সাত
বাসন্তীর কাহিনি
ঠাকুরের সঙ্গে ওই কাণ্ডটি ঘটাবার পর বাসন্তী খুবই মর্মবেদনায় ভুগছিল। তার মনে হচ্ছিল, কাণ্ডটা আসলে সে ঘটায়নি। তেঁতুলতলা বা বাঁশঝাড়তলায় তিনাদের যিনি বসবাস করেন, তাদের সত্যি সত্যিই কেউ না কেউ বাসন্তীর ওপর ভর করেছিল। বাসন্তীকে দিয়ে কাজটা সে করিয়েছে। ঠাকুরকে বাসন্তী কামনা করেছে ঠিকই কিন্তু এই পদ্ধতিতে সেই কামনার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, বাসন্তী নিজেও তা ভাবতে পারেনি। যে-কাজ করার কথা পুরুষ মানুষের, সেই কাজটা ঠাকুরের সঙ্গে করেছে বাসন্তী। সে এখন নিশ্চিত যে তার ওপর কিছু একটা ভর করেছিল। স্বাভাবিকভাবে কোনো কুমারী মেয়ের পক্ষে
এ-কাজ করা সম্ভব না।
মর্মবেদনায় দিনে দিনে ম্লান হয়ে গেল বাসন্তী। আগের সেই উচ্ছ্বাস-উচ্ছলতা কিছুই রইল না তার। পাড়ার ছেলেপানদের সঙ্গে হইহল্লা মাতাব্বরি, একে ধরা ওকে মারা কোনো কিছুতেই তার আর মন টানে না। ঘরের দাওয়ায় বসে সে ঝিমায়, কখনো বকুলগাছটির তলায় গিয়ে বসে থাকে। কমলা ডাকাডাকি করে তাকে খালে চান করতে পাঠায়, জোর করে খাওয়ায়। নবীন রিশি আর কমলার ধারণা, ভূতের আছর ছাড়াবার পর মেয়েটি নিস্তেজ হয়ে গেছে। ঠাকুর বলে গেছেন যত দ্রুত সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিতে। তারা সেই কাজে উঠেপড়ে লাগল। বড় দুই মেয়ে নয়নতারা আর কৃষ্ণা স্বামী-সন্তান নিয়ে বোনকে এসে দেখে গেল। তারাও বাসন্তীর বিয়ের ব্যাপারে স্বগোষ্ঠীর ছেলে খুঁজে ফিরতে লাগল।
বাসন্তীর মতো মেয়ের জন্য ছেলে পাওয়া বড়ই কঠিন। মেয়েটির সৌন্দর্য যেটুকুই বা ছিল, ওই কাণ্ডের পর সেটুকুও আর নেই। শরীর কিছুটা ভেঙেছে বাসন্তীর। চেহারা ফ্যাকাসে আর বিষণ্ন হয়েছে। গেছো মেয়েটি একেবারেই নির্জীব হয়ে গেছে। বাসন্তীর অবস্থা ছুলুম (খোলস) বদলানো সাপের মতো। তবে সেদিনের পর থেকে ধীরে ধীরে একটা ব্যাপার ঘটেছে, বাসন্তীর মুখের গোটাগাটি একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে। কালো মুখটা পরিষ্কার হয়েছে। বকুলতলায় বসে ডাগর চোখ দুখানা তুলে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দশ কথার জবাব দেয় হয়তো একটা।
মেয়ের ওই অবস্থা দেখে কমলা তার স্বভাবমতো গুনগুনিয়ে কাঁদে আর নবীনকে তাড়া দেয় মেয়েটিকে একবার ঠাকুরের কাছে নিয়ে যেতে। অথবা যেমন করে হোক ঠাকুরকে একবার রিশিপাড়ায় আনা যায় কি না সেই ব্যবস্থা করতে।
