বিরাট বাড়ি। একতলায় ডাইনিং হলে সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার খাওয়া হয় সবাই মিলে। বিকেলের চা দোতলার ড্রয়িংরুমে। খুব হইহই করে দিনগুলি কাটছিল। আজ চিড়িয়াখানা তো কাল জাদুঘর। এর মধ্যে দুদিনের জন্য বসিরহাটেও যাওয়া  হলো। 888sport appর বাইরে আমি পোড়াদহ ছাড়া কখনো কোথাও যাইনি। দুর্গানগর যেতে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ওখানে শ্বশুরের ভিটেতে আগরবাত্তি জ্বালাতে জ্বালাতে আমার গলার কাছে কী একটা দলা পাকাল। আমার আব্বুরও একটা ভিটে আছে। সেখানে এখন অন্য লোক থাকে ঠিকই, কিন্তু তারা নিশ্চয় বাড়িটায় ঢুকতে দেবে আমাকে। ভাবতেই আমার বুকটা লাফিয়ে উঠল। আমি দেখতে পেলাম সেই রঙিন আলোয় ভরা চিলেকোঠা, পুতুলের বাক্সটা। শিশু বিদ্যাপীঠের বড় মাসিমা আর ছবির মুখটা আবছা আবছা ভেসে উঠল। আমি দেখতে পেলাম সেই আম আর নারকেল গাছগুলি, গেটের ওপর মাধবীলতার ঝাড়, মোরগঝুঁটির ফুল আর পেছনে লজ্জাবতী লতা। ছুঁলেই কুঁকড়ে যেত। তাই বারবার ছুঁতাম। সারাদিন কতবার যে দৌড়ে দৌড়ে যেতাম শুধু পাতাগুলিকে ছোঁব বলে। আর পাশেই ছিল ভর্তি আমরুল পাতা। তুলে নিয়ে খেতাম যখন-তখন। ধোয়ার কথা মনেই হতো না। দারুণ টক-টক খেতে। আম্মি একটু হেসে বলত, ‘কত ভালো ভালো খাবার বানাই বাসায়, তবু সাল্লু সারাদিন বনবাদাড়ে ঘুরে বুনো ফল-পাতা খায়। ঠিক দুর্গার মতো।’

আম্মি আমাকে পথের পাঁচালী পড়ে শুনিয়েছিল, তাই জানতাম দুর্গার কথা। কিন্তু আম্মি কী যে বলে! কলকাতায় বনবাদাড় কোথায়? একটু যা বাগান।

দুর্গানগরে চারদিকে গহন সবুজ দেখে আমার হঠাৎ দুর্গার কথা মনে পড়ল। সেই বাড়িটা। লজ্জাবতী লতা, আমরুল পাতা আর মাধবীলতা। আমার আম্মি, আব্বু। চোখ ভেসে গেল জলে। 888sport live chatী-পাপনের পাপা খেয়ালই করল না। 

তিন

শুধু দুপুরবেলা নয়, সারাদিনে সুযোগ পেলেই ফুড়ৎ করে পালিয়ে ছাদে চলে যেতাম। ছাদে এক চক্কর পাক খেয়ে আমার প্রিয় চিলেকোঠায় ঢুকে পড়তাম। এই রঙিন কাচে সাজানো চিলেকোঠায় বসে দুনিয়াটাকে তখন কত রঙিন লাগত, আজ মনে পড়লে হাসি পায়। যেহেতু এর শেপটা ছিল ষড়ভুজ, তাই আমি কল্পনা করতাম, আমি আসলে একটা মৌচাকের মধ্যে বসে আছি।

একদিন কী হলো, স্কুল থেকে ফিরে নাস্তা খেয়ে ছাদে গেছি খেলব বলে, একটু একা একা লাফানদড়ি খেলে, চিলেকোঠায় ঢুকে পুতুল খেলছি, কখন যে বিকেলের আলো পড়ে গেছে খেয়াল নেই, বেশ ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। গরম লাগায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, আবছা অন্ধকার চারদিকে, তখনো সব বাড়ির আলো জ্বলে ওঠেনি। তখন মানুষ সন্ধ্যা গাঢ় হওয়ার আগের অন্ধকারটা উপভোগ করতে পারত। এখন প্রকৃতির অন্ধকার মুছে দেওয়ার চেষ্টা কত ঝকঝকে আলো দিয়ে। দিনের বেলাতেও চোখ জ্বলে যায় আলোয়। তাই কি যত অন্ধকার জমা হয়েছে মানুষের মনে?

