চৌদ্দ

শ্রাবণ মাসের শুরুর দিককার এক রাতে তুমুল বৃষ্টি নামল। রাত তেমন হয়নি। বদরু খেয়ে এসে শুয়ে পড়েছে রান্নাঘরে। সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগী দেখেছেন দেবু ঠাকুর। দুপুরের দিকেও এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। উঠোনের মাটি ভেজা। সেই কারণে ঠাকুর আর ঘর থেকে বেরোননি। হারিকেনের আলোয় পড়ার টেবিলে বসেছিলেন। একবার ভাবলেন, কলের গানে গান শুনবেন। তারপর ভাবলেন, না একটু পড়ালেখা করি।

প্রথমে বই নিয়ে বসলেন টেবিলে। বসে থাকতে ভালো লাগল না। হারিকেনটা মাথার কাছে এনে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ‘কালোজাদু’ বিষয়ক বহু পুরনো একটা বই। কলিকাতার ফুটপাত থেকে কিনেছিলেন। ইংরেজিতে লেখা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই বইটি প্রায়ই তিনি পড়েন। পড়তে পড়তে অন্য এক জগতে চলে যান।

আজো গিয়েছিলেন।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বদরু ডাকল, ‘কত্তা।’

বই থেকে মুখ না তুলেই ঠাকুর বললেন, ‘আইচ্ছা যা। খাইয়া আয় গিয়া।’

‘আপনেরে দুধ দিয়া যামু?’

‘হ দিয়া যা।’

ওই বড় এক গেলাস দুধই ঠাকুরের রাতের খাবার। দুধ খেয়ে ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে লাগলেন ঠাকুর।

বৃষ্টি নামার আগেই বাড়ি থেকে ফিরলো বদরু। ঠাকুরের সঙ্গে তার আর কোনোা কথাই হলো না। রান্নাঘরে ঢুকে সে দরজা বন্ধ করল।

তারপরও অনেকক্ষণ জেগে রইলেন ঠাকুর। বৃষ্টিটাও নামলো। এমন নিঝুম বৃষ্টি! গাছপালা, উঠোন, মাটি আর চারদিককার বর্ষাজলে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

ঠাকুর দরজা বন্ধ করলেন। বিছানায় শুয়ে চাদরটা টেনে নিলেন। চাবি ঘুরিয়ে নিভিয়ে দিলেন হারিকেন। গভীর অন্ধকার ছাড়া ঘুমাতে পারেন না তিনি। অন্ধকারে ঘুমাবার আগ পর্যন্ত তিনি থাকেন অন্য এক ঘোরে। অন্য এক জগতে। সেই জগৎ রহস্যময়। গভীর রহস্যময়। রহস্যময়তার জগৎ থেকে তিনি সংগ্রহ করেন তাঁর শক্তির উপাদান।

এ এক তন্ত্রচর্চা। গভীর রাতে, নিরেট অন্ধকারে এই চর্চা তিনি নিয়মিত করেন।

আজ চর্চাটা তিনি করলেন না। একজন মানুষের কথা তাঁর মনে পড়ল। কত কতদিন আগের কথা। মানুষটির মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে।

দোলন। সেই মানুষটির নাম দোলন।

বাইরে নিঝুম হয়ে ঝরছে বৃষ্টি। গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে ঠাকুরের ঘর। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়েছেন তিনি। অন্ধকার থেকে চলে গেছেন আরো অন্ধকারে। তখনই যেন আলো হয়ে ফিরে এলো দোলনের মুখখানি।

কেন যে!

দোলন ছিল এক অনাথ মেয়ে। ঠাকুরের দূরসম্পর্কের পিসতুতো বোন কৃষ্ণার মেয়ে। কৃষ্ণার বিয়ে হয়েছিল চাঁদপুর মহকুমার মতলব থানার ওদিককার নারায়ণপুর গ্রামে। স্বামী ছিল দরিদ্র স্কুলমাস্টার। দোলনের জন্মের কয়েক মাস পর যক্ষ্মায় মারা গেল। দরিদ্র পরিবার। বিধবা কৃষ্ণার আর জায়গা হলো না শ্বশুরবাড়িতে। মেয়েটাকে কোলে নিয়ে সে এসে উঠল ছোট বোনের বাড়িতে।

ছোট বোনটির নাম রাধিকা। তার বিয়ে হয়েছে অবস্থাপন্ন ঘরে। শ্বশুরবাড়ি চাঁদপুর শহরে। বিরাট যৌথ পরিবার।

শ্বশুর-শাশুড়ি আর চার ছেলে একত্রে বাস করে। তাদের ছেলেমেয়েও বিস্তর। বাড়ির তৃতীয় ছেলেটির বউ রাধিকা।

