বারো

‘‘আবদুল মোত্তালিব যখন জমজম কূপ খনন করতে গেলেন তখন কুরায়েশদের প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হলেন। তখন তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তাঁর যদি দশটি সন্তান হয় তাহলে তাঁদের একজনকে তিনি কাবাঘরের চত্বরে মহান আল্লাহপাকের নামে কুরবানি করবেন।

আবদুল মোত্তালিবের দশটি সন্তান হলো। এক সময় তিনি তাঁদের ডেকে তাঁর অঙ্গীকারের কথা জানালেন। আল্লাহপাকের সঙ্গে তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করার ইচ্ছাও ব্যক্ত করলেন। সন্তানেরা প্রত্যেকেই পিতার এই ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানালেন এবং তাঁদের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই একটি করে তীর হাতে নাও। আর তাতে নিজের নাম লেখ।’

সন্তানেরা তাই করলেন।

কাবার মাঝামাঝি জায়গায় হুবালের মূর্তির কাছে একটি কূপ আছে। কাবায় প্রদত্ত যাবতীয় সম্পদ এই কূপটিতে জমা রাখা হতো। আবদুল মোত্তালিব তীরগুলো এই কূপের কাছে নিয়ে গেলেন। সন্তানদের তীর ছুড়তে বললেন। তাঁরা তীর ছুড়লেন। তীরে নাম উঠল আবদুল মোত্তালিবের প্রিয়তম সন্তান আবদুল্লাহর। রাসুলে (সা.) পাকের পিতার।

আবদুল্লাহ, আল জুবায়ের ও আবু তালিব ছিলেন আবদুল মোত্তালিবের এক স্ত্রী ফাতিমার সন্তান। তীরে আবদুল্লাহর নাম উঠবার পর আবদুল মোত্তালিব একটা বড় ছুরি হাতে তাঁকে টেনে নিয়ে গেলেন ইসাফ ও নায়েলা নামক দুটো মূর্তির কাছে। কুরবানি করা হতো এখানটাতেই। আবদুল মোত্তালিবের এই কাণ্ড দেখে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ আপত্তি করলেন। তাঁরা বললেন, ‘ভাগ্য পরীক্ষার শেষ বিধানটি পূর্ণ না করে আবদুল্লাহকে কুরবানি করা যাবে না।’

মদিনার তখন নাম ছিল ‘হিজাজ’। হিজাজে এক জাদুকর রমণী ছিলেন। কুরায়েশ নেতারা বললেন, ‘তাঁরা সেই রমণীর কাছে যাবেন। তিনি যা বলবেন সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তাই করা হলো। জাদুকর রমণী বললেন, ‘তিনি তাঁর অশরীরী অনুচরের সঙ্গে কথা বলবেন, তারপর কী করণীয় সে-সম্পর্কে জানাবেন।’

পরদিন কুরায়েশ নেতাদের ডেকে জাদুকর রমণী বললেন, ‘অশরীরী অনুচরের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এখন আমাকে তোমরা বলো হত্যার বদলে কত অর্থ প্রদান করার নিয়ম আছে তোমাদের মধ্যে?’ কুরায়েশ নেতারা বললেন, ‘দশটি উট।’ জাদুকর রমণী বললেন, ‘তোমরা তোমাদের দেশে ফিরে যাও, গিয়ে আবদুল্লাহ ও দশটি উট পাশাপাশি রেখে, তারপর তীর ছোড়ার ব্যবস্থা করো। যদি একই নাম ওঠে তাহলে প্রতিবারেই দশটি করে উট বাড়তে থাকবে।’

জাদুকর রমণীর কথামতোই কাজ শুরু হলো। দেখা গেল প্রতিবারই আবদুল্লাহর নাম উঠছে আর উটের 888sport free bet বেড়ে যাচ্ছে। আবদুল মোত্তালিব কম্পিত হৃদয়ে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন। যখন উটের 888sport free bet একশটি হলো তখন আর আবদুল্লাহর নাম উঠল না। উটের নাম উঠল। অর্থাৎ আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন।