আগেই বলেছি, আমাদের বাড়ির সামনে আর পেছনে খানিকটা জায়গা ছিল, সামনে ফুল গাছ আর পেছনে আম, সবেদা আর অল্প কিছু শাক-সবজি। উঁচু পাঁচিল বরাবর ছিল সারি সারি নারকেল গাছ। 

নারকেল পাতার ঝালরের ফাঁকে যে চাঁদ উঠতে না দেখেছে, তার জীবনই

বৃথা। ওই বয়সেই সেই দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করত, কালচে সবুজ পাতাগুলি জ্যোৎস্নার মায়াকে যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিত, দেখে আমার চোখে জল চলে আসত। আমার আম্মি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘কী যে আছে এই মেয়ের কপালে!’

সেদিন অবশ্য চাঁদ ওঠেনি, কৃষ্ণপক্ষ চলছে। জানালায় দাঁড়িয়ে মনে হলো সামনের নারকেল গাছ বেয়ে কে যেন উঠছে। আমার মনে হলো, জলিল চাচা, তাকে মাঝে মাঝে নারকেল পাড়ার জন্য ডাকা হতো। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, জলিল চাচা তো কখনো এত সন্ধেবেলা গাছে ওঠে না। সেইসময় আম্মি ছাদে এলো। আম্মিকে বললাম, ‘আম্মি দেখো দেখো, এই সন্ধেয় জলিল চাচা নারকেল পাড়তে উঠেছে।’

আম্মি চমকে তাকাল। কেউ নেই কোথাও। আম্মি ছুটে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিল।

‘কী হয়েছে আম্মি?’

‘তুই কি জানিস না জলিল তিনদিন  হলো মারা গেছে?’

আমার গলা দিয়ে একটা অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।

আমি কি জলিলচাচার ভূত দেখলাম তাহলে?

চার

ওই ঘটনার কিছুদিন পরেই দাঙ্গা বাধে, আমরা চলে আসি কলকাতা ছেড়ে। 

কিন্তু চলে আসার পর, এমনকি আব্বুর মৃত্যুর পরও যে আমরা কেউ ভুলতে পারিনি ওই বাড়িটাকে, তার প্রমাণ মা তার প্রেসের নাম দিলো আহিরী প্রিন্টিং প্রেস! 

রোজ এই নামটা শুনলেও একটা সময় এটা কিছু মনে পড়াত না। সেই বাড়ি, ফেলে আসা পুতুল, কষ্টের 888sport sign up bonus, কিচ্ছু না। চিলেকোঠার সেই নানান রঙের কাচ, নারকেল গাছ, কিছুই মনে পড়েনি।

আমার স্বামীর কী একটা কাজ পড়ল কলকাতায়। আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে এলো। উঠলাম কর্নেল বিশ^াস রোডে। তিনতলা বাড়ি ওর মাসির। সেই বাড়িতে এসে আহিরীপুকুরের কথা মনে পড়ল আমার।

অবশ্য প্রথম কদিন আমার কিছু মনে করার অবস্থা ছিল না। জীবন একটা আনন্দময় পিকনিক কিংবা কার্নিভালের মতো হয়ে উঠেছিল। তিনতলা বাড়ির প্রতিটি তলায় অনেক লোক, খাওয়া-দাওয়া, অনেক হাসি-হল্লা, তর্ক-বিতর্ক। আমার স্বামী কমিউনিস্ট, তাঁর সঙ্গে প্রায়ই তর্ক বাধত পুরনো কংগ্রেসী আনোয়ার চাচার। তাছাড়া ফিসফাস শুনেছিলাম গিটার বাজিয়ে গান করা, নিজের ঘরে চুপচাপ থাকা ছেলেটি, যে আমার সম্পর্কে দেওর হয়, সে নাকি নকশাল, অনেক কষ্টে তাকে বাঁচানো হয়েছিল পুলিশের নজর থেকে। সে অল্পই কথা বলত, কিন্তু যখন বলত, তীব্র ঘৃণা ফুটে উঠত দুনিয়ার সবকিছুর বিরুদ্ধে। আমি এসব ঠিক বুঝতে পারতাম না। দুনিয়ার সব মানুষ সমান হবে নাকি কোনোদিন? 888sport live chatী পাপনের পাপা আমাকে এইসব বই পড়তে দেয়নি তো কোনোদিন! এসব চেঁচামেচির থেকে বরং ভালো লাগত মাঝে মাঝেই কলকাতা দেখতে বেরিয়ে পড়া। আর নানান মানুষের বাড়ি দাওয়াত খাওয়া।

