মধুপূর্ণা মুখার্জি
ক্ষুধার্ত বাংলা : রাষ্ট্র ও বেনিয়াতন্ত্রের গণহত্যার দলিল
সম্পাদনা : মধুময় পাল
দীপ প্রকাশন
কলকাতা, ২০১৩
৪০০ রুপি
এক. ফিরে দেখা
চিত্র-১ : গলির বাড়ি থেকে প্রায় জোর করে ঠেলে বার করে দিলে এক ভদ্রলোক – এক মা আর তার বছর সাতেকের মেয়েকে। মায়ের হাতে একটা বাঁশের চেলা, আর এক হাঁড়ি ফ্যানভাত। এক হাতে পিছনে ফিরে মুখে পুরছে তার মা, নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই, মুখে পুরছে আর পুরছে। এক একবার কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে এগিয়ে আসে, দে মা এট্টু দে মা – এট্টু। বাঁশের চেলার এক-এক ঘা বসিয়ে তাকে তাড়ায় মা। কাঁদতে কাঁদতে মেয়ে সরে যায় – আবার ফিরে আসে তখনি, আবার বাঁশের ঘা দিয়ে তাড়াতে হয় তাকে।… তাড়াতে হয়, – কাক তাড়াতে হয়, কুকুর তাড়াতে হয়, শেয়াল তাড়াতে হয় – মেয়েকেও তাড়াতে হয় – বাঁচতে হবে যে – মাকেও বাঁচতে হবে।
চিত্র-২ : ‘আজিমুন্নেসার গোটা মুখে আগুনে পোড়া দাগ। কুমারভোগে তার বাড়ি। বিধবা মা অন্নাভাবের সময় আবার নিকা করে। আজিমুন্নেসা আর তার ছোটো বোন সুকুরবানু মার নতুন সংসারে স্থান পায় না। তাদের গ্রামের এক প্রতিবেশী বোন দুটির ভার গ্রহণ করে। কিন্তু ভাতের অভাবে যখন সংসারে তীব্র হাহাকার দেখা দিল, তখন লোকটির মন হইতে দয়ামায়া মুছিয়া গেল। একদিন লোকটি ক্ষুধার্ত আজিমুন্নেসাকে উনুনের মুখে চাপিয়া ধরিল। সুকুরবানুর চিৎকার শুনিয়া পাড়ার লোকজন আসিয়া শেষকালে তাদের রক্ষা করে। অসহায় ২টি বোন লঙ্গরখানায় আশ্রয় নেয়। আলি হোসেন, গৌরাঙ্গ, ধারাশ্যাম, মজিদ, হরিদাসী, আমিনা – এতিমখানার প্রত্যেকটি শিশু ও কিশোরের জীবনে এমনই সব করুণ ইতিহাস।
চিত্র-৩ : ওই যে, ওদিকে – একটা মেয়ে অপেক্ষা করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।’ কারা ভিড় থেকে বের করে নিয়ে এসেছে তাকে। ‘হয়তো মরে যাবে’, কে বললে। শুইয়ে দিলে ফুটপাতে। বিনয় দাঁড়িয়ে পড়ল – সে ডাক্তার, দেখবে না? কিন্তু দেখবার কী আছে আর? না দেখেও তো বিনয় জানে ওর পীড়া কী। রাস্তার ওপার থেকে আর একটি বুভুক্ষু তার এলুমিনিয়ামের ভাঙা থালা দিয়ে বাতাস করতে লেগে গেল, একজন মাথায় জল দিতে গেল। বাঁচবার আশায় খাওয়া-খাওয়ি করে পরস্পরে এরা; আবার বাঁচাতেও চায় একজন আর একজনকে তবু! বিনয় দেখলে, তাদেরই কে একজন ওবেলা অন্য লঙ্গরখানা থেকে আনা ভাতের ফ্যান জোগাড় করে রেখেছিল, তাই এখন মেয়েটার মুখে ঢেলে দেবার চেষ্টা করছে – হয়তো এক চুমুক খেতে পারলে মেয়েটা শক্তি পাবে; আবার চক্ষু মেলবে, তাকাবে, উঠে বসবে; আবার চাইবে বাঁচতে, চাইবে ফ্যান, চাইবে ভাত; আবার দাঁড়াবে লাইনে, আবার ধাক্কা সইবে, মারামারি করবে, কাড়াকাড়ি করবে, – তবু বাঁচবে, বাঁচতে চাইবে, বাঁচবে, হাঁ, বাঁচবে আবার।… কিন্তু বাঁচবে কতক্ষণ, কদিন?