আবদুল মোত্তালিব বললেন, ‘না, আরো দুইবার এই পরীক্ষা চালাতে হবে। ফল একই হলে বুঝব আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন।’ তাই করা হলো। প্রতিবারই আবদুল্লাহ নামের পরিবর্তে একশটি উটের নাম উঠল। ফলে ওই উটগুলো কুরবানি করা হলো। মক্কার মানুষ প্রাণভরে সেই উটের গোশত খেল।

আবদুল মোত্তালিব তাঁর প্রিয়তম পুত্র আবদুল্লাহর হাত ধরে গভীর আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় ওরাকা বিন নওফেলের সুন্দরী বোন কাবার দিকটাতে আসছিলেন। আবদুল মোত্তালিব ও আবদুল্লাহর সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। সুন্দরী মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, ‘আবদুল্লাহ, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ আবদুল্লাহ জবাব দিলেন, ‘আমি আমার পিতার সঙ্গে যাচ্ছি।’ মেয়েটি বলল, ‘তোমার নামে যতগুলো উট কুরবানি করা হয়েছে, ততগুলো উট আমি দেবো যদি তুমি আমাকে বিয়ে করো।’ আবদুল্লাহ বললেন, ‘আমি আমার পিতার সঙ্গে যাচ্ছি। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে পারবো না। তাঁকে ছেড়ে যেতে পারবো না।’

তারপর আবদুল মোত্তালিব ছেলেকে নিয়ে গেলেন ওহাব ইবনে আবদুল মানাফের কাছে। আবদুল্লাহর বিয়ে দিলেন তাঁর কন্যা আমিনার সঙ্গে। কুরায়েশদের মধ্যে আমিনা ছিলেন এক অসাধারণ রমণী। তাঁর মা-বাবা দুজনেই বংশমর্যাদায় ছিলেন অতুলনীয়। বাসররাতেই রাসূলে (সা.) পাককে গর্ভে ধারণ করলেন আমিনা। যে-মেয়েটি আবদুল্লাহকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল পরদিন তাঁর সঙ্গে আবদুল্লাহর দেখা হলো। আবদুল্লাহ তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘বিয়ের প্রস্তাবের কথা কি সে ভুলে গেছে?’ মেয়েটি বলল, ‘আবদুল্লাহর প্রতি তাঁর আর কোনো আকর্ষণ নেই। কারণ আগের দিন আবদুল্লাহর কপালে যে-আলোর ছটা মেয়েটি দেখতে পেয়েছিল তা এখন আর নেই। মেয়েটি তাঁর ভাই ওরাকা বিন নওফেলের কাছে শুনেছিল যে, তাঁদের মাঝে একজন রাসূলের (সা.) আবির্ভাব ঘটবে।’

আল্লাহর রাসূল (সা.) যখন তাঁর মায়ের গর্ভে, তখন আমিনা বলতেন, মাঝে মাঝে তিনি গায়েবি আওয়াজ শুনতে পান। গায়েবি আওয়াজ তাঁকে জানাতো, ‘তুমি এই জাতির রাজাকে গর্ভে ধারণ করেছ। যখন তাঁর জন্ম হবে তখন তুমি বলবে, আমি এই শিশুকে মহান প্রভুর হেফাজতে রাখলাম। সকল ঈর্ষাকাতর লোকের অমঙ্গল থেকে তিনি তাঁকে রক্ষা করুন আর তাঁর নাম রেখো ‘মুহাম্মদ’।’

গর্ভাবস্থায় আমিনা কখনো কখনো দেখতে পেতেন তাঁর শরীর থেকে একটি আলো বেরিয়ে চারদিক আলোকিত করে তুলছে। সেই আলোয় তিনি সিরিয়ায় বসরার দুর্গগুলো দেখতে পেতেন। সন্তানের জন্মের আগেই আল্লাহর রাসূলের (সা.) পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।’’

মজলিসের এক কোণে আবুও বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে খাঁ সাহেবের কথা শুনছে। বিড়ালটি পায়ের কাছে শুয়ে আছে আগের ভঙ্গিতে। খাঁ সাহেব থেমেছেন দেখে আবু তাকিয়েছে তাঁর দিকে। তাকিয়েই বুঝতে পারলো এখন চা দিতে হবে তাঁর শিষ্যদের। সে উঠে গেল।