নবীন সাব্যস্ত করল ঠাকুরকর্তাকে তো আর বাড়িতে আনা যাবে না, তার ভিজিটের টাকা লাগে দুখানা। সেই টাকা নবীন রিশি দেবে কোত্থেকে? তার চেয়ে বাসন্তীকে একবার ঠাকুরবাড়িতে নিয়ে গেলে হয়। তাকে দেখিয়ে আনলে হয়। ওষুধবিসুধ দিলে নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে মেয়ে।
বাসন্তীকে বলা হলো সেই কথা। বাসন্তী বেঁকে বসল। সে কিছুতেই ঠাকুরের কাছে যাবে না। ঠাকুর যদি এ-বাড়িতে আসেও, তাও সে ঠাকুরের সামনে যাবে না। কমলা আর নবীন তাকে খুব বোঝালো। পাড়ার গুরুজনরা বোঝালো। বাসন্তীর শেষ কথা, সে ঠাকুরের সামনে যাবে না। যদি জোরজার করা হয় তাহলে সে পদ্মায় ডুবে মরবে।
এই রহস্য কমলা বা নবীন বা রিশিপাড়ার লোকজন কেউ বুঝতেই পারল না। বাসন্তীকে ভূতে ধরার পর ঠাকুর এসে তার বাঁধ খুলে দিলে সুবোধ মেয়েটির মতো সে ঠাকুরের সঙ্গে ঘরে গিয়ে ঢুকল। দুয়ার বন্ধ করে ঠাকুর তার ভূত ছাড়াল। দিব্যি হাসিভরা মুখ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটি। তারপর তার এই অবস্থা হবে কেন? দিনে দিনে এমন হয়ে গেল কেন মেয়েটি?
কমলার কথায় নবীন নিজেই একদিন গেল ঠাকুরের কাছে। ঘটনা তাকে বুঝিয়ে বলল। সব শুনে ঠাকুর খুব গম্ভীর। বললেন, ‘ওষুধবিসুধে তর মাইয়ার কোনো কাজ হইবো না নবীন। যত তাড়াতাড়ি পারছ ওর বিয়া দে। এইটাই ওর চিকিৎসা।’
নিমাই নামে রিশিপাড়ায় একটা ছেলে আছে। নিমাই রিশি। পৈতৃক পেশাটাই সে ধরেছে। গ্রামের মড়কখোলায় ফেলে রাখা মড়া গরু-ছাগলের ছাল ছাড়িয়ে আনে ঠিকই। রোদে শুকিয়ে বিক্রিবাট্টাও করে। অন্য সময় মাওয়ার বাজারে বসে
জুতা-স্যান্ডেল সিলাবার কাজও করে। বর্ষাকালে রিশিপাড়ার অনেকের মতো পেশাটা সে বদলেও ফেলে। মহাজনদের ইলিশ মাছ ধরবার নৌকায় চড়ে মজুর হিসেবে চলে যায় পদ্মার গভীরে। পাড়ার পুবদিকে পৈতৃকসূত্রে কয়েক গণ্ডা জমিও সে পেয়েছে। সেই ক্ষেতটায় ধান হয় না। বেলে মাটির জমি। তরমুজ-বাঙ্গি হয়, ক্ষিরাই হয়। সংসারে একা মানুষ নিমাই। মা মরেছিল নিমাইকে জন্ম দিতে গিয়ে। বাপ মরেছিল যক্ষ্মায়। দোচালা টিনের একটা পুরনো ঘর আছে নিমাইয়ের। একটাই কাকা। সেই কাকার স্ত্রী মায়া নিজের বুকের দুধ দিয়ে কোলেপিঠে করে নিমাইকে বড় করেছে। নিজে কামকাজ শেখার পর, রুজিরোজগার করার বয়সে