জিল্লু এরকমই। যে-কোনো কথা শুরু করে ‘না’ দিয়ে। এই যেমন এখন। আমাকে ফোন করেই বলল, না না, তোকে ফোন করেছি অন্য একটা কারণে।
চা শেষ করে সিগ্রেট ধরিয়েছি। বড় করে টান দিয়ে বললাম, কারণটা বল বাপ!
জিল্লু হাসল। না না, ব্যাপারটা হলো তুই তো জানিসই আমি সুইডেনের 888sport apps সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি। সুইডেন নরওয়ের সব বাঙালিই আমাকে চেনে। সুইডিশরাও কেউ কেউ চেনে। না না, মিডিয়ার লোকজন।
ওই একটু-আধটু লেখালেখি করি তো! পেন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গেও জড়িত। কবি-লেখকরাও অনেকেই চেনেন। তেইশ বছর ধরে এখানে আছি। বউটা বাঙালি ছিল। না না, এখন সুইডিশ হয়ে গেছে। বাচ্চা দুটো তো সুইডিশই। হা হা হা।
কাজের কথাটা বল।
না না, মারিয়া নামের একটা মেয়ে 888sport appsে যাবে। একলা যাবে না। পাঁচজনের একটা গ্রুপ। সবাই সুইডিশ। না না, একেকজন একেক শহরের। রায়ান ছেলেটা আমার শহরের। না না, উপসালাতেই বাড়ি। মারিয়া থাকে মালমোতে।
মারিয়ার মালমোতেই থাকার কথা।
না না, কেন?
মারিয়া আর মালমো দুটোই ময় আকার দিয়ে শুরু হয়েছে। মাল কেমন?
ভাবলাম জিল্লু হা হা করে হেসে উঠবে। সে হাসল না। গম্ভীর গলায় বলল, ময় আকারে মাও হয়, মাতৃভূমিও হয়।
আমি একটু ধাক্কা মতো খেলাম। সিগ্রেটে টান দিয়ে বললাম, খুবই সিরিয়াস গলায় মা আর মাতৃভূমি বললি! বাঙালি মেয়ে নাকি?
না না, এখন সুইডিশ।
আমি কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই জিল্লু বলল, এই রবি, তুই কি মারিয়াকে দিনদশেক সময় দিতে পারবি? না না, সে তোকে পে করবে।
তুই কি ভেবেছিস আমি বেকার?
না না, আল্লার কসম, আমি তাই ভেবেছি দোস্ত।
তোমার ভাবনা সঠিক। আমি বর্তমানে বেকার। শেষ চাকরিটা বিশদিন আগে ছেড়েছি।
জিল্লু হা হা করে হাসল। আমি তাকে নকল করে বললাম, না না, তোমার মারিয়া আমাকে কী রকম পে করবে?
পার ডে হানড্রেড ডলার। না না, দশদিনে এক হাজার ডলার। বাংলা টাকায় পঁচাশি হাজার টাকা।
নট ব্যাড। আমি রাজি। জীবনের দশটা দিন মাত্র এক হাজার ডলারের বিনিময়ে মারিয়ার কাছে বিক্রি করে দিলাম। দালালি বাবদ তোকে পারসেনটিজ দিতে হবে না?
জিল্লু আবার সেই প্রাণখোলা হাসিটা হাসল। না না, বিতলামি না দোস্ত। মেয়েটা 888sport apps ঘুরে ঘুরে দেখবে। তুই গাইডের কাজটা করবি। আমার হেল্প চেয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তোর নামটা মনে পড়ল। তুই স্মার্ট, ড্যাশিং। ইংরেজিটা ভালো বলিস। তাহলে তোর সেল নাম্বার আর মেইল আইডি দিয়ে দিই।
সিগ্রেটে শেষ টান দিয়ে বললাম, সবই বুঝলাম। তার আগে বল, মারিয়া দেখতে কেমন?
না না, নিজ চোখেই দেখে নিও।
মারিয়াকে দেখে হতাশই হলাম। একেবারেই সাধারণ বাঙালি মেয়ে। ইউরোপে থেকেও ইউরোপিয়ান হতে পারেনি। এভারেজ বাঙালি মেয়েদের মতো লম্বা। গায়ের রং শ্যামলা। মুখটা মিষ্টি। রোগা শরীর। রোগা মেয়েদের চেহারায় সবসময় এক ধরনের বিষণ্নতা থাকে। মারিয়ার বিষণ্নতা একটু বেশি। মুখে হাসি নেই। ঘন পাপড়ির ডাগর চোখ দুটোয় উদাসীনতার ছায়া। সারাক্ষণ কী যেন ভাবছে। ফাইভ স্টার হোটেলে ওঠেনি। শান্তিনগরের হোয়াইট হাউস হোটেলে উঠেছে। হোটেলটা পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। ডোরবেল বাজানোর পর দরজা খুলল মারিয়া। গুড আফটারনুন। এসো। তোমার ব্যাপারে সবকিছুই জিল্লু আমাকে বলেছে।
রুমে ঢুকে বললাম, তোমার ব্যাপারেও জিল্লু আমাকে বলেছে।
মারিয়া যেন একটু চমকালো। কী বলেছে?
না মানে তুমি দশদিন 888sport appsে থাকবে। আমাদের দেশটা ঘুরে ঘুরে দেখবে।
আর কিছু বলেনি?
না তো!
ঠিক আছে। বসো। চা খেতে খেতে কথা বলি।
চা আসার পর বললাম, আমি কি তোমার রুমে স্মোক করতে পারি?
খুব জরুরি না হলে কোরো না।
ওকে।
রুমটা সুন্দর। একপাশে দেয়ালঘেঁষা দুটো আরামদায়ক চেয়ার। মাঝখানে টি-টেবিল। আমরা বসেছি মুখোমুখি। যেটুকু কথা হয়েছে তাতে বুঝেছি ইংরেজিটা পরিষ্কার বলে মারিয়া। অপরিষ্কার বললেও অসুবিধা হতো না। বিদেশিদের সঙ্গে চলাফেরায় আমি অভ্যস্ত।
তোমার গ্রুপের বাকি চারজন কী করবে? 888sport apps দেখবে না?
দেখবে তো বটেই। তবে আমার মতো একা একা মুভ করবে না। ওরা চারজন একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যাবে। গাইড গাড়ি সব ঠিক করা আছে। তুমি কি ওদের সঙ্গে পরিচিত হতে চাও?
দরকার আছে?
আমার মনে হয় না। আমরা আমাদের প্ল্যানটা করে ফেলি।
সিওর। তুমি কি কিছু, ভেবেছ কোথায় কোথায় যেতে চাও? আই মিন 888sport apps নিয়ে তোমার কোনো ধারণা আছে কি না। কী কী দেখতে চাও? ঐতিহাসিক স্থানগুলো? সমুদ্র, চা-বাগান?
888sport apps নিয়ে কিছুটা ধারণা আমার আছে। একাত্তর সাল নিয়ে আমি একটু খোঁজখবর করেছি। যতটা পেরেছি জানার চেষ্টা করেছি। এখন তো অনেক সুবিধা। সহজেই সবকিছু জানা যায়। ঐতিহাসিক জায়গা, সমুদ্র ইত্যাদি আমি দেখতে চাই না। আমি 888sport appsের গ্রাম, নদী এসব দেখতে চাই। দুয়েকজন বিশেষ মানুষ দেখতে চাই।
মারিয়া আনমনা হলো। চা শেষ হয়েছে। আমার এখন তীব্র সিগ্রেটের নেশা। উঠে দাঁড়ালাম। আমি একটু বাইরেটা ঘুরে আসি।
স্মোক করবে?
হ্যাঁ।
চলো আমিও যাই। তুমি স্মোক করবে, আমি কথা বললাম।
বারান্দাটা সুন্দর। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আমি হাওয়ায় সিগ্রেটের ধোঁয়া ওড়াতে লাগলাম।
মিস্টার রবি, এখান থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সটা কতদূর?
এক মিনিটের পথ।
মানে?