বোধহয় এভাবেই বিপন্নতার জন্ম হয়। 888sport appsে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মহামন্বন্তর প্রসঙ্গে সদ্য প্রকাশিত ক্ষুধার্ত বাংলা বইটির পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় মানুষের মধ্যেই মানব আর অমানব সত্তার দাঙ্গাধ্বস্ত চিত্রগুলো যেন বাক্ রোধ করে। রূঢ় বাস্তবের অলিতে-গলিতে ঘুরতে গিয়ে মৃতের স্তূপ টপকে, 888sport promo codeর দেহমাধুরী বিকিকিনি দেখে জীবিত কঙ্কালদের পাশ কাটিয়ে একরকম পালাতে পালাতে ধেয়ে আসা একটাই প্রশ্নের মুখোমুখি হই আমরা – ‘কেন?’… তবে কি কোনোভাবে বিস্মৃত হয়েছি মানুষের তৈরি করা দুর্ভিক্ষের বলি ৩০ বা ৩৫ লাখ মৃত মানুষকে। সেই প্রান্তিক বাঙালির শবের স্তূপেই তো জন্ম নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। একই ক্ষুধার অসহনীয় তীব্রতা আজো তো বিক্ষিপ্তভাবে প্রাণ কেড়ে চলেছে মানুষের।
দুই. তারপরও আগে
তথ্যসারণি বেয়ে বলা যায়, বাংলাজুড়ে মন্বন্তরের আগে মেদিনীপুরে হয় তার সূচনা। ১৯৪২ সালের ১৬ ও ১৭ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড়ে হাজার বর্গমাইলেরও বেশি এলাকা বিধ্বস্ত হলে – অসংখ্য মানুষের প্রাণহানিতেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না ব্রিটিশ সরকার। ‘ত্রাণ ও সাহায্য পাঠানো দূরের কথা, এই ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরটাই’ কৌশলে চেপে যায় তারা; সরকারি সূত্রে খবর প্রকাশ করা হয় নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে। এই অমানবিক আচরণের পেছনে সক্রিয় ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিখ্যাত প্রতিশোধস্পৃহা – ১৯৩১, ১৯৩২, ১৯৩৩-এ পরপর তিন বছর মেদিনীপুরের তিন জেলাশাসক পেডি, ডগলাস ও বার্জকে হত্যার বদলা।
‘খেতমজুরদের ঘর প্লাবনে নিশ্চিহ্ন, ছোট কৃষকরা সম্বলহীন, মাঝারি কৃষক ও মধ্যবিত্তরা প্রশাসনের অত্যাচারে বিপন্ন’ – মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়ল, জন্ম নিল দুর্ভিক্ষ। ১৯৪২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের চিত্র এমন কথাই বলে। এরপর দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস মেদিনীপুরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাজুড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বাজারে মন্দার জোয়ার নামে। ‘বাংলার চাষির কৃষিপণ্যের দাম পড়ে যায় প্রায় ৫৫ শতাংশ।’ বাঁচার লড়াইয়ে কাঁধে চাপাতে হয় ঋণের বোঝা। অস্তিত্বের অভিযোজন-লুব্ধ কৃষক জোতদার-মহাজনদের হাতে স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে তুলে দিতে থাকে বাঁচার রসদ – আবাদি জমির মালিকানা। বাড়তে থাকে বর্গাদারি।
