কম্পানি : ইতিহাসের পুনর্পাঠ

এবারের ঈদ উৎসব আর বাংলা নববর্ষ বরণে 888sport appবাসীর জন্য এক নতুন আনন্দের মাত্রা যুক্ত করেছিল মঞ্চনাটক। ঈদের দিন সন্ধ্যা থেকে পহেলা বৈশাখ সন্ধ্যা পর্যন্ত নাট্যামোদীদের জন্য আনন্দের যোগসূত্র রচিত হয়েছিল আরণ্যকের নতুন নাটক কম্পানির মাধ্যমে। পহেলা বৈশাখ সন্ধ্যায় অবশ্য আরো একটি নতুন মঞ্চনাটকের উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় 888sport live chatকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার অনন্ত হিরার নির্দেশনায় মঞ্চে আনে প্রাঙ্গণে মোর নাট্যদল। আজকের এ-আলোচনা অবশ্য আমরা সীমাবদ্ধ রাখবো শুধু কম্পানিকে ঘিরে।

ঈদ উৎসবের সময় নতুন live chat 888sport মুক্তির হিড়িক লেগে যায়। প্রচুর টিভিনাটকও প্রদর্শিত হয় টেলিভিশনগুলিতে। কিন্তু মঞ্চে এ-সময় প্রচণ্ড খরা চলে। অবশ্য বেশ কয়েক বছর আগে ঈদের সময় সৈয়দ জামিল আহমেদ মঞ্চে এনেছিলেন রিজওয়ান। বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল সেবার 888sport appর মঞ্চনাটকের দর্শকদের মধ্যে। যতদূর মনে পড়ে, এরও বেশ অনেক বছর আগে নাগরিক নাট্যাঙ্গন ঈদে নাটকের মঞ্চায়ন করেছিল। ঈদ উৎসবে নাটকের মঞ্চায়ন সে-অর্থে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে মন্দ হতো না। কারণ ঈদের ছুটিতে কিছু দর্শকের নাটক দেখার ফুরসত মেলে। এবার পরপর চার সন্ধ্যায় 888sport live chatকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে কম্পানি নাটকের চারটি প্রদর্শনীতেই দর্শকের ঢল নেমেছিল। রিজওয়ানের প্রদর্শনীতেও প্রতিটি শোয়ে হলভর্তি দর্শকের উপস্থিতি লক্ষ করা গিয়েছিল। এবার যেন তা ছাপিয়ে গেল। মূল হলে দর্শক ধারণক্ষমতা এক্সপেরিমেন্টাল হলের কমবেশি আড়াই গুণ তো হবেই। প্রতিটি শোয়ে দর্শকে প্রায় ভরপুর ছিল মিলনায়তন। সেই হিসাবে চার দিনে প্রায় দু-হাজার দর্শক নাটকটি উপভোগ করেছেন। এটি আমাদের মঞ্চনাটকের জন্য আশাজাগানিয়া খবর বইকি। 

888sport free betতত্ত্বের হিসাব-নিকাশ দিয়ে আলোচনাটা শুরু হয়ে গেল যেন কেমন করে। তাতে অবশ্য দোষের কিছু দেখছি না। কারণ কম্পানি নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন হিসাব-নিকাশ করা মানুষ। এক ছিঁচকে চোর, মদ্যপ থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রথম গভর্নর লর্ড ক্লাইভ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল তাঁর হিসেবি বুদ্ধি।

১৭৪৩ সালে জেলখানা থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর শাস্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যান্বেষণ। সুদূর সাগরপাড়ের ইংল্যান্ড থেকে চলে এলেন ভারত ভূখণ্ডে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত চৌদ্দ বছরের ভারতবাসেই তিনি হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার অধিকারী। চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে সীতাকে (ভারতীয় পুরাণ) নিয়ে সন্দিহান ছিল যে ভারতবাসী, সেই ভারতবাসীকে তিনি খুব ভালোভাবেই চিনতে শিখে গিয়েছিলেন। কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষকে টোপ দিয়ে হাত করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের দূরভিসন্ধি করা সহজ হয়েছিল তাঁর পক্ষে। (বলা বাহুল্য বাণিজ্য-অর্থ কিন্তু আজো নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে। ফলে ইতিহাসের অনিবার্য ঘটনাটি ঘটে যায় ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে। সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ ও জগৎ শেঠ ক্লাইভের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করায় সিরাজ যুদ্ধে হেরে যান। ইতিহাসের এই পুনর্পাঠ আমরা অবলোকন করি কম্পানি নাটকে। এ-নাটকে বর্তমান বাস্তবতায় কলোনিয়াল মানসিকতাকেও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। লুটপাট, বৈষম্য, অর্থ পাচারকে এ-নাটকে নাট্যকার তুলে ধরেছেন নতুন কালের বাস্তবতায়।

কম্পানি মঞ্চে মামুনুর রশীদের নবতর সংযোজনা। বৃহত্তর ক্যানভাসে তিনি নাটকটি উপস্থাপন করেছেন। এ-নাটকে তাঁর মেধা ও শক্তিমত্তার এ এক নতুন দিগন্ত। এত বড় টিম নিয়ে কাজ করা চাট্টিখানি কথা নয়। হিম্মত থাকতে হয়। মামুনুর রশীদ সেই হিম্মত দেখিয়েছেন।

