বটবৃক্ষের ছায়া যেমন

আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে কবে যে পরিচয়, সে-কথা মনে পড়ে না। কবে যে ঘনিষ্ঠতা বা তাঁর স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় মিলল, সে-কথা মনে পড়ে না। মনে হয় জন্মের পর থেকেই তিনি আমার মাথার ওপর ছিলেন। আমার দশ দিক জুড়ে ছিলেন। স্যার ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। তাঁর ছায়ায় দাঁড়িয়ে তনুমন জুড়িয়েছে। তাঁর মুখপানে তাকালে যে-আলোর ছটা দেখা যেত সেই আলো অন্তরে গিয়ে পৌঁছাত আমার। এমন মায়াবী স্নিগ্ধ মানুষ জীবনে অনেক কম দেখেছি। মনে হয় দেখিইনি।
স্যারকে নিয়ে লিখতে বসে কত দিনকার কত কথা যে মনে পড়ছে। নূরজাহান লিখতে শুরু করলাম তিরানব্বই সালে। আজকের কাগজ গ্রুপের সাপ্তাহিক খবরের কাগজে। স্যার সেই লেখা পড়তে শুরু করলেন। তখনো মোবাইল যুগ শুরু হয়নি। ল্যান্ডফোনে মাঝেমধ্যে ফোন করতেন। নূরজাহান নিয়ে কথা বলতেন। কথা একটাই ছিল, যেভাবে লিখছ লিখে যাও। তাড়াহুড়া করো না। লেখা লেখার গতিতে এগোক। ছোট করার চেষ্টা করো না। ভাবিও একই কথা বলতেন। কখনো কখনো খুব উচ্ছ্বসিত হতেন।
আমি স্যারের কথা মাথায় রেখে 888sport alternative linkটি লিখছিলাম। কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ পাবলিশার্সের কর্ণধার বাদল বসু আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ওই সময় তিনি একবার 888sport appয় এলেন। চারদিকে নূরজাহান নিয়ে কথা হচ্ছে শুনে বললেন, এই বই আমি ছাপব। অন্য কাউকে দেওয়ার কথা ভেবো না।
কিন্তু লেখা তো শেষ হয় না। বিক্রমপুর অঞ্চলের কত ঘটনা, কত চরিত্র। অঞ্চলের ইতিহাস-প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাপন প্রণালি – সবকিছু এসে ভিড় করছে লেখায়। নূরজাহানের ঘটনা ঘটেছিল কমলগঞ্জের ছাতকছড়ায়। সেই নূরজাহানকে আমি প্রতিষ্ঠিত করলাম বিক্রমপুরে। ফতোয়ার শিকার নূরজাহানকে নেওয়া হয়েছিল প্রতীকী চরিত্র হিসেবে। এই নূরজাহান তো পুরো 888sport appsেরই। 888sport appsের যে-কোনো অঞ্চলেই এমন অনেক নূরজাহান ধর্মীয় মৌলবাদ এবং অন্য নানা রকম সামাজিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমি বিক্রমপুরের লোক। ওই অঞ্চলের ভাষা সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য – সব আমার জানা। মাঠ নদী খাল গ্রীষ্ম বর্ষা আর শীত বসন্তের প্রকৃতি আমার চোখের সামনে ছবির মতো ফুটে থাকে। কোন গাছের পাতা কখন রং বদলায়, তাও আমি জানি। আমি আমার চেনা পরিবেশে নূরজাহানকে নিয়ে এলাম।
কিন্তু লেখা তো শেষ হয় না। ওদিকে বাদলদা তাগিদ দিচ্ছেন। তাঁকে জানালাম লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে। কবে শেষ হবে বুঝতে পারছি না। আনন্দ পাবলিশার্সের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বাদলদা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যবসায়ী মানুষ। পরামর্শ দিলেন, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এনে শেষ করো। লিখে দাও প্রথম পর্ব সমাপ্ত।