বাজারে বিশাল মুদিমনোহারির পাইকারি ব্যবসা রাধিকার শ্বশুর হরিপদ সাহার। হরিপদ বুড়ো হয়েছেন। এখন ব্যবসা সামলায় চার ছেলে।

এই বাড়িতে দাসির মতো জীবন হয়েছিল কৃষ্ণার।

ঝি-চাকরানিদের ছেলেমেয়েদের মতো বড় হচ্ছিল দোলন। স্কুলেও যেত।

আশ্চর্য ব্যাপার। কয়েক বছর পর স্বামীর রোগটাই বাঁধিয়ে বসলো কৃষ্ণা। যক্ষ্মা। তখনো দেশভাগ হয়নি। কয়েক মাস ভুগে মারা গেল কৃষ্ণা। দোলন অনাথ। আপন মাসি রাধিকাও দূর দূর ছাই ছাই করে।

দেশভাগ হয়ে গেল। পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার হিন্দু পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে চলে গেল পশ্চিমবঙ্গে। কলিকাতার আশেপাশে ছড়িয়ে গেল। দূর-দূরান্তেও ছড়াল। কৃষ্ণনগর, কালনা এইসব জায়গায় গিয়েও আশ্রয় নিল পূর্ববঙ্গের বহু হিন্দু পরিবার।

হরিপদ সাহার পরিবার চলে গেল কৃষ্ণনগরে। একবারে গেল না। একজন দুজন করে যেতে লাগল।

সমস্যা হয়ে দাঁড়াল দোলন। তাকে কেউ নিতে চায় না। সে তখন সংসারের বিরাট বোঝা। কেউ নেবে না তাকে। দোলন তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে।

কী দুর্ভাগ্য মেয়েটির! তাকে সত্যি সত্যি কেউ নিল না। মুসলমানরা দখল করে নিয়েছে হরিপদ সাহার বিশাল বাড়ি। সেই বাড়ির এক কোণে আশ্রয় হয়েছিল বাড়ির বিধবা ঝি নারায়ণীর। দখলদাররা দয়া করে মহিলাটিকে থাকার জায়গা দিলো। বাড়ির কাজ যতটুকু পারত সে করত। আপন মাসি রাধিকা নারায়ণীর কাছে ফেলে গিয়েছিল দোলনকে। দখলদাররা দোলনের দিকে ফিরেও তাকায়নি। নারায়ণীর সঙ্গে এই মেয়ের জীবনও হয়ে গিয়েছিল ঝিয়ের জীবন।

দোলন ছিল অতি নিরীহ। অবলা জীবের মতো। কথা তেমন বলতই না। কাঁদতও না। নীরবে জীবনের এই পরিহাস মেনে নিয়েছিল। কোনো রকমে বেঁচে থাকতে পারলেই যেন হলো।

দেবু ঠাকুরের কানে কেমন কেমন করে এসেছিল দোলনের খবর। দেশভাগের দু-বছর পেরিয়ে গেছে। দাঙ্গা-বিরোধ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। দেবু ঠাকুর চাঁদপুরে গিয়ে দোলনকে তাঁর কাছে নিয়ে এলেন।

কিশোরী মেয়েটির শরীরে এই অবস্থায়ও প্রকৃতির কারণেই লাবণ্য দেখা দিয়েছে। অযত্ন-অবহেলায় বড় হওয়া মেয়ে। গায়ের রং শ্যামলা। ডাগর দুখানি চোখ। মুখটা মায়াবী। তেমন লম্বা নয় দোলন। ছোটখাটো শরীরের। তবে তাকিয়ে থাকলে মেয়েটিকে দেখতে ভালো লাগে।

ঠাকুরের বাড়িতে এসে যেন জীবনে প্রথম সচ্ছলতা দেখল দোলন। স্বাধীনতার স্বাদ পেল। নিজের মতো করে সে চলতে পারছে। খেতে-পরতে পারছে। কোনো শাসন নেই। গালাগাল নেই। শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন নেই। ফুলের কলি থেকে দোলন যেন ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ফুল হয়ে ফুটে উঠল।

দেবু ঠাকুর তাকে খুবই ভালোবাসেন। দোলন তাঁকে ডাকে ‘লালমামা।’

এই ডাকের কী কারণ?

ঠাকুর একদিন জানতে চাইলেন। ‘আচ্ছা দোলন, তুই আমাকে ‘লালমামা’ ডাকিস কেন?’