এসে নিমাই একা একাই তার জীবন চালায়। নিজের রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন সব নিজেই করে। কাকার অবস্থা ভালো। মেয়ে নেই। তিনটা তাগড়া জোয়ান ছেলে আছে। তাদের বউঝিরা আছে। কাকা গত হলেন বছর দেড়েক আগে। তার ছয় মাসের মাথায় গেলেন কাকি। ভাই আর ভাইয়ের বউয়েরা, এমনকি তাদের বাচ্চাকাচ্চারাও নিমাইয়ের দিকে ফিরে তাকায় না। কাকি বেঁচে থাকতে কিছুটা খোঁজখবর নিত। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখত নিমাই খেয়েপরে বেঁচে আছে কি না। এখন আর নিমাইয়ের দিকে কেউ ফিরে দেখে না। এত বড় রিশিপাড়াটায় সে একা। বিয়ের বয়স হয়েছে। টাকা-পয়সাও কিছু হাতে জমেছে নিমাইয়ের। কিন্তু নিমাইকে মেয়ে দেবে কে? সে ঢ্যাঙ্গা লম্বা একজন মানুষ। চেহারার ছিরিছাদ নেই। ক্ষেতখোলায় হাত-পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে মনে হবে কাকতাড়ুয়া।
এক সন্ধ্যারাতে কমলা ধরল নবীনকে। নবীন তখন ঘরের দাওয়ায় বসে নারিকেলের হুঁকায় গুড়গুড় করে তামাক টানছে। কমলা পাশে এসে বসে বলল, ‘তোমারে একখান কথা কইতে চাই।’
হুঁকা টানার ফাঁকে নবীন বলল, ‘কও।’
‘ঠাকুর কইছে যত তাড়াতাড়ি পারো মাইয়ার বিয়া দিয়া দাও। বিয়ার তো কিছু আমরা করতে পারতাছি না।’
নবীন বলল, ‘কেমতে করুম? পোলাই তো পাই না।’
‘পোলা একখান আছে।’
নবীন এক হাতে হুঁকা ধরে কমলার দিকে তাকাল। ‘কও কী? কই আছে পোলা?’
‘রিশিপাড়াতেই আছে।’
‘কেডা কও তো?’
‘ওই যে নিমাই।’
নিমাইয়ের নামটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নবীন। হুঁকায় টান দিতে ভুলে গেল। ‘ওই রকম ভূতের লাহান দেখতে ছেমড়াডা হইবো আমার মাইয়ার জামাই? মাইনষে কইবো কী?’
কমলা একেবারে জ্বলে উঠল। ‘মাইনষের কথায় আমাগো কী যাইবো-আইবো। আমার মাইয়ার বিয়া দেওনের দরকার বিয়া দিয়া দিমু। বিয়া না দিলে এই মাইয়া ভালো অইবো না, ঠাকুর কইয়া দিছে। আর তোমার মাইয়া কী সুন্দরী? নিমাইরে যদি তুমি ভূত কও তাইলে তোমার মাইয়া তো পেত্নি! আমার কথা হোনো, নিমাইয়ের সংসারে তোমার মাইয়া সুখে থাকবো। হৌর-হরি নাই, দেওর-ননদ নাই, নিজের মতো সংসার করবো। কথা কওনের কেউ থাকবো না। নিমাইয়ের লগে মাইয়া বিয়া দেও। আমি মা। আমি আমার মাইয়ারে চিনি। বিয়া না দিলে ও ভালো অইবো না।’
নবীন মিনমিনে গলায় বলল, ‘নিমাই রাজি অইবো?’