বাদলদার পরামর্শ আমি নিলাম। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রথম পর্ব বেরিয়ে গেল। মুদ্রণ888sport free bet পাঁচ হাজার। দেড়-দুই মাসের মাথায় দেশ পত্রিকায় নূরজাহানের বিজ্ঞাপন বেরুল। ‘চোখের পলকে দ্বিতীয় মুদ্রণ’। মুদ্রণ888sport free bet তিন হাজার। আনন্দ পাবলিশার্স বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে মুদ্রণ888sport free bet উল্লেখ করে।
আনিসুজ্জামান স্যার তখন ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে থাকেন। এক সন্ধ্যায় নূরজাহান নিয়ে গেছি তাঁর কাছে। কিন্তু বইটির শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। কী রকম হতাশ গলায় বললেন, প্রথম পর্ব সমাপ্ত মানে কী! লেখা শেষ করোনি? বললাম, না স্যার। আরো বড় হবে। দ্বিতীয় পর্ব লিখতে হবে।
স্যার আর কিছু বললেন না। পরে এক ঘনিষ্ঠজনের কাছে শুনলাম, স্যার আনন্দ 888sport app download bd কমিটির বিচারকদের একজন। তিনি চাইছিলেন নূরজাহান যেন আনন্দ 888sport app download bd পায়। কিন্তু অসম্পূর্ণ বইয়ের ক্ষেত্রে আনন্দ 888sport app download bd হয় না।
আনন্দ 888sport app download bd পাওয়া না-পাওয়া বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু স্যার যে আমার নূরজাহান নিয়ে এভাবে ভেবেছিলেন তার মূল্য আনন্দ 888sport app download bdের চেয়ে অনেক বেশি আমার কাছে।
জনকণ্ঠ পত্রিকায় আমি একটি ধারাবাহিক 888sport alternative link লিখলাম। অধিবাস। দেশভাগের প্রভাব কীভাবে পড়েছিল বিক্রমপুর অঞ্চলের একটি গ্রামে! একজন হিন্দু ডাক্তার মণীন্দ্রকে ঘিরে কাহিনি। দেশভাগের প্রভাবে রাতারাতি কেমন বদলে গেছে এলাকার মানুষগুলো। মানুষ আর মানুষ থাকল না। হয় হিন্দু হয়ে গেল, না-হয় মুসলমান হয়ে গেল। 888sport alternative linkটির বক্তব্য ছিল এই রকম। নূরজাহানের মতো এই 888sport alternative linkেও বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক ব্যবহার ছিল। এই 888sport alternative linkটিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন স্যার। ফোনে বা দেখা হলে অধিবাস নিয়ে কথা বলতেন। মাওলা ব্রাদার্স থেকে বইটি বেরুল। স্যারকে উৎসর্গ করলাম এই বই। বাংলা একাডেমি বইমেলায় স্যারের হাতে তুলে দিলাম। স্যার খুবই খুশি। উৎসর্গ পাতাটি খুলে দিয়ে বললেন, এখানে একটা সই করে দাও।
জীবনে ওই প্রথম সই করতে আমার হাত কাঁপছিল। এক ফাঁকে বললেন, নূরজাহানটা দ্রুত শেষ করো। এসব লেখা বেশিদিন ফেলে রাখতে হয় না।
তারপরও সাড়ে বারোশো পৃষ্ঠার নূরজাহান লিখতে আমার ১৮ বছর লেগেছিল। বাদল বসু প্রয়াত হয়েছেন। এখন আনন্দ পাবলিশার্সের কর্ণধার সুবীর মিত্র। তিনি নূরজাহানের অখণ্ড সংস্করণ প্রকাশ করলেন। এবারো সেই প্রথম পর্বের মতো ঘটনা। এক হাজার রুপি দামের বইটি বছর দুয়েকের মধ্যে তিনটি সংস্করণ হলো। অখণ্ড সংস্করণ হাতে পেয়ে স্যার খুব খুশি। পড়ে কিছুদিন পর বললেন, তোমার আর কিছু না লিখলেও চলবে।