চায়ের আগে মুড়ি-বাতাসা দেওয়া হলো। খাঁ সাহেব নিজে মুড়ি-বাতাসা খেলেন না। তিনি উদাস ভঙ্গিতে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। তারপর সিগারেট ধরালেন।

মুড়ি-বাতাসা আর চা খাওয়া শেষ হতেই খাঁ সাহেব মজলিসের দিকে একবার তাকালেন। সিগারেটে টান দিলেন। তখন আউয়াল বিনীত গলায় বলল, ‘হুজুর, একখান কথা জিগাইতে চাই।’

খাঁ সাহেব নরম গলায় বললেন, ‘বলো।’

‘নবিজির দাদা আবদুল মোত্তালিবের যে-ঘটনা আপনে বললেন, নবিজির পিতা আবদুল্লাহকে কুরবানি দেওয়ার কথা, কুরায়েশরা সেইটার প্রতিবাদ কইরা মদিনার এক জাদুকর মহিলার কাছে গেছিল। সেই মহিলা সমস্যা সমাধান কইরা দিলো। আবার আপনের মুখেই শুনেছি হজরত মুসা (আ.) তাঁর হাতের লাঠি ছুইড়া মারছিলেন জাদুকরগ সাপের দিকে। মুসা নবির লাঠি সাপ হইয়া জাদুকরগ সব সাপ খাইয়া ফালাইছিল। আমি হুজুর বলতে চাইতাছি, সেই আমলে জাদুকরগ মনে হয় বহুত ক্ষমতা আছিল। জাদুবিদ্যা কি হুজুর এখনো আছে দুনিয়াতে?’

খাঁ সাহেব আউয়ালের দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি কেন তোমার মনে এই প্রশ্নটা এলো? রতনপুরের দেবু ঠাকুরের নানা কাণ্ডকারখানার কথা এলাকার সবাই জানে। সবাই মনেও করে ঠাকুর নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যা খুব ভালো জানে। দেবুর ওইসব কাণ্ডকারখানা জাদুমন্ত্র কি না তা আমি বলতে পারবো না। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।’

খাঁ সাহেব একটু থামলেন, সিগারেটে টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মনজিল ব্যাপারী বলল, ‘সব থিকা বড় ঘটনা হইল হুজুর, এলাকার বেবাক মাইনষে দেখলো ঘরের দুয়ারে ঠাকুরের গলাকাটা লাশ। দারোগা-পুলিশে হেই লাশ লইয়াও গেল। তয় এক বচ্ছর বাদে ঠাকুর আবার ফিরত আইলো কেমনে? এইটা তো হুজুর জাদুই মনে হয়।’

খাঁ সাহেব বললেন, ‘এই প্রসঙ্গটা থাক। যা বলছিলাম সেইসব কথা আর কিছুটা বলি। নবিজির জীবনের অলৌকিক ঘটনা। তাঁর পিতা হজরত আবদুল্লাহ যখন বিয়ে করেন তখন তিনি যুবক। ব্যবসাও শুরু করেছিলেন তখন। তবে বেশিদিন বাঁচলেন না। আগেই বলেছি নবিজি তাঁর মাতৃগর্ভে থাকার সময়েই আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। তবে তিনি বেশি সম্পদ রেখে যেতে পারেননি। পাঁচটি উট, একপাল ছাগল আর একজন ক্রীতদাসী রেখে যান। ক্রীতদাসীর নাম ‘উম্মে আয়মন’। উম্মে আয়মন ছিলেন হাবসি বংশের। নবিজিকে তিনি খুবই আদর-স্নেহ করতেন। তাঁর আসল নাম ছিল ‘বারাকা’। নবিজির জীবনের তখনকার গরিবানা অবস্থার উল্লেখ আছে পবিত্র কোরআন মজিদে। সুরা দুহা; আয়াত-৮। ‘আল্লাহপাক তোমাকে দরিদ্র পেয়েছিলেন এবং তারপর তোমাকে ধনশালী বানিয়ে দিলেন।’