এই বিল্ডিংটার পুবদিকে দু-তিনটা বিল্ডিং পরই রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স।
মারিয়ার মুখটা উজ্জ্বল হলো। তাই নাকি? একাত্তর সালে রাজারবাগের পুলিশরাই প্রথম প্রতিরোধ করেছিল পাকিস্তানি সৈনিকদের।
তা করেছিল। পুলিশ বাহিনীর বহু বীর শহিদ হয়েছিলেন। তারপর পুলিশ লাইন্স হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানিদের আস্তানা। মেয়েদের ধরে ধরে এনে এখানে দিনের পর দিন আটকে রাখা হতো। যে-নির্যাতন তাদের ওপর করা হতো তা তোমাকে আমি বলতে পারব না।
মারিয়া উদাস হলো। বিষণ্ন মুখ আরো বিষণ্ন হলো তার। আমি কিছুটা জানি। একাত্তরে পাকিস্তানিরা যে-888sport promo code নির্যাতন করেছে এদেশে, যাঁদেরকে পরবর্তীকালে বীরাঙ্গনা বলা হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে তোমার ধারণা কেমন? কতটা জানো তাঁদের ব্যাপারে?
কিছুটা ধারণা তো আছেই। বিষয়টা নিয়ে একসময় আমি কিছু কাজও করেছি।
কী ধরনের কাজ?
লেখালেখি।
তুমি লেখক একথা তো জিল্লু বলেনি!
ঠিক লেখক না। আমার পেশা সাংবাদিকতা। দু-তিনটা এনজিওতেও কাজ করেছি। যারা বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কাজ করেন। একাত্তরে সম্ভ্রম-হারানো 888sport promo codeদের আমরা বলি ‘বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা’। অস্ত্রহাতে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁদের চেয়ে আমাদের ওই মা-বোনদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়।
ঠিক, একদম ঠিক।
আমার খুব ভালো লাগছে যে তুমি একাত্তর নিয়ে ভাবছ, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ভাবছ। এ-বিষয়ে প্রচুর কালেকশান আমার। গভীর আগ্রহ নিয়ে একাত্তরের ওইসব মা-বোন নিয়ে আমি পড়াশোনা করি।
একথাও জিল্লু আমাকে বলেনি। খুব ভালো হলো তোমাকে পেয়ে। তুমি কি আমাকে দুয়েকজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার কাছে নিয়ে যেতে পারবে? তেমন কাউকে তুমি চেনো?
বেশ অনেকজনকেই চিনি। তুমি চাইলেই নিয়ে যেতে পারব। দু-বছর ঘুরে ঘুরে ষোলোজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে আমি খুঁজে বের করেছিলাম। সারা 888sport apps তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলাম তাঁদের। সেই ষোলোজনকে নিয়ে লিখেছিলাম। তখন একটা খুব নামকরা ইংরেজি কাগজে আমি কাজ করতাম। 888sport appর আশেপাশেই আছেন কয়েকজন। ভালুকায় আছেন, কাপাসিয়া-নরসিংদীতে আছেন।
দশদিনে যে-কজনের সঙ্গে সম্ভব আমি দেখা করতে চাই। কথা বলতে চাই। কোনো একটা নদীর সামনে সম্ভব হলে আমাকে নিয়ে যেও। এদেশের মানুষ আর নদী তো একাত্ম। 888sport appsকে তো নদীমাতৃক দেশ বলা হয়!
আমি তীক্ষ্ণচোখে মারিয়ার দিকে তাকালাম। সে উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চৈত্রমাসের বিকেল শেষ হওয়া আলোয় তার বিষণ্ন মুখ আরো বিষণ্ন দেখাচ্ছে। এই মুখ দেখে আর বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তার আগ্রহের কথা শুনে আমার তখন একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে। মারিয়া ওয়ারচাইল্ড নয় তো? যুদ্ধশিশু! একাত্তরের পর ওরকম বেশ কিছু শিশু সুইডেন নরওয়ে কানাডা এইসব দেশের দরদি কাপলরা দত্তক নিয়েছিলেন। মারিয়া কি তেমন কেউ?
রুমে এসে মারিয়া বলল, কালই কি এমন কারো কাছে আমরা যেতে পারি?
পারি। ভালুকা জায়গাটা কাছে। গাজিপুরও কাছে। আজ রাতেই আমাকে তাহলে সব ব্যবস্থা করতে হবে। ভালুকাটা আমার জন্য সহজ হয়। কিরণবালাকে আমি চিনি।
কিরণবালা নাকি তাঁর নাম?
হ্যাঁ। কিরণ অর্থ আলো। বালা অর্থ মেয়ে। আমি তাঁর ইন্টারভিউ করেছিলাম।
মারিয়া উদাস গলায় বলল, আলোককন্যা।
তারপর আমার দিকে তাকাল। তুমি তাহলে ব্যবস্থা করো। দশদিনের জন্য একটা রেন্ট-এ-কার নাও। কাল সকালেই আমরা বেরুবো।
একটু সকাল সকাল রওনা দিতে পারলে ভালো। তুমি সকালে উঠতে পারবে?
নিশ্চয়। যখন বলবে তখনই উঠব।
আটটা সাড়ে আটটায় স্টার্ট করি।
কোনো অসুবিধা নেই।
মারিয়া উঠে গিয়ে হ্যান্ডব্যাগ থেকে তার পার্স বের করল। লম্বা কালো পার্সের ভিতর অনেকগুলো ক্রেডিট কার্ড। কারেন্সি রাখার জায়গাটা বেশ ফোলা। সেখান থেকে গুণে গুণে দশটা একশো ডলারের নোট বের করল। মিস্টার রবি! পাঁচশো ডলার তোমার অ্যাডভান্স আর পাঁচশো ডলার একদিনের গাড়িভাড়া আর খাওয়া ইত্যাদির খরচ। আমার কাছে বাংলা টাকাও আছে। এয়ারপোর্ট থেকে চেঞ্জ করে নিয়েছিলাম। এই হোটেলে চেঞ্জ করা যায়?
নিশ্চয় যাবে। দরকার হলে আমাকে বলো, আমি বাইরে থেকে চেঞ্জ করে আনবো।
মারিয়া আমার হাতে এক হাজার ডলার দিলো। টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমার স্বভাব হচ্ছে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’। টাকাটা নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা একটু গরম হলো। টাকার গরম। স্পিডও বেড়ে গেল। এখান থেকে বেরিয়েই সব ব্যবস্থা করে ফেলব।
বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করতে গেলে টাইমটা আমি খুবই মেইনটেইন করি। সময়ের পাঁচ মিনিট আগে স্পটে পৌঁছাই। আজো তাই করেছি। সকাল আটটার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে হোটেলে পৌঁছালাম। রিসেপশান থেকে ইন্টারকম করা হলো মারিয়ার রুমে। সে বোধহয় রেডি হয়েই ছিল। লবিতে বসে মাত্র সিগ্রেট ধরিয়েছি, মারিয়া হাজির।
গুডমর্নিং।
মর্নিং। কেমন আছ মারিয়া? ঘুম কেমন হয়েছে?
ভালো আছি। ঘুম ভালো হয়েছে। তোমার সব ঠিকঠাক?
সব ঠিকঠাক। সিগ্রেট শেষ করেই রওনা দিচ্ছি। তুমি ব্রেকফাস্ট করেছ?
করেছি। তুমি চাইলে এককাপ চা খেয়ে নিতে পারো।
দরকার নেই। সকালবেলা দু-কাপ খেয়েছি। আর একটা কথা তোমাকে বলে রাখি। আমাদের দেশের সর্বত্রই রাস্তার ধারে, হাট-বাজারে চায়ের দোকান থাকে। অসাধারণ চা তৈরি হয় সেসব দোকানে। গরুর দুধের চা খেতে দারুণ। ওই চা আমি খুবই এনজয় করি। তুমি খেয়ে দেখো। ভালো লাগবে।
তার আগে বলো তো, আমাকে কেমন লাগছে? বাঙালি মেয়ে মনে হচ্ছে?