‘সরকারকে ধানের একটি দানাও নয়’ – সংকল্পে মেদিনীপুরের মানুষ সাত-সাতটা দিন ধরে ধ্বংসের তাণ্ডবে পুড়িয়েছিল তিনটি গোলার কয়েক হাজার মণ ধান। কেউবা মাটির তলায় পুঁতে ফেলেছিল সোনার ফসল। আবার অনেকে সরকারকে এড়িয়ে চাল তুলে দিয়েছিল মজুতদারদের হাতে। আবেগচালিত, শিক্ষার আলোকশূন্য, আত্মরক্ষায় অসমর্থ বাংলার মানুষ সেদিন বোঝেনি, নিরন্ন দিনগুলোর আসন পাতছে তারাই! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই পটভূমিতে সিঙ্গাপুর আর মিয়ানমার করায়ত্ত করে জাপান তখন শ্যেন দৃষ্টি দিয়েছে ব্রিটেনের কলোনি ভারতের দিকে। তাদের ভাতে মারতে উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য সরানো শুধু নয়, খাদ্য সরবরাহ বিপর্যস্ত করতে বাজেয়াপ্ত হচ্ছে যাবতীয় নৌকা, এমনকি গরুর গাড়িও।
১৯৪২ সালের জুলাই মাসে রপ্তানি-ব্যবস্থায় নিষেধাজ্ঞা জারি হলে বাজার থেকে উধাও হতে শুরু করল ক্ষুধার অন্ন। চাল যেটুকু-বা মিলল তাও মূল্যের মাপকাঠিতে নাগালের বাইরেই থেকে গেল নিুবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষেরও। অঘোষিতভাবে চাল রপ্তানি হওয়ায় উৎপাদনকারীই হলো নিরন্ন! অবস্থা ক্রমশ এমন জায়গায় ঠেকল, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে স্থির হলো ‘উদ্বৃত্ত প্রদেশ থেকে বাংলায় চাল পাঠাতে আমদানি করতে হবে ৩.৭০ লাখ টন।’ কিন্তু ১৯৪৩-এর জুন পর্যন্ত এসে পৌঁছল মাত্র ৪৪ হাজার টন। বিহার থেকে যেখানে ১.৮৫ লাখ টন চাল আসার কথা, সেখানে এলো এক হাজার টন। ১৯৪৩ সালের ২৯ মার্চ বাতিল হয় ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা। বাংলার গভর্নর জন হারবার্টের যোগসাজশে গঠিত হলো নাজিমুদ্দিনের সরকার। খাদ্যমন্ত্রী তখন সুরাবর্দী। অবাধ বাণিজ্যের খাদ্যনীতি চালু হলো। ইস্পাহানি হলো বাংলার সরকারের হয়ে বেচাকেনার সব দায়িত্বের একমাত্র ভারপ্রাপ্ত। মানুষের খিদে যার পেট ভরায়, তারই হাতে পড়ল সকল মানুষের পেট ভরানোর কাজ। স্বাভাবিকভাবে চাল নিয়ে ফাটকাবাজির জেরে চালের দাম বিশ্বাসের গণ্ডি পেরিয়ে আকাশ ছুঁলো। গ্রামের নিুবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ হারাল ভাতের স্বপ্ন। সুযোগ নেই শ্রম বিক্রয়ের, সুতরাং রোজগারের পথ হলো রুদ্ধ, কিন্তু খিদে যে কোনো শাসন মানে না। সেই খিদেরই তাড়নায় শান্তির নীড়গুলোয় শুধু ব্যাপক ফাটলই ধরল না, বিচ্ছিন্ন হলো সমস্ত সম্পর্কের নিগড়। গ্রামবাংলার লাখ লাখ নর888sport promo code – আবালবৃদ্ধবনিতা পাষাণ শহরে ছুটে এলো। অন্নসংস্থানের আশায়। শুরু হলো ‘ক্ষুধার মৃত্যু’। চূড়ান্ত খাদ্যসংকটের সঙ্গে শুরু হলো বস্ত্রসংকট, ওষুধের অপ্রাপ্তি, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বরের পাশাপাশি খাদ্যের জন্য শরীর বিক্রির ফসল সিফিলিস, গনোরিয়া।