‘আমার মনে অয় অইবো। পবন দাদারে কও কথা কইতে। হেয় গুরুজন। নিমাই তার কথা হালাইবো না।’
‘তোমার মাইয়ায় রাজি অইবো।’
‘আমার মনে অয় অইবো।’
পরদিনই পবনকে ধরল নবীন। পবন ধরল নিমাইকে। নিমাই এক কথায় রাজি। বাসন্তীও কোনো রা-শব্দ করল না। দিনক্ষণ দেখে কয়েক দিনের মধ্যেই নিমাইয়ের সঙ্গে বাসন্তীর বিয়ে হয়ে গেল।
বিয়ের রাতে নিমাইকে অদ্ভুত কিছু কথা বলল বাসন্তী। প্রথম রাতে এরকম কথা বলতে পারে বউ, এটা নিমাই কল্পনাও করেনি। সে স্ত্রী সহবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বউকে মাত্র জড়িয়ে ধরতে যাবে, ছিটকে সরে গেল বাসন্তী। নিমাই তো একই পাড়ার। ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখে আসছে বাসন্তী। বয়সে বাসন্তীর চেয়ে বছর চার-পাঁচেকের বড় হবে। দেখতে মোটেই ভালো না বলে রিশিপাড়ার বউঝিরা কেউ নিমাইয়ের দিকে তাকিয়েও দেখেনি। বাসন্তীও কোনোদিন দেখেনি। মানুষের মতো দেখতে একজন পাড়াতে আছে এইটুকুই যা। খেয়াল করে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। আর বাসন্তীর খায়েশ ছিল ঠাকুর। রাজপুরুষের মতো মানুষটি। বাসন্তী তার খায়েশ পূরণ করেছে ঠিকই, তবে তারপর সে বলতে গেলে মরে গেছে। যে রকম হঠাৎ সিদ্ধান্তে ঠাকুরের সঙ্গে ওই কাণ্ডটা করেছিল, তেমন হঠাৎ সিদ্ধান্তে নিমাইকে বিয়েও করে ফেলল। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর, নিমাইয়ের ঘরে আসার পর রাতের বেলা এখন তার মনে হচ্ছে, এই কাজটাও তার ভুল হয়েছে। বিয়েটা সে না করলেও পারত। এখন নিমাইকে তার সব বলতে হবে।
নিমাই তখন হতভম্ব হয়ে আছে। বাসন্তী বলল, ‘তোমার লগে আমার বিবাহ হইছে ঠিকই, তয় বউর কাছে পুরুষপোলারা যা চায় হেইডা তুমি আমার কাছে পাইবা না। আমি তোমারে রাইন্ধা-বাইড়া খাওয়ামু ঠিকই, তোমার কাপড়চোপড় ধুইয়া দিমু, গরমের দিনে খাইতে বহাইয়া তালের পাঙ্খা দিয়া বাতাস করুম। পাড়ার মাইনষে দেখব বেবাক কিছুই আমি তোমার লাইগা করতেছি। ওই একখান জিনিসই আমি তোমারে দিতে পারুম না।’
নিমাই নরম চরিত্রের আবেগী মানুষ। বউয়ের কথা শুনে সে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এই হগল তুমি কী কইতেছ বাসন্তী! আমরা সহবাস করুম না? আমাগো পোলাপান হইব না? তোমার লগে বিয়ার কথা হওনের পর থেইকা আমি খালি একটা পোলার স্বপ্ন দেখি। ঠিক তোমার লাহান দেখতে একটা পোলা। আমি তারে কোলে কইরা রাখুম, কান্দে কইরা রাখুম। যেহানে যামু পোলাডারে লইয়া যামু। তুমি আমার স্বপ্নটা নষ্ট কইরো না।’
ঘরে একটা কুপি জ্বলছিল। সেই আলোয় নববধূর সাজে চৌকিতে বসে আছে বাসন্তী। পাশে বসে আছে নিমাই। বাসন্তী অপলক চোখে নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে ধীর শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি ভালো মানুষ। তোমারে আমি ঠকাইতে পারুম না। তোমার লগে মিছা কথাও কইতে পারুম না। হাছা কথা তোমারে আমি কইতাছি। আমি কুমারী নাই। আমি নষ্ট হইয়া গেছি। না না, কেউই আমারে নষ্ট করে নাই। নিজেরে আমি নিজে নষ্ট করেছি।’
তারপর ভূতে ধরার ভান করা থেকে শুরু করে ঠাকুরকে সে কীভাবে কাবু করেছে সবই নিমাইকে খুলে বলল। শুনে নিমাই খানিক হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার কাঁদতে লাগল। ‘এইডা তুমি কী করছ বাসন্তী? কেন নিজেরে এমনে নষ্ট করলা?’