তখনকার যুগে আরব দেশে একটা প্রথা প্রচলিত ছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানদের দুধপান করানোর জন্য মরু অঞ্চলের কোনো ভালো পরিবারে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো। যেন তারা মুক্ত আবহাওয়া ও ভালো পরিবেশে লালিত-পালিত হতে পারে। পাশাপাশি শুদ্ধ আরবি ভাষা শিখতে পারে। এই উদ্দেশ্যে ওইসব মরু অঞ্চল থেকে মহিলারা মক্কায় আসতো। ধনী ব্যক্তিদের কিংবা গোত্রপ্রধানদের সন্তান নিয়ে যেতো এবং ন্যায়সংগত পারিশ্রমিকও পেত। সন্তান ফেরত দেওয়ার পরও প্রতিপালনকারীরা ধনী পরিবারগুলোর কাছে সদাচরণ আশা করতো।

নবিজির জন্মের পরে ওরকম কিছু মহিলা মক্কায় এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন হাওয়াজেফ গোত্রের শাখা সায়াদ বিন বকর গোত্রের। এই দলে হালিমা ও তাঁর স্বামী ছিলেন। কোলের শিশুটিও ছিল। তাঁরা চড়েছিলেন একটা মাদি গাধার পিঠে। গাধাটি একেবারেই কঙ্কালসার। সে প্রায় চলতেই পারে না। পড়ে থাকে দলের অন্য গাধাদের অনেকটা পেছনে। হালিমার সঙ্গে একটা মাদি উটও ছিল। সেই উটটিও দুর্বল আর তার ওলানে একফোঁটা দুধও ছিল না। ক্ষুধার্ত শিশুটিকে বুকের দুধ পান করাতে পারছিলেন না হালিমা। কারণ তাঁর বুকেও একফোঁটা দুধ নেই। ক্ষুধায় সারারাত শিশুটি কান্নাকাটি করলো। শিশুর কান্নায় হালিমা ও তাঁর স্বামী সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। অন্যদিকে তাঁরাও ক্ষুধার্ত ছিলেন। পরদিন সকালবেলাও সঙ্গের উটটি একফোঁটাও দুধ দিলো না। বৃষ্টি হচ্ছিল না অনেক দিন। বৃষ্টি হলে হয়তো এই পরিস্থিতি বদলাবে। হালিমা ও তাঁর স্বামী বৃষ্টির আশায় ছিলেন। গাধাটা দুর্বলতার জন্য অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল না। তাতে সঙ্গীরা খুবই বিরক্ত হচ্ছিল।

দলটি মক্কায় পৌঁছাল। সেখানে পৌঁছে পালার মতো শিশুর খোঁজ করতে লাগল। তাদের সবাইকে আল্লাহর রাসূলকে (সা.) প্রতিপালন করার উদ্দেশ্যে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো কিন্তু কেউ রাজি হলো না।

কী কারণ?

কারণ হচ্ছে শিশুটি পিতৃহীন। তাঁর বাবা নেই। যারা শিশু প্রতিপালন করে তারা সবাই শিশুর পিতার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আশা করে। আল্লাহর রাসূল (সা.) তো পিতৃহীন! এই শিশুর অভিভাবক মা ও দাদা। সবাই ভাবছিল, মা ও দাদার ওপর ভরসা করে এই শিশুকে নিয়ে কী লাভ হবে?

হালিমার সঙ্গে অন্য যারা এসেছিল তারা প্রত্যেকেই পালন করবার মতো শিশু পেয়ে গেল। শুধু হালিমার ভাগ্যেই কোনো শিশু জুটল না। ফেরার সময় হয়ে এলো। হালিমা তাঁর স্বামীকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম। খালি হাতে ফেরাটা আমার মোটেও ভালো লাগছে না। আমি ওই এতিম শিশুটিকেই নেব।’ হালিমার স্বামী বললেন, ‘তোমার যা খুশি তাই করো। এই শিশুটির জন্যই হয়তো আল্লাহ আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন।’