মামুনুর রশীদ এ-নাটকের আখ্যান নির্মাণ করেছেন খুব সহজ ও তির্যক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি রবার্ট ক্লাইভকে স্থান দিয়েছেন কাহিনির কেন্দ্রে। সিরাজউদ্দৌলা, মীর জাফর, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগম, মোহনলাল, মোহাম্মদী বেগ এসব চরিত্রকে এঁকেছেন ইতিহাসের জনগ্রাহ্য দৃষ্টিকোণ থেকে। শকুন্তলা, জহরত বাঈ, দৌলত খাঁর প্রতি নাট্যকার কিঞ্চিৎ পক্ষপাত করায় এসব চরিত্র যেন দর্শকদের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে।

ক্লাইভের গল্প ছাড়া পুরো গল্পটিই দর্শকের চেনা। খুব সহজেই দর্শক নাট্যকাহিনির সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন। নাটক দেখতে দেখতে মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ-নাটকে নতুন কী আছে? হ্যাঁ, নাটকের একেবারে শেষ দৃশ্যে রয়েছে দারুণ এক টুইস্ট। নাট্যকার মামুনুর রশীদের মুনশিয়ানা দেখা গেল একেবারে শেষে এসে, যাকে বলে ওস্তাদের মাইর শেষ রাতে। তিনি আড়াইশো বছর আগের বিষয়কে সাম্প্রতিক সময়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন এক তুড়িতে। এই নাটকে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভের লুটতরাজকে নাট্যকার অসামান্য দক্ষতায় মিলিয়ে দিলেন বর্তমান সময়ের করপোরেট তথা কোম্পানি কালচারের সঙ্গে। কম্পানি খুব সহজ-সরল হলেও অত্যন্ত সাহসী নাটক।

নাটকের প্রযোজনা বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়, নাটকটি সুঅভিনীতও। সিরাজ চরিত্রে সাজ্জাদ সাজু চমৎকার অভিনয় করেছেন। মঞ্চে live chat 888sportে অনেক সিরাজ দেখেছি, কিন্তু এই নাটকের সিরাজকে সত্যিকারের সিরাজ মনে হয়েছে। মীর জাফর চরিত্রে সুজাত শিমুল, দৌলত খাঁ চরিত্রে আরিফ হোসেন আপেল, জগৎ শেঠ চরিত্রে কামরুল হাসান, ঘসেটি বেগম চরিত্রে লায়লা বিলকিছ ছবি, জহরত আরা চরিত্রে রুবলী চৌধুরী দারুণ অভিনয় করেছেন। রবার্ট ক্লাইভ চরিত্রে শাহরান আপ্রাণ চেষ্টা করলেও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেননি। তাঁর উচ্চতা ও সংলাপ প্রক্ষেপণে ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত না হওয়াটা অন্তরায় হিসেবে মনে হয়েছে। তবে নিঃসন্দেহে শাহরানের চেষ্টার খামতি ছিল না। উপস্থাপক চরিত্রে স্বল্পসময়ের জন্য হলেও সুরভী রায়ের উপস্থিতি ছিল প্রাঞ্জল। সবচেয়ে কম সময়ের জন্য সেলিম রহমান চরিত্রে মামুনুর রশীদের উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বলতম।

কম্পানি নাটকের আলোক পরিকল্পনায় কোনো বাহুল্য ছিল না। পরিমিত আলোয় নাট্যঘটনাকে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন ঠান্ডু রায়হান। মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন ফয়েজ জহির। তিনি খুব সাদামাটাভাবে নাটকটি উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন মঞ্চশৈলীতে। নবাবের কোষাগার লুণ্ঠনের দৃশ্য ছাড়া বাকি অনেক দৃশ্যে মনে হয়েছে আরো একটু টেকশ্চার বা রং ব্যবহার করলে মন্দ হতো না; বিশেষ করে সিরাজের দৃশ্যগুলিতে। বারবার চোখে ভাসছিল দেবাশীষের উড়ন্ত তারাদের ছায়া নাটকটির দৃশ্যসজ্জা। সেখানেও সামান্য উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছিল; কিন্তু তাতে আভিজাত্যের ঘাটতি ছিল না। পোশাক পরিকল্পনায় সিরাজ, ঘসেটি বেগম যেমন মানানসই ছিল, মীর জাফর, জগৎ শেঠ, ক্লাইভ, এমনকী কোরাস দলও তেমনটা ছিল না। সংগীত পরিকল্পনায় পরিমল মজুমদার সচেষ্ট ছিলেন নাটকের মূলভাবনাকে সমর্থন জুগিয়ে যেতে। তবে কোরাস অংশে কোরিওগ্রাফি, স্টেপিং ও মুভমেন্টে আরো স্মার্ট হওয়া দরকার। যুদ্ধের দৃশ্যগুলিও আরো পরিপক্ব হওয়া দরকার। যুদ্ধের দৃশ্যের সঙ্গে আবহসংগীত মানানসই লাগেনি। এসব ছোটখাটো বিষয় শুধরে নিলে নাটকটির পরবর্তী প্রদর্শনীগুলি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।

আনন্দের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম, আনন্দের প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করতে চাই। পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করেও আরণ্যক তারুণ্যে উদ্দীপ্ত একটি নাট্য সংগঠন। এই দলের প্রধান কাণ্ডারি মামুনুর রশীদ ৭৬ বছর পূর্ণ করেও আমাদের মঞ্চের তারুণ্যের প্রতীক। তারুণ্যে ভরপুর আরণ্যক ভবিষ্যতে আরো তারুণ্যতেজোদীপ্ত স্মার্ট প্রযোজনা নিয়ে আমাদের মঞ্চ কাঁপাবে, দর্শকদের আনন্দ দেবে – সেই নাট্যের সূচনা হোক কম্পানির আরো সফলতর ভবিষ্যৎ প্রদর্শনীর মাধ্যমে।