বাসন্তী নির্বিকার গলায় বলল, ‘জানি না। ভূতে ধরার ভান করছিলাম ঠিকই। তয় আমারে মনে হয় সত্যই ভূতে ধরছিল। মাথাডা খারাপ হইয়া গেছিল। ছোটকাল থিকাই ঠাকুররে দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়। ঠাকুররে লইয়া চিন্তা করতে করতে রাইতের পর রাইত আমি ঘুমাইতে পারি নাই। আমার মুখ গোটাগাটিতে ভইরা গেছে ঠাকুরের চিন্তায়। হেইদিন মাথা আরো খারাপ হইছিল। নাইলে দিনে-দোফরে এমন কাম কোনো মাইয়ায় করে নি! ঠাকুরও মনে হয় আমারে জাদু করছিল। তার চোখের দিকে চাইয়া আমি বইদলা গেলাম। ভালো মাইনষের লাহান ঘরে ঢুইকা ঐ চৌকিতে হালাইয়া ঠাকুরের ওপর চইরা বইলাম। ঠাকুরের কোনো দোষ নাই। দোষ আমার। তয় মানুষটা এমন। তার লগে একবার থাকলে, হেই মাইয়া অন্য কেউর লগে থাইকা সুখ পাইব না। ঠাকুরের কাছ থাইকা যেই সুখ আমি জোর কইরা আদায় করছি, আমি ওই সুখ লইয়াই থাকতে চাই। তুমি আমার কথা মাইনা নিলে নিবা নাইলে আমি রাইতের আন্দারে পদ্মায় গিয়া ডুইব্বা মরুম।’
নিমাই আর একটি কথাও বলল না। প্রায় সারারাত ধরে নিঃশব্দে কাঁদল।
দিন দশেক পর একদিন দুপুরের দিকে বমি করতে শুরু করল বাসন্তী। বমির পর বমি। বমির পর বমি। নিমাই বাড়িতেই ছিল। সে বুঝে উঠতে পারল না ঘটনা কী? রিশিপাড়ার বউঝি আর বয়স্ক 888sport promo codeরা নানা পদের আলাপ-আলোচনা করতে লাগল। বাসন্তীর বমি করার নমুনা দেখে অভিজ্ঞ 888sport promo codeরা বুঝে গেল গর্ভধারণ করেছে বাসন্তী। বিয়ে হয়েছে মাত্র দশদিন আগে। এই কদিনেই এই অবস্থা হওয়ার কথা না! তাহলে ঘটনাটা কী?
নানা প্রকারের মুখরোচক আলাপ-আলোচনা চলতে লাগল। নবীন আর কমলা হতভম্ব। পাটাভোগ গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে বসে খবর পেল নয়নতারা। বারইখালিতে বসে কৃষ্ণাও খবরটা পেয়ে গেল। যত নিচু জাতের মানুষই হোক মানসম্মান সবারই আছে। কমলা এসে মেয়েকে ধরল। যত রকম কায়দায় সম্ভব কথা বলে আসল ঘটনা জানতে চাইল। বাসন্তী শুধু একটাই কথা বলল, ‘আমি জানি না কিছুই। এইটা ভূতের কারবার।’
কমলা তার স্বভাবমতো কাঁদতে লাগল। কাঁদে আর কপাল চাপড়ায়। কমলার মুখে ভূতের কথা শুনে নবীনের তা বিশ্বাস হয় না। কমলার তো হয়ইনি। দুজন মানুষ মরমে মরে গেল। পাড়ার কারো দিকে আর মুখ তুলে তাকাতে পারে না।
তবে বাসন্তী যেমন ছিল তেমনই আছে। নির্বিকারভাবে সংসারের কাজ করে। রান্নাবান্না করে নিমাইকে খাওয়ায়। থালাবাসন আর কাপড়চোপড় ধুতে খালঘাটে যায়।