আল্লাহর রাসূলকে (সা.) বুকে নিলেন হালিমা। যেখানে তাঁর উট গাধা আর মালসামান ছিল সেখানে এলেন। নিজের শিশুটিকে বুকের দুধ দিতে পারেননি। কারণ তাঁর বুকে একফোঁটাও দুধ ছিল না। কিন্তু নবিজিকে বুকে নিয়ে তিনি যখন তাঁর বুকের দুধ খাওয়াতে গেলেন, তখন দেখেন তাঁর বুকে দুধ উথলে উঠেছে। শিশু রাসূল (সা.) ও তাঁর দুধভাই পেটভরে মায়ের দুধ পান করলেন। শিশু দুটি আরামে ঘুমাতে লাগল। অন্যদিকে হালিমার স্বামী তাঁদের দুর্বল মাদি উটটির কাছে গেলেন। গিয়ে অবাক হলেন। উটের ওলান দুধে ভরে গেছে। তিনি দুধ দোহালেন। তারপর স্বামী-স্ত্রী ভরপেট সেই দুধ পান করলেন। রাতভর আরামে ঘুমালেন।

ফেরার পথে ঘটল আরেক আশ্চর্য কাণ্ড। হালিমাদের হাড়জিরজিরে গাধাটা সবার আগে আগে ছুটতে লাগল। দলের লোকজন অবাক। তারা বলল, ‘যে গাধাটায় চড়ে তোমরা এসেছ, এটা কি সেই গাধাটাই?’ হালিমা বললেন, ‘অবশ্যই এটা সেই গাধা।’ দলের লোকজন বললেন, ‘তা হলে আল্লাহর কসম নিশ্চয়ই অলৌকিক কিছু ঘটেছে।’

আল্লাহর রাসূল (সা.) হালিমার পরিবারে থাকাকালীন তাঁদের ভেড়াগুলো প্রচুর দুধ দিত; কিন্তু অন্যদের ভেড়া তেমন দুধ দিত না। হালিমার ঘরে তখন প্রাচুর্য। আল্লাহর রাসূল (সা.) হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। যখন তাঁর বয়স দু-বছর, তখন তাঁকে মা আমিনার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। তবে মা তাঁর ছেলেকে নিজের কাছে রাখলেন না। কারণ মক্কায় তখন মহামারি চলছিল। হালিমা ও তাঁর স্বামী আল্লাহর রাসূলকে (সা.) আবার তাঁদের বাড়িতে নিয়ে এলেন।

কিছুদিন পর ঘটল আরেক অলৌকিক ঘটনা।

নবিজি তাঁর দুধভাইয়ের সঙ্গে বাড়ির অদূরে খেলা করছিলেন। একসময় দুধভাইটি ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে হালিমাকে বলল, ‘আম্মা, দুজন সাদা পোশাক পরা লোক কোত্থেকে যেন এলো। এসে তাঁরা মুহাম্মদকে (সা.) মাটিতে শুইয়ে দিলো। তারপর তাঁর পেট চিড়ে ফেলল। আমি একটু দূরে ছিলাম। গিয়ে দেখি সেই লোক দুজন নেই। আর আমার কুরায়েশি ভাইটি বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘দুজন সাদা পোশাক পরা লোক এসে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিলো আর পেট কেটে কী যেন খুঁজল।’ শুনে হালিমা ভয় পেয়ে গেলেন। আল্লাহর রাসূলকে (সা.) নিজেদের কাছে রাখা নিরাপদ মনে করলেন না। নবিজিকে তিনি তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন।’

একদিন সাহাবিরা রাসূলে (সা.) পাককে তাঁর নিজের সম্পর্কে বলতে বললেন। তিনি বললেন, ‘আমি সে-ই যার জন্য আমার পিতা ইবরাহিম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন আর আমার ভাই ঈসা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। আমার মা যখন আমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন তখন তিনি একটি আলো দেখতে পেয়েছিলেন, যে আলোতে তিনি সিরিয়ার দুর্গগুলোকে দেখতে পেয়েছিলেন। আমি বনি সা’দ বিন বকরের মাঝে লালিত-পালিত হয়েছি। একদিন যখন আমি আমার দুধভাইয়ের সঙ্গে তাঁবুর পেছনে ভেড়া চড়াচ্ছিলাম তখন সাদা পোশাক পরা দুজন লোক আমার কাছে এলো। তাদের হাতে ছিল একটা সোনার পাত্র ভরা বরফ। তারা আমার পেট চিড়ে আমার হৃদপিণ্ড বের করে কেটে ফাঁক করলো। তারপর হৃদপিণ্ডের ভেতর থেকে কালো একটা টুকরা বের করে ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর তারা আমার হৃদপিণ্ড এবং পেট বরফের পানি দিয়ে ধুতে লাগল যতক্ষণ না তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হলো। তাদের একজন অপরজনকে বলল, ওঁকে ওদের গোত্রের দশজনের সঙ্গে ওজন করো। সে তাই করলো; কিন্তু আমার ওজন দশজনের চাইতে বেশি হলো। তারপর ক্রমান্বয়ে একশ ও হাজার জনের সঙ্গে ওজন করলো; কিন্তু তাতেও আমার ওজনই বেশি হলো।