শুধু ওটুকুই। স্যারের কথায় আমার চোখে পানি এসেছিল। ভারতের আনন্দ 888sport app download bd না পেলেও দিল্লি­র আইআইপিএম-সুরমা চৌধুরী 888sport sign up bonus আন্তর্জাতিক 888sport live football 888sport app download bd পেয়েছিল নূরজাহান । আর্থিক মূল্যে সে এক বিশাল 888sport app download bd।
তারপর কত দিন কত অনুষ্ঠানে স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি তাঁর কথা। প্রতিটি মঞ্চেই তিনি সভাপতি বা প্রধান অতিথি। পরিচ্ছন্ন সুন্দর উচ্চারণে এত পরিমিতিবোধ থাকত তাঁর বক্তব্যে, শ্রোতাদের মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকত না। একটি বাড়তি শব্দও ব্যবহার করতেন না কখনো। সেই চেনা ঢোলা পাজামা, স্যান্ডেল শু আর গেরুয়া পাঞ্জাবি; ওই সামান্য পোশাকে কী অসামান্য এক ব্যক্তিত্ব। কোটি মানুষের মধ্যেও চোখে পড়ার মতো। যখনই স্যারের সামনে দাঁড়াতাম, মনে হতো হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মানুষের অনুরোধ কখনো ফেলতেন না। অনেক ছোট ছোট অনুষ্ঠানেও ঠিক গিয়ে হাজির হতেন। শুধু তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে জায়গাটার কিংবা মানুষগুলোর মিল থাকলেই সেই অনুষ্ঠানে স্যার উপস্থিত হতেন। কী অসামান্য পড়াশোনা! কী অপূর্ব জীবনদর্শনে আলোকিত একজন মানুষ!
হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেও আসতেন। এক আড্ডায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন। তাঁর একটি 888sport app download apk নিয়ে স্যার কথা বললেন। শুনে সুনীলদার চোখ কপালে উঠে গেল। এ-888sport app download apkও আপনি পড়েছেন? এ-888sport app download apkর কথাও আপনি মনে রেখেছেন? এ তো আমি ভাবতেই পারছি না।
সমরেশ মজুমদার তো স্যারকে আনিসদা আনিসদা বলতে অজ্ঞান। জলপাইগুড়িতে স্যারকে আর ভাবিকে বেড়াতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা সমরেশদা লিখেছেনও।
তরুণদের সঙ্গে স্যার মিশতেন বন্ধুর মতো। কবি মারুফুল ইসলামকে খুব ভালোবাসতেন। অন্য প্রকাশের মাজহার কমলদেরকে খুব ভালোবাসতেন। এরকম কত প্রিয় তরুণ স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে যখন কালি ও কলম পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলো, সম্পাদক পরিষদের উপদেষ্টা হলেন আনিসুজ্জামান স্যার। আর সম্পাদক আমাদের সবার প্রিয় হাসনাতভাই। আবুল হাসনাত। এ আরেক তুলনাহীন মানুষ। কালি ও কলম প্রকাশের প্রস্তুতিপূর্বে 888sport app ক্লাবে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে। স্যার এবং হাসনাতভাইও আছেন। হাসনাতভাই আমাকে বললেন, প্রথম 888sport free bet থেকেই আমরা দুটো ধারাবাহিক 888sport alternative link ছাপব। কলকাতা থেকে লিখবেন সুনীলদা আর 888sport apps থেকে আপনি। আমি একটু গাঁইগুঁই করছিলাম। কারণ লেখার কোনো প্রস্তুতি নেই। লেখা দিতে হবে দিন পনেরোর মধ্যে। ব্যাপারটা হাসনাতভাই বুঝলেন। বুঝে ঠোঁট টিপে হাসলেন। ইশারায় আনিস স্যারকে দেখিয়ে বললেন, স্যার বলেছেন।