এদিকে বেড়াতে বেরিয়ে আমার জুতো নিয়ে বিপত্তি হলো। হাঁটার উপযুক্ত নয় সে-জুতো। আসলে বাসা থেকে বেরিয়ে কখনো হাঁটতে হয়নি। হয় পর্দা ফেলা বাহারি নকশা করা রিকশা, রিকশা তো নয় যেন ময়ূরপঙ্খি নৌকো, নয়তো বেবিট্যাক্সি। একবার আম্মির বাবার বাড়ি পোড়াদহে মেলা দেখতে গিয়ে কীরকম নাকাল হয়েছিলাম, মনে পড়ে এখনো। আমার ফ্যান্সি চটি ছিঁড়ে, শাড়ি ছিঁড়ে সে এক বিশ্রী কাণ্ড। তখন থেকেই আমি পথে বিবর্জিতা।

কলকাতা তো আরো বিশাল ব্যাপার। এখানে ফুটপাত সব দখল হয়ে আছে। এখানে আমি কী করে হাঁটব? এদিকে ট্যাক্সিও পাওয়া খুব শক্ত। তার ওপর যখন গিয়েছিলাম তার কয়েক বছর আগেই ওপারে নকশাল আন্দোলন শেষ হয়েছে, এপারে মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু বোমা ফাটলে যেমন স্পিøন্টার এদিক-ওদিক ছিটকে লুকিয়ে থাকে, তেমনি দুই বাংলার গোটা গায়েই অসংখ্য ক্ষত।

সেখানে আমরা ঘুরছি, ফিরছি, ফূর্তি করছি, দূরে শ^শুরের ভিটাও দেখে এলাম। কিন্তু আমার বাড়ি এত কাছে, তা আর দেখা হয় না, মনের কোণে গুমরে মরি একা একা।

শেষ পর্যন্ত বলে ফেললাম, স্বামীর কাছে না, কেমন এক অভিমান আটকে রাখল গলা, বললাম ছেলেমেয়ের কাছে। তারা তাদের পাপার কাছে গিয়ে বলল, ‘পাপা, ও পাপা, এখানে তো আমাদের নানার বাড়ি আছে, এই কলকাতাতেই, এই নানির বাড়ির কাছেই, আম্মিকে নিয়ে যাবে না দেখতে?’

‘নানার বাড়ি? ইন্ডিয়ায়! ওহ্ সেই যে গ্রেট পুতুলের বাক্স? তোর আম্মির কাণ্ড দেখেছিস? সবকিছু শেষ মুহূর্তে। কাল আমাদের ফেরার ফ্লাইট আর আজ বলছে।’  আমি ধরা গলায় বললাম, ‘লাগবে না দেখাতে।’

‘আবার খোমা রাগ আছে! একটু আগে বলতে কী হয়? এতদিন থাকা হলো! এখন আর সময় কোথায়? এখনো কত মার্কেটিং বাকি। তারপর মুজাফফরভাইয়ের বাড়ি দাওয়াত রাতে। গোছগাছ।’

মার্কেটিং অনেক হয়েছিল যদিও। ঘড়ি, সাইকেল। হটপট, টিফিন বক্স, প্রেশার কুকার, মিক্সি, কিমা মেশিন, প্লাস্টিকের বড় বালতি। গড়িয়াহাট, বড়বাজার আর নিউমার্কেট ঘুরে ঘুরে কেনা সব। শাল, জর্জেট শাড়ি, সুট পিস। কিন্তু যা হয়, শেষ মুহূর্তে দেখা গেল, অনেকের জন্যে উপহার কেনা হয়নি। গেলে তো তারা বাঁকা কথা শোনাতে ছাড়বে না। ইন্ডিয়ায় যাইলে, আর কিছুই আনলা না!