আড়ালে-আবডালে রিশিপাড়ার 888sport promo code-পুরুষ, এমনকি অল্প বয়সে পেকে ওঠা ছেলেমেয়েরাও বাসন্তীকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কুৎসিত কথাবার্তা বলে। বাসন্তী শোনে সবই, একটি কথারও জবাব দেয় না। যেন সে মানুষ নয়, যেন সে একখানা কলের পুতুল। কেউ একজন চাবি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে তাকে। সেই চাবির জোরে সে চলছে।
নিমাইয়েরও একই অবস্থা। সে কারো দিকে মুখ তুলে তাকায় না। কথাবার্তা নিজের থেকে কারো সঙ্গে বলে না। কেউ বললে হু-হা না বলে জবাব দেয়। ক্ষেতে কাজ করে। বাজারে কাজ করে। মরা গরু-ছাগলের ছাল ছাড়িয়ে আনে। সেও যেন এক কলের পুতুল।
ওদিকে বমিপর্ব শেষ হয়েছে বাসন্তীর। এখন প্রতিদিনই পেট একটু একটু করে বাড়ছে। রাতের বেলা এক কাণ্ড হয়। গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে নিমাইয়ের পাশে শুয়ে থাকা বাসন্তী টের পায় নিমাই তার উঁচু হওয়া পেটে গভীর মমতায় হাত বুলাচ্ছে। যেন সে পেটের ভিতরকার মানুষটিকে আদর করছে। নিমাইয়ের মুখ ঝুঁকে আছে বাসন্তীর পেট বরাবর। নিঃশব্দে কাঁদছে মানুষটি। তার চোখের জল ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে বাসন্তীর পেটের ওপর।
যথাসময়ে বাসন্তীর একটা ছেলে হলো। বাসন্তীর মতো কালো কুচকুচে গায়ের রং। মুখটি যেন বাসন্তীর মুখ কেটে বসানো। সেই শিশুটির দিকে বাসন্তী তাকিয়েও দেখল না। বুকের দুধও দিলো না। শিশুটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল নিমাই। এ যেন তারই ঔরসজাত। তার আপন সন্তান, আপন রক্ত। এত বেশি উদ্বেলিত যে, শিশুটিকে বাসন্তী দেখছে কি দেখছে না তা সে গায়েই লাগাল না। কাঁথা-কাপড়ে প্যাঁচানো শিশুটিকে দু-হাতে অতিযত্নে বুকের কাছে ধরছে, অতি নরম ভঙ্গিতে বিছানায় শুইয়ে দিচ্ছে। বাসন্তী দুধ দিচ্ছে না শুনে পাড়ার এক বিধবা বয়স্ক মহিলা ময়নামাসি গরুর দুধ এনে শিশুটিকে কোলে শুইয়ে ঝিনুক দিয়ে একটু একটু করে খাওয়াতে লাগল। এই শিশুর দিকে রিশিপাড়ার কেউ তাকিয়েও দেখল না। নবীন বা কমলা উঁকি দিতেও এলো না। একটি শিশু যে বিশাল শক্তি নিয়ে জন্মায়, পরিবার বা চারপাশের মানুষজনের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে তার কিছুই বাসন্তীর ছেলেটির ক্ষেত্রে ঘটল না। সবাই ‘জাউরা পোলা’ বলে শিশুটিকে আখ্যায়িত করল। সবই কানে গেল বাসন্তীর। সে শুনেও শুনল না কোনো কথা। নিমাইয়ের কানে তো যাচ্ছিলই। কেউ কেউ তো মুখের সামনে স্পষ্ট বলল, ‘জাউরা পোলা লইয়া এত আদেখলাপানা দেখাইতেছস কেন নিমাই? পোলা কোলে দিয়া বাসন্তীরে ঘর থেইকা বাইর কইরা দে।’
নিমাই জানে এসব কথার জবাব দিতে গেলে কাইজ্জা-কীত্তন লাগবে। খারাপ কথা না শোনাই ভালো। তার জবাব না দেওয়া আরো ভালো। চুপচাপ থাকা আরো ভালো।