চিত্র-১ : ‘অন্নাভাবে পঙ্গপালের মতো লোক ঘরবাড়ির মায়া কাটাইয়া আসামের পথে ছুটিয়াছিল। অনাহার ও রোগে মৃত্যুর হাত হইতে তাহারা রেহাই পায় নাই। গ্রামে গ্রামে এই সমস্ত নিরুদ্দেশ ও নির্বংশ পরিবারের উচ্ছন্ন ভিটা পড়িয়া আছে। মুসলমান পাড়ায় বাড়ির উঠানগুলো কবরে উঁচু হইয়া আছে। সন্ধ্যায় হিন্দুর বাড়িতে শঙ্খ ধ্বনিত হয় না।’
চিত্র-২ : ‘মুন্সীগঞ্জ মহকুমাই বিক্রমপুর বলিয়া পরিচিত। গত দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে এই মহকুমার ৯ লাখ লোকের মধ্যে ৮০ হাজার লোক মরিয়া গিয়াছে। ইহাদের মৃতদেহের ভিড়ে খাল-নালার জলস্রোত রুদ্ধ হইয়াছিল। যার শরীরে শক্তি ছিল, সে মাঠে নদী নালায় মৃতদেহ টানিয়া ফেলিয়া দিয়াছে। যার শরীরে কুলায় নাই, তার ঘরের উঠানে শিয়াল, শকুনিরা শবদেহ ছিঁড়িয়া খাইয়াছে। লৌহজঙ্গের ব্যবসায়ীরা দুর্গন্ধে টিকিতে পারে নাই। পাইকারি কবর দেওয়াইবার জন্য বন্দরে ২ জন মাহিনা করা লোক রাখিয়াছিল।’
চিত্র-৩ : ‘…চৌরঙ্গি, কালিঘাট, লেক মার্কেটের মোড়, বালিগঞ্জ… ওদিকে শেয়ালদা, শ্যামবাজারের মোড়। সর্বত্র এক দৃশ্য – শত সহস্র কঙ্কাল ফ্যান দাও ফ্যান দাও বলে চিৎকার করছে। পেটের জ্বালায় গ্রাম উৎখাত করে শহরে এসে অন্নদাতা কৃষক ও জগদ্ধাত্রী কৃষাণী দু-মুঠো অন্ন ভিক্ষা চাইতেও সাহস পায় না – বলে, ফ্যান দাও। মনুষ্যত্বের কী অবমাননা। গোরু ছাগলের খাদ্য নিয়ে মানুষে-মানুষে কাড়াকাড়ি। ডাস্টবিনের পচা এঁটোকাঁটা নিয়ে কুকুরে-মানুষে মারামারি।… অমৃতের সন্তানরা মরছে যেন পোকামাকড়।’
বেহিসেবি মৃত্যু আর 888sport free betয় বাঁধা যায় না, মৃতদেহ হিসাবহীন। তবু লন্ডনে ভারত সচিব আমেরি, দিল্লিতে গভর্নর জেনারেল লিনলিথগো, বাংলার গভর্নর জন হারবার্ট দুর্ভিক্ষের বাস্তবতা অস্বীকার করে ক্ষুধার মৃত্যুকে গোপন করে বিবৃতি দিতেই থাকলেন। লিনলিথগোর স্থানাধিকারী হয়ে ওয়াভেল এসে ‘নিজে দেখে মানলেন’ পরিস্থিতির ভয়াবহতা। কিন্তু ততদিনে লাখ লাখ প্রাণ অকালে বিনষ্ট হয়েছে। ‘প্রান্তিক হিন্দু ও মুসলমান ক্ষুধার শহিদ হয়েছে। রাষ্ট্র ও ফাটকাবাজরা তাদের হত্যা করেছে।’
তিন. প্রতিরোধ কথা
১৯৪৩ সালের মার্চ মাস থেকে দ্য স্টেটসম্যানে অনাহারে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়। ২২ আগস্ট ১৯৪৩, রোববার ছাপা হলো পাতা জোড়া দুর্ভিক্ষের ছবি। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মহলে তার তাপ বিকিরিত হলো, 888sport app পত্রিকাও এ-সময় থেকে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহে তৎপর হয়।
কমিউনিস্টরা দরদি ত্রাণকর্তা হয়ে এসে দাঁড়ালেন মানুষের হৃদয়ের মাঝখানে। তাঁদের উদ্যোগ অবি888sport app download for androidীয়।