দোলন হাসল। তার হাসি ভারি মিষ্টি। হাসলে যেন চেহারা থেকে সুন্দর একটা আলো বেরোয়। বলল, ‘তোমার গায়ের রং শুধু কাঁচা হলুদের মতো ফর্সাই না, তোমার গায়ের রঙে লালচে একটা আভা আছে। এরকম আভা আমি কাউর শরীরে কোনোদিন দেখি নাই। এইজন্য তোমাকে আমি ‘লালমামা’ ডাকি।’

ঠাকুর হেসেছিলেন। কথা বলেননি।

এই বাড়িতে এসে মুখচোরা দোলন তেমন মুখচোরা আর থাকেনি। পাখির মতো মিষ্টি সুরে কথা বলে। এই এদিকে ছুটে যাচ্ছে, এই ওদিকে ছুটে যাচ্ছে। ডাসা পেয়ারা ছিঁড়ে এনে কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। আমের দিনে কাঁচা আম কাঁসুন্দি দিয়ে মাখিয়ে খাচ্ছে। কলা দিয়ে দুধভাত তার খুব প্রিয়। রোজ রাতেই তা খাচ্ছে। বছরখানেকের মধ্যে দোলন একেবারে অন্য দোলন। অন্য মেয়ে। অন্য মানুষ। যেন তার কোনোদিন কোনো বাবা ছিল না। মা ছিল না। রাধিকা মাসি ছিল না। হরিপদ সাহার বাড়ির অবহেলার জীবন ছিল না। নারায়ণী ঝি নামে কাউকে সে চিনতই না। তার আসলে যেন কোনো অতীতই ছিল না। সে যেন জন্মেছেই দেবু ঠাকুরের বাড়িতে। তার জন্মই যেন হয়েছে যখন তার সতেরো বছর বয়স।

দোলন বলতে অজ্ঞান ঠাকুর। লালমামা বলতে অজ্ঞান দোলন। দেবু ঠাকুরের বাড়িতে শুরু হয়েছিল দুজন অসম বয়সী মানুষের পরস্পরের প্রতি অভূতপূর্ব এক টান। মায়া। মমতা। স্নেহ। ভালোবাসা। গভীর ভালোবাসা। গভীরতর ভালোবাসা। দুজন মানুষের পৃথিবী এই দুজন। দুজন মানুষের ডুবে থাকা এই দুজনে। কোথাও আর কিছু নেই। আর কেউ নেই।

আজকের এই বৃষ্টিমুখর রাতে দোলনের 888sport sign up bonus ঘুমাতেই দিলো না ঠাকুরকে।

কেন যে এতকাল পর দোলন আবার ফিরে এলো তাঁর কাছে?

শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা রাত।

প্রখর জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে দেশগ্রাম। চরাচর। আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। পদ্মার দিক থেকে হু-হু করে আসছে হাওয়া। গাছপালা উতলা হয়েছে সেই হাওয়ায়। পাতারা শিশুর মতো নাচানাচি করছে। তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে জ্যোৎস্না যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।

মধ্যরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করেছেন দরবেশ খাঁ। এখন তাঁর ঘুমিয়ে পড়ার সময়। তাঁর ঘুম এলো না। তিনি ঘর থেকে বেরোলেন। তাঁর পিছন পিছন বেরোল মায়া।

উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন খাঁ সাহেব। মায়া আছে পায়ের কাছে। মনের ভেতরে তখন অনির্বচনীয় এক আনন্দ উপলব্ধি করলেন তিনি। মন একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল তাঁর। বহু বছর পর এরকম অনুভূতি হলো। সেই যে হিমালয়ের পাদদেশে দিনগুলো কাটিয়েছিলেন, সেই সময়কার এক রাতের কথা মনে এলো। বসন্তকাল। ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত। সেই রাতে তিনি দেখেছিলেন হিমালয় যেন অন্য এক পৃথিবী। সেই পৃথিবীকে আল্লাহপাক অপূর্ব এক আলোয় ভরে দিয়েছেন। ওরকম আলোয় পৃথিবী পবিত্র থেকে পবিত্রতর হয়ে ওঠে। এক জীবনে ওরকম আলো এক-দুবারের বেশি দেখতে পায় না মানুষ। তা-ও পরম করুণাময়ের সান্নিধ্যলাভের আশায় মগ্ন হওয়া মানুষ ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এই আলো দেখা সম্ভব নয়।

আজ যেন সেরকম এক আলো ফুটেছে আল্লাহপাকের

পৃথিবীতে। এই আলোয় যেন ধুয়ে যাচ্ছে জগতের সব কালিমা।

খাঁ সাহেব ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আল্লাহর ঘোরে মগ্ন তিনি। সেই ঘোরের মধ্যেই নৌকায় চড়লেন। আজ আর লগি নিলেন না। বইঠা হাতে নিলেন। মায়া এসে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে পাটাতনের ওপর আধশোয়া হলো।