আমার আর নড়াচড়ার উপায় নেই। প্রায় দুই বছর ধরে লিখলাম পর 888sport alternative linkটি। কোনো কোনো কিস্তি লেখার সময় বেশ ফাঁকি দিতাম। স্যার প্রতিটি কিস্তিই মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। কিন্তু দুর্বল কিস্তিগুলো নিয়ে তিনি কিছু বলতেন না। ভাবিকে দিয়ে আমাকে ফোন করাতেন। ভাবি খুব নরম মাতৃসুলভ কণ্ঠে বলতেন, লেখায় আরেকটু মনোযোগী হওয়া দরকার। বুঝতাম এটা স্যারেরই কথা। বই করার সময় পর 888sport alternative linkের সেই দুর্বল অংশগুলো আমি নতুন করে লিখেছি।
স্যার তেমন বেশি লেখেননি। সেই কবে পড়েছি তাঁর পুরোনো বাংলা গদ্য নামের বইটি। মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট বই মুনীর চৌধুরী পড়েছি। আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি তাঁর দুই পর্বে লেখা আত্মজীবনী কাল নিরবধি ও বিপুলা পৃথিবী । বিপুলা পৃথিবীর জন্য পেলেন আনন্দ 888sport app download bd।
দেশে-বিদেশে কত 888sport app download bd পেয়েছেন স্যার। 888sport appsের সবগুলো জাতীয় 888sport app download bd। ভারতের আনন্দ 888sport app download bd, পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মভূষণ’। শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য জাতীয় অধ্যাপক হয়েছেন। কিন্তু এসবে যেন তাঁর আসলে কিছু যেত-আসত না। এত বড় মানুষটি যখন আমাদের সঙ্গে মিশতেন, মনে হতো আমরা আমাদের এক সিনিয়র বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। অহংকার বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি তাঁকে। নিজের আলোয় তিনি এতখানি আলোকিত ছিলেন, সেই আলো পূর্ণিমা-সন্ধ্যার মতো মোহময় করত চারদিক।
অন্যদিন পত্রিকার জন্য স্যারের একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম আমি। কোনো কোনো সন্ধ্যায় ইন্টারভিউ নিতে বসতাম হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে। আমার প্রশ্ন ধরে ধরে স্যার কথা বলে যাচ্ছেন। রেকর্ডার চলছে। স্যারের চারপাশ ঘিরে বসে আছি আমরা কয়েকজন। হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর বন্ধুদল। আলমগীর রহমান, দুই করিমভাই, মাজহার কমল নাসের মাসুম, মুনীর ভাই। ফাঁকে ফাঁকে খাওয়া-দাওয়া চলছে। বেশ কয়েকটা সিটিং হলো এরকম। একদিন স্যারের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারেও বসা হলো। এত বড় ইন্টারভিউ এবং এত বিষয় নিয়ে কথা, স্যার অতি সরল ভঙ্গিতে সব বলে গেলেন। অন্যদিনে সেই ইন্টারভিউ ছাপতে গিয়ে দেখা গেল, এত কথার পরও কোনো কোনো প্রসঙ্গ বাদ পড়ে গেছে। ছাপার আগেই ইন্টারভিউটা স্যার পড়লেন। তারপর এক বিকেলে এসে হাজির হলেন অন্যদিন অফিসে। অনেকটা রাত পর্যন্ত বসে কী যে মনোযোগ দিয়ে অসম্পূর্ণ জায়গাগুলো সম্পূর্ণ করলেন নিজ হাতে লিখে লিখে, স্যারের সেই একাগ্রতার দৃশ্য আমি জীবনে ভুলব না।
আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এক বিশাল বটবৃক্ষ। তাঁর মায়াবী ছায়ায় আমরা স্নিগ্ধ হয়েছি। আমাদের মাথার ওপরকার সেই ছায়া সরে গেছে। তবে সরে যাওয়ার পরও ছায়ার সবখানি রেশ চিরকাল আমাদের সঙ্গে থাকবে। মৃত্যু আনিসুজ্জামান স্যারকে একটুও ম্লান করতে পারেনি। চলে গিয়েও তিনি আসলে আমাদের মাঝে রয়েই গেছেন। কোন শক্তি তাঁকে সরায় আমাদের অন্তর থেকে!