কিছু মানুষ হাতিয়ার হিসেবে তুলে নিলেন কলমকে। অপচিত প্রাণের হাহাকার আর বিপন্নতা যখন অসাড় করেছে চেতনাকে, তখনই যেন প্রতিরোধের অন্তর-স্পৃহা ছিটকে উঠেছে ভাষার বয়নে। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বলেছেন – ‘একদিন দেখলাম মা মরে পড়ে আছে। তার স্তন ধরে অবোধ ক্ষুধার্ত শিশু টানাটানি করছে, আর হেঁচকি তুলে কাঁদছে। এর প্রচণ্ড অভিঘাত আমার গোটা অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দিল। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম – না না না। অস্থির পায়ে দৌড়তে দৌড়তে হেঁটে চলেছি আর মনে মনে বলছি – We won’t allow people to die… হাত মুঠো করে আবার বলে উঠলাম না না না’… সুর আর কথা মনের বেদনা ও যন্ত্রণার রুদ্ধ উৎসমুখ থেকে ঝরনার মতো বেরিয়ে এলো। শুরু হলো নবজীবনের গান –
না না না
মানব না মানব না
কোটি মৃত্যুরে কিনে নেব প্রাণপণে
ভয়ের রাজ্যে থাকব না।…
মহামন্বন্তরকে সামনে রেখে গানে, নাটকে, গল্পে, 888sport alternative linkে চেতনার প্রতিরোধ গড়া শুরু হলো। রচিত হলো বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন, জবানবন্দী, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীপশিখা, তুলসী লাহিড়ীর দুঃখীর ইমান, ছেঁড়া তার, জ্যোতির্ময় সেনগুপ্তের চালের দর, বনফুলের নমুনা, ব্রজেন্দ্রনাথ দে-র আকালের দেশ, মহাযুদ্ধের বলি ও উজানীর চরের মতো অসংখ্য নাটক। অন্ন-কাতর মানুষের যন্ত্রণা শুঁষে নিয়ে জন্ম হলো বহু গানের –
কী করি, উপায় রে, কী করি উপায়
পরান বাঁচান হইল দায়
চাউলের দর ত্রিশ টাকা মণ, কেরোসিন তেল নাই
কাপড়ের দর দশ টাকা জোড়, অষুধপত্র নাই
আকালের লাগল আগুন রে
পুড়্যা হলাম ছাই।
কিংবা,
সাতকানিয়ায় আছিল ঘর, সোয়ামী আছিল চাষী
আছিল চার হালর বলদ গোলায় ধানর রাশি।
শুন ও মা-ভৈন রে…
‘ছিল নেই মাত্র এই’ – অথচ এর মধ্যে কত শূন্যতা : যেন কান্নার বাষ্পীভূত রূপ এই ‘আছিল’। আজ কাল পরশুর গল্পে মানিক লেখেন – ‘না খেয়ে রোগে ভুগে কত মানুষ মরে গেল, কত মানুষ, কত পরিবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, কোন বাড়ির দশজন কোথায় গিয়ে ফিরে এলো মোট দুজন ধুঁকতে ধুঁকতে, কত মেয়ে-বৌ চালান হয়ে গেল কোথায়।’ তাঁর অসংখ্য গল্পে নির্মোহ দৃষ্টিতে সময়ের যেন ফটোগ্রাফ ধরা আছে। দুর্ভিক্ষ সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে, অন্নচিন্তা স্বামীকে কাছছাড়া করেছে। প্রাণ টিকিয়ে রাখতে সেই মেয়েটি শহরে শরীর বিক্রি করেছে। তারপর! এগারো মাস পরে সমাজসেবিকার সাহায্যে যখন সে ফিরতে পারে তার নীড়ে, তখন সমাজ তাকে কীভাবে নেয়! এমনই আর একটি গল্প ‘নমুনা’ – যেখানে নিজের মেয়ের শরীর কয়েক বস্তা চালের বিনিময়ে ওজনদরে বিকিয়ে দিয়ে বাবা আফসোস করে সেই মৃত কন্যাটির জন্য, যে থাকলে আরো কয়েক বস্তা চাল ও কাপড় কেনার টাকা সংগ্রহ করা যেত। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কলমে উঠে আসে কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা, যে-পরিবারের প্রধান নিশ্চিন্ত হয় সন্তানের জ্বর হলে, কারণ জ্বর হলে সে আর খাবার চাইবে না। এভাবেই প্রচুর লেখকের কলম কথা বলে উঠেছিল সেদিন।