সিগ্রেটে টান দিয়ে আমি হাসিমুখে মারিয়ার দিকে তাকালাম। সে পরেছে হালকা বেগুনি রঙের সুতি সালোয়ার-কামিজ। ওড়না নিয়েছে বাঙালি মেয়েদের ভঙ্গিতে। কাঁধের ব্যাগটা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েরা যে-ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করে তেমন। পোশাকের সঙ্গে মানানসই জুতো পায়ে। আমি একটু অবাকই হলাম।
এরকম পোশাক না পরলেও হতো।
আমি চাইছি দেখে কেউ যেন আমাকে বিদেশি না মনে করে।
কিন্তু কথা বললেই তো বুঝে যাবে তুমি বিদেশি। বাংলা বলতে পারো না?
শুধু একটা শব্দ বলতে পারি।
কী সেটা?
এখন বলব না। সিগ্রেট শেষ হয়েছে না? চলো রওনা দিই।
সিগ্রেটটা আরো দু-টান খাওয়া যেত। ওই অবস্থাতেই অ্যাশট্রেতে চেপে উঠে দাঁড়ালাম। চলো।
আমার পরনে জিনস আর আকাশি রঙের পলো শার্ট। পায়ে কেডস। পিঠে হ্যাভারস্যাক। মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে। সিগ্রেটের প্যাকেট লাইটার ইত্যাদি হ্যাভারস্যাকের সাইড পকেটে।
এনজিওতে কাজ করার সময় থেকে সাজ্জাদের সঙ্গে আমার পরিচয়। আমার চেয়ে দু-তিন বছরের ছোট হবে। স্বাস্থ্যবান, প্রাণবন্ত যুবক। সৌদিতে ড্রাইভারি করেছে সাত বছর। ফিরে এসে নিজেই একটা নোয়া মাইক্রোবাস কিনে চালাচ্ছে। বাঁধা কিছু ক্লায়েন্ট আছে। বেশিরভাগই এনজিও। তাদের কাজই করে। সারাদেশ চষে বেড়ায়। লেখাপড়া জানা ছেলে। ব্যবহার অত্যন্ত চমৎকার। সুন্দর করে কথা বলে। আমার খুবই ভক্ত। কী কারণে জানি না। ডাকলেই সাজ্জাদকে পাই। অতি জরুরি কাজ না থাকলে, ক্যান্সেল করার স্কোপ থাকলে সেই কাজ ক্যান্সেল করে আমার কাজে চলে আসে।
আজো এসেছে।
এখান থেকে বেরিয়ে কাল রাতে প্রথম ফোনটাই সাজ্জাদকে করেছিলাম। সব শুনে বলল, চলে আসবো স্যার।
তোমার কোথাও কাজ নেই তো?
কাজ একটা আছে স্যার। শ্রীমঙ্গল যাওয়ার কথা। সেটা ক্যান্সেল করা যাবে। গাড়িটা হঠাৎ গড়বড় করছে। গ্যারেজে দিতে হবে বলে কাট্টি মারতে পারব।
কাট্টি তাহলে মারো। দশদিনের কাজ। টাকা-পয়সা কী নেবে বলো?
ওসব আপনি ঠিক করবেন স্যার। কখন আসতে হবে বলেন।
গাড়ির খুবই যত্ন নেয় সাজ্জাদ। একবার আমাকে বলেছিল, গাড়িটা ওর সন্তানের মতো। ছোট্ট একটা মেয়ে আছে তার। গাড়িটা হলো তার ছেলে। মেয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে। ছেলে থাকে তার সঙ্গে।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর মারিয়া বলল, গাড়িটা ভালো নিয়েছ।
তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ। ড্রাইভারও ভালো মনে হচ্ছে। ভালো ড্রাইভ করছে। একদমই রাফ না। এই ধরনের ড্রাইভিং আমি পছন্দ করি। আচ্ছা মিস্টার রবি …
কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি তাকে থামিয়ে দিলাম। শুধু রবি। নো মিস্টার।
ভাবছিলাম হেসে কথাটা মেনে নেবে মারিয়া। ওকে ওকে করে কথাটা সে মেনে নিল কিন্তু হাসল না। মেয়েটার মুখে হাসিটা নেই। এই বয়সী মেয়ের মুখে হাসি থাকবে না কেন?
মারিয়া তোমার বয়স কত?
চৌত্রিশ।
হাসো না কেন?
ভেবেছিলাম আমার প্রশ্ন শুনে বিব্রত হবে সে। বা একথায় হয়তো হাসবে। কোনোটাই হলো না। নির্বিকার গলায় বলল, শিশু বয়সেই আমি হাসতে ভুলে গেছি।
কী কারণ? প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলাম না। এত ব্যক্তিগত বিষয় জানার দরকার কী? দশদিন আমি তার গাইড হিসেবে কাজ করব। টাকা যা পাবো তাতে আমার মাসদুয়েক চলবে। ততোদিনে চাকরিও কোথাও একটা হয়ে যাবে। চাকরি আমি যেমন হুট করে ছাড়ি তেমন হুট করে পেয়েও যাই। এবার যে-চেষ্টাটা করছি সেটা যদি হয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই। জীবনটাই বদলে যাবে।
রবি।
বলো।
কিরণবালা সম্পর্কে তুমি কি আমাকে বিস্তারিত বলতে পারো?
হ্যাঁ নিশ্চয়।
তার আগে তোমাকে বলি, আজ সকালে হোটেল থেকে আমি বেরিয়েছিলাম। উঠেছি ছটার দিকে। উঠেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
বন্ধুদের সঙ্গে?
আরে না না। হোটেলে ঢোকার পর ওদের সঙ্গে আমার আর দেখাই হয়নি। ওরা জানে আমি একটু একলা থাকতে পছন্দ করি। ওরাও আমাকে ডিস্টার্ব করেনি। জনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। ওরা জানে আমি আজ সকালে তোমার সঙ্গে বেরুবো।
তার মানে ভোর ছটায় তুমি একা বেরিয়েছিলে?
হ্যাঁ। দূরে কোথাও যাইনি। রাজারবাগ এলাকাটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পুলিশ লাইন্সের ভেতরে ঢুকিনি। বাইরে থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। একাত্তরে এলাকাটা যেমন ছিল এখন নিশ্চয় তেমন নেই। তবে কল্পনায় সেই সময়টা আমি দেখতে পেয়েছি। গুগল ফেইসবুক উইকিপিডিয়া এসব সার্চ দিয়ে দিয়ে 888sport appsের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি অনেক তথ্য জেনেছি। জায়গাটা ঘুরে দেখতে দেখতে মনটা কেমন হয়ে গেল! পাকিস্তানিরা যেসব মেয়েকে এখানে ধরে এনে আটকে রেখেছিল তাঁদের প্রত্যেকের মুখ আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম তাঁদের আর্তনাদ আর মরণচিৎকার। সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে কাউকে কাউকে। পরনে কাপড় নেই। পা ওপরের দিকে, মাথা নিচে। রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝে। কারো স্তন কেটে নেওয়া হয়েছে। গোপন অঙ্গ ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে বেয়নেট চার্জ করে। আমি তাঁদের দেখতে পাচ্ছিলাম।
মারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই মহিলাটিকে দেখতে পেলাম চোখের সামনে। যিনি নিজেও তার সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। তারপরও পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন মেয়েগুলোকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল সেখানটায়। পিশাচগুলোর নানা রকমের কাজও তাঁকে করে দিতে হতো। কোনো মেয়ে মারা গেলে তাঁর লাশ টেনে তুলে দিতে হতো গাড়িতে। মেয়েগুলো মরছিল শারীরিক যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে আর তিনি মরছিলেন চোখের সামনে এরকম নারকীয় কা- দেখে দেখে। কখনো কখনো নরপশুদের চোখ এড়িয়ে মেয়েগুলোকে সাহায্য করারও চেষ্টা করতেন তিনি। আহারে সেই মানুষটা!