প্রথমজন বলল, আর দরকার নেই। আল্লাহর কসম। ওকে সারা দেশের লোকের সঙ্গে ওজন করলেও ওর ওজনই বেশি হবে।’

আল্লাহর রাসূল (সা.) বলতেন, ‘এমন কোনো নবি জন্মায়নি যে মেষ পালন করেনি।’ সাহাবিরা বললেন, ‘হুজুর আপনি?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ আমিও।’

সিগারেট শেষ হয়ে এসেছে। সেই সিগারেটে শেষ টান দিয়ে পায়ের কাছে ফেললেন খাঁ সাহেব। বিড়ালটি তাকিয়ে দেখলো তার অদূরে পড়েছে সিগারেট। খাঁ সাহেব অতিযত্নে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা পায়ে তা চেপে চেপে নেভালেন। তারপর শিষ্যদের দিকে তাকালেন। আগের ভঙ্গিতে কথা বলতে শুরু করলেন।

‘আবু তালিব একবার বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে সিরিয়ায় যাওয়ার কথা ভাবলেন। তিনি নবিজির চাচা। নবিজিকে খুবই ভালোবাসেন। যাত্রার সব প্রস্তুতি যখন হলো তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) বায়না ধরলেন তিনি চাচার সঙ্গে বাণিজ্যে যাবেন। তাঁর কান্নাকাটি দেখে চাচা আবু তালিব বললেন, ‘আচ্ছা চলো। তবে একটা শর্ত আছে। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।’ তিনি রাজি হলেন।

কাফেলা যখন সিরিয়ায় পৌঁছলো তখন ‘বাহিরা’ নামে এক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীর আশ্রমের কাছে তারা তাঁবু গাড়লেন। এ আশ্রমটিতে যুগ যুগ ধরে একজন সন্ন্যাসী বসবাস করেছেন। বাহিরা আশ্রমে রাখা পুরনো বই পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কুরায়েশরা বছরের পর বছর বাণিজ্য করতে এসেছে। বাহিরা তাদের সঙ্গে কখনো কথা বলেননি। এবার তারা যখন তাঁর আশ্রমের কাছে এলো, তিনি তাদের জন্য একটা বিরাট ভোজের আয়োজন করলেন।

কারণ কী?

কারণ হলো, তিনি এবার তাঁর ঘরে অলৌকিক কিছু দেখতে পেয়েছিলেন। লোকে বলে যে, আশ্রমে বসে তিনি আরব কাফেলায় আল্লাহর রাসূলকে (সা.) দেখতে পেয়েছিলেন। ওরা কাছে এলে তিনি দেখলেন, একখণ্ড মেঘ বালক নবিজির মাথার ওপর ছায়া দিয়ে রেখেছে। কাফেলা তাঁর আশ্রমের কাছে একটি গাছের নিচে এসে থামল। বাহিরা দেখলেন, মেঘ পুরো গাছটাকে ঘিরে ফেলেছে। ডালগুলো নুয়ে পড়েছে এমনভাবে যাতে আল্লাহর রাসূলের (সা.) গায়ে রোদ না লাগে।

এ-দৃশ্য দেখে বাহিরা আশ্রমের বাইরে এসে বললেন, ‘হে কুরায়েশগণ, আমি তোমাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেছি। তোমরা সবাই আজ আমার এখানে খাবে।’ কুরায়েশগণ সবাই অবাক হলো কিন্তু সবাই এলো। যারা এলো তারা আল্লাহর রাসূলকে (সা.) মালসামানা পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে এলো। কিন্তু বাহিরা তখন আর সেই চিহ্ন দেখতে পেলেন না। তিনি বললেন, ‘তোমাদের সবাই এসেছো তো?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, যাদের আসা উচিত তারা সবাই এসেছে। কেবল একজন বালক ছাড়া। তাকে আমরা মালমাত্তা পাহারা দিতে রেখে এসেছি।’