নিমাই চুপচাপ শিশুটির পাশে বসে থাকে। তাকে আদর করে। ওইটুকু শিশু দিনরাত শুধু ঘুমায় আর ঘুমায়। সদ্য জন্মানো শিশুদের নিয়মই এমন। শুধু খিদে পেলে কাঁদে। তখন ওই বিধবা ময়নামাসি এসে ঝিনুকে করে দুধ খাওয়ায়।
ছেলে আবার ঘুমায়। তার পাশে পাথরের মতো বসে থাকে বাসন্তী। নিমাই ‘ও আমার সোনা সোনা’ বলে আহ্লাদ দেখায়। গোয়ালিমান্দ্রার হাট থেকে ছিট কাপড়ের জামা কিনে আনে। টিনের একটা ঝুনঝুনি কিনে আনে। এই ছেলের বাইরে কোনো দিকে তার খেয়াল নেই।
ছেলে জন্মানোর পাঁচদিনের মাথায় গভীর রাতে নিঃশব্দে ঘরের ঝাঁপ খুলল বাসন্তী। পাড়া ছাড়িয়ে পূজামণ্ডপের ওদিকটায় এলো। ফকফকে জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। দেড়-দুশো কদম দূরে রাস্তার ধারে একটা বিশাল জামগাছ। সেই গাছতলায় বাসন্তী পরিষ্কার দেখতে পেল ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছে। বাসন্তী দ্রুতপায়ে তাঁর কাছে এগিয়ে গেল। ঠাকুর একবার মাত্র তার দিকে তাকালেন। তাকিয়ে পা চালিয়ে দক্ষিণমুখী হাঁটতে লাগলেন। বাসন্তীও ছুটল তাঁর পিছন পিছন।
বারো-পনেরো কানি জমির পর পদ্মা। গত বছর এদিকটায় ভাঙন লেগেছিল। বিশ-পঁচিশ কানি জমি পদ্মার পেটে গেছে। গেল বর্ষায় আর ভাঙন লাগেনি। এবার বেলে মাটির জমিতে ভালোই তরমুজ-বাঙ্গি হয়েছে। ক্ষিরাই হয়েছে। গেরস্তরা দুটো পয়সার মুখ দেখেছে।
জমির ফাঁকে ফাঁকে চিরল আলপথ। ঠাকুর সেই পথে নদীর দিকে হাঁটছেন। লম্বা লম্বা ‘কাইক’ দিচ্ছেন। বাসন্তী রীতিমতো দৌড়াচ্ছে। ঠাকুরকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ধরতে পারলেই মনের কথা সে ঠাকুরকে খুলে বলবে, কিন্তু কিছুতেই
সে-মনোবাসনা পূর্ণ হচ্ছে না তার।
পদ্মার এদিককার পাড় উঁচু নয়। চটান মাটি। যেন তরমুজ, বাঙ্গি আর ক্ষিরাইয়ের ক্ষেতগুলো এসে পা ভিজিয়েছে পদ্মার জলে।
ঠাকুর জলের একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বাসন্তীর দিকে মুখ ফেরালেন। বাসন্তী ছুটে এসে দু-হাতে তাঁর পা জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি বড় পাপী, বিরাট খারাপ কাম করছি আপনার লগে। আপনি ক্ষেমা না করলে আমার জ্বলতে অইব নরকের আগুনে। সেদিনের পর থেইকা বাইচা থাইকাও নরকের আগুনে পুড়তাছি আমি। একটা পোলা জন্ম দিছি। আমি হুনছি পুরুষ পোলা জোর কইরা কোনো মাইয়ার ক্ষেতি করলে হেই মাইয়া যদি গর্ভবতী হইয়া যায়, পোলাপান হয় পুরুষটার চেহারায়। আমার পোলাডার চেহারা হইছে আমার লাহান। কারণ আপনে আমারে কিছু করেন নাই। করছিলাম আমি। পাপ আমার। আপনি ক্ষেমা না করলে আমার কোনো উপায় নাই। মইরাও শান্তি পামু না আমি। আমার কপালে নরকবাস।’