খাঁ সাহেব নৌকা বেয়ে চলেছেন। কোন দিকে যাচ্ছেন, জানেন না। নৌকা বেয়ে চলেছেন। জগৎ-সংসার ডুবে আছে পবিত্র আলোয়। কোথাও কোনো শব্দ নেই। রাতের কীটপতঙ্গরা ডাকে না। ঝিঁঝিঁরা ডাকে না। পানির তলার মাছ শ্বাস ফেলতে ওঠে না। রাতপাখিরা ওড়ে না। ডাকাডাকি করে না। গৃহস্থবাড়িতে ঘেউ দেয় না কুকুর। শিয়ালেরা স্তব্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে। হঠাৎ জেগে ওঠা শিশুরা কাঁদে না। মানুষ নিঃসাড়।

এ যেন এক অন্য পৃথিবী। আল্লাহপাকের অন্য জগৎ। এই জগতের ভেতর দিয়ে আল্লাহর এক নেক বান্দা তাঁর ডিঙি নৌকাখানি বেয়ে যান। কোথায় যান, জানেন না। কোন দিকে যান, জানেন না। নৌকা বেয়ে যান। বেয়ে যান।

রাত কত হলো? তা তিনি জানেন না। তিনি আছেন আল্লাহর ঘোরে।

একসময় দরবেশ খাঁ দেখেন বিস্তীর্ণ এক জলাভূমিতে তাঁর নৌকা স্থির হয়ে আছে। চারদিকের গ্রামগুলো দূরে আবছায়ার মতো। জলাভূমির এদিক-ওদিক গলা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আমন ধানের ডগা। চাঁদের আলোয় অচেনা সবুজ রূপ তাদের। হাওয়া বয়ে যায় হাওয়ার মতো। সাত আসমানের প্রথম আসমানটি যেন অনেকটা নেমে এসেছে জলাভূমির ওপর। দরবেশ খাঁয়ের নৌকার ওপর যেন পড়েছে চাঁদের একটুখানি বেশি আলো। প্রখর আলো। সে-আলোর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ। আল্লাহ। আল্লাহ।’

সময় কাটতে থাকে সময়ের মতো।

কতক্ষণ এরকম ঘোরের মধ্যে ছিলেন খাঁ সাহেব, তিনি তা জানেন না। ফজর ওয়াক্তের বেশ কিছুক্ষণ আগে আগে হঠাৎই ঘোর যেন কাটে তাঁর। তিনি দেখেন তাঁর নাওয়ের পাশে আরেকটি ডিঙি নাও গায়ে গা লাগিয়ে আছে। তিনি মুখ ফেরালেন। সেই নাওয়ে আসনপিঁড়ি করে বসে আছেন দেবু ঠাকুর। খাঁ সাহেব একটুও চমকালেন না। একটুও অবাক হলেন না। ধীর শান্ত গলায় বললেন, ‘আসছস দেবু?’

দেবু ঠাকুর হাসলেন। ‘হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছি দরবেশ দাদা। আমি জানতাম, আজ রাতে তুমি ঘর থেকে বেরোবে। এমন আলোর রাতে ঘরে তুমি থাকবে না। আমি তো তোমার পিছনেই আছি দরবেশ দাদা। আমি তো জানি তুমি কত ওপরের মানুষ। কত বড় মানুষ। কত বড় সাধক। কত আধ্যাত্মিক শক্তি তোমার। সেই রাতে বলেছি, আজ আবার বলি। আমি তোমাকে আমার মাথার ওপর রেখেছি। তোমার পাশে ছায়ার মতো আছি। তুমি আমাকে ফেলো না দরবেশ দাদা। আমার ধর্ম আলাদা। ধর্ম দিয়ে আমাকে তুমি বিচার কোরো না। মানুষ হিসেবে বিচার কোরো। আমাদের পথ আলাদা; কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা এক। আমাকে তুমি আমার মতো থাকতে দিও। তোমার ওই ‘মায়া’র মতো আমাকে তোমার পায়ের কাছে ঠাঁই দিও।’

খাঁ সাহেব বললেন, ‘তা হলে ওর নামও তুই জানিস?’

‘জানি দরবেশ দাদা। সবই জানি।’

‘মায়াকে দেখছি না কেন? গেল কোথায়? নৌকাতেই তো ছিল?’