তাঁর নাম রাবেয়া। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন।
হ্যাঁ। রাবেয়া। মহীয়সী 888sport promo code। তুমি আমাকে কিরণবালার কথা বলো, রবি। তুমি তাঁর ইন্টারভিউ করেছিলে, লিখেছিলে তাঁর ওপর। নিশ্চয় তুমি বিস্তারিত জানো। যেতে যেতে শুনি তাঁর কথা।
দশ বছর বয়সে কিরণবালার বিয়ে হয়েছিল।
মারিয়া অবাক। দশ বছর বয়সে? ওইটুকু বয়সে বিয়ে হয় কী করে? সে তো তখন একেবারেই শিশু।
এই উপমহাদেশে একসময় ওরকমই হতো। এখন আঠারো বছর বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ 888sport appsে। তারপরও গ্রাম এলাকায় লুকিয়ে-চুরিয়ে বারো-চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। পনেরো-ষোল বছর বয়সে মা হয়ে যাচ্ছে তারা। হিন্দু-মুসলিম দুই শ্রেণির মধ্যেই এসব হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে। যাদের খাওয়া-পরার অভাব। মেয়ে একটু সুন্দরী হলে অন্য রকমের সমস্যা। চারপাশের পুরুষরা ছোঁক-ছোঁক শুরু করে। ইভটিজিং, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া। শিশুবয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার এটাও একটা কারণ।
বুঝেছি।
যে-গ্রামে কিরণবালা জন্মান সেই গ্রামের নাম সাঁকোয়া। বিয়ে হলো ভালুকা থানার নয়নপুর গ্রামে। মল্লিকপুর ইউনিয়ন। কিরণবালার স্বামী মল্লিকপুর বাজারে নরসুন্দরের কাজ করতেন। এটাই তাঁদের পৈতৃক ব্যবসা। নাম ছিল সতীশচন্দ্র বিশ্বাস। পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে হলো কিরণবালার। কয়েক বছর পর মাও হয়ে গেলেন। ছেলে হলো। ছেলের নাম সুকুমার বিশ্বাস। ছেলের বয়স যখন চার-পাঁচ মাস তখন শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। পঁচিশে মার্চের রাতে অপারেশান সার্চলাইট নামে 888sport app শহরে গণহত্যা শুরু করল পাকিস্তানিরা।
ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে গেল তারা। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করতে লাগল। লুটপাট অগ্নিসংযোগ আর 888sport promo code নির্যাতন। সেই সময়টা যারা না দেখেছে তারা ঠিক বুঝতে পারবে না, মানুষের মতো দেখতে পাকিস্তানি জন্তুগুলো কী করেছিল এই দেশে। শহর ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে গেল তারা। প্রত্যন্ত গ্রামেও হানা দিতে লাগল। এক-দুদিন পরপর কিরণবালাদের গ্রামেও আসতো। ছেলে-কোলে এদিক-ওদিক দৌড়ে পালাতেন কিরণবালা। পুরো গ্রাম, পুরো এলাকার লোকজনই পালাচ্ছে। পুরুষমানুষ পেলে গুলি করে মারছে আর মেয়েদের পেলে, যেখানে পাচ্ছে সেখানেই নির্যাতন করছে। গুলি করে মারছে। পছন্দ হলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতন।
ওরকম একদিন মিলিটারি আসার খবর পাওয়া গেল। কিরণবালার ছেলেটি তাঁর মায়ের কোলে। তাঁর শাশুড়ি ছিলেন না। মারা গেছেন। বাচ্চা হওয়ার পর মা এসে থাকতেন কিরণবালার কাছে। ওই অবস্থায় যে যেদিকে পারেন ছুটতে লাগলেন। কিরণবালা গেলেন একদিকে, মা আরেকদিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে কিরণবালা চলে এলেন মহানন্দপুর গ্রামে। সেখানেও মিলিটারি। সেখান থেকে আবার ছুট। এবার চলে এলেন তালাব নামের এক গ্রামে। তালাব একেবারেই অজপাড়াগাঁ। এই গ্রামেই অনেকের সঙ্গে মিলিটারিরা ধরে ফেলল কিরণবালাকে। তালাব থেকে পশ্চিমে অনেকটা দূরের একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। জায়গাটার নাম কিরণবালা জানেন না। সেখানে তিনদিন আটকে রাখা হয় তাঁদের। তিনদিন ধরে অবিরাম চলে নির্যাতন। উপর্যুপরি নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন কিরণবালা। যখন জ্ঞান ফিরত তাঁর মনে পড়তো বুকের সন্তানটির কথা। স্বামীর কথা। শ্বশুরবাড়ির লোকদের কথা। কে কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে। জ্ঞান ফেরার পর হয়তো এইসব ভাবছেন কিরণবালা আর তখনই হয়তো সেই ঘরে এসে ঢুকল জন্তুরা। শুরু হলো তাদের পৈশাচিকতা। ধীরে ধীরে আবার জ্ঞান হারালেন কিরণ …
মারিয়ার বিষণ্ন মুখ আরো বিষণ্ন হয়েছে। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে সে তাকিয়ে আছে বাইরে। আমরা উত্তরা ছাড়াচ্ছি। একটানা কথা বলে যাচ্ছি আমি। ইংরেজিটা বাংলার মতোই তরতর করে বলতে পারি বলে বেশ গুছিয়ে বলে যাচ্ছি। কিরণবালার কথা বলতে বলতে নিজেও যেন চলে যাচ্ছি সেই সময়ে। আমাদের সবচেয়ে গৌরবের দিনগুলো, আমাদের সবচেয়ে বেদনার দিনগুলো। মারিয়ার মন ভারাক্রান্ত হচ্ছে কিরণবালার কথা শুনে। আমার মন ভারাক্রান্ত হচ্ছে তাঁর কথা বলতে বলতে।
মারিয়া আমি কি একটা সিগ্রেট ধরাতে পারি?
মারিয়া আমার দিকে তাকাল। পারো।
জানালা খুলে দিই। নয়তো তোমার অসুবিধা হবে।
দাও।
সাজ্জাদ, জানালার গ্লাস নামিয়ে দাও।
দিচ্ছি স্যার।
সিগ্রেট ধরিয়ে বড় করে টান দিলাম। এসি গাড়ির জানালা খুলে দিলে হঠাৎ করে পরিবেশটা বদলে যায়। শোঁ শোঁ হাওয়ার শব্দ কান সহজে গ্রহণ করতে চায় না। এখন অবস্থাটা তেমন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।
রবি, বলো। তারপর?
তিনদিন পর অন্য এক ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় কিরণবালাদের। কোথায় সেই ক্যাম্প, কী নাম জায়গার কিছুই জানেন না তাঁরা। বোধহয় সেটা একটা স্কুলবাড়ি। দালানঘরগুলো লম্বা লম্বা, পুরনো দিনের। চারদিকে দেয়ালঘেরা। মাঠ আছে সামনে, ভিতর দিকে আছে উঠোন। গাছপালা আছে বড় বড়। যে-ঘরটায় কিরণবালাদের আটকে রাখা হয়েছিল তার সঙ্গেই বড় একটা আমগাছ। বেশ ছড়ানো ডালপালা। জানালা দিয়ে কখনো কখনো সেই গাছটার দিকে তাকাতেন কিরণবালা। তাঁর মতো তেরোজন এই এক ঘরে আটক। একেকজনকে একেক জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছে। কেউ কাউকে চেনেন না। কেউ কারো সম্পর্কে কিছুই জানেন না। শুধু জানেন তাঁরা বাঙালি। তাঁদের ধরে এনেছে পাকিস্তানি জন্তুরা। অবিরাম খুবলে খুবলে খাচ্ছে তাঁদের। কখনো পাঁচ-দশ মিনিট সময় পেলে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতেন। চোখের জল বাঁধ মানতো না। একজনের চোখের জল কথা বলতো আরেজনের চোখের জলের সঙ্গে। হয়তো তখনই দরজা খোলার শব্দ। জন্তুরা এসে ঢুকল। দিন নেই, রাত নেই। চলছে নির্যাতন। কিছু বলার ক্ষমতা নেই। বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। অসহায় চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকছেন কিরণবালারা। অত্যাচার চলছে। ধীরে ধীরে চেতনা লোপ পাচ্ছে। জ্ঞান হারাচ্ছেন একেকজন।
শুধু কি সেই বীভৎস অত্যাচার? অত্যাচারের সঙ্গে ঘৃণাও করছে। ভাবলে হাসি পায়। জন্তুরা ঘৃণা করছে মানুষকে। শূকররা ঘৃণা করছে মানুষকে!