বন্যার পর পলিতে যেমন নতুন করে সবুজ ঘাস মাথা তোলে সেদিনের দুর্ভিক্ষের মৃত্যুমিছিলের পরেও বাংলার মানুষ টিকে ছিল। তাদের মধ্যে জীবিত নাপিতদের দু-একজন সেলুন খুলল, চুল ছাঁটা, ক্ষৌরীর বিনিময়ে নগদ পয়সা দাবি করল তারা। ধোপাদের কেউ কেউ দোকান করে নগদ পয়সায় কাপড় কাচা শুরু করল। দুর্ভিক্ষের কারণে ছিন্নমূল হয়ে শহরে আসা মানুষের 888sport free bet বৃদ্ধির সঙ্গেই স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ল নিষিদ্ধপল্লিতে যৌনকর্মীর 888sport free bet। তবে ছিন্নমূল মানুষ 888sport free betলঘু সম্প্রদায়ের হলে যে কেবল তারা কলকাতার 888sport free betলঘু মহল্লাগুলোতেই ভিড় করেছেন এমনটাও নয়। দুর্ভিক্ষে বাঙালিকে অনেক মূল্য চোকাতে হলেও এদিক থেকে ছবিটা যেন মানুষের নিজেকে জিইয়ে রাখার সূত্রকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। জীবন জীবিতের, বাঁচতেই যে হবে!
চার. যেভাবে এ-সংকলন
পঞ্চাশের মন্বন্তরে যুক্ত-বাংলার ক্ষুধার্ত রূপ আজ হারিয়ে যাওয়া অতীত। দীপ প্রকাশনের উদ্যোগী সহযোগিতার সম্পাদক মধুময় পাল আক্ষরিক অর্থেই সেই অতীত খনন করেছেন তাঁর ক্ষুধার্ত বাংলা সংকলনে। ১৯৪৩-এর নভেম্বরে সমগ্র বাংলা যখন দুর্ভিক্ষের ‘করাল কবলে’, সে-সময়ে চিত্তপ্রসাদ মেদিনীপুর জেলা ঘুরে মর্মন্তুদ ডকুমেন্টেশন নির্মাণ করেন অনাহার-মৃত্যু ও ধ্বংসের। তাঁর সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে ক্ষুধার্ত বাংলায়। ভবানী সেন ও সোমনাথ হোরের রচনা দুটিও মন্বন্তরগ্রস্ত চট্টগ্রাম পরিক্রমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। ‘বিক্রমপুরের বুকে সংকটের ছায়া’ সন্ধান করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। 888sport sign up bonusর আয়নায় এপার বাংলা ওপার বাংলা দুর্ভিক্ষের চেহারা দেখা যায় জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, অমলেন্দু দে-র লেখাগুলোতে। নবতিপর সুনীল মুন্সী কিংবা অশীতিপর হরিপদ মণ্ডলের 888sport sign up bonus উসকে তুলে আনা তথ্যসংকলনটিতে পাঠকের প্রাপ্তি। হাওয়ার্ড ফাস্ট, পিসি জোশি, গোপাল হালদার, অশোক মিত্র, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিনয় রায়, বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায়, আনিসুজ্জামান কিংবা সৈয়দ আজিজুল হক, সোমেশলাল মুখোপাধ্যায়, অনুরাধা রায় ও অন্যদের রচনায় গেঁথে সংকলনটিকে সম্পূর্ণতা দিয়েছেন সম্পাদক।
কিছু মানুষের অর্থস্ফীত হওয়ার বাসনা আর কালোবাজারি যখন ছিনিয়ে নিয়েছিল অন্তত ৩৫ লাখ মানুষের প্রাণ… রাষ্ট্র ও বেনিয়াতন্ত্রের সেই গণহত্যার দলিল এই সংকলন।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.