বাহিরা বালকটিকে নিয়ে আসতে বললেন। বালকটি এলে বাহিরা তাঁকে আলিঙ্গন করে সসম্মানে বসালেন। তিনি তাঁকে খুব গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলেন। দেখলেন খ্রিষ্টান ধর্মের বইয়ে বর্ণিত বর্ণনার সঙ্গে মিল খুঁজে পান কি না। লোকজনের খাওয়া শেষে তারা চলে গেলেন। বালকটি বাহিরার সঙ্গে থাকলেন। বাহিরা তাঁকে বললেন, ‘আল-মানাত ও আল-ওজজার কসম তুমি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবে।’

আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, ‘আমাকে মানাত-ওজজার কসম দেবেন না। কারণ আমি ওদের ঘৃণা করি।’ বাহিরা বললেন, ‘তাহলে আল্লাহর কসম, তুমি আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দেবে।’ তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন, ‘এবার বলুন আপনি কী জানতে চান?’ বাহিরা তাঁকে তাঁর অভ্যাস, ঘুম ও 888sport app বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। দেখলেন যে তাঁদের ধর্মগ্রন্থে যে নবির আগমনের কথা বলা হয়েছে তার সব চিহ্নই বালকটির মধ্যে রয়েছে। তাছাড়া তিনি তাঁর পিঠে, দুই কাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের চিহ্নও দেখতে পেলেন।

প্রশ্ন শেষ হলে বাহিরা আবু তালিবের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ছেলেটি তাঁর কে হয়?’ আবু তালিব বললেন, ‘সে আমার ছেলে।’ বাহিরা বললেন, ‘না, এ হতে পারে না। কারণ এই ছেলের পিতা বর্ণনামতো জীবিত থাকার কথা নয়।’ তখন আবু তালিব বললেন, ‘সে আমার ভাইপো। ওর বাবা ওর জন্মের আগেই মারা গেছেন।’ বাহিরা বললেন, ‘এবার আপনি সত্য বলেছেন। ওঁকে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যান। সাবধান কোনো ইহুদি যেন ওঁর সম্পর্কে জানতে না পারে। আমি ওঁর সম্পর্কে যা জানি তা যদি ইহুদিরা জানতে পারে তবে ওরা তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আপনার ভাইপোর ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। সুতরাং তাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যান।’

খাঁ সাহেব থামলেন।

ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। বাইরে ফুরিয়ে আসছে দিনের আলো। গাছ-গাছালিতে ডাকতে শুরু করেছে দিনশেষের পাখিরা। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এলো। খানিক পরই মসজিদ থেকে ভেসে আসবে আজানের মধুর ধ্বনি।

খাঁ সাহেবের শিষ্যরা উঠলো।

খাঁ সাহেব ওজু করেন একটা জলচৌকিতে বসে। আবু গিয়ে সেই জলচৌকি আর বদনা ভরে পানি নিয়ে এলো। খাঁ সাহেব ওজু করে নামাজ আদায় করলেন। তারপর স্বভাব অনুযায়ী সন্ধ্যারাতেই তাঁর রাতের খাবার খেলেন। পালানে তিনটা নাড়ার পালা অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বিক্রমপুর

অঞ্চলে খড়কে বলে ‘নাড়া’ আর গাদাকে বলে ‘পালা’। আর যেখানে নাড়ার পালা দেওয়া হয় সেই জায়গাটাকে বলে ‘পালান’।

রাতের খাওয়া শেষ করে প্রতি রাতেই পালানের দিকটায় অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন খাঁ সাহেব। সিগারেট টানেন। আজো তাই করছিলেন। বারবার দেবু ঠাকুরের কথা মনে হচ্ছে। আর ঠাকুরের কথা ভেবে অদ্ভুত এক উত্তেজনা হচ্ছে তাঁর। জানতে ইচ্ছে করছে, দেবকুমার ঠাকুরের রহস্যটা কী?

সেই রাতেই অদ্ভুত এক কাণ্ড করবেন দরবেশ গোলাম মোস্তফা খাঁ। [চলবে]