মারিয়া শুকনো ম্লান গলায় বলল, কী রকম ঘৃণা?
কিরণবালা আমাকে যা বলেছেন তা হচ্ছে, ধরো জন্তুদের একটা ঢুকেছে সেই ঘরে। ঢুকে এক এক করে তেরোজন মেয়ের মুখ দেখেছে। অর্থাৎ কার চেহারা ভালো। কোনো কোনো শুয়োরের বাচ্চা মেয়েদের কাপড় খুলে দেখেছে। যাকে পছন্দ হয়েছে তাকে ধরেছে। নির্যাতন করে সেই মেয়েকেই দিলো কয়েকটা লাথি। থুতু ফেলল একদলা। যেন খুবই ঘেন্না হয়েছে হারামজাদার। রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারতো। যাদের হাতে রুল থাকতো, সেটা দিয়ে পিটাতো।
আমি মারিয়ার দিকে তাকালাম। তুমি সহ্য করতে পারছ মারিয়া?
মারিয়া বিষণ্ন গলায় বলল, সহ্য করা কঠিন। তারপরও আমি শুনতে চাই। যত কষ্টই হোক, আমি শুনবো। তুমি বলো।
কখন আমার হাতের সিগ্রেট শেষ হয়েছে, কখন শেষ অংশ ফেলে দিয়েছি কিছুই খেয়াল নেই। সাজ্জাদ খুবই স্মার্ট ছেলে। সে খেয়াল করেছে। উইন্ডোগ্লাস তুলে দিয়েছে।
বাইরে শেষ ফাল্গুনের মনোরম রোদ। চৌরাস্তা পেরিয়ে ছুটছে আমাদের গাড়ি। এদিককার রাস্তা অসাধারণ। রাস্তার দু-ধারে গাছপালা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আইল্যান্ডে নানারকম ফুল-পাতাবাহারের ঝাড়। বসন্তদিনের হাওয়ায় দোল খাচ্ছে ঝোপঝাড় আর গাছের পাতা।
মারিয়া কোথাও নামবে? চা খাবে একটু?
আর কতক্ষণ লাগতে পারে?
ঘণ্টাখানেক।
তোমার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে?
এখন এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না। চা খেয়ে কিরণবালার কাছে শোনা দুটো ঘটনা বলব তোমাকে। মন শক্ত রেখো। দুটো ঘটনাই নৃশংসতার চূড়ান্ত।
ঠিক আছে।
সাজ্জাদ, রাস্তার ধারে চায়ের দোকান দেখলে থামিয়ো।
জি আচ্ছা স্যার।
দু-তিন মিনিটের মধ্যেই ওরকম একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। পরিবেশটাও ভালো। গাছপালা আর সবুজ ঘাসের একটা মাঠ আছে দোকানটার পাশে। আমরা নামলাম।
গরুর দুধের চা পাওয়া গেল। দোকানি লোকটা চা খুব ভালো বানায়। আমার খুবই ভালো লাগল। কাপে দু-তিনটা চুমুক দিয়ে মারিয়াকে বললাম, কেমন চা?
টেস্টি।
আমি আরেক কাপ খাবো। তুমি খাবে?
না।
সাজ্জাদ?
না স্যার।
দ্রুত চা শেষ করে দোকানের পিছনদিককার ঝোপঝাড় আর গাছপালার ছায়াভরা জায়গাটায় জল বিয়োগ করতে গেল সাজ্জাদ। দ্বিতীয় কাপ চায়ের সঙ্গে আমি সিগ্রেটও ধরিয়েছি। মারিয়াকে দেখছি আগের চেয়েও উদাস। বিষণ্নতা তো আছেই। গাড়ির জানালা দিয়ে একদৃষ্টে সে বাইরের দিকটা দেখছিল। বুঝতে পারছিলাম সে 888sport appsটা দেখার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে কান পেতে রেখেছে আমার দিকে। কিরণবালার কথা শুনছে। মেয়েটি খুবই অন্যরকম। কী যেন এক বেদনা নিজের ভিতর লুকিয়ে রেখেছে। মুখে সেই বেদনার ছাপ খেয়াল করে তাকালেই দেখা যায়। চোখেও ছায়া ফেলে রেখেছে বেদনা।
আমার আবার সেই কথাটা মনে হলো। মারিয়া ওয়ারচাইল্ড নয় তো?
গাড়িতে চড়েই মারিয়া বলল, ঘটনা দুটো বলো।
দু-কাপ সুস্বাদু চা আর সিগ্রেট টেনে আমি খুবই চাঙা হয়েছি। যদিও দুটো মর্মান্তিক ঘটনা এখন বলতে হবে আমাকে। বুক তোলপাড় করবে। তবু বলতে হবে। সাংবাদিকতা করেছি অনেকদিন। সাংবাদিকদের মন একটু শক্তই হয়। শক্ত মন নিয়েই আমি শুরু করলাম।
তেরোজনের মধ্যে একটি মেয়ে খুবই সুন্দরী ছিল। বয়সও কম। ক্যাম্পের জন্তুগুলো ওকেই পছন্দ করতো বেশি। একসঙ্গে তিন-চারজন করে ঢুকতো। ওই মেয়েটিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হতো। নির্যাতন ওর ওপর দিয়েই বেশি যেত। একসঙ্গে সবগুলো ঝাঁপিয়ে পড়তো। কে কীভাবে নির্যাতন করবে দিশা পেত না। পরে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে লাইন ধরতো। একের পর এক …
এরকম একদিন মেয়েটি আর সহ্য করতে পারছিল না। সর্বশক্তি দিয়ে একটাকে দিলো এক লাথি। লাথি খেয়ে সেটা ছিটকে পড়ল ঠিকই কিন্তু দমলো না। উঠে এসে নির্যাতন শেষ করল, মেয়েটিকে যতরকম কষ্ট দেওয়া যায় সেইসব কষ্ট দিয়ে। তারপর শুধু লাথি। লাথির পর লাথি, লাথির পর লাথি। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিরণবালারা ভাবলেন, যাক, মেয়েটা বোধহয় বেঁচে গেল।
না। তখনো কেউ ভাবেনি, ভাবেনি কি, কল্পনাও করেনি কী ঘটতে যাচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর আর একটা জন্তুকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো বুনো শূকরটি। সঙ্গীর হাতে অ্যালুমিনিয়ামের গরম হাঁড়ি। তাতে তিনটা সিদ্ধ ডিম। ঘরে ঢুকে প্রথমে বুটপরা পায়ে অবিরাম লাথি মারতে লাগল মেয়েটিকে। তারপর সঙ্গীকে বলল মেয়েটিকে চেপে ধরতে। আর নিজে এক এক করে তিনটা সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিলো …
মারিয়া দিশেহারা ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। আমার একটা হাত চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বলল, না না না। আমি আর শুনবো না। প্লিজ আর বলো না। আর বলো না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।
আমার গলা জড়িয়ে আসছিল। বুকটা কেমন ভার হয়ে গেছে। ধরা গলায় বললাম, কিরণবালারা তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখছেন আর চোখের জলে ভাসছেন। মেয়েটির চিৎকার আর আর্তনাদে সাত আসমান পর্যন্ত কাঁপছিল। কিরণবালার মনে হচ্ছিল সেই মেয়ের আর্তনাদে ঘরের দেয়াল ধসে পড়বে। বাইরের আমগাছটির সব পাতা খসে পড়বে। তারপর আর আর্তনাদ করার শক্তিও ছিল না সেই মেয়ের। শূকর দুটো চলে যাওয়ার পর মেয়েরা সবাই গেল তাঁর কাছে। গিয়ে দেখে জ্ঞান নেই। পরদিন সেই শূকরটা আবার এলো। সঙ্গে আগের দিনের সঙ্গীটিও আছে। এসে দেখে মেয়েটির অবস্থা খুবই খারাপ। ওই বিশেষ নির্যাতনটি তাঁকে করা যাবে না। তখন শুরু করল আরেক নির্যাতন। আগের দিন অস্ত্র ছিল সিদ্ধ ডিম, আজ হলো রাইফেলের নল। আর দ্বিতীয় শূকরটি বুটপরা পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে মেয়েটির পেটের ওপর। গরু জবাই করলে যেমন রক্তের ধারা ছোটে, মেয়েটির শরীরের রক্ত সেই ভাবে মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছিল।
ভয়ার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মারিয়া। মুখটা হা হয়ে আছে, চোখে পলক পড়ে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, মেয়েটি তখন আর নড়ছে না। ওই অবস্থায় পড়ে থাকল তিনদিন। কিরণবালারা নাকের সামনে হাত দিয়ে দেখতেন। তখনো বেঁচে আছে। তিনদিন পর সব শেষ। শূকরের দল কোথাও ফেলে দিয়ে এলো সেই মেয়েকে!