‘সে-ও তোমার আমার মতো ঘোরের মধ্যে আছে। নৌকা থেকে নেমে নিজের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তুমি ডাকলেই চলে আসবে।’

খাঁ সাহেব মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন। ‘মায়া। মায়া।’

গলা তোলা ধানডগায় নিবিড় হয়ে আছে চারদিক। সেই নিবিড়তার ভেতর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো মায়া। তার পায়ের তলায় যেন জল বা পানি বলতে কিচ্ছু নেই। যেন সে হেঁটে এলো শক্ত শুকনো মাটির ওপর দিয়ে। কাছাকাছি এসে নিজস্ব ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠল নৌকায়। নামাজের ভঙ্গিতে বসে থাকা খাঁ সাহেবের পায়ের কাছে এসে আধশোয়া হলো।

খাঁ সাহেব মায়ার দিকে একবার তাকালেন। চোখে নির্বিকার দৃষ্টি।

চাঁদ পশ্চিমে হেলেছে। যেন একটু বেশি চলে এসেছে দুজন মানুষ আর মায়ার মাথার কাছে। স্টিমারের সার্চলাইটের মতো পশ্চিম থেকে জ্যোৎস্না ফেলা হয়েছে নৌকা দুটোর ওপর। দুজন মানুষ ও মায়ার ওপর।

চাঁদের আলো কি আগের মতোই? নাকি আগের চেয়েও প্রখর? নাকি আগের চেয়েও উজ্জ্বল?

মানুষ দুজন একই সঙ্গে আকাশের দিকে তাকালেন। দুজন দু-রূপে দেখতে পেলেন আলো। দেবু ঠাকুর দেখেন ভগবান তাঁর অপার্থিব এক আলোয় জগৎ-সংসার ভরিয়ে দিয়েছেন। এই আলোর ছোঁয়ায় মানুষের মনে কোনো পাপচিন্তা থাকে না। মানুষ মানুষে থাকে না কোনো বিভেদ। মানুষ হয়ে ওঠে সত্যিকারের মানুষ।

দরবেশ খাঁ দেখেন পরম করুণাময় মহান আল্লাহপাক সাত আসমানের ওপর থেকে তাঁর সৃষ্ট আসমান জমিন চরাচর ধুয়ে পবিত্র করে দিচ্ছেন তাঁর পাঠানো অসামান্য আলোয়। এই আলো মানুষকে সম্পূর্ণ মানুষ হওয়ার পথ দেখায়। মানুষের মন থেকে মুছে দেয় সব কালিমা। মনের ভেতরকার অন্ধকার ঘুচিয়ে দেয় চিরকালের তরে।

হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়। এ এক অদ্ভুত বৃষ্টি। আকাশের কোথাও নেই একটুও মেঘের চিহ্ন। চাঁদের আলো একটুও মøান হয়নি। সেই আলোর ভেতর ঝরছে অপূর্ব বৃষ্টি। এ যেন এক অচেনা বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি বুঝি আজ রাতের আগে কখনো হয়নি পৃথিবীতে। আসমান থেকে নেমে আসা লক্ষ কোটি বৃষ্টির ফোঁটা যেন মুক্তোদানার মতো ঝরে পড়ছে চারদিকে। আলোর বন্যার ভেতর বৃষ্টি!

দেবু ঠাকুর দেখেন, জলের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা লাফালাফি করছে। অপূর্ব চাঁদের আলোয় এই দৃশ্য অতুলনীয়। জীবনে একবারের বেশি এরকম দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয় না মানুষের।

দরবেশ খাঁ দেখেন, পানির ফোঁটা ঝরে ঝরে পড়ছে পানির ওপর। অপূর্ব চাঁদের আলোয় এই দৃশ্য অতুলনীয়। জীবনে একবারের বেশি এরকম দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয় না মানুষের।

দেবু ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মনে হয়, ভগবানের লীলা। সবই ভগবানের লীলা।

দরবেশ খাঁ তাকিয়ে থাকেন আল্লাহর প্রেমে সম্পূর্ণ মগ্ন হওয়া মানুষের দৃষ্টিতে। তাঁর মনে হয়, এ হচ্ছে পরম করুণাময় মহান আল্লাহপাকের কুদরত। তাঁর কুদরত অপরিসীম। এরকম জ্যোৎস্নায় এরকম বৃষ্টি! আল্লাহ। আল্লাহ। আল্লাহ। সবই আল্লাহর কুদরত। তাঁর কৃপা। দয়া।

দুই নৌকায় বসা দুজন মানুষ চাঁদের আলোয় ভিজতে থাকেন। বৃষ্টিতে ভিজতে থাকেন। মুহূর্তে যেন পেরিয়ে যাচ্ছেন অনন্তকাল। [চলবে]