দু-হাতে বাসন্তীকে তুলে দাঁড় করালেন ঠাকুর। বাঁ-হাতে শক্ত করে ধরলেন বাসন্তীর ডান হাত। অচেনা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আয় আমার লগে, তর বেবাক পাপ ধুইয়া দেই।’
বাসন্তীর হাত ধরে তিনি নদীতে নামতে লাগলেন। জল গোড়ালি ছোঁয়, হাঁটু ছোঁয়, কোমর ছোঁয়, বুক-গলা ছোঁয়। বাসন্তীর হাত ছেড়ে দিয়ে ঠাকুর বললেন, ‘যা তরে আমি ক্ষমা করলাম। তোর সব পাপ মোচন হইয়া গেল। নরকবাস তোর হইব না …’
চাঁদ তখন পদ্মার একেবারে বুকের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে। গরুর দুধের মতো জোছনায় আর অচিনলোক থেকে আসা হাওয়ায় পদ্মাজলে নিবিড় ঝিলিমিলি। কোথাও কোনো শব্দ নেই। এই নৈঃশব্দ্যের ভিতর ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে, বাসন্তী ডুবে গেল পদ্মার গভীর জলে।
পরদিন সকালবেলা চা পান করতে করতে বদরুকে ঠাকুর বললেন, ‘রিশিপাড়ার খবর লইছ তো বদরু। বাসন্তীর লাশ ভাইসা উঠল কি না?’
বদরু যেন জামগাছের ডগা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েছে। এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘বাসন্তী গাঙে ডুইবা মরছেনি?’
‘হ। তয় সেই কথা আমি ছাড়া অহনতরি কেউ জানে না। আমি জানি আর অহন জানলি তুই।’
‘আপনি জানলেন কেমতে?’
‘তুই যেই গরু আছিলি অহনও হেই গরুই আছস। বেবাক কিছু জাইনাও নতুন কইরা জানতে চাস। আমার ক্ষমতা তুই জানস না। বাসন্তী আমার লগে কি করছিল হুনবি সেই ঘটনা?’
ঠাকুর তারপর বিস্তারিত বলেছিল বদরুকে। ভূতে ধরার অছিলায় কী করেছিল বাসন্তী সেই পাপের শাস্তি গত রাতে ঠাকুর তাকে দিয়েছেন। বাসন্তীর সন্তানটির কোনো ক্ষতি হবে না। সে তার মতো বড় হবে। শিশুদের কোনো পাপ থাকে না। পাপ থাকে মা-বাবার। এক্ষেত্রে ঠাকুরের কোনো পাপ নেই। পাপ ছিল বাসন্তীর। ঘটনার দিন বদরু ছিল সঙ্গে। বিধ্বস্ত ঠাকুর রিশিপাড়া থেকে বেরিয়ে বদরুকে একটু আভাস দিয়েছিলেন বাসন্তীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। সেই আভাস বাস্তবরূপ নিয়েছে গত রাতে।
এসব ঠাকুর ফিরে আসার সাত বছর আগের ঘটনা। বাসন্তীর ছেলেটির নাম রাখা হয়েছে ভূতো। ভূতের ছেলে আর ‘জাউরা পোলা’ হিসেবে তার পরিচয়। পাড়ার লোকে তো বটেই, দেশ-গেরামের লোকে ভূতোকে ভূতের ছেলে বলে খেপায়। ভূতো কোনো কথাই বলে না। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সে বড় হতে লাগল। সাত বছর বয়সেই সে পাড়ার তার বয়সী অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেকটাই লম্বা, তাগড়া শরীর। তার বয়সী তিন-চার বা পাঁচজনে একত্রে আক্রমণ করেও ভূতোকে কাবু করতে পারে না। ভূতোর শরীরে ভূতের মতো শক্তি। [চলবে]


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.