বুঝতে পারছিলাম, মারিয়া কাঁদতে চাইছে কিন্তু পারছে না। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া অবস্থা। ড্রাইভিং সিট থেকে দুবার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুনেছি সাজ্জাদকে। লেখাপড়া জানা ছেলে। ইংরেজিতে বলা কথার কিছু কিছু নিশ্চয় বুঝেছে।
আমার হাত ছেড়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে মারিয়া। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
মারিয়া। অন্য ঘটনাটা শুনবে?
শুনতে চাই না। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
এ একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা। তাঁকে ধরে আনা হয়েছিল ওই ক্যাম্পে। নিজের জীবন তুচ্ছ করে একটি মেয়ে কীভাবে দাঁড়িয়েছিল সেই বীরের পাশে, শুনবে? কিরণবালাই বলেছিলেন।
বলো শুনি।
যে-নির্যাতন করে সেই মেয়েটিকে মেরেছিল, তারপর থেকে কিরণবালারা ওই অবস্থাতেই আরেকটু বেশি সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। নির্যাতন সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে যেতেন। তাও মুখ খুলতেন না। শুধু চোখের পানি ঝরতো। একটা পর্যায়ে চোখের পানিও শুকিয়ে গিয়েছিল। কাঁদতেও পারতেন না। কত রকমের শারীরিক নির্যাতন! ওসব বলাও যাবে না। শূকরগুলো ঘরে ঢুকতো আর ভয়ে-আতঙ্কে জড়সড় হয়ে যেতেন ওরা। দৈত্যের মতো একেকটা জন্তু। প্রতিদিনই গাড়ি ভরে মানুষ ধরে আনতো। পুরুষগুলোকে মেরে ফেলতো। মেয়েগুলোকে রেখে দিত। তাঁদের অনেকে নির্যাতনেই মারা যেতেন। রাতের বেলা ট্রাক ভর্তি করে সেইসব লাশ নদীতে ফেলে আসতো।
একদিন একজন পুরুষমানুষকে ধরে আনলো। মানুষটা দেখতে সুন্দর। ভালো কাপড়চোপড় পরা। দেখেই বোঝা যায় বড়ঘরের শিক্ষিত মানুষ। সারা দিনরাত একটা ঘরে আটকে রেখে তাঁকে নানা রকমের প্রশ্ন করতো। কোনো একটা কথা তাঁর কাছ থেকে বের করতে চায়। সে একদম বোবা। কথা বলে না। একটাও শব্দ করে না। তারপর শুরু হয় তাঁর ওপর অত্যাচার। হাত-পা-চোখ বেঁধে ঘরের মেঝেতে ফেলে রেখেছে। চার-পাঁচদিন চলল এরকম। কথা বের করার চেষ্টা চলছে। তিনি কথা বলেন না। অমানুষিক অত্যাচারে জ্ঞান হারান। জ্ঞান ফিরে এলে আবার সেই অত্যাচার। বীভৎস মার। তিনি নির্বিকার। অত্যাচার সহ্য করছেন মুখ বুজে। পাঁচদিন পর শূকরদলের হোমরা-চোমরা একটা এলো ক্যাম্পে। তাঁর বাঁধন খুলে দিলো। আবার কথা বের করবার চেষ্টা। না, তিনি বোবা। কথা বলবেনই না। শুরু হলো অকথ্য মার। এক পর্যায়ে কথা বললেন তিনি। পানি, পানি। মারের চোটে তাঁর দাঁত পড়ে গেছে। চোখ ফুলে 888sport app পড়ে গেছে। নাকের জায়গায় নাক নেই, ঠোঁটের জায়গায় ঠোঁট নেই। মাথা-কপাল ফাটা। একটা কান ছিঁড়ে ঝুলছে। হাত-পা ভাঙা। উঠে দাঁড়াতে পারেন না। মেঝেতে পড়ে থাকা মানুষটির চারপাশে রক্ত। কাতর অনুনয় করছেন। পানি, পানি। শুয়োরটা অন্য একটি শুয়োরকে ইশারা করল। সে প্যান্টের জিপার খুলে প্রস্র্রাব করতে লাগল তাঁর মুখে। অন্য দুটি শুয়োর তাঁকে চেপে ধরে রাখল। এসময় কী যেন একটা খবর এলো। অফিস রুম থেকে ছুটে এসে আরেকটি শূকরছানা খবরটা দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বেরিয়ে এলো সবাই।
গাড়ি নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেল। শুধু কয়েকটি রাজাকার রইল পাহারায়। সেগুলোও কী রকম যেন চিন্তিত। আমাদের রুমের দিকে আসছেই না। অফিসঘরে আর গেটের দিকে চলে গেছে। এই সুযোগে কিরণবালারা কয়েকজন গেলেন সেই মানুষটার কাছে। অর্থাৎ মেয়েদের মধ্যে যাঁরা তখনো হাঁটাচলার অবস্থায় আছেন তাঁরা কয়েকজন গেলেন। মানুষটা ইশারায় বোঝাতে চাইলেন, পানি, পানি। কিন্তু কিরণবালারা কেউ ভয়ে তাঁকে পানি দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। যদি রাজাকাররা দেখে ফেলে তাহলেই তো ওদের প্রভুদের কানে তুলবে। তাহলে আর রক্ষা নেই। সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মারবে। অল্পবয়সী একটা মেয়ে ছিল দলে। তাঁর নাম মরিয়ম অথবা জরিনা। সে ছুটে গিয়ে একগ্লাস পানি নিয়ে এলো। মানুষটার মাথাটা কোলে টেনে গভীর মমতায় পানিটা খাওয়ালো। জিজ্ঞেস করলো আরো পানি খাবে কি না। মানুষটা উত্তর দিলেন না। কদিন ধরে না-খাওয়া। তার ওপর চলছে এই অত্যাচার। মেয়েটির তখন নিজের জীবনের কথা মনে নেই। সে ছুটে গেল রান্নাঘরে। ভাত-তরকারি যা পেল একটা থালায় করে এনে মা যেমন করে অসুস্থ শিশুকে খাওয়ায় ঠিক সেইভাবে খাওয়ালো। ওই অবস্থাতেই মানুষটা গোগ্রাসে খেলেন। যতদ্রুত সম্ভব পুরো প্লেটের ভাত খেয়ে ফেললেন। কিরণবালারা ততোক্ষণে সেই ঘর থেকে চলে এসেছেন। নিজেদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে ইশারায় ডাকছেন। তাড়াতাড়ি চলে আয়। যদি ওরা দেখে ফেলে তাহলে আর রক্ষা নেই। এখনই মরবি। এক পর্যায়ে কিরণবালা ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে হাত ধরে টানলেন। মানুষটা তখন কী যেন বলতে চাইছেন মেয়েটিকে। মেয়েটি তাঁর মুখের কাছে কান নিয়ে শুনল। কিরণবালাকে বলল, তুমি ওইদিকে খেয়াল রাখো। আমি তাঁর কথাটা শুনে রাখি। খুবই জরুরি কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এই খবরটা আমাকে পৌঁছাইতে হবে। মেয়েটি সেই খবর জায়গামতো পৌঁছাতে পেরেছিল কি না জানতে পারেননি কিরণবালা। তার কিছুদিন পর দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। স্বাধীন হওয়ার তিনদিন আগে শূকরের দল ক্যাম্প ফেলে পালায়। মুক্তিযোদ্ধারা এসে কিরণবালাদের মুক্ত করেন।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল মারিয়া। সেই মানুষটার শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল?