আমি বলতে পারলাম না, তুমি তো একবারও বলোনি আমার বাড়ি যাওয়ার কথা, অথচ কতবার শুনেছ আমার মুখে। একবার তো বলেওছিলে ওই বাড়িটা

থাকলে কত মজা হতো। কলকাতায় ওঠার একটা বাড়ি থাকত নিজেদের। মাসির বাড়ির এই হট্টমেলায় থাকতে হতো না। এখানে আদর-যত্নের অভাব নেই সত্যি, কিন্তু বড় বেশি লোক, নামই মনে রাখা যায় না, মাথা ঘুরায়।

আমি চোখের জল সামলাতে সামলাতে বললাম, ‘বললাম তো লাগবে না দেখতে।’

আমার স্বামী বলল, ‘কী আর দেখবে গিয়ে? অন্য লোকরা আছে, গিয়ে কষ্ট হবে, বুঝলি 888sport live chatী, তোর মা ভাবছে গিয়ে সেই পুতুলের বাক্স নিয়ে বসে খেলতে পারবে তিনতলার চিলেকোঠায়, আর দেখবে জলিল মিয়ার ভূত এখনো নারকেল গাছ বেয়ে উঠেই চলেছে। টাইম স্ট্যাচু হয়ে গেছে।’

বলে সে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল। কিন্তু 888sport live chatী বা পাপন কেউ হাসল না। 888sport live chatী আমাকে এসে জড়িয়ে ধরল আর পাপন, চোদ্দো বছরের ছেলে, ওর পাপার চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘কাল এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য একটু আগে আগে রওনা হবো আমরা। যাওয়ার পথে নানার বাড়ি দেখে যাব।’

পাঁচ

আমি আঁচলটা মাথায় আরেকটু টেনে নিলাম। বড় রোদ এখানে। চোখে ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। আমার মনে হলো, এই সেই আগুনের ধোঁয়া। আমাদের বাড়ির জায়গায় একটা ঝকঝকে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়ি, কত তলা বুঝতে পারলাম না। সেটার তিনতলা আর এটার তিনতলা কি একই উচ্চতায়? আমি মনে মনে মাপতে চেয়ে থই পাই না। একটা  জানালা দিয়ে উঁকি মারে ফুটফুটে একটা বাচ্চা, আমাকে দেখেই আবার পর্দার পেছনে লুকিয়ে পড়ে, ওই তো আমার সেই সোনালি চুল, নীল চোখের চোখ খোলা চোখ বন্ধ পুতুলটা। তখন ইশকুলে কারো কাছে এই পুতুল ছিল না, একবার আমি  নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলাম সবাইকে। ছবি দেখে কী আনন্দ পেয়েছিল। ও নাকি একজন ফিল্মস্টারের মেয়ে, ওর কাছেও ছিল না এই পুতুল। আর আম-নারকেল গাছ? সেসব তো প্রথমেই কাটা পড়েছিল। রাবিশগুলি কোথায় ফেলেছে? তার মধ্যে কি আমার সেই পুতুলের বাক্সটা আছে?

আমার স্বামী ট্যাক্সি থেকে অধৈর্য গলায় বলে, ‘কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যাম নিয়ে কোনো ধারণা আছে? এয়ারপোর্ট একেবারে শহরের ওই মাথায়। আমি তো আগেই বলেছিলাম কিছুই পাবে না, হুদাই সময় নষ্ট।’

আমি ট্যাক্সিতে ওঠার আগে একবার নেমপ্লেটটা দেখি। ঠিকানাটা অবিকল এক, ১৪এ আহিরীপুকুর রোড, কোথাও কোনো ভুল হয়নি তো, শুধু পুতুলগুলো ছাই হয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে

পড়েছে…