তেরো

রাতের খাওয়া শেষ করেছেন দেবু ঠাকুর।

বড়ঘরে হারিকেন জ্বলছে। রান্নাঘরে জ্বলছে পিতলের একটা কুপি। উঠোনের জমাট অন্ধকারের ওপর দু’ঘরের আলো এসে পড়েছে। একদিকে হারিকেনের আলো, আরেকদিকে কুপির। সেই আলোয় পুরো উঠোন আলোকিত হয়নি। কিছুটা হয়েছে।

রাতের খাওয়ার পর উঠোনে পায়চারি করার অভ্যাস ঠাকুরের। বৃষ্টি না থাকলে পায়চারিটা তিনি নিয়মিত করেন। রাতের খাবারের পর আধঘণ্টার মতো হাঁটা শরীরের জন্য ভালো।

শ্রাবণ মাস। আজ বৃষ্টি নেই। রাত তেমন হয়নি। ঠাকুরের ছোট্ট উঠোন ছাড়া বাড়ির সর্বত্র চাপধরা অন্ধকার। ঝোপঝাড়ে জোনাকপোকার ওড়াউড়ি। ঝিঁঝিঁর ডাক হয়েছে প্রবল। মাথার ওপর দিয়ে বাদুড় উড়ে যায়। গাছের পাতায় পাতায় মৃদু হাওয়া। তারও একটা শব্দ আছে। যেন ফিসফিস করে কথা বলছে পাতারা।

গ্রামের ছাড়াবাড়িগুলোতে শিয়ালের বাস। বর্ষাদিনে খাবারের অনটনে ভোগে জীবগুলো। তারপরও রাতের বেলা নিয়মিত ডাকটা তারা ডাকে। একটা এক ছাড়াবাড়ি থেকে হুক্কা দিলেই 888sport app ছাড়াবাড়ি কিংবা গোরস্তান থেকে সাড়া দেয় অন্যগুলো। ‘হুক্কা হুয়া’ রবে মুখর হয় দেশগ্রাম।

খানিক আগে শিয়ালের ডাকে মুখর হয়েছিল রতনপুরের এদিকটা। আর শিয়াল ডাকলেই যা হয়, গৃহস্থবাড়ির ‘পালা’ কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ শুরু করে। দু’পক্ষের ডাকাডাকি চলেছে বেশ কিছুক্ষণ। পরে থেমে গেছে।

এখন একেবারেই নীরব চারদিক। আছে শুধু ঝিঁঝিঁ আর রাত পোকাদের ডাক। গাছের পাতাদের ফিসফিসানি।

পুবদিককার চক থেকে নৌকা বেয়ে আসার শব্দ পাওয়া গেল। লগির ‘খোঁচ’ না। বইঠা বেয়ে আসার শব্দ। এখনো চকেমাঠে অনেক জল। ধানিজমিতে জল একটু কম। ওদিকটায় লগি বাওয়া যায়। হাজামবাড়ি থেকে ঠাকুরবাড়িতে আসার পথে ধানিচক তো পড়েই, পুকুরও পড়ে অনেকগুলো। ফলে বাড়ি যেতে আসতে লগি-বইঠা দুটোই বাইতে হয় বদরুকে। চকে লগি, পুকুরে বইঠা। পুকুরের অগাধ জলে লগি ‘ঠাঁই’ পায় না।

এখন বইঠার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে কাছাকাছি চলে এসেছে বদরু। রাতের খাওয়া শেষ করে ফিরল।

বদরু আসার পর ঠাকুর বললেন, ‘আইজ একটু জাইগা থাকিস, বদরু।’

বদরু প্রথমে অবাক হলো, তারপর ভয় পেল। ‘ক্যান কত্তা? কোনো ঘটনা আছে?’

ঠাকুর হাসলেন। ‘আছে একটা ঘটনা।’

‘কেমুন?’

‘এত ডরাইতাস ক্যান বেডা? ডরের কিছু নাই।’

বদরু একটু সাহস পেল। ‘না, ডরাই না। তয় জাইগা

থাকতে কইলেন ক্যা?’

‘চা বানাইতে হইব।’

‘এত রাইতে আপনে চা খাইবেন?’