তুমি বুঝতেই পারছো তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর কাছ থেকে ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হদিস বের করবার চেষ্টা করছিল পাকিস্তানিরা। সেই কারণেই ওরকম অত্যাচার। তিনি মুখ খোলেননি। শেষ পর্যন্ত যে পৈশাচিক কাণ্ডটা শূকরগুলো করলো, শোনো সেটা। বলি। তবে মন শক্ত রেখো।
আমি বোধহয় তোমার কথা শুনতে শুনতে কিছুটা শক্ত হয়েছি। তুমি বলে যাও। কোনো কিছু লুকিয়ো না।
ঠিক আছে। পরদিন পাকিস্তানিরা আবার চেষ্টা চালালো তাঁর কাছ থেকে কথা বের করবার। অফিসার তাঁকে বলল, যা জানতে চাই বললে তোমাকে ছেড়ে দেব। তিনি আগের মতোই বোবা। কথা বলেন না। রক্তাক্ত ফোলা চোখের ফাঁক দিয়ে কোন দিকে যে তাকিয়ে থাকেন! শূকরগুলো একসময় আর সহ্য করতে পারল না। কিরণবালাদের ঘরের পাশের আমগাছটার ডালায় ঝুলানো হলো তাঁকে। পা ওপরে মাথা নিচে। তারপর চাবুক দিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে যে যেভাবে পারছে মারছে। বেয়নেট চার্জ করছে। মানুষটার নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে মাটিতে ঝরছে রক্ত। আমগাছতলা লাল হচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই আমগাছে ঝুলন্ত অবস্থায় কখন যে মারা গেলেন মানুষটা, কিরণবালারা কেউ টেরই পেলেন না। জানালা দিয়ে ওই দৃশ্য দেখেছিলেন তাঁরা। চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তাঁদের।
কাতর শব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মারিয়া।
একটা জমজমাট বাজারের সামনে এসেছে গাড়ি। আমি সাজ্জাদকে বললাম, কোথায় এসেছ?
সিডস্টোর বাজার। এখান থেকে পশ্চিমদিককার রাস্তায় ঢুকতে হবে।
মল্লিকবাড়ি বাজারটা তুমি চেনো?
চা খাওয়ার পর একজনের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিয়েছি স্যার। ওই যখন দোকানটার পিছনদিকে যাচ্ছিলাম।
ভেরি গুড। মল্লিকবাড়ি বাজারের বটগাছতলায় দাঁড়াবে। বটগাছটা রাস্তার ধারেই। ওখানে লোক থাকবে। ভালুকায় আমার সাংবাদিক বন্ধু আছে মনির। কালরাতে তাকে ফোন করেছিলাম। সে ব্যবস্থা করে রেখেছে। ওর লোক আমাদের স্পটে নিয়ে যাবে।
এতক্ষণ একটানা ইংরেজি বলার পর নিজের ভাষায় সাজ্জাদের সঙ্গে কথাগুলো বলে খুব ভালো লাগলো।
এই রাস্তায় কিছুদূর যেতেই দুপাশে ছাড়া ছাড়া কিছু বাড়িঘর আর ধানক্ষেত। প্রচুর কাঁঠালগাছ বাড়িগুলোতে। এলাকাটা কাঁঠালের। লাল মাটির এলাকা। এই মাটিতে কাঁঠালগাছ বেশি হয়। বাঁশঝাড় আছে অনেক বাড়িতে। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ আর শিমুলগাছ আছে। জারুল আছে। ফুলে ফুলে ভরে আছে গাছগুলো। গৃহস্থবাড়ির মাটির ঘরগুলো ফাল্গুন মাসের রোদে মায়াময় হয়ে আছে। বাড়ির আঙিনায় নানা রকমের সবজির মাচান। শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ। সরু একটা খাল চলে গেছে গ্রামের ভিতর দিয়ে। পানিটা দোয়াতের কালির মতো কালো। বহু রকমের কেমিক্যাল ইত্যাদির মিশ্রণে এই অবস্থা পানির। এদিকটায় নানা রকমের মিল-কারখানা হয়েছে। সেইসব মিল-কারখানার বর্জ্য এই খাল দিয়ে নেমে যাচ্ছে দূরের নদীতে। খাল তো মরেছেই নদীও মরতে বসেছে। পথের ওপর পুরনো ছোট্ট ব্রিজ। একপাশের রেলিং প্রায় ধসে পড়েছে। অন্য পাশেরটা ভাঙাচোরা।
মারিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ব্রিজটার কাছে আসার পর আমার দিকে তাকাল। ফিরে এসে পরিবারের সবাইকে পেয়েছিলেন কিরণবালা?
না, শুধু তাঁর মাকে পেয়েছিলেন। মায়ের কোলে পেয়েছিলেন তাঁর ছেলেটিকে। শ্বশুরবাড়িতে সাতজন মানুষের সংসার ছিল। শাশুড়ি আগেই মারা গিয়েছিলেন। সেইদিনই সংসারের বাকি পাঁচজনকে হত্যা করেছিল জন্তুরা। কিরণবালার স্বামী আর শ্বশুরকে হত্যা করল মল্লিকবাড়ি বাজারে। বাকিদের গ্রামের বাড়িতে। ওদিকে কিরণবালার দুই ভাইকে হত্যা করা হলো তাদের গ্রামে। কিরণবালার বাবাকে হত্যা করা হলো।
একটু থেমে বললাম, স্বাধীন হয়েছে দেশ। কিন্তু কিরণবালার তো কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল জন্তুরা। এখন ছেলে আর মাকে নিয়ে খেয়েপরে বেঁচে থাকা। কিরণবালা মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ শুরু করলেন। ছেলে থাকে মায়ের কাছে। কোনো রকমে একটা কুঁড়েঘর তুলে দিয়েছে গ্রামের লোকে। সেই ঘরে একবেলা খেয়ে আর উপোস দিয়ে ছেলেটাকে বড় করতে লাগলেন। পাকিস্তানিরা যে অকথ্য নির্যাতন করেছিল সেই নির্যাতনের 888sport sign up bonus শরীরে, অন্যদিকে ছেলে নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ। যুদ্ধটা করে গেলেন কিরণবালা। দিনে দিনে দিন কেটে গেল। ছেলে বড় হলো। বাপ-দাদার পেশা ধরল। নরসুন্দর। মল্লিকপুর বাজারে তার দরিদ্র ধরনের সেলুন। সুকুমার বিয়ে করেছে। তার সংসারেও ছেলে এসেছে। তবে মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর 888sport apk download apk latest version ছেলের। যেখানে বেশির ভাগ বীরাঙ্গনা সমাজে জায়গা পাননি, সমাজ তাঁদের গ্রহণ করেনি, ঘৃণা করেছে, সেখানে সুকুমার তার বীরাঙ্গনা মায়ের জন্য গৌরববোধ করে। বুক দিয়ে আগলে রাখে মাকে। দেশের জন্য তার মায়ের ত্যাগের কথাটা মনে রাখে। তাকে মানুষ করে তোলার জন্য মায়ের অবদানের কথাটা মনে রাখে।
মারিয়া আগের মতোই উদাস। বিষণ্ন চোখে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। কিরণবালার কথা বলতে বলতে আমার মনটাও ভারি হয়েছে।
মল্লিকপুর বাজারের বটতলায় এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে পুরনো ময়লা জিনস আর সাদা ঢোলা টি-শার্ট। আমাদের গাড়ি দেখেই চঞ্চল হলো। তার মানে এই যুবকই মনিরের লোক।
সাজ্জাদ, গাড়ি থামাও। ওই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলো। মনির সাহেব পাঠিয়েছেন কি না জিজ্ঞেস করো।
গাড়ি থামিয়ে গ্লাস নামাল সাজ্জাদ। কথা বলল যুবকের সঙ্গে। হ্যাঁ, মনিরই পাঠিয়েছে।
গাড়িতে উঠতে বলো। তোমার পাশের সিটে বসাও। রাস্তা চিনিয়ে নেবে।
গাড়িতে উঠে যুবক আমাকে সালাম দিলো।
কী নাম ভাই আপনার?
মিজান।
মনির আপনাকে নিশ্চয় সব বলেছে। কিরণবালার বাড়িটা আপনি চেনেন?
জি। কিরণবালাকেও চিনি। তাঁর ছেলেকে চিনি। আমি সব জানি। চলুন।
পথ চিনিয়ে মিজান আমাদের নয়নপুর গ্রামে নিয়ে এলো। কিরণবালার বাড়ি একটু ভিতরে। রাস্তায় গাড়ি রেখে মিনিট দুয়েক হেঁটে এলাম আমরা। তার আগে মারিয়ার কাণ্ড দেখে অবাক হলাম। পায়ের জুতো খুলে সে গাড়িতে রাখল। খালি পায়ে হেঁটে ঢুকল কিরণবালার বাড়িতে।
কী করছ মারিয়া? গ্রামের রাস্তা। পায়ে কাঁটা ফুটতে পারে।
ফুটলে ফুটবে। এই মাটিতে আমি জুতো পায়ে হাঁটব না।
মারিয়ার মনোভাবে আমি মুগ্ধ।
কিরণবালার বাড়ি একেবারেই হতদরিদ্র। দুটো মাটির ঘর বাড়িতে। একটা রান্নাচালা। কয়েকটা কাঁঠালগাছ আছে বাড়িটায়, একটা বাঁশঝাড় আছে। ছোট্ট উঠোনটা খুব পরিষ্কার। গাছের একটা পাতাও পড়ে নেই। মাটির ঘর দুটো নিকোনো। রোদ হাওয়ায় ঝিমঝিম করছে চারদিক। জামগাছে একটা পাখি ডাকছে।
কিরণবালা পাশের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁর নাতির বয়স সাত বছর। ছেলে বাড়িতে নেই। বউ রান্না বসিয়েছে। ছেলেকে ডেকে বললেন, রতন, তোর দাদুকে ডেকে আন।
রতন দৌড়ে চলে গেল।
মিনিট পাঁচেক পর কিরণবালা এলেন। সাদা থান পরা। একটু ভারির দিকে শরীর। মাথায় এখনো ঘন চুল। বেশিরভাগই পেকে গেছে। মুখে পান আছে। চেহারা দেখে বোঝা যায় একসময় দেখতে বেশ ভালো ছিলেন।
কেমন আছেন মাসিমা?
আছি বাজান। আমরার আর থাকা!
মারিয়া অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন কিরণবালার দিকে। তিনি একপলক মারিয়ার দিকে তাকালেন। তয় যে হোনলাম বিদেশি মাইয়া?
এই মেয়েটাই বিদেশি।
কও কী? এই মাইয়া তো আমরার লাহানই। বাঙ্গালি মনে অয়। বও মা, বও। ও বউ, জলচকি দেও।
বউ উঠে গিয়ে দুটো জলচৌকি নিয়ে এলো। আঁচল দিয়ে মুছে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলো। মারিয়ার খালি পা দেখে সে অবাক। বলল, বহেন আপনেরা। বহেন।
মিজান বলল, আমি গাড়ির সামনে আছি। আপনারা কাজ শেষ করে আসুন।
ঠিক আছে।
মিজান চলে যাওয়ার পর আমি বসলাম। মারিয়া বসল না। বসতে বললাম। সে মাথা নাড়ল। বসবে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে কিরণবালার দিকে।
কী দেহ মা চাইয়া চাইয়া? আমারারে দেহনের কী আছে? বেবাক শ্যাষ অইয়া গেছে একাত্তর সনে। বহুত কষ্ট গেছে গো মা। জীবনডা আর জীবন নাই। ভগবান ক্যান যে তহন বাঁচাইয়া রাখল! সুকুমার কয়, আমরার মা হইল আমরার ভগবান। পোলাডা আমরারে ফালাইয় নাই। কোনো কাম করতে দেয় না আমরারে। কয় বহুত কষ্ট করছ। অহন আরাম করো। আরাম কারে কয় গো মা? এই শইল্লের উপরে দিয়া যা গেছে, খালি আমরার ভগবান বোঝে কষ্টডা কিমুন? অন্য কেউ বুজবো না গো মা।
মারিয়া আমার দিকে তাকাল। আমি কিরণবালার কথা 888sport app download apk latest version করে মারিয়াকে বললাম। কিরণবালাকে বললাম, একটা সিগ্রেট খাই মাসিমা?
খাও বাজান, খাও। বউ, তাগোরে চা দেও।
না না, চা লাগবে না। আমরা বেশিক্ষণ থাকব না। আপনার সঙ্গে একটু কথা বলেই চলে যাব।
আমি সিগ্রেট ধরালাম। বসো, মারিয়া।
মারিয়া ধীরে শান্ত গলায় বলল, তাঁর সামনে আমি বসব না।
কী কয় মাইয়াডা?
আপনের সামনে বসবে না।
শিখখিত মাইয়া। সন্মান করে। ওই হারামির পুতেরা তো মা জাতির সন্মান বোজে নাই। যেই পথে জন্ম লইছে সেই পথে বইদা (ডিম) ঢুকাইছে। নরকেও থান (স্থান) হইব না। আহা রে, আরেকটা মুক্তিবাহিনীর বেডারে গাছে ঝুলাইয়া মারল। চোখের সামনে দেখলাম। তেরোডা মাইয়ারে সমানে অইত্যাচার করছে। আমি অহনও চোখের সামনে দেহি। ইয়া লাম্বাচুড়া জুয়ান বেডারা ঘরে ঢোকতাছে …
এইসব ঘটনা বিস্তারিত আমি মারিয়াকে বলেছি। আগেরবার যখন কিরণবালার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তখন মোটামুটি গুছিয়ে কথা বলতেন। এবার দেখছি এলোমেলো। এককথা থেকে চলে যাচ্ছেন অন্যকথায়। কথার খেই হারিয়ে ফেলছেন। মাথা বোধহয় এলোমেলো হচ্ছে।
সব মিলিয়ে মিনিট-বিশেক কিরণবালার বাড়িতে আমরা ছিলাম। পুরো সময়টা মারিয়া দাঁড়িয়েই ছিল। একসময় আমাকে বলল, তাঁকে আমি কিছু টাকা দিতে চাই। দেখে মনে হচ্ছে তাঁর শরীর বিশেষ ভালো না। ওই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। তুমি তাঁকে বলো।
বলে লাভ নেই মারিয়া। তিনি নেবেন না। তিনি কারো দয়া নেন না। ছেলের রোজগারে কষ্ট করে চলেন। কারো সাহায্য নেন না। যেভাবেই দিতে চাও, কিছুতেই নেবেন না।
আমি যদি তাঁকে একটু জড়িয়ে ধরি, তিনি কি পারমিশান দেবেন?
বলে দেখতে পারি।
বলো।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মাসিমা, আমরা এখন যাবো।
তিনি দাঁড়ালেন। হ যাইবাই তো! মানুষ তো খালি আহে আর যায়। কেউ থাকে না বাজান।
এই মেয়েটা আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চায়।
ধরুক না, ধরুক। আমরার মাইয়ার লাহানই তো। ধরুক।
কিরণবালা নিজেই মারিয়ার দিকে দু-হাত বাড়িয়ে দিলেন। আহো গো বেডি, আহো। আমার বুকে আহো।
কিরণবালা তাঁর মতো করে ধরলেন মারিয়াকে। কিন্তু মারিয়া ধরল গভীর আবেগে। যেন বহুদিনের না-দেখা মাকেই সে জড়িয়ে ধরেছে। তার কান্নার শব্দ আমার কানে এলো না। বিস্মিত হয়ে শুনি কিরণবালার বুকে মুখ রেখে ফিসফিস করে পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে মারিয়া বলছে, মা মা মা মা মা …
কিরণবালা মারিয়ার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কান্দস ক্যান রে বেডি? কান্দিস না, কান্দিস না। আমরারে কানতে দেহচ? আমি তো কান্দি না! কান্দিস না গো মা। কান্দিস না।
কিরণবালার চোখ জলে ভরে গেছে। ওদিকে রান্না করতে বসা বউটি রান্না ফেলে অবাক চোখে দৃশ্যটি দেখছে। রতন দেখছে চোখ বড় বড় করে। এরকম দৃশ্য তারা কখনো দেখেনি।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.