‘আমি একলা খামু না।’

বদরুর বুকের ভয়টা আবার ফিরে এলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তয় আর কে খাইব?’

‘তরে না কইলাম ডরাইছ না? আরে বেডা চা মানুষেই খাইব।’

‘কোন মানুষ, কত্তা?’

‘দরবেশ দাদায় আইব।’

বদরু যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘দরবেশ সাবে আইবেন রাইতে? তা-ও অনেক রাইতে?’

‘আরে হ বেডা।’

‘রাইতে তো তিনায় কোনোদিন আসেন নাই?’

‘আইজ আসবেন।’

‘খবর দিছে আপনেরে?’

‘এতদিন ধইরা তুই আমার লগে আছস, তা-ও আমারে

 তুই চিনতে পারলি না? তুই যে-ই গরু আছিলি, সে-ই গরুই রইয়া গেছস।’

বদরু বোকার মতো হাসল। ‘বুজছি কত্তা। আপনে আপনের মতন জাইনা ফালাইছেন।’

‘এইত্তো বুজছস। জাইগা থাকিস।’

দেবু ঠাকুর পায়চারি শেষ করে ঘরে ঢুকলেন। দরজা খোলা রেখেই পড়ার টেবিলটায় বসলেন। হারিকেনের আলোয় বেশ পুরনো, পোকায়-কাটা একটা বই খুলে বসলেন।

পশ্চিম দিককার ঘাটে ডিঙি নৌকাটা বাঁধা। লগি পুঁতে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। একটা বইঠা আছে নৌকার পাটাতনে। দেশগ্রামে নৌকা চুরি হয় প্রায়ই। এজন্য গৃহস্থলোক বাড়ির ঘাটে মোটা গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে নৌকা বেঁধে, শিকলের দুই মাথা একত্র করে তালা মেরে রাখে। তাও বড়, শক্ত তালা। চাইলেই ভাঙা যায় না। তাতেও রক্ষা নেই। ওই তালা ভেঙে, শিকল খুলেও পাকা চোরেরা নৌকা চুরি করে নিয়ে যায়।

দরবেশ খাঁর বাড়িতে ভুলেও চোর আসে না। এই বাড়ির কুটোটায়ও কোনো চোর কখনো হাত দেয় না। রাত্রে ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘুমালেও অসুবিধা নেই। লোকে মনে করে, খাঁ সাহেবের জিনেরা তাঁর বাড়ি পাহারা দিয়ে রাখে। খারাপ উদ্দেশ্যে এই বাড়ির দিকে তাকালে অন্ধ হয়ে যেতে হবে। চুরির উদ্দেশ্যে কোনো কিছুতে হাত দিলে, সেই হাত চিরতরে অকেজো হয়ে যাবে। যে পা চুরির উদ্দেশ্যে এই বাড়ির মাটিতে ফেলবে, সেই পা অচল হয়ে যাবে।

আজ গভীর অন্ধকারের রাত।

এশার নামাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়েছেন খাঁ সাহেব। অনেকক্ষণ পায়চারি করেছেন উঠোনে। হাতে তসবিহ। বিড়বিড় করে দোয়া-কালাম পড়ছিলেন। ঘরে এসে বসেছিলেন কিতাব নিয়ে। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

তারপরই অদ্ভুত কাজটা করলেন তিনি। সিগারেট ধরিয়ে ঘর থেকে বেরোলেন। পশ্চিমের ঘাটে এসে নৌকার বাঁধন খুললেন। ‘চারোটে’ দাঁড়িয়ে মাত্র লগির খোঁচ দিতে যাবেন, বিড়ালটা ছুটে এসে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠল।

খাঁ সাহেব নিঃশব্দে হাসলেন।

বিড়ালটির একটা নাম আছে। মায়া। খাঁ সাহেব ছাড়া এই নাম কেউ জানে না। কারো সামনে বিড়ালটির নাম তিনি উচ্চারণ করেন না। কখনো কখনো গভীর রাতে কিংবা দিনের নির্জন প্রহরে বিড়ালটির সঙ্গে তিনি কথা বলেন। নাম ধরে ডাকেন। আদুরে বিড়াল তাঁর পায়ের কাছে মুখ ঘষে। যেন সেও নিঃশব্দে অনেক কথা বলে।

এই অন্ধকারে হারিকেন নিয়ে বেরোবার দরকার ছিল। খাঁ সাহেব মানুষের তৈরি আলোর কথা ভাবেননি। লগির খোঁচ দিতে দিতে আকাশের দিকে তাকালেন।

পরম করুণাময়ের আকাশে আজ লক্ষ-কোটি নক্ষত্র। নক্ষত্রের আলোয় পরিষ্কার সবকিছু দেখতে পাচ্ছেন খাঁ সাহেব। মায়া আধশোয়া হয়ে আছে নৌকার পাটাতনে। তার চোখ থেকেও ঠিকরে বেরোচ্ছে নীল রঙের আলো। সেই আলোয়ও যেন দেখা যায় আশপাশ। সামনের অনেকটা দূর অবধি যেন পৌঁছে যাচ্ছে মায়ার চোখের আলো।

সোনাদিঘি গ্রাম থেকে রতনপুর মাইল দেড়েক হবে। লগি আর বইঠা চালিয়ে সেই গ্রামে এলেন খাঁ সাহেব। ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণ দিককার পায়েচলা পথটির সামনে এসে নৌকা ভেড়ালেন।

পথটি সোজা চলে গেছে দেবু ঠাকুরের উঠোনের দিকে। নৌকা থেকে নেমেই খাঁ সাহেব দেখতে পেলেন শুধুমাত্র পায়েচলা পথটা আবছা এক আলোয় ভরে আছে। পথটার দু’পাশে গাঢ় অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। শুধু পথটা দেখা যায়।

খাঁ সাহেব নিঃশব্দে হাসলেন। মায়াও নেমেছে তাঁর সঙ্গে। সে দু’বার শব্দ করল।

হাঁটতে শুরু করেছেন খাঁ সাহেব। তাঁর মনে হলো সামনে পেছনে আরো কিছু মানুষ যেন হাঁটছে! মায়ারও বোধহয় একই রকম অনুভূতি হলো। দু-তিনবার খাঁ সাহেবের পায়ে মুখ ঘষলো। খাঁ সাহেব বুঝলেন, মায়া ভয় পাচ্ছে।

মায়াকে দু’হাতে বুকে তুলে নিলেন খাঁ সাহেব। উঠোনের কাছাকাছি এসে দেখেন দেবু ঠাকুরের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। দরজা খোলা। আলো কিছুটা উঠোনেও পড়েছে।

তিনি খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

বই থেকে হঠাৎই মুখ তুললেন দেবুকুমার ঠাকুর। দেখতে পেলেন দরজার সামনে একজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন।

মাথায় লম্বা চুল। বুকের অর্ধেকটা পর্যন্ত নেমে এসেছে দাড়ি। পরনে নীল রঙের একফালি মার্কিন কাপড়। ওই এক কাপড়েই তাঁর পুরো শরীর 888sport app। কোলে সাদা ধপধপে একটি বিড়াল।

দেবু ঠাকুর অতি সম্ভ্রমের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। ‘আসো দরবেশ দাদা। আসো।’

এগিয়ে গিয়ে খাঁ সাহেবের পায়ে হাত দিলেন। পদধূলি নিয়ে মাথায় ছোঁয়ালেন।

দরবেশ খাঁ ঘরে ঢুকলেন। ‘খবর কী রে, দেবু? ভালো রহস্য তৈরি করছস গ্রামে?’

দেবু ঠাকুর হাসলেন। নিজের বসার চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বসো দরবেশ দাদা। বসো। জানতাম আইজ রাইতে তুমি আসবা।’

দরবেশ খাঁ চেয়ারে বসলেন। মায়া লাফ দিয়ে নেমে গেল কোল থেকে। খাঁ সাহেবের পায়ের কাছে বসে রইল। খাঁ সাহেব কোচর থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করলেন।

ঠাকুর বললেন, ‘আমি তোমার জন্য সিগারেট আনাইয়া রাখছি দরবেশ দাদা। আমারগুলিই খাও।’

টেবিলের দেরাজ থেকে দু’প্যাকেট কাঁচি মার্কা সিগারেট বের করলেন ঠাকুর। নতুন একটা দেয়াশলাই বের করলেন। টেবিলের ওপর দরবেশ খাঁর হাতের কাছে রাখলেন। ‘তুমি সিগারেট ধরাও দরবেশ দাদা। বদরুরে বলি চা দিতে।’

ঠাকুরের দেওয়া প্যাকেট খুলে সিগারেট ধরালেন খাঁ সাহেব। ‘এত রাইতে ছেমড়ারে জাগাবি?’

‘অরে জাগাইয়াই রাখছি। কইছি তুমি আসবা। আমরা দুইজনে চা খামু।’

‘তয় দিতে ক চা।’

দরজার কাছে গিয়ে বদরুকে ডাকলেন ঠাকুর। বদরু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠাকুরের তিনবার ডাকের পর ধড়ফড় করে উঠল। সাড়া দিলো। ‘কন কত্তা। কন।’

‘ভালো কইরা চা বানা। দরবেশ দাদায় আইছে।’

‘অহনঐ বানাইতাছি কত্তা। টাইম লাগব না। বেবাক রেডি আছে।’

কুপি দেয়াশলাই বদরুর হাতের কাছেই থাকে। চট করেই কুপি জ^ালাল সে। চা বানাতে বসে গেল।

খাঁ সাহেব ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বড় করে সিগারেটে টান দিলেন। ‘ঘটনা আমারে বল তো দেবু? হইছে কী তর? কোন বুজরুকি শুরু করছস? আরবছর তর আর চদরির লাশ পাওয়া গেল এই উঠানে। আষাঢ় মাসে তুই আর চদরি খুন হইলি। দেশগেরামের বেবাকতেই এই ঘটনার সাক্ষী। সেই তুই একবছর বাদে কই থিকা ফিরত আইলি? কেমনে ফিরত আইলি? আইলি যখন একলা আইলি ক্যান? চদরিরে লইয়া আইলি না ক্যান?’

ঠাকুর হাসলেন। ‘আমি খুন হই নাই দরবেশ দাদা। চদরি খুন হইছে। মইরা গেছে। সে ফিরত আইব কেমনে?’

‘তয় তর জাগায় কে খুন হইল?’

‘সেইটাও আমিই।’

‘এইসব ছাড়, দেবু। আমার লগে চালাকি করিস না। আসল ঘটনা আমারে ক?’

‘এইটাই আসল ঘটনা, দরবেশ দাদা। চদরির লগে আমিও খুন হইছি। আমি ফিরত আইতে পারছি, চদরি পারে নাই। তার পারার কথাও না। সে আর আমি এক না। তোমার তো এইটা বোঝা উচিত, দরবেশ দাদা! তুমি তো সাধারণ মানুষ না! তুমি অসাধারণ মানুষ। কামেল। দরবেশ। আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ। তোমার দুই-চাইরটা লেখা আমি পড়ছি। অতি উচ্চাঙ্গের কামেল দরবেশ না হইলে, আধ্যাত্মিক মানুষ না হইলে, ওই রকম লেখা কেউ লেখতে পারে না। তোমারে আমি কী বলবো? তুমি এক আধ্যাত্মিক জগতে চলাফিরা করো। তুমি আছ তোমার জগৎ নিয়া। সেই পবিত্র জগতের হদিস আমার জানার কথা না। আমার ক্যান, কেউরই জানার কথা না। জানো শুধু তুমি। আমারও তো কোনো নিজস্ব জগৎ থাকতে পারে, দরবেশ দাদা। সেই জগতে থাকতে পারে কোনো জাদুমন্ত্র। হয়তো সেই জাদুমন্ত্রের জোরে, বা অলৌকিক কোনো ক্ষমতায় আমি আমার মতোন চলতাছি। আমার সেই জগতের হদিস আমি তো কেউরে দিমু না। তুমি কি তোমার জগতের হদিস কেউরে দিছ?’

একটু থেমে ঠাকুর বললেন, ‘তুমি যে বারোটা বছর হিমালয়ে কাটাইছ, ক্যান কাটাইছ? অবশ্যই আল্লাহর ধ্যানে কাটাইছ। কিন্তু তোমার সেই বারো বছরের জীবন নিয়া তুমি কি কোনোদিন মুখ খুলছো? তুমি কি কেউরে কইছো, ওই বারো বচ্ছরে  কী কী ঘটছে তোমার জীবনে? কী কী পাইছো তুমি? কোন আধ্যাত্মিক শক্তি তুমি অর্জন করছো? কও নাই। কারণ ওইসব কথা কওন যায় না। গুহ্যকথা।’

বদরু ঘন দুধের দুই মগ চা নিয়ে এলো। ধোঁয়া-ওঠা চা। চমৎকার গন্ধ চায়ের।

টেবিলে চায়ের মগ দুটো নামিয়ে রাখার সময় বদরু দেখে, মুখোমুখি বসে থাকা মানুষ দু’জন যেন এই জগতে থেকেও এই জগতে নেই। যেন তাঁরা চলে গেছেন অন্য কোনো জগতে। অচিন কোনো জগতে।

তার গা কাঁটা দিলো। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। ঠাকুর বললেন, ‘হালকা গরম দুধ আন একবাটি।’

বদরু অবাক। ‘দুধ আনুম কার লেইগা?’

‘ঘরে যে আরেকজন অতিথি আছে তুই দেখতাছস না? এই যে দরবেশ দাদার পায়ের সামনে বইয়া রইছে! তারে দুধ দে।’

বদরু ছুটে বেরিয়ে গেল।

‘চা খাও দরবেশ দাদা। বদরু খুব ভালো চা বানায়।’

খাঁ সাহেবের হাতের সিগারেট শেষ হয়েছে খানিক আগে। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের উঠোনে সিগারেটের শেষ অংশ টোকা মেরে ফেলে দিলেন তিনি। চায়ে চুমুক দিলেন। মুগ্ধ হলেন। ‘সত্যই রে দেবু। তর ওই বদরু ছেমড়াটা ভালো চা বানায়। অনেকদিন বাদে এই রকম ভালো চা খাইতাছি।’ 

পরপর দু’চুমুক চা খেলেন খাঁ সাহেব। ‘তুই বললি আমার কোনো কোনো 888sport app download apk বা গান তুই পড়ছস। পইড়া কী বুজছস? বুজছস, আমি আল্লাহপাকের সেবায় নিজেরে নিয়োজিত রাখছি। নানান ভাবে তাঁরে আমি খুঁজি। আমার চিন্তা-চেতনায় সব সময় মহান আল্লাহপাক। আল্লাহপাকের দুনিয়ায় অনেক রহস্য। অনেক রহস্যময় ঘটনাই এই দুনিয়াতে ঘটে। আমরা বলি আল্লাহর কুদরত। আল্লাহর কুদরতের কোনোা শেষ নাই। হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি কোটি বছর ধইরা চেষ্টা করলেও আল্লাহর কুদরতের কোনো সীমা-পরিসীমা মানুষ খুঁইজা পাইবো না। মানুষ তার কুদরতের কিছুই বুইজা উঠতে পারবো না। কিছুই ধরতে পারবো না। তয় আমার মতোন আল্লাহপ্রেমী কোনো কোনো মানুষ জীবনভর আল্লাহরে খোঁজে। কেউ সংসারে থাইকা খোঁজে। কেউ পথে পথে খোঁজে। কেউ বনে-জঙ্গলে খোঁজে। কেউ পাহাড়ে-পর্বতে খোঁজে। খোঁজার পথ ভিন্ন ভিন্ন। উদ্দেশ্য এক। আল্লাহ। আল্লাহকে পাওয়া। তিন বয়সে তিন পথে আল্লাহরে আমি খুঁজছি। ছোটবেলায় নদী দেইখা, বিল-বাঁওড় আর ফসলের মাঠ দেইখা, আসমান-জমিন দেইখা, চাঁদ-সুরুজ দেইখা আমার খালি মনে হইতো, এইসব কে বানাইছে? কোন মহান কারিগর? কোন মহান 888sport live chatী? আমি তাঁরে খুঁজবো? আমি তাঁরে পাইতে চাই।’

বদরু একটা টিনের বাটিতে দুধ নিয়ে এলো। মায়ার মুখের সামনে রেখে চলে গেল। মায়া চুকচুক করে দুধ খেতে লাগল।

ঠাকুর পরপর দু’বার চায়ে চুমুক দিলেন। খাঁ সাহেবও দিলেন একবার। ‘বড় হইয়া উঠতে উঠতে, পড়ালেখা করার ফাঁকে ফাঁকেও আল্লাহর ধ্যানে থাকি আমি। আল্লাহরে খুঁজি। অজু করতে করতে খুঁজি। নামাজ পড়তে পড়তে খুঁজি। রোজা রাইখা খুঁজি। জাইগা থাইকা খুঁজি। ঘুমের মধ্যেও খুঁজি। দিন-রাইত চব্বিশ ঘণ্টা তাঁরে খুঁজি। এই খোঁজের কোনো শেষ নাই। আলীগড়ে পড়তে গিয়া খুঁজলাম। বাগদাদে গিয়া খুঁজলাম। মক্কা-মদিনায় গিয়া খুঁজলাম। বারো বছর খুঁজলাম হিমালয় পর্বতে গিয়া। কোথাও কিছু নাই। বিরাট পর্বত। সেখানে দিনরাইত কাইটা যায়। কোথায় থাকি, কোথায় খাই, কোথায় ঘুমাই কিছুই মনে থাকে না। আমার অন্তর শুধু আল্লাহরে ডাকে। লোকে বলে আমার সঙ্গে জিন আছে। আছে কি নাই সেইটা তরে আমি বলুম না। তবে জিন আর ইনসান আল্লাহ তৈরি করেছেন। মানুষের সঙ্গে জিনের সম্পর্ক থাকতেই পারে। আল্লাহর ধ্যান করতে করতে মনপ্রাণ সঁপে আল্লাহর পথে

থাকতে থাকতে মানুষ অনেক কিছু পায়। অনেক কিছু আবিষ্কার করে। ওই চেষ্টা থেকে মানুষের মধ্যে অলৌকিক কিছু ক্ষমতা তৈরি হয়। কিছু শক্তি তৈরি হয়। সেই শক্তি দিয়া মানুষ মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু কিছু কাজ করে। আমিও করি। করি একটু অন্যভাবে। মানুষরে আল্লাহর কথা বলি। আল্লাহর পথে আনার চেষ্টা করি। নবিজির জীবনের অনেক ঘটনার কথা বলি। কোরান মজিদের কথা বলি। হিমালয়ে বারো বছর কাটাইয়া আসার পর আমি গ্রামেই রইয়া গেলাম। ক্যান? ভাবলাম, শুধু আমার চাইরপাশের এলাকার মানুষগুলিরেই যদি কোরানের বাণী অর্থাৎ আল্লাহর বাণী শুনাইতে পারি, তাদেরকে আল্লাহর পথে আনতে পারি, সেইটাই হইবো আমার আসল কাজ। আমি এখন সেই কাজটাই করি। সেই কাজ করতে করতে আমি আসলে আল্লাহরেই খুঁজি। যখনই সময় পাই কোরান শরিফ পড়ি। হাদিসের বই পড়ি। রাসুলাল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী পড়ি। সবকিছুর মূলে আল্লাহপাকরে খোঁজা। আমি ওইটাই করি।’

ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে খাঁ সাহেবের কথা শুনছেন। একসময় বললেন, ‘আমিও তোমার মতোন লেখাপড়া করতে ভালোবাসি দরবেশ দাদা। তুমি আমার বাড়িতে আগেও আসছো। দেখছো কত বই আমার ঘরে। গিরিশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষায় প্রথম কোরান শরিফ 888sport app download apk latest version করেছেন। নরসিংদীর ওদিককার লোক। একজন হিন্দু করলো বাংলা ভাষায় প্রথম কোরান শরিফের 888sport app download apk latest version! এইজন্য মুসলমানরা খুশি হইয়া তাঁরে ‘ভাই’ উপাধি দিলো। তিনি হয়ে গেলেন ‘ভাই গিরিশচন্দ্র’। গিরিশ সেনের 888sport app download apk latest versionই আমি পড়ছি। খুব মন দিয়া, অনেকদিন ধইরা, একটু একটু কইরা পড়ছি। পড়তে পড়তে অন্য এক জগতে চইলা যাইতাম। কোরান শরিফ এক মহাগ্রন্থ। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এই গ্রন্থের কোনো তুলনা নাই। আমি মহানবির জীবনীও পড়ছি। তাঁর জীবনের অনেক কথা বিভিন্ন বইতে পড়ছি। মহানবির জন্মের আগে থেকেই বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটতেছিল …’

ঠাকুরের কথা শেষ হওয়ার আগেই খাঁ সাহেব বললেন, ‘আইজ বিকালেই নবিজির জীবনের কিছু ঘটনার কথা আমি মজলিসে বলছি। সবই অলৌকিক ঘটনা। সবই আল্লাহর কুদরতের

কথা।’

চা তখনো শেষ হয়নি। খাঁ সাহেব আবার সিগারেট ধরালেন।

দেবু ঠাকুর তাঁর চায়ে শেষ চুমুক দিলেন। ‘দরবেশ দাদা, আগেও বলছি, আবারও বলি। জগৎ রহস্যময়। তুমি তোমার মতোন তোমার জগৎ নিয়া আছ। আমি আছি আমার জগৎ নিয়া। বলতে পারো, আমার জগৎ জাদুর জগৎ। জাদুমন্ত্রের শক্তিতে আমি অনেক কিছু করি। হয়তো সেইটাই ঠিক। হয়তো এমন কোনো মন্ত্র আমার আছে, এমন কোনো জাদুর শক্তি আছে, যেই শক্তির জোরে মইরাও আমি ফিরত আসতে পারি।’

খাঁ সাহেব এক চুমুক চা খান, আরেক টান সিগারেট। মিনিট পাঁচেক সময় নীরবে কেটে গেল। তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ‘তুই আমারে যত কিছুই বুজানের চেষ্টা করতাছস না ক্যান দেবু, আমি যা বুজনের বুজছি। তুই কেমনে ফিরত আইছস সেইটা আমি বুজছি। তয় সেই কথা আমি কেউরে কমু না। তুই থাক তর মতোন। তয় তুই একজন ভালো ডাক্তার। জান দিয়া রুগি বাঁচানের চেষ্টা করস। হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। তুই অছিলামাত্র। তুই তর কাজটা ঠিক মতোন করিস দাদা। গরিব দুঃখী মানুষের সেবা করিস। কেউরে অবহেলা করিস না। সবাই আল্লাহপাকের সৃষ্টি। মানুষের সেবা করলে আল্লাহপাক তর উপরে সন্তুষ্ট থাকবেন। তিনি তরে দয়া করবেন।’

‘আমি তোমার কথা মনে রাখুম, দরবেশ দাদা। ভুলুম না।’

‘শোনলাম ফিরত আসনের পর তুই বাড়িত থিকা বাইর হইচ না। রুগি দেখতে যাস না?’

‘হ দরবেশ দাদা। বাড়িতেই রুগিরা আসে। আমি আর কলে যাই না।’

‘না না। এইটা করিস না দাদা। কত মানুষ আছে, যাগো লড়াচড়ার ক্ষমতা নাই। তারা তরে দেখাইতে চায়। আসতে পারে না। সেই মানুষগুলিরে তুই দেখতে যাইস। গর্ভবতীর পাশে থাকিস। প্রসব করাইস। মা জাতির সবচাইতে বড় কষ্টের সময়। তুই তাগো সাহায্য করিচ দাদা। এইটা তর কাছে আমার অনুরোধ।’

দেবু ঠাকুর দু’হাতে খাঁ সাহেবের পা জড়িয়ে ধরলেন। ‘এইটা তুমি কী বললা, দরবেশ দাদা? তুমি আমারে অনুরোধ করবা ক্যান? আদেশ করবা। আদেশ। তোমার আদেশ শিরোধার্য। তুমি যা বলবা আমি তাই করুম। কাইল থিকাই বাড়িত থিকা বাইর হমু। রুগি দেখতে যামু। তোমার কথা সারাজীবন মাইনা চলুম। তোমারে মাথায় তুইলা রাখুম।’

খাঁ সাহেব খুশি হলেন